ইঁদুর -1
একটা ইঁদুর খাটের তলা থেকে দৌড়ে বেরিয়ে সোজা এসে সুধীনবাবুর ইজিচেয়ারের তলায় ঢুকে গেল।
তালতলার চটি থেকে পা দুটো তাড়াতাড়ি চেয়ারের ওপরে তুললেন তিনি। তুলেই হাঁক দিলেন, দেবেন।
দেবেন ছিল না। থাকে না। কখনোই ও আজকাল সময়মতো থাকে না হাতের কাছে। চেঁচামেচি শুনে শ্যামা দৌড়ে এলো, বলল, কী হলো বাবু?
সুধীনবাবু ওকে দেখে পা দুটো নামিয়ে ফেললেন।
মুখে গাম্ভীর্য এনে বললেন, ইঁদুর।
শ্যামা অনেক দিনের লোক। মা, মানে সুধীনবাবুর স্ত্রী থাকতেই সে দশ বছর এ বাড়িতে কাজ করেছে। সুধীনবাবুর বড় ছেলে এবং মেজ ছেলের বাচ্চারা সবাই শ্যামার হাতেই মানুষ। ওর শরীরে মায়াদয়া আছে। বয়সও হয়েছে। কপালের দুপাশের চুলগুলো সব রুপোলি হয়ে গেছে। নিজেরও গেঁটে বাত ও ডায়াবেটিসের কারণে বাবুর দুঃখ ও একটু একটু বোঝে।
শ্যামা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ইঁদুরই তো! ঘর থেকে যে বাঘ বেরোয়নি এই যথেষ্ট! কী অবস্থা করেছে দেবেন ঘরটার। আর বৌদিদেরও বলিহারি যাই। বুড়ো শ্বশুরের দিকেও তো মানুষ একটু দেখে। নিজেদের ঘরও তেমনই, কী নোংরা; কী নোংরা।
সুধীনবাবু কখনো পরনিন্দা পরচর্চা প্রশ্রয় দেননি। এখনো দেন না। চাপা ধমক দিলেন তিনি শ্যামাকে। বললেন, আঃ শ্যামা। যাও, নিজের কাজ করো। দেবেন এলে পাঠিয়ে দিও আমার কাছে।
শ্যামা গজগজ করতে করতে চলে গেল।
সিঁড়ির কাছে গিয়েই শ্যামা চুপ করে গেল। বৌদিরা কেউ তার বক্তৃতা শুনতে পেলে আর রক্ষা নেই।
সুধীনবাবুর চোখ দুটো ভারী হয়ে এলো। তাঁর আপন বলতে যে একমাত্র মানুষটি ছিল সেই নীহারিকাই চলে গেছেন দু বছর হলো; যদিও নীহারিকা থাকাকালীন তিনি যে তাঁর এতখানি আপন সে-কথা পঁয়তালি্লশ বছরের পার্টনারশিপেও কখনো বুঝতে পারেননি সুধীনবাবু। দাবি করার, জোর খাটানোর, ঝগড়া করার মানুষ ঐ একজনই ছিল।
নীহারিকার ছবির দিকে তাকালেন একবার সুধীনবাবু। বড় ছেলে একটা অয়েল পেইন্টিং করে এনেছে কাকে দিয়ে যেন অনেক পয়সা খরচ করে। বেঁচে থাকাকালীন সপ্তাহে এক দিনও ছেলে মা বলে ডাকেনি, কি মা-বাবার ঘরে আসেনি পর্যন্ত। আর মায়ের মৃত্যুর পর ছবি বাঁধিয়ে এনে ভালোবাসার পরাকাষ্ঠা দেখাচ্ছে!
মেজ ছেলে গত মৃত্যুদিনে কাগজের ফুলের একটা সাদা মালা এনে নীহারিকার ছবির গলায় পরিয়ে দিয়েছিল। এখন সে সাদা কাগজের ফুলের চেহারা হয়ে গেছে প্রায় রুদ্রাক্ষের মতো। এত ধুলো পড়েছে যে ছবি তো দূরের কথা, মালাটাতেও হাত ছোঁয়ানো যায় না। মানুষটা চলে গেছে বলে কী কাগজের মালা পরিয়ে তাকে অবহেলা করতে হয় এমন করে? ছেলে-বৌরা কি রোজ একটা করে সাদা ফুলের মালাও নীহারিকার গলায় পরাতে পারে না? যে তাদের স্তন্যদায়িনী, যে কোলে-কাঁখে করে মানুষ করল, যে সারা জীবনে এক দিনও স্বামীর সঙ্গে সিনেমা দেখতে গেল না পাছে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার ক্ষতি হয়; সেই মানুষটাকে? জন্মদাত্রী, পরম শুভার্থী মাকেও ওরা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেল? ভেবে বড়ই কষ্ট পান সুধীনবাবু।
দেবেন এলো। বলল, ডাকছিলেন?
