আরোগ্য নিকেতন – 11
অতীত কালের কথা মনে করে যতই মনের মধ্যে বিচিত্র রসের সঞ্চার হয়—বৃদ্ধ জীবন মশায় ততই ঘন ঘন দাড়িতে হাত বোলান। সাদা দাড়ি, তামাকের ধোঁয়ায় খানিকটা অংশে তামাটে রঙ ধরেছে। যত্ন অভাবে করকরে হয়ে উঠেছে। তবুও হাত না বুলিয়ে পারেন না। সঙ্গে সঙ্গে হাসেন, সেকালের তরুণবয়সী নিজেকে পরিহাস করেন এই হাসির মধ্যে। একা নিজেকেই বা কেন—সমস্ত মানুষকেই করেন।
যৌবনে কী একটা আছে; জলের যেমন ঢালের মুখে গতির বেগ তেমনি একটা বেগ; যৌবনের মন যখন কোনো একজনের দিকে ছোটে তখন ওই বেগে ছোটে, তখন শাস্ত্রের কথা, ভালমন্দ বিবেচনার কথা, সমাজের বাধার কথা, হাজার কথাতেও কিছু হয় না, মন বাগ মানে না। এই সব শাস্ত্ৰকথাগুলিকে যদি বালির বাঁধের সঙ্গে তুলনা করা যায় তবে মন সেখানে ঢালের টানে ছুটন্ত জলস্রোত। হয় বাঁধ ভাঙে নয় জল শুকায়।
তাই তো আজ হাসছেন জীবন মশায়। সেই দিনই ওই রোগিণী দেখে ফিরবার পথে মঞ্জরীর সঙ্গে বিবাহ-সম্ভাবনা বন্ধ হওয়ায় তরুণ জীবন ভাগ্যবিধাতাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল। মঞ্জরীর আসল চেহারা দেখতে পেয়ে তার ওপর বিতৃষ্ণার সীমাও ছিল না। কিন্তু যে মুহূর্তে জগৎমশায় স্ত্রীকে বললেন– প্রথম আষাঢ়ে বিবাহ হবে, সেই মুহূর্তেই তরুণ জীবন সব ভুলে গিয়েছিল। শুধু ভুলে যাওয়াই নয়, মনে হয়েছিল হাত বাড়িয়ে সে আকাশের চাঁদের প্রায় নাগাল পেয়েছে। যেটুকু ব্যবধান রয়েছে আষাঢ় মাস পর্যন্ত নিশ্চয় সে ততখানি বেড়ে উঠবে।
জীবন দত্তের প্রত্যাশার আনন্দে টলমল মনের পাত্র হতে আনন্দ যেন উথলে উঠে তাঁর চারপাশে পড়েছিল। পৃথিবীর যতটুকু অংশ তার চোখে পড়েছিল সমস্তটুকু আনন্দময় হয়ে উঠেছিল। সব মধু। মধু বা ঋতায়তে!
ওদিকে পত্রবিনিময় চলছিল। জগৎমশায় পত্র দিয়েছিলেন নবকৃষ্ণ সিংহকে। কয়েক দিন পরই সে পত্রের উত্তর এল।
নবকৃষ্ণ সিংহ দ্বিতীয় পত্র লিখেছিলেন মঞ্জরী আমার লজ্জায় দুঃখে শয্যাগ্রহণ করিয়াছিল। আপনার পত্ৰ আসিবার পর তাহার মুখে হাসি ফুটিয়াছে। সে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে। তাহার মাকে বলিয়াছে—আমার শিবপূজা মিথ্যা হয় নাই।
জীবন দত্ত আনন্দে আপনাকে হারিয়ে ফেলেছিলেন। মঞ্জরী লজ্জায় দুঃখে শয্যাগ্ৰহণ করেছিল, জীবনের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধের কথা শুনে সে উঠে বসেছে? মুখে হাসি ফুটেছে? দুঃখের শয্যা ছেড়ে মঞ্জরীর হাসিমুখে উঠে বসার কথা মনে হতে তার চোখের সামনে ফুলে ফুলে সর্বাঙ্গ ভরা গুলঞ্চফুলের গাছটার ছবি ভেসে উঠেছিল।
ছুটে গিয়ে সেতাবকে , সুরেন্দ্রকে এবং নেপালকে দেখিয়েছিলেন চিঠিখানা। চিঠিখানা তিনি চুরি করেছিলেন।
নিজের গ্রামের সুরেন্দ্র এবং নবগ্রামের সেতাব ও নেপাল ছিল তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু। সুরেন আর নেপাল তখন মদ ধরেছে। সেকালে এ অঞ্চল সম্পর্কে লোকে বলত মাটিতে মদ খায়। তা খেত। তের চোদ্দ বছর হতেই মদ খেতে শিখত। তান্ত্রিকের দেশ, সবাই তান্ত্রিক বিশেষ তো ব্রাহ্মণেরা। তারপর দীক্ষা হলে ওটা সঁড়াত ধৰ্মসাধনের অঙ্গ। অর্থাৎ প্রকাশ্যেই খাওয়ার অধিকার পেত। খেত না শুধু সেতাব। সেতাবও ব্রাহ্মণ, শাক্ত ঘরের সন্তানও বটে, কিন্তু ভড়কে যেত। সেতাব সমস্ত জীবনটা পিতলের পাত্রে নারিকেলের জল ঢেলে তাই দিয়ে তান্ত্ৰিক তৰ্পণ চালিয়ে এল।
