সংকোশ নদী
সংকোশ নদীটা তার বরফ-গলা স্বচ্ছ জল বুকে করে দু-পাশের নিবিড়, ভয়াবহ অরণ্যের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে। নদী পার হলেই ভুটান। ভুটানের মহারাজা প্রতিবছর-ই এক দু-বার হেলিকপ্টারে করে থিম্পু থেকে যমদুয়ারে চলে আসেন শিকারের জন্যে। ভারতবর্ষে পাওয়া যায়, অথচ যমদুয়ারে পাওয়া যায় না, এমন প্রাণী খুব কমই আছে। হাতি, বাঘ, বাইসন, (গাউর), বুনো মোষ, চিতা, শম্বর, চিতল হরিণ, কোটরা, নানারকম সাপ, নদীর জলে দ্রুত সাঁতরে যাওয়া কালো ও লাল মাছের মস্ত মস্ত ঝাঁক, কী যে নেই এই গহন, ভয়াবহ বনে, তা খোদাই জানেন। ভাবে, আবু ছাত্তার। পাখি, নানারকম প্রজাপতি।
যমদুয়ার বাংলো থেকে মাইল দুয়েক দূরে পরেশ আর ছাত্তার সংকোশ নদীর পাশে একটি মোষের বাথানে বসেছিল।
নেপালিদের বাথান। প্রায় শ-খানেক মোষ আছে। ঘি তৈরি করে, তারা পৌঁছে দেয় ভুটানে। সংকোশের একপারে ভুটান। আর অন্য পারে আসাম এবং পশ্চিমবাংলা।
নদীতে চান করে উঠেছে ওরা। তারপর দুপুরে ময়ূরের ঝোল আর ভাত দিয়ে ভরপেট খাওয়া-দাওয়ার পর কষে ঘুম লাগিয়েছিল। রাতের বেলাতে বাথানের নেপালিদের সঙ্গেই খেয়ে নেবে। নেমন্তন্ন করেছে ওদের, নেপালি গোয়ালারা। আজ-ই সকালে একটা কুটরা হরিণও মেরে ওদের দিয়েছিল। তার-ই ঝোল, মেটে-চচ্চড়ি আর ভাত খাবে রাতে। খিদেটাও বেশ চনমনে হয়েছে।
ক্যামেরন সাহেব যমদুয়ারের দোতলা বন-বাংলোতে আছেন। কলকাতা থেকে একটি পাঞ্জাবি মেয়েকে সঙ্গে করে এনেছেন উনি। বড়োঘরের মেয়ে। মহামূল্য বেশ্যা। রূপ ফেটে পড়ছে। বয়সও ত্রিশের নীচে। কিন্তু হলে কী হয়, বেশ্যারা বেশ্যাই। তাদের রকম-সকম চলন-বলন, তারা যতই সম্ভ্রান্ততা দিয়ে ঢেকে রাখুক-না-কেন; ঘরের বউ আর টানামালে তফাত থাকেই।
চোখের সামনে ক্যামেরন সাহেবের ওই বেলেল্লাপনা সহ্য করতে পারে না পরেশ। জন্মেছিল বিত্তশালী পরিবারে কিন্তু ছেলেবেলাতে ভিটে-মাটি ছেড়ে চলে এসেছিল জন্মভূমি ছেড়ে, একবস্ত্রে। ইজ্জত-এর জন্যে। যে-ইজ্জতের জন্যে অনেক মূল্য দিয়েছে তারা সকলে, সেই ইজ্জত-ই কেনা-বেচা করছে এরা চোখের সামনে। যে-দৃঢ়মূল, রক্ষণশীল মানসিকতাতে তারা মানুষ হয়েছে তাতে এইসব বড়ো চোখে লাগে। সহ্য করা মুশকিল হয়। অথচ প্রতিবাদও করতে পারে না। সে-ক্ষমতা নেই। ফলে মনের মধ্যে সবসময়েই একটা চাপা উত্তেজনা গুমোট মেরে থাকে। দমবন্ধ লাগে। অমন উদার খোলামেলা পরিবেশেও নিশ্বাস নিতে পারে না যেন।
আবু ছাত্তার বড়ো স্থিতপ্রজ্ঞ মানুষ। বড়োবাঘ তাকে পেড়ে ফেললেও, সে যেমন নিরুত্তাপ থাকে, চোখের সামনে দোতলার খোলা বারান্দায় দিনের বেলাই প্রায় ন্যাংটো মেয়েকে নিয়ে ক্যামেরন সাহেবের রমদা-রমদি দেখেও ও তেমন-ই নিরুত্তাপ। তবে, ছাত্তারের চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে ওঠে। দেখতে পায়, বুঝতে পারে পরেশ। আর চোয়াল শক্ত হলেই ভয় পায়।
বেশ কয়েকবছর পরে, এইরকম চোয়াল শক্ত করেই ছাত্তার তার বন্দুক তুলে নিয়ে তার এগারোজন রক্তের আত্মীয়কে একই দিনে গুলিতে শেষ করে দিয়েছিল।
মানুষটা বাঘের সঙ্গে কারবার করত। সাহসের কোনো খামতি ছিল না। কিন্তু নোংরামি, নীচতা এসব সহ্য করতে পারত না। পারত না ভন্ডামি।
ছাত্তারের ব্যক্তিগত আইন নিষ্ঠুর ছিল। ভয়াবহ ছিল, কিন্তু তা অন্যায় ছিল না, নীচ ছিল না।
এই ক্যামেরন সাহেবদের হাব-ভাব দেখে পরেশেরও একধরনের ঘৃণা জন্মে গেছে। মুখ ফিরিয়ে থুথু ফেলে ও, সংকোশের বহমান স্বচ্ছ জলে। ওর থুথু ভেসে যায় দ্রুত। ঘুরপাক খেতে খেতে হারিয়ে যায়। জলের নীচে নানা-রঙা নুড়ি দেখা যায়। মহাশোল মাছের ঝাঁক, কালো ছায়া ফেলে সাঁতরে যায় গভীরে গভীরে। জলের গভীরে আষাঢ়ের মেঘের মতো মনে হয় সে চলমান মাছের ঝাঁককে।
কাল বিকেলের আগেই ভুটানের দিকে একটা ল্যাংড়া, বাঁজা মোষকে বেঁধেছিল পরেশরা বাঘের জন্যে। যে-মোষ দুধ দেয় না, তার কোনোই প্রয়োজন নেই বাথানের গোয়ালাদের কাছে। গোস্ত করবে বলে কিনতে চায়, মুসলমান যাযাবর ব্যবসায়ীরা। কিন্তু নেপালিরা কট্টর হিন্দু। যদিও দুর্গাপুজোর সময় মোষ বলি দেয় তারা, কেউ জবাই করে খাবে তা জেনে ল্যাংড়া, বাঁজা, অকর্মণ্য দামহীন মোষও বেচে না।
টাকা যাদের খুবই দরকার, তাদের-ই দেখা যায় যে, টাকার জন্যে হাহাকার না করতে। টাকার জন্যে নিজেদের নিজস্বতা বিকিয়ে না দিতেও। সেই লোভ আছে শহরের মানুষদের। পরেশ ভাবে, একদিন শহরের মানুষেরা পুরো পৃথিবীটাকে নষ্ট-ভ্রষ্ট করে দেবে। এই গাছ থাকবে না, এই ফুল, এই বাঘ, এই শান্তি এবং এই মানসিকতাও। পেনশন এবং পুঁজিহীন রিটায়ার্ড পুরুষদের যেমন অবস্থা সংসারে, অনেকটা তেমন-ই অবস্থা ওই মোষটার। তবু ওকে কেউই অসম্মান করে না। না গোয়ালারা, না অন্য মোষেরা।
প্রায় প্রতিরাতেই বড়োবাঘ এসে বাথানে হামলা করে, যদিও বাথানের শক্ত কাঠের বেড়ার মধ্যে ঢুকে মোষ নেওয়ার সাহস কোনো বাঘের-ই নেই। একসঙ্গে বাঘিনি এবং বাচ্চারা। থাকলেও নয়। তবুও হম্বি-তম্বি করে। মোষগুলোও বোঁ-বোঁ-ও করে প্রচন্ড চিৎকার করে ওঠে। দাপাদাপি, ঝাঁপাঝাঁপি হয় অনেকক্ষণ। ঘুমের দফা-রফা। মশাল হাতে করে গোয়ালারা ঘেরার মধ্যে থেকেই লম্ফ-ঝম্ফ করে। ক্যানেস্তারা পিটিয়ে ভয় দেখায় বাঘকে। ঘেরার বাইরে অবশ্য বেরোয় না। মোষদের রক্ষাকবচ ছাড়ে না।
একে বড়োবাঘ, তায় রাত বলে কথা।
সচরাচর বাথানের মধ্যে রাতের বেলা বাঘে কিছু করতেও পারে না। অনেক মোয যে, থাকে একসঙ্গে শিং উচিয়ে। মোঘ ধরে বাঘে, দিনের বেলাতেই, যখন কোনো মোষ চরতে চরতে একলা হয়ে যায়, তখন। তবু রাতে এসে ভয় না-দেখালেও যেন চলে না তাদের।
ল্যাংড়া, বাঁজা মোষটাকে মেরেছিল বাঘ গতকাল-ই শেষরাতের দিকে। মড়িটাকে বেঁধে ছিল অবশ্য বুদ্ধি করে বাঘের চলাচলের পথেই কাল। খেয়েছে সামান্যই। তাই আজ রাতে যে, মড়িতে আসবেই বাঘ, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই।
ছাত্তার আর পরেশ বাঘের পায়ের দাগ দেখে বুঝেছে যে, মস্ত বাঘ।
নেপালিরাও বলেছিল যে, অত বড়োবাঘ সারাজীবন বনে বনে ঘুরেও দেখেনি ওরা। মোযটা ভালো করে বাঁধা না থাকলে ওই বাঘের পক্ষে অতবড়ো মোষকে বয়ে নিয়ে ভুটান হিমালয়ের খাড়া পাহাড়ে উঠে চলে যাওয়াও অসুবিধের ছিল না। একটি বড়োবাঘ তার শরীরে যে, কতখানি শক্তি ধরে তা যারা বাঘকে জেনেছে, তারাই জানে।
খুব ভালো করে, শক্ত করে মাচা বেঁধেছে ওরা, সারাসকাল ধরে। চারজন লোককে নিয়ে। ক্যামেরন সাহেব বাঘ মারবেন বলেই এখানে এসেছেন। এখন মানে মানে মারতে পারলেই ভালো। যদি না মারতে পেরে, আহত করেন তবে সেই বাঘকে পিছা করে মারার কাজ হবে পরেশ আর ছাত্তারের-ই। পেশাদার শিকারি ওরা।
ক্যামেরন সাহেব নিজেই বাঘ মারতে পারলে দু-শো টাকা দেবেন বলেছেন আর আহত করার পর সেই বাঘকে যদি ছাত্তারদেরই পিছা করে রক্তের দাগ দেখে দেখে খুঁজে বের করে শেষ করতে হয়, তবে তিন-শো টাকা। সাহসী শিকারিদের কোনো সম্মান দেয় না এইসব মিথ্যাচারী, জালি মানুষেরা। সম্মানটা নিজে নিয়ে, টাকাটা হাতে ধরিয়ে দেন।
পরেশ ভাবে, ওই পাঞ্জাবি মেয়েটার সঙ্গে আসলে হয়তো ওদের নিজেদের বিশেষ তফাত নেই। ওরা বেচে, ওদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, দুর্জয় সাহস; আর মেয়েটা বেচে অন্য কিছু। ওরা সবাই অসহায়।
তবে, ওদের, অসহায়তার রকমটা আলাদা।
ভাবে পরেশ কে জানে! হয়তো ক্যামেরন সাহেবও অসহায়। তার অসহায়তার রকমের খোঁজ হয়তো তারা রাখে না। প্রাণ বিপন্ন করেও বাঘের চামড়া, বাইসনের বা বুনোমোষের মাথা, হাতির দাঁত তারা এনে দেয় শৌখিন, আত্মসম্মান-জ্ঞানহীন শিকারিদের পায়ের কাছে। সামান্য অর্থের বিনিময়ে।
টাকার বড়ো দরকার পরেশের। ছাত্তারেরও টাকার দরকার কম নয়। তাই-ই ওরা চাইছিল ক্যামেরন সাহেব কোনোক্রমে গুলি ছোঁয়াক একবার বাঘের গায়ে। তারপর ওরাই দেখবে। মাথাপিছু পঞ্চাশটা করে টাকা বেশি পাওয়া সোজা কথা নয়। যা বাজার!