সুধীনবাবুর কথা বলতে ইচ্ছে করল না। মুখে শুধু বললেন, ইঁদুর।
দেবেন ঘরে আসার আগেই শ্যামার মুখে শুনেছিল। বলল, আজ ইঁদুরের বিষ আনব। মজা টের পাবেন বাছাধনরা।
সুধীনবাবু আস্তে আস্তে বললেন, ঘরে ইঁদুরের চাষ করে তারপর বিষ দিয়ে মারা কেন? চাষটা বন্ধ করো না ঘরে।
তারপর বললেন, প্রিভেনশান ইজ বেটার দ্যান কিওর।
সুধীনবাবু অভ্যেস বশেই বলে ফেললেন ইংরেজি। দেবেন ইংরেজিটা বুঝতে পারল না। বলল, ঝাড়ব ঘর। একা লোক চারদিকের কাজ সামলাতে পারি না। এই বড়দা ডাকল সিগারেট আনতে, মেজদা ডাকল পান আনতে, তাও তো ছোড়দারা এ বাড়িতে থাকে না। বাঁচোয়া। বৌদিরাও কি কম ডাকাডাকি করে? শুধু আপনার একার কাজ করলে না হয় এসব ঠিক ঠিক করে রাখতাম।
এসব কথাতে সুধীনবাবু আজকাল সত্যিই বিরক্ত হন। এসব কথা শুনতে বা আলোচনা করতেও চান না তিনি। তাঁর একার কাজের জন্যে তো দেবেনকে অথবা বাড়ির কাউকেই রাখা হয়নি। তাই এসব কথা কোনো ছেলে বৌয়ের কানে গেলে মিছিমিছি অশান্তিই বাড়বে। যত দিন নীহারিকা ছিল, তখন অন্য কথা। আজ তার এই অবসরপ্রাপ্ত, কর্মহীন, অপ্রয়োজনীয় জীবনে এই রকম তুচ্ছ বিষয় নিয়ে অশান্তি ভালো লাগে না। একা ঘরে ইজিচেয়ারে বসে যতই অনাদর-অবহেলা পান, ততই যেন অসহায়তায় চোখের কোল দুটো জ্বালা করে। নীহারিকার কথা মনে পড়ে।
এই বয়সে সকলেই একটু দেব-দেবী গুরুটুরুর দিকে ঝোঁকে। সুধীনবাবুর ঐসব দুর্বলতা কখনো ছিল না। সুধীনবাবুর ধারণা যে যারা জীবনে অনেকানেক অন্যায় করে তারাই শেষ জীবনে হঠাৎ ঠাকুর দেবতার শ্রীচরণে হুমড়ি খেয়ে পড়ে পাপক্ষালন করতে চায়। না, সুধীনবাবু যৌবনেও ওসব করেননি; বার্ধক্যেও করবেন না।
সবচেয়ে মুশকিল হয় সময় নিয়ে। সময়ের ভার বড় ভার। যাঁরা বেশি বয়সে স্বামী হারান, তাঁরা এতটা একা হয়ে পড়েন না। কারণ বিধবাদের পক্ষে সংসারের মধ্যে অনেকখানি সময় আদরেই হোক কি অনাদরেই হোক, কেটে যায়ই। কিন্তু বিপত্নীক পুরুষ মানুষ সত্যিই বড় নির্জন। সময় তাঁদের বুকে পাথরের মতো চেপে বসে। কিছুতেই নড়তে চায় না। বই পড়ে সময় কাটাতেন আগে, কিন্তু এখন চোখও বিদ্রোহ করছে। দুটি চোখেই ছানি পড়েছে অথচ ম্যাচিওর করেনি যে কাটাবেন। সন্ধের পর টিভি দেখে সময় কাটে। তবু শনি-রবিবার বাংলা-হিন্দি সিনেমা যখন হয়, তখন আজকাল আর দেখেন না। ছেলে বৌরা বন্ধুবান্ধব নিয়ে জমিয়ে বসে সিনেমা দেখে। তাই হংসমধ্যে বকযথা হয়ে থাকতে খারাপ লাগে তার। একদিন আড়াল থেকে শুনেছিলেন, বড় বৌ বলছিলেন কাউকে। ‘বুড়োর রস কম নয়।’