সুরেন গ্রামের ছেলে। ঠাকুরদাস মিশ্রের ছেলে। জমিদারি সেরেস্তার পাটোয়ারী কাজ শিখেছে। চতুর ছেলে। সে বললে—আজ তোকে খাওয়াতে হবে। মদ-মাংস খাব। দে, টাকা ফেল।
নেপাল বাপের আদুরে ছেলে। সবরেজেষ্ট্রি আপিসের কেরানী তার বাবার অনেক রোজগার। নবগ্রামের ছড়ায় ছিল—বিনোদ বুড়ো লম্বা জামায়, পকেট ভরে রেজকি কামায়। বিনোদ মুখুজ্জে সত্যিই রেজকি বোঝাই পকেট দুটো দুই হাতে ধরে বাড়ি আসত। নেপাল লোক ভাল। হাউ-বাউ করে বকত, হা-হা করে হাসত, দুম দুম করে চলত, সাদা দিলখোলা মানুষ। একবার রাঘবপুরে ব্রাহ্মণভোজনে নেমন্তন্ন খেতে যাবার পথে হঠাৎ নেপালের খেয়াল হল পৈতে নেই গলায়, কোথায় পড়েছে। নেপাল পথে কালী বাউরিকে দেখে জিজ্ঞাসা করছিল কী করি বল তো কেলে? আমাকে একটা পৈতে দিতে পারিস? জীবনের বাড়ি এসে মশায়ের কবিরাজখানায় ঢুকে কামেশ্বর মোদকের বদলে খানিকটা হরীতকী খণ্ডই খেয়ে ফেলত অম্লান বদনে। স্বাদেও বুঝতে পারত না। এবং তাতেই তার নেশাও হত।
নেপাল সেদিন বলেছিল-হাম, হাম খাওয়ায়েঙ্গা। আমি খাওয়াব।
নেপালই সেদিন খাইয়েছিল। তিন টাকা খরচ হয়েছিল। লুচি মাংস মিষ্টি মদ। গান-বাজনা হয়েছিল রাত্রি দুটো পর্যন্ত। সুরেন তবলা সঙ্গত করেছিল—জীবন আর নেপাল গান গেয়েছিল। সেতাব ছিল শ্রোতা।
চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতির পদাবলী। পূর্বরাগের পালাটাই শেষ করে ফেলেছিল তিন জনে। সেতাব ঘাড় নেড়েছিল, বাহবা দিয়েছিল।
ভুল হচ্ছে। বৃদ্ধ জীবন দত্ত দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন এতক্ষণে। এতকাল পরে ভুল হয়ে যাচ্ছে। জীবন নিজেই সেদিন গুলঞ্চ চাপার ফুলের মালা গেঁথেছিল। এক গাছি নয় চার গাছি। চার বন্ধু গলায় পরেছিল।
নেপাল এবং সুরেন সেদিন তাকে পায়ে ধরে সেধেছিল—একটু খা ভাই। আজ এমন সুখের সংবাদ পেয়েছি, আজ একটু খেয়ে দেখ! একটু!
জীবন কিন্তু ধর্মভ্রষ্ট হন নি।
বৈষ্ণব-মন্ত্ৰ-উপাসকের বংশ। মহাশয়ের বংশ। তিনি খান নি। তিনি বলেছিলেন না। ভাই। বাবার কথা তো জানিস। মঞ্জরীদের বাড়িও ঠিক আমাদের মত। তারাও বৈষ্ণব।
ওদিকে বাড়িতে চলছিল মহাসমারোহের আয়োজন। জগদ্বন্ধু মশায়ের একমাত্র সন্তানের বিবাহ। ব্রাহ্মণভোজন, জ্ঞাতিভোজন, নবশাখভোজন, গ্রামের অন্য লোকদের খাওয়াদাওয়া এমনকি আশপাশের মুসলমান পল্লীর মিঞা সাহেবদের লুচি মিষ্টি খাওয়ানো, ব্যবস্থার ত্রুটি রাখেন নি জগদ্বন্ধুমশায়। বাজনা, বাজি পোড়ানো, রায়বেশে তার ওপর দুরাত্রি যাত্ৰাগান হবে কি না এ নিয়েও কথা চলেছিল। সুরেন-সেতাব-নেপাল থেকে গ্রামের ঠাকুরদাস মিশ্রের মত মাতব্বর পর্যন্ত ধরেছিলেন—সে কি হয়! যাত্ৰাগান করাতে হবে বৈকি। না হলে অঙ্গহীন হবে।
মশায় বলছিলেন-আষাঢ় মাসের কথা। বৃষ্টি নামলে সব পণ্ড হবে। শামিয়ানাতে জল আটকাবে না। তার ইচ্ছা ওই খরচে বরং গ্রামের সরকারি কালীঘরের মেঝে দাওয়া বাঁধানো হোক, ঘরখানারও সংস্কার হোক।
