উজান যাত্রা (Ujan Jatra) : যাত্রা শুরু
ভোরবেলা ইস্পাতে যাচ্ছি আমরা— আমরা চারজন— কস্তুরীদি, মিঠু, শিখরিণী ও আমি। গতকাল সকালে কস্তুরীদি খুব রহস্যময় ব্যবহার করছিলেন। দেখি ওঁর ক্যারি-অনটা গোছাচ্ছেন।— কী ব্যাপার দিদি, ফিরে চললেন?
প্রথমে জবাবই দেন না। তারপরে যখন মুখ তুললেন, দেখি মুখ থমথম করছে, বললেন, ফিরে যেতে তো আসতে চাইনি!
—তবে কোথায় চললেন?
—আমাকে একটু পশ্চিমবঙো বর্ডারে ঘুরতে হবে। কিছু খুঁজচি।
—তা বলবেন তো!
—তোমাকে বলব কেনো?
—কেননা, নিতাইদা আমার ওপর আপনার দেখাশোনার ভার দিয়েছেন।
—তো দেকাশোনা তো করলে। মাতায় জল, ওষুদ, গর্ম সুপ, রাত থাকা কিচু তো বাদ নেই।
—আপনি যদি আমদাবাদ, আপনার নিজের জায়গা ছাড়া আর কোথাও যেতে চান, আমাকে আপনার সঙ্গী হতে হবে দিদি। আপনাকে আমি একা ছেড়ে দিতে পারি না।
—কোতোবার বলবো এ-ও আমার নিজের জায়গা! জায়গা দিবে না, না কী! নিজের জায়গা পোরের জায়গা এ সোব কী! একটা এডুকেটেড ইয়াং ইন্ডিয়ান তো তুমি! না কী!
—ঠিক, দিদি— এ আপনারও নিজের জায়গা। কিন্তু সব কিছুর তো একটা পরিপ্রেক্ষিত থাকে।
—শোক্ত কোথা বলবে না।— অর্থাৎ ‘পরিপ্রেক্ষিত’ উনি বোঝেননি, এবং ওঁর মুড খারাপ।
একটু পরে, আমার দৃঢ় মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপাতত জাড়গ্রাম যাব। শোক্তো কিচু? ইস্পাত ধরব চলে যাব।
—ঝাড়গ্রাম!!!
—কেনো। পাণ্ডবরা যায়নি নাকি? টিক আচে যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন না গেলো, আমি যাব।
—না, তা নয়। আমাকে যেতে হবে। ঝাড়গ্রাম কেন বুঝতে পারছিলাম না।
সোব বুঝা সোজা নয়।
খুব মন্থর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির মুখে দাঁড়ালাম। মিঠুকে ফোন করলাম কাল সকালের ইস্পাত ধরে ঝাড়গ্রাম যাচ্ছেন দিদি। বেজায় চটেছেন— কেন জানি না। তোর যাওয়া উচিত, নিতাইদাকে এক্সপ্ল্যানেশন তোকেও দিতে হবে। চট করে চলে আয়। আর শিখরিণীকে একটা ফোন করে জানিয়ে দে। আমাকে বলেছিল সব প্রোগ্রাম জানাতে।
—তুই-ই দে না।
—অসুবিধে আছে। কনজারভেটিভ ফ্যামিলি। কাজিয়া আমার ভাল লাগে না।
আধ ঘণ্টার মধ্যে মিঠু এসে পড়ল। অসম্ভব ফাস্ট। সবসময়ে এক পায়ে খাড়া। ওকে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।
—তুমি! তুমিও যাবে!
—হ্যাঁ দিদি, যতদিন পারি আপনার সঙ্গে সঙ্গে থাকতে দিন। আমার ভাল লাগছে।
সস্নেহে তার কাঁধে হাত রাখলেন দিদি।— টিক আচে। তুমি যতদিন আমার সঙে থাকতে চাও, থাকবে। কিন্তু কোস্টো হোবে!
—কী যে বলেন দিদি! আমি এন সি. সি করেছি, মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স নিয়েছি। দার্জিলিং থেকে সন্দকফু ট্রেকিং করেছি, তখন আমি কলেজও পেরোইনি।
বোলো কী? তুমার এতো বীর তা তো বুজিনি!
