আরোগ্য নিকেতন – 04
পরানের বিবি একটু ভালই আছে। আরও ভাল থাকা তার উচিত ছিল। কিন্তু তা থাকছে না। নাড়ির গতি দেখে ডাক্তারের যা মনে হয় উপসর্গের সঙ্গে ঠিক তার মিল হয় না। রোগের চেয়ে রোগের বাতিকটা বেশি। এখানে ব্যথা ওখানে ব্যথা, বিছানায় শুয়ে কাতরানো, পাকস্থলীতে যন্ত্রণা-এর আর উপশম নেই। আরও মজার কথা!—রোগী তো ভাল আছে বললেই রোগ বেড়ে যায়। কী করবেন ডাক্তার। এর চিকিৎসা তাঁর হাতে নাই। তিনি বুঝতে পেরেছেন, মেয়েটি ভাল হতে চায় না। পরান খাঁয়ের স্ত্রী হিসেবে সুস্থ দেহে উঠে হেঁটে বেড়াতে সে অনিচ্ছুক। তাই ডাক্তার কৌশল অবলম্বন করেছেন, রোগ আদৌ কমে নি বলে যাচ্ছেন। আজও তাই বলবেন—তবে হ্যাঁ, ভয় কিছু নাই খাঁ। ভয় কোরো না। এ ছাড়া খাঁকেই বা বলবেন কী? ও কথা খাঁকে বললে খাঁ যে কী মূর্তি ধরবে—সে ডাক্তারের অজানা নয়। বৃদ্ধের জীবনও অশান্তিময় হয়ে উঠবে। স্বামী-স্ত্রীর অমিলনের মত অশান্তি আর নাই। তিনি নিজেও চিরজীবন জ্বলছেন। আগুন তার জীবনে কখনও নিভল না। আজও রোগী দেখে বাড়ি ফিরে দেখলেন যে। সে আগুন যেন লেলিহান হয়ে উঠেছে। কোন্ আহুতি পেয়েছে বুঝলেন না।
আতর-বউ নিজে নিষ্ঠুর আক্ৰোশে বকছে। এই মুহূর্তেও বকে চলেছে আপনার মনে। বকছে তাকে এবং নবগ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার শশী মুখুজ্জেকে। শশীই দিয়ে গিয়েছে আহুতি; সে তার অনুপস্থিতিতে এসে হাজির হয়েছিল। জীবন ডাক্তারকে না পেয়ে বাড়ির ভিতর আতরবউয়ের কাছে বসে তাকেই জ্বালাতন করে গিয়েছে। তামাক খেয়ে ছাই এবং গুল ঝেড়ে ময়লা করে দিয়ে গিয়েছে গোটা দাওয়াটা। রাজ্যের সংবাদ দিতে গিয়ে ওই হাসপাতালের ডাক্তার তাকে যে কটু কথাগুলি বলেছে, সেগুলিও আতর-বউয়ের কানে তুলে দিয়ে গিয়েছে। হতভাগা শশীর উপর আতর-বউয়ের মমতাও যত ক্রোধও তত।
জীবন মশায়ের শিষ্য শশী। তাঁর আরোগ্য-নিকেতনেই ডিসপেনসিং শিখেছিল সে এখানেই তার হাতেখড়ি। তারপর বর্ধমান গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাকা কম্পাউন্ডার হয়ে ফিরে নবগ্রামের চ্যারিটেবল ডিসপেনসারির প্রথম কম্পাউন্ডার হয়েছিল সে। কম্পাউন্ডিং সে ভালই জানে। তার সঙ্গে চিকিৎসাবিদ্যাটাও মোটামুটি শিখেছে শশী। তিনিই তাকে নাড়ি দেখতে রোগ চিনতে শিখিয়েছিলেন। কিন্তু শশী আশ্চর্য অপরিচ্ছন্ন লোক! কামানোর ঝঞ্ঝাটের জন্য দাড়িগোঁফ রেখেছে। স্নান কদাচিৎ করে, দাঁতও বোধ করি মাজে না। এক জামা পনের দিন গায়ে দেয়; উৎকট