বাঘ শিকারের ওই নিয়ম। যে-আগে রক্ত ঝরাতে পারবে, বাঘ তার। সেই প্রথম গুলি, ল্যাজেই লাগুক, কী কানের পাতাতে। রক্ত ঝরলেই হল।
তবে ক্যামেরন সাহেবকে পাঠিয়েছে গৌহাটির ল্যাম্পুন সাহেব। ল্যাম্পুন সাহেব কিন্তু ভালো শিকারি। ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে-না ওদের যে, এই ক্যামেরন সাহেব শিকারের কিছু জানেন বলে। শিকারে তাঁর মনও নেই। শিশু যেমন সুন্দর খেলনা পেয়ে পৃথিবী ভুলে মত্ত হয়ে যায়, ক্যামেরন সাহেবও পাঞ্জাবি মেয়েটাকে নিয়ে তেমন-ই মত্ত। মেয়েটা যেন দুর্মূল্য আইসক্রিম। এখুনি চেটে-পুটে শেষ আদ্রতাটুকুও না খেলে যেন, গলে গিয়ে আঁজলা গলে গড়িয়ে যাবে সব রস, মিষ্টত্ব!
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর ভালো করে ঘুম দিয়ে উঠল ওরা দু-জনে। রাতে জাগতে হবে। কে জানে, সারারাত-ই জাগতে হবে কি না। বাঘের মতিগতির কথা কি বলা যায়? মড়িতে এসে হয়তো হাজির হল একেবারে শেষরাতে।
ঘুম থেকে উঠেই পরেশ বলল, আমি একটু ঘুরে আসছি।
ছাত্তার ভালো করে জানে, কোথায় ঘুরতে গেল পরেশ। ওই একটিই কমজোরি পরেশের। পৃথিবীর সমস্ত বাহাদুর মানুষদের-ই কোনো-না-কোনো কমজোরি থাকেই। থাকাটা অবধারিত।
ভুটানের দিকেই পাহাড়ের নীচে খড়ের ঘরে মদ পাওয়া যায়। ভুটানে তৈরি হুইস্কি। পাঁইটের বোতল। কমলালেবুর ছবি আঁকা। কমলা-রঙা। সাদা লেবেলের ওপর। নাম, ভুটান অরেঞ্জ।
ছাত্তার মদ ছোঁয় না। ওর নেশার মধ্যে গুয়া-পান। শুধুই গুয়া-পান।
কেউ মদ খাক, তাও পছন্দ নয় ছাত্তারের।
পরেশ যাওয়ার সময়ে, ছাত্তার বলল, ক্যামেরন তো মাতাল হইবই, তুই বেশি খাস না। অত বড়োবাঘ! মাতলামি যদি করিস, আমি কিন্তু তোক গুলি করুম।
থোও, থোও! পরেশরে কোনোদিন মাতাল হইতে দ্যাখছ তুমি! যত্ত ফাঁকসা কথা!
–তাড়াতাড়ি আসস কিন্তু। দেরি যদি করস, তো খারাপ হইব। ভুটানি ছুকরিও তো আছে ওই দোকানে। কী হয় না হয়; আমি সব-ই জানি।
-মুখ সামলাইয়া কথা কইও মিয়ার পুত। তোমার জিভখান কাইট্যা ফেলাউম। ওইসব মাইয়া-ফাইয়ার ধান্দা আমার লাই। মদ খাই; মদ খাই।
-না থাকন-ই ত ভালো।
অবিশ্বাসী স্বগতোক্তি করল ছাত্তার।
পরেশ, একা একা চৈত্রর নদী পেরিয়ে ভুটানের দিকে যাচ্ছিল। মন্থর পায়ে। চৈত্রদিনের বিকেলের মধ্যেই একটা মন্থরতা আছে। সবকিছু শ্লথ হয়ে যায়, ভিতর-বাহির।
ঘন, গহিন বন, পাহাড়ের গায়ে। পেছনে। সামনে, ডাইনে, বাঁয়ে। যমদুয়ারের সেগুন আর শালগাছের কান্ডর বেড় দশজন মানুষের দু-হাতেও দেওয়া যায় না। এই বনে, গা ছমছম করে দিনের বেলাতেও। ছায়াচ্ছন্ন সবুজ অন্ধকারে ঢাকা থাকে দুপুরের রোদও, অনেক-ই জায়গাতে। যেখানে জঙ্গল ঘন।
এই ছমছমানির প্রেমেই পড়েছে আসলে পরেশ। চাকরি করল না, থিতু হল না। বিয়ে করল না কোনো দায়-দায়িত্বই নিল না জীবনে, শুধু এই ছমছমানির-ই প্রেমে পড়ে। তার বিয়ে হয়েছে জঙ্গলের-ই সঙ্গে। কী ভালো যে লাগে, এমন গহন জঙ্গলে এল! মদ খায় মাঝেমধ্যে। নেশা করার জন্যে নয়। নেশা, তার জঙ্গলে এলে; এমনিতেই হয়। সেই নেশাকে জমাট করে তোলার জন্যেই মাঝে মাঝে একটু-আধটু খায়। জঙ্গলে বসে মাল খাওয়ার আনন্দই আলাদা। প্রকৃতির প্রভাবের-ই মতো, হুইস্কির প্রভাবও আস্তে আস্তে চাড়িয়ে যায় নিজের ভেতরে। ধীরে ধীরে। বেলাশেষের বুনো হাঁস, যেমন করে ম্লান রক্তিম আলোয়, সারারাতের স্থির জলজ শীতের জন্যে তৈরি হয়ে যায়।
ছাত্তার মিয়া, এই মদ-ফদ কোনোদিন জিভেও দেয়নি। ও কী করে জানবে, ভুটান অরেঞ্জের স্বাদ।
কুমারগঞ্জ থেকে বেরোবার সময় দাদার জ্বর ছিল অনেক। শিলিটা একা ছিল বাড়িতে। পরেশের এমন করে চলে আসাটা ঠিক হয়নি।
খড়ের চালাটার বারান্দার এককোণে বসে লালচে, মোটা কাঁচের গেলাসে, জল-মেশানো ভুটান-অরেঞ্জ খেতে খেতে ভাবছিল, পরেশ। ভাবছিল, এই জীবনে খুব কম কিছুই ও করেছে, যা, ওর করা উচিত ছিল। ছেলেবেলায় উদবাস্তু হয়ে চলে এসেছিল আসামে, উত্তরবঙ্গ থেকে। তারপর এখানে এসেই এই বন-জঙ্গলের প্রেমে পড়ে গেল। শিকারের এক গুরুও পেয়েছিল, সে কাসেম মিয়া। এই নেশাটাই ধরে নিল তাকে কিশোর বয়সে। সেই যে, ধরল হাত, বজ্রমুঠি আর ছাড়ল না। রাঙামাটি, পর্বতজুয়ার, গঙ্গাধর নদী, রাইমানা, কচুগাঁও, বরবাধা, যমদুয়ার।
এই নেশা যাকে একবার ধরেছে, তার ইহকাল পরকাল সব-ই গেল।
ভুটানি মেয়েটার গাল দু-টি কমলা লেবুর-ই মতন। বুকদু-টি পাকা টুকটুকে মাকাল ফলের মতো দেখতে। ইচ্ছে করেই বুকের পর্দা একটুখানি খুলে রেখেছে। মাকাল ফল নিগুণ হয়, কিন্তু এই ফলের অনেক-ই গুণ। আর রূপ তো আছেই।
এখানে সব গন্ডার-মারা, হাতি-মারা চোরাশিকারিরা আসে। স্মাগলাররা আসে। সাংঘাতিক সাংঘাতিক সব চরিত্র। ভারতের দু-টি রাজ্য এবং ভুটানের বর্ডার বলে নানারকম খারাপ কাজ-ই হয় এখানে। মদ, আফিম, চরস, মেয়ে চালান যায়। মাঝে খুন-খারাপিও হয় দু চারটে। রুক্ষ, দুর্দান্ত সব মানুষের গায়ের গন্ধ ভাসে এখানের বাতাসে এবং ভাসে বলেই এত ভালো লাগে পরেশের।
এক ঘণ্টার জন্যে ঘর বন্ধ করে কারও সঙ্গে বাঁশের মাচানে শুতে দু-টাকা নেয় মেয়েটা। বাইরে যারা বসে মদ খায়, তারা দু-টি সলিড-শরীরের, কখনো মৃদু, কখনো জোর ধ্বস্তাধ্বস্তির শব্দ শুনতে পায়। হাঁসফাঁস নিশ্বাসের শব্দ, বাঁশের মাচার মচমচানি শব্দের সঙ্গে। সময় পেরোলে, জরায়ু ভিজলে, মেয়েটা ঘরের পেছনের জঙ্গলে চলে যায়। সেখানে মস্ত মাটির জালাতে জল রাখা থাকে, একটা প্রাচীন শিমুলগাছের নীচে।
ধোওয়া-পাকা করে নিয়ে, পরের রাউণ্ড কুস্তির জন্যে তৈরি হয় সেই পাহাড়ি মেয়ে। রতি-ক্রীড়ায় ক্লান্তিহীন এরা। যেমন, পাহাড় চড়ায়। চড়াই-উতরাই সহজে পেরোতে জানে। তবে, কাজ কারবার যা হওয়ার, তা সন্ধে-রাতেই শেষ হয়ে যায়। কখনো-বা ভর দুপুরেও। যমদুয়ার, যমের-ই দুয়ার। এখানে অন্ধকার নামার পর যম নিজেও ঘরের বাইরে বেরোতে ভয় পায়। এ বড়ো ভীষণ বন। এই বনে যম নানারকম ভেক ধরে আসে। কখনো বাঘ, কখনো হাতি, কখনো দানো, কখনো বার্গম্যানের ছবি দ্যা সেভেন্থ সিল-এর দাবাড় মৃত্যুর মতো কালো পোশাক পরে।
খড়ের ঘরের বারান্দায় বসে, ভুটান-অরেঞ্জ খেতে খেতে, পরেশ সংকোশ নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। দূরে, বন-বাংলোটা দেখা যায়। সূর্য ডুবতে আর ঘণ্টাখানেক বাকি। একটু পরেই মাচায় গিয়ে বসতে হবে ওদের। এই-ই ওদের জীবিকা। পেশা। ইচ্ছে করেই দু-টি মাচা বেঁধেছে। একটি বড়ো, একটি ছোটো। বড়োমাচাতে বসবে ছাত্তার আর ক্যামেরন। আর অন্য গাছে, ছোটোমাচাটিতে বসবে পরেশ একা।
বাঘ কিন্তু মারতে হবে ওই ক্যামেরনকে দিয়েই। পরেশ কিংবা ছাত্তারের মতো শিকারির কাছে, বাঘ মারা কিছুই নয়। কিন্তু অন্য শিকারিকে দিয়ে বাঘ-মারানো বড়ো কঠিন কাজ। হাতে দামি বন্দুক-রাইফেল থাকলেই তো আর শিকারি হয় না কেউ। কতরকম, কত দিশি বিদেশি, আর কত্ত জাতের শিকারিই যে, দেখল ওরা আজ অবধি।