অর্থাৎ মিঠু চট করে পেয়ে গেল অনুমতিটা, যার জন্যে আমাকে যথেষ্ট কসরত করতে হয়েছে। মিঠুর অ্যাপ্রোচ আলাদা। সাংঘাতিক পাবলিক রিলেশনস সেন্স।
আমি টিকিট করতে যাচ্ছি, দেরি হতে পারে। ভাববেন না।— বললাম, চলে আসছি, মোবাইলটা বাজল।
মিঠু বলল, ধর, ওটা শিখরিণীর।
তাই তো দেখছি। শিখরিণী বলল, আমিও যাচ্ছি। আমার একটা টিকিট যেন থাকে।
বললাম— দিদিকে দিচ্ছি।
উনি বলছেন শুনছি— না না। তুমি পারবে না। কোষ্টো হোবে। এন সি. সি. করেচো? মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স নিয়েচো? সন্দকফু ট্রেকিং করেচো? আমি আর মিঠু ওঁর কথা শুনে হাসছি।
হাসিহাসি মুখেই বললেন, বেশ, রাজকন্যের যকন দেশ দেখার সাদ হয়েচে তো দেকবে। কিন্তু বিপদের জন্য রেডি থাকতে হোবে।
মোবাইলটা হাত দিয়ে চাপা দিয়ে বললেন, কাজল, দিস আই ডোন্ট লাইক। এতো জন গেলে আমার কাজটা না হোতে পারে। তারপোর ওতো সুন্দরী মেয়ের দায় নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ডিসকারেজ হার। দিদিমোণি!
মিঠু বলল, আমি পারব না দিদি। কাজলকে দিন।
মোবাইলটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিলেন উনি। কী আর করি! বললুম, শিখরিণী প্রবলেমটা বোঝো। বুঝতে চেষ্টা করো। এ একরকম নিরুদ্দেশযাত্রা। দিদি কোথায় কোথায় যাবেন, নিজেই ভাল করে জানেন না। তোমার মতো সুন্দরী মেয়েকে এরকম যাত্রায় নিতে উনি ভয় পাচ্ছেন। কানট ব্লেম হার। দেশকাল বড় খারাপ।
—শিখরিণী বলল, কেন তুমি তো আছ?
আমি বলি, আমি আছি ঠিকই। কিন্তু আমার সব শক্তি যদি তোমাকে প্রোটেকশন দিতেই চলে যায়, আমার আসল দায়িত্বটা পালন করব কখন?
—আমি নিজেই নিজেকে প্রোটেক্ট করতে পারব। প্লিজ কাজল, একঘেয়ে জীবনে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। আমাকে একটু চান্স দাও।
ওদের দিকে তাকিয়ে আমি বলি, নাথিং ডুয়িং। ও যাবেই, অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজ।
ঈষৎ বিরক্ত হয়ে দিদি বললেন, ও জানল কী করে?
মিঠু খবর দিয়েছে বোধহয়— অম্লানবদনে আমি বললাম।
মিঠু কটমট করে আমার দিকে তাকাল একবার।
সুতরাং আমরা যাচ্ছি চারজন। দিদি, মিঠু, শিখরিণী ও আমি। শিখরিণী অবশ্য তার নিয়মভঙ্গ করে সালোয়ার কামিজ পরে এসেছে। অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে তৈরি। যাই হোক তবু একটু বুদ্ধিসুদ্ধি আছে। বললাম, একটা কুকরি নিয়েছ?
—কুকরি? কুকরি কেন?
—ওই যে নিজেকে প্রোটেক্ট করবে।
—আমিই সবাইকে প্রোটেক্ট করব— একটু জেদি, গর্বের সুরে বলল ও। এইটা ওর অহঙ্কার আমি লক্ষ করেছি। নেত্রী-নেত্রী ভাব। নেতৃত্ব দেবার জোর ওর ভেতরে সত্যি-সত্যি আছে কিনা যাচাই না করেই ওর এমনি ভাব। মনে মনে হাসি।