২. সকালবেলা জেগে উঠে
সকালবেলা জেগে উঠে দেখল মৃগাঙ্ক ঘুমোচ্ছে, মুখে নির্মল একটা প্রশান্তি। দিনের বেলায় যেটা প্রায় দুর্লভ হয়ে উঠেছে। বদলে গেল মন, ভারি একটা আনন্দে ছলছল করতে করতে স্নান করতে গিয়েছিল অতসী, অনেক উপকরণে সমৃদ্ধ স্নানের ঘরে।
কিন্তু স্নানের ঘর থেকে বেরিয়েই চমকে কাটা হয়ে গেল মৃগাঙ্কর প্রচণ্ড চীৎকারে।
ঘুম থেকে উঠেই কাকে এমন বকাবকি করছেন রাশভারী মৃগাঙ্ক ডাক্তার? কেনই বা করছেন? আবার কি সেদিনের মত জুতোর মধ্যে কাঁচের কুচি পেয়েছেন?
না, কাঁচের কুচি নয়, কাগজের কুচি।
কাগজের কুচি পেয়েছেন মৃগাঙ্ক! জুতোর মধ্যে নয়, জুতোর তলায়। যে কাগজের গোছাখানা কাল খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছিলেন মৃগাঙ্ক, হয়রান হয়েছিল অতসী। সকালবেলা বাড়ির সামনের ছোট্ট বাগানটুকুতে একপাক ঘুরে গাছ-গাছালিগুলোর তদারক করা মৃগাঙ্কর বরাবরের অভ্যাস। আজও এসেছিলেন নেমে, এসে দেখলেন সারা জমিটায় কাগজের কুচি ছড়ানো।
সেই কালকের জার্নালখানা। কে যেন দুরন্ত রাগে কুটি কুটি করে দাঁতে ছিঁড়ে ছড়িয়েছে! কে? কে? কে করেছে এ কাজ?
রাগে পাগলের মত হয়ে চেঁচামেচি করেছেন মৃগাঙ্ক, বাড়ির সবকটা চাকরবাকরকে ডেকে জড় করেছেন, তারপর হয়েছে রহস্যভেদ।
আসামীকে এনে হাজির করেছে নেবাহাদুর পাঁজাকোলা করে। কারণ অপরাধটা তার নিজের চক্ষে দেখা। •
এখন অপরাধীর কানটা ধরে প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দিচ্ছেন মৃগাঙ্ক, আর প্রচণ্ড ধমক দিচ্ছেন, কেন করেছ এ কাজ? বল কেন করেছ? না বললে ছাড়ব না আমি।
সকালবেলার ঘুমভাঙা মনে কোন অন্যায় দেখলে রাগটা বুঝি বেশিই হয়ে পড়ে। ঝাঁকুনির চোটে কানটা ছিঁড়ে যাবে মনে হচ্ছে।
অতসী নেমে এসেছে কোনওরকমে একখানা শাড়িজামা জড়িয়ে, খুকুকে কোলে করে তার ঝিটাও।
দাদা মাত্তে বাবা। হাঁ করে কেঁদে ওঠে খুকু।
আর অতসীর আর্তনাদটাও খুকুর মতই শোনায়।
মরে যাবে যে! কি করছ?
অমন ছেলের মরাই উচিত। বলে পরিস্থিতিটার দিকে একবার তাকিয়ে ধীরে ধীরে চলে যান মৃগাঙ্ক।
আস্তে আস্তে সকলেই চলে যায় আপন কাজে, সময়মত খায়-দায়। শুধু বাগানের এককোণে ঘাড় গুঁজে অভুক্ত বসে থাকে একটা দুর্মতি শিশু, আর নিজের ঘরের এককোণে তেমনি বসে থাকে অতসী। আজ বুঝি খুকুর কথাও মনে নেই তার।
মৃগাঙ্ককে দোষ দেবার তো মুখ নেই অতসীর, তবু তার প্রতিই অভিমানে ক্ষোভে মন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। বারবার মনে হয়, সে একটা অবোধ শিশু বই তো নয়, তার প্রতি এত নিষ্ঠুরতা সম্ভব হল এ শুধু অতসীর একার সন্তান বলেই তো?
.
খিদেয়, গরমে ঘাড় গুঁজে বসে থাকার কষ্টে, আর কানের জ্বালায় দুঃখের অবধি নেই, তবু আজ মনে ভারি আনন্দ সীতুর।
বাবার খুব একটা অনিষ্ট করতে পারা গিয়েছে ভেবে খুব আনন্দ হচ্ছে তার। বোঝাই যাচ্ছে জিনিসটা খুব দরকারী।
হোক মার খেতে, হোক বকুনি খেতে, তবু সীতু এমনি করে জ্বালাতন করবে বাবাকে। দরকারি জিনিস নষ্ট করে দিয়ে, জুতোর মধ্যে কাঁচের কুচি পুরে, আর প্যান্টের পকেটে ধারালো ব্লেড ভরে রেখে।
ধারালো ব্লেড সীতুর মনের মতই ধারালো। সেটা এখনো বাকি আছে।
প্যান্টের যে পকেটে টাকার ব্যাগ আর গাড়ির চাবি থাকে মৃগাঙ্কর, সেই পকেটের মধ্যে লুকিয়ে রাখবে সীতু সেই সংগ্রহ করে রাখা ব্লেডখানা। পকেটে হাত ভরে জিনিস নিতে গেলেই,–হি হি, চমৎকার! আরও অনেক জ্বালাতনের চিন্তা করতে থাকে সীতু। জ্বালাতন করে করে বাবাকে মরিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় তার।
হঠাৎ কোথা থেকে কাদের কথা কানে আসে। ফিস ফিস কথা।
কি কথা এসব? কার কথা? কার গলা?
য্যাতোই হোক, কাঁচা ছেলে বই তো নয়, করে ফেলেছে একটা অকম্ম, তা বলে কি আর অমন মারটা মারে? আপনার ছেলে হলে কি আর পারত?
এ গলা বাসনমাজা ঝি সুখদার।
উত্তর শোনা যায় বামুন মেয়ের গলায়, তুই থাম্ সুখী, নিজের বাপে শাসন করে না? মেরে পাট করে দেয় না অমন ছেলেকে? ছেলের গুণ জানিস তুই? আমার বিশ্বাস পুঁটকে ছোঁড়া জানে সব। তা নইলে কর্তার ওপর অত আক্রোশ কিসের?
বিহ্বল হয়ে এদিক ওদিক তাকায় সীতু। কার কথা বলছে ওরা?
কোন ছেলে সে? কে তাকে শাসন করেছে? নিজের বাপ আপনার ছেলে এ সব কি কথা? কী জানে সীতু?
ভয়! ভয়! হঠাৎ সমস্ত শরীরে কাঁপুনি দিয়ে ভয়ানক একটা ভয় করে আসে সীতুর। বুকের মধ্যেটা হিম হয়ে যায়, আর ওর সেই আবছা আবছা ছবিটা কি রকম যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মনে পড়েছে, ঠিক মনে পড়েছে। জানলায় বসা সেই ছেলেটা আর কেউ নয়, সীতু।
সীতু সে বাড়ির নল দিয়ে জলপড়া চৌবাচ্চাওলা ভাঙা ভাঙা সেই বাড়িটার। সীতু এখানের কেউ নয়, এদের কেউ নয়।
ভয়, ভয়, ভয়ানক ভয়!
কী কাঁপুনি! কী কষ্ট! ভয়ে এত কষ্ট হয়?
.
অফিসে আজ আর কিছুতেই কাজে মন বসে না মৃগাঙ্কর। নিজের সকালের সেই মাত্রাহীন অসহিষ্ণুতার কথা মনে পড়ে লজ্জায় কুণ্ঠায় বিচলিত হতে থাকেন।
ছি ছি, ক্রোধের এমন উন্মত্ত প্রকাশ মৃগাঙ্কর মধ্যে এল কি করে? অতগুলো চোখের সামনে অমন নির্লজ্জ অসভ্যতা করলেন কি করে তিনি? কানটা কি যথাস্থানে আছে ছেলেটার? না ছিঁড়ে পড়ে গেছে?
অতসী কি আজ কথা বলেছে? খেয়েছে? খুকুকে খাইয়েছে?
বাড়ি গিয়ে কি অতসীকে দেখতে পাবে মৃগাঙ্ক? নাকি সে তার ছেলে নিয়ে কোথাও চলে গেছে? দুলাইন চিঠির মারফতে নিষেধ করে গেছে খুঁজতে?
বড় বেশি হয়ে গিয়েছিল!
কিন্তু ছেলেটা যে কিছুতেই কাঁদে না, দোষ স্বীকার করে না, আর করব না বলে না! মানুষের তো রক্তমাংসের শরীর! কত সহ্য করা যায়?
মনে করলেন, যদি ঈশ্বর-অনুগ্রহে যথাযথ সব দেখতে পান, তাহলে নিজেকে আশ্চর্য রকম বদলে ফেলবেন তিনি। অবহেলা করবেন ওই ছোট ছেলেটার সমস্ত দৌরাত্মি। শান্ত হবেন, সহিষ্ণু হবেন, উদার ক্ষমাশীল হবেন। আর কিছুতেই বিচলিত হবেন না।–
ভাবলেন, ছি ছি, ও কি আমার রাগের যোগ্য, ও কি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী? ওর বাচ্চা বুদ্ধির শয়তানী কতটুকু ক্ষতি করতে পারবে ডাক্তার মৃগাঙ্কমোহনের?
অতসীর জন্যে মমতায় মনটা ভরে ওঠে। তার প্রতিও বড় অবিচার করা হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই তো তার কি দোষ? এতদিনের অসাবধানতা আর ত্রুটির পূরণ করে নেওয়ার মত জোরালো কী নিয়ে গিয়ে দাঁড়ানো যায় অতসীর সামনে? কতটা স্নেহ সমাদর আদর?
ভাবতে ভাবতে আবার চিন্তার ধারা অন্য খাতে বইতে থাকে।
সীতু অত ওরকম করেই বা কেন? এই বিকৃত বুদ্ধির কারণ কি শুধুই বংশগত? নাকি ও মৃগাঙ্কর সঙ্গে নিজের সম্বন্ধটা বোঝে?
কেউ কি ওকে কিছু বলেছে?
কিন্তু কে বলে দেবে? কার এত সাহস?
মৃগাঙ্কর আদেশ অমান্য করতে পারে এতবড় দুর্জয় সাহসধারী কে আছে? অতসীই বলেনি তো? কিন্তু অতসীর তাতে স্বার্থ কি?
তবে কি ওর সব মনে আছে?
তাই কি সম্ভব? কত বয়েস ছিল ওর তখন? বড় জোর দুই। কিন্তু তখন থেকেই কি ছেলেটা অমনি বিরুদ্ধভাবাপন্ন নয়?