এসব শুনেও গায়ে মাখেন না বিশেষ সুধীনবাবু। মাখেন না, এই কারণে যে এ বাড়িটা তাঁর, তাঁর বাড়িতেই ছেলে-বৌ-নাতি-পুতিরা রয়েছে। এই বাজারে আলাদা আলাদা বাড়ি নিয়ে থাকতে হলে প্রত্যেকেই বুঝত। বড় সরকারি চাকরি করতেন বলে এখনো মাসে হাজার টাকা করে পেনশন পান উনি। তা ছাড়া ফিঙ্ড ডিপোজিটের সুদও আছে। নিজের কোনো ব্যাপারে তিনি পরের মুখাপেক্ষী ননই, উপরন্তু তিনি ছেলেদের সংসারে প্রতি মাসে নিজের সামর্থ্যের প্রায় সবটাই ঢেলে দেন। এ কারণেই আর্থিক বিষয়ে কোনো রকম মানসিক দৈন্য কখনো বোধ করেননি। যতটুকু অবহেলা পান সুধীনবাবু, তা নিছক জেনারেশন গ্যাপ এবং নীহারিকার স্বার্থপরের মতো আগে চলে যাওয়ার দোষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত থাকেন।
টেলিফোনটা বাজছিল। টেলিফোনটা নিচের বসার ঘরে আছে। ওঁর ঘরে একটা এঙ্টেনশন আছে। টেলিফোনটা বেজেই চলল অথচ কেউই ধরছে না। দেবেনটাই বা কোথায় গেল?
যখন কেউ ধরল না, তখন অগত্যা নিজেই উঠলেন। কোমরটা কনকন করে উঠল। ধীরে ধীরে গিয়ে রিসিভারটা তুললেন। ওপাশ থেকে মিষ্টির গলা ভেসে এলো।
কে—এ—এ? দাদু?
সুধীনবাবুর মুখ-চোখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, হ্যাঁ দাদু। তোমার কী খবর?
—ভালো। ওপাশ থেকে পাঁচ বছরের মিষ্টি বলল।
—তুমি কবে আসবে আমাদের বাড়ি?
—আসব না। আড়ি তোমার সঙ্গে।
সুধীনবাবু উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, কেন? কেন? আড়ি কেন? কী করেছি আমি?
—তুমি আমাকে রথ কিনে দিলে না কেন? আজ না রথ! আমাদের বাড়ির দোতলার মিঠুকে ওর দিদা কিনে দিয়েছে। পাশের বাড়ির বুজুকে ওর বাবা কিনে দিয়েছে। আমাকে কেউ কিনে দিল না।
সুধীনবাবু বললেন, ঠিকই তো। বড্ড ভুল হয়ে গেছে তো! ভেরি সরি। তোমাকে কালই কিনে দেব।
মিষ্টি বলল, কাল কিনলে কি হবে? রথ তো আজ হয়েই গেল।
তাতে কী? উল্টোরথের দিন টানবে।
—আচ্ছা। আশ্বস্ত হয়ে বলল মিষ্টি।
তোমার মা-বাবা কোথায়?
—পার্টিতে গেছে।
—তুমি একা আছ?
—না, বেলাদি আছে।
—তুমি খেয়েছ?
—না, খাব।
—কী খাবে?
—এই ভাত, পেঁপের তরকারি, আমার তো শরীর ভালো না। ও জানো দাদু, দাদু; আজ না কাঁচকলার ঝুরি করবে রঘুদাদা। ঝুরি খেতে কি ভালো, না?
—হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ভালো।
আজ থেকে দশ বছর আগে হলে এই কথার উত্তরে সুধীনবাবু হয়তো বলতেন, খুব ভালো। ঝুরি, ঝুড়ি ঝুড়ি খেতে ভালো।
তখন কত সহজে রসিকতা করতে পারতেন। কত আনন্দ ছিল মনে। আজকাল নিজের সবচেয়ে প্রিয় ছোট্ট একমাত্র নাতনির সঙ্গেও রসিকতা করেন না তিনি।
তারপর বললেন, শোনো, আমি এক্ষুনি মেলায় যাচ্ছি তোমার জন্যে রথ কিনতে। তুমি কি আসবে এখানে? মেলায় যাবে আমার সঙ্গে?
