ন্যাশনাল হাইওয়ে
চিকরাসি যখন গাড়িটা ঢোকাল ন্যাশনাল হাইওয়ে থেকে ডানদিকে কিছুটা গিয়ে গ্রীনফিল্ডস-এর হাতাতে তখন রাত হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। তবে চাঁদ ওঠেনি তখনও। চতুর্থী কী পঞ্চমী। চাঁদ উঠতে এখনও দেরি আছে।
হারিতরা ততক্ষণে পৌঁছে গিয়ে চেয়ার-টেয়ার বাইরে বের করিয়ে লন-এ পাতিয়েছে। গ্রীনফিল্ড লজ-এর একটা অংশ কোনো ব্যাঙ্ককে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। গামহাররা গাড়ি পার্ক করে নামতে নামতে ব্যাঙ্কের আনোগুলো সব নিভে গেল এক এক করে। লন-এ একটা আলো আছে। কয়েকটা রোগা-রুখু ইউক্যালিপটাস গাছ। ওরা গিয়ে বসতে না বসতেই মশা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। গামহার যেদিকে বসেছে সেদিকটা আধো-অন্ধকার। আলোটা আটকে যাচ্ছিল ইউক্যালিপটাসের ডালে। কামড়াতে লাগল মশা। গামহার জিনস পরে রয়েছে, তাই পায়ের পাতা গোড়ালি, মুখ এবং হাত ছাড়া অন্যত্র অবশ্য কামড়াতে পারছিল না। ঝাঁঝি ঠিক গামহার এর উল্টোদিকের চেয়ারে বসেছিল। একটা ঝাঁঝি-রঙা ফিকে হলুদ শিফনের শাড়ি পরেছিল সে। গায়ে সবুজ ব্লাউজ-এর সঙ্গে হাতে সবুজ ব্যান্ডের হাতঘড়ি। তার মুখের একটা দিকে আলো পড়ে তাকে আরও ব্যক্তিত্বময়ী দেখাচ্ছিল। পাছে ঝাঁঝির মুখটাকে দুচোখ ভরে দেখতে না পায় তাই যথেচ্ছ মশা কামড়ানো সত্ত্বেও ওই চেয়ার ছেড়ে গামহার বেশি আলোতে পাতা অন্য চেয়ারে উঠে গেল না। ও যে আর্টিস্ট। ওর দেখার চোখই আলাদা, ও ফুল দেখে, প্রজাপতি দেখে, সূর্যোদয় বা সুর্যাস্ত দেখে যেমন আনন্দ পায় তেমনই এক অতীন্দ্রিয় আনন্দ পাচ্ছিল ঝাঁঝির মুখের দিকে চেয়ে। একজন আর্টিস্ট বা কবির চোখ যা দেখে, তা কি সাধারণে কখনও দেখতে পায়?
গ্রীনফিল্ডস-এ খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত নেই। হাইওয়ের ওপরে সর্দারজীদের ভাল ধাবা আছে। সেখান থেকে খেয়ে আসেন অনেকেই। এদের বললে, এরাও এনে দেয়। তবে চিকরাসি সঙ্গে করে চারটি বড় ক্যাসাবোল নিয়ে এসেছে। গাড়ি নিয়ে গিয়ে ও গরম গরম খাবার নিয়ে আসবে।
গামহার বলল, আমাকে কী করতে হবে বলো?