সেই প্রথম দিনকার স্মৃতি থেকে তন্ন তন্ন করে মনে করতে থাকেন, কে কাকে প্রথম বিরুদ্ধ দৃষ্টিতে দেখেছিল। তিনি সীতুকে, না সীতু তাকে?
একেবারে প্রথম কবে দেখেছিলেন ওকে? সুরেশ রায়ের সেই বাড়াবাড়ি অসুখের দিন না? চোখ উল্টে মুখে ফেনা ভেঙে একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছিল বললেই হয়।
অতসী পাংশুমুখে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল বেতপাতার মত, আর রোগা কাঠিসার ছেলেটা অবিরত তার আঁচল ধরে টানছিল আর কাঁদছিল–মা তলে আয়, মা ওখান থেকে তুলে আয়।
দেখেই কেন কে জানে রাগে আপাদমস্তক জ্বলে গিয়েছিল মৃগাঙ্কর। সহসা ইচ্ছে হয়েছিল ওটাকে টিকটিকি আরশোলার মত ধরে ছুঁড়ে ফেলে দেন ঘরের বাইরে।
সেই প্রথম দেখা। সেই বিরূপতার সুরু।
.
তারপর অনেক ঝড়ের পর যখন অতসীকে নিয়ে এলেন ঘরে, বিবাহের দাবির মধ্য দিয়ে, তখন তার ছেলের যত্ন আদরের ত্রুটি রাখেন নি ঠিক কথা, কিন্তু সেটা কি আন্তরিক?
আপন অন্তর হাতড়ে আজ সেই ছবছর আগের দিনগুলোকে বিছিয়ে ধরে নিরীক্ষণ করছেন মৃগাঙ্ক। দেখছেন যা কিছু করেছেন সীতুর জন্যে, তার সবটাই অতসীর মন প্রসন্ন রাখার তাগিদে, না কিছুটাও সত্যবস্তু ছিল?
হতাশ হচ্ছেন মৃগাঙ্ক, নিজের মনের চেহারা দেখে হতাশ হচ্ছেন। এমন করে তলিয়ে নিজেকে দেখা বুঝি কখনো হয় নি।
নইলে অনেক আগেই বুঝতে পারতেন, সেই রোগা হ্যাংলা কাঠিসার ছেলেটাকে কোনোদিনই সহ্য করতে পারেন নি তিনি। অবিরতই তাকে প্রতিদ্বন্দ্বীর মত মনে হয়েছে।
হোক সে অতসীর সন্তান, তবু তাকে মৃগাঙ্কর প্রতিদ্বন্দ্বী বললে ভুল হবে না। সে যে সুরেশ রায়েরও সন্তান, সে কথা বিস্মৃত হওয়া যাবে কি করে? সুরেশের সন্তান বলে কি অতসী ওকে এতটুকু কম ভালবেসেছে কোনোদিন? বুঝিবা-মৃগাঙ্ক একটু থামলেন, তারপর আবার ভাবনাটাকে এগিয়ে দিলেন বুঝিবা মৃগাঙ্কর সন্তানের চাইতে বেশিই ভালবাসে। হ্যাঁ বেশিই। মুখে যতই ঔদাসীন্য অবহেলা দেখাক, সীতুর দিকে তাকিয়ে দেখতে চোখে সুধা ঝরে ওর।
সেই সেটাই অসহ্য মৃগাঙ্কর। সেই সুধাঝরা দৃষ্টি। সেই দৃষ্টিস্নাত জীবটাও তাই অসহ্য! ওকে অতসীর কাছাকাছি দেখলেই মনে পড়ে যায়, সেই কদর্য কুৎসিত রোগগ্রস্ত লোকটাকে। মনে হয় তাকে কিছুতেই মুছে ফেলা যাবে না অতসীর জীবন থেকে।
তবু এখন আর এক দিক থেকে ভাবছেন মৃগাঙ্ক। তিনি যদি সেই শীর্ণ অপুষ্ট নিতান্ত অসহায় শিশুটাকে বিদ্বেষের মনোভাব নিয়ে না দেখতেন, যদি অতসীর সামনে সস্নেহ ব্যবহার করে, আর অতসীর আড়ালে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে না তাকাতেন ওর দিকে, তাহলে হয়তো ছেলেটাও এত হিংস্র হয়ে উঠত না। এত জাতক্রোধের ভাব থাকত না তার উপর।
কিংবা কে জানে থাকত হয়ত। তার সহজাত সংস্কারই জাতক্রোধের মূর্তিতে ভিতর থেকে ঠেলা মারত তাকে। সেই সংস্কারই তাকেও শেখাতো মৃগাঙ্ক ডাক্তারকে প্রতিদ্বন্দ্বীর চোখে দেখতে। ইতর প্রাণীরা তো আপন জন্মদাতাকেও তাই দেখে।
তবু আজ সত্যই অনুতপ্ত মৃগাঙ্ক ডাক্তার। সত্যই তার ভাবতে লজ্জা হচ্ছে যে ভিতরের সমস্ত গলদ প্রকাশ হয়ে পড়েছে।
অতসীকে কি তিনি আর সম্পূর্ণ করে পাবেন? তার মনের দরজা কি চিরদিনের মত বন্ধ হয়ে গেল না?
.
কিন্তু অতসীর সম্পূর্ণ মনটা কি তিনি কোনদিনই পেয়েছেন? পাওয়া যায় কি?
কুমারী মেয়ের মন কোথায় পাবে, সংসারে পোড়খাওয়া একখানা পুরনো মন?
পুরনো জীবনের ওপর বিতৃষ্ণা ছিল অতসীর, কিন্তু সেই আগেকার আত্মীয়-স্বজনের উপর তোকই বিতৃষ্ণা নেই। ওই যে একটা মেয়ে মাঝে মাঝে আসে, অতসীকে কাকীমা কাকীমা বলে বিগলিত হয়। ও কি মৃগাঙ্কর ভাইঝি?
তা তো নয়। ওকে মৃগাঙ্ক চেনেনও না। ও সেই সুরেশ রায়ের ভাইঝি। সে এলে অতসীর মুখে যেন একটা নতুন লাবণ্যের আলো ফুটে ওঠে, তাকে আদরযত্ন করে খাওয়াবার চেষ্টায় তৎপর হয়ে ওঠে।
দেখে অবশ্য খুব ভাল লাগে না মৃগাঙ্কর, তবু বলেনও না কিছু। হঠাৎ একদিন, এই সেদিন, মেয়েটা না বলা না কওয়া দুম করে মৃগাঙ্ক ডাক্তারের ঘরে ঢুকে কাকাবাবু বলে ঢিপ করে এক প্রণাম। শিউরে উঠেছিলেন মৃগাঙ্ক।
মেয়েটা কিন্তু বেজায় সপ্রতিভ। তবে হৈ চৈ করে যতই সে মৃগাঙ্ককে কাকাবাবু, কাকাবাবু করুক, মৃগাঙ্ক তো কিছুতেই পারলেন না তাকে সস্নেহে স্বচ্ছন্দে আত্মীয় বলে মেনে নিতে! বাচ্চা একটা ছেলের চিকিৎসার জন্যে অনুরোধ করল সে মৃগাঙ্ককে, আড়ষ্টভাবে দেখে ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলেন মৃগাঙ্ক, এই পর্যন্ত।
কেন আড়ষ্ট হলেন তিনি?
ভাবলেন মৃগাঙ্ক। অতসীর যে একটা অতীত ছিল এটা তো স্বীকার করে নিয়েই অতসীকে ঘরে এনেছিলেন, তবে কেন সম্পূর্ণ স্বীকার করে নিতে পারেন না।
মেয়েরা ঈর্ষাপরায়ণ, মেয়েরা সপত্নী-অসহিষ্ণু, মেয়েরা কৈকেয়ীর জাত, কিন্তু পুরুষের উদারতার সোনাটুকু কি কোনোদিন বাস্তব আঘাতের কষ্টিপাথরে ফেলে যাচাই করে দেখা হয়েছে?
এই তো, যাচাই করতে বসলে তো সব সোনাই রাং। মন থেকে প্রসন্ন হয়ে যদি সুরেশ রায়ের ভাইঝিকে গ্রহণ করতে পারতেন মৃগাঙ্ক, যদি পারতেন সুরেশ রায়ের সন্তানকে একেবারে নিতান্ত স্নেহের পাত্র বলে গ্রহণ করতে, তবেই না বলা যেত–পুরুষ মহৎ, পুরুষ উদার, পুরুষ স্ত্রীলোকের মত ঈর্ষাপরায়ণ ক্ষুদ্রচিত্ত নয়!
মৃগাঙ্ক ভাবলেন, সপত্ন-সম্পর্ক সম্বন্ধে পুরুষ বোধ করি মেয়েদের চাইতে অনেক বেশি কুটিল ক্ষুদ্রচেতা ঈর্ষাপরায়ণ।
ভাবলেন, আরও অনেক আগে এভাবে আত্মবিশ্লেষণ করা উচিত ছিল তার।
.
কে বলেছে এ কথা?
তীক্ষ্ণ প্রশ্ন নয়, যেন হতাশ নিশ্বাস! সেই হতাশ নিশ্বাস থেকেই আবার প্রশ্ন হয়, বলেছে বলেই তাই বিশ্বাস করেছ তুমি? তুমি কি পাগল?
কিন্তু প্রশ্ন করবারই বা কি আছে? সীতু যে পাগল নয় এ প্রমাণ তো দিচ্ছে না। পাগলের মতই তো করছে সীতু। বিছানায় মাথা ঘষটাচ্ছে, আর বলছে না তুমি মিথ্যে কথা বলছ। আমার বাবা মরে গেছে। আমি এখানে থাকব না, আমি চলে যাব, আমি মরে যাব!
আচ্ছা ঠিক আছে, তোমাকে থাকতে হবে না এখানে অতসী তেমনি হতাশ কণ্ঠে বলে, তোমার অন্য ব্যবস্থা করব। শুধু যে কটা দিন তা না হচ্ছে, একটু শান্তিতে থাকতে দাও আমায়।
না না পাগলের মতই গোঁ গোঁ করছে সীতু, আমি এক্ষুনি চলে যাব। আমি এক্ষুনি চলে যাব।
চলে যাবি! আমার জন্যে তোর মন-কেমন করবে না?
না না না। তুমি খুকুর মা, তুমি এদের বাড়ির লোক।
অতসী এবার দপ করে জ্বলে উঠে দৃঢ়কণ্ঠে বলে, রোসো, সত্যিই তোমাকে বোর্ডিঙে রাখবার ব্যবস্থা করছি আমি।
বলছি তো আমি এক্ষুনি চলে যাব।
যা তবে। কোন চুলোয় তোর সেই পূর্বজন্মের বাড়ি আছে, যা সেখানে। হবেই তো, এর চাইতে ভাল বুদ্ধি আর হবে কোথা থেকে? কৃতজ্ঞতা কি তোদের হাড়ে থাকতে আছে? বলছি যত শীগগির পারি তোমায় বোর্ডিঙে দেব, আজ এক্ষুনি সেটা শুধু সম্ভব নয়। একটা দিন আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।
তুমি কেন মিথ্যে কথা বলেছিলে? কেন বলেছিলে ওটা আমার বাবা?