দুর্গন্ধ না হলে সেটাকও ছাড়ে না। আর প্রায় অনবরতই তামাক টানে। জামার পকেটেই থাকে তামাক টিকে দেশলাই এবং হাতে থাকে কো। তার ওপর করে মদ্যপান। মধ্যে মধ্যে বেশ হয়ে পড়ে থাকে। এই কোর জন্যেই তার নবগ্রাম ডিসপেনসারির চাকরি গিয়েছিল। পকেটে হুঁকো, কল্কে, তামাক, টিকের টিনএ না নিয়ে শশী কোনো কালেই এক পা হাঁটে না। বলে—ওরে বাবা, লোকে লুকিয়ে বাবার কো টেনে তামাক খেতে শেখে। আমি আমার কর্তাবাবার মানে বাবার বাবার কাছে তামাক খেতে শিখেছি। লুকিয়ে নয়, তিনি আমাকে নিজে সেজে তামাক খাওয়াতেন। এ ছাড়া চলতে বারণ। ছেলেদিগে বলেছি, আমি মরলে আমার চিতায় যেন হুঁকো কল্কে তামাক টিকে দেয়। দেশলাই চাই না। ও চিতের আগুনেই হবে। ডাক্তারখানার ওষুধের আলমারিতে তামাক-টিকে রাখত। কোণে গুল ঝেড়ে গাদা করত, ডাক্তার সাহেব এলে কোনো কিছু একখানা কাগজ কি কাপড় কি প্যাকিং বাক্স দিয়ে চাপা। দিয়ে রাখত। তবুও ধরা পড়ত। তিনবার ধরা পড়ে চাকরি বেঁচেছিল, চারবারের বার বাচল না। তা না বাঁচলেও শশী ওই বিদ্যেতেই বেশ করে খেয়েছে, আজও খাচ্ছে। মদ্যপানটা কিছু কমেছে এখন। ছেলেরা চাকরি করে। নিজে এখনও একটা টাকা কোনোরকমে উপার্জন করে শশী। পরামর্শের দরকার হলে মাঝে মধ্যে জীবন মশায়ের কাছে আসে। জীবন ডাক্তারকে বলে। গুরুজী! বলে অনেক শিখেছি জীবন মশায়ের কাছে। যা কিছু জানি তার বার আনা। বলে আর প্রচুর হাসে। ইঙ্গিত আছে কথাটার মধ্যে। শশী তার কাছে শুধু ডিসপেনসিং এবং ডাক্তারিই। শেখে নি, দাবা খেলাও শিখেছিল সে। আরও শিখেছিল হরিনাম সংকীর্তনে দোয়ারকি। এ দুটোতে শশীরবিদ্যা শিষ্যবিদ্যা গরীয়সী বলে তাই।
শশীকে দাবা খেলতে বসিয়ে দিয়ে বন্ধুরা তার বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে এসে খেতে দিত। শশীর বাড়িতে গিয়ে বলত, শশীদাকে আজ রাত্রে রোগীর কাছে থাকতে হবে। কল পেয়েছে। শশীদা আমাদের বললে, ভাই বাড়িতে গিয়ে আমার খাবার যদি এনে দিস, তবেই তো খাওয়া হয়। শশীদার খাবার দিন।
শশী রাত্রে খেত রুটি এবং শশীর স্ত্রীর রুটি ছিল বিখ্যাত। রাত্রি দুটোর পর শশী যখন দাবা খেলে উঠত, তখন সঙ্গীরা খাবারের শূন্য পাত্রটা তার হাতে দিত, বলত নিয়ে যাও শশীদা। তোমাদের বাড়ির থালা। শশীর আর বাড়ি যাওয়া হত না। গালাগালি দিয়ে খালি পেটেই শুয়ে পড়ত সেই আঘরে। না হলে শশীর কলের মর্যাদা যায়। পরের দিন কারুর কাছে দুটো টাকা ধার করে নিয়ে তবে বাড়ি ফিরত। বলত, কলের টাকাটা রাখ তো!