পটাপট চারটে খেয়ে উঠল পরেশ। মেয়েটা খল-বল করছিল। মেয়েমানুষের দু-ঊরুর মাঝের আনন্দর স্বাদ পেতে তাকে কিশোর বয়েসে একবার বাধ্য করেছিল পাড়াতুতো এক দশ বছরের বড়োদিদি। ধর্ষিতা নারীদের-ই মতন, সেও ধর্ষিত হওয়ার পর থেকে ব্যাপারটাকে কোনোদিনও স্বাদু বলে মনে করতে পারেনি। প্রচন্ড শারীরিক এবং মানসিক কষ্ট হয়েছিল ওর। তারপর থেকে এ-ব্যাপারটার প্রতিই এক অসূয়া জন্মে গেছে পরেশের। পরেশ অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। প্রচন্ড নারী-বিদ্বেষীও। নারীসঙ্গর চেয়ে অনেক-ই বেশি আনন্দ পায়, পরেশ উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে এসে থেকে।
মেয়েদের প্রতি ওর এই অনাসক্তি দেখে অনেকে ভাবে যে, ও নপুংসক। কিন্তু পরেশ নিজে জানে ও কী। কৈশোরের ওই দুর্ঘটনার পর থেকেই মেয়েদের প্রতি ওর এক তীব্র বিদ্বেষ জন্মে গেছে। তা ছাড়া, ওর ধারণা হয়েছে যে, মেয়েরা পুরুষকে পুরুষ হতে বাধাই দিয়েছে চিরটাকাল। শালা আদম যা করেছিল, তা করেছিল, আদম মূর্খ ছিল বলে পরেশ কেন মূর্খ হতে যাবে? যতটুকু দাম মেয়েদের প্রাপ্য ঠিক ততখানি দাম-ই দেয় তাদের।
সেটুকুর এককণাও বেশি দাম দিতে রাজি নয় ও।
ভুটানি মেয়েটা পরেশের ঔদাসীন্যে ব্যথিত হয়। গতবছরও এসেছিল ওরা। তখনও হয়েছিল। মদ আর মেয়েমানুষ একসঙ্গে থাকলে, শুধু মদ নিয়ে সন্তুষ্ট কম পুরুষ-ই থাকতে চায়। এমন-ই জেনে এসেছে মেয়েটি রুপোপজীবিনী হওয়ার দিন থেকে।
পরেশ অন্যরকম। পরেশ, কড়ায় গন্ডায় নিজের ফেরত পয়সা বুঝে নিয়ে, মরা বিকেলের হলুদ আলোয় কমলা-রঙা মুখ ও বুকের ভুটানি মেয়েটির দিকে একবারও না তাকিয়ে মাচার দিকে ধীরপায়ে এগোতে থাকে। ওর বন্দুক ও সঙ্গে করেই এনেছিল। যমদুয়ারে এসে একমুহূর্তও বন্দুকটা হাতছাড়া করাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বন্দুকটা কাঁধের ওপর ফেলে, দু টি হাত লাঠির মতো করে শুইয়ে-রাখা বন্দুকের ওপর রেখে দিয়ে হাঁটে সে, ফিরে চলে বাথানের দিকে।
বেলা পড়ে এসেছে। ছায়ারা ঝুপড়ি হয়েছে। নিবাত নিষ্কম্প বন, ভরে উঠেছে নানারকম মিষ্ট-কটু-কষায় গন্ধে।
মাচার দিকে এগোতে দেখতে পেল পরেশ যে, ছাত্তার বন-বাংলো থেকে জিপে করে ক্যামেরন সাহেব আর সেই পাঞ্জাবি মেয়েটিকে নিয়ে মাচার দিকেই আসছে।
মাচা অবধি এলে জিপের শব্দে বাঘ যেখানেই থাকুক হুশিয়ার হয়ে যাবে। মাচা অবধি আসার মতো বোকামি ছাত্তার করবে না যে, তা পরেশ জানত। পরেশ ভেবে পেল না যে, বড়োবাঘ মারবে ক্যামেরন সাহেব, সঙ্গে ওই রিঙ্কি নামের মেয়েটি কী করতে আসছে?
বাঘ-শিকার খেলা নয়। এমনকী মাচায় বসে, বাঘ-শিকার দেখাটাও খেলা নয়। অনভিজ্ঞ বাক্যবাগীশেরা অর্বাচীনের মতন যা-খুশি বলতে পারেন। মাচাতে হেগে-মুতে দিতে দেখেছে। কত বড়ো বড়ো শিকারিকে, শুধু বাঘ দেখেই! বাঘ তো শুধু একটা জানোয়ার মাত্র নয়। বহু শতাব্দীর রূপকথা, লোকগাথা, কুসংস্কার আর ভয়ের জীবন্ত প্রতীক। প্রকৃত বুনো-বাঘ যখন প্রতিবারেই সামনে এসে দাঁড়ায়, স্যাংচুয়ারির বসে-খাওয়া, ঘাড়ে-গর্দানে-হওয়া বাঘেদের, কুলাঙ্গারদের কথা বলছে না পরেশ, তখন বুকের মধ্যে, পেটের মধ্যে যে, কী হয়, তা পরেশ-ই জানে।
যেসব আরামকেদারা-বাসী, কিতাব-দুরস্ত, সাহসী সমালোচক, মাচায় বসে বাঘমারা শিকারের মধ্যেই পড়ে না, একথা ঠেটি বেঁকিয়ে বলেন, তাঁরা বনের বাঘকে তার স্বাভাবিকতায় কোনোদিনও দেখেননি। স্যাংচুয়ারির বা চিড়িয়াখানার পোষা বাঘ নয়। জঙ্গলের আসল বাঘ। লজ্জাহীন মেয়েদের সব সৌন্দর্যই যেমন মাটি, পরাধীন এবং কোনোরকম ভয়ের কারণহীন বাঘেদের অস্তিত্বও তেমন-ই। ফাঁকা, মিথ্যে। তারা সত্যিই তাদের নিজ নিজ জাতের কুলাঙ্গার।
ভয়াবহতা না থাকলে, বাঘের বাঘত্বই লোপ পায়।
মাচা থেকে দু-শো গজ দূরে ওদের নামিয়ে দিয়ে জিপ ফিরে গেল বাংলোতে। পরেশ কাছে গিয়ে দেখল, ক্যামেরন আর রিংকি দু-জনেই নেশাতে একেবারে চুর। ক্যামেরনের হাতে একটি হুইস্কির বোতল। সবুজ চৌকো দেখতে বোতলটা। নাম অ্যানসেস্টর। রিঙ্কি মেমসাহেব পিঙ্ক-রঙের একটি টাইট ব্লাউজ পরেছে, পিঙ্ক-রঙা স্কার্ট। ব্লাউজের তলাতে কিছু পরেনি। বোঝা যাচ্ছে। ওই শহুরে, ইংরিজি জানা মেয়ের, মোমের তালের মতো বুকের চেয়ে, একটু আগে দেখা ভুটানি মেয়ের পাকা মাকাল ফলের মতো শক্ত, লাল বুকের সৌন্দর্য অনেক-ই বেশি। যদিও মেয়েদের বুকের দিকে চোখ পড়লেই পরেশের গা-গোলায়, বমি-বমি পায়। তবু চোখ পড়ে গেল বলেই দেখল।
নারীরা নরকের-ই কীট। ওর হাতে ক্ষমতা থাকলে পৃথিবীর সব মেয়েদের ও গুলি করে মেরে দিত। পুরুষদের এবং এই পৃথিবীর সমূহ সর্বনাশ করছে ওরা। ওদের প্রতি কোনো দুর্বলতাই নেই পরেশের।
ছাত্তার বলল, পরেশকে, সাহেবদের সঙ্গে তুই-ই বোস পরেশ, বড়োমাচাতে।
পরেশ তীব্র আপত্তি জানাল।
ওর বমিই হয়ে যাবে। কোনো মেয়ের শরীরের অত কাছে থাকলে, ঘেন্নাতেই ওর বমি হয়ে যাবে। কিন্তু ছাত্তার নাছোড়বান্দা। তা ছাড়া, ছাত্তার-ই তাকে সঙ্গে করে এনেছে। শিকারে কাউকে-না-কাউকে নেতা বলে মেনে নিতেই হয়। শুধু শিকার কেন, সমস্ত মারণযজ্ঞেই নেতার ভূমিকা থাকেই। সবাই যেখানে নেতা, সেখানে মারামারিটা প্রায়ই নিজেদের মধ্যেই ঘটে যায়।
অতএব ক্যামেরন এবং রিঙ্কি মেমসাহেবের টলমল পায়ে মাচার ওঠার পরেই পরেশকেও উঠতে হল। রিঙ্কি-মেমসাহেব যখন উঠছিল মাচাতে, দড়ি দিয়ে বানানো সিঁড়ি বেয়ে দুলতে দুলতে, তখন নীচে-দাঁড়ানো পরেশ তার গোলাপি স্কার্টের ফাঁকে তার গোলাপি উরু এবং নিতম্বর আভা দেখেছিল। তখন সংকোশ নদীতেও শেষ সূর্যের গোলাপি আভা। রিঙ্কি মেমসাহেব স্কার্টের নীচেও কিছু পরে নেই, বুঝেছিল পরেশ।
এই ঊরুর আভা দেখার পরমুহূর্ত থেকেই পরেশের বুকের মধ্যে একধরনের কষ্ট শুরু হল। সেই কষ্টর কথা ও আগে কোনোদিনও জানেনি। সে কষ্টটা, মেয়েদের প্রতিবছরের পর বছর ধরে জমিয়ে তোলা, ওর তীব্রঘৃণার চেয়েও অনেক বেশি তীব্ৰকষ্ট। সে-কষ্টের নাম ও জানে না। তাকে আগে জানেনি কখনো। এই কষ্ট নিশ্চয়ই কোনো রিপুজাত। সেই রিপুর সঙ্গে পরিচয় ছিল না আগে।
সত্যিই বড়ো কষ্ট হতে লাগল পরেশের।
বাঘটার আসার কথা, ভুটান পাহাড়ের দিক থেকে। পায়ের দাগ তাই-ই বলে। এমন গহন জঙ্গলে বেলা থাকতেই বাঘ এসে হাজির হওয়ার কথা। বিশেষ করে, আগের রাতের শেষে করা মড়ি খেয়েও গেছে একটুখানি। অতএব..।
সূর্য ডুবে গেছে কিন্তু পশ্চিমাকাশে গোলাপি আভা আছে এখনও। সংকোশ নদীর বুকে যে, নুড়িময় চর জেগেছে, এখন সেখানে একদল গোলাপি-মাথা বিদেশি হাঁস আর হাঁসী স্বগতোক্তি করছে, দিনশেষের আগে। তাদের ঠোঁট দিয়ে পালক পরিষ্কার করছে। মাচার ওপরের এই গোলাপি শরীরের হাঁসীটির-ই মতো, রিঙ্কি।
ঝিঁঝি ডাকতে আরম্ভ করেছে। সন্ধের ঠিক আগের মুহূর্তে বনের গভীরে আলো মরে যাওয়ার দুঃখে যে-রুদ্ধশ্বাস শোক পালিত হয় কয়েক মুহূর্ত; প্রাণী, পশু, গাছপালা যখন স্তব্ধ হয়ে থাকে স্বল্পক্ষণ, সেই মুহূর্তটিতেই এসে দাঁড়িয়েছে এখন দিন। এই মুহূর্ত পেরোলেই রাত নামবে।
ক্যামেরন আর রিঙ্কি বোতলটা থেকে ক্রমাগত খেয়েই চলেছে। খেয়ে, পরেশের উপস্থিতিতেই এমন এমন কান্ড করছে যে, পরেশের মনে হচ্ছে, ওরা যেন তাকেও কোনো পাথর বা গাছ বা ফুল বলে মনে করছে। মানুষ তো দূরের কথা, গাছেরাও যে, দেখতে পায়, তা কি ওরা জানে না। আর পরেশ তো মানুষ-ই। জলজ্যান্ত শক্ত-সমর্থ একজন মানুষ।