বেশ করেছি বলেছি। একফোঁটা একটা ছেলের কাছে আর হারতে পারে না অতসী। নিষ্ঠুরতার চরম করবে সে। তাই ঝজালো গলায় তেতো স্বরে বলে ওঠে, কি করবি তুই আমার? এখানে যদি না আসতিস, খেতে পেতিস না, পরতে পেতিস না, বাড়িওলা দূর দূর করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিত, রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করতে হত বুঝলি? যে মানুষটা এত যত্ন করে মাথায় করে নিয়ে এল, তাকে তুই–উঃ এই জন্যেই বলে দুধকলা দিয়ে সাপ পুষতে নেই!
মেরে ফেল, মেলে ফেল আমাকে!
মেরে তোকে ফেলব কেন, নিজেকেই ফেলব। অতসী গম্ভীরভাবে বলে, সেইটাই হবে তোর উপযুক্ত শাস্তি।
.
কাকীমা!
দরজার বাইরে থেকে ধ্বনিত হল এই পরিচিত কণ্ঠটি। হল বেশ শান্তকোমল স্বরেই, কিন্তু সে স্বর অতসীর শুধু কানেই নয়, বুকের মধ্যে পর্যন্ত ঝনাৎ করে গিয়ে লাগল। লাগার সঙ্গে সঙ্গে হাত পা শিথিল হয়ে এল তার।
এ কী! এ কী বিপদ! বেড়াতে আসার আর সময় পেল না শ্যামলী? এই যে ছেলেটা খাটের ওপর মুখ গুঁজে গড়াগড়ি খাচ্ছে, এ দৃশ্য তো শ্যামলী এখনি এসে দেখে ফেলবে। কী কৈফিয়ৎ দেবে অতসী তার? শ্যামলী কি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাবে না? ভাববে না কি কোথাও কোনও ঘাটতি ঘটেছে? তাছাড়া সীতু ওকে দেখে আরও গোঁয়ার্তুমি, আরও বুনোমি করবে কিনা, কে বলতে পারে? হয়তো ইচ্ছে করে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করবে, যে অবস্থাকে কিছুতেই আয়ত্তে এনে সভ্য চেহারা দেওয়া যাবে না।
কাকীমা আসছি। পর্দায় হাত লাগিয়েছে শ্যামলী। মুহূর্তে সমস্ত ঝড় সংহত করে নিয়ে সহজ স্বাভাবিক গলায় কথা বলে ওঠে অতসী, আয় আয়, বাইরে থেকে ডেকে পারমিশান নিয়ে এত ফ্যাশান শিখলি কবে থেকে?
শ্যামলী একমুখ হাসি আর বড় একবাক্স সন্দেশ হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল।
নিজের খুশীর ছটায় পারিপার্শ্বিকের দিকে দৃষ্টি পড়ে না শ্যামলীর, এগিয়ে এসে সন্দেশটা অতসীর দিকে বাড়িয়ে ধরে, নিন–বাটুর সেরে ওঠার মিষ্টি খান।
কি আশ্চর্য! এসব কি শ্যামলী? না না, এ ভারি অন্যায়।
অন্যায় মানে! অতদিন ধরে ভুগছিল ছেলেটা, আমরা তো হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। কোনও ডাক্তার রোগ ধরতে পারছিল না। ডাক্তার কাকাবাবুর দুদিনের দেখায় সেরে উঠল, এ আহ্বাদের কি শেষ আছে? নেহাৎ নাকি ফুলচন্দন দিয়ে পূজো করা চলে না, তাই কাকাবাবুকে একটু মিষ্টি মুখ করিয়ে
ভারি বাক্যবাগীশ মেয়েটা। কিন্তু দ্বিধা চিন্তা কিছু নেই, সাদাসিধে সরল। কথা যখন বলে, তাকিয়ে দেখে না তার প্রতিক্রিয়া কি হচ্ছে। এই জন্যেই তো সুরেশ রায়ের বংশের মধ্যে এই মেয়েটাকেই বিশেষ একটু স্নেহের চক্ষে দেখত অতসী। সুরেশ রায়ের জেঠতুতো দাদার মেয়ে। শ্যামলা রং, হাসিখুশী মুখ, গোলগাল গড়ন, বছর আষ্টেকের মেয়েটা, বিয়ের কনে অতসীর সামনে এসে দাঁড়ানো মাত্রই অতসীর মন হরণ করে নিয়েছিল। শ্যামলীও কাকীমার মধ্যে যেন বিশ্বের সমস্ত সৌন্দর্য দেখতে পেয়েছিল।
তারপর তো অতসীর দিকে কত ঝড়, কত বন্যা, মহামারী দুর্ভিক্ষ, আরও কত কি! আর শ্যামলীর দিকে প্রকৃতির অকৃপণ করুণা। স্কুলের পড়া সাঙ্গ হতে না হতেই ভাগ্যে জুটে গেছে দিব্যি খাসা বর, সংসার করছে মনের সুখে স্বাধীনতার আরাম নিয়ে। বড়লোক না হলেও অবস্থা ভাল, আর স্বামীটির প্রকৃতি অতীব ভাল। সরল, হাস্যমুখ। দুটো ছেলেমানুষে মিলে যেন খেলার সংসার পেতেছে!
বিধাতার আশ্চর্য নির্বন্ধ, সে সংসার পেতেছে অতসীরই বাড়ীর কখানা বাড়ি পরে। আগে জানত না দুজনের একজনও, দেখা হয়ে গেল দৈবাৎ।
পাড়ার বইয়ের দোকানে সীতুকে নিয়ে তার নতুন ক্লাসের বই কিনতে গিয়েছিল অতসী, আর শ্যামলীও এসেছে ছোট ছেলের জন্যে রঙিন ছবির বই কিনতে। অসুস্থ ছেলে রেখে এসেছে ঘরে, তার মন ভোলাতে বাছাই করছে নানা রঙবেরঙের ছবি-ছড়া। ছেলে নিয়ে দোকানে উঠেই অতসী যেন পাথর হয়ে গেল!
এ কী অভাবিত বিপদ! এই দণ্ডে কি সীতুকে টেনে নিয়ে দোকান থেকে নেমে যাবে অতসী? নাকি না দেখার ভান করবে?
দুটোর কোনোটাই হল না, চোখাচোখি হয়ে গেছে। আর চোখ পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শ্যামলী লাফিয়ে উঠেছে, কাকীমা!
এরপর আর কি করে না দেখার ভান করবে অতসী? কি করে চট করে নেমে যাবে দোকান থেকে?
ফিকে হাসি হাসতেই হয়, মুখে কথা জোগাবার আগে। কিন্তু শ্যামলী ওসব ফিকে ঘোরালোর ধার ধারে না। পূর্বাপর ইতিহাস, বর্তমান পরিস্থিতি, কোনও কিছুই তার উল্লাসকে রোধ করতে পারে না। দোকানের মাঝখানেই একে ওকে পাশ কাটিয়ে অতসীর গায়ে হাত ঠেকিয়ে বলে ওঠে, ওঃ কাকীমা, কতদিন পরে! বাবাঃ!
অতসীর প্রবল শক্তি আছে ঝড়কে মনের মধ্যে বহন করে বাইরে সহজ হবার, তবু বুঝি অবিচলিত থাকা সম্ভব হয় না। তবু বুঝি কথা কইতে ঠোঁট কাঁপে, তুমি এখানে!
ওরে বাবা, আমাকে আবার তুমি! এই দুষ্টু মেয়েটাকে বুঝি ভুলেই গেছেন কাকীমা? ওসব চলবে না, তুই বলুন!
এবার অতসী সত্যিকার একটু হাসে, বলছি। এখানে আর কি কথা হবে?
এখানে মানে? ছাড়ব নাকি? ধরে নিয়ে যাব না? বইটই কেনা এখন থাক, চলুন চলুন। বাবাঃ কত দিন পরে! আপনার কার জন্যে বই? ওমা সীতু না? কত বড়টি হয়ে গেছে, ইস! কিন্তু সেই রকম রোগা আছে। কথা, কথা, কথার স্রোত একেবারে! দোকানের লোকেরা যে হাঁ করে শুনছে তাও খেয়াল নেই মেয়েটার।
শুধু ওই জন্যেই দোকান থেকে বেরিয়ে পড়ে অতসী। কি বলবে ভেবে না পেয়ে বলে তুমি এখানের দোকান থেকে কেনাকাটা কর বুঝি?
আবার তুমি! অভ্যাস বদলান। এই দোকান থেকে কেনাকাটা করব না! এই তো পাড়া আমাদের। ওই মোড়ের মাথায় প্রকাণ্ড লালরঙা বাড়িটা, ওখানেই একটা ফ্ল্যাটে থাকি। দোতলার ফ্ল্যাট। অত কথায় কাজ কি, চলুন!
অতসী অনুভব করছে তার হাতের মধ্যে ধরা সীতুর হাতটা কাঠের মত শক্ত হয়ে উঠেছে, চকিত দৃষ্টি ফেলে দেখছে, যাকে বলে বিস্ময়বিস্ফারিত, তেমনি দৃষ্টি ফেলে নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে আছে সীতু এই বাক্যচ্ছটাময়ীর হাসিতে উচ্ছল খুশীতে টলমল মুখটার দিকে!
অমন করে দেখছে কেন? শুধুই অপরিচিতার প্রতি শিশুমনের কৌতূহল? নাকি এমন হাসিতে উচ্ছল খুশীতে টলমল মুখ সে জীবনে কখনো দেখেনি বলে অবাক হয়ে গেছে?
নয় তো কি! নয় তো কি! মনে মনে শিউরে উঠছে অতসী, এই আকস্মিকতার সূত্র ধরে এক বিস্মৃত অতীতকে মনে পড়ে যাচ্ছে সীতুর? পরতে পরতে খুলে পড়ছে চেতনার কোনও স্তর?
এ কী বিপদ, এ কী বিপদ!
অন্যমনস্ক মেয়েটা কি শুধুই অন্যমনস্ক? ভেবেছিল সেদিন অতসী। নাকি এই অজস্র কথার ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভয়ঙ্কর একটা ভারী জিনিসকে ঠেলে পার করে নিয়ে যেতে চায় সে? তাই অন্যমনস্কতার ভান করে এই ঢেউ দেওয়া, ঢেউয়ে ভাসিয়ে দেওয়া।
.
শুধু কথা নয়, রাস্তার মাঝখানে প্রায় হাত ধরেই টানাটানি করেছিল সেদিন শ্যামলী অতসীকে, তবু হেসে মিনতি করে সে অনুরোধ কাটিয়ে পালিয়ে এসেছিল অতসী, আর নিতান্ত ভদ্রতার দায়ে নিতান্ত মৌখিকভাবেই বলতে বাধ্য হয়েছিল, বেশ তো, তুইও তো চলে আসতে পারিস!