তোমাকে কিছুই করতে হবে না। রিল্যাক্স করো। এনজয় করো। আমরা ছোট ভায়েরা আছি কী করতে।
গামহার-এর কোনো ভাই নেই। এক দিদি। দিদি তো স্পেইন-এ থাকতেই মারা গেছেন। বড় জামাইবাবু ফরেন সার্ভিসে ছিলেন। তিনিও আর নেই। রিটায়ার করার পরেই মারা গেছেন। গামহার লক্ষ্য করেছে যে অধিকাংশ চাকরিসর্বস্ব চাকরিজীবীরাই রিটায়ার করার পরপরই চলে যান। যাদের চাকরি ছাড়াও অন্য কোনো শখ, বা নেশা, বা ধ্যান থাকে তারাই চাকরি ছাড়ার পর বাঁচেন এবং আনন্দেই বাঁচেন। গামহার যেহেতু চাকরি করে না, ছবি আঁকে, ওর রিটায়ারমেন্ট নেই। যতদিন শরীরে কুলোবে, ইচ্ছে করবে, ততদিন ছবি এঁকে যাবে। তবে চিকরাসির কথাতে মনে পড়ল যে, ওর ভাই-বোন না থাকার দুঃখ চিকরাসির মতো অগণ্য ভায়েরা পূর্ণ করে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলতেন না যে, যেই আত্মার কাছে থাকে সেই তো আত্মীয়। রক্তসূত্রের আত্মীয়তার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। যে আত্মীয়তা মানুষে জীবনের পথে চলতে চলতে অর্জন করে নিজের ব্যবহারে, গুণে, রুচিতে, মানসিকতাতে সেই আত্মীয়তাই আসল আত্মীয়তা। সেই অর্থে এই চিকরাসি তার আসল ভাই-এর চেয়েও হয়তো আপন। আপন ভাই থাকলে হয়তো তুলনা করে দেখতে পারত। নেই বলে, সেই তুলনা করার উপায় নেই। ভাগ্যিস নেই।
জারুল গাড়ি থেকে নেমেই বাথরুমে গেছিল। তিনটি ঘর খুলে দিয়েছে এরা। উজ্জ্বল আলো জ্বলছে ঘরে। হারিত হুইস্কি ও রাম-এর বোতল এনে টেবিলের ওপরে রাখল। গ্লাসগুলো, কলকাতা থেকে আনা ন্যাপকিন দিয়ে ভাল করে মুছল। আইস-বক্সে করে বরফও এনে দিল বেয়ারা।
চিকরাসি বলল, দাদার জন্যে স্কচ এনেছি। দাদা স্কচই খান। বুঝলে, হারিত।
গামহার বলল, তোমাদের জন্যে একটি জ্যাপানীজ হুইস্কি এনেছি আমি। সানটোরি। টুয়েলভ ইয়ার্স ওল্ড। আমার ছবির একজন অ্যাডমায়রার তপন মিত্র টোকিও থেকে নিয়ে এসেছেন। টোকিওতে ওঁদের কোম্পানির ব্রাঞ্চ আছে। প্রায়ই যেতে হয় কাজে।
হারিত বলল, ওটা জোরান্ডাতে গিয়ে খোলা হবে।
চিকরাসি কী একটা বলতে যাচ্ছিল এমন সময়ে প্রচণ্ড আর্তনাদ করে প্রায় লাফাতে লাফাতে জারুল ঘর থেকে বাইরে এল দড়াম করে দরজা খুলে।
ওরা সকলেই দাঁড়িয়ে উঠল, কী হলো? কী হলো? বলে। দম নিতে কষ্ট হচ্ছিল জারুল-এর। সে বিবর্ণ মুখে বলল, ইঁদুর।
কোথায়?
ঝাঁঝি শুধোল।
কোথায় নয় বলো? ঘরে, বাথরুমে। এত বড় বড় ইঁদুর যে নাক-কান খেয়ে ফেলবে মুহূর্তের মধ্যে।
চিকরাসি বলল, সেজন্যে এমন চিৎকার করবে। আমি তো ভাবলাম ঘরের মধ্যে কেউ লুকিয়ে থেকে তোমাকে রেপ করতে গেল বুঝি। প্রত্যঙ্গ খেয়ে ফেলার ভয় তো তোমাদের থেকে আমাদের, মানে পুরুষদেরই বেশি।
ঝাঁঝি মুখ ফিরিয়ে নিঃশব্দে হাসল।
জারুল চিকরাসির কথাটার মানে প্রথমে বুঝতে পারল না, পরক্ষণেই বলল, এত অসভ্য না তুমি!
গামহার বলল, চলো তো ঘরগুলো একটু দেখে আসি। থাকার মতো না হলে কিন্তু রাতে থাকব না। তার চেয়ে সারারাত গাড়ি চালিয়ে চলি চলো, এখানে খাদ্য-পানীয়র শ্রাদ্ধ করে।
তারপর হারিতের দিকে চেয়ে বলল, জঙ্গলে প্রথমে আমরা যেখানে যাব সেখানে পৌঁছতে ক’ঘণ্টা লাগবে?