—এখন? এখন কি করে যাব? এখন তো খাব। মা বকবে এখন গেলে। কার সঙ্গে যাব?
—ঠিক আছে।
তারপর বললেন, আজ রথ, তুমি পাঁপর ভাজা খেয়েছিলে?
—পাঁপর ভাজা? না তো। রথের দিনে বুঝি পাঁপর ভাজা খেতে হয়?
—হয় তো। আমরা তো তাই-ই খেতাম ছোটবেলায়। তোমার দিদা থাকতেও। এবারে খাইনি।
—মা পাঁপর ভাজা খেলে রাগ করে। বলে, পেট আপসেট করবে।
—ও—ও। না, না। তাহলে খেও না।
রেখেদি? মিষ্টি গলায় বলল।
আচ্ছা।
নাতনি রিসিভার নামিয়ে রাখল।
সুধীনবাবু ডাকলেন, দেবেন।
সাড়া নেই। আবারও ডাকলেন, দেবেন, অ্যাই দেবেন।
সাড়া নেই।
ঠাকুর সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল ওপরে। বলল, দেবেনের সঙ্গে তো আমার রাস্তায় দেখা হলো, বাবু। দেবেন তো ঋষির দোকানে গেল—বৌদিদের জন্যে ভেলপুরি কিনতে। আর দই-বড়া।
ড্রাইভারকে ডাকো তো ঠাকুর। সে কি আছে? না চলে গেছে।
ড্রাইভার তো বড়দাকে নিয়ে বেরোল, বলছিল নাখুদা মসজিদের কাছে যাবে। রয়্যাল না কী হোটেল আছে, সেখান থেকে বিরিয়ানি পোলাউ আনবে। বড়দার সম্বন্ধীরা খেতে আসছেন।
—ঠিক আছে। বললেন সুধীনবাবু।
তারপর আস্তে আস্তে ধুতিটা পরলেন। আলমারি খুলে হ্যাঙার থেকে এন্ডির পাঞ্জাবিটা বের করলেন। ছাতাটা নিলেন। তারপর সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলেন। আজকাল তিনি বাড়ি থেকে বেরোলে কোথায় যাচ্ছেন, কখন ফিরবেন এবং আদৌ ফিরবেন কি না তা জিজ্ঞেস করার লোক কেউ নেই। উনি ভাবেন, ভালোই হয়েছে। একেবারে মুক্তপুরুষ।
মেজ বৌ বসবার ঘরে বসেছিল। বলল, গাড়ি তো দাদা নিয়ে গেছেন, গাড়ি ছাড়াই বেরোচ্ছেন, বাবা?
—হ্যাঁ।
মেজ বৌও আর কিছু বলল না, সুধীনবাবুও না।
সুধীনবাবু বুঝলেন যে মেজ বৌয়ের তাঁর সম্বন্ধে যত না মাথাব্যথা, দাদাই যে গাড়িটা বেশি ব্যবহার করে এ কথাটা তাঁকে জানানোর উৎসাহই তার চেয়ে অনেক বেশি।
টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল সকাল থেকে। তখনো পড়ছিল। ছাতাটা খুললেন তিনি। রথের দিনে প্রতিবছরই বৃষ্টি হয়। সারা পথ কাদা প্যাচ প্যাচ করছে। হাঁটুতে এতই ব্যথা যে পদ্মপুকুর হেঁটে যাওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব। মোড়ে এসে রিকশা নিলেন। তারপর মেলায় পৌঁছে একটা রথ কিনলেন সাড়ে চার টাকা দিয়ে। জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার কাঠের মূর্তিও কিনলেন।
ফেরার সময় একটা মিনিবাস আস্তে করে ধাক্কা দিল রিকশাটাকে। একটু হলে তিনি ও রিকশাওয়ালা দুজনেই পড়ে যেতেন। কিন্তু পড়লেন না। রিকশায় চড়া মানেই লোকের কাঁধে চড়া। যৌবনে কখনো সে জন্যে রিকশায় চড়েননি তিনি। কিন্তু এখন নিজের পায়ের ওপর আর কোনো জোর নেই বলে পরস্কন্ধারূঢ় হন নিরুপায়েই।