অন্য দিন হলে, ও ঘৃণাতে মুখ ফিরিয়েই থাকত কিন্তু আজকের এই নতুন অনুভূতি ওকে চোখ ফেরাতে দিচ্ছে না। ও যত ওইসব দেখছে, যতই বুঝছে যে, মাতাল বুড়োর দাঁতহীন কামড়ে এই যুবতী মেয়ের ছটফটানি যতই বেড়ে যাচ্ছে, ততই সেই ছটফটানিটা যেন পরেশের ভেতরে চাড়িয়ে যাচ্ছে।
আজকে কিছু একটা ঘটবে।
পরেশ নিজেকে বলল। মনে মনে। সত্যিই সাংঘাতিক কিছু ঘটবে। বাঘ শিকারে এসে আজ নিজেই শিকার হয়ে যাবে পঁয়ত্রিশ বছরের পরেশ। জঙ্গলের সব কিছুই ও জানে চেনে। এই নতুন গোলাপি মেয়ে জানোয়ারের দাঁত নখ-এর খবর-ই শুধু জানা নেই ওর। কীভাবে আক্রমণ করে তাও জানা নেই। আক্রমণ প্রতিহত করার প্রক্রিয়াও নয়।
অন্ধকার হওয়ার পর-ই বাঘটা ডাকল একবার। আশ্চর্য! বাথানের দিক থেকেই। মোষগুলোযে, বাথানের মধ্যে হুড়োহুড়ি করে, নাক দিয়ে মুখ দিয়ে নানারকম শব্দ করছে তা, এতদুরে বসেও শোনা গেল।
আশ্চর্য তো! বাঘটা কাল রাতে মড়ি করেছে, আসবেও এখানেই। তবুও মোষেদের বাথানের কাছে একবার না গিয়ে পারল না।
পরেশের মনে হল, রোজ-ই একবার করে ভয় দেখিয়ে যায় সম্ভবত বাঘটা, বাথানে মোষেদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করবার জন্যে। কুমারগঞ্জের মুদির দোকানি মধুদা যেমন রোজ-ই ধার দেওয়া বন্ধ করে দেবে বলে ভয়ে খাবি-খাওয়ায় পরেশকে। নখ-দন্তঅলা জানোয়ার আসলে শহরে-গঞ্জেই বেশি আছে জঙ্গলের চেয়ে। মধুদার মতো, ক্যামেরন সাহেবের মতো। তবে ওদের দাঁত-নখ দিয়ে ফালা ফালা করে দিলেও রক্ত পড়ে না। এই যা তফাত।
অনেকের দাঁত-নখে সত্যি ধারও থাকে না, যেমন ক্যামেরনের। কিন্তু তবুও দাঁত-নখ দেখিয়েই তারা সহজে কাজ হাসিল করে। আলমারিতে, ব্যাঙ্কে, তাকের পর তাক তাদের দাঁত-নখ সাজানো থাকে। কাগজে-ছাপা নখ, রুপোর দাঁত, সোনার থাবা। পরেশ জানে। জানে বলেই, বাঘের চেয়ে এদের অনেক-ই বেশি ভয় করে ওর। বাঘের ঘোঁৎ-ঘাঁৎ তো জানাই। কিন্তু এদের ঘোঁৎ-ঘাঁৎ জানা যায় না। সব শিকারের-ই নিয়মকানুন থাকে। শিকারি এমনকী শিকাররাও সেই অলিখিত নিয়মকে মেনে চলেই। কিন্তু এইসব শিকারিরা কোনো নিয়ম, কোনো বিবেকের-ই ধার ধারে না।
ঘনান্ধকার নেমে এসেছে এখন। জঙ্গলের চন্দ্রাতপের নীচে অন্ধকার গাঢ়তর হয়েছে। একটা ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা ভাব। রাতপাখিরা ডাকছে থেকে থেকে। অনেক পাখি। ছাত্তার ওদের সকলের নাম-ই জানে। পরেশ ডাকগুলো চেনে; কিন্তু নাম জানে না।
বাথানের কাছ থেকে সেই যে, ডেকেছিল বাঘ, সেই ডাক থেমে গেছে অনেকক্ষণ। এবারে সে বোধ হয় মড়ির কাছাকাছিই এসে গেছে। খুব-ই সন্তর্পণে আসবে। চারদিক দেখে নেবে। অসম্ভব না হলে, গোল করে চক্কর মারবে চারদিকে। তারপর মড়ির কাছে কোনো বিপদ যে নেই, সে-সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হলেই মড়িতে আসবে। সন্দেহ যদি একটুও হয়, তাহলে সে ফ্রিজ করে যাবে, সিনেমার শট-এর মতন। নাম বাঘ। তার ধৈর্যর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এক-ই জায়গাতে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে হয়তো, মাচার কাছেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ছায়ার সঙ্গে মিশে থাকবে। ও জানোয়ারের চরিত্রে কোনো তাড়াহুড়ো নেই। পৃথিবীর সবটুকু সময়কে তার থাবার নীচে নিয়ে বসে থাকে সে। হঠকারিতা তার চরিত্রেই নেই।
সেই কারণেই বাঘে-করা মড়ির ওপরে ধ্যানে-বসা মুনি-ঋষিদের-ই মতো নীরব, নিষ্কর্ম হয়ে বসে থাকতে হয় শিকারিকে। কিন্তু পরেশের মাচায় যেসব কান্ড-মান্ড চলছে–হি-হি হা-হা, উঃ-উঃ-ইঃইঃইঃ, কাতুকুতু, সুড়সুড়ি, ফু:, তার বিচিত্র আওয়াজে বাঘ তো দূরস্থান বনবেড়ালও মাচার এক মাইলের মধ্যে আসবে বলে মনে হচ্ছে না আজ রাতে।
ছাত্তারকে অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না। তবে কোনোই সাড়াশব্দই নেই ছাত্তারের মাচা থেকে। কী করছে সে, ভূতের মতন নিঃশব্দ নিঃসাড় হয়ে, তা সেই জানে। সেও আজ বাঘ। হয়ে গেছে।
ছাত্তার আধ ঘণ্টাটাক পরে চেঁচিয়ে বলে উঠল, এই পরেশ। এই হারামজাদা কি বাঘ মাইরবার লইগ্যা আইছে যমদুয়ারে? না লদকা লদকির লইগ্যা? যে-জিনিস খাটে শুইয়াই করন যায়, তা করনের লইগ্যা সেগুন গাছের মাচার কী কাম বুঝি না। চল চল। লাম। ফিইরা যাই চল। কী খিটক্যাল। কী খিটক্যাল। ওই বুড়ার মাগ্যে আমিই গুলি করুম আজ। দেইখ্যা লইস তুই। হালায় হারামির পুত।
পরেশকে মাচা থেকে নামতে দেখেই ক্যামেরন হাঁ হাঁ করে উঠল। বলল, হামারা টাইগার কঁহা? টাইগার?
ছাত্তার তার মাচা থেকে নামতে নামতে, নিজস্ব ভাষায় নিজের মনেই বলল, ওই ম্যামছাহাবের দুই ঠ্যাঙের ফাঁকে ভালো করি দ্যাখবার কয়্যা দে পরেশ, হারামি ছাহেবরে। বাঘ মারন লাগব না আর। তার বাঘ সেখানেই শুইয়া আছে। এ হালার লাইন-ই ভিন্ন। ছ্যা: ছ্যা:। টঙে বইস্যা।
ছ্যা: ছ্যা: পরেশের গা ঘিন ঘিন করে উঠল। এক বিচ্ছিরি দৃশ্য। তায়, এত বিচ্ছিরি করে তার বর্ণনা দেওয়া।
পরেশ আসলে কবি। প্রকৃতিপ্রেমিক। ওর সূক্ষ্মরুচিতে বড়ো ধাক্কা লাগল।
গাছ থেকে নেমেই ওয়াক ওয়াক করে বমি করে ফেলল পরেশ। পরেশ আবার পুরোনো পরেশ হয়ে গেল। ছাত্তার-ই তাকে ফিরিয়ে আনল ওইরকম বর্ণনা দিয়ে। ভালোই হল। পরেশ যা নয়, তাই হতে যাচ্ছিল। পরেশ যা ছিল, তাই হতে পেরে; খুশি হল খুব। প্রচন্ড নারীবিদ্বেষ আবার স্বাভাবিক করে তুলল তাকে।
ক্যামেরন, রাইফেল তুলল মাচাতে বসেই পরেশের দিকে। বলল, কাম আপ ইউ সান অফ আ বিচ। হোয়্যারস মাই টাইগার?
ছাত্তার ততক্ষণে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে পরেশের।
সে মুখ তুলে বলল, ম্যামসাহেবের ঠ্যাঙের ফাঁকে তর বাঘ আছে হারামির পুত। বড়োবাঘ মারতে আইছে হালায়।
ক্যামেরন রাইফেলের নল তুলল ওদের দিকে।
মাতালের ঠিক নেই। সব মাতালের তাল ঠিক থাকে না। কী করতে কী করে বসে। মুহূর্তের মধ্যে ছাত্তার তার বন্দুক তুলে গুলি করল ওদের দিকে। গুলি Ball ছিল। সেটা গিয়ে গাছের কান্ডে লাগল ক্যামেরনের মাথার একহাত ওপরে। ছাত্তার যেখানে মারতে চেয়েছিল, সেখানেই লাগল।
রিঙ্কি আর্তনাদ করে উঠল। ক্যামেরনও। পরক্ষণেই ক্যামেরন গুলি করল রাইফেল দিয়ে। গুলিটা ওদের তিনহাত বাঁ-দিকে, শালের চারাগাছে পড়ল। মাটি ভেদ করে গেল।
রাইফেলের বজ্রনির্ঘোষ গমগম করে ফিরে এল ভুটানপাহাড় থেকে।
ছাত্তার বলল, চল পরেশ, পালাই। এ হালার মাতালের ঠিক নাই। তায়, হাতে আবার ম্যাগাজিন রাইফেল। যদি গুলি লাইগ্যা যায় আন্দাজে। কওন ত যায় না। কপাল যখন খারাপ হয়, তহন…
ওরা এঁকে-বেঁকে দৌড়োতে লাগল বাংলোর দিকে।
দৌড়োত দৌড়োতে ছাত্তার বলল, হালার পুত এর নিশানাখানা দ্যাখছস। মাচার এক্কেরে নীচে খাড়াইয়া ছিলাম, তাই আমাগো তিনহাত বাঁয়ে ফ্যালাইল রাইফেলের গুলিখানরে। হালায় বড়োবাঘ মারে! খাউক! খাইয়া ফালাক হালারে বাঘে। খুব-ই খুশি হমু অনে।
–এখন কী করবে ছাত্তার! তুমি যে, ওই গুলিটা ওকে ভয় পাওয়াবার জন্যেই করেছিলে, তা তো ও বিশ্বাস করবে না। থানায় গিয়ে বলবে, আমরা ওকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম।
পরেশ, চিন্তার গলায় বলল।
-কউক না। যদি থানায় যায়, হালারে সত্যিই আমি জানে মাইরা থুমু।
–তা তো! কিন্তু এখন কী করবে?
–এখন চল, জিপ চইড়া একটু হাওয়া খাইয়া আসি।
–যাইবা কই?