ও বাবা! সে আবার বলার অপেক্ষা? শ্যামলী হেসে উঠেছিল, সে তত আমি না বলতেই যাব। গিয়ে গিয়ে পাগল করে তুলব। একবার যখন সন্ধান পেয়ে গিয়েছি।
.
তা কথা রেখেছে শ্যামলী। কেবলই এসেছে। অতসী অস্বস্তি পাচ্ছে কি বিব্রত হচ্ছে, সে চিন্তা মাথায় আসে নি তার। ওকে দেখলে অতসীর মনটা স্নেহে কোমল হয়ে আসে–কেবলমাত্র নিজস্ব, এই একটা অদ্ভুত সুখানুভূতির রোমাঞ্চে, যেন নিষিদ্ধ ভালবাসার স্বাদ পায়, তবু অতসীর পূর্বজীবনের একটা টুকরো যে বারবার এসে মৃগাঙ্কর চোখকে আর মনকে ধাক্কা মেরে যাবে, এটাতেও স্বস্তি পায় না।
কিন্তু এই অবুঝ ভালবাসাকে ঠেকাবেই বা সে কি করে? কি করে বলবে, তুই আর আসিস না শ্যামলী?
তার উপর আর এক ঝামেলা। শ্যামলী তার ছেলেকে দেখাতে চায় মৃগাঙ্ক ডাক্তারকে। শুনে মনটা বোদা বিস্বাদ হয়ে গিয়েছিল অতসীর। বেশ একটা বিরক্তি এসে গিয়েছিল তার উপর। এ তো বড় ঝঞ্জাট! এ আবার কী উপদ্রব! মনে হয়েছিল, নাঃ এ সবে দরকার নেই, স্পষ্টাস্পষ্টিই বলে দেবে শ্যামলীকে, এতে অতসী অস্বস্তি বোধ করে।
কিন্তু বলতে গিয়েও বলা যায় না। তাই ছেলের কি এমন হয়েছে সেটাই জিগ্যেস করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
কি হয়েছে, সেইটাই তো রহস্য! কী যে হয়েছে বুঝতে পারছে না কোনও ডাক্তারবদ্যি। লক্ষণের মধ্যে, শুধু পায়ের হাড়ে ব্যথা, শুধু দুর্বলতা। অথচ বারবার এক্সরে করেও ব্যথার কোনও উৎস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, যথেষ্ট পরিমাণে যথোপযুক্ত খাইয়েও দুর্বলতা ঘোচানো যাচ্ছে না।
মৃগাঙ্ক যে বোন স্পেশালিস্ট এটা যেন শ্যামলীরই গ্ৰহমুক্তির একটা নিদর্শন!
মনে আশা হচ্ছে কাকীমা, এতদিনে হয়তো ফাড়া কাটল। নইলে খোকার যা অসুখ করেছে, ডাক্তার কাকাবাবু ঠিক তারই স্পেশালিস্ট হলেন কেন! বলেছিল শ্যামলী।
অতসী অবাক হয়ে চেয়ে দেখেছিল ওর মুখের দিকে। কী সুখী এই নির্বোধ মানুষগুলো! এরা কত সহজেই সহজ হতে পারে!
রোখা গেল না শ্যামলীকে। কি করে যাবে? কোন অমানবিকতায়? একটা শিশুর দুরারোগ্য ব্যাধির কাছে কি অতসীর তুচ্ছ মানসিক বাধার প্রশ্ন?
বিবেককে কি জবাব দেবে, যদি শ্যামলীকে ফিরিয়ে দেয়?
বলতে হল মৃগাঙ্ককে।
.
মৃগাঙ্ক রাগ করল না, বিদ্রূপ করল না, আপত্তিও করল না, শুধু অতসীর মুখের দিকে একবার স্পষ্ট পরিষ্কার চোখে চেয়ে বলল, নিয়ে এস।
তা নিজে নিয়ে আসে নি অতসী। শ্যামলীকেই পাঠিয়ে দিয়েছিল ছেলে সঙ্গে দিয়ে, এবং গম্ভীরমূর্তি মৃগাঙ্কমোহন গভীর যত্নের সঙ্গেই দেখেছিলেন রোগীকে। আর জানিয়েছিলেন, হাড়ে কিছুই হয়নি, ব্যথার উৎস পেশীতে।
দুর্বলতা? সেটা ভুল চিকিৎসার প্রতিক্রিয়া।
বার দুই দেখা আর ওষুধ দেওয়াতেই অদ্ভুতভাবে কাজ হল। অতসী এতটা আশা করে নি।
ওদিকে শ্যামলী আর তার স্বামী বিগলিত।
তারপর থেকে দ্রুত উন্নতি হয়েছে। বেড়েছে ওজন। সেই ওজন বাড়ার সূত্র ধরেই আজ শ্যামলীর এত দুঃসাহস।
হ্যাঁ, সেই কথাটাই মনে হল অতসীর। মৃগাঙ্ককে সন্দেশ খাওয়াতে চায়! কী দুঃসাহস, কী ধৃষ্টতা!
অথচ শ্যামলীকে বলা চলে না সে কথা। তাই হাত পেতে নিতে হয় সেই সন্দেশ সম্ভার, যেটা বিপদের ডালির মত!
ছেলেকে এবার আনিস একদিন। বলল অতসী, এখন তো হাঁটতে পারবে।
ও বাবা নিশ্চয়।
শ্যামলী কেন সাধারণ ভদ্রতা বা সাধারণ সৌজন্যটুকুর মানে বোবে না? কেন সেই মুখের কথাটাই বড় করে ধরে?
আজ যেন ফেরার তাড়া মাত্রও নেই শ্যামলীর, জাঁকিয়ে বসে কথা কইছে তো কইছেই।
বুঝলেন কাকীমা, আপনার জামাই বলেন, ডাক্তার কাকাবাবু শুধু ডাক্তারই নন, যাদুকরও। নইলে দেখলামও তো এ পর্যন্ত কমজনকে নয়, কেউ বুঝতে পারল না, আর উনি দেখলেন আর
মোটই ভাল ডাক্তার নয়?
হঠাৎ একটা তীব্র তীক্ষ্ণ রূঢ় মন্তব্যে শিউরে চমকে উঠল ঘরের আর দুজন। বিছানার কোণ থেকে চেঁচিয়ে উঠেছে সীতু।
.
ওমা ও কি রে সীতু, ও কথা বলতে আছে? শ্যামলী অবাক হয়ে বলে, ভাল ডাক্তার নয় কি, খুব ভাল ডাক্তার তো!
ছাই ভাল! বিদ্বেষে তিক্ত শিশুর কণ্ঠ কি কুৎসিত! ভাবল অতসী।
আর শ্যামলী ভাবল ছেলেমানুষের ছেলেমানুষী। নিশ্চয় কোন কারণে বাপের ওপর রাগ হয়েছে ছেলের। পরক্ষণেই ভাবল–তা বাপ ছাড়া আর কি! উপকারী আর স্নেহশীল মানুষকে পিতৃতুল্যই বলা হয় বইকি। ইনি যদি এমন উদারচিত্ত না হতেন, কোথায় আজ দাঁড়াত অতসী? কে জানে কোথায় ভেসে যেত সীতু!
ও বাড়ির ছোটকাকার কী না কী অবস্থা ছিল, শ্যামলী তো আর ভুলে যায় নি! কী হালে কাটিয়েছে অতসী আর সীতু, তাও দেখেছে সে।
আর এখন?
এই রাজপুরীর কুমার হয়ে সুখের সাগরে গা ভাসিয়ে থাকা! কত ভাগ্য! এ বাড়ির সাজসজ্জা আরাম আয়োজন ঔজ্জ্বল্য চাকচিক্য শ্যামলীকে মুগ্ধ করে।
বাড়িতে বরের সঙ্গে আলোচনাও করে খুব। মৃগাঙ্ক যদি এমন মহৎ না হতেন, মৃগাঙ্ক যদি এমন ধর্মনিষ্ঠ না হতেন, কী হত অতসীর দশা?
সুরেশের মৃত্যুর পর অতসীর প্রতি মৃগাঙ্কর যে ভাব জেগেছিল, সে কি শুধুই নারীরূপের মোহ? শুধুই বেওয়ারিশ একটা মানুষের প্রতি উছুল লুব্ধতা?
তা যদি হত, বিবাহের সম্মান দিয়ে তাকে ঘরে নিয়ে আসতেন? কী দরকার ছিল? তা না দিয়েও, ঘরে ঢোকার অধিকার না দিয়েও সেই মালিকহীন রূপবতাঁকে উপভোগ করবার বাধাটা কোথায় ছিল, যদি অভাবগ্রস্ত এবং মোহগ্রস্ত অতসী আত্মসমর্পণ করে বসত?
বাধা সমাজও দিত না, আইনও দিত না। পুরুষের এ দুর্বলতা গ্রাহের চক্ষেই আনত না কেউ।
অতসীকে? তা হয়তো সবাই ছিছিক্কার করত, কিন্তু তাছাড়া আর তো কিছু করত না! মৃগাঙ্ক না দেখলে সুরেশ রায়ের আত্মীয় সমাজ ডেকে শুধোত কি তাকে, হ্যাঁ গো এখন তোমার কিভাবে চলবে? বলতে কি সীতুকে মানুষ করে তুলবে কি করে?
ভাড়া দিতে না পারলে বাড়িওলা যদি তাড়িয়ে দিত? সীতুর হাত ধরে অতসী কারও বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়ালে সে কি দরজা খুলে ধরতে?
না, মানবিকতার প্রশ্ন নিয়ে কেউ এগিয়ে আসত না। নেহাৎ যদি অতসী মান অপমানের মাথা খেয়ে কারুর পায়ে গিয়ে কেঁদে পড়ত, চক্ষুলজ্জার দায়ে সে হয়তো দিত এতটুকু ঠাই, একমুঠো ভাত, কিন্তু প্রতিদিন দীর্ঘশ্বাস আর চোখের জলে সে অন্নের ঋণ শোধ করতে হত।
নিষ্পরের বাড়ির দাসত্বে মাইনে আছে, মর্যাদা আছে। আত্মীয়জনের বাড়ির দাসত্বে দুটোর একটাও নেই। উল্টে আছে গঞ্জনা, লাঞ্ছনা, অবমাননা!
দুঃখে পড়ে আত্মীয়ের কাছে আশ্রয় নেওয়ার চাইতে বড় দুঃখ বোধকরি জগতে দ্বিতীয় নেই।
বেশ করেছে অতসী, ঠিক করেছে।
.