এখান থেকে কখন বেরোব আমরা তারই ওপর ডিপেন্ড করছে।
এখন বাজে সাড়ে ন’টা প্রায়। যদি এখানে না থেকে রাত এগারোটা নাগাদ বেরোই তবে আস্তে আস্তে চালিয়ে গেলে যোশিপুরের আগেই বাঁদিকে ঢুকে গিয়ে চাহালা পৌঁছে যাব সকালেই।
তাহলে তো ভালই।
তার আগে ঘরগুলো তো দেখা যাক। বলে, ওরা তিনজনেই গেল ঘর দেখতে। বিছানা, বেডকভার, বালিশের তেলচিটে ও মর্দিত চেহারা দেখে হারিত বলল, এসব ঘর তো দেখছি ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়।
গামহার বলল, ইঁদুর কেন? এখানে বাঘ থাকাও আশ্চর্য নয়।
চিকরাসি বলল, তার চেয়েও বড় কথা এই বিছানাতে রাত কাটালে এইডস হবে নির্ঘাৎ।
যে বেয়ারা বরফ নিয়ে এসেছিল, সে বলল, ভাল করে স্প্রে মেরে গুডনাইট জ্বালিয়ে দেব স্যার। মচ্ছর লাগবে না।
গুডনাইটে কি ইঁদুর মরবে?
ইঁদুর কোথায়? মাঠ থেকে হয়তো জানালার ভাঙা কাঁচ দিয়ে একটা হঠাৎই ঢুকে এসেছিল।
তার কথা শেষ হতে না হতেই বাথরুম থেকে একটা এবং খাটের তলা থেকে আরেকটা বেড়ালের মতো ইঁদুর লাফ মেরে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে ওদিকের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
হারিত বলল, দ্যা ডিসিশন ইজ মেড। চলো, খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়ি। সারারাত গাড়ি চালালে রাফিং হবে। ছেলেবেলায় জি টি রোড দিয়ে গাড়ি চালিয়ে বার্নপুরে বড়পিসের বাড়ি যেতাম। রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর বেরোতাম। ধীরে সুস্থে গিয়ে গরম গরম সিঙ্গাড়া-জিলিপি কিনে নিয়ে পিসি-পিসেকে হল্লাগুল্লা করে ঘুম থেকে তুলতাম সকালে।
ছেলেবেলা আবার কি! তুমি তো এখনও ছেলেমানুষই।
আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক গামহারদা। আমার বউকে শুনিয়ে আরেকবার বলুন। এই যে শুনছো!
শুনেছি। আমি তো জানিই যে তুমি ছেলেমানুষ। তুমি যেটাকে গুণ ভাবছ, আমি তোমার মধ্যে সেটাকেই দোষ বলে মনে করি। সব বুড়োমানুষী সব ছেলেমানুষকে যেমন মানায় না, সব ছেলেমানুষী তেমনই সব বুড়োমানুষকে মানায় না। সব ফুলদানীতে কি সব ফুল মানায়? আধারে আধারে তফাৎ থাকেই।
হারিত বলল, দেখলেন স্যার। একটা সরল কথার পিঠে কী দার্শনিক এবং গোলমেলে তত্ত্ব আওড়ালো আমার বউ।
আবার স্যারটার কেন ভাই। গামহারদাই বোলো।
তাই বলব।
কে কি খাবে বল। আমি অর্ডারটা দিয়ে আসি তারপর সয়ে গিয়ে নিয়ে আসব।
যা হয় বলে কিন্তু সকলের জন্যে একই মেনু বল। একি জামাইষষ্ঠী না কি? অত ঝামেলা করার কি দরকার।
নাই বা কেন? নানারকম জিনিস যখন পাওয়া যায় তখন আপরুচিসে খানার অসুবিধা কোথায়? মেয়েদের অন্তত ওই সম্মানটা দেওয়া যাক।
সবসময় মেয়ে মেয়ে কোরো না তো। আমরা মানুষ তো। অনেক ব্যাপারে তোমাদের চেয়েও আমরা এগিয়ে, তবু সবসময়ে এমন করে যেন আমাদের সত্যি সত্যিই তোমরা মাথায় করে রাখো। লোক-দেখানো ভড়ং না করাই ভাল।
ঝাঁঝি বলল, ঝংকার তুলে।
গামহার-এর ভাল লাগল। ঝাঁঝির গ্রীবা উঁচু করে কথা বলার ভঙ্গি, তার গলার ভরা-কলসের মতো স্বর, তার বক্তব্য। সবকিছুই। যাকে ভাল লেগে যায় গামহারের এমনই সবকিছুই ভাল লাগে আর যাকে পছন্দ হয় না তার চরণও বাঁকা লাগে।
চিকরাসি গাড়ি স্টার্ট করে বেরিয়ে গেল। হারিত স্কচ-এর বোতলটা খুলে একটা গ্লাসে ঢেলে বলল, টেল মি হোয়েন টু স্টপ।
এটা কি?