–রাইমানায় চল। বড়োই রসগোল্লা খাওনের ইচ্ছা করতাছে আমার।
–পাগল হইল্যা নাকি তুমি মিয়া?
-পাগল ক্যান হমু? জিপ লইয়া আমরা ঘুইর্যা-ফিইর্যা শ্যাষরাতে মাচার কাছে ফিইর্যা যামু। ওই হালার ক্যামেরনের সাধ্য আছে নাকি এই জঙ্গলে মাচা থিক্যা নাইম্যা ওই মাইয়ারে সঙ্গে লইয়া বাংলোয় ফিরনের? ভয়েই মইর্যা থাকব অনে পথে। যতক্ষণ আমরা না যামু, ততক্ষণ-ই হালার শাস্তি।
–লাভ কী অইলো? বাঘ ত মারা হইলো না। টাকাটা ত দিব না। শুদামুদা হয়রানি।
-থাম ত। বাঘ মারতে কী লাগে? ওর লইগ্যা মারলে মারুম। যদি হালায় টাকা দ্যায়। নইলে বাঘ এমনিই মাইরা, চামড়া বেইচ্যা দিমু অনে লহর শ্যাখরে। ধুবড়িতে। চইল্যা যাইব গিয়া সে চামড়া, গৌহাটি। আমেরিকানরা বহুত-ই দামে লইয়া যাইব গিয়া। যে টাকা, ওই ক্যামেরনে দিত, চামড়া বিক্রি কইর্যা তার থিক্যা অনেক-ই বেশি পামুনে। টাকা টাকা করস ক্যান? আমরা কি ভিখারি? যদ্দিন হাতে বন্দুক আছে, তদ্দিন না খাইয়া মরুম না। শুনছস? কান খুইল্যা শুইন্যা রাখ।
হ, পরেশ বলল, মাথা নীচু করে।
বাংলোতে পৌঁছেই দেখল, ড্রাইভার উৎকর্ণ হয়ে বসে আছে। ড্রাইভারও ধুবড়ির। সাহেব তো ভাড়ায় এনেছে জিপ, ধুবড়ি থেকে। ড্রাইভার আনসারকে বলল ছাত্তার, চল রে আনছার ভাই, রসগোল্লা খাইয়া আসি।
ড্রাইভার আনসার বলল, চিন্তিত গলাতে, সাহেব যদি ভাড়া-মাড়া লইয়্যা গোলমাল করে? ও ছাত্তার ভাই। পরে সামলাইব কেডায়?
–ছাড়ান দে তো। ওর পেন্টুলুন খুইল্যা ফ্যালাইম না। মাগিটারে রাইখ্যা দিমু অনে। তারপর নেপালিগগা বাথানে পৌঁছাইয়া দিয়া আসুম। এক্কেরে ঘিই-বানাইয়া থুইব তারা অরে। ওইসব পিঁয়াজি আমার থনে মারন লাগব না। আমার নাম আবু ছাত্তার। হালার ক্যামেরনের কি চিনন বাকি আছে নাকি আর আমার? মুই ভালোর সঙ্গি ভালো, খারাপের সঙ্গি যম। হঃ। হালায় ভালো কইরাই জানে তা। কুননাই চিন্তা নাই তগো। চল চল, রসগোল্লার লইগ্যা মনটা হাঁচোর-পাঁচোর করতাছে।
খুব জোরে জিপ চালিয়ে আনসার যখন রাইমানাতে পৌঁছোল, রাইমানার ছোট্টমিষ্টির দোকানের মালিক, দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে, বাড়ি যাওয়ার তোড়জোড় করছিল।
ঠিক সময়েই ওরা গিয়ে হাজির। রসগোল্লা গরম-ই নেমেছিল সবে।
আনসার বলল, যা হইল্যো তা ভালোর-ই জন্য। মোর প্যাটটা নরম হয়্যা ছিল সকাল থিক্যা। ধইর্যা যাইব গিয়া গরম রসগোল্লা খায়্যা।
দোকানের মালিক ঘাঁটু বলল ছাত্তারকে, খান খান যতগুলা খুশি খান। পয়সা কিন্তু নিমু না।
–ক্যান? পয়সা নিবি না ক্যান? আমরা কি তোর কুটুম?
-কুটুম না অইলে হয় কী! সেই মাঘমাসে আইছিলেন না ছাত্তারদা। যা হরিণের মাংস খাওয়াইছিলেন, কী কম। আমার বউ তো কয়, মুখে লাইগ্যা আছে এহনও। এবারে কী হইল শিকার? কারে লইয়া আইছেন?
পরেশের মুখটা চিরদিন-ই খারাপ।
বলল, এবারে যা শিকার হইতাছে, তা খাইলে তোমার প্যাটও নরম হইয়া যাইব গিয়া ঘাঁটু, আনসারের-ই মতন। সব খাদ্য, সব শিকার; খাইতে পারে কি হক্কলে? ত্যামন ত্যামন খাদ্যর লইগ্যা, ত্যামন ত্যামন প্যাটের দরকার।
ঘাঁটু কথার মানে না বুঝে, হাঁ করে চেয়ে রইল পরেশের মুখে।
ছাত্তার মুখভরা রসগোল্লা নিয়ে মুখ-বন্ধ-করা অবস্থাতেই ফিচিক-ফিচিক করে হাসতে লাগল।
এমন সময় বাসটা এল। শেষ বাস। জানলার খড়খড়ি খড়খড়িয়ে গ্যাটিস লাগানো টায়ারে ভটর-ভটর আর ঢিলে বনেটে ঝ্যাকর-ঝ্যাকর শব্দ করে, পেট্রোল-ট্যাঙ্কের মুখ থেকে উপছে-পড়া পেট্রোলের তীব্ৰমিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে।
বাসটা মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়তেই ড্রাইভার, বয়েস-হয়ে-যাওয়া বাইজির পেল্লাই মাই-এর মতো চামড়া ফাটা-ফাটা বালব-হর্নটি জম্পেশ করে ধরে, তিনবার টিপল, প্যাঁকু-প্যাঁকু-প্যাঁকু।
রওনা হবে আবার উলটো পথে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নির্জন পথ। প্যাসেঞ্জার বেশি থাকলে সাহস হয়। এই দিকে নেই, এমন জানোয়ারও তো নেই।
বাসটার দিকে চেয়ে থেকে রসগোল্লা খেতে খেতে হঠাৎ-ই পরেশ উঠে দাঁড়াল তোক করে। ঘটি চেয়ে, হাতটা পথে ধুয়েই বলল, ছাত্তার ভাই, আমি চলি। ডাক আইছে আমার। দাদায় আমারে ডাকে। তুমি ওই ম্যামসাহেব আর বুড়ারে সামলাইনে।
ছাত্তার ভুরু তুলে তাকাল একবার ওর দিকে।
পরেশ ততক্ষণে বেরিয়ে পড়েছে দোকান ছেড়ে, ড্রাইভারের পাশের ভালো সিটে বসবে বলে। বাসের ড্রাইভারও বন্দুক-কাঁধে পরেশ শিকারিকে দেখে খুশি হল। এই রাস্তায়, সঙ্গে শিকারি থাকলে বুকে বল লাগে। বড়োবাঘ, পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রায়ই হুয়াও-হুঁয়াও করে।
ড্রাইভার বলল, আজ কিন্তু তামাহাটেই থাকন লাগব পরেশদা। বাস তো ওই অবধিই যাইব।
–তুই থাকবি কই?
–আমি তো গুলাবচাঁদজির গদিঘরে শুইয়া থাকুম। বারান্দায় খাঁটিয়া টাইন্যা লইয়া। গরমের দিনে শোওনের চিন্তা কী?
–আর খাওন-দাওন?
–গুলাবচাঁদজির শেঠানি পুরি-তরকারি দিয়ে অনে। ফুট-ফরমাশ খাইট্যা দিই না কত্ত? ধুবড়িতে পুৰ্চা পৌঁছাইয়া দ্যাও, কচুগাঁতে মাইয়ার বাড়ি আচার পৌঁছাইয়া দ্যাও, কারিপাতা গাছ থিক্যা পাতা ছিইড়া আনো বন খুঁইজা। খাওইব না ক্যান? ভাবনা কী? আপনেও খাইবেননানে আমার লগে।
–নাঃ আমি মনা মিত্তিরের বাড়ি চইল্যা যামু।
–মনা মিত্তির নাই। ধুবড়ি গ্যাছেন গিয়া।
–বাচ্চু আর পাঁচু তো থাকব। মানিকদায়, গল্প করে ভারি মজার। কী কও পাঁচু?
–হঃ। যা কইছেন পরেশদা। ওয়ার-রিটার্ন মানুষগুলানের ব্যাপার-স্যাপার-ই আলাদা। কী কন?
-হ। এক্সপিরিয়েন্স-এর দাম নাই? পুরুষ মানষে যদি দুনিয়াই না দ্যাখল, তয় কইরবার মতো কইরলটা কী?
আনসার অবাক হয়ে পরেশের দিকে তাকিয়ে ছিল। মানে, বাসটার দিকে। পরেশের কম্বল, সুজনি, বালিশ সব পড়ে আছে নেপালিদের বাথানেই। জঙ্গলে তখনও রাতে বেশ ঠাণ্ডা। লোকটা বলা নেই, কওয়া নেই অমন হুট করে চলে গেল! আরও অবাক হল ও, ছাত্তার ভাইও ওকে কিছুই বলছে না বলে।
রসগোল্লা খেয়ে ছাত্তারও হাত ধুয়ে বাসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরেশকে বলল, ফিরনের পথে কুমারগঞ্জে তর সঙ্গে দেখা কইরা যামু আনে।
–দেখি, কী হয়।
–যা হয় অইব। তোমারে কি অবিশ্বাস করি আমি?