গাড়িটাও তাঁর নিজেরই। যেবার প্রথম ওভারহেড ভাল্বের অ্যাম্বাসাডর বেরোল, সেবার কিনেছিলেন। আজ অনেক বছর হলো। কন্ডিশন এখনো ভালোই আছে। এক হাতের গাড়ি ছিল। এখন ছেলেরাই চড়ে। ওরাই চাঁদা করে ড্রাইভার রেখেছে। ছেলেরা অবশ্য বলে, বাবা, যখনই আপনার দরকার একটু আগে বলে দেবেন, গাড়ি নিয়েই বেরোবেন। কিন্তু নিজের গাড়ি নিয়ে বেরোতে হলে পাঁচ দিন আগে থেকে অন্যদের বলাবলি তাঁর পছন্দ হয় না।
তা ছাড়া, যাবেনই বা কোথায়? সত্তর বছরে পৌঁছে সংসারে বন্ধু, হিতাকাঙ্ক্ষী আত্মীয়-পরিজনের স্বরূপ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন তিনি। যত দিন বড় সরকারি চাকরিতে ছিলেন, প্রভাব-প্রতিপত্তি, বেকারদের চাকরি করে দেওয়ার ক্ষমতা এ সমস্ত বিদ্যমান ছিল, তত দিন তাঁর কাছে লোকের ভিড়ের অভাব হয়নি। বন্ধুরা এসেছে দলে দলে। আজকে সারা দিনে দুটো কথা বলার লোকও পান না একজনও। তাই গাড়ির প্রয়োজন তার মিটেই গেছে। যখন দরকার হয় তখন এমন হঠাৎ হঠাৎই দরকার হয়। আগে বলবার সময় কোথায় পান?
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই প্রতিবেশী জগবন্ধুবাবুর সঙ্গে দেখা। ময়দার কল আছে ভদ্রলোকের। হাসিখুশি মোটাসোটা আমুদে মানুষ। বয়সে সুধীনবাবুর চেয়ে বছর চার-পাঁচের ছোট। তিনি গাড়ি থামিয়ে দুটো কথা বলে নিলেন। বললেন, কী খবর বড় সাহেবের? গেছিলেন কোথায়? রিকশা কেন? গাড়ি কী হলো?
সুধীনবাবু হাসলেন। গাড়ির কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বললেন, এই রথের মেলায়। কাছাকাছিই। ওহো তাই তো! রথ দেখছি যে! তা পেঁয়াজি-ফুলুরি খেলেন?
সুধীনবাবু হাসলেন। বললেন, অম্বল।
কিসের অম্বল? ইয়াং ম্যান। জগবন্ধুবাবু বললেন।
তারপর বললেন, চলুন চলুন আমার বাড়ি। আপনাকে দেখে যদি আমার গৃহিণী গালাগালি থেকে ক্ষান্ত হয়। আজ বড় দেরি হয়ে গেল ফিরতে। ওকে নিয়ে এক জায়গায় যাওয়ার ছিল। চলুন। আপনার সুন্দর মুখ দেখলেই রাগ পড়ে যাবে।
সুধীনবাবু হাসলেন। আজকাল যেমন নিজে রসিকতা করতে পারেন না। অন্য কেউ করলেও ভালো লাগে না।
বললেন, আজ ছেড়ে দিন।
তার পরই বলতে গেলেন; শুনুন! স্ত্রীকে অমন হেলাফেলা করবেন না। স্ত্রী যে কী জিনিস, চলে গেলে বুঝবেন। কিন্তু কথাটা আর বলবেন না। ভাবলেন, তিনি নিজেও বুঝতেন না কী জিনিস স্ত্রী, নীহারিকা থাকতে। ভাবলেন, স্ত্রীর কথা ওঠালে জগবন্ধুবাবু ভাবতে পারেন যে দাঁত চলে যাওয়ায় দাঁতের কদর বুঝেছে বুড়ো। হাঃ হাঃ।
রিকশাওয়ালাকে বিদায় দিয়ে রথটা নিয়ে বাড়ি ঢুকতে গিয়ে দেখলেন, বড় দুটো রথ সুন্দর করে সাজিয়ে-টাজিয়ে তার বড় ছেলের ও মেজ ছেলের পুত্ররা টানাটানি করছে।
সুধীনবাবু বললেন, রথ? এ কী, রথ কোথায় পেলি?