জন হেইগ।
বাস্। বাস্। বলে উঠল গামহার।
জল না সোডা?
জল। জল। বিদেশ বিভুঁই-এ সোডা পাওয়া যায় না। তাই জল দিয়েই খাই, যখন খাই।
বরফ?
হ্যাঁ বরফ দেবে বেশি করে।
যখন খান মানে? রোজ খান না? সে কি?
না। তবে যেদিন খাই সেদিন গুণে গুণে খাই না।
তাই?
হ্যাঁ। যারা গুণে গুণে ড্রিঙ্ক করে তারা মানুষ খুন করতে পারে, সুদের কারবার করে। সেইসব মানুষকে কখনও বিশ্বাস করবে না।
ঝাঁঝি বলল, উনি কিন্তু তোমার মতো হিসেবী চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট নন উনি একজন আর্টিস্ট। হিসেব আর আর্ট কখনও সহাবস্থান করে না। করলে, দুটির একটিরও মঙ্গল হয় না।
বাঃ।
খুশি হয়ে বলল, গামহার।
তারপর বলল, ঠিক সে জন্যেও নয়। ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথের ‘তিনসঙ্গী’র একটি গল্প পড়েছিলাম। ‘রবিবার’ তার নায়ক অভীকের মুখে একটা সুন্দর কথা ছিল। এই কথাটি অবশ্য আমি প্রায়ই বলি। তোমরাও হয়তো আগে আমার মুখেই শুনে থাকবে…
শুনে থাকলেও আবার শুনব।
জারুল বলল।
অভীক বলেছিল, আমি কোনো নেশাকে পেতে পারি কিন্তু কোনো নেশা আমাকে পাবে সেটি হচ্ছে না। বা এই রকমই কিছু।
বাঃ। সত্যিই ভারি সুন্দর কথা। তোমরা গামহারদাকে দেখে শেখো। সঙ্গে হলেই ‘আজ কাথায় বসা যায়’ নইলে ‘বাড়িতেই বসা যাক’ এই বাক্য শুনে শুনে তো কান পচে গেল। যেদিন বৃষ্টি পড়ে তোমরা সেদিনও খাও, যেদিন বৃষ্টি পড়ে না সেদিনও। কোনোদিন আনন্দ হলে খাও, অন্যদিন দুঃখ হলে। কোনো কিছুতেই নেশাগ্রস্ত হলে তাতে আর আনন্দ থাকে না।
জারুল বলল।
ঠিক। কোনোরকম কম্পালসিভনেসই আনন্দর মধ্যে গণ্য নয়।
নেশারই মতো একজন নারীতে অভ্যস্ত হওয়াটাও অনুচিত। তাতে নারী বা পুরুষ কারওই গৌরব বৃদ্ধি হয় না, যে কারণে বিয়ে ব্যাপারটাই শিক্ষিত, সচ্ছল সমাজে বাতিল হয়ে যেতে বসেছে। বিয়েটা একঘেয়েমির সংজ্ঞা হয়ে গেছে। যুগ বদলাচ্ছে, কাল বদলাচ্ছে, তার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সমাজ ব্যবস্থা বদলাতে বাধ্য।
ঝাঁঝি বলল।
তা ঠিক। একঘেয়েমির মতো এত বড় অভিশাপ আধুনিক মানুষের জীবনে সম্ভবত আর নেই। তাই হয়ত অসচ্ছল সমাজেও বাতিল হতে বসেছে।
এই যে। নিন গামহারা।
তোমার?
তারপর ঝাঁঝিদের দিকে ফিরে বলল, তোমরা খাবে না কিছু?
ঝাঁঝি বলল, মদ-এর চেয়েও অনেক বেশি নেশা হয় আমি তেমন তেমন নেশাতে বিশ্বাস করি।
সে কেমন নেশা? গামহার বলল।
আমরা কোক খাব। জারুল বলল।
যেমন প্রকৃতি, যেমন পূর্ণিমা রাত, যেমন মনের মতো পুরুষ, ভাল লাগার গান, বহুদিন মন-খারাপ অথবা মন-ভাল করে-রাখা সাহিত্য। সেটাই আমার হ্যাঙ্গ-ওভার।
বাঃ। তুমি ভারি ভাল কথা বলো তো। ঝাঁঝি বলল।
সেটা বুঝি একমাত্র আপনাদেরই প্রেরোগেটিভ করে রাখতে চান? ভাল কথা বলি বুঝি আমি? পারলে তো ভালই হতো। একসঙ্গে এত কথা আমার মনে আসে, নানা শেডস এরই মতো যে, surealistic ছবি আঁকতে গিয়ে নিতান্তই daub হয়ে যায়।
হারিত জারুলকে কোক-এর সঙ্গে রাম মিশিয়ে দিয়ে নিজে জলের সঙ্গে রাম নিল। ঝাঁঝিকে শুধু কোক দিল গ্লাসে ঢেলে।
তারপর চেয়ারে বসে বলল, একটু ব্যাখ্যা করে বলুন দাদা। ঝাঁঝির বাবা আর্টিস্ট ছিলেন। আমার বাবা তো ছিলেন না। এইসব আর্টিস্টিক টার্মস আমরা জানি না।
ঝাঁঝি বলল, হ্যাঁ। আমি চিত্রীরই মেয়ে। তবে আমার বাবাদের প্রজন্ম আপনাদের মতো অর্থ, যশ, প্রচার কিছুই পাননি। বরং সমাজের উপেক্ষাই পেয়ে গেছেন। আমার মা বড়লোকের মেয়ে ছিলেন। চালচুলোহীন, ফাইন-আর্ট করা আর্টিস্টকে ভালবাসার অপরাধে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাড়ি থেকে বিপুল অর্থবান, হাওড়ার ঢালাইওয়ালা দাদু। মাকে নিয়ে বাবা বস্তীতে গিয়ে উঠেছিলেন। তখন শিল্পীদের জনগণায়নও হয়নি। সরকার অথবা মিডিয়ার তাঁবেদারী করে তখনকার শিল্পীরা কিছুই পেতে চাইতেন না। সেই সময়ের কবি, সাহিত্যিক, গায়ক, বাদক, নাচিয়ে, চিত্ৰী সকলেরই আত্মসম্মানজ্ঞান ছিল প্রখর। কোনো প্রলোভনেই নিজস্বতাকে তারা বিকোতেন না।
একটু চুপ করে থেকে বলল, তবে আপনার বেলাতে এই সব নিন্দামন্দ যে খাটে না, তা জানি। কিন্তু চারদিকে যা দেখি! কবি সাহিত্যিক গাইয়ে চিত্রীদের যে পরিমাণ তৈলমর্দন করতে দেখি মন্ত্রী ও মিডিয়াদের তাতে তাদের আর শ্রদ্ধা করতে পারি না। আমার বাবা তো মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন। সাহিত্য-শিল্পী-সঙ্গীতের এমন পণ্যায়ন, জনগণায়ন, তাকে দেখে যেতে হল না!
গামহার বলল, চিয়ার্স।
জারুল বলল, ইসস, তোমাদের বরফ লাগবে কি না জিজ্ঞেস করতে একদম ভুলে গেছি। আপনাকে আরও কি দেব গামহারদা।
দাও। আই লাইক প্লেন্টি অফ আইস। তারপর বলল, আউ গুট্টে দিয়স্তু।
জারুল বলল, আপনি ওড়িয়া বলতে পারেন?
সামান্য।
কী করে শিখলেন?
একটি ওড়িয়া মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম।
কোথায়? কটকে?
না, না। কটকে নয়, কলকাতাতেই। আমাদের পাশের বাড়ি তার বাবা ভাড়া নিয়েছিলেন। কাস্টমস-এর বড় অফিসার ছিলেন বাবা। অমন নরম, সুশ্রী, সভ্য, ভদ্র, সুগায়িকা মেয়ে আর দেখিনি। সুনন্দা পট্টনায়কের ছাত্রী ছিল। ওদের পরিবারের সঙ্গে আমি উটি, ভুবনেশ্বর, সম্বলপুর, সাতকোশীয়া গণ্ড সব ঘুরেছি।
তাহলে বিয়েটা হলো না কেন?
ওই একই কারণ।
কি কারণ?
ওই ঝাঁঝির বাবারই মতন আমার চালচুলো ছিল না। আমাকে কুমুদিনী বিয়ে করতে চায় শুনে তার প্রতিষ্ঠিত বাবাও কুমুদিনীকে তাড়িয়ে দেবেন বলেছিলেন।
তা আপনি কুমুদিনীকে নিয়ে চলে গেলেন না কেন?
গ্লাসে, গামহার একটা বড় চুমুক দিয়ে বলল, আসলে আমার সাহস কম ছিল। বেশ কম। তাছাড়া, সেই সঙ্কটে পড়ে দুটো জিনিস হৃদয়ঙ্গম করেছিলাম। দুটোই গ্রেট রিভিলেশান। জীবনে খুবই কাজে লেগেছিল। পরে।
কি? কি?
ঝাঁঝি তার দুচোখের মণি গামহার-এর দুচোখের মণিতে না-ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে রাখল এমন করে, যেন একফোঁটা চাউনিও উপচে না পড়ে যায় বাইরে।
ঝাঁঝি বলল, বলুন, কি? কি?
হারিত একটু অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ঝাঁঝির দিকে। ঝাঁঝির মধ্যে কী যেন একটা পরিবর্তন লক্ষ করছিল ও। এই গামহার ঘোষ লোকটার মধ্যে এমন কিছু আছে যাতে মেয়েরা দারুণভাবে আকৃষ্ট হয়। লোকটা ডেঞ্জারাস। লেখক-শিল্পীদের মধ্যে বেশ কিছু আছে ওরকম। গোলমেলে। এই কিছুটা যে কি? তা সিমলিপালে পৌঁছে জঙ্গলের মধ্যে গামহার ঘোষকে মশলা বেটে দেখতে হবে। সেটার উপাদানগুলিকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। বলল, হারিত মনে মনে। চলো জঙ্গলে মক্কেল, তোমার আক্কেল গুড়ুম করব। তোমার মধ্যে কী ডেবিট কী ক্রেডিট হয়ে আছে দেখব ইনসাইড আউট করে।
বললেন না, কি কি?
হ্যাঁ। বলছি।
প্রথমটা হল, ভালবাসার শেষ, প্রাপ্তিতে নয়, হারানোতেই।
চলো, হারানো আরও বোঝাব ভাল করে।
মনে মনে আবারও বলল হারিত। রাম-এর গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে।
আমি যে সত্যিই কুমুদিনীকে ভালবেসেছিলাম। ও যে বড় আদরে মানুষ হয়েছিল। ওড়িয়া সমাজে আমার চেয়ে হাজারগুণ ভাল ভাল ছেলেরা ওর জন্যে পাগল ছিল।
গামহার বলল।
কুমুদিনী তাহলে আপনাকে ভালবাসেনি আসলে?
না, না, সেও বেসেছিল বইকি। অমন ভালবাসা এ জীবনে আমাকে আর কেউই বাসেনি। জানি না, বললে তোমরা বিশ্বাস করবে কি না, তার সঙ্গে কোনরকম শারীরিক সম্পর্কই হয়নি আমার। একমাত্র হাতে হাত রাখা ছাড়া।
ন্যাকা ব্যাটা! নেকু-পুষু-মুনু! না বলে বলল, হারিত।
তাতেই যেন ইলেকট্রিক শক লাগত–ভাললাগার। ওকে ভালবেসেছিলাম আমি, ও আমাকে ভালবেসেছিল। ওর গায়িকা-সত্তা আমার শিল্পী-সত্তাকে ভালবেসেছিল। তাই ওর কষ্ট হোক তা আমি হতে দিইনি। তাছাড়া, আমাকে বিয়ে করলে ওর গান নষ্ট হয়ে যেত। বাঙালি সমাজে ওড়িশী সংস্কৃতির প্রভাব কম। সেটা আমাদেরই উচ্চমণ্যতা আর কুপমণ্ডুকতারই দোষ। নইলে অসম আর ওড়িশা থেকে আমরা অনেক কিছু নিয়ে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি-সঙ্গীতকে অবশ্যই আরও অনেক সমৃদ্ধ করতে পারতাম।
ওরা চোখ বড় বড় করে গামহার-এর কথা শুনছিল।
ব্যাঙ্কের দারোয়ান বোধহয় চৌপাইটা টানল সান-বাঁধানো বারান্দার উপরে। কর্কশ শব্দে নিস্তব্ধতা খান খান হলো। এমন সময়ে চিকরাসি ফিরল। গাড়ি থেকে নেমে এসে বলল, কী ব্যাপার! তোমাদের সকলের ঠোঁটে আঠা কেন?
আঃ চুপ করো তো। তমার ড্রিঙ্কটা নিয়ে এসে বসো। আমরা গামহারদার কথা শুনছি।
এই তো। সাব্বাস দাদা! শুরু করে দিয়েছ তোমার Spell!
চিকরাসি বলল, গামহারকে।
তারপর ঝাঁঝি আর হারিতকে বলল, তোমরা তো গামহারদার সঙ্গে বাইরে কোথাও আসোনি। ইটস অ্যান এক্সপীরিয়েন্স। তোমার প্রফেশান চুজ করাই ভুল হয়ে গেছে গামহারদা। মেয়েদের তুমি যেরকম চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে পারো তাতে তোমার কোনো গুরুটুরু হয়ে যাওয়াই উচিত ছিল। দেশে এখন প্রফেশান বলতে তো মাত্র দুটো। এক রাজনীতি আর দ্বিতীয় গুরুগিরি।
প্রফেশান চুজ করার কথাই যখন ওঠালে তখন একটা গল্প মনে এল। গল্পটা অনেককেই বলেছি আগে। বয়স হলে এক কথাই বার বার বলে সবাই একই জনকে। ভাবে, আগে কখনও বলেনি বুঝি।
চিকরাসি বলল, আমি শুনেছি কিন্তু ওরা তো শোনেনি। বলেই ফেলো আরেকবার।
এক ভদ্রলোক উদ্বাস্তু হয়ে এসেছেন রাজশাহী থেকে। বরেন্দ্র ব্রাহ্মণ। এল. এম. এফ. ডাক্তার কিন্তু খুব ভাল ডাক্তার। চার ফিট দশ ইঞ্চি হাইট। মুখে বসন্তের দাগ। ওজন দুমন। রং সেভেন্টি-এইট রেকর্ডের মতো কালো।
রাজশাহীতে অনেক মাড়োয়ারী রোগী দেখতে দেখতে চমৎকার মাড়োয়ারী বলতে পারতেন তিনি। তাই উদ্বাস্তু হয়ে এসে মধ্য কলকাতার এমন একটি জায়গাতে বাড়ি ও চেম্বার করলেন যেখানে মাড়োয়ারীদের বাস বেশি। অল্প ক’দিনেই পসার জমে গেল। তবে খাটতে হতো প্রচুর। অবসর বলতে, বিনোদন বলতে কিছুমাত্রই ছিল না।
তারপর?
যে সময়ের ঘটনার কথা বলছি, তখন উত্তমকুমারের একেবারে রমরমে দিন চলেছে। ডেট পাওয়াই মুশকিল। একদিন সেই ডাক্তার ভদ্রলোক তার ছেলেদের জিজ্ঞেস করলেন, তোরা যে উত্তমকুমার উত্তমকুমার কইর্যা লম্ফঝম্ফ করিস তা লোকটা মাসে কত রোজগার করে রে? পাঁচ হাজার টাকা হইব?
বড় ছেলে রেগে গিয়ে বলল, তুমি কও কী বাবা! আমাদের কইল্যা কইল্যা, বাইরের কাউরে যেন কখনও কইও না। মানষে শুইন্যা হাসব।
ক্যান? হাসব ক্যান?
আরে পাঁচ হাজার তো তার ঘণ্টার রোজগার।
ডাক্তার একটা ধাক্কা খেলেন জোর।
তারপর বললেন, দুসস শালা। লাইন চুজ করাই ভুল হয়্যা গিছে।
যেন উনি ইচ্ছে করলেই উত্তমকুমার হতে পারতেন!
ওরা সকলেই হো হো করে হেসে উঠল। আগে শোনা থাকলেও চিকরাসিকেও হাসতে হলো নতুন করে গামহার এর কথা বলার সরস ভঙ্গীর কারণে।
বলতে বলতে ও রাম ঢালল গ্লাসে, কোক মেশাল। তারপর এসে বসল।
জারুল বলল, তুমি দিলে রসভঙ্গ করে। বলুন তো গামহারদা, যা বলছিলেন।
বলি! কিন্তু কেমন করে বলি! আমি তো লেখক নই। আমি যে চিত্রী! রবীন্দ্রনাথের কথা ধার করে বলতে পারি ‘সংসারে মোরে রাখিয়াছ যেই ঘরে, সেই ঘরে রব সকল দুঃখ ভুলিয়া/করুণা করিয়া নিশিদিন নিজ করে, রেখে দিয়ে তার একটি দুয়ার খুলিয়া।‘ আসলে ভালবাসা যত বেশি গভীর হয় তার দুঃখও তত গভীর। ভালবাসা আর ভাললাগাতে চিরদিনই তফাৎ ছিল। ভালবাসা, ভালবাসার ধনকে না পেলেই বেঁচে থাকে চিরদিন।
আর দ্বিতীয়টা।
ঝাঁঝি বলল।
দ্বিতীয়টা বুঝিয়ে বলা একটু মুশকিল। টি. এস. এলিয়টের কথাতে বললে কি তোমরা বুঝবে?
কী কথা?
‘Time present and time past
Are both perhaps present in time future,
And time future contained in time past.’
যে যার মতো করে বুঝে নাও এখন।
চিকরাসি বলল, তাহলে কি ঠিক হলো? খাওয়া তো আধঘন্টার মধ্যে হয়ে যাবে। ড্রিঙ্কটিঙ্ক করে খাওয়া-দাওয়ার পরে সারারাত গাড়ি চালিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
ঝাঁঝি বলল হারিতকে, তুমি কিন্তু বেশি ড্রিঙ্ক করো না। ড্রাইভ করবে সারারাত। মনে থাকে যেন।
আরে না, না।
তোমার কষ্ট হবে গামহারা সারারাত জেগে বসে যেতে? “ZEN” তো আর বড় গাড়ি নয়!
আরে, জারুলের গান শুনতে শুনতে চলে যাব।
জারুল বলল, আর তুমি গান গাইবে না?
চিকরাসির ঘুম পেয়ে গেলে ঘুম তাড়াবার জন্যে গাইতে পারি।
হারিত আর ঝাঁঝি হেসে উঠল গামহারের কথায়।
জারুল আর চিকরাসি সমস্বরে বলল, হেসো না। গামহারদা কিন্তু বেশ ভাল গান করেন।
তাই? বাবাঃ। কোন গুণ নেই আপনার?
কোনো গুণই নেই। আমি ‘Jack of all trades master of none.’
বেরোতে বেরোতে সাড়ে এগারোটা হয়ে যাবে।
কটা বাজে এখন?
পৌনে দশটা।
আমি আর পনেরো মিনিট পরে গিয়ে ধাবা থেকে খাবারটা নিয়ে আসি।
চালাতে চালাতে চোখ লেগে গেলে গাড়ি রাস্তার ধারে লাগিয়ে ঘুমিয়ে নেবে। তখন কিন্তু একদমই চালাবে না গাড়ি।
চিকু বলল, হারিতকে।
আরে জানিরে বাবা জানি। হোল-নাইট ড্রাইভ কি করিনি না কি? একসময়ে র্যালি করতাম তা কি জানো?
ফাস্ট রেসিং?
গামহার জিজ্ঞেস করল।
না না, এনুড্যুরেন্স র্যালি। চব্বিশ ঘন্টায় কলকাতা থেকে দিল্লি। রাতে রেস্ট। পরদিন দিল্লি-বম্বে। তার পরদিন বম্বে-মাড্রাস এবং তার পরদিন মাড্রাস-ক্যালকাটা। আমরা সেকেন্ড হয়েছিলাম।
আমরা মানে?
আমরা মানে বিশ্বজিৎ ইন্দ্রজিৎ ছিল। গুহ ব্রাদার্স।
ননীও।
মানে? কোন ননী?
ননীগোপাল চন্দ। এখন পাকপাড়ার রানীর বেয়াই। এই তো সেