Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

সেদিন অপদস্থ হয়ে ঘরে গিয়ে রাগে ফুঁসে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন হরসুন্দরী, রোসো! ঝেঁটিয়ে বিদেয় করছি। ওমা আমি গেলাম তোদের ভাল করতে, আর তোরা কিনা–পুঁচকে ছোঁড়াটা যেন কেউটের বাচ্ছা!

আসল কথা দুদিকে জ্বালা হল তার।

হঠাৎ অতসী কাজটা ছেড়ে আসায় সন্দেহাকুল মনে গিয়েছিলেন তল্লাস নিতে, ভেবেছিলেন খুব একটা কিছু ঘটে গেছে বোধহয়।

কিন্তু এমন আর কি!

তাঁ, বুঝলাম ভাল ঘরের মেয়ে। ছেলেটাকে মানুষ করে তোলবার জন্যে শরীর পতন করতে বসেছে, চাকর রাখা কথাটা ভাল লাগে নি। তা বলে ঝপ করে কাজটা ছেড়ে দিবি?

সুরেশ্বরী হাত ধরে কেঁদেছিলেন।

তুমি যেমন করে পারো তাকে বুঝিয়ে বাঝিয়ে নিয়ে এসো বাপু। সেবার হাতটি তার বড় ভাল। এমনটি আর পাব না। আর যে আসবে, সেই তো হবে কি না কি জাত। এমন ভাল জাতের মেয়ে

হরসুন্দরী ভেবেছিলেন, অনুরোধ উপরোধের জাল ফেলে মাছকে টেনে তুলবেন। উপরোধে ঢেঁকি গেলানো যায়, আর এ তো ছানার মণ্ডা। অভাবের জ্বালায় মান অভিমান কতক্ষণ থাকে? নিজের ওপর আস্থা ছিল হরসুন্দরীর।

বলেই এসেছিলেন সুরেশ্বরীকে, আচ্ছা আমি বুঝিয়ে বাঝিয়ে নিয়ে আসব আবার। উপরোধের মতন উপরোধ করতে জানলে ঢেঁকি গেলানো যায় লোককে, আর এ তো গিয়ে ছানার মণ্ডা। ভাল ঘরের মেয়ে তো, হঠাৎ মান অপমান বোধটা বেশি।

কিন্তু এখন তাদের কী বলবেন? উপরোধ করার স্পৃহা তো আর নেই হরসুন্দরীর।

ওই ঢেঁটা ছেলেটা তার চিত্ত বিষ করে দিয়েছে। তাই একমনে দিন গুনছেন তিনি মাসকাবারটা কবে হয়। কবে ভাড়া না দিয়ে চুপচাপ বসে থাকার দায়ে ওই আঝাড়া বাঁশ দুখানাকে ঘরছাড়া করেন।

গরীবের উপকার করতে বুক বাড়িয়ে দেওয়া যায়, যদি গরীব গরীবের মত নত থাকে, গরীবের অহঙ্কার অসহ্য!

.

হরসুন্দরী মাসকাবার পর্যন্ত অপেক্ষা করে বসে আছেন, কিন্তু অতসীর যে দিন কাটে না। তার স্বল্পসঞ্চয় ভাঁড়ারের সব কিছুই তো শেষ হয়ে গেছে। কাল পর্যন্ত চালটা ছিল, আজ তাও নেই।

চাল নেই!

মৃগাঙ্ক ডাক্তারের স্ত্রী চালের শূন্য কলসীটার সামনে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে মৃগাঙ্ক ডাক্তারের স্ত্রী কাঁদবে? না হেসে লুটিয়ে পড়বে?

কলসীটা নেড়ে নাচাতে নাচাতে এসে বলবে, ওরে সীতু কী মজা! আজ মার বেশ রান্না করতে হবে না! বেশ কেমন যত ইচ্ছে ঘুমাবো মজা করে!

হুঁ, সেই কথাই বলতে গিয়েছিল অতসী। সত্যিই কলসীটা হাতে করে গিয়েছিল।

নাচাতে নাচাতে বলেওছিল, ওরে সীতু আজ কী মজা! আজ আর রাঁধতে হবে না আমায়

কিন্তু এত হাসি যে কোথা থেকে এল অতসীর?

প্রগলভ প্রবল হাসি! সেই হাসির ধমকে মাটির কলসীটা হাত থেকে ছিটকে গড়িয়ে ভেঙেই পড়ল একদিকে। আর অতসী লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

এক ঝাঁক স্কুলের মেয়ে একত্রে থাকলে যেমন করে তুচ্ছ কথায় হেসে লুটোপুটি খায়, একা অতসী তেমনি লুটোপুটি খাবে নাকি?

এই হাসির দিকে তাকিয়ে আতঙ্কবিহ্বল একজোড়া দৃষ্টি যেন পাথর হয়ে তাকিয়ে থাকে।

আর ঠিক এই সময় হরসুন্দরী দরজায় এসে দাঁড়াল, তার বড় মেয়েকে নিয়ে।

মহিলা দুটি ঘরের সম্পূর্ণ দৃশ্যটি একবার যাকে বলে অবলোকন করে গালে হাত দিয়ে বিস্ময় বিমুগ্ধ কণ্ঠে বলেন, হ্যাঁ গা ব্যাপার কি! ও খোকা, মা পড়ে গিয়ে কাৎরাচ্ছে নাকি গো!

খোকা অবশ্য এক ডাকে কথা কয় না, এখনো কইল না।

হরসুন্দরী এগিয়ে এসে বলেন, অ সীতুর মা, কাৎরাচ্ছ কেন? কলসীটাই বা ভেঙে গড়াগড়ি যাচ্ছে কেন, মায়ে ছেলের মুখে রা নেই যে!

এবার ছেলে রা কাড়ে। স্বভাবগত তীব্র স্বরে বলে, কাৎরাবেন কেন? হাসছেন।

হাসছেন!

মা মেয়ে দুজনে বোধকরি হাঁ করে হাঁ বন্ধ করতে ভুলে যান।

কিন্তু অতসী উঠে পড়ছে না কেন? কেন উঠে পড়ে বলছে না, বোকাটার কথা শুনছেন কেন মাসীমা! হঠাৎ পেটটা বড্ড ব্যথা করছে বলে!…ওই ব্যথার দাপটেই হাত থেকে কলসীটা পড়ে গিয়ে

না, অতসী উঠছে না। মাটিতে মুখ গুঁজেই পড়ে আছে সে। শুধু দেহটা যে কেঁপে কেঁপে উঠছিল সেটা স্থির হয়ে গেছে।

হরসুন্দরী যদিও নিজের মেয়েদের সম্পর্কে সর্বদাই বিদ্বেষবাক্য উচ্চারণ করেন, কিন্তু আপাতত দেখা গেল মায়ে-ঝিয়ে একতার অভাব নেই। মেয়েও অবিকল মায়ের ভঙ্গীতে গালে হাত দিয়ে বলে, হঠাৎ এত হাসির কি কারণ ঘটল যে গড়াগড়ি দিয়ে হাসতে হচ্ছে? সিদ্ধি খেয়েছ নাকি গো অতসী?

তোমরা সব্বাই এত অসভ্য কেন? সীতু স্বর আরও তীব্র করে, কলসীতে চাল নেই, রাঁধতে হবে না বলে মা হাসছেন! সিদ্ধি! সিদ্ধি মানুষে খায়? শুধু তো দারোয়ানরা খায়।

সহসা মাতা কন্যা চুপ করে যান, এবং পরস্পর একটি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিবিনিময় হয়। আর মিনিট খানেক তাকিয়ে থেকে হরসুন্দরীর চোখে যে আলোটি ফুটে ওঠে, সেটি প্রেমেরও নয়, করুণারও নয়, স্রেফ জয়োল্লাসের।

সেই আলোঝরা চোখে বলে ওঠেন হরসুন্দরী, তোমাদের রঙ্গলীলা তোমরাই জানো। ঘরে চালের দানা নেই, মেজাজ চালে মটমট! এই অবধি বুড়ি কী খোসামোদটাই করল আমাকে! তোমাদের মতিগতি দেখে আর বলে অপমান্যি হলাম না। এতদিনে তারা হতাশ হয়ে অন্য লোক রাখল। যাক গে মরুক গে! ভেতরের কথা তোমরাই মায়ে পোয়ে জানো। আমার কথা বলে যাই। ভাড়া না নিয়ে ভাড়াটে পুষি এমন সঙ্গতি আমার নেই। মাসের আর দুদিন আছে, এর মধ্যে অন্য ব্যবস্থা করে ফেলো, পয়লা থেকে আমার মেয়ের ভাগ্নী এসে থাকবে। এর যেন আর নড়চড় না হয়।

দুম দুম করে চলে আসেন দুজনে। কিন্তু দোষ হরসুন্দরীকে দেওয়া যায় না। অসহায়া বিধবাকে দেখে মায়া তার পড়েছিল। ওদের যাতে ভাল হয় তার চেষ্টাও কম করেন নি। কিন্তু মায়া যে নেয় না, ভাল যে চায় না, তার ওপর কতক্ষণ আর কার চিত্ত প্রসন্ন থাকে?

তার উপর আজকের এই পরিস্থিতি।

বলতে এসেছিলেন অবিশ্যি বাড়ি ছাড়ারই কথা। কিন্তু রয়ে বসে আর একবার শেষ চেষ্টা দেখে বলবেন ভেবেছিলেন। ওমা এ আবার কী ঢং! ঘরে চাল নেই, রান্নার ছুটি বলে আহ্লাদে গড়াগড়ি দিয়ে হাসছে! হয় পাগল, নয় তলে তলে অন্য ব্যাপার! হয়তো আসলে গরীব নয়, ঘর ভেঙে পালিয়ে টালিয়ে এসেছে। আবার হয়তো ফিরে যাবে। তবে আর মায়া করার কী দরকার?