দুজনেই বলেছিল ওরা-শ্যামলী আর শ্যামলীর বর, ঠিক করেছেন কাকীমা।
বলেছিল, ছেলেটাকে পথের ভিখিরি হবার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন উনি।
তাছাড়া ভালবাসারও একটা মর্যাদা দিতে হয় বইকি বলেছিল শ্যামলী। ইনি, মানে ডাক্তারবাবু, কাকীমাকে সত্যিকার স্নেহের চক্ষে, ভালবাসার চক্ষে দেখেছিলেন।
তা তো সত্যি বলেছিল তার বর, নইলে আর বিবাহের মর্যাদা দেন! আরও বলেছিল, সে সীতুকে উপলক্ষ্য করে-লাকী বয়! ধর, তোমার কাকীমার যদি শুধু ওই মেয়েই থাকে, আর ছেলে না হয়, ওই অত সম্পত্তি, সব কিছুর মালিক তোমাদের সীতু। আর হয়ও যদি, বেশ কিছু তো পাবেই।
.
কাজেই লাকী বয় সম্পর্কে নিশ্চিন্তচিত্ত শ্যামলী সীতুর এই সহসা উগ্র হয়ে ওঠা রূঢ়তায় বিস্মিত না হয়ে হেসে উঠে বলে, কি হল? হঠাৎ এত রাগ কিসের সীতুবাবুর?
আশ্চর্য! আশ্চর্য!
অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে সীতু, অতসীর অবিচলিত অম্লান মুখ থেকে সহসা উত্তর উচ্চারিত হচ্ছে, আরে দেখ না, ওর পেটব্যথা করছে, ওষুধ খেয়ে কমে নি, তাই অত মেজাজ! সেই থেকে পড়ে পড়ে ছটফট করছিল
ওমা তাই বুঝি! হি হি করে হেসে ওঠে শ্যামলী, সত্যিই তো বাপু, মেজাজ তো হতেই পারে। বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা!
মায়ের ওই অবিচলিত মুখের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় বলেই কি সীতু আর কথা বলতে পারে না?
.
মেয়েটি কে গো বৌদিদি?
বামুন মেয়ের উগ্র কৌতূহল আর বাঁধ মানে না, মনিবানীর ভূভঙ্গীর ভয়েও না। সে কৌতূহল উক্ত প্রশ্নের আকারে এসে আছড়ে পড়ে অতসীর কাছে।
অতসী ভ্রূভঙ্গী করে।
বলে, কোন মেয়েটি?
ওই যে কেবলই আসে যায়, দাদাবাবুকে অসুখ ছেলে এনে দেখায়, এই তো আজও এসেছিল—।
আমার ভাইঝি।
গম্ভীর কণ্ঠে বলে অতসী।
ভাইঝি! বামুন মেয়ের বিস্ময় যেন আকাশে ওঠে। ভাইঝি যদি তো, তোমায় কাকীমা বলে কেন গো?
বলে, ওর বলতে ভাল লাগে। অতসী কঠিন মুখে বলে, কে কাকে কি বলে ডাকে, তা নিয়ে তোমার এত মাথা ঘামানোর কি আছে?
ওমা শোন কথা! মাথা ঘামানো আবার কি? ডাকটা কানে বাজল তাই বলেছি। দেখিনি তো ওকে কখনো এর আগে। আমি তো আজকের নই, কত কালের! তোমার শাশুড়ির আমল থেকে আছি। এদের যে যেখানে আছে সবাইকে জানি চিনি। সগর্বে ঘোষণা করে বামুনমেয়ে।
ভালই তো। বলে চলে যায় অতসী, আর মনে ভাবে, ঠিক এই কারণেই তোমাকে আগে বিদায় করা দরকার। আমার সমস্ত নিশ্চিন্ততার ওপর কাটার প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে তোমায় দেব না আমি।
.
কিন্তু দেব না বললেই তো চলে না। পুরনো হয়ে দাঁড়ালে কাটাগাছেরও মাটির ওপর একটা স্বত্ব জন্মায়, শিকড়ের বন্ধন জোরালো হয়। তাকে উৎপাটিত করতে অনেক শক্তি লাগে।
কারণ তো একটা থাকা চাই! অনেক দিনের শিকড়কে উৎপাটিত করবার উপযুক্ত কারণ!
সুরেশ রায়ের ভাইঝির পরিচয় চেয়েছিল সে, এই অপরাধে বরখাস্ত করা যায়?
.
নিতান্ত বুদ্ধিসম্পন্নরাও মাঝে মাঝে বোকা হয়ে যায়, এ দৃষ্টান্ত আছে। অতসীর আজকের সেই দৃষ্টান্তে একটা নতুন সংযোজনা। নইলে কি দরকার ছিল ওর মৃগাঙ্কর সামনে শ্যামলীর আনা সেই প্রকাণ্ড মিষ্টির বাক্সটা নিয়ে আসা। খেতে বসেছিল মৃগাঙ্ক, অতসী বাক্সটা টেবিলে নামিয়ে চামচ করে সন্দেশ তুলে পাতে দিতেই মৃগাঙ্ক বলে ওঠেন, এত সন্দেশ! কেউ তত্ত্বটত্ত্ব পাঠিয়েছে নাকি?
তত্ত্ব নয়, অতসী মৃদুস্বরে বলে, শ্যামলীর ছেলের অসুখ সেরে গেছে বলে আহ্লাদ করে
শ্যামলী কে? ভুরু কুঁচকে বলে ওঠেন মৃগাঙ্ক।
শ্যামলী! অতসী থতমত খেয়ে বলে, শ্যামলী মানে সেই মেয়েটি যার ছেলের অসুখে তুমি–
থেমে গেল অতসী। দেখল মৃগাঙ্কর ভুরুটা আরও বেশি কুঁচকে উঠেছে, হাতের আঙুল কটা উঠেছে কঠিন হয়ে, সেই কঠিন আঙুলের ডগা দিয়ে সন্দেশ দুটো ঠেলে রাখছে থালার কোণে। মুহূর্তে সহসা কঠিন হয়ে উঠল অতসীও। যে স্বরে কখনো কথা বলে না সেই স্বরে বলল, খাবে না?
মৃগাঙ্ক গম্ভীর স্বরে বলেন, না।
অতসীরও বুঝি সীতুর হাওয়া লেগেছে, জেগেছে বুনো গোঁ, তা নয়তো অমন জিদের স্বরে বলে কেন, না খাবার কারণ?
ইচ্ছে নেই!
কেন ইচ্ছে নেই বলতে হবে।
বলতেই হবে?
বিদ্রুপে তিক্ত শোনাল মৃগাঙ্কর কণ্ঠ।
আশ্চর্য! এই সেদিন না মৃগাঙ্ক ডাক্তার মনকে উদার করার দীক্ষা নিচ্ছিলেন? মন্ত্রপাঠ করেছিলেন সহনশীলতার? ভাবছিলেন, অতসীর যে একটা অতীত আছে, সেটা ভুলে গেলে চলবে কেন? অথচ কিছুতেই তো সামান্য ওই বাটাছানার মিহি সন্দেশ দুটো গলাধঃকরণ করতে পারলেন না! তিক্তকণ্ঠে বললেন, বলতেই হবে?
হ্যাঁ বলতেই হবে। স্বভাব বহির্ভূত জেদি সুরে রুক্ষ নির্দেশ দেয় অতসী, বলতেই হবে, বাধা কিসের? প্রতিবেশীর ঘর থেকে মিষ্টি দিলে লোকে খায় না?
প্রতিবেশী। ও হ্যাঁ, নতুন একটা পয়েন্ট আবিষ্কার করেছ দেখছি। কিন্তু প্রতিবেশীর পরিচয় বহন করেই কি সে এখানে এসেছিল?
ঠিক কথা, তা সে আসেনি। কিন্তু যে পরিচয়েই আসুক, তার অপরাধটা কোথায় জানতে পারি কি?
মৃগাঙ্কমোহনের কি সামলে যাওয়া উচিত ছিল না? ভাবা উচিত ছিল না, অতসী তো কই কখনো এমন করে না? সত্যি স্ত্রীর অধিকারে তর্কাতর্কি জেদাজেদি, অথবা ঔদ্ধত্যপ্রকাশ, এ কবে করেছে অতসী? হয় নিজেকে লুকিয়ে রাখা কুণ্ঠিত মৃদু ভাব, নয়তো বিগলিত অভিভূত কৃতজ্ঞতা। অতসীর আজকের এ রূপ নতুন, অপরিচিত। তবু তো কই নিজেকে সামলালেন না মৃগাঙ্ক, বরং যেন আগুনে ইন্ধন দিলেন। বলে উঠলেন, অপরাধ কারুর কোথাও নেই অতসী; অপরাধী আমিই। সুরেশ রায়ের আত্মীয়ের হাতের সন্দেশ খাবার রুচি আমার নেই।
স্পষ্ট স্বীকারোক্তি!
বোধকরি এতটা স্পষ্টতা আশা করে নি অতসী, তাই স্তব্ধ হয়ে গেল সে, সাদা হয়ে গেল মুখ। তারপর আস্তে আস্তে আরক্ত হয়ে উঠল সেমুখ। তারপর কথা কইল আস্তে আস্তে। বলল, এক সময় আমিও ওই নামের লোকেরই আত্মীয় ছিলাম।
মৃগাঙ্ক এবার বোধকরি একটু সামলে নিলেন নিজেকে। বললেন, বৃথা উত্তেজিত হচ্ছ কেন? কারণটা যখন সামান্য। এই সন্দেশটা খেলাম কি না খেলাম, কি এসে গেল তাতে?
প্রশ্নটা সন্দেশ খাওয়ার নয়, স্থির স্বরে বলে অতসী, প্রশ্নটা হচ্ছে রুচি না হওয়ার। প্রশ্ন হচ্ছে সহ্য করতে পারা না পারার। সাদাসিধে হাসিখুশী কমবয়সী একটা মেয়ে এক আধবার তোমার বাড়িতে বেড়াতে আসে, সেটুকু সহ্য করবার মত উদারতা তুমি খুঁজে পাচ্ছ না দেখতে পাচ্ছি।
মৃগাঙ্ক আবার যেন দপ্ করে জ্বলে ওঠেন, সেটা দেখতে পাচ্ছ অতসী, কারণ মন তোমার আচ্ছন্ন হয়ে আছে সন্দেহে আর অভিমানে। তবু জিজ্ঞেস করি, যদিই হয়ে থাকে, এই সঙ্কীর্ণতা কি খুব অস্বাভাবিক?
অন্তত যে কোনও বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে স্বাভাবিকও নয়। তুমি কি জানতে না আমার একটা অতীত আছে, আর জীবনের ছাব্বিশ সাতাশটা বছর ধরে আমি সমাজ সংসারের বাইরেও কাটাই নি? আমার সেই জীবনে কারুর ওপর একটু স্নেহ জন্মাবে না, এটাই বা হবে কেন?