বারে! বাবা কিনে দিয়েছে। বাবা কিনে দিয়েছে।
শান্টু বলল, দাদু ঐ রথটা আমাকে দাও।
সুধীন গম্ভীর মুখে বললেন, না। এটা মিষ্টির।
বলেই ওপরে চলে গেলেন আস্তে আস্তে। দেবেন এসে ভিজে ছাতাটা নিল।
জামাকাপড় ছাড়তে ছাড়তে সুধীনবাবু খুব দুঃখিত হলেন। যা ভেবেছিলেন, তার কিছুই হলো না। ভেবেছিলেন, ছেলেরা সব এক বাড়িতেই থাকবে। জমজমাট সংসার। নীহারিকার ফরসা, লক্ষ্মীশ্রীসম্পন্ন চেহারাটা মনে পড়ল। চওড়া লাল পেড়ে শাড়ি। চাবির গোছা আঁচলে। বৌরা ঘিরে রয়েছে। ছেলেদের ভাব গলায় গলায়। মা-বাবা, ছেলে-বৌ।
কিছুই হলো না।
ছোট ছেলে দীপু পড়াশোনায় সবচেয়ে খারাপ ছিল। ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় কখনোই তেমন ভালো করেনি। কিন্তু জীবনের পরীক্ষাতে ঐ সবচেয়ে সফল হলো। সাহেবি কম্পানিতে সামান্য সেলসম্যানের চাকরিতে ঢুকে দেখতে দেখতে মার্কেটিং ম্যানেজার হলো। কম্পানির ফ্ল্যাট, কম্পানির গাড়ি। দীপুর বৌ শিখা বোম্বের মেয়ে। ওর বাবা ছিলেন এক মার্কেন্টাইল ফার্মের বড় কর্তা। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। সাহেবি ধরনের মানুষ। তার পক্ষে এই বাড়িতে পাঁচমিশালি রুচির মধ্যে থাকা সম্ভব হলো না। মিষ্টিটাকে বড়ই মিস করেন সুধীনবাবু। আর কী যে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ও। নীহারিকার বড়ই প্রিয় ছিল এই নাতনি।
আসলের চেয়ে সুদ যে বড়, এ কথা যাদের সুদ নেই তারা জানে না।
আজকাল দীপু ও শিখার সঙ্গেও দেখা হয় না বেশি। সপ্তাহে এক দিন করে আসে। অবশ্য ফোন করে খোঁজখবর নেয় মাঝেমধ্যে। রান্না করে এটা-ওটা পাঠায়। কিন্তু মিষ্টির জন্যেই মনটা হু হু করে সুধীনবাবুর। নীহারিকা চলে যাওয়ার পর মিষ্টি ওদের নতুন ফ্ল্যাটে উঠে যাওয়ায় দ্বিতীয়বার ধাক্কা খেয়েছিলেন তিনি। পুরোপুরি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন।
যখন দীপু চলে গেছিল, খুব রাগ হয়েছিল সুধীনবাবুর। কিন্তু এখন মনে হয় যে তাঁর প্রজন্মের মানুষদের পক্ষে, সমস্ত পৃথিবীজুড়ে যে যৌথ পরিবারের ভাঙন আরম্ভ হয়েছে, তা রোধ করা সম্ভব নয়। আলাদা থাকা একেক সময় ভালো বলেও মনে হয়। তাতে সম্পর্ক বোধ হয় ভালো থাকে। যদি প্রত্যেকের রুচি, রোজগার, শিক্ষা এসব একরকম না হয়, তাহলে জোর করে একসঙ্গে থেকে বাইরের লোককে সুখের বন্যা দেখানো হয় বটে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে পায়ের তলায় মাটি সরতে থাকে। কেউ অত্যাচার করে, কেউ অত্যাচারিত হয়। যার রোজগার বেশি এবং যার কম তাদের দুজনেরই দুরকম কমপ্লেঙ্ জন্মায়। সেটা প্রত্যেকেরই জীবন উপভোগের পথে বাধাস্বরূপ। সুধীনবাবু আর নীহারিকা সবাইকে নিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন জড়িয়ে। কিন্তু তিনি নিজের জীবনেও দেখেছেন। যৌথ পরিবারে কেউ ঠকে; কেউ ঠকায়। কেউ অন্যায় করে; কেউ তা সয়ে যায়। যে ভালো, তাকে বোকা ভাবা হয়। জীবন যেহেতু একটাই, তখন যার যার যোগ্যতা, যার যার রুচি, যার যার মতামত নিয়ে আলাদা থাকাই বোধ হয় ভালো। যারা, তা থাকতে পারে। বড় বৌ, মেজ বৌ তাঁর সামনে কখনো ঝগড়া করে না বটে, কিন্তু সুধীনবাবু বোঝেন, ভালো করেই বোঝেন যে ওদের মধ্যে সব সময় একটা রেষারেষি, একটা কোল্ড-ওয়ার চলে। সেটা আরো অসহ্য ঠেকে।
রথ নিয়ে উনি ওপরে উঠে যেতেই মেজ বৌ ঘরে গিয়ে উষ্মার সঙ্গে মেজ ছেলেকে বলল, বাড়াবাড়ি।
—কেন? কার? খাটে শুয়ে বই পড়তে পড়তে মেজ বলল।
—কার আবার? তোমার বাবার। মিষ্টির জন্যে নিজে হাতে রথ কিনতে গেলেন, বৃষ্টিতে ভিজে। কেন আমার ছেলেদের জন্যে তো কখনো একটা চকোলেটও কিনে দেন না?
মেজ বলল, তাই নাকি? বাবা নিজে গেছিলেন? স্ট্রেঞ্জ!
মেজ বৌ বলল, তোমার ছেলেরা কি ভেসে এসেছিল?
বড় বৌ জানালার পাশে দাঁড়িয়েছিল যখন সুধীনবাবুর সঙ্গে জগবন্ধুবাবু কথা বলছিলেন।
বড় বৌ মেজকে ডাকলেন। মেজ বাইরে এলে বলল, দ্যাখ কী লজ্জার।
—কী? মেজ বলল।
বাবা জগবন্ধুবাবুকে, গাড়ি পান না, রিকশায় যাতায়াত করেন—এসব কথা বলছিলেন নিশ্চয়ই; এটা অপমানের নয়? বুড়ো হলে মানুষগুলো কুটিল হয়ে যায়? কাজকর্ম নেই তো!
সুধীনবাবুও ইজিচেয়ারে বসে ভাবছিলেন, স্ট্রেঞ্জ! বড় ছেলে, মেজ ছেলে নিজেদের ধাড়ী ধাড়ী ছেলেদের রথ কিনে দিল আর ছোট ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে মিষ্টির জন্যে চার টাকা দিয়ে একটা রথ কেনার কথা মনে হলো না ওদের। এরা একেবারে চামার হয়েছে। তাঁর নিজের ছেলে বলে ভাবতেও কষ্ট হয়।
সুধীনবাবু বোঝেন সব। মুখে কিছু বলেন না। বড়লোক বাবার কাছে গরিব সেজে থাকার লাভ অনেক। অন্তত তাই ভাবে ওরা। তিনি চিরদিন ন্যায়ের পক্ষে, অন্যায়ের বিপক্ষে। দীপু চলে গেছে বলেই তিনি তাকে দূর করে দিতে পারেন না। উইল করে ফেলেছেন তিনি। যা-কিছুই আছে স্থাবর-অস্থাবর, ছেলেমেয়ে সকলকে সমান ভাগ। বৌমারা এ কথা জানে না বলেই বোধ হয় রেষারেষি হয়। কে শ্বশুরের বেশি কাছের, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে।
ড্রাইভার ফিরে এসে ওপরে এলো দেখা করতে। সুধীনবাবু বললেন যে এক্ষুনি রথটা ছোটবাবুর নিউ আলিপুরের ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে আসতে।
ড্রাইভার চলে গেল। বড় ছেলে শালা ও শালা-বৌয়ের জন্যে গরম গরম বিরিয়ানি ও চিকেন চাঁব নামিয়ে রেখে রাগতস্বরে শালাদের সামনেই বলল, বাবা যত বুড়ো হচ্ছেন, ততই ইনকনসিডারেট হচ্ছেন। এত রাতে বৃষ্টির মধ্যে ড্রাইভারকে কি না পাঠালেই চলত না। গরিব লোকটা সারা দিন খাটছে। বুড়ো হলে মানুষগুলো সেনাইল হয়ে যায়। ভীমরতি ধরে।
বড়বাবুর বড় শালা কথা ঘুরিয়ে বলল, যাই বলো আর তাই বলো, শিখা ও দীপু চলে গিয়ে তোমাদের বাড়িটা কেমন খাঁ খাঁ করে যেন।
বড় বৌ বলল, তা তো লাগবেই দাদা তোমার। আমরা তো শিখার মতো সুন্দরীও নই আর অমন শরীর বের করে সাজতেও পারি না।
বড় শালা হেসে ফেললেন। বললেন, নমু তুই কোন লজ্জায় এ-কথা বলছিস? তুই যা শরীর করেছিস তা কি কাউকে দেখাবার? তুই তো একেবারে আমাদের কম্পানির সাফ্লায়ার ঢালাইওয়ালা মি. আগরওয়ালার স্ত্রীর মতো দেখতে হয়ে গেছিস। ওজন কত কুইন্টাল হলো?