এই প্রতীক্ষার কাল যত সুখের তত উদ্বেগের। উদ্বেগে দিনকে মনে হয় মাস, মাসকে মনে হয় বৎসর। তবুও কাটল দিন। আষাঢ়ের এগারই বিবাহ, আষাঢ়স্য প্রথম দিবস এল। আকাশে মেঘ এল। সে মেঘ ভুবন বিদিত বংশের পুষ্কর মেঘ নয়। অশনিগৰ্ভ কুটিলমনা কোনো অজ্ঞাতনামা মেঘ। বর্ষণের ফলে বজ্ৰপাত হয়ে গেল সে মেঘ থেকে।
মঞ্জরী নাই।
বেলা দুপহরের সময় তোক এল পত্র নিয়ে। পত্রে লেখা ছিল—গত পরশ্ব রাত্রে আমার কন্যা বিসূচিকা রোগে মারা গিয়াছে।
এক মুহূর্তে সুখস্বপ্ন একেবারে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। সেকালের তরুণ জীবন দত্ত। সেকালের মানুষের বিবাহিত পত্নীর মৃত্যুতে বুকখানা ফেটে চৌচির হয়ে গেলেও আর্তনাদ বের হত না মুখ থেকে। এ তো ভাবী পত্নী। জীবন কাঁদে নি। নির্জনে কবিরাজখানার উপরের ঘরে চুপ করে বসে ছিল। হঠাৎ ঠাকুরদাস মিশ্রের উচ্চ চিৎকারে চমকে উঠেছিল।
চিৎকার করছিল ঠাকুরদাস মিশ্র।–আমি ঠাকুরদাস মিশ্ৰ—আমার চোখে ধুলো দেবে? লোকে ডালে ডালে যায়—আমার আনাগোনা পাতায় পাতায়। মুখ দেখে আমি মতলব বুঝতে পারি, পাটোয়ারিগিরি করে খাই আমি। এদিকের চার দিকে গোলমাল চলছে, ওদিকে বেটা সুট করে উঠে রাস্তায় নামল! আমার সন্দেহ হল। কী ব্যাপার? জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় যাবে হে? বললে—একবার মাঠে যাব। প্রথমটা বুকটা ধড়াস করে উঠল। সেখানে ওলাউঠো হয়েছে লোকটা সেখান থেকে আসছে, ওর আবার কিছু হয় নি তো? লোকটা হনহন করে চলে গেল। গেল তো, একেবারে যে পথে এসেছে, সেই পথে। কাছের পুকুর জঙ্গল ফেলে চলল। হঠাৎ নজরে পড়ল ছাতাটিও বগলে পুরেছে। তখনই আমার সন্দেহ হল বেটা পালাচ্ছে, আমিও গলিপথে মাঠের ধারে এসে দাঁড়ালাম। দেখি, মাঠে এসেই ছুটতে শুরু করেছে। তখনই আমি বুঝে নিয়েছি। কিন্তু পালাবে কোথা? মাঠে চাষীরা হাল ছেড়ে ঘুরছে, হাকলামধর বেটাকে ধর ধর। ধর।
সোলেমান, করিম, সাতন-তিন জন বেটাকে ধরলে, বললাম নিয়ে আয় বেটাকে পঁজাকোলা করে। আনতেই সোলেমানের হাতের পাঁচনটা নিয়ে বেটার পিঠে কষে এক বাড়ি। বল বেটা, বল—সত্যি কথা বল। ঠিক বলবি, নইলে কাস্তে দিয়ে জিভ কেটে ফেলব। গলগল। করে বলে ফেললে সব।
জগদ্বন্ধু মশায়ের গম্ভীর শান্ত কণ্ঠ বেজে উঠেছিল—ওকে ছেড়ে দাও ঠাকুরদাস, ও গরিবের কী দোষ? ও কী করবে! ওকে পাঠিয়েছে-ও এসেছে। দূত অবধ্য। ও দৃত। নবকৃষ্ণ সিংয়ের। অপকর্মের জবাবদিহি বা প্ৰায়শ্চিত্ত ও কী করে করবে বল?
ঠাকুরদাস বললেন–দোষ তোমার। একখানা চিঠিতে তুমি বিয়ে পাকা করলে। নিজে গেলে না, তাকে আসতে লিখলে না।
মশায় তাঁর বাপের কথাগুলি পুনরাবৃত্তি করলেন, প্রবঞ্চনা আমি করি নি ঠাকুরদাস, প্রবঞ্চনা করেছে নবকৃষ্ণ। এতে আমার দোষ কোথায় বল?
জীবন নেমে এসেছিল উপর থেকে।
মঞ্জরীর বিসূচিকায় মৃত্যু মিথ্যা কথা। গত ২৯শে জ্যৈষ্ঠ তার সঙ্গে ভূপী বোসের বিবাহ হয়ে গিয়েছে।
জীবনের মনে হয়েছিল-দোলের দিন মঞ্জরী হাতে আলকাতরা নিয়ে তার মুখে লেপে দিতে এসেছিল; সেদিন পারে নি, কিন্তু আজ মঞ্জরী সেই আলকাতরা মুখে মাখিয়ে দিয়েছে। যেন মঞ্জরী সেই খিলখিল হাসি নতুন করে আসছে দূরান্তরে দাঁড়িয়ে।
ভূপী হেসে বলছে—বুনো শুয়োরটা!