মৃগাঙ্কর খাওয়া শেষ হয়েছিল, তিনি চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, আমি তো বলি নি অতসী, হবে না, হওয়া উচিত নয় হওয়া অস্বাভাবিক। তুমি যাকে খুশী এবং যতখুশী স্নেহ করে বেড়াও না, আমি তো আপত্তি করতে যাচ্ছি না। শুধু এইটুকু চাইছি, আমাকে তার মধ্যে জড়াবার চেষ্টা না কর।
অতসী কি আজ ক্ষেপে গেছে? ও কি মস্তবড় একটা বোঝাঁপড়া করতে চায়–শুধু মৃগাঙ্কর সঙ্গে নয়, নিজের সঙ্গেও? নইলে এমন করে কথা কাটাকাটি করছে সে কি করে? এতগুলো বছরের মধ্যে যে অতসী মৃগাঙ্কর মুখের উপর একটি উঁচু কথা কয় নি?
আজ শুধু কথাই উঁচু নয়, গলাও উঁচু অতসীর।
তাই বা চেষ্টা করব না কেন? আমি যদি তোমার পরিচিত সমাজ থেকে নির্লিপ্ত থাকতে চাই? তোমার প্রীতিকর হবে সেই অবস্থাটা?
মৃগাঙ্ক একটু ভুরু কোঁচকালেন, তারপর ঈষৎ ব্যঙ্গে বললেন, হয়তো হবে না। তবু এটাই স্বীকার করে নেব, জীবনে সব কিছুই প্রীতিকর জোটে না।
ওঃ তাই! অতসী সহসা খুব শান্ত গলায় বলে, তাই এই নীতিতেই তাহলে সীতুকে মেনে নিয়েছিল তুমি? তোমার অগাধ অসীম উদারতায় নয়?
এবার বুঝি স্তব্ধ হবার পালা মৃগাঙ্কমোহনের।
এক মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে বলেন, নিজেকে আমি মস্ত এক উদার ব্যক্তি বলে কোনদিনই প্রচার করে বেড়াই নি অতসী!
ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে যান মৃগাঙ্ক ডাক্তার।
আর অতসী কাঠের মত বসে থাকে সেই খাবার টেবলেরই ধারের একটা চেয়ারে। এখানে যে এখুনি চাকরবাকর এসে পড়বে, সে খেয়াল থাকে না তার।
এ কী করল সে? এ কী করল? কেঁচো খুঁড়তে, সাপ তুলে বসল?
মৃগাঙ্ককে ছোট করতে গিয়েছিল সে? ছি ছি ছি! তা করতে গিয়ে কত ছোট হয়ে গেল নিজে!
মৃগাঙ্ক স্তব্ধ হয়ে গেল।
যাবেই তো। সীমাহীন স্পর্ধা আর সীমাহীন অকৃতজ্ঞতা মানুষকে মূক করে দেওয়া ছাড়া আর কি করতে পারে?
.
ডাক্তার মৃগাঙ্কমোহনের সময় নেই অতসীর মত মন নিয়ে রোমন্থন করবার। তবু আজ আর গাড়ির স্টিয়ারিঙ নিজের হাতে নিলেন না তিনি, ড্রাইভারের হাতে ছেড়ে দিয়ে পিছনে বসলেন হেলান দিয়ে, ভাবতে লাগলেন অতসীর অভিযোগ কি ভিত্তিহীন?
সত্যি বটে, সীতুর অসভ্যতা তাকে এত পীড়িত করে যে, কিছুতেই তার প্রতি মনকে প্রসন্ন করে তুলতে পারেন না, কিন্তু ওই মেয়েটা? ওর প্রতি অপ্রসন্নতা আসতে পারে এমন কোন ব্যবহার তো ও করে নি? খুব একটা কুৎসিত কুরূপ, অমার্জিত কি অভব্য, এমনও নয়। সত্যিই অতসী যা বলেছে, সাদাসিধে সরল হাসিখুশী মেয়ে।
তবু?
তবু ওকে দেখলে বিরক্তিতে মন বিষিয়ে ওঠে যেন মৃগাঙ্কর? কেবলমাত্র সুরেশ রায়ের সম্পর্কিত বলেই তো? অতসীর দেওয়া অপবাদ কি তাহলে মিথ্যা?
অনেকবার চেষ্টা করলেন মৃগাঙ্ক সেই মেয়েটার প্রতি মনকে সহজ করেছেন এই অবস্থাটা কল্পনা করতে। ভাবলেন সহাস্যে তাকে বলছেন, খুব তো সন্দেশ খেলাম, ছেলে কেমন আছে? আর কোনও অসুবিধে নেই তো? পারলেন না, কল্পনা করতেই মনটা বিস্বাদ বোদা হয়ে উঠল।
অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ নিজের কাছে স্বীকার করলেন মৃগাঙ্ক, জীবনের এই জটিলতার জাল থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না। হতে গেলে–অতসীর ভাষায় যে অসীম অগাধ উদারতা থাকা প্রয়োজন, তা অন্তত মৃগাঙ্কর নেই।
কিন্তু কারোরই কি থাকে? এ রকম ক্ষেত্রে?
যে বস্তু অসহনীয় তাকে মন থেকে সহ্য করতে কে পারে?
সপত্নী সম্পর্কটা সহ্য করবার বস্তু নয়।
.
অনেকদিন পরে এক বন্ধুর বাড়ি গেলেন মৃগাঙ্ক।
কলেজের বন্ধু সতীনাথ।
বিশেষ করে এই বন্ধুর বাড়ি যাবার একটু তাৎপর্য আছে। বন্ধুটি কিছু বছর হল বিপত্নীকের খাতায় নাম লিখিয়েছেন, ছিলেন কিছুদিন সে খাতায়। কিন্তু বছর দুই হল আবার সেখান থেকে নাম খারিজ করে নিয়েছেন, আবার সগৌরবে সস্ত্রীক বেড়িয়ে বেড়াচ্ছেন, আত্মীয়জনের বাড়ির কাজকর্মে স-পরিবারে নেমন্তন্ন খেয়ে আসছেন।
দ্বিতীয়বার মস্তক মুণ্ডনের সময়ও বন্ধুবান্ধবদের নেমন্তন্ন করেছিলেন সতীনাথ, মৃগাঙ্ক ইচ্ছে করেই যান নি। অথবা যেতে ইচ্ছে হয়নি।
এতদিন বিপত্নীক অবস্থায় কাটিয়ে, বছর আড়াইয়ের মেয়েটাকে আট দশ বছরের করে তুলে, তারপর আবার বিয়ে করা, খুব খেলোমি ঠেকেছিল মৃগাঙ্কর। তদবধি বড় একটা দেখা সাক্ষাৎও হয় নি। সময় হয় নি, কর্মব্যস্ত পৃথিবীতে সভ্য শহুরে লোকগুলোর যে মরবারও সময় থাকে না।
বন্ধুর বাড়ি গিয়ে আড্ডা দেওয়া? স্বাদ ভুলে গেছে লোকে সেই পরম রমণীয়তার।
বিনা উদ্দেশ্যে বন্ধুর বাড়িতেও আর যায় না কেউ। যায় না মানে যেতে পারে না। সময় হয় না।
মৃগাঙ্ক ডাক্তার আজ বার করলেন সময়। কাজের থেকে চুরি করে নিলেন খানিকটা সময়। কিন্তু মৃগাঙ্কই কি বন্ধুর বাড়ি গেলেন বিনা উদ্দেশ্যে?
.
যদিও বন্ধুর জীবনটা মৃগাঙ্কর নিজের জীবনের থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত, তবু ইচ্ছে হল মৃগাঙ্কর একবার বন্ধুর ওই বিড়ম্বনাময় জীবনটা দেখে আসেন। দেখেন তারা নিজেদেরকে কোন অবস্থায় রাখতে পেরেছে?
না, বিড়ম্বনাময় ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারলেন না মৃগাঙ্ক।
.
সতীনাথ হৈ হৈ করে ওঠেন, আরে, আরে, এসো এসো! ব্যাপারটা কি? তোমার দর্শন?
মৃগাঙ্ক ধীরে সুস্থে আসন গ্রহণ করে বললেন, দর্শনটা নিতান্তই যখন দুর্লভ হয়ে ওঠে তখন এক পক্ষকে এগিয়ে আসতেই হয়।
খুব যা হোক নিলে এত হাত? বললেন সতীনাথ, অবিশ্যি নেবার অধিকার তোমার আছে। বাস্তবিকই ভারি কুঁড়ে হয়ে গেছি, কোথাও আর যেয়ে উঠতে পারি না।
বৃদ্ধস্য তরুণী হলে যা হয়! বললেন মৃগাঙ্ক মৃদু হেসে।
যা বল ভাই। বলে নাও যত পারো। তারপর তোমার খবর কি?
ভালই! বললেন মৃগাঙ্ক।
এই নিরুত্তাপ ভালইএর পর কথাটা যেন স্রোত হারিয়ে থেমে গেল। থেমে যে গেল তার প্রমাণ পাওয়া গেল সতীনাথের পরবর্তী কথায়–কি রকম গরম পড়েছে দেখেছ?
দেখছি, খুব পড়েছে।
গরম হয়তো সত্যিই বেশি পড়েছে। কিন্তু সেটা কখনই দুই বন্ধুর আলোচ্য বিষয় হতে পারে না, যদি না তাদের কথার ভাড়ার ফাঁকা থাকে।
রোসো একটু চায়ের কথা বলি,বলে সতীনাথ উঠলেন, দরজার কাছে গিয়ে হাঁক পাড়লেন, ঠাকুর?
মৃগাঙ্ক বাধা দিলেন, এই শোন, মিথ্যে কেন চেঁচামেচি করছ, জানোই তো আমি রোগীর বাড়ির পোশাকে কিছু খাই না।
ও হো হো, তাও তো বটে! তা এখনও সে অভ্যাসটি বজায় রেখেছ? এ যুগে তো কেউই ওসব শুদ্ধাচারের বিধিনিষেধ মানে না হে!
শুদ্ধাচার বলতে কি বোঝায় জানি না সতী, আচার যদি বল তো বলতে পারি ডাক্তারের ঘূত্মার্গ হচ্ছে বুদ্ধিমানের আচার। স্বাস্থ্যবিধির বিধিনিষেধ কোনও যুগেই অচল হয়ে যায় না, ওটা চিরযুগের।
তোমার এ কথাটি মানতে পারলাম না ভাই, বললেন সতীনাথ, বিধিনিষেধেরও ধারা পাল্টায়। সমাজরক্ষার মতই স্বাস্থ্যরক্ষার বিধিও নিত্য বদলাচ্ছে। পুরোপুরি কাঠামোটাই বদলাচ্ছে। দেখো আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন দেখেছি জ্বরবিকারের রুগীকে এক ফোঁটা জল খেতে দেওয়া হত না, ঘরের জানলা খোলবার জো নেই, গায়ে কম্বল চাপা, আর এখন? তেমন রুগীকে জল খাইয়েই রেখে দিচ্ছ তোমরা, গায়ে ঢাকা দেবার দরকার বোধ কর না, আর জানলা খোলা ছেড়ে খোলা বারান্দায় শুইয়ে রাখতেও বোধ হয় আপত্তি নেই। এ তো একটা মাত্র উদাহরণ, কি জুরে, কি শূল বেদনায়, কি শিশু পালনে, কি প্রসূতি পরিচর্যায়, আগের থিয়োরি তো কিছুই নেই। বল আছে?