মেয়ে বলে, তুমি মোটেই আশা কোর না মা, যাবে। ও দেখো ঠিক ঘর কামড়ে পড়ে থাকবে।

হরসুন্দরী থমথমে গলায় বলেন, নাঃ সেদিকে তেজ টনটনে। ছেলের হাত ধরে গাছতলায় গিয়ে দাঁড়াবে, তবু মচকাবে না।

.

হ্যাঁ, হরসুন্দরী বাড়িওয়ালি চিনেছিলেন অতসীকে। মানুষ চেনবার ক্ষমতা তার আছে।

এই তালাচাবিটা রইল মাসীমা, ঘরটা ধুয়ে রেখে গেলাম। বলে ভাঙা নড়বড়ে সেই তালাটা হরসুন্দরীর কাছে নামিয়ে দিয়ে একটা নমস্কারের মত করে অতসী।

হরসুন্দরী নীরস গলায় বলেন, আশ্রয় একটা জোগাড় করেছ, না তেজ করে ছেলের হাত ধরে ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়াচ্ছ?

অতসী ঈষৎ হেসে বলে, আপনাদের আশীর্বাদই আশ্রয় মাসীমা, উপায় হবেই যা হোক একটা কিছু।

হরসুন্দরী নিঃশ্বাস ফেলে চাবিটা কুড়িয়ে নিয়ে বলেন, ধর্মে মতি থাক, ছেলেটা মানুষ হোক। তবে এও বলি অতসী, তোমার যত দুৰ্গতি ওই ছেলে থেকেই। ওর চেয়ে এক গণ্ডা মেয়ে থাকাও ভাল।

মেয়ে সম্পর্কে বিরক্তি-পরায়ণা হরসুন্দরী আজ এই রায় দিয়ে বসেন।

আর কি শোনবার আছে? আর কি বলবার আছে? এখন শুধু দেখতে বেরুনো পৃথিবীটা কত ছোট।

.

না, মাসপয়লায় হরসুন্দরীর মেয়ের ভাগ্নী এসে ভাড়াটে হল না তার। ওটা ছল। ঘরটা শূন্য পড়ে রইল আর দশ বিশ দিন। এ ঘরের উপযুক্ত খদ্দের আবার জোটা চাই তো?

কিন্তু পয়লা তারিখে হরসুন্দরী বাড়িওয়ালির ওপর একটা মস্ত ধাক্কা এসে লাগল। ওই সরু বাইলেনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল প্রকাণ্ড একখানা গাড়ি। আর সেই গাড়ি থেকে রাজার মত চেহারার একটা মানুষ নেমে এসে খুঁজেছিল হরসুন্দরী বাড়িওয়ালিকে।

আচ্ছা, তার সীমানা কি ওইটুকু পর্যন্তই ছিল? তাহলে হরসুন্দরী অমন করে কপালে করাঘাত করেছিলেন কেন?

এই ঘর বাবা! এই দুদিন আগেও ছিল। হঠাৎ কী মতি হল—

নিজের দুর্মতির কথাটা আর মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেন না হরসুন্দরী। সেটা মনের মধ্যে পরিপাক করে তুষের আগুনে জ্বলতে থাকেন।

কী কুকাজই করেছেন! আর দুটো দিন যদি ধৈর্য করে অপেক্ষা করতেন! তাহলে আজকের নাটকটা কতখানি জমে উঠত, একবার প্রাণভরে দেখে নিতেন।

তা কি করেই বা জানবেন হরসুন্দরী যে, বলতে মাত্রই পরদিন সকালবেলাই দম্ভ দেখিয়ে চলে যাবে ছুঁড়ি! দুটো দিনও থাকবে না!

আহা-হা ইস! এই রাজার মত মানুষটা তাকে খুঁজতে এসে ফিরে যাচ্ছে।

এবারে বোঝাই যাচ্ছে, বাড়ি ছেড়ে চলে আসা নিছক রাগের ব্যাপার। যা তেজ যা রাগ! মানুষটা অতসীর কি রকম আত্মীয় সেটা জানবার দুরন্ত ইচ্ছেকে দমন করে থাকেন হরসুন্দরী। এই হোমরা-চোমরা দীর্ঘদেহ সাহেবী পোশাক পরা লোকটাকে জিগ্যেস করতে সাহস হয় না। তবু মনে মনে অনুভব করেন, হয় বড় ভাই, নয় ভাসুর। তা ছাড়া আর কি হতে পারে? ভাসুর হওয়াই সম্ভব, ভাই হলে যতই হোক চেহারায় আদল থাকত।

কোনও ঠিকানা রেখে যায় নি?

নাঃ! হরসুন্দরী ক্ষোভ প্রকাশ করেন, মানুষকে তো মনিষ্যি জ্ঞান করে না! কেমন যে একবগ্গা জেদী মেয়ে!

এক বগগা জেদী! সে কথা মৃগাঙ্কর চাইতে আর বেশি কে জানে!

ঘরটা এমন কিছু বিশাল বিস্তৃত নয় যে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখা যায় না, বলতে গেলে তো এ দেওয়ালে ও দেওয়ালে হাত ঠেকে। তবু মৃগাঙ্ক সহসা চৌকাঠের মধ্যে পা রাখলেন।

দেখতে চেষ্টা করছেন কি, দুদিন আগেও যারা এঘরে ছিল, তাদের উপস্থিতির রেশ এখন এর মধ্যে সঞ্চরণ করে ফিরছে কিনা? না, তা নয়, মৃগাঙ্ক শুধু অস্ফুট একটা শব্দে শিউরে ওঠাটা দমন করলেন।

এই ঘরে বাস করে গেছে অতসী! এই দুদিন আগে পর্যন্তও ছিল?

রাত্রে দরজা বন্ধ করলে তারের জাল ঘেরা ঘুলঘুলির মত ওই জানলাটা ছাড়া নিঃশ্বাস ফেলার দ্বিতীয় আর পথ নেই। আর সেই পথ থেকে উঠে আসছে নীচের কচা নর্দমার দুর্গন্ধবাহী বাতাস।

কিন্তু এত বিচলিত হচ্ছেন কেন মৃগাঙ্ক, সুরেশ রায়ের বাড়ি কি তিনি দেখেন নি?

তবু ব্যাকুল মৃগাঙ্ক ব্যগ্র স্বরে বললেন, যদি কোন দিন আসে, যদি আপনার সঙ্গে দেখা হয়, বলবেন, তার যে ছোট্ট বাচ্চা একটা মেয়ে আছে, তার খুব বেশি অসুখ–

মেয়ে!

কথা শেষ করতে দেন না হরসুন্দরী, চমকে উঠে গালে হাত দেন, মেয়ে! বলেন কি বাবা? মেয়ে আছে তার? আপনি যে তাজ্জব করলেন আমাকে! ছেলের থেকে ছোট মেয়ে? সেই মেয়ে ছেড়ে

মৃগাঙ্ক বোধ করি এবার সচেতন হন। মৃদু গম্ভীর স্বরে শুধু বললেন, হ্যাঁ, দুর্ভাগ্য শিশু! যাক যদি কোনরকম যোগাযোগ–আচ্ছা–একদম একা গেছে? না কোনও

না বাবা, কেউ না। একেবারে একা। মায়ে ছেলে দুজনে চলে গেল একটা রিকশ ডেকে। তাই সে রিকশর ভাড়াটাই যে কি করে দেবে ভগবান জানেন! ঘরে তো ভাঁড়ে মা ভবানী! আপনাদের মতন এমন সব আত্মীয় থাকতে

মৃগাঙ্ক ততক্ষণে উঠোনে নেমেছেন।

না, মৃগাঙ্কর পক্ষে সম্ভব নয় নিজেকে এর থেকে বেশি ব্যক্ত করা, যতই ব্যাকুল হয়ে উঠুক অন্তর।

আশ্চর্য! আশ্চর্য!

দুদিন আগে এলেন না মৃগাঙ্ক! খুকুর টাইফয়েড! খুকু প্রবল জ্বরের ঘরে মা মা করছে, এ শুনলেও হয়তো কাঠ হয়ে বসে থাকত সেই পাষাণমূর্তি! বলত, খুকুর মা তো অনেকদিন আগে মরে গেছে!

হয়তো তাই বলত!

জ্বরে আচ্ছন্ন খুকুকে নার্সের কাছে রেখে এসেছেন মৃগাঙ্ক। আর স্বেচ্ছায় এসে বসে আছে সেই মেয়েটা। যে মেয়েটা সুরেশ রায়ের ভাইঝি।

গতকাল খুকুর একটা টাল গেল। শহরের সেরা সেরা ডাক্তারের ভিড় হয়ে উঠল বাড়িতে, নার্সের উপর নার্স এল। আর সহসাই সেই সময় ওই মেয়েটা খুকুর খবর নিতে এল। পথে এ বাড়ির কোন ঝি-চাকরের সঙ্গে দেখা হয়েছে, শুনেছে খুকুর অসুখ।

ভাবলে অবাক লাগে, সেই কাল থেকে মেয়েটা মৃগাঙ্কর বাড়িতেই রয়ে গেল। নার্সের সঙ্গে মিলে মিশে দেখাশোনা করতে লাগল খুকুকে। মৃগাঙ্ক অস্বস্তি বোধ করে বারবার অনুরোধ করেছেন বাড়ি ফিরে যেতে, তার যে একটা ছোট ছেলে আছে–সেকথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু শ্যামলী গ্রাহ্য করে নি ব্যাপারটা। বলেছে ছেলে তার যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে।

মৃগাঙ্ক অবাক হয়ে দেখলেন মেয়েটা কত সহজে সহজ হয়ে গেল। পরের বাড়ি থেকে গেল। সময়মত চান করে খেয়ে নিল, কাকাবাবু আপনি একটু বিশ্রাম করুন গে বলে জোর করে পাশের ঘরে ঘুমোত পাঠিয়ে দিল মৃগাঙ্ককে। কোথাও ঠেক খেলো না। সরল–মানে বোকা! আর বোকা বলেই হয়তো বা নিজের জীবনকে কোনদিন জটিল করে তুলবে না।

.

হয়তো মৃগাঙ্কর ভাবনাই ঠিক।

অতসী আর অতসীর ছেলের বুদ্ধি প্রখর, তাই ওরা জীবনকে ক্রমশ জটিল করে তুলছে। নইলে খেটে খাওয়া ছাড়া যার জীবনে আর কোনও গতি রইল না, সে তুচ্ছ একটু অভিমানের বশে সুরেশ্বরীর কাজটা ছেড়ে দেয়।

সে তো তবুও মোটা মাইনের সম্ভ্রম ছিল। এখন যে খাওয়া পরা রাঁধুনীর কাজ।

হ্যাঁ তাই মেনে নিতে হয়েছে। ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে আহার আর আশ্রয় জোগাড় করবার এছাড়া আর উপায় কি?

এই যে জোগাড় হয়েছে সেটাই আশ্চর্য! এমন হয় না। রিকশা করে অনেকটা দূর এগিয়ে অতসী হঠাৎ একটা গেটওয়ালা বড় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে ছেলেকে বলেছিল, দাঁড়া তুই এই জিনিসপত্ৰ আগলে, আমি আসছি।

আর খানিকক্ষণ পরে বেরিয়ে এসে ছেলেকে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিল, আয়।

এখানে কি? সীতু আড়ষ্ট হয়ে বলে উঠেছিল, এরা তোমার চেনা?

না! চেনা করে নিতে হবে। করে নিলাম।

অতসীর অনেক ভাগ্য যে ঠিক যে সময় বাড়ির গিন্নী রাঁধুনীহীন অবস্থায় কারে পড়ে রয়েছেন, সেই সময় অতসী গিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করেছিল, রান্নার লোক রাখবেন?

রান্নার লোক!

গিন্নী ভাবলেন তার আকুল প্রার্থনায় স্বয়ং ভগবান কি ছদ্মবেশিনী কোন দেবীকে পাঠিয়ে দিলেন। বিহ্বলতা কাটতে কিছুক্ষণ গেল। তারপর থতমত সুরেই বললেন, রাখব তো, লোকের তো দরকার। কিন্তু তুমি কে কি বৃত্তান্ত না জেনে

অতসী মনকে দৃঢ় করে এনেছে, এনেছে স্নায়ুকে সবল করে। তাই স্পষ্ট গলায় বলে, আমাকে দেখে কি আপনার চোর ডাকাত অথবা খুব খারাপ কিছু মনে হচ্ছে?

না না, খারাপ কেন? সরস্বতী প্রতিমাখানির মত তো চেহারা! তা বলছি না। মানে

মানে ভাববার কিছু নেই। আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি, আমার জন্যে কোন বিপদে পড়তে হবে না আপনাকে।

তা তুমি হঠাৎ এমনভাবে কোথা থেকে

বুঝতেই পারছেন খুব একটা অসুবিধেয় না পড়লে এভাবে মানুষ আসে না। সেইটা মনে করে আমার সম্পর্কে বিচার করবেন।

আঘাত খেয়ে খেয়ে শক্ত হয়ে উঠেছে অতসী, শিখেছে কথা বলতে।

তা বেশ, থাক তবে। আজ থেকেই থাক। রান্নাটান্না জানো তো?

অতসী মৃদুহেসে বলে, চালিয়ে নেবো।

হু, মনে হচ্ছে জানো। তা মাইনে টাইনে

এবার অতসী আরও বুক শক্ত করে ফেলেছে। তাই অবলীলার ভানে বলে, মাইনে লাগবে না, তার বদলে আমার ভার নিতে হবে।

ছেলে!

গিন্নীর মুখটা পাংশু হয়ে যায়। ছেলে আছে?

অতসী শান্ত দৃঢ়স্বরে বলে, হ্যাঁ। ছেলে না থাকলে শুধু নিজের জন্যে কে অপরের দরজায় দাঁড়াতে আসে বলুন? পৃথিবীতে মৃত্যুর উপায়ের অভাব নেই।

গিন্নী আরও থতমত খেয়ে বলেন, কিছু মনে কোর না বাছা, মানে কর্তাকে না জিগ্যেস করে ছেলের বিষয়

তিনি বাড়ি নেই?

আছেন। ওপরে আছেন। বেশ তুমি বোসো, জিগ্যেস করে আসি। কত বড় ছেলে?

ক্লাস সিক্সে পড়ে।

ওমা তাহলে তো বড় ছেলে!

গিন্নী অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন, দেখে তো তোমায় খুব ভদ্রঘরের মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে, এ অবস্থা কত দিন হয়েছে?

অতসী মাথা নীচু করে বলে, ওকথা জিগ্যেস করবেন না।

ভদ্রমহিলা আসলে ভদ্র-প্রকৃতি। এবং অতসীর মধ্যে তিনি সাধারণ রাঁধুনীর ছাপ দেখতে পান নি বলেই আকর্ষিত হলেন। ভাবলেন ঠাকুর মুখপোড়া যদি দেশ থেকে আসে তো একে ঘরের কাজের জন্যে রাখব। বাড়ির মেয়ের মত থাকবে। ছেলেটা? তা ওর মাইনের বদলে তো ছেলেটার ইস্কুলের মাইনে আর খাওয়া দাওয়া একটু বেশি পড়বে বটে–থাক, ভদ্রঘরের মেয়ে বিপাকে পড়েছে।

মিনিট দুই তিন পরেই নেমে এলেন তিনি, বললেন, কর্তার অমত নেই। তাহলে ছেলেকে নিয়ে এসো। কখন আসবে?

এখনই। বলে বেরিয়ে গেল অতসী।

কর্তা গিন্নীর বয়েস হয়েছে। মেয়ে নেই, আছে দুটি বিবাহিত ছেলে। দুটিই বিদেশে কাজ করে, স্ত্রী পুত্র নিয়ে বছরে একবার ছুটিতে আসে। বাকী সময় কর্তা গিন্নী এত বড় বাড়িটায় একাই থাকেন। চাকর বাকর নিয়েই সংসার।

অবস্থা ভাল, তাই সাধারণ নিয়মে গিন্নীর হার্টের অসুখ, বাতের কষ্ট। রান্নার লোক বিহনে দুদিনেই হাঁপিয়ে ওঠেন।

অতসীকে দেখে তার মনটা আশায় উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে। বৌরা চলে গিয়ে পর্যন্ত এমনি ঘরের মেয়ের মত একটি ভদ্র মেয়ে তার কল্পনার জগতে ছিল।

কর্তাও এক কথায় রাজী হয়ে যান। বলেন, নাতিপুতি কেউই তো থাকে না, একটা ছেলে থাকুক পড়ালেখা করুক, ভালই।

আশ্রয় জুটল। নিরাপদ আশ্রয়। ভাল ঘর, সৎ পরিবেশ। আর তবে কিছু চাইবার নেই অতসীর?

গভীর রাত্রে যখন সীতু ঘুমিয়ে পড়েছে, ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় অতসী। হ্যাঁ, দোতলাতেই ঠাই পেয়েছে সে। গিন্নী বলেছেন, নীচে চাকর বাকরের আড্ডা। ওখানে আমি তোমাকে থাকতে দিতে পারব না বাছা, ওপরেই আমাদের ঘরের কাছাকাছি থাকো। সকল ঘর দোরই তো খালি পড়ে।

বারান্দার কোণের দিকের ছোট একটা ঘরে মা ও ছেলে আশ্রয় পেল।

রাত্রে যখন ঘুম আসে না বারান্দায় এসে দাঁড়ায় অতসী। নিজেকে যেন আর সেই হরসুন্দরী বাড়িওয়ালির ভাড়াটের মত দীনহীন মনে হয় না, আর সেই সময় ভাবতে থাকে অতসী, তাহলে আর কিছু চাইবার রইল না তার? এই পরম পাওয়ার ভেলায় চড়ে সমুদ্র পার হবার সাধনা করে চলবে? পৃথিবীর আরও অসংখ্য দুঃখী মেয়ের মত দাসীবৃত্তি করে ছেলেকে কোন রকমে বড় করে তুলবে, তারপর ছেলের উপার্জনের ভাত খেয়ে মনে করবে জীবনের চরম সার্থকতার সন্ধান মিলল তবে? মিলল দীর্ঘ সংগ্রামের পুরস্কার?

জীবনে মৃগাঙ্ক বলে কোনদিন কোনও এক দেবতার দর্শন মিলেছিল সে কথা নিশ্চিহ্ন করে মুছে ফেলতে হবে সমস্ত চেতনা থেকে? আর তুলোর পুতুলের মত সেই একটা জীব যে কোনদিন পৃথিবীতে এসেছিল, একেবারে ভুলে যেতে হবে সে কথা?

আশ্চর্য, তবু বেঁচে থাকবে অতসী। বেঁচে আছে। সহজ সাধারণ মানুষের মত খাচ্ছে ঘুমচ্ছে, নিশ্বাস নিচ্ছে, কথা বলছে, এমনকি হাসছেও।

সেই তুলোর পুতুলটার কোন বার্তা আর কোনদিন জানতে পারবে না।

সে বার্তা নিয়ে যে অতসীর দরজায় দাঁড়াতে এসেছিল একজন, জানতেও পারল না অতসী।

হরসুন্দরী বাড়িওয়ালি অতসীদের খবর খবর করে হাঁপিয়ে মরলেন, অথচ এ বুদ্ধিটুকু মগজে আনতে পারলেন না, সীতুর স্কুলে একবার খোঁজ করে দেখলে হত! অতসীর যে একটা মেয়ে আছে, তার বাড়াবাড়ি অসুখ শুনলে কী করত অতসী সেটা আর দেখা হল না হরসুন্দরী বাড়িওয়ালির।

বেইমান! মহা বেইমান!

ভাবলেন হরসুন্দরী। নইলে এত যে উপকার করলেন তিনি, সে সব ভস্মে গেল। এতটুকু কি একটু বললেন, বড় হয়ে উঠল সেইটাই? একবার কি দেখা করতে আসতে পারত না?

অতসীও স্তব্ধ রাত্রে জনশূন্য রাস্তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে, সীতু অকৃতজ্ঞ সীতুর মা-ই বা অকৃতজ্ঞতায় কী কম যায়! নইলে শ্যামলীর কাছ থেকেও নিজেকে লুপ্ত করে নিল কি করে? শ্যামলী হরসুন্দরীর বাড়ি জানত, এ বাড়ির সন্ধান পাবার কোন উপায় তার নেই।

কিন্তু চিঠি লিখে ঠিকানা জানাবে অতসী কোন পরিচয় বহন করে?

শিবনাথ গাঙ্গুলীর বাড়ির রাঁধুনী?

.

কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি।

আকাশে নক্ষত্রের সভা। অনেকক্ষণ চেয়ে থাকলে কেমন একটা ভয় ভয় আর মন ঝিমঝিম করা অনুভূতি আসে। তেমনি অনুভূতিতে অনেকক্ষণ নিথর হয়ে থেকে অতসী ভাবে, এমন করে হারিয়ে গিয়ে আবার কোনদিন কি তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোনা যাবে?

ছেলেকে তো দৃঢ়চিত্তে শাসন করেছিল সে সেদিন, মরে যাব কেন? মরে গেলেই তো হেরে যাওয়া হল। তোমাকে মানুষ হতে হবে, মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর উপযুক্ত হতে হবে।

কিন্তু কবে সেই উপযুক্ততা আসবে সীতুর? আর যখন আসবে, তখন কি তারা অবিকল থাকবে, যাদের সামনে উঁচু মাথা নিয়ে গিয়ে দাঁড়ানোর মূল্য?

যদি তা না হয়, যদি এই হারিয়ে যাওয়া দিন থেকে কূলে উঠে দেখে অতসী, যাদের দেখাবার জন্যে এই কাঁটাবনের সংগ্রাম, তারাই গেছে হারিয়ে? আর সেই পুতুলটা

অসম্ভব একটা যন্ত্রণায় মাথাটা দেওয়ালে ঠুকতে ইচ্ছে করে অতসীর। ইচ্ছে করে খুকু খুকু করে চীৎকার করে কাঁদে। কিছুই করতে পারে না, শুধু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে ঊর্ধ্বলোকের নক্ষত্রসভায়।

মৃগাঙ্ক কি কোনদিন রাত্রে জেগে থাকেন? তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে?

কিন্তু যদিই থাকেন? সে খবর জানবার দরকার কি–শিবনাথ গাঙ্গুলীর বাড়ির রাঁধুনীর?

.

বর্ষা যায় শরৎ আসে, গাঙ্গুলীদের মেয়ের মতন রাঁধুনীর দিন কাটে মৃদু মন্থরে। ভারাক্রান্ত, ক্লান্ত ছন্দ, রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধার একটানা একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি।

কাজের চাপ বেশি থাকলেও বুঝি ছিল ভাল, তাতে তাল উঠত দ্রুত। কিন্তু এঁদের সংসার ছোট, চাহিদা কম, পুরনো চাকর আছে, সে প্রায় সবই করে, অতসীর অনেক অবসর।

কিন্তু সে অবসরকে কাজে লাগাবার সুবিধে কোথায়? অতসী ভাবে, আমি কি আবার লেখাপড়া করব? আমি কি চেষ্টা করে কোথাও সেলাই শিখব? আমি কি আমার আয়ত্তাধীন বিদ্যে পশম বোনাটাকে কাজে লাগিয়ে উপার্জনের চেষ্টা করব? একটা কিছু না করে কি করে কাটাব আমি? আর কতদিন বহন করব এই রাঁধুনীর পরিচয়?

ভাবে, ভেবে ভেবে উত্তাল হয়ে ওঠে তার দিনের অবসর, বিনিদ্র রাত্রি মর্মরিত হয়ে ওঠে সে ভাবনার দীর্ঘশ্বাসে। কিন্তু কিছুই করে উঠতে পারে না। ভয়ঙ্কর এক ভয় গ্রাস করে থাকে তাকে, পথে পা বাড়াতে দেয় না।

এ তো হরসুন্দরীর পাড়ার সর্পিল গলি নয়, এটা বড় রাস্তা। আর জীবনের সম্ভ্রম খুঁজে নিতে পা বাড়াতে হলে তো বড় রাস্তার পথ ধরেই চলতে হবে।

কিন্তু বড় রাস্তায় পা ফেলতে যে সেই দুর্দমনীয় ভয়। যদি কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যায়!

দেখা হয়ে গেলে কী হয়? অনেক দিন ভেবেছে অতসী, আর ভাবতে ভাবতে খেই হারিয়ে ফেলেছে। কী হয়, সেটা আর সম্পূর্ণ একটা ছবিতে পরিণত করতে পারে নি।

খেই হারাতে হারাতে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে তার অতীত জীবন। শ্লেট পাথরের মত একটা বিবর্ণ ভারী ভারী অনুভূতি ছাড়া সবই যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ভুলে যাচ্ছে এ বাড়ির রাঁধুনী ছাড়া আর কোন পরিচয় অতসীর ছিল।

তা এমন অতীত হারানো বিস্মৃতির কুয়াশা অনেক মেয়ের জীবনেই তো ক্রমশ পাকা বনেদ নিয়ে বসে। বিদেশে বাসায় রাজার হালে কাটাতে কাটাতে হঠাৎ ওঠে কালবৈশাখীর ঝড়, তচনচ করে উড়িয়ে নিয়ে যায় পাখীর বাসাটুকু, ভাগ্যহতের পরিচয় সর্বাঙ্গে বহন করে এসে আশ্রয় নিতে হয় তাদের কাছে, যারা এযাবৎ তার সুখসৌভাগ্যে আনন্দের থেকে ঈর্ষা অনুভব করেছে বেশি। সেখানে গৃহকর্মের সমস্ত দায় মাথায় নিয়ে সেই মেয়েকে টিকে থাকতে হয় সংসার নামক বৃক্ষের শাখায়। যদি তাকে টিকে থাকাই বলা হয়।

তখন সেই দাস্যবৃত্তির অন্তরালে কোনও দিন কি কখনো মনে পড়ে তার একদা অনেক সুখ তার হাতের মুঠোয় ছিল?

ভুলে যায়! অতসীও ক্রমশ ভুলছে। ভুলছে বললে ঠিক বলা হয় না, মনে আনার চেষ্টাই। করছে না। কেন করবে, অতসীকে তো তার ভাগ্য প্রত্যক্ষ আঘাত হানে নি। আপাতদৃষ্টিতে তো দেখলে মনে হয় অতসী নিজেই হাতের মুঠো আলগা করে ছড়িয়ে ফেলে দিয়েছে তার সুখ, তার জীবন।

তাই অতসীর অনেক ভয়। ভয়, যদি পথে বেরিয়ে হঠাৎ মুখোমুখি হয়ে যেতে হয় সেই অনেক সুখের অতীত জীবনের সঙ্গে?

কিন্তু অতসী কি বুঝতে পারে সীতুও আজকাল ওই এক রোগে ভুগছে। ওই ভয় রোগে। যদি কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এই আতঙ্কে সীতু স্কুলে যায় আসে প্রায় চোখ বুজে।

না, অতসী জানে না।

সে দিনের সে কথা সীতু অতসীকে বলে নি। তা কবে আর কোনও কথা মার কাছে বলে সীতু? তাই সেদিন বলবে পথে কী ভয়ানক ঘটনা ঘটেছিল? সেদিন সীতু শুধু আরক্ত মুখ আর ভয়ঙ্কর ওঠা পড়া বুক নিয়ে ছুটে এসেছিল। আর অতসীর ব্যাকুল প্রশ্নে বলেছিল রাস্তায় পড়ে গেছি।

অতসী কি করে জানবে সেদিন স্কুল থেকে বেরিয়ে মোড় পার হবার মুহূর্তে সীতুর পাশ দিয়ে ধাঁ করে বেরিয়ে গিয়েছিল একখানা ভয়ঙ্কর পরিচিত মোটরগাড়ি। আর তার চালকের আসনে যে বসেছিল সে সীতুর দিকে চোখ ফেলে নি বলেই এ যাত্রা রক্ষা পেয়েছিল সীতু।

হ্যাঁ, সে লোকটার এদিক ওদিক কোনদিকেই যেন দৃষ্টি ছিল না। গাড়িটা চোখের সামনে দিয়ে চলে যাওয়া সত্ত্বেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত যেন বিশ্বাস হয়নি সীতুর, যা দেখল সত্যি কিনা, অথচ ভেবে দেখলে সত্যি হওয়াটা কিছুই আশ্চর্য নয়।

আশ্চর্য নয়, তবু বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে রইল মিনিটের পর মিনিট।

ও যে কোথায় ছিল, কোথায় যাচ্ছিল, সবই যেন বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল সেই অদ্ভুত মুহূর্তগুলিতে।

চেতনার জগতে ফিরে এল ঘাড়ের ওপর একখানা ভারী হাতের থাবার চাপে আর একটা দুর্বোধ্য চীৎকারে

চমকে পিছন ফিরে কাঠ হয়ে গেল সীতু।

হরসুন্দরী বাড়িওয়ালি!

তীব্রস্বরে চেঁচাচ্ছেন, ও সর্বনেশে ছেলে, এখনো তোরা এ তল্লাটেই আছিস? আর আমি

আঃ লাগছে, ছেড়ে দিন–

সীতু কঁধটায় ঝাঁকুনি দিয়ে সেই ভারী খাবার কবলমুক্ত হতে চেষ্টা করে। কিন্তু থাবাটি বড় শক্ত ঘাঁটি। তাছাড়া হরসুন্দরী তখন রাগে দুঃখে আবেগে উত্তেজনায় মরীয়া। তিনি বরং আরও শক্ত করে চেপে বলেন, এইখানেই আছিস! এখনো এই স্কুলেই পড়িস! ওমা আমার যে মাথা খুঁড়ে মরতে ইচ্ছে করছে গো! অতবড় একটা মান্যিমান লোক রোজ আসছে আমার দরজায় তাদের তল্লাস নিতে, রোজ আমি লজ্জায় অধোমুখ হয়ে যাচ্ছি, দিতে পারছি না একটা খবর। বলি কী ব্যাপার তোদের? অতবড় গাড়ি চড়ে অমন মানুষটা হ্যাং হ্যাং করতে করতে আসে তোদের মা বেটার খবর নিতে, আর তোরা ঘাপটি মেরে বসে আছিস এখানেই? হা আমার কপাল! বলি তোর মার এত তেজ কেন বল তো?

চুপ করুন। আপনাকে মার কথা বলতে হবে না।

না, তা তো হবেই না। যেমন তুমি আর তেমনি তোমার মা! এদের জন্যে আবার মানুষ খবর খবর করে খুঁজে বেড়ায়! আমি হলে তো

সীতু হঠাৎ কেমন একটু শিথিল ভাবে বলে, কে খুঁজতে আসে?

কে তা তোমরাই জানো। তোমার মামা-দাদা কি জ্যাঠা-খুড়ো। হোমরাচোমরা চেহারা, তাই দেখি। এই নিত্যদিন আসছে খবর আছে কিনা।

আমিও আজ শুনিয়ে দিয়েছি, তারা খবর দেবার লোক নয় মশাই, বেইমানের ঝাড়। মিথ্যে আপনি আশা করছেন। যে মেয়েমানুষ কোলের কচি মেয়ে ফেলে তেজ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে–

ছেড়ে দিন। কাঁধ ছাড়িয়ে পথে নামে সীতু।

আর হরসুন্দরী তীক্ষ্ণ কণ্ঠে অনেক বিষাক্ত রস মিশিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠেন, এই শোন ছোঁড়া, শুনে যা। সেই আহাম্মক লোকটা বলে গেছে যদি তোদের সঙ্গে দেখা হয় তো–যেন জানাই তোর মার কোলের সেই কচিটার মরণবাঁচন অসুখ, বুঝলি? যায় যায় অবস্থা! বাড়িতে দিন দশটা করে ডাক্তার আসছে!

প্রতিহিংসা চরিতার্থের বিষাক্ত আনন্দে হাঁপাতে থাকেন হরসুন্দরী। আর সীতু? সে যেন হঠাৎ স্থাণু হয়ে যায়। ভুলে যায় সে পুতুল নয়। কিছু না হোক নিঃশ্বাস ফেলাও তার একটা ডিউটি।

যখন চেতনা ফেরে, দেখে অনেক দুরে হরসুন্দরীর পিঠের চাদরটা শুধু দেখা যাচ্ছে।

সীতু কি ছুটে যাবে? ছুটে গিয়ে চীৎকার করে বলবে, কী অসুখ হয়েছে সেই খুকুটার? বল শীগগির!

না, সীতু ছুটে যেতে পারে না। বলতে পারে না।

শুধু তার সমস্ত প্রাণ আছড়াপিছড়ি খেতে থাকে সেই প্রশ্নটার ওপর।

কী অসুখ হয়েছে সেই খুকুটার? বল শীগগির!

তবু অতখানি যন্ত্রণার ভার নিজের মধ্যে সংহত রেখেছিল সে। বাড়ি এসে বলেছিল রাস্তায় পড়ে গেছি।

কিন্তু মাকে যা হোক বলে বোঝানো যত সহজ, নিজেকে বোঝানো কি তত সহজ? প্রত্যেকটি মুহূর্ত যে ছুঁচের মত ফুটিয়ে ফুটিয়ে একটা কথা উচ্চারণ করছে–সেটা মরণবাঁচন অসুখ!

তুলোর পুতুলের মত গোলগাল খ্যঁদা খ্যাঁদা সেই ছোট্ট মানুষটারও ওই রকম ভয়ানক বিচ্ছিরি অসুখ করতে পারে? হরসুন্দরী যাকে বলেন মরণবাঁচন।

আর যদি শেষের কথাটা আর না থাকে?

শুধু প্রথম কথাটাই

শিউরে কেঁপে ওঠে সীতু, আর ভাবতে পারে না। সেই বিশেষ একটি রাস্তার উপরকার বিশেষ একখানি বাড়ি তীব্র একটা আকর্ষণে অহরহ টানতে থাকে চির-নির্মম চির-উদাসীন একটা বালক চিত্তকে। অথচ পথে বেরুতে তার ভয় করে পাছে দেখা হয়ে যায় কারও সঙ্গে। এ এক আশ্চর্য রহস্য!

সীতু কি স্বপ্নে কোন মন্তর পেয়ে যেতে পারে না যাতে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া যায়, আর উড়ে চলে যেতে পারা যায়–যেখানে ইচ্ছে?

রোজ রাত্রে ঘুমের আগে কাতর প্রার্থনা করে সীতু–যে ভগবানকে মানে না সেই ভগবানের কাছে। প্রার্থনা করে যেন সেই অলৌকিক স্বপ্ন দেখে, যাতে এক জটাজুটধারী সন্ন্যাসী এসে মৃদু হেসে বলছেন, বর চাস? কী বর?

হায়, প্রতিটি সকাল আসে ব্যর্থতা বহন করে। সীতুর জ্ঞানের জগতে যত কটুক্তি আছে, সমস্ত বর্ষণ করে সে অক্ষম ভগবানের উপর। অথচ আবার ঘুরে ফিরে সেই অলৌকিকের কথাই ভাবতে থাকে।

ধরো, পথ চলতে চলতে পায়ের কাছে কুড়িয়ে পেল সীতু একটা শিকড়, সেটা কুড়িয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অদৃশ্য হয়ে গেল সে, আর উড়তে আরম্ভ করল।

তারপর?

তারপর

সেই একখানি ঘরের একটি বিশেষ জানালার বাইরে ঘন্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে এক অদৃশ্যদেহী বালক, বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে।

ঘরের মধ্যে দশটা ডাক্তার ঘুরে বেড়ায়, ফিসফিসিয়ে কী যেন বলাবলি করে, বুকের মধ্যেটা ঠাণ্ডা হয়ে আসে ওই ছেলেটার।

ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখে সেই পুতুলটা কোথায়?

ছোট্ট খাটের মধ্যে লেপ চাপা দিয়ে শুয়ে প্রবল জ্বরে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে? নাকি নিঃশ্বাস আর কোনদিন ফেলবে না সে?

.

হঠাৎ কেঁদে ওঠা ঘুমন্ত ছেলেকে ষাট ষাট করে ভোলায় অতসী, বলে, জল খাবি সীতু? গরম হচ্ছে সীতু? খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস সীতু?

সীতু আর সাড়া দেয় না। শুধু মায়ের হাতটা আঁকড়ে ধরে।

অতসী স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। অস্বাভাবিক সীতুর মধ্যে কি তাহলে তীব্র কোনও মানসিক ব্যাধির সৃষ্টি হচ্ছে?

সকালবেলা মনিবগিন্নী প্রশ্ন করেন, রাত্তিরে ছেলে কেন কেঁদে উঠেছিল সীতুর মা?

অতসী ম্লান ভাবে বলে, স্বপ্ন দেখে মা!

হ্যাঁ, আর মাসীমা নয়, মা।

শ্রদ্ধার ডাক, ভালবাসার ডাক, আবার প্রভুভৃত্যের চরম মামুলি ডাক। তবু মা বলতেই হয়। মনিবগিন্নীর তাই বাসনা।

মাসীমা কেন গো? মা বলবে। আমার মেয়ে নেই। বলেছিলেন তিনি।

মেয়ে নেই তাই তো মেয়ের মতন। তাই তো অতসীরও এ এক পরম বন্ধন।

.

স্বপ্ন দেখে? মনিবগিন্নী বলেন, পেট গরম হয়েছে। একটু মৌরীমিশ্রীর জল করে খাইয়ে দিও দিকি, ঠাণ্ডা হবে।

সরল মানুষ এর চাইতে বেশি কিছু জানেন না, বোঝেনও না। সত্যিই ভারি সরল।

আজ সকালে কিন্তু তার কথাতেও একটু অসারল্যের ছোঁয়াচ লাগল। অতসীকে ডেকে বললেন, শুনেছ অতসী, আমার ব্যাটা, ব্যাটার বৌ যে দয়া করে গরীবের কুঁড়েয় পদার্পণ করতে আসছেন।

অতসী ঈষৎ বিস্মিত হয়। আনন্দের বদলে এমন সুর কেন?

তবে সে সহজভাবেই বলে, পূজোর ছুটি হয়েছে বুঝি?

হ্যাঁ তাই লিখেছিলেন বাবু! পূজোর আগেই বেরুচ্ছি, দিন পনের ছুটি বাড়িয়ে নিয়েছি। তা তোমায় মিথ্যে বলব না অতসী, বউ আমার মন্দ নয়, মতি বুদ্ধি ভালই ছিল। কিন্তু কথায় আছে, সঙ্গদোষে শত গুণ নাশে। তোমার কাছে তো সব কথাই বলি–আমার ওই ছেলেটিই যেন বিলেতের সাহেব! যত ফ্যাসান, তত ফি কথায় নাকবাঁকানি! ওর সঙ্গে পড়ে বউও

অতসী শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকায়। কি জানি আবার কোন ঝড় ওঠে! কে জানে এই স্তিমিত নিস্তরঙ্গতার উপর সে ঝড় কোন তরঙ্গ তুলবে! যে ছেলে বিলেতের সাহেবটি, সে কি বরদাস্ত করবে রাঁধুনী আর রাঁধুনীর ছেলের উপর তার মায়ের এই স্নেহাতিশয্য?

আর সেই বউ? সঙ্গদোষে যার শতগুণ নাশ হয়েছে? বউ-জাতীয়াকে বড় ভয় অতসীর। যদি সুরেশ্বরীর ছেলের বৌয়ের মত হয়?

কবে আসবেন?

কবে কি গো, আজই। মনিবগিন্নী স্বভাবছাড়া একটু ব্যঙ্গহাসি হাসেন, ট্রাঙ্ককলের টেলিফোন জানো? তাই করে খবর দিল যে এক্ষুনি। আমার ছেলের কোন কিছুতেই দিশিয়ানী নেই। দুদিন আগে খবর দেবে না। পথে বেরিয়ে কোন ইস্টিশন থেকে টেলিফোন করবে। বললে বলে, নিজের বাড়িতে আসব তার আবার খবর কি! কিন্তু শুনতেই ওই নিজের বাড়ি। এক মাসের ছুটি তো কুড়ি দিন শ্বশুরবাড়িতেই কাটাবে।

ছেলে বৌয়ের সম্পর্কে অনেকগুলি তথ্য পরিবেশন করে ফেলেন ভদ্রমহিলা।

.

অতসী আর কি করবে? সমস্ত রকম অবস্থার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত রাখা ছাড়া? ওঁর বৌ ছেলে যদি রাঁধুনী আর রাঁধুনীর ছেলেকে নিজেদের পাশাপাশি সহ্য করতে না পারে, যদি নীচে নামিয়ে দেয়, তাও মেনে নিতে হবে বইকি।

নীচের তলায় নামাটা তো কিছু নয়, অন্য সব চাকরবাকরদের চোখে অনেক নেমে যাওয়া এই যা! তবু তাই যেতে হবে। সেইটাই তো প্রস্তুতির সাধনা।

শুধু সীতু? বিরাট একটা জিজ্ঞাসার চিহ্ন।

.

কিন্তু অতসীর আশঙ্কা অমূলক।

ওরা ও রকম নয়।

অতসী দোতলায় কেন আছে, বা একতলায় কেন থাকবে না, এ নিয়ে মাথা ঘামাল না ওরা।

ট্রেন থেকে নেমেই স্নান সেরে বাপের বাড়ি যাবার জন্যে প্রস্তুত হতে হতে বৌ বলল, মা আপনার ঘরের পাশে ওই ছোট ঘরটায় কাকে যেন দেখলাম? কেউ এসেছেন নাকি?

মা বলে ওঠেন, ওটি আমার একটি কুড়নো মেয়ে বৌমা! ঈশ্বর-প্রেরিত। ঠাকুর দেশে চলে যাওয়ায় যখন অসুবিধেয় মরছি, তখন হঠাৎ একদিন

বৌ কথায় যবনিকাপাত করে বলে, ওঃ রান্নার লোক? তা দেখতে তো বেশ পরিচ্ছন্ন, নেহাৎ লো ক্লাস বলে মনে হল না।

অতসী পাশের ঘর দিয়ে যাচ্ছিল। দেয়ালটা ধরল। শুনতে পেল না তারপর আর কি কথা হল। সচেতন হল তখন, যখন বৌ ব্যস্তভাবে এদিকে যেতে যেতে অতসীকে দেখে বলে উঠল, আচ্ছা ওই ছেলেটি তোমার তো?

অতসী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

বৌ দালানে টাঙানো আরশিটার সামনে তাকিয়ে বেশবাসে দ্রুত আর একটি সমাপ্তি স্পর্শ দিতে দিতে বলল, ওকে আমার সঙ্গে আমার বাপের বাড়িতে নিয়ে যাব?

আপনার বাপের বাড়িতে! অতসী অবাক হয়। অতসী কারণ নির্ণয় করতে পারে না। অতসী দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলে, ছেলেটা বড্ড লাজুক, যেতে চাইবে কি?

চাইবে না?

সভ্য তরুণী আর জোর করে না, বলে তবে থাক। গেলে একটু সুবিধে হত। ওখান থেকে বেবিকে ধরার লোকটিকে আনতে পারি নি, বেচারার অসুখ করেছে। এই ঠিক তোমার ছেলের মতই ছেলে। তাই ভাবছিলাম ওকে পেলে হয়তো–যাকগে আমার বাপের বাড়িতে তো লোজনের অভাব নেই। তবে যেত, ভাল ভাল খেত, খেলত

হঠাৎ অতসী দৃঢ়স্বরে বলে, আচ্ছা দাঁড়ান আমি বলছি।

ঘরে গিয়ে তেমনি দৃঢ় স্বরেই বলে, সীতু ওই যিনি এসেছেন, ওর সঙ্গে ওর বাপের বাড়ি যেতে হবে তোমায়।

সীতু এ আদেশের মর্ম ঠিক ধরতে পারে না, থতমত খেয়ে বলে, কেন, আমি লোকেদের বাপের বাড়িতে যেতে যাব কেন?

অতসী আরও দৃঢ়স্বরে বলে, কেন যাবে শুনবে? ওর সঙ্গে ওর ওই বাচ্চাটিকে কোলে করে বেড়াতে।

ইস! সীতু তীব্রকণ্ঠে বলে, টিকটিকির মত ওই মেয়েটাকে আমি কোলে নেব বইকি! ছুঁতেই ঘেন্না করে।

চুপ! এসব কথা মুখে আনবে না। যাও ওই আলনা থেকে জামা পেড়ে পরে চলে যাও ওঁর সঙ্গে, সেখানে খেতে পাবে। খুব ভালো ভালোবুঝলে, যাও ওঠ।

মায়ের এই নিষ্ঠুরতায় কঠিন কঠোর সীতুর বুঝি চোখে জল এসে যায়। লাল লাল মুখে বলে, না যাব না। আমি কি চাকর?

অতসী হঠাৎ ফেটে পড়ে।

চাপা গর্জনে বলে ওঠে, হ্যাঁ তাই। বুঝতে পারো নি এতদিন? টের পাও নি চাকর হওয়াই তোমার বিধিলিপি! আমি হুকুম করছি চাকরই হওগে। যাও ওঁর সঙ্গে, সারাদিন ওঁর মেয়ে কোলে নিয়ে বেড়াওগে। ওরা যদি উঠোনের ধারে খেতে বসতে দেয় মাথা হেঁট করে তাই খাবে, একটি কথা বলবে না। যাওযাও বলছি। অপেক্ষা করছেন উনি। কী, তবু বসে রইলে? পেড়ে আনো জামা

মাটিতে বসে পড়ে অতসী। হাঁপাতে থাকে।

আর সীতুর চোখের সামনে বুঝি সমস্ত পৃথিবী ঝাপসা হয়ে আসে। মার ওই বসে পড়া চেহারাটার দিকে তাকাতে সাহস হয় না। উদভ্রান্তের মত আলনা থেকে শার্টটা পেড়ে গায়ে গলাতে গলাতে নীচে নেমে যায়। গিয়ে দাঁড়ায় বাইরে গাড়ির কাছে। যে গাড়ি বৌকে নিতে এসেছে তার পিতৃগৃহ থেকে।

বৌ বোধকরি হাতে চাঁদ পায়, হৃষ্টচিত্তে বলে, ও তুমি যাচ্ছ? এসো, গাড়িতে উঠে এসো।

সত্যিই গাড়িতে উঠে বসে সীতু।

কিন্তু সে কি সত্যিই সীতু? নাকি কোন যন্ত্রচালিত পুতুল?

.