মশায় ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সস্নেহে তাকে বলেছিলেন-ভগবান তোমার ওপর। সদয়, বাবা জীবন। তোমাকে তিনি আজীবন প্রবঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা করেছেন। ওই মেয়ে। ঘরে এনে তুমি সুখী হতে না। শুধু প্রবঞ্চনা নয়—আজীবন সে তোমাকে অশান্তির আগুনে দগ্ধ করত। তা ছাড়া যার যে পতি-পত্নী। এ তো তোমার আমার ইচ্ছায় হবে না! লজ্জা পেয়ো না, দুঃখ কোরো না। মনকে শক্ত কর।
শেষের কথা কটা ভাল লাগে নি জীবনের। সে মাথা হেঁট করে সেখান থেকে চলে এসেছিল।
মশায় বলেছিলেন—তোমার সঙ্গে কথা আছে। যেয়ো না কোথাও। সুরেন তুমি যাও, তোমাকেও চাই। পাশের ঘরে অপেক্ষা কর।
পাশের ঘরে বসেই জীবন সমস্ত বৃত্তান্ত পেয়েছিলেন। ঠাকুরদাস মিশ্র আস্তে কথা বলতে জানতেন না, অন্যের কাছে আস্তে উত্তর শুনতেও পছন্দ করতেন না। জগৎ মহাশয়ের অনুরোধে। দূতকে তিনি নির্যাতন করেন নাই বটে তবে ধমক দিয়েছিলেন অনেক। প্ৰশ্নোত্তরের মধ্যে যে কথাগুলি প্রকাশ পেয়েছিল, তা হল এই।
প্রতারণা নবকৃষ্ণ সিংহ ঠিক করেন নি।
করেছে মঞ্জরী, বঙ্কিম, আর ওদের মা।
জীবনের হাতে মুষ্ট্যাঘাত খেয়ে ভূপী বোস অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল; খুন করবে, সে খুন করবে বর্বর উল্লুককে, রোমশ কালো শুয়োরকে। তারপরই তার চোখ পড়েছিল মঞ্জরীদের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধ গিয়ে পড়ল তাদের ওপর। বঙ্কিমকে ঠেলে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মঞ্জরীর সামনে হাত নেড়ে কুৎসিত মুখভঙ্গি করে বলেছিল-এ তাদের ষড়যন্ত্র। তোদর! তোদের! ভাই বোন মা সবাই মিলে ষড়যন্ত্র করেছিলি আমাকে তাড়াতে। টাকার জন্যে ওই শুয়োেরটার সঙ্গে, ছোটলোকের ছেলের সঙ্গে প্রেম করতে বাধে না! ছি! ছিঃ ছি! তারপর সাড়ম্বরে পথে চিৎকার করে অপবাদ রটনা করে ফিরেছিল। কিছুদিন থেকেই তার সন্দেহ হয়েছিল মঞ্জরীরা জীবনকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। জীবনের খরচের বাহুল্য দেখে অনুমান করেছিল যে, প্রশ্রয় পেয়েই জীবন এমন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। সে এর প্রমাণ দিতে পারে। নইলে নাতনী। দাদামশায় সম্পর্ক ধরে যে হাসিখুশি বক্র রসিকতার বাগযুদ্ধ চলছিল সে এমন সীমা ছাড়াত না। সম্পর্কটা প্রকাশ্য হলে মঞ্জরী তার কাছ থেকে দামি আতর গোপনে উপহার নিত না। আর আলকাতরা মাখাতে যেত না। তাই সেদিন নাক ভেঙে রক্তমাখা মুখেই ওই কথা রটাতে রটাতে বাড়ি ফিরেছিল। এবং তার দলবল জড়ো করে বোর্ডিং থেকে আরম্ভ করে চারপাশ জীবনের। খোঁজে প্রায় সমুদ্র মন্থন করে ফেলেছিল। খুন করবে। তাকে না পেয়ে তার মুগুরটা কুড়ুল দিয়ে কেটে চেলা বানিয়ে তবে ক্ষান্ত হয়েছিল।
নবকৃষ্ণ সিংহ অথৈ সমুদ্রে পড়েছিলেন। কূল-কিনারা ছিল না। গোটা বাজারে ওই ছাড়া কথা ছিল না। মা মঞ্জরীকে বলেছিলেন—মর, মর—তুই মর!
মঞ্জরী মরতে পারে নি, কিন্তু শয্যা সত্যই পেতেছিল।
বঙ্কিম আস্ফালন করেছিল—আমিও বঙ্কিম সিংহী, আমি দেখে নেব।
বাপ তার গালে ঠাস করে চড় মেরেছিলেন-হারামজাদা, তুই সব অনৰ্থের মূল। দুজনকেই তুই ঘরে এনেছিলি।
বঙ্কিম তাতেও দমে নি, সে আরও প্রবল আস্ফালন করে বলেছিল–খুন করব ওকে আমি।
নবকৃষ্ণ বাঁকা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন কাকে? কাকে খুন করবি?