তা নেই বটে! হাসলেন মৃগাঙ্ক, তবে আক্ষেপেরও কিছু নেই।
আক্ষেপের কথা হচ্ছে না। আমি বলছি, একসময় ভাল ভাল পাশ করা ডাক্তাররাও তো সেই পদ্ধতিতে চলে এসেছে, আজ যে পদ্ধতিকে তোমরা সেকেলে বলছ। সেই পদ্ধতিতেই চলে হাতযশ দেখিয়েছে, বিখ্যাত হয়েছে, অথচ আজ তোমরা তাদের অজ্ঞতার কথা ভেবে কৃপা করছ তাদের। পরবর্তীকাল আবার তোমাদের অজ্ঞতায় হাসবে।
মৃগাঙ্কমোহন হেসে উঠে বলেন, তা এসব তো জানা কথা, এখন আসলে তোমার বক্তব্যটা কি?
বক্তব্য কিছুই নয়, শুধু বলছি আমাদের সমাজ ব্যবস্থাও ওইভাবে দ্রুত বদলাচ্ছে, কিন্তু এর শেষ কোথায় জানো?
না, তা জানি না। আবার হাসেন মৃগাঙ্ক।
শেষ হচ্ছে সতীনাথ প্রায় উত্তেজিতভাবে বলেন, আবার সেই আদিমকালের মাতৃতন্ত্র! আমি বলছি মৃগাঙ্ক, সেদিনের খুব বেশি দিন নেই, যেদিন আবার ফিরে আসবে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ।
হঠাৎ এত বড় ভবিষ্যত্বাণী?
যা দেখছি ভাই! কেন তুমি দেখতে পাচ্ছ না, বাড়ির কর্তা বলে শব্দটা স্রেফ উঠে গেছে। গিন্নীরাই সব, গিন্নীদেরই সমস্ত, গিন্নীর অঙ্গুলি নির্দেশে সারা সংসার চলছে। গিন্নীর কাজের প্রতিবাদ করেছ কি আগুন জ্বেলেছ! দেখছ না? টের পাচ্ছ না?
এতক্ষণে বুঝতে পারেন মৃগাঙ্ক, আসল ব্যথাটা সতীনাথের কোথায়! মৃদু হেসে বলেন, তোমার মতন অতটা টের বোধহয় পাচ্ছি না।
তা হলে বুঝতে হবে তুমি ভাগ্যবান ব্যক্তি। তোমার গৃহিণী এ যুগের ব্যতিক্রম। আমার অবস্থা বুঝতেই পারছ, বন্ধু এসেছে, বামুনঠাকুরকে ডাকছি চা বানাতে। গৃহিণী হাওয়া! কখন বেরোন কখন ফেরেন, কতক্ষণ বাড়িতে থাকেন কিছু জানি না। অনুগ্রহ করে যখন দেখা দেন কৃতার্থ হয়ে যাই। জিগ্যেস করতে সাহস হয় না–গিছলে কোথায়? আমার পোস্ট হচ্ছে ব্যাঙ্কের। টাকা দরকার হলেই শুধু আমি।
মৃগাঙ্ক বলেন, তবে আবার কি, ওই তো যথেষ্ট। অর্থনৈতিক পরাধীনতা না আসা পর্যন্ত পুরুষসমাজ টিকে থাকবেই কোনরকমে। তাছাড়া
আরে ভাই তাও তত যেতে বসেছে। আমার না হোক, পাড়ার অনেকের স্ত্রীই তো চাকরি বাকরি করছে। আর দুদিন বাদে বলবে তোমার ভাত আর খাব না।
বন্ধুর সামনে গম্ভীর মৃগাঙ্ক সহসা বুঝি একটু তরল হয়ে ওঠেন, হেসে বলেন, তাতেও চিন্তার কিছু নেই সতীনাথ, এমন দিন যদি আসে মেয়েরা একযোগে বলছে তোমাদের ঘরে আর শোব না, তবেই বুঝবে পুরুষের যথার্থ দুর্দিন এল। কিন্তু সে কথা আর কজন বলবে বল, কদিনই বা বলতে পারবে? আমাদের দেহবিজ্ঞান বলছে দেহাতীত হবার শক্তিতে মেয়ে পুরুষ দুজনেই সমান কাঁচা। অবশ্য ব্যক্তিবিশেষে ব্যতিক্রম আছেই। কিন্তু সংসার যদি কর্তাপ্রধান না হয়ে গৃহিণীপ্রধানই হয়-ক্ষতি কি? তারাই তো সংসার। তাদের জন্যেই তো সংসার।
ওহে বাপু, নিজে ভুক্তভোগী নয় বলেই বলতে পারছ এ কথা। যখন জুলজুল করে তাকিয়ে দেখতে হয় তোমার সংসারে তোমার কোন অধিকার নেই, তখন
এক সময় আমাদের সমাজে মেয়েদের তো এই অবস্থাই ছিল সতীনাথ, আজ না হয় পুরুষের হল।
বলা সোজা মৃগাঙ্ক–সতীনাথ উত্তেজিতভাবে বলেন, তোমার স্ত্রী যদি তোমার বিনা অনুমতিতে, তোমার সঙ্গে পরামর্শ মাত্র না করে তোমার ছেলেটাকে বোর্ডিঙে দিয়ে আসে, আর কেবলমাত্র পাড়ায় চেঁচামেচি লোক জানাজানির ভয়ে তোমাকে সেই অত্যাচার সহ্য করতে হয়, বলতে পারবে একথা?
মৃগাঙ্ক আর একবার বুঝলেন সতীনাথের যন্ত্রণাটা কোথায়। লোকটা চিরকালই হাসিখুসি স্ফুর্তিবাজ, তাই চট করে বোঝা যায় নি।
আর হাসলেন না, মৃদুস্বরে বললেন–আমার পক্ষে ঠিক এ রকমটা বোঝার একটু অসুবিধে আছে সতী, কারণ আমার বাড়ির ছেলেটা আমার ছেলে নয়। তুমি যে অবস্থাটার বর্ণনা করলে, আমি হয়তো তেমন অবস্থায় পড়লে বেঁচেই যাই, কিন্তু তা হবার আশা নেই। আমার স্ত্রী সম্পূর্ণ অন্য প্রকৃতির। স্বাধীন ভাবে কিছু করা যায়, এ তিনি যেন ভাবতেই পারেন না।
আবার বলব ভাই তুমি ভাগ্যবান! স্বাধীন স্ত্রী নিয়ে আমার হঠাৎ গলাটা বুজে এল সতীনাথের, একটু পরে গলা ঝেড়ে মৃদুস্বরে বললেন, বিশ্বাস করতে পারো, আমাকে না বলা কওয়া, আমার মেয়েটাকে, আমার একলার মেয়েটাকে–বোর্ডিঙে ভর্তি করে দিয়েছে!
মৃগাঙ্ক তীব্র বিদ্রুপে বলে ওঠেন, দিয়েছেন, খুব ভালই করেছেন, কিন্তু তুমি সেটা মেনেও তো নিয়েছ দেখতে পাচ্ছি।
কী করব বল ভাই, করবার আছে কি? খুশী তাই করে ও, আর ওর বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা দিতে নিজের কানে শুনেছি আমি, বাহাদুরী করে বলে বেড়ায় পুরুষমানুষ কোথায় জব্দ জানিস, কেলেঙ্কারির ভয়ের কাছে। তাই কেয়ার করি না আমি ওকে, মারতে তো পারবে না, আমাদের পিতামহী প্রপিতামহীদের আমলের মত? তবে আর ভয়টা কি? বোঝ ভাই, যে মেয়েমানুষ এমন কথা বলতে পারে, তাকে কী করা যায়?
মারাই যায়! আরও তীব্রস্বরে বলে ওঠেন মৃগাঙ্ক, আমাদের সেই চলতি কথাটা ভুলে গেছ সতীনাথ? হাতে না মেরে ভাতে মারা! তুমি ওঁর সঙ্গে সমস্ত সহযোগিতা ত্যাগ করে অপরিচিতের মত থাকতে পারো। দেখো কাকে কার আগে প্রয়োজন হয়।
সে কি আর হয়! সতীনাথ ক্ষুণ্ণভাবে বলেন, সমাজে সংসারে বাস করে তা চলে না।
না চলবার কী আছে? এ তো ঠাণ্ডা লড়াই।
ঠাণ্ডাই ডাণ্ডা হয়ে ওঠে রে ভাই! আত্মবন্ধুকে জবাবদিহি করতে হবে না? আমার পারিবারিক জীবনের ওপর সমাজের সহস্র চক্ষু তীব্র হয়ে নেই?
বেশ তো, তেমন প্রশ্ন ওঠে, স্পষ্টই বলবে স্ত্রীর সঙ্গে আমার বনে না। রায় দেওয়ার ভঙ্গীতে–কথা শেষ করে একটা সিগারেট ধরান বৃগাঙ্ক। সতীনাথ ধূমপায়ী নন, তাই একাই ধরান।
সতীনাথ মিনিট খানেক সেই অলস ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, ওইখানেই তো মেরে রেখেছে ভাই। স্ত্রীর সঙ্গে আমার বনে না এতবড় লজ্জার কথা কি উচ্চারণ করা সহজ? ওর থেকে অগৌরব আর কি আছে? লোকের কাছে ওই মাথা হেঁট হবার ভয়ই এত সহ্য করতে বাধ্য করাচ্ছে। সুখ নেই, শান্তি নেই, অন্তরঙ্গতা নেই, স্টেজের থিয়েটারের মত প্রতিনিয়ত শুধু প্লে করে চলেছি।
সতীনাথের ভাষা সাদা-মাটা, কিন্তু ভাবটা মৃগাঙ্কর হৃদয়কে স্পর্শ করে। না, একেবারে উড়িয়ে দিতে তিনি পারেন না বন্ধুর মর্মকথা। এ তো একা সতীনাথের জীবনের অভিশাপ নয়। এ হচ্ছে আধুনিক সভ্যতার অভিশাপ।
অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে বলেন, এক্ষেত্রে মেয়েকে ছেড়ে থাকা তো আরোই কষ্টকর তোমার পক্ষে, মন কেমনের কথা তুলে ওকে আনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে দেখো না? তাতে তো গোলমালের আশঙ্কা নেই।
সে চেষ্টাই কি করি নি ভাই? বলল কি জানো?–অতবড় মেয়ে আমাদের মাঝখানে ঘুরে ঘুরে বেড়ালে আমার অস্বস্তি হয়, বিরক্তি আসে। আমার নিজের পেটের মেয়ে হলেও দিতাম।
তা ভাল। আশা করি এখন প্রেমের লীলাটা অবাধ চলছে? না, তোমাদের ওপর সহানুভূতি আসে না সতীনাথ, আসে ঘৃণা। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না, স্ত্রী সঙ্গ ত্যাগ করবার ক্ষমতা তোমার নেই। মেরে রেখেছে আর কিছুতেই নয় সতী, ওইতেই।
বলে উঠে দাঁড়ালেন মৃগাঙ্ক। আর পরমাশ্চর্যের কথা, সতীনাথ ক্রুদ্ধ না হয়ে একান্ত ক্ষুব্ধকণ্ঠে আস্তে আস্তে বলেন, তুমি ডাক্তার মানুষ, তোমাকে আর কি বোঝাব ভাই, সবই তো বোঝ। আমাদের মতন লোকের জীবনে আর আছে কি বল? বাঁচতে তো হবে?