তার কাছে শেখা তৃতীয় বিদ্যা সঙ্গীত। তাতে সে অসুর। অসুর বললেও ঠিক ব্যাখ্যা হয়। না, বলতে হয় বিকটাসুর। কণ্ঠস্বর তার যেমন কৰ্কশ তেমনি সে বেমক্কা বেতালা। তার ওপর মদ্যপান না করে আসরে সে নামে না। দৃষ্টান্ত দেয় বড় বড় ওস্তাদের।
সংকীর্তনের দলে শশী তারস্বরে চিৎকার করে।
জীবন মশায় কপালে হাত দিয়ে হেসে বলেন, আমার কপাল! মধ্যে মধ্যে শশীকে বলেন শশী, একসঙ্গে বেচারা হরিকে আর তানকে মেরে খুন করি না বাবা! শিষ্যের পাপ গুরুকে। অর্সায়! আমার যে নরক হবে। শশী বলে–ভাববেন না। আপনার রথ আটকায় কোন্ শা–।
বলেই সে হা-হা করে হাসে।
এই শশী ডাক্তার।
মধ্যে মধ্যে শশী আসে পরামর্শের জন্য, সেটা যে পেকে গেল ডাক্তারবাবু!
জীবন মশায় বলেন, রোগীটা কাঁচা না পাকা আগে বল। পাকা হলে খসতে দে। তোর চিকিৎসা-দোষের চেয়ে ওর বয়সের দোষ বেশি।
রোগী তরুণ হলে শোনেন, গভীরভাবে চিন্তা করে পরামর্শ দেন।
কখনও কখনও কল দিয়ে নিয়ে যায় শশী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব কলে ফি নাই, বিনা ফিয়ের কল। শশী কম্পাউন্ডার যেখানে ডাক্তার হিসেবে চিকিৎসা করে, সেখানে চারিদিকে দৈন্য; চার আনা আট আনা ফি-তে শশী সন্তুষ্ট। সেখানে জীবন মশায়কে একটাকা ফি দেবে কোথা থেকে। তা ছাড়া জীবন মশায় এখানকার মাটি, মানুষ, গাছপালাকে নিবিড়ভাবে চেনেন। তাদের দুঃখ তিনি জানেন। তাদের জন্য তার বাপ-পিতামহের চিকিৎসালয়ে দুয়ার ছিল অবারিত। তাঁর দুয়ারও তিনি বন্ধ করেন নি। এরা কঠিন রোগে শয্যাশায়ী না হলে ও চার আনা বাঁচাতে বুকে হেঁটেও দাতব্যালয়ের দুয়ারে এসে হাজির হয়। তাদের কাছে তিনি কি ফি নিতে পারেন?
ইদানীং কিন্তু শশীর মাথায় যেন একটু গোল দেখা দিয়েছে। যুদ্ধের মধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্রে যে। কয়টা বিস্ময়কর আবিষ্কার হয়েছে, সেই আবিষ্কারের সঙ্গে শশী কোনোমতেই তাল রাখতে পারছে না। এতদিন পর্যন্ত খুব গোল বাধে নি। তারপর সালফারুপের বিভিন্ন নামে ট্যাবলেট বের হতেই বেচারার মুশকিল হয়েছে। এর পর পেনিসিলিন স্ট্রেপ্টোমাইসিন। নূতন কালের ডাক্তাররা ওই ওষুধগুলি প্রচুর পরিমাণে প্রয়োগ করে চলেছে। পেনিসিলিন ছাড়া তো কথাই নাই। শশী ওগুলো ব্যবহার করতে খানিকটা ভয় পায়। পাবারই কথা। পাওয়াও উচিত। এর ফলে কিন্তু শশী ক্ষেপে ওঠে মধ্যে মধ্যে এবং যা করে বসে চিকিৎসাশাস্ত্রে তা অভূতপূর্ব। কিছুদিন আগে বাউরিদের কুড়োরামের কন্যার হয়েছিল নিউমোনিয়া। শশীকে কুড়োরাম বলেছিল—ডাক্তারবাবু—এই হাসপাতালের ডাক্তার বললে, কুঁড় ওষুধ দিলে শিগগির সেরে যাবে। তা—
শশী বুঝেছিল—পেনিসিলিনের কথা বলছে কুড়োরাম। চটে গিয়ে বলেছিল—নিয়ে আয় টাকা। দিচ্ছি যুঁড়ে। প্যাক করে যুঁড়ে—একটু আঙুলের ঠেল, আমার তো ওই কষ্ট। তারপর তোরা সামলাবি দেহের দাহ। টাকার দাহ আছে। তাও সামলাবি। ও ইনজেকশন দিতে আমাকে টাকা-টাকা করে ফি নিতে হবে তাও বলে দিচ্ছি।
—তা হলে?
—তা হলে যা খুশি কর। হাসপাতালের ডাক্তার তো বললে তা হাসপাতাল থেকে দিলে না কেন? ভরতি করে নিলে না কেন?
—সে আজ্ঞে জায়গা নাই। আর হাসপাতালেও উসব ওষুধ দেয় না।
—তা হলে, আমি যা বলি, তাই কর। চিরকাল খাওয়ার ওষুধ আর মালিশে বড় বড় নীলমণি কেস ভাল হয়ে এল আর আজ কুড়োরামবাবুর কন্যের বুকে খানিকটা সর্দি হয়েছে পেনিসিলিন ছাড়া আর ভাল হবে না?
–তবে তাই দেন।
শশীর মাথায় বিকৃতি কিছু হয়েছে বার্ধক্য ও নেশার জন্য, সেটা নিস্ফলতার আক্ৰোশে আরও বেড়ে যায়। সে গভীর চিন্তা করে স্থির করেছিল মালিশের সঙ্গে সরষের তেল মেশানোর পরিবর্তে কেরোসিন মিশিয়ে মালিশ করলে মালিশের কাজ দ্রুততর হবে। কেরোসিনে আগুন জ্বলে। সুতরাং তার তেজে বুকের ভিতরের সর্দি নিশ্চয় দ্রুত গলবে। যেমন চিন্তা তেমনি কর্ম। ফলে ব্লিস্টার দেওয়ার মত বুক-পাঁজর জুড়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল টলটলে এক ফোস্কা। তখন ছুটে এসেছিল মশায়ের কাছে।
জীবন ডাক্তারই ব্যাপারটা সামলেও দিয়েছিলেন। বেগ অবশ্য খুব পেতে হয় নি। প্রচুর যত্ন নেওয়ার ফলে ঘা হতে পায় নি। ফোস্কার চামড়া উঠেই নিষ্কৃতি পেয়েছে। এবং বেঁচেও উঠেছে। সেটার জন্য কৃতিত্ব কার—সে কথা জীবন ডাক্তার জানেন না। শশীর উদ্ভাবিত ওষুধের গুণই হোক, আর মেয়েটার ভাগ্যই হোক, ফোস্কা উঠলেও নিউমোনিয়াটা বাগ মেনে গিয়েছিল। বিনা পেনিসিলিনে, বিনা মালিশে, বিনা অ্যাটিস্টিনে কয়েকদিনের মধ্যে সেদিক দিয়ে বিপন্মুক্ত হয়েছিল।
এই শশিভূষণ আজ এসেছিলেন। কেন এসেছিল শশী কে জানে? হতভাগা কিন্তু আতরবউকে জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছে। আতর-বউয়ের কানে কামার-বুড়ির কথাটা তুলেছে, তা বোঝা যাচ্ছে। ছিঃ ছিঃ ছি!
আতর-বউ এখন তাঁকে এই ছুতো ধরেই বকছে। চিরটা জীবন মানুষের এক স্বভাব? বার বার ঠেকেও মানুষ শেখে না! নিদান হকার অহঙ্কার কেন? তুই অমুক দিন মরবি বলে লাভ কী? তবু যদি পাসকরা ডাক্তার হতে! ঘরে ডাক্তারি শিখে কেউ সর্ববিদ্যেবিশারদ হয়?—ছি–ছি—ছি! নবগ্রামের ডাক্তারেরা কী বলছে তা শুনে আসুক গিয়ে। আর ওই মুখপোড়া নেমকহারাম শশী বলে কিনা বোগাস!