বঙ্কিম এর উত্তর দিতে পারে নি।
ওদিকে নিত্যনতুন রটনা রটাচ্ছিল ভূপী বোস। কঠিন আক্রোশ তার তখন। শেষ পর্যন্ত নবকৃষ্ণ এই পত্র লিখলেন জগদ্বন্ধু মশায়কে এবং পত্রোত্তর পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। মঞ্জরীও উঠে বসেছিল। ভূপী বোসের নির্মম নিষ্ঠুর অপবাদ রটনায় লজ্জা তার হয়েছিল বৈকি! দুঃখও হয়েছিল, বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে কেঁদেও ছিল। আঘাত যে নির্মম। কাঁদী শহরের চারিদিকে যে রটে গিয়েছিল এই কাহিনী। জগৎ মশায়ের পত্রে সেসব মুছে গেল। নবকৃষ্ণ মাথা তুললেন, সেই পত্র দেখিয়ে বেড়ালেন সকলকে। জগশায় লিখেছেন—মা লক্ষ্মীকে সসম্মানে ঘরে আনিব ইহাতে আর কথা কী আছে। মঞ্জরীও উঠে বসেছিল। ওদিকে ভূপী বোস গরজাতে লাগল খাঁচার বাঘের মত। আর সে কী করতে পারে? তবুও নবকৃষ্ণ সিং সাবধানতা অবলম্বন করে কাঁদী থেকে দেশে চলে এলেন। কাঁদীতে বিবাহ দিতে সাহস করলেন না। গ্রীষ্মের ছুটির কয়েকদিন পরই বিবাহের দিন। স্কুলে ছুটির জন্য দরখাস্ত পাঠালেন। দরখাস্ত নিয়ে গেল বঙ্কিম। সেখানে যে কী করে কী হল কেউ বলতে পারে না, তবে ভূপীর সঙ্গে বঙ্কিমের ছিন্ন প্রীতির সম্পর্ক গাঢ়তর হয়ে উঠল। বঙ্কিমই ফিরে এসে সব পণ্ড করে দিয়েছে।
লোকটি বললে–ওনারা জানতেন-পাত্র ডাক্তার হবে। কিন্তু জগৎ মশায় চিঠিতে লিখেছিলেন, ছেলে তার ডাক্তারি পড়বে না; কবিরাজি করবে, আমার কাছেই কবিরাজি শিখছে। এই শুনেই মায়ের মুখ বেঁকে গেল, কন্যের মুখে বোঝা নামল।
কিন্তু নবকৃষ্ণ সিংহ সেটা চাপা দিলেন, বললেন–তাতে কী হয়েছে?
মঞ্জরীর মা বলেছিলেনকোবরেজ? ছিঃ ছি! একালে কোবরেজের কি মানসম্মান আছে? পয়সাই বা কোথায়? তুমি বরং লিখে দাও ছেলেকে ডাক্তারি পড়াতে হবে।
ধমক দিয়েছিলেন নবকৃষ্ণ সিং। বলেছিলেন তার ছেলেকে তিনি যদি ডাক্তারি না পড়ান? দায়টা আমাদের না তাদের?
মঞ্জরী নাকি কেঁদেছিল গোপনে কিন্তু সে কথা মায়ের অগোচর ছিল না। তিনি আবারও বলেছিলেনো বাপু, একে তোে ছেলের ওই দত্যির মত চেহারা, তার ওপর কোবরেজ হলে খালি গায়ে-বড়জোর পিরান চাদর গায়ে—না বাপু।
নবকৃষ্ণ বলেছিলেন খবরদার! সাবধান করে দিচ্ছি আমি-এ বিয়ে ভেঙে গেলে তোমার মেয়েকে আইবুড়ো হয়ে থাকতে হবে। ভূপী বোস কালসাপের বাচ্চা তার বিষে তোমার মেয়ের জীবন নীল হয়ে গিয়েছে। ও দেখে তোমার মেয়েকে নিতে পারে শুধু জগৎআশায়। কবিরাজ বলে তাকে উপেক্ষা করতে চেয়ো না।
চুপ করতে বাধ্য হয়েছিলেন মঞ্জরীর মা। কিন্তু গজগজ তিনি করেছিলেন।
এই অবস্থায় ভূপীর সঙ্গে আপোস করে বঙ্কিম এল। ফলে আরও দুদিন প্রচণ্ড ঝগড়া হয়ে গেল। তৃতীয় দিন রাত্রে নবকৃষ্ণ ঘুমিয়ে থাকলেন বাড়িতে, বঙ্কিমকে সঙ্গে নিয়ে মা এবং মঞ্জরী গরুর গাড়ি ভাড়া করে এসে উঠল কাঁদীতে। পরের দিন ২৯শে বিবাহের দিন ছিল পাঁজিতে।
নবকৃষ্ণ সিংহ ছুটে গিয়েছিলেন বিবাহ বন্ধ করতে কিন্তু কিছু করতে পারেন নি।
তখন মঞ্জরী ভূপতির চাদরে নিজের অঞ্চল আবদ্ধ করে নবকৃষ্ণের বাসাবাড়ি পিছনে রেখে ভূপীদের জীর্ণ পুরনো চকমিলানো দালানে গিয়ে উঠেছে।
মঞ্জরীর মা ভূপতির বামপার্শ্বে মঞ্জরীকে দেখে আনন্দাশ্ৰু বিসর্জন করে বলেছেন দেখ তো, কী মানিয়েছে—এ যেন মদন-মঞ্জরী!
ভূপতিদের বাড়িতে ওখানকার অভিজাতবংশীয়দের সঙ্গে কুটুম্বিনীর দাবিতে রহস্যালাপ করে এসেছেন। একসঙ্গে দোতলার ঘরে বসে খেয়ে এসেছেন।
ঠাকুরদাস বলেছিলেন চিটিং কেস কর তুমি, করতেই হবে।
জগদ্বন্ধু বলেছিলেন—তার আগে ভাল পাত্রীর সন্ধান কর। ওই এগারই তারিখে বিয়ে। সদ্বংশের সুন্দরী পাত্ৰী খুঁজে বের কর। বিয়ে হয়ে যাক—কেসটেস তার পরে। আমোদ-আহ্লাদ খাওয়াদাওয়া সেরে হৃষ্ট চিত্তে, সবল সুস্থ দেহে আদালতে হাজির হয়ে বলা যাবে আমাদের ঠকাতে চেয়েছিল, কিন্তু আমরা ঠকি নি। ধারাটারাগুলো বরং দেখেশুনে রেখো অবসরমত।
হা-হা করে হেসে উঠেছিলেন মশায়।
সকলে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল জগৎ মশায়ের মুখের দিকে। এই অপমানেও জগৎমশায় হা-হা করে আসছেন।
জগৎ মশায়ের সেই এক কথা—বিয়ে এগারই। একদিন পিছুবে না। সুরেন্দ্ৰ তুমি আর সেতাব আমার সঙ্গে পাত্রী দেখতে যাবে। তোমরা পছন্দ করে ঘাড় নাড়লে আমি তবে হাঁ বলব। খোঁজ কর কোথায় আছে গরিবের ঘরের সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী মেয়ে। তবে বংশ সদ্বংশ হওয়া চাই।
সেতাব, সুরেন্দ্র, নেপাল এদের উৎসাহের আর সীমা ছিল না। উঠে পড়ে লেগেছিল-পাত্রী খুঁজে বের করবেই। ভাল মানুষ সেতাব হেসে বলেছিল—এ সেই রাজপুত্র মন্ত্রীপুত্ৰ সদাগরপুত্র কোটালপুত্রের গল্প হল, যারা উদ্দেশে রাজকন্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু ভাই জীবন, তুই এই একটু হাঁস দেখি!
সেতাব চিঠি লিখেছিল তার মামার বাড়িতে। সুন্দরী গুণবতী সদ্বংশের বয়স্কা পাত্রী থাকিলে অবিলম্বে জানাইবে। কোনো পণ লাগিবে না। পাত্রের পিতা এখানকার নামকরা কবিরাজ জগৎ মশায়। খুব রোজগার। জমি পুকুর বাগান জমিদারি আছে। ছেলেও কবিরাজি শিখিতেছে।
সুরেন্দ্র সত্য সত্যই চালচিড়ে বেঁধে বেরিয়ে পড়ার মত বেরিয়ে পড়েছিল। জগৎ মশায়ের কাছে কয়েকটি টাকা চেয়ে নিয়ে বলেছিল—আমি একবার সদর শহরটা ঘুরে আসি। পসার নাই এমন গরিব উকিল মোক্তারের তো অভাব নাই। এদের মধ্যে কায়স্থও অনেক। বয়সওয়ালা আইবুড়া মেয়ে এইসব জায়গাতে মিলবে।
জগৎমশায় তাই পাঠিয়েছিলেন সুরেন্দ্রকে।
নেপালটা ছিল ছেলেবেলা থেকেই আধপাগলা। সন্ধানের ধারা ছিল বিচিত্র। তার বাবা ছিলেন সবরেজেষ্ট্রি আপিসের মোহরার। নেপাল তখন বাপের সঙ্গে সবরেজেষ্ট্রি আপিসে গিয়ে টাউটের কাজ করত। দলিল যাতে আগে রেজেষ্ট্রি হয় তার ব্যবস্থা করে দাখিল দিত, কাটাকুটি থাকলে কৈফিয়ত লিখে দিত, শনাক্তদার না থাকলে শনাক্ত দিয়ে দিত। অর্থাৎ বলে দিত—এই ব্যক্তির নাম ধাম পিতার নাম যাহা বলিয়াছে তাহা সত্য আমি শ্ৰীনেপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায় পিতা শ্ৰীবিনোদলাল মুখোপাধ্যায় নিবাস নবগ্রাম-আমি ইহাকে জানি এবং চিনি। তার তলায় সই মেরে দিত। ফি নিত দু আনা। নেপাল সবরেজেষ্ট্রি আপিসের সামনে বটতলায় বসে জনে। জনে জিজ্ঞাসা করত-বলি চাটুজ্জেমশায়, আপনার খোঁজে ভাল কায়স্থ পাত্রী আছে?
—ওহে কী নাম তোমার? গোবিন্দ পাল? কায়স্থ পাত্রীর খোঁজ দিতে পার?
–কোথায় বাড়ি শেখজীর? আপনাদের গায়ের কাছাকাছি কায়স্থ আছে? বেশ সুন্দরী ভাল। বংশের কন্যে আছে? বলতে পারেন?
শুধু এই নয়, পথেঘাটে পথিক পেলেই সে প্রশ্ন করত। ভাল কন্যে আছে হে কায়স্থ বংশের?
শেষ পর্যন্ত লাগল একদিন। ওদের জমির ভাগজোতদার নবীন বন্দীকে বলেছিল-খোঁজ করিস তো নবীন! ভাল কায়স্থদের বড়সড় মেয়ে। নবীন যাচ্ছিল কাটোয়ার বয়ে গঙ্গাজল আনবে। নেপাল বলেছিল—যাবি তো এতটা পথ। আসিস তো নবীন খোঁজ করে।
আজকের জীবন মশায় তখন শুধু জীবন; বড়জোর জীবন দত্ত। সেদিন জীবনের পক্ষে এ আঘাত হয়েছিল মর্মান্তিক। কিন্তু ভেঙে পড়েন নাই। বরং ক্রোধে আক্ৰোশে বিবাহের জন্য উৎসাহিত হয়ে উঠেছিলেন। সে উৎসাহ অনেকের চোখে বেশি বেশি মনে হয়েছিল। জীবন কিন্তু গ্রাহ্য করেন নাই। তরুণ জীবন সেদিন মনের ক্ষোভে উল্লাসে উন্মত্ত হয়ে উঠতে চেষ্টা করেছিল।
আজ বৃদ্ধ জীবন মশায় হাসলেন। আজ তিনি দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজের তরুণ জীবনের দিকে চেয়ে আছেন রসজ্ঞ দ্রষ্টার মত।
সাপের বিষে জৰ্জর মানুষের জিভে নিমের মত তেতোকেও নাকি মিষ্টি লাগে। মিষ্টি রসকে মনে হয় তেতো।
নাঃ।
ভুল হল। বৃদ্ধ জীবন মশায় বার দুই ঘাড় নাড়লেন। না-না।
মঞ্জরী যে তাঁর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তার সঙ্গে মঞ্জরীর প্রতি তাঁর ভালবাসার সম্পর্ক কী? ভালবাসার সঙ্গে কি কখনও সাপের বিষের তুলনা হয়? তিনি ক্ষোভে নিজে হাতে বিষের নল মুখে তুলে শেষ বিন্দু পর্যন্ত পান করেছিলেন।
ক্ষোভে আক্ৰোশে তরুণ জীবন দত্ত সেদিন দুটি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।
খুব সুন্দরী পত্নী ঘরে এনে সর্বোত্তম সুখে সুখী হবেন। ভালবাসবেন তাকে রামায়ণের কাহিনীর ইন্দুমতীকে অজরাজার ভালবাসার মত।
আর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ডাক্তার তিনি হবেনই।
নাইবা পড়তে গেলেন মেডিক্যাল স্কুল বা কলেজে। ঘরে বসে তিনি পড়ে ডাক্তার হবেন। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিল তার চোখের সম্মুখে।
এ অঞ্চলের প্রথম বিখ্যাত ডাক্তাররঙলাল মুখুজ্জে। নতুন দিনের সূর্যের মত তিনি তখন উঠলেন।
বিস্ময়কর মানুষ, বিস্ময়কর প্রতিভা, রোমাঞ্চকর সাধনা রঙলাল ডাক্তারের; তেমনি চিকিৎসা।
গৌরবর্ণ মানুষ; সবল স্বাস্থ্য, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, রঙলাল ডাক্তারকে একশো জনের মধ্যে দেখবামাত্র চেনা যেত। চেহারাতেই যারা প্রতিভার স্বাক্ষর নিয়ে আসেন তিনি ছিলেন তাঁদের একজন। এসব মানুষ দুঃসাহসী হবেই। স্বল্পভাষী কিন্তু সেই অল্প কথাগুলিও ছিল, রূঢ় ঠিক নয়, অতি দৃঢ়তায় কঠিন, সাধারণের কাছে রূঢ় বলে মনে হত। হুগলী জেলার এক গ্রামে সেকালের নিষ্ঠাবান ব্ৰাহ্মণ পরিবারে জন্ম। হুগলী স্কুলে এবং কলেজে এফ. এ. পর্যন্ত পড়ে বাপের সঙ্গে মনান্তরের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কলেজে পড়বার সময় তিনি হুগলীর মিশনারিদের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। তাদের ওখানে যেতেন, তাদের সঙ্গে খেতেন। বাপের সঙ্গে মনান্তরের হেতু তাই।
বাপের মুখের ওপরেই বলেছিলেন–জাত আমি মানি না। ধর্মকেও না। তাই ওদের ওখানে ওদের সঙ্গে খাওয়া আমি অপরাধ বলে মনে করি না। আর ধৰ্মই যখন মানি না তখন ধর্মান্তর গ্রহণের কথাই ওঠে না।
সেই দিনই গৃহত্যাগ করে বেরিয়েছিলেন পদব্রজে, কপদকশূন্য অবস্থায়। এই জেলায় প্রথম এসে এক গ্রামে হয়েছিলেন পাঠশালার পণ্ডিত। পাঠশালার পণ্ডিত থেকে হয়েছিলেন স্কুল মাস্টার। এ জেলার এক রাজ-স্কুলে শিক্ষকের পদ খালি আছে শুনে দরখাস্ত করে চাকরি পেয়েছিলেন। এই চাকরি করতে করতেই হঠাৎ আকৃষ্ট হলেন চিকিৎসাবিদ্যার দিকে। রাজাদের প্রতিষ্ঠিত। হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে হয়েছিল বন্ধুত্ব। প্রায় যেতেন তার কাছে। হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে রোগী দেখতেন। ডাক্তারের কাছে ডাক্তারি বই নিয়ে পড়তেন। ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করতেন রাত্রির পর রাত্রি। এক-একদিন সমস্ত রাত্রিব্যাপী আলোচনা চলত। আলোচনা থেকে তর্ক, তর্ক থেকে কলহ।
একদিন কলহ কী হয়েছিল কে জানে—সে কথা রঙলাল ডাক্তার কারও কাছে জীবনে প্রকাশ করেন নাই, ডাক্তারও করে নাই—তবে তার ফল হয়েছিল বন্ধুবিচ্ছেদ। কয়েকদিন পরেই হঠাৎ রঙলাল ডাক্তার মাস্টারি ছেড়ে তার বইয়ের গাড়ি নিয়ে এসে উপস্থিত হলেন এই অঞ্চলে। এখান থেকে ছমাইল দূরে ময়ূরাক্ষীর তীরে একটা বাঁকের উপর মুসলমানপ্রধান লালমাটি গাঁয়ে প্রথম রইলেন ঘর ভাড়া করে। তারপর গ্রামপ্রান্তে নদীর প্রায় কিনারার উপর একখানি বাঙলো বাড়ি তৈরি করে বাস করলেন। সামনে বিস্তীর্ণ ময়ূরাক্ষীকে রেখে বারান্দার উপর বসে দিনরাত্রি সাধনা শুরু করলেন। মধ্যে-মধ্যে রাত্রে বের হতেন পিশাচসাধকের মত। কাঁধে কোদাল নিয়ে বেরিয়ে যেতেন আর নিয়ে যেতেন একটা চাকাওয়ালা ঠেলাগাড়ি। কবরস্থানের টাটকা কোনো কবর খুঁড়ে শবদেহ বের করে নিয়ে আবার কবরটি পরিপাটি করে বন্ধ করে শবদেহটা ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে টেনে আনতেন। তারপর দু-একদিন রঙলাল ডাক্তারকে আর বাইরে দেখা যেত না। বাঙলোটার পিছনে পাঁচিল—ঘেরা বিস্তীর্ণ হাতার মধ্যে তিনি একটা কাচের-ছাদওয়ালা ঘর করেছিলেন। সে ঘরে কারুর ঢুকবার অধিকার ছিল না। সেইখানে তিনি মড়া কেটে বই মিলিয়ে দেহতত্ত্ব শিখেছিলেন। কিছুদিন পরই জুটেছিল এক যোগ্য উত্তরসাধক। ময়ূরাক্ষীর ওপারের মনা হাড়ি। মনা হাঁড়ি ছিল ময়ূরাক্ষী ঘাটের খেয়ামাঝি। আর একটা কাজ করত—সে ছিল শ্মশানের শ্মশানবন্ধু—দুর্দান্ত মাতাল, সব পরিচয়ের চেয়েও তার আর-একটা বড় পরিচয় ছিল—লোকে বলত মনা রাক্ষস। মনার ক্ষুধার কখনও নিবৃত্তি হত না। একবার এক হাঁড়ি ভাত নিঃশেষ করে মনা শ্মশানের অনতিদূরে একটা পাঠাকে দেশে আবার ক্ষুধার্ত হয়ে পাঠাটাকে ধরে ঘাড় মুচড়ে মেরে ওই চিতার আগুনেই সেটাকে পুড়িয়ে ৫ষ করেছিল। এই মনাই হল রঙলাল ডাক্তারের প্রথম ভক্ত। বছর দুয়েক পর থেকে মনাই হয়েছিল তার পাঁচক। তার হাতেই তিনি খেতেন। এই মনাই তাকে শব সংগ্রহে সাহায্য করত। ময়ূরাক্ষীর জলে ভেসে-যাওয়া শব তুলে এনে দিত। অনেক সময় শ্মশানের পরিত্যক্ত শব এনে দিত। এইভাবে বৎসর পাঁচেক সাধনার পর রঙলাল ডাক্তার একদিন ঘোষণা করলেন-আমি ডাক্তার। যে রোগ এখানে কেউ সারাতে পারবে না, সেই রোগী আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি সারিয়ে দেব।
কিছুদিনের মধ্যেই এই ঘোষণাকে তিনি সত্য বলে প্রমাণিত করলেন। লোকে বিস্মিত হয়ে গেল তাঁর প্রতিভায়। বললে, ধন্বন্তরি। ডাক্তার পালকি কিনলেন কলে যাওয়ার জন্যে।
মনা বললে—উঁহুঁ! একটা ঘোড়া কিনে ফেল বাবা। মানুষের পায়ে আর ঘোড়ার পায়ে! রঙলাল বললেন–দূর বেটা! মানুষের কাঁধে আর ঘোড়ার পিঠে? মানুষের কাঁধে আরাম কত?
–আজ্ঞে?
—সে তুই বুঝবি না বেটা! ঘোড়ায় চড়ে শেষে পড়ে হাড়গোড় ভাঙব?
জীবন দত্ত সেদিন আকাশকুসুম কল্পনা করে নাই। তার আদর্শ ছিল বাস্তব এবং সজীব। ডাক্তার হয়ে প্রচুর প্রতিষ্ঠা অর্জন করে সোনার গহনায় সুন্দরী স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে একদিন তার কাঁদী যাবার ইচ্ছা ছিল। সে যাবে বড় সাদা ঘোড়ায় চেপে, স্ত্রী যাবে কিংখাবে মোড়া পালকিতে।
মুরশিদাবাদ যাবার অছিলায় পথে কাঁদীতে ভূপী বোসের ফাটল ধরা বাড়ির দরজায় ঘোড়াটার রাস টেনে দাঁড় করিয়ে বলবে-আজকে রাত্রির মত একটু বিশ্রামের স্থান হবে কি? ইচ্ছে করেই প্রহরখানেক রাত্রে গিয়ে উপস্থিত হবে ওদের বাড়িতে।
স্ত্রীকে পাঠিয়ে দেবে অন্দরে। মঞ্জরীর কাছে।
সে গিয়ে বলবেআজ রাত্রির মত থাকতে আমাদের একটু জায়গা দেবেন? আপনি তো আমাদের আপনার লোক। সম্বন্ধটা সইয়ের বউয়ের বকুল ফুলের বোনপো-বউয়ের বোনঝি জামাইয়ের মত হলেও সম্বন্ধ তো বটে।
তারপর যা হবার আপনি হবে।
বিবাহের পর কিন্তু সব যেন বিপরীত হয়ে গেল। জীবন দত্ত আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল সেদিন, কেন এমন হল?