আর কি বলবার আছে? এরপর আর বলবার কি থাকে? দুর্বলের প্রতি ঘৃণাই বা আসবে কোথায়, আসে শুধু করুণা।
ফেরার সময় গাড়িতে সেই কথাই ভাবতে ভাবতে যান মৃগাঙ্গ, একা সতীনাথকেই বা দোষ দেওয়া যায় কোন নীতিতে? সতীনাথের চাইতে উচ্চমানের বাঁচার মানে কজনই বা আবিষ্কার করতে পারছে?
ওই যে পথের অনারণ্য, সত্যিকার সুখী আর সন্তুষ্ট মানুষ কটা আছে ওদের মধ্যে?
ওই যে মেয়েটা আর ছেলেটা–প্রায় হাত ধরাধরি করে রাস্তায় চলেছে যেন প্রেমের জোয়ারে গা ভাসিয়ে, ওরাও হয়তো স্টেজের অভিনয় করছে।
মৃগাঙ্কর এক সমস্যা, সতীনাথের এক সমস্যা, এর ওর তার সকলেরই এক এক সমস্যা। আর অন্নবস্ত্র, ঔষধ, আচ্ছাদন, সমস্ত কিছুর চাইতে তীব্র সমস্যা হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের জটিলতা।
এই পৃথিবীতে মানুষের সঙ্গে এক সঙ্গে থাকতেই হবে মানুষকে, ঠেসাঠেসি ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে। মরে না গেলে পৃথিবীর বাইরে কোথাও পালিয়ে যাবার উপায় নেই। থাকতে হবে রাষ্ট্রবদ্ধ হয়ে, সমাজবদ্ধ হয়ে, পরিবারবদ্ধ হয়ে, অথচ কিছুতেই কেউ কাউকে সহ্য করতে রাজী নয়।
প্রত্যেকে প্রত্যেককে বলছে, একটু সরো না বাপু।
সরবো কোথায়? সরবো কেন? এ প্রশ্ন তুললেই লেগে গেল লাঠালাঠি, বেধে গেল যুদ্ধ।
আরও সূক্ষ্মস্তরে চলে গেলে দেখবে প্রধান আসামী হচ্ছে ভুল বোঝ। একে অপরকে যেন ভুল বুঝবেই প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে।
আঃ বিধাতার সৃষ্টি এই দেহটার মধ্যে মন নামক বালাইটা যদি না থাকত! মন নামক রোগটাই মানুষকে জেরবার করছে।
এই যে মৃগাঙ্ক! কতই তো সুখী হতে পারতেন, দৃশ্যত সুখী হবার সমস্ত উপকরণই তো তার ছিল, কিন্তু হল না। জীবনবীণার তারখানি ঠিক সুরে বাজল না।
ওই ছোট্ট ছেলেটা!
সীতু।
কী অসহ্য মনোব্যাধিতেই ভুগছে ও। কী দরকার ছিল ওর এ কষ্ট পাবার? হাসত খেলতো, ছুটতো লাফাতো, যা ইচ্ছে আবদার করত, যত পারতো খেতো, কী সহজই হত! তা নয়, ও নিজের সুখকে পা দিয়ে মাড়িয়ে ক্লেদাক্ত করবে বসে বসে।
ওই তো অতসী!
হোক না আরও পাঁচটা স্বাভাবিক মেয়ের মত। ওর ওই আহ্লাদী শ্যামলীর মতই হোক না! খুব হাসুক, খুব কথা বলুক, মান করুক, অভিমান করুক, ছেলের ব্যাপার নিয়ে ঝগড়াই করুক মৃগাঙ্কর সঙ্গে, তা নয়।
হৃদয়ের দরজায় চাবি কুলুপ লাগিয়ে শান্ত সমাহিত হয়ে ঘুরে বেড়াবে।
আর মৃগাঙ্ক নিজে?
.
বলি খোকাবাবু আজ খাবে কি খাবে না?
বামুন মেয়ে এসে দাঁড়াল সীতুর পিছনে, তোমার মা বেরিয়ে গেছে, বলে গেছে তোমাকে খাইয়ে রাখতে, ফিরতে দেরি হবে।
সাধারণত বামুন মেয়ের কথা গ্রাহ্য করে না সীতু। আজও করত না, যদি না শেষদিকের কথাগুলো কানে এসে বাজত।
মা বেরিয়ে গেছে। ফিরতে রাত হবে!
কোথায় গেছে অতসী?
সীতুকে না জানিয়ে আর কবে কোনদিন কোথায় গেছে? কই মনে তো পড়ে না। হয় সীতু সঙ্গেই থাকে, নয় তাকে বলে বুঝিয়ে গল্পের বই ঘুষ দিয়ে তবে তো যায়।
আজ এটা কি?
হঠাৎ বুকটা একটু কেঁপে উঠল। সেই তখনকার কথাই কি তবে সত্যি? তখন বলেছিল না অতসী–তুমি কেন চলে যাবে, আমিই চলে যাব।
তাই কি? রাগের সময়কার সেই প্রতিজ্ঞাটাই তাহলে পালন করতে বসল মা?
চোখে জল আসতে না দেবার প্রতিজ্ঞা করে কাঠ হয়ে বসে রইল সীতু পিছন ফিরেই। তবু মান খুইয়ে জিগ্যেস করা তো চলে না, কোথায় গেছে মা।
বামুন মেয়ে আবার বলে ওঠে, এই এক কাঠগোঁয়ার এক বগা ছেলে হয়েছে বাবা! খুরে খুরে নমস্কার! এতখানি বয়েস হয়েছে আমার, এমনধারা ছেলে সাতজন্মে দেখি নি। কোন ঝাড়ের বাঁশ যে আনল! নাও বাপু নাও চল।
যাব না আমি। খাব না কিছু।
তীব্র স্বর, তীক্ষ্ণ গলা!
তবে খেও না। মা ওবাড়ি থেকে ফিরে এলে তাই বলব।
ওবাড়ি!
সেটাই বা আবার কোন রহস্য?
কিন্তু রহস্য ভেদ করতে হলেই তো ফের কথা কইতে হবে। সীতু তো কথা বলবে না।
বামুন মেয়ে বলতে বলতে যায়, আমার বলবার কথা আমি বলেছি, তা বলে তো পায়ে ধরে সাধতে পারব না। অধর্মের ভোগ আমার, তাই এখনো এ বাড়িতে পড়ে আছি। নইলে দাদাবাবু যখন ফলসুষ্ঠু গাছ ঘরে নিয়ে এল তখনই তো আমার সব ফেলে দিয়ে বেরিয়ে যাবার কথা। যেতে পারলাম না, মায়ায় পড়ে রয়ে গেলাম, এই এখন তার ফল ভুগছি। লোকের সামনে মুখ দেখাতে পারি নে, সবাই বলেছে-ছিঃ ছিঃ তোর অমন মনিবের এই কাজ! তবু রয়ে গেছি, এইবার এস্তফা দেবো, আর নয়।
অতসীর অনুপস্থিতির সুযোগে বামুন মেয়ে বেশ সশব্দেই স্বগতোক্তি করতে করতে চলে যায়। তাকিয়ে দেখে না ওই জেদি ছেলেটার ভুরু কোঁচকানো মুখেও কী হতাশ অসহায়তা ফুটে উঠেছে।
মা একেবারে চলে যায় নি, আবার তাহলে ফিরে আসবে, এ তথ্যটা যেই নিশ্চিত করেছে তাকে, সেই জেগে উঠেছে এক ক্ষুব্ধ তীব্র অভিমান সীতুর অজানায় অনেক কিছুই এখন চলছে। কোথায় কোনখানে ওবাড়ি নামক এমন একটা জায়গা আবিষ্কার হয়েছে, যেটা এবাড়ির সবাই জানে, বামুন মেয়ে পর্যন্ত জানে, কিন্তু সীতু ছন্দাংশেও জানে না। আর সবচেয়ে অসহায়তা সীতুর, কাউকে সে জিগ্যেস করতে পারবে না।
না, মরে গেলেও মুখফুটে কাউকে জিগ্যেস করতে পারবে না, মা কোথায়? কোথায় সেই ওবাড়িটা? কে থাকে সেখানে? কবে তাদের চিনল মা?
সীতু কেন মরে যায় না? সীতুর বয়সী কত ছেলেই তো মরে। এই তো সেদিন ওই সামনের বাড়ির ওই দোতলার ছেলেটা মরে গেল, কি যেন নাম ছিল তার সীতু জানে না। কিন্তু কী মোটা ছিল তা দেখেছে তো!
হঠাৎ একদিন ওবাড়িতে খুব জোর কান্না উঠল, সীতু হাঁ করে তাকিয়ে থাকল, তারপর সকলের বলাবলিতে জানতে পারল সেই ছেলেটা মারা গেছে।
ভয়ানক রকম আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল সেদিন সীতু। আগের দিনও ছেলেটাকে রাস্তায় বেরতে দেখেছিল যে!
আর আজ সীতু অবাক হচ্ছে এই ভেবে যে, সীতু এত রোগা, তবু হঠাৎ ওইরকম মরে যায় না কেন? এই এক্ষুনি যদি মরে যেতে পারত! যদি মা সেই ওবাড়ি না কি থেকে এসে দেখত সীতু এই জানলার ধারে মরে পড়ে রয়েছে।
বেশ হয়, ঠিক হয়!
দুহাতে শক্ত করে জানলার গ্রীল চেপে ধরে তাতেই মাথাটা ঠেকিয়ে সীতু প্রাণপণে প্রার্থনা করতে থাকে–ভগবান এই দণ্ডে মরিয়ে দাও সীতুকে।
ধ্রুবও তো ছিল সীতুর বয়সী ছেলে, তার প্রাণপণ ডাকে তো ভগবান নিজে এসে দেখা দিয়েছিলেন, আর সীতুর ডাকে যমরাজাকে একবার একটু পাঠিয়ে দিতে পারেন না? যমরাজাই তো মরার দেবতা।
কিন্তু প্রাণপণ মানে কি? আর কাকে প্রাণপণ বলে?