বয়স ছিল আট ,
পড়ার ঘরে বসে বসে ভুলে যেতেম পাঠ ।
জানলা দিয়ে দেখা যেত মুখুজ্যেদের বাড়ির পাশে
একটুখানি প ো ড়ো জমি , শুকনো শীর্ণ ঘাসে
দেখায় যেন উপবাসীর মতো ।
পাড়ার আবর্জনা যত
ওই খানেতেই উঠছে জমে ,
একধারেতে ক্রমে
পাহাড়-সমান উঁচু হল প্রতিবেশীর রান্নাঘরের ছাই ;
গোটাকয়েক আকন্দগাছ , আর – কোনো গাছ নাই ;
দশ-বারোটা শালিখপাখি
তুমুল ঝগড়া বাধিয়ে দিয়ে করত ডাকাডাকি ;
দুপুরবেলায় ভাঙা গলায় কাকের দলে
কী যে প্রশ্ন হাঁকত শূন্যে কিসের কৌতূহলে ।
পাড়ার মধ্যে ঐ জমিটাই কোনো কাজের নয় ;
সবার যাতে নাই প্রয়োজন লক্ষ্মীছাড়ার তাই ছিল সঞ্চয় ;
তেলের ভাঙা ক্যানেস্তারা , টুকরো হাঁড়ির কানা ,
অনেক কালের জীর্ণ বেতের কেদারা একখানা
ফুটো এনামেলের গেলাস , থিয়েটারের ছেঁড়া বিজ্ঞাপন ,
মরচে-পড়া টিনের লণ্ঠন ,
সিগারেটের শূন্য বাক্স , খোলা চিঠির খাম ,
অ – দরকারের মুক্তি হেথায় , অনাদরের অমর স্বর্গধাম ।
তখন আমার বয়স ছিল আট ,
করতে হত ভূবৃত্তান্ত পাঠ ।
পড়ার ঘরের দেয়ালে চারপাশে
ম্যাপগুলো এই পৃথিবীকে ব্যঙ্গ করত নীরব পরিহাসে ;
পাহাড়গুলো মরে-যাওয়া শুঁয়োপোকার মতো ,
নদীগুলো যত
অচল রেখার মিথ্যা কথায় অবাক হয়ে রইত থতমত ,
সাগরগুলো ফাঁকা ,
দেশগুলো সব জীবনশূন্য কালো-আখর-আঁকা ।
হাঁপিয়ে উঠত পরান আমার ধরণীর এই শিকল রেখার রূপে —
আমি চুপে চুপে
মেঝের ‘ পরে বসে যেতেম ওই জানলার পাশে ।
ঐ যেখানে শুকনো জমি শুকনো শীর্ণ ঘাসে
পড়ে আছে এলোথেলো , তাকিয়ে ওর ই পানে
কার সাথে মোর মনের কথা চলত কানে কানে ।
ওই যেখানে ছাইয়ের গাদা আছে
বসুন্ধরা দাঁড়িয়ে হোথায় দেখা দিতেন এই ছেলেটির কাছে ।
মাথার ‘ পরে উদার নীলাঞ্চল
সোনার আভায় করত ঝলমল ।
সাত সমুদ্র তেরো নদীর সুদূর পারের বাণী
আমার কাছে দিতেন আনি ।
ম্যাপের সঙ্গে হত না তার মিল ,
বইয়ের সঙ্গে ঐক্য তাহার ছিল না এক তিল ।
তার চেহারা নয় তো অমন মস্ত ফাঁকা
আঁচড়-কাটা আখর-আঁকা —
নয় সে তো কোন্ মাইল-মাপা বিশ্ব ,
অসীম যে তার দৃশ্য ; আবার অসীম সে অদৃশ্য ।
এখন আমার বয়স হল ষাট
গুরুতর কাজের ঝঞ্ঝাট ।
পাগল করে দিল পলিটিক্সে ,
কোন্টা সত্য কোন্টা স্বপ্ন আজকে নাগাদ হয় নি জানা ঠিক সে ;
ইতিহাসের নজির টেনে সোজা
একটা দেশের ঘাড়ে চাপাই আরেক দেশের কর্মফলের বোঝা ,
সমাজ কোথায় পড়ে থাকে , নিয়ে সমাজতত্ত্ব
মাসিক পত্রে প্রবন্ধ উন্মত্ত ।
যত লিখছি কাব্য
ততই নোংরা সমালোচন হতেছে অশ্রাব্য ।
কথায় কেবল কথারি ফল ফলে ,
পুঁথির সঙ্গে মিলিয়ে পুঁথি কেবলমাত্র পুঁথিই বেড়ে চলে ।
আজ আমার এই ষাট বছরের বয়সকালে
পুঁথির সৃষ্টি জগৎটার এই বন্দীশালে
হাঁপিয়ে উঠলে প্রাণ
পালিয়ে যাবার একটি আছে স্থান ।
সেই মহেশের পাশে
পাড়ায় যারে পাগল বলে হাসে ।
পাছে পাছে
ছেলেগুলো সঙ্গে যে তার লেগেই আছে ।
তাদের কলরবে
নানান উপদ্রবে
একমুহূর্ত পায় না শান্তি ,
তবু তাহার নাই কিছুতেই ক্লান্তি ।
বেগার-খাটা কাজ
তারি ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে কেউ মানে না লাজ ।
সকালবেলায় ধরে ভজন গলা ছেড়ে ,
যতই সে গায় , বেসুর ততই চলে বেড়ে ।
তাই নিয়ে কেউ ঠাট্টা করলে এসে
মহেশ বলে হেসে ,
“ আমার এ গান শোনাই যাঁরে
বেসুর শুনে হাসেন তিনি , বুক ভরে সেই হাসির পুরস্কারে ।
তিনি জানেন , সুর রয়েছে প্রাণের গভীর তলায় ,
বেসুর কেবল পাগলের এই গলায় । ”
সকল প্রয়োজনের বাহির সে যে সৃষ্টিছাড়া
তার ঘরে তাই সকলে পায় সাড়া ।
একটা রোগা কুকুর ছিল , নাম ছিল তার ভুতো ,
একদা কার ঘরের দাওয়ায় ঢুকেছিল অনাহূত ,
মারের চোটে জরজর
পথের ধারে পড়ে ছিল মর-মর ,
খোঁড়া কুকুরটারে
বাঁচিয়ে তুলে রাখলে মহেশ আপন ঘরের দ্বারে ।
আরেকটি তার পোষ্য ছিল , ডাক – নাম তার সুর্মি ,
কেউ জানে না জাত যে কী তার , মুসলমান কি কাহার কিংবা কুর্মি ।
সে-বছরে প্রয়াগেতে কুম্ভমেলায় নেয়ে
ফিরে আসতে পথে দেখে চার বছরের মেয়ে
কেঁদে বেড়ায় বেলা দুপুর দুটোয় ।
মা নাকি তার ওলাউঠোয়
মরেছে সেই সকালবেলায় ;
মেয়েটি তাই বিষম ভিড়ের ঠেলায়
পাক খেয়ে সে বেড়াচ্ছিল ভয়েই ভেবাচেকা ,—
মহেশকে যেই দেখা
কী ভেবে যে হাত বাড়াল জানি না কোন্ ভুলে ;
অমনি পাগল নিল তারে কাঁধের ‘ পরে তুলে ,
ভোলানাথের জটায় যেন ধুতরোফুলের কুঁড়ি ;
সে অবধি তার ঘরের কোণটি জুড়ি
সুর্মি আছে ওই পাগলের পাগলামির এক স্বচ্ছ শীতল ধারা
হিমালয়ে নির্ঝরিণীর পারা ।
এখন তাহার বয়স হবে দশ ,
খেতে শুতে অষ্টপ্রহর মহে শ তারি বশ ।
আছে পাগল ঐ মেয়েটির খেলার পুতুল হয়ে
যত্নসেবার অত্যাচারটা সয়ে ।
সন্ধ্যাবেলায় পাড়ার থেকে ফিরে
যেমনি মহেশ ঘরের মধ্যে ঢোকে ধীরে ধীরে ,
পথ-হারানো মেয়ের বুকে আজো যেন জাগায় ব্যাকুলতা —
বুকের ‘ পরে ঝাপিয়ে প ‘ ড়ে গলা ধ ‘ রে আবোলতাবোল কথা ।
এই আদরের প্রথম – বানের টান
হলে অবসান
ওদের বাসায় আমি যেতেম রাতে ।
সামান্য কোন্ কথা হত এই পাগলের সাথে ।
নাইকো পুঁথি নাইকো ছবি , নাই কোনো আসবাব ,
চিরকালের মানুষ যিনি ওই ঘরে তাঁর ছিল আবির্ভাব ।
তারার মতো আপন আলো নিয়ে বুকের তলে —
যে-মানুষটি যুগ হতে যুগান্তরে চলে ,
প্রাণখানি যাঁর বাঁশির মতো সীমাহীনের হাতে
সরল সুরে বাজে দিনে রাতে ,
যাঁর চরণের স্পর্শে
ধুলায় ধুলায় বসুন্ধরা উঠল কেঁপে হর্ষে ,
আমি যেন দেখতে পেতেম তাঁরে
দীনের বাসায় , এই পাগলের ভাঙা ঘরের দ্বারে ।
রাজনীতি আর সমাজনীতি পুঁথির যত বুলি
যেতেম সবই ভুলি ।
ভুলে যেতেম রাজার কারা মস্ত বড়ো প্রতিনিধি
বালুর ‘ পরে রেখার মতো গড়ছে রাজ্য , লিখছে বিধান বিধি ।