–না। সেকথা…
–ঠিক আছে।
–যাই।
–যাওন নাই। আসো।
জিপটা চলে গেল। একটু গিয়েই, বন বিভাগের চেক-নাকাটা পেরিয়েই, টপ-গিয়ারে ফেলে, হেডলাইটটা ডিপার করে দিল আনসার। তারপর গভীর বনের মধ্যের রাস্তায় জিপের স্পিড বাড়িয়ে বলল, অদ্ভুত মানুষ এই পরেশদা। না, ছাত্তার ভাই।
রসগোল্লা খেয়ে ছাত্তার মুখে গুয়া-পান দিয়েছিল।
বলল, সব মানুষ-ই অদ্ভুত। মানষের ছা তো আর জানোয়ারের ছা লয় যে, একইরকম অইব। আমাগো পরেশ হইল গিয়া পোয়েট। ভাবুক। যহন অর যা মুড হয়, বাবু ঠিক তহন-ই তাই করেন। আমারও খুব ইচ্ছা যায়, পরেশ হইয়া যাই। কিন্তু ঘরে বিবি আছে, পোলা-পান; ক্ষুধা; এইটা চাই, ওইটা চাই। এই জীবনে যহন যা ইচ্ছা করে, তাই-ই করনের মতো কঠিন কাম আর কিছু নাই রে আনসার। আমরা পারি না, পারি নাই; পরেশ পারছে। লোকে ওরে ভ্যাগাব, দায়িত্বজ্ঞানহীন, লোফার কয়। কয় তো কয়! হ্যাঁতে পরেশের কিছুই যায়-আসে না। নিজের জীবনের স্টিয়ারিং অর নিজেরই হাতে। আমাগো মতন বেড়ি নাই দ্যাখ, তুই জিপ চালাইতাছস আর আমি বইস্যা আছি তোর পাশে।
নিজের জীবনের গাড়ি নিজে চালাইতে না জানলে শুদামুদা বাঁইচ্যা কোনোই লাভ নাই।
লোক ভরে যেতেই, বাসটাও ছেড়ে দিল।
পরেশ, ড্রাইভারের পাশে বসে ভাবছিল, দাদার অসুখের কথা মনে পড়াতেই যে, ও ফিরে যাচ্ছে। শুধু তা নয়, তা ছাড়াও আরও কিছু ছিল।
ওই রিঙ্কি মেয়েটার শরীর ওর সমস্ত শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিল। এমন যন্ত্রণা ও কখনো ভোগ করেনি। মেয়েরা হল গিয়ে পুরুষের শত্রু। ওদের ওই শরীরের মধ্যে জাদু আছে। পুরুষ হল, বহির্মুখী জীব। বনে-পাহাড়ে বন্দুক হাতে ঘুরে বেড়ানোই তার কাছে জীবনের সব। ওই মেয়েটা তাকে বন্দি করতে চেয়েছিল, না চেয়েই। অনেক বিপদের হাত থেকে বেঁচে সে, এই পঁয়ত্রিশ বছর পথ পেরিয়ে এসেছে। ওই লোভের পথে পা বাড়াবে না বলে, নিজের ভেতরে এই মেয়ে জাতটার প্রতি এক গভীর ঘৃণা জমিয়ে তুলেছে ও। সংসার, ছেলে-মেয়ে, রান্না বান্না, অসুখ-বিসুখ এসব সে দাদার পরিবারে থেকেও জেনেছে। ওপর ওপর দাদার জন্যে বউদির জন্যে যতটুকু পেরেছে, করেছে। টাকাপয়সা, তারা যা দেয়, তার থেকেও বেশি দিয়েছে চিরদিন। কোনো গদিতে থাকলে ওর চেয়ে কম খরচে ওর চলে যেত দিন। বিবেকের কারণেই পারেনি। তবে নিজের সংসার করার মতো মূর্খামি এতখানি পথ পেরিয়ে এসে, সে করতে রাজি নয়। তা ছাড়া ও মেয়ে তো সংসারের মেয়ে নয়। বাজারের মেয়ে। যাদের নষ্ট করার মতো অঢেল টাকা আছে ক্যামেরনের মতো, তারাই পারে ওরকম বাজারি মেয়ের সঙ্গে বাজার করতে। ওইসব মেয়ের ধর্মই পুরুষকে নষ্ট করা। যার ঘর আছে, তার ঘর ভাঙা। যার ঘর নেই, তাকে ঘরের মিথ্যে স্বপ্ন দেখানো। বেঁচে থাকলে, শিকার অনেক-ই করবে, টাকাও রোজগার করবে শিকার করে। মানে মানে প্রাণ নিয়ে, তার স্বাধীনতা নিয়ে, সে তাই পালিয়ে এসেছে।
পরেশ ভাবছিল, তার শরীরটা তার সঙ্গে এই প্রথম বেইমানি করল। তার শরীরমধ্যে এত হাজার কাঁকড়া ঘুমিয়ে ছিল, তাদের দাঁড়ার কামড় যে, এমন-ই ভীষণ; তা আগে কখনো জানেনি ও। খোলা হাওয়ায় শেষচৈত্রর বনের রাতের গন্ধে, পরেশের মন আবার খুশিতে ভরে উঠেছে।
ড্রাইভার বলল, বিড়ি খাবা নাকি একটা পরেশদা?
–দ্যাও।
বলে, পরেশ হাত বাড়াল।
তারপর বিড়িটা, হাওয়া আড়াল করে ধরিয়ে, জোর ধোঁয়া ছাড়ল একবুক।
–আঃ। শান্তি; বড়ো শান্তি। বড়ো আনন্দ এই আগল-খোলা, বাঁধন-হারা জীবনে। এই শান্তির কথা ঘরে, ঘরে নিজের নিজের বউ নিয়ে জাবর-কাটা, খোঁটায়-বাঁধা পুরুষেরা কল্পনাও করতে পারে না।
শিলি নদীতে চান করতে গেছিল আজ। বহুদিন পরে।
পাশের বাড়ির মুনিয়াও গেছিল সঙ্গে। ও বলল, বাড়িতে অনেক কাজ। তাই তাড়াতাড়ি চান সেরে উঠে চলে গেছে আজ ও।
রোজ তো বাড়িতে চান করে। ভোলা কুয়োর জলে, ঘেরা বাথরুমে। সপ্তাহে একবার করে আসে নদীতে। ভালো করে পা ঘষে, মাথা ঘষে, সঙ্গে কেউ থাকলে, তাকে বলে পিঠে সাবান দিয়ে দিতে। তারপর অনেকক্ষণ সাঁতার কাটে। নদীর স্রোত তার উলঙ্গ শরীরের আনাচে কানাচে বয়ে যায়। অননুভূত অনুভূতিতে সারাশরীর আরামে আবেশে ভরে যায়। জলের যে, কত সহস্র হাত, আঙুল তা যারা নদীতে অবগাহন না করেছে তারা জানে না। তার শরীরের গোপন, অসূর্যম্পশ্যা জায়গাগুলি সেইসব আঙুলের আদরে শিরশির করে ওঠে। ভালোলাগায় মরে যায় শিলি। কত কী কল্পনা করে সেইসব মুহূর্তে, কত সব স্বপ্ন সত্যি হয়ে ওঠে। যেসব স্বপ্ন, শিশুকালের পুতুল খেলার দিন থেকে প্রত্যেক মেয়েই বুকে করে বড় হয়; সেইসব স্বপ্নই জলের তলায়, দুপুরের নিরিবিলিতে সত্যি হয়ে উঠতে থাকে এক এক করে।
মাঝে মাঝে ডুব দিয়ে অনেকক্ষণ থাকে জলের তলায় চোখ খুলে। জলের নীচের হলদেটে সবজে আলো প্রতিসরিত হয়ে গিয়ে, তার দু-চোখের মধ্যে দিয়ে তার মস্তিষ্কের ভেতর নানা নরম রং ছড়িয়ে দেয়।
দুপুরের এই সময়টা নদীপারে কেউই থাকে না। কোনো নৌকোও এই সময় থাকে না নদীতে। জোয়ারভাটা দেখেই ওরা তরী বায়। সকালে জোয়ারে ভেসে যায়, বিকেলে ভাটায় ফেরে।
শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ সব নদীপারের একটি ঝোঁপের ওপরে খুলে রেখে এসেছিল। চান করে যে, নতুন শাড়ি পরবে, তাও। যখন-ই আসে, তখন এমন-ই করে।
জলে অনেকক্ষণ পড়ে থাকার পর যখন তার হাত-পায়ের আঙুল, মুখের চামড়া ঢেউ খেলানো হয়ে গেল, শরীরে নদীর সব স্নিগ্ধতা বসে গেল, তখন-ই শুধু নদী ছেড়ে উঠল ও। জল ছেড়ে নগ্ন, রোদ-পিছলানো শরীরে ও যখন ঘুঘু-ডাকা নদীপারে উঠে আসে জল ঝরাতে ঝরাতে, তখন প্রতিবারেই ওর মনে হয়, ও যেন কোনো জলকন্যা। জলের নীচের কোনো প্রাসাদেই বুঝি ওর বাস। মাটির কোনো রাজপুত্রর দেখা পাবে বলেই যেন, ও মাঝে মাঝে এই মাটির, গাছগাছালির, পাখপাখালির পৃথিবীতে উঠে আসে।
ঝোপটার কাছে তখনও ও এসে পৌঁছোয়নি এমন সময় একটা মাদার গাছের ঝুপড়ি ডাল থেকে কে যেন, মোটা কর্কশ গলায় ডেকে উঠল, শিলি।
চমকে উঠে, প্রথমেই দু-হাত দিয়ে বুক আড়াল করল শিলি। পরমুহূর্তেই বুক খোলা রেখে ও ঊরুসন্ধি ঢাকল দু-হাতে। মেয়েদের শরীরের কোন জায়গাটা যে, বেশি গোপন, পরকে দেখানোতে বেশি লজ্জা; তা বুঝি ক্ষণেকের জন্যে বুঝে উঠতে পারে না ও।
ততক্ষণে গদাই ঝুপ করে গাছ থেকে লাফিয়ে নামে। একটা নীলরঙা টুইলের শার্ট ওর গায়ে। মিলের ফাইন ধুতি। সে শিলির দিকে দৌড়ে এসে যে-ঝোপে ওর শাড়িটাড়ি ছিল, সেই ঝোপটার আর শিলির মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে। ওর চোখে-মুখে মুগ্ধ, লুব্ধ দৃষ্টি। জড়িয়ে জড়িয়ে বলে, একটিবার হাত সরা শিলি। তোকে একবার দেখি ভালো করে।
শিলি গর্জে উঠে বলে, অসভ্য। জানোয়ার। দাঁড়াও। কাকাকে বলে দেব। কাকা তোমাকে কুকুরের মতো গুলি করে মারবে।
সরল শিশুর মতো মনের গদাই বলে, শুধু একটু দেখতে চাওয়ার জন্যে পরেশ কাকু গুলি করে মারবে আমাকে? তুই বড়ো কৃপণ রে শিলি! যা নদী দেখল, মাছ দেখল, দেখল জলের শুশুক, এতবড়ো আকাশ যা দেখল, দেখল এত এত গাছ আর পাখি, দেখল আকাশভরা রোদ, তাই দেখতে চাওয়ায় এতবড়ো শাস্তি আমার?
–একবার দেখতে দে শিলি। তোর পায়ে পড়ি। গদাইকে অপ্রকৃতিস্থ দেখাল।
শিলি, এক ধাক্কায় গদাইকে সরিয়ে দিয়ে শাড়ি, জামা সব তুলে নিয়ে দৌড় লাগাল কোনো নিরাপদ আড়ালে গিয়ে ওগুলো পরে নেবে বলে।
আশ্চর্য! গদাই তার পেছনে পেছনে এল না। কোনোরকম অসভ্যতা করল না। শুধু মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে থাকল শিলির দিকে। জল-ভেজা ছিপছিপে কালো, লাফিয়ে-ওঠা শিঙি মাছের গায়ে রোদ পড়লে যেমন চেকনাই ওড়ে, তেমন চেকনাই উড়ল দৌড়ে যাওয়া উলঙ্গ জল-ভেজা শিলির উড়াল শরীর থেকে। পেছনটাও কী সুন্দর। মনে মনে বলল, গদাই। তারপর স্তব্ধ, মুগ্ধ চোখে গদাই চেয়ে রইল, যেদিকে শিলি গেল।
গদাইও কবি। পরেশের-ই মতো। একজন নারী-প্রেমী কবি। অন্যজন নারী-বিদ্বেষী।
গদাই ভাবে, কবি এই দুনিয়ার সকলেই। কেউ কাগজে কবিতা লেখে, কেউ মনে মনে। কেউ কবিতা পাঠায় সম্পাদকের দপ্তরে, কেউ মাকাল গাছের পাতা ছিঁড়ে অদৃশ্য মনের কালিতে সেই গোপন গা-শিউরানো কবিতা লিখে ভাসিয়ে দেয় নদীর জলে। কবিতার যে অনুপ্রেরণা, তার-ই উদ্দেশে, নৈবেদ্যর মতো। বিজয়া দশমীর দিনে পলতেতে আগুন জ্বালিয়ে প্রদীপ ভাসায় যে-মেয়েরা, তারাও গদাই-এর-ই মতো কবিতাই লেখে, প্রদীপের আগুন-রঙা কালি দিয়ে জলের কাগজে। ভাবছিল গদাই।
সবুজ গাছগাছালির মধ্যে ত্রস্ত হরিণীর মতো ছুটে-যাওয়া শিলির দিকে শুভকামনা, মুগ্ধতা, নীরব স্তুতিতে নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকে গদাই, অনেকক্ষণ। নদীর ওপার থেকে উড়ে-আসা শঙ্খচিল ডাকতে ডাকতে উড়ে যায় শিলির মাথার উপর দিয়ে। বহুদূর থেকে নিঃশব্দে গুণ টেনে বাদামি পালতোলা নৌকোকে স্রোতের মুখে আসতে দেখা যায়। আঁতকে ওঠে শিলি। আজ বড়ো বেশিক্ষণ জলে ছিল। নইলে নৌকো আসার সময় তো এ নয়।
গদাইও মনে মনে গুণ টানে। বাদামি পাল তুলে দেয় তার মনের নৌকোয়। জোরে হাওয়া এসে লাগে তাতে। যে-হাওয়াতে জল-ভেজা শিলির নগ্নতার গন্ধ, সেই হাওয়া নাকে নিয়েই ভালোলাগায় মরে যায় গদাই।
তারপর গদাই-লশকরি চালে, বাড়ির দিকে হাঁটে। গদাই মনে মনে ভাবে, শিলিকে বউ না করতে পারলে, তেঁতুলগাছ থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলবে ও। শিলিকে ছাড়া ও থাকতে পারবে না। ও যে কত ভালো, শিলিকে-যে ও কত ভালোবাসে তা শিলিকে নিয়ে তার দোরবন্ধ ঘরের পালঙ্কে না শুতে পারলে, কী করে বোঝাবে শিলিকে?
গদাই-এর বুক ভেঙে এক মস্ত দীর্ঘশ্বাস উঠে এসে চৈত্র দুপুরের ঘুঘুর ঘুঘু-র-র-র–ঘু ঘু-র-র-র, ঘুঘুর-র-র-র বিধুর স্বরের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে যায়।
ঝিকা গাছের ডালে বসে বউ-কথা-কও কথা-কও-বউ-কথা-কও।
গদাই না বলে বলে, ও বউ কথা কও। কথা কও। কথা কও না ক্যান?
হাঁফাতে হাঁফাতে বাড়ি ফিরতেই শিলির বাবা বলেন, চান করতে কতক্ষণ লাগেরে তর? তুই কি রাধা হইলি? কোন কৃষ্ণ বইস্যা থাকে তর চান-দ্যাখতে, কদমের ডালে?
ধক করে ওঠে শিলির বুক। থরথর করে ঝড়ের গাছের মতো বুক কাঁপে তার।
বাবা কি জেনে গেছে?
নরেশ বলেন, ক্ষুধায় প্যাট চুই চুই করে। পরেশ আইস্যা বইস্যা আছে। রাঁধন-বাড়নের কাম নাই।
শিলি নীচু গলায় বলে, সব-ই তো রাইন্ধ্যা থুইয়াই গেছি। খালি, গরম গরম ভাত লামাইয়া দিমু আনে পাঁচ মিনিটেই।
বলেই, রান্নাঘরে ঢোকে ও।
হাঁসের ঘর থেকে দুটো মুরগি কঁক-কঁক করে ওঠে। ওদিকে চোখ তুলে চায় শিলি অবাক হয়ে। মুরগি এল কোত্থেকে?
নরেশ বলেন, পরেশ আনছে তামাহাট থিক্যা। আজ হাট ছিল। রাতে মুরগির ঝোল আর ভাত রাঁধিসানে। ক্যাবলারে কইয়া বিকাল-বিকাল ওগুলানরে কাটাইয়া থুস।
শিলি ভাবে, খাওয়া ছাড়া বাবার আর কোনো চিন্তা নেই। শুধু খাওয়া আর খাওয়া। ম্যালোরির জ্বর ছাইড়া যাওনের সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষুধা আরও জোর হয় য্যান।
এবার ভাত চড়িয়ে দেয় শিলি রান্নাঘরে গিয়ে। চাল ধুয়েই রেখে গেছিল। ঘি-এর ভান্ডটা কাত করে দেখে, কতখানি ঘি আছে। তেলের শিশিটা, রান্নাঘরের বাঁশের ছ্যাঁচা-বেড়ার দেওয়ালে গোঁজা ছিল। সেটাতেও একবার চোখ বোলায়। গরম গরম ভাত। মুসুরির ডাল। কড়কড়ে করে আলু আর বেসন-দেওয়া কুমড়োশাক ভাজা। আর সঙ্গে কাঁঠালের বিচি ভাজা।
এই আজকের রান্না।
রান্নাঘর থেকেই, উনুনের সামনে আম-কাঠের ছোটোচৌকিতে বসে বলে, কাকায় গেল কই? ভাত নামাইলে তো ঠাণ্ডা হইয়া যাইবানে।
-আইতাছে আইতাছে। নদীতে গেছে চান কইবার লইগ্যা।
–নদীতে?
বুকটা ধক করে ওঠে শিলির।
বলে, আমি তো আইতাছি নদী থিক্যাই। তারে দেহি নাই তো!
–কোন নদীতে আর কোন পথে গেছিলি তুই, তা তুই-ই জানস।
শ্লেষের সঙ্গে বলেন নরেশ।
শিলির শরীরের সব জলীয় ভাব, উরুসন্ধির জলজ স্নিগ্ধতা সব কাঠের উনুনের তাপে শুকিয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে। অনেকখানি ভয়েও।
হঠাৎ-ই বাইরে উঠোনে, পরেশের গলা শুনতে পেল ও।
পরেশ বলল, কই গেলিরে শিলি? দ্যাখ, কারে লইয়া আইছি?
শিলি কোমরে আঁচল গুঁজে বাইরে এসেই দেখে, কাকার সঙ্গে গদাই।
ভয়ে আধমরাই হয়ে যায় ও। কিন্তু হেসে বলে, কী খবর? গদাইদা?
-এই তো তোমাগো খবর লইতেই তো আইলাম!
বলেই, একদৃষ্টে চেয়ে থাকে গদাই, শিলির দিকে।
পরেশ বলে, আমাগো গদাই-এর মাথাখান এক্কেরে গ্যাছে গিয়া।
বড়োঘরের দাওয়ায় বসে নরেশ বলেন, ক্যান হইল কী?
-ও নাকি আজ নদীর থিক্যা উইঠ্যা আসা পরিরে দ্যাখছে। কেবল-ই কয়, কী রূপ তার!
শিলি খিলখিল করে হেসে ওঠে। অভিনেত্রীর মতো।
বলে, বড়লোকের পোলাগো তো একমাত্র কাজ-ই হপন দেখা। কী কও গদাইদা।
–কমু কী আর। যা কই তা সত্যই।
-তা তুমি কী কইরলা তারে দেইখ্যা? কথা কয় নাই কুনো? কোন ভাষায় কথা কয় পরিরা?
শিলি নিজের সপ্রতিভতায়, নিজেই ঝলমল করে উঠল।
রীতিমতো ভালো অভিনয় করছে ও। মেয়েমাত্রই জন্ম-অভিনেত্রী।
ভাবল, শিলি।
-কথা কি আর শোনবার অবস্থা ছিল আমার?
–হে তো অজ্ঞান হইয়া পইড়্যা ছিল গাছতলায়। আমি কাছে গিয়া ডাক দিতেই, হায়! হায়! কী কান্না পোলার। যেন সাপে কাটছে তারে।
গদাই চুপ করে থাকল একটু।
তারপর বলল, বিশ্বাস করেন পরেশকাকা। সাপের কামড়ও ঢ্যার ঢ্যার ভালো আছিল। পাগল যে, হইয়া যাই নাই, তাই যথেষ্ট। সে-রূপ খালি-চোখে দেখন-ই যায় না। এত্ত তেজ।
শিলি বলল, তা ধুবড়ি থিক্যা বা তামাহাটে হাটের দিন যাইয়া একজোড়া গগলস কিন্যা আনো না ক্যান? আবারও যদি দর্শন পাও কুনোদিন। অমন ড্যাব ড্যাবা চোখ দুইখান যে, যাইব গিয়া চিরদিনের-ই লইগ্যা।
-হ। ভাবতাছি। তাই-ই করুম। পরির দেখা তো, সাপের দেখার-ই মতো। আবার কবে যে হঠাৎ কইর্যা ঘটব ব্যাপারখান, তা তো কওন যায় না। আজ থিক্যা যখন-ই নদীর পারে যামু তখন-ই সেই গগলসখান পইরাই যামু অনে।
তারপরই গদাই বলল, আমি যাই। বাবায় নাইলে চিন্তা করবো আনে। না-খাইয়া বইস্যা রইব।
শিলি বলল, দুগা গরিবের ঘরে খাইয়াই যাও না, যাই-ই রান্ধা হইছে। আইস্যাই যহন পড়ছ, খাওনের সময়ে। ভালো খাবার কিছু না, তবে ভালোবাসা তো আছে।
গদাই হেসে বলল, ভালোই কইছ তুমি। ভালোবাসা কি চিবাইয়া খাওনের জিনিস? কপাল আমার।
বলেই, পা বাড়াল। বলল, আসুমানে অন্য একদিন। আগে আমারে নেমন্তন্ন পাঠাইও, তবে না আমু।
পরেশ বলল, মাসিমার কাছে সকালে শুইন্যা আইলাম পুতন নাকি আইতাছে ম্যানেজারের কে এক ছোকরা আত্মীয়রে লইয়া। সামনের শনিবারে। তা অদের তো একদিন খাওয়াইতেই অইব। সেইদিন তোমারেও কইয়া দিমু। আইস্যো য্যান।
উত্তর না দিয়ে গদাই বলল, কে? কে আইতাছে?
গদাই-এর মুখের সব হাসি মিলিয়ে গেল। কালো হয়ে গেল অমন সুন্দর মুখটা।
পরেশ বলল, পুতন।
–পুতন? আইতাছে নাকি?
গদাই ক্লিষ্টকণ্ঠে বলল।
-হ। তাই-ই তো কইল মাসিমায়।
–দেখুমানে।
বলেই, চলে গেল গদাই।
শিলির বুক নেচে উঠল আনন্দে। রাগও হল একটু। আসছেন-ই যদি এতদিন পর, তাও আবার সঙ্গে অন্য একজনকে নিয়ে কেন? একা আসতে যেন অসুবিধা ছিল! ভারি খারাপ!
নরেশ, চলে-যাওয়া গদাই-এর দিকে চেয়ে পরেশকে বললেন, গদাইটারে ভাবতাম বোকা-সোকা। কিন্তু কথা তত বেশ চোখাচোখাই কয় দেহি।
পরেশ অন্যমনস্ক গলায় বলল, কোন কথা?
–ওই যে, কইল না? ভালোবাসা কি চিবাইয়া খাওনের জিনিস?
পরেশ হেসে ফেলল, দাদার কথা শুনে।
বলল, যা কইছ। দারুণ-ই সেন্টেন্সখান। এক্কেরে যাত্রার ডায়ালগ-এরই মতো।
.
মাদারিহাট হয়ে, কোচবিহার হয়ে পুতনরা এসে পৌঁছেছিল, রবিবার সন্ধের বাসে, ধুবড়ি থেকে।
ঠিক কখন আসবে তা জানত না। তবে জানত শিলি যে, বিকেলের দিকেই আসবে।
প্রথম-বিকেলে একবার কিরণশশীর কাছে গিয়ে কালো পাথরের বাটিতে একবাটি পায়েস দিয়ে এসেছিল।
পুতন যদি একাই আসত তাহলে থাকত ওখানে, যতক্ষণ না আসে। তবে, সঙ্গে অচেনা মানুষ নিয়ে আসছে। কেমন লোক তা কে জানে? তাই শিলি যায়নি ইচ্ছে করেই। পুতনের দরকার থাকলে, সে নিজেই আসবে।
শিলি সামান্য দুশ্চিন্তাতেও আছে। নরেশবাবুর আর্থিক অবস্থা এমন-ই হয়ে পড়েছে যে, তা বলার নয়। কাকারও কোনো স্থায়ী রোজগার নেই। শিকার করেই যা হয়। আজকাল বনবিভাগও কড়াকড়ি আরম্ভ করেছে। ছাত্তারকাকাকে তো একবার অ্যারেস্টও করেছিল। ছাত্তারকাকা নাকি সংকোশের পারে হাতি মেরে তার দাঁত বিক্রি করে দিয়েছিল। পারমিট টারমিট নিয়ে তো শিকার কোনোদিনও করে না। তাই কাকার ওপরে ভরসা বিশেষ নেই। কবে যে, শ্রীঘরে যেতে হয়।
শিলির বাবাও ক্রমাগতই চাপ দিচ্ছেন গদাইকে বিয়ে করার জন্যে। গদাই-এর বাবার সঙ্গে বোধ হয় কোনো অলিখিত চুক্তিও হয়েছে। শিলিকে গদাই-এর সঙ্গে বিয়ে দিলে ওঁকে বোধ হয় একটা মাসোহারার বন্দোবস্ত করে দেবেন গদাই-এর বাবা। শিলির মনে হয়। তাতে বাবা কাকার খাওয়া-দাওয়া, ক্যাবলারও, ক্যাবলার মাইনে, বাবার সিগারেটের খরচ ইত্যাদি দিব্যি চলে যাবে। সেটা অবশ্য গদাই-এর বাবার কাছে কিছুই নয়। অত সম্পত্তি যাঁর। তার ওপর কুঁজোর জল তো গড়িয়ে খান না এখনও। সঞ্চয় যা আছে তো আছেই, তার ওপরেও সমানে রোজগার করে যাচ্ছেন। আর বংশের বাতি বলতে তো ওই গদাই-ই একা।
তবু শিলিকে এইভাবে বিক্রি করে দিয়ে, তার বাবা নিজের আখের গুছোচ্ছেন–এই কথাটা ভাবলেই বড়ো ঘেন্না হয় ওর। বাবার ওপরে তো হয়-ই, তার নিজের ওপরেও হয়। তা ছাড়া গদাইদাটা যদি লেখাপড়াও করত একটু-আধটু। এদিকে চালাক-চতুর আছে। সেদিন যা-খেলাটা দেখাল। বলে কিনা, ভালোবাসা কি চিবানোর জিনিস?
নরেশবাবু বলেন, কলেজে পড়লেই কেউ অমনিতেই বিদ্বান হয়ে ওঠে না। যে-ছেলে ব্যাবসা করতে পারে, সে কি বুদ্ধি ছাড়াই পারে? বুদ্ধি না থাকলে তো গদাই বাবার অতবড়ো ব্যাবসায় সাহায্য করতে পারত না। তা ছাড়া সাধারণত ব্যাবসাদারের ছেলেদের বুদ্ধিটা দুর্বুদ্ধিই হয়। বিশেষ করে আজকাল। কী করে তোক ঠকানো যায়, কী করে পয়সা আরও বেশি রোজগার করা যায়, এই ধান্দাতে থাকতে থাকতে তাদের সুবুদ্ধি বলতে আর বিশেষ কিছু বাকি থাকে না। পুরো নজরটাই বেঁকে যায় ওদের। কিন্তু গদাই ওরকম নয়। সুবুদ্ধি নিয়েই ব্যাবসা করে ও। প্রাণে মায়া-দয়া আছে। এমনকী, এও শুনতে পান নরেশবাবু লোকমুখে যে, বাবাকে না জানিয়েই ও কর্মচারীদের নানাভাবে সাহায্য করে। বাবা নিজে যা করতেন না, বা জানলে করতে দিতেন না।
গোপেন সুকুলকে বাড়ি করার জন্যে টাকা দিয়েছে গদাই, রহমতুল্লার মেয়ের বিয়ে দিয়েছে, সব খরচ দিয়ে। সুভাষের ছেলেটাকে ধুবড়ির কলেজের হস্টেলে রেখে পড়াচ্ছে। নিজে পড়াশোনা না করলেও পড়াশোনার প্রতি যে, ওর শ্রদ্ধা আছে, এসবেই তা বোঝা যায়।
ছাইন্যার দাদাটার পা কেটে গেছিল কোকরাঝাড় স্টেশনে রেলের ইঞ্জিনিয়ারের ট্রলির নীচে পড়ে, তাকে ধুবড়ি ম্যাচ-ফ্যাক্টরিতে চাকরিও করে দিয়েছে এই গদাই-ই। ম্যাচ-ফ্যাক্টরিতে শলাই কাঠের সাপ্লাই বিজনেসটাও গদাই একাই সামলায়। সাহেবরা তো এখনও আছে দু একজন। তাদের সঙ্গে ইংরিজিতে কথা-টথাও তো চালাতে হয়। স্কুল-কলেজে দু-পাতা পড়ে কি ল্যাজ গজায়? রবি ঠাকুর বা জি.ডি. বিড়লারা কি কলেজে পড়েছিলেন?
এসব নানা কথা বলে শিলিকে বোঝাতে চান তিনি। বলেন, যারা বেশি পড়ে, পড়াশুনোয় ভালো হয়, তারা তো ওই ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া পুতনের মতো ব্যাবসাদারদের-ই চাকর হয়। যারা জানে, তারাই জানে যে, চাকরদের মধ্যে যতখানি নোংরামো, যতখানি নীচতা, খেয়োখেয়ি, ততখানি মালিকদের মধ্যে নেই। প্রমোশনের জন্যে পা-চাটে তারা, মেরুদন্ড বিকিয়ে দেয়, বউ বা বোনকে পাঠিয়ে দেয় ওপরওয়ালা বা মালিকের খাটে। অনেক বড়ো বড়ো চাকর দেখেছেন নরেশবাবু। চাকরেরা সব চাকর-ই। আর এই বাঙালি জাতটা চাকরের বংশধর, চাকর হওয়ার প্রত্যাশা নিয়েই ওদের জীবনের যা-কিছু, বিদ্যা-শিক্ষা, আর তাদের ছেলেদেরও বংশপরম্পরায় তারা চাকর-ই বানায়।
গদাই কলেজে পড়েনি, স্বাধীন ব্যাবসা করে বলেই যে, খারাপ ছেলে, তা নয়। তা ছাড়া, ছেলেবেলা থেকেই বড়োলোকির মধ্যে যারা মানুষ হয়, তাদের মনে অনেকরকম ক্ষুদ্রতা, ইতরামি, ছিঁচকেমিই থাকে না। হা-ভাতে ঘর থেকে এসে যেগুলো বড়োেলোক হয়, তাদের বেশিরভাগেরই বড়োলোক হওয়ার প্রক্রিয়ার রকমটা নরেশবাবু ভালোই জানেন। একজীবনে তো আর কম দেখলেন না। তাই অনেক ভেবেচিন্তেই নরেশবাবু শিলির সঙ্গে গদাই-এর বিয়ে দিতে চান।
তা ছাড়া, পুতন ছিল ভালো। ওই কলকাতায় গিয়ে চা-বাগানে চাকরি নিয়ে, ডুয়ার্সে যাওয়ার পর থেকেই, ওর চোখে-মুখে লোভ চকচক করে। নরেশবাবুর মনে হয় যে, পার্থিব সুখের জন্যে ও করতে পারে না, এমনকিছুই নেই। ভালো-থাকা, ভালো-খাওয়ার জন্যে, একটি স্কুটার বা টি.ভি কেনার জন্যে পুতন এখন মানুষও খুন করতে পারে।
গ্রাম থেকে উদবাস্তু হয়ে গ্রামেই এসে বাসা বেঁধেছেন নরেশবাবু, ইচ্ছে করেই। শান্তি যতটুকু থাকার, তা এখনও গ্রামেই আছে, এই গরিবির মধ্যেই, যেন-তেন-প্রকারেণ বড়োলোকির মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই, সম্মান নেই। সুখ তো নেই-ই। মেয়ের ভালো চান বলেই গদাই-এর কথা ভাবেন। তিনি নিজে আর কতদিন! শিলির মায়েরও তাই কথা ছিল। দারিদ্র্য যদি মোটামুটি রকমের হয়, মধ্যবিত্তর জীবন হচ্ছে সব চেয়ে সুন্দর, সুখের, নিরুদবেগের জীবন। জীবনের মানে শুধুমাত্র ভালো-খাওয়া, ভালো-থাকা নয়, তার চেয়েও বড়োকিছু। মূল্যবোধ-এর ওপর যে-জীবন দাঁড়িয়ে থাকে, তার ভিত, বুনিয়াদ অনেক-ই বেশি শক্ত হয়ও, মূল্যহীন সমাজ বা সংসারের স্বাচ্ছল্যের চেয়ে।
কিন্তু নরেশবাবু এও দেখেছেন যে, দারিদ্র অসহনীয় হলে তা থেকে যেসব খারাপ জিনিস জন্মায়, তা বড়োলোকির খারাপত্বর চেয়েও অনেক-ই বেশি। মানুষের তখন অমানুষ হয়ে যাওয়ার প্রবণতা জন্মায়। তিনি নিজের জীবন দিয়েই এটা উপলব্ধি করেছেন। বর্তমানের অপরিসীম দারিদ্র্য যেন, তাঁর অমন রূপগুণের একমাত্র মেয়েটার জীবনেও না বর্তায়, তাই-ই দেখে যেতে চান উনি।
বড়োলোকি যেমন ভালো নয়, মোটামুটি খেতে-পরতে না পেলে মানুষের মনুষ্যত্ব বাঁচিয়ে রাখাও যে, দায় হয়ে ওঠে।
মাঝে-মাঝেই তিনি নিজেও যে, অমানুষ হয়ে উঠছেন, তাও বুঝতে পারেন। খিদের মতো খারাপ রোগ আর কিছুই নেই। মানুষের শরীর, মানুষের মন, সবকিছুই ছুঁচোর মতো কুরে কুরে খেয়ে যায় এই খিদে। শিলিটার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার যে করেন, সেটা এই দারিদ্ররই জন্যে। নিজের অপারগতার-ই জন্যে। অপারগতা অসীম হলে, তখন অপারগ, অসভ্য, অবুঝ, অভব্য হয়ে ওঠে। এই দারিদ্রর কামড় যে-না খেয়েছে, সে কখনোই জানবে না ওঁর জ্বালা।
নরেশবাবুর, গদাই বা তার বাবার কাছে থেকে বিন্দুমাত্রও প্রত্যাশা নেই। উনি জানেন না, শিলি কী ভাবে তাঁর সম্বন্ধে! শিলির সঙ্গে গদাই-এর বিয়েটা হয়ে গেলে তিনি কুমারগঞ্জ ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবেন, এই ভিটে পরেশকে লিখে দিয়ে। কারণ, চোখের সামনে থাকলেই জামাই তাঁর জন্যে কিছু করবেই। মেয়েরও কষ্ট হবে বাবার জন্যে। মেয়ের বিয়ের পরে উনি পথে পড়ে মরলেও কোনো দুঃখ নেই ওঁর। এই জীবন, যে-জীবনে কাউকেই কিছুমাত্র দেওয়ার ক্ষমতা নেই, কাউকেই সুখী করার ক্ষমতা নেই কোনোভাবেই; সে জীবন থাকা না থাকা সমান।
আত্মহত্যা করে মরে যাবেন বলেও ভাবেন, কখনো-কখনো। জীবন মানে তো শুধু নিশ্বাস ফেলা বা প্রশ্বাস নেওয়া নয়। জীবন যদি জীবন্ত না হয়, তবে তা নিজে হাতে নিভিয়ে দেওয়াই ভালো। জীবন যদি ঈশ্বরের দান হয়, তবে সে-জীবন নিভিয়ে দেওয়ার স্বাধীনতাও ঈশ্বরের-ই দান। সব জীবের-ই মতন, মনুষ্যেতর জীবের মতো বেঁচে থাকার চেয়ে, মরে যাওয়া অনেক। ই বেশি সম্মানের।