বোন রেগে গেল। বলল, তোমাদের সব দেমাকি মেয়েছেলে ছাড়া ভালোই লাগে না। শিখার দেমাক একদিন ভাঙব। ভগবান কি নেই? ভগবানই একদিন ওকে মুড়িয়ে খাবেন।
দাদা বললেন, ছিঃ ছিঃ, তুই না পড়াশোনা করেছিস। তুইও এ রকম? টিপিক্যাল! তারপর বলল, ভগবানের আরো অনেক ইমপরট্যান্ট কাজ আছে। যা-ই বলিস, তোদের বাড়িতে কিন্তু দীপু-শিখাকে আমার সবচেয়ে পছন্দ। ভেরি ট্রেইট-ফরোয়ার্ড।
বড় বৌদি বলল, খুব লক্ষ্মী মেয়ে কিন্তু শিখা। ওরা যখন এখানে থাকত, একটা ঘরে থাকলে কী হয়; ঘরের মেঝেতে মুখ দেখা যেত। এখন তোমাদের বাড়িতে ঢুকলেই মনই খারাপ হয়ে যায়। মাসিমা আর শিখা চলে গিয়ে তাদের বাড়ি একেবারে শ্রীহীন হয়ে গেছে।
বড় বৌ চটে গেল। বলল, তা এই বাড়িতে আসা কেন, বাবা? না এলেই তো পারো। কেউ বাড়ি বয়ে এসে এমন অপমান করে, শুনিনি কোথাও।
ঘর ফাঁকা হতেই বড় শালা নিজের স্ত্রীকে বলল, তোমার এমন স্পষ্ট কথা বলার দরকার কী?
আমি স্পষ্ট কথাই বলি। তোমার বোন বলে কি ছেড়ে দেব? ওরা কেউ শিখার ধারেকাছে নয়। তাই-ই তো দলাদলি আর পলিটিকস করে ওকে তাড়াল। শিখা চাপা মেয়ে, কিন্তু একদিন আমার কাছে সব বলেছিল। শিখার কী? ও নিজে বড়লোকের একমাত্র মেয়ে, স্বামীরও যথেষ্ট যোগ্যতা আছে; ও কেন এই নোংরামির মধ্যে থাকবে? আমার সামর্থ্য থাকলে আমিও তোমাদের বাড়ি থাকতাম না। কত সুখেই রেখেছ তুমি আমাকে জগাখিচুড়ির সংসারে।
তারপর বলল, লোকে ঈর্ষা আর হিংসা করে তো আর কারো কপাল পোড়াতে পারে না। কপাল কে নেবে? যে যেমন কপাল করে আসে। তোমার বোনের এই পরশ্রীকাতর স্বভাব আমার মোটেই ভালো লাগে না।
আঃ কী করছ! বাড়াবাড়ি কোরো না, শুনতে পাবে।
শুনুক। তোমার মতো আদেখলাও দেখিনি আমি। বিরিয়ানি খাওয়ার এত লোভ, তো হোটেলে গিয়ে খেলেই পারো!
আহা! সমীর এত করে নেমতন্ন করল। সমীরের কী দোষ। বলল, হুইস্কি খাওয়াবে। বৃষ্টির দিন। সমীর তো ভালোই।
বড় শালার স্ত্রী বলল, ভালো। তেমনি ভালো। যেমন দেবা, তেমনি দেবী। এ রকম ছোট মনের পুরুষও আমি দেখিনি। স্ত্রীর কথায় ওঠে-বসে।
থামো তো! ধমক লাগাল বড় শালা।
বড় এসে বলল, এসো, ঘরে এসো, চুপচাপ হুইস্কি খেতে হবে ঘরে বসে। হাশ্-হাশ্ করে। বাবা জানতে পারলে তো কোনো সম্পত্তিই দিয়ে যাবেন না। ত্যাজ্যপুত্তুর করবেন।
বড় শালা অবাক হয়ে বলল, কেন? দীপু তো খেত বাড়িতে মাঝেমধ্যে।
বড় ছেলে সমীর বলল, দীপুর কথা ছাড়ো। ওর কি কোনো রেসপেক্ট আছে নাকি বড়দের প্রতি? ও সাহেব লোক।