বৌ ওর কোলে নাইলনের ফ্রক পরা সেই টিকটিকি বিশেষণপ্রাপ্ত শিশুটিকে গুছিয়ে বসিয়ে দিয়ে বলে, নাও বেশ ভাল করে ধরো। ফেলে দিও না যেন।

না, সীতু ফেলে দেবে না।

কিন্তু সেই কাঠির মুঠি মেয়েটাই প্রবল আপত্তি তুলে সীতুকে তচনচ করে দেয়। অচেনা কোল বলে? নাকি শিশু বোঝে অনাগ্রহের অনুত্তাপ?

এই দেখো, তুমি যে সামলাতেই পারছ না? বৌ রেগে ওঠে না, হেসে ওঠে। সহজভাবে বলে, ভাল করে ধরতে পারছ না কিনা, তাই মহারাণীর মেজাজ গরম হয়ে উঠেছে। তোমার তো কোন ছোট ভাই বোন নেই, তাই অভ্যাস নেই। দাও আমায়, কী রে দুষ্ট, বাহন পছন্দ হল না?

মেয়েকে কোলে করে ভোলাতে ভোলাতে শান্ত করে বলে সে, চিনে যাবে। দুদিনেই চিনে যাবে। দেখো তখন তোমাকে ছাড়তেই চাইবে না। তুমি যে আবার স্কুলে পড় শুনলাম। তাছাড়া তোমার মার তুমি এক ছেলে, মা নিশ্চয় ছাড়তে রাজী হবে না। নইলে তোমায় আমার সঙ্গে আমার কাছে নিয়ে যেতাম। ঠিক এই রকম একটি কমবয়সী বাঙালীর ছেলেই খুঁজছি আমি।

.

সীতু কি রূঢ়কণ্ঠে প্রতিবাদ করে উঠল? তীব্র চীৎকারে প্রশ্ন করে উঠল, আমায় কী ভেবেছ তুমি? আমি চাকর?

না, ওসব কিছু করল না সীতু। ওসব কথা বোধকরি ওর কানেও ঢোকে নি। ও গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তাকিয়ে আছে বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে।

এ কী!

এ কোথায় আসছে সে?

এই শিবমন্দির কোন পাড়ার? ওই গম্বুজ দেওয়া লাল বাড়িটা কোন রাস্তায়? নীল কাঁচের জানলা বসানো ওই ফোটো তোলার দোকানটা? আর ওই সিনেমাবাড়িটা? গাড়ি দ্রুত পার হতে থাকে আর সীতুর সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করতে থাকে।

একবার দরদর করে ঘাম ঝরেছিল, এখন একটা শুকনো দাহ।

বুঝতে পেরেছে সীতু, বুঝতে পেরেছে এবার।

এ সমস্তই ষড়যন্ত্র। ওই বৌটার বাপের বাড়ি যাওয়াটাওয়া সব বাজে, সীতুকে ভুল বুঝিয়ে ফন্দী ফিকির করে সেইখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যেখানকার লোক রোজ এতবড় মোটর হাঁকিয়ে হরসুন্দরী বাড়িওয়ালির বাড়ি যায় সীতুকে খুঁজতে!

আগে থেকেই তাহলে তৈরি হয়ে আছে এই সব ব্যাপার। আর মা? সীতুর মা?

সন্দেহ নেই তিনিও এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছেন। আর সীতু এমন বোকা যে তাতেই ভুলে

উঃ!

মা নিজে যেতে পারলেন না, বেচারী সীতুর ওপর দিয়েই

ওঃ, ওঃ এই তো এসে গেছে…পার্কের রেলিঙ দেখা যাচ্ছে। পার্কটা পার হলেই

সীতু জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে তীব্র প্রশ্ন করে, এটা কোন রাস্তা? আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?

এ প্রশ্নে গাড়ির চালক পর্যন্ত ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। বৌ অবাক হয়ে বলে, কেন, আমার বাপের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। সব্যসাচী রোডে যাব। কেন, তোমার মা বলে নি?

কিন্তু ততক্ষণে স্তিমিত হয়ে গেছে সীতু, ততক্ষণে সন্দেহ সরে গেছে তার।

গাড়িটা পার হয়ে গেছে ভয়ঙ্কর একটা ভয়ের জায়গা।

আতঙ্কটা ঘুচল। কিন্তু আশা? যে আশা শিশুমনের অজ্ঞাত অবচেতনে জন্ম নিচ্ছিল পরিচিত পথের ছলনায়?

.

এ রাস্তা তুমি চেনো?

সীতু মাথা নেড়ে বলে না।

.

গাড়ি নির্দিষ্ট জায়গায় থামে। বাড়ির মধ্যে ঢুকতে না ঢুকতেই অনেক ছোট বড় মাঝারি বয়সের মেয়ে পুরুষ এসে কলকন্ঠে সম্ভাষণ জানায়, একটি মধ্যবয়সী মহিলা সীতুর দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে বলেই ফেলেন, এটি কে রে ছন্দা?

এতক্ষণে সীতু জানতে পারে বৌটার নাম ছন্দা।

ছন্দা ওর দিকে একটি স্নেহদৃষ্টি ফেলে বলে, এ? এ হচ্ছে আমার শ্বশুরবাড়ির নতুন বামুন দিদির ছেলে! বেবির চাকরটাকে নিয়ে আসি নি বলে ভাবলাম ওকেই বরং

গরম সীসে কানে ঢেলে দিলে কি কানে এর চাইতে দাহ হয়?

মধ্যবয়সী মহিলাটিও সস্মিত কণ্ঠে বলেন খাসা ছেলেটি! তোর শাশুড়ী জোটায়ও বেশ। বুড়োবুড়ি একা থাকে, এ বেশ নাতির মত–

ছন্দা হেসে ওঠে, ওমা, সে আর বোলো না! আমার শাশুড়ীর তো এমন ব্যবস্থা, নাতি কোথায় লাগে! দোতলার ঘর, খাট বিছানা, মশারি টেবিলফ্যান, পড়ার টেবিল চেয়ার

কথা শেষ হয় না, সমবেত হাস্যরোলে চাপা পড়ে যায়।

বামুনদি আর বামুনদির ছেলের জন্য এ হেন অভিনব ব্যবস্থা রীতিমত হাস্যকর বৈকি। বামুনদির মনিবগিন্নীর পাগলামীর পরাকাষ্ঠা!

সীতু কি সকলের অলক্ষ্যে কোন এক সময় এই কুৎসিত কদর্য বাড়িটা থেকে বেরিয়ে যাবে?

কিন্তু এরা কি খারাপ?

এরা কি হৃদয়হীন? তা তো নয়।

ছন্দার মার এবার মেয়ের দিক থেকে নাতনীর দিকে মন যায়, হাত বাড়িয়ে কোলে নিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু নাতনী তারস্বরে আপত্তি জানায়। অনেক ভুলিয়ে কোলে নিয়েই ভদ্রমহিলা যেন শিউরে ওঠেন, ওমা, মেয়ের সমস্ত শরীরটুকুই যে হাড়! কী মেয়ে, কী করে ফেলেছিস ছন্দা?

ছন্দা মলিনভাবে বলে, কত বড় অসুখে ভুগল তা বল? লিখেছিলাম তো সবই। একেবারে–যায় যায় অবস্থা হয়েছিল।

যায় যায় অবস্থা!

যায় যায় অবস্থা! সীতুর প্রত্যেকটি লোমকূপের মধ্যে থেকে কি ওই নতুন শেখা শব্দটা উঠছে?

যায় যায় অবস্থা!

ছন্দা তখনো বলে চলে, একদিন তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। পাড়ার সবাই আমায় বলতে লাগল, বেঁচে উঠেছে নেহাৎ তোমার কপালজোরে।

দিদিমা নাতনীর গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, বোশেখ মাসে স্বপ্ন তোর ওখান থেকে বেড়িয়ে এসে তো আহ্বাদে কুটিকুটি, বলে, মা, দিদির মেয়েটা হয়েছে যেন মাখনের পুতুল! আর তেমনি হাসিখুশী ।

হাসি-খুশী ততক্ষণে সানাই বাঁশী বাজাতে সুরু করেছে।

দিদিমা বিরক্ত চিত্তে বলেন, বাবা, আমার কাছে জন্মাল, মানুষ হল, এখন আমাকে একেবারে ভুল?

ছন্দা মেয়ে কোলে নিয়ে অপ্রতিভভাবে বলে, অসুখ করে পর্যন্ত ওই রকম মেজাজী হয়ে উঠেছে। এই তো ছেলেটাকে আনলাম, তা গেলে তো ওর কাছে! কি যেন তোমার নাম থোকা? সীতু না কি? সীতানাথ না সীতারাম?

বলাবাহুল্য উত্তর পাওয়া তার ভাগ্যে ঘটে না।

ছন্দার মা বলেন, বড্ড দেখছি মুখচোরা। যাও খোকা, ওদিকে বাইরের বারান্দায় বোসোগে।

বাইরের বারান্দা! মুক্তির আহ্বান বহে আনছে কথাটা।

ছন্দার অনেকখানি সময় কেটে যায় অনেক কথায় অনেক হুল্লোড়ে। স্বপ্না এসেছে, এসেছে স্বপ্নার বর। খুশীর স্রোত বইছে।

হঠাৎ এই স্বচ্ছন্দ স্রোতে ঢিল পড়ে। ছন্দার মা এসে উদ্বিগ্ন প্রশ্ন করেন, তোর সঙ্গে যে ছেলেটি এসেছিল, কোথায় গেল বল দিকি? দেখতে পাচ্ছি না তো? গণেশকে দিয়ে খেতে ডাকতে পাঠালাম, বলছে বাইরে দাওয়ায় নেই। রাস্তায়ও নেই–

.

কিন্তু সত্যিই কি সীতু রাস্তায়ও নেই?

আছে। রাস্তাতেই আছে সীতু। নেশাচ্ছন্নের মত পথ চলেছে। তার চোখের সামনে শুধু বারেবারে ছায়া ফেলে ফেলে যাচ্ছে একটা তুলোর পুতুলের ধ্বংসাবশেষ! যায় যায় অবস্থা হয়ে যে নাকি টিকটিকির মত হয়ে গেছে!

মূর্তিটা ঠিক গড়তে পারছে না সীতু, কি রকম যেন হারিয়ে যাচ্ছে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তার পিছনে একটা ভীষণদর্শন দাঁতাল জন্তু উঁকি মেরে মেরে বলছে, ওরকম হলে বেঁচে যায় শুধু মায়ের কপালজোরে, বুঝলি?

কিন্তু যার মা নেই? অবহেলায় ফেলে চলে গেছে?

সীতু কি জমাদারের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠবে?

কিন্তু তারপর?

অদৃশ্য হয়ে যাবার শিকড় কই তার? কই আর কুড়িয়ে পেল সে বস্তু? তবে?

সীতু কি নীচু হবে? ছোট হবে? বলবে একবার শুধু খুকুকে—

ওরা যদি সকলে মিলে হেসে ওঠে? বামুনদি, নেপবাহাদুর, বাসনমাজা সেই ঝিটা?

সীতু কি তাহলে সোজা মাথা তুলে সেই মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? স্পষ্ট গলায় বলবে, তুমি আমাদের খুঁজতে গিয়েছিলে কেন? বলবে, খুকুর কি এখনো যায় যায় অবস্থা?

কিন্তু সেই মানুষটা যদি ভয়ঙ্কর লাল চোখে তাকায়? যদি ভারী ভারী গলায় বলে, খুকু নেই।

.

টেলিফোন ঝনঝনিয়ে ওঠে শিবনাথ গাঙ্গুলীর বাড়ি।

গিন্নী যথারীতি বলে ওঠেন, অ অতসী, দেখ তো মা কে ডাকে–

কিন্তু ততক্ষণে গিন্নীর পুত্ররত্ন কর্মভার হাতে তুলে নিয়েছেন। আর পরক্ষণ থেকেই তার কণ্ঠযন্ত্র লহরে হরে ঝঙ্কার তুলতে সুরু করেছে।

অ্যাঁ! বল কি? কতক্ষণ?…আঃ কী মুশকিল, তোমারও যেমন কাণ্ড! চেনো না জানো না, কী নেচারের ছেলে না খোঁজ করেই

ছেলে!

অতসী দরজার বাইরে আটকে যায়। তার সমস্ত ইন্দ্রিয়ের শক্তি বুঝি শ্রবণেন্দ্রিয়ে এসে ভিড় করে। কে কোথা থেকে খবর দিচ্ছে? কার ছেলের কথা বলছে? কী হয়েছে তার?

এদিকে তারযন্ত্র আর কণ্ঠযন্ত্র পাল্লা চালিয়ে যাচ্ছে….আচ্ছা আমি এখুনি যাচ্ছি। যাচ্ছিলামই কি বলছ? বিপদ? তা ইচ্ছে করে বিপদকে ডেকে আনলে সে আসবে বইকি!… কী বললে? গাড়ি চাপা? না না, অতদূর ভাববার দরকার নেই। তোমার কল্পনাশক্তি দূরপ্রসারী বটে। আমার মনে হচ্ছে এখানে পালিয়ে এসেছে।

এখানে!

তাহলে আর সন্দেহের অবকাশ নেই অতসীর, কোন ছেলের কথা হচ্ছে।

কী হল? বাসে ট্রামে চড়তে জানে না? হুঃ, কলকাতার এই সব বামুন চাকর ক্লাসের ছেলেদের তো চেনো না! ওরা সাত বছর বয়স থেকে পাকা হয়ে ওঠে। আমি বলছি অত উতলা হবার কিছু নেই। ঠিক শুনবে দিব্যি বিকশিত দন্তে বিড়ি খেতে খেতে এখানে এসে হাজির হয়েছে।..যাক আমি যাচ্ছি। তোমার যখন দায়িত্ব।

অতসী কি ছুটে গিয়ে রিসিভারটা কেড়ে নেবে ওই হৃদয়হীন লোকটার হাত থেকে? নাকি দুড়দুড়িয়ে নেমে গিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাবে রাস্তায়?

কিন্তু তারপর?

মনিবগিন্নীর বেহাইবাড়ি কোন রাস্তায় সে কথা কি জেনে নিয়েছে অতসী? ভাগ্যের নিষ্ঠুরতায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে চরম নিষ্ঠুরতার আঘাত হেনেছে সে সেই অবোধ অভিমানী বালকচিত্তের উপর। আর কিছু করে নি। এখন অতসী ছেলে ছেলে বলে উভ্রান্ত হলে ভগবান সূকুটি করবেন না?

ফোন কে করছে রে খোকা? অতসীর মনিবানী এগিয়ে আসেন, বৌমা বুঝি?

হ্যাঁ, যত সব ঝামেলা! খোকা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, তোমাদের যেমন কাণ্ড! বুদ্ধিসুদ্ধি যদি কোন কালে হবে! খামোকা তোমার রাঁধুনীর না কার ছেলেকে ওদের ওখানে পাঠাবার কী ছিল? সে ছেলে নাকি ওখান থেকে হাওয়া!

ওমা সে কি! চোখ কপালে তোলেন ভদ্রমহিলা, ওখানে অচেনা পাড়ায় একা একা সে আবার কোথায় যাবে?

কোথায় যাবে তোমরাই জানো। এখন ছুটতে হবে আমাকেও। ভেবেছিলাম সন্ধ্যের দিকে যাব। এখন তোমার বৌমা অস্থির হচ্ছে। বলছে পরের ছেলে নিজের দায়িত্বে নিয়ে এসেছি!

শিবনাথগিন্নী কাতর বচনে বলেন, এত সব আমি কি করে জানব বাছা? বৌমা বলল নিয়ে যাই, আমি বললাম যেতে চায় তো নিয়ে যাও। মুখচোরা ছেলে। তা অনিচ্ছেয় জোর করে নিয়ে গেছে নাকি অতসী, তোমার ছেলে….কই গো তুমিই বা কোথায় গেলে? অতসী….অ সীতুর মা…ওমা এই তো এখানে ছিল, সে আবার কোথায় গেল!…এ সব কী ভূতুড়ে কাণ্ড গো! অ খোকা, দেখ দেখ ছেলে হারানো শুনে সে আবার রাস্তায় বেরিয়ে গেল কিনা! ছেলেঅন্তপ্রাণ! কিন্তু একা মেয়েমানুষ বেরিয়ে কি করবে? অ খোকা–ওমা আমি কেন মরতে তার ছেলেকে যেতে দিতে রাজী হলাম

.

মৃগাঙ্ক চুপচাপ বসে ভাবছিলেন টেবিলে কনুই রেখে, চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে। একটু আগে রোগী দেখে ফেরার সময় একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেছে। অথচ এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না ঘটনাটা সত্যি কিনা।

আসলে কিন্তু কোনও ঘটনা কি? না, ঘটনা বলতে কিছুই নয়, শুধু একটা চকিত ছায়া, একটা অবিশ্বাস্য বিস্ময়। তখন থেকে বার বার ভাবছেন মৃগাঙ্ক, তিনি কি ঠিক দেখেছেন? নাকি তার একাগ্র বাসনা ছায়ামূর্তি ধরে তাকে ছলনা করছে? কিন্তু ছলনাটা বড় অবিকল!

গাড়িতে আসতে আসতে হঠাৎ দেখতে পেলেন পাশ দিয়ে একটা গাড়ি সাঁ করে বেরিয়ে গেল, তার মধ্যে সীতু।

সীতু এতবড় একখানা গাড়ির আরোহী হয়ে বসেছে এটাও যেমন অবিশ্বাস্য, মৃগাঙ্ক সীতুকে চিনতে পারবেন না সেটাও তেমনি অসম্ভব।

কিন্তু সে গাড়িতে আর কে ছিল?

দেখতে পান নি মৃগাঙ্ক, আদৌ দেখতে পাননি, দেখবার চেষ্টা করবার অবকাশও পাননি, শুধু যা দেখেছিলেন তাতেই দিশেহারা হয়ে গিয়ে মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন, আর সেই বিস্মৃতির মুহূর্তে হঠাৎ গাড়িটাকে আড়াল করে ফেলেছিল প্রকাণ্ড একটা লরী। আর ট্রাম চলছিল এপাশ দিয়ে।

লরির শত্রুতাপাশ থেকে উদ্ধার হয়ে যখন কোন রকমে নিজের গাড়িখানা উদ্ধার করলেন মৃগাঙ্ক, তখন সেই মায়ামৃগ মিলিয়ে গেছে ধূসর শূন্যতায়।

গাড়ির নম্বরটাও দেখে নেবার সুবিধে হয় নি। এখন মাথায় হাত দিয়ে ভাবছেন মৃগাঙ্ক যা দেখেছেন তা কি সত্যি? সত্যি হওয়া সম্ভব? না প্রখর সূর্যালোকের মাঝখানে দিবাস্বপ্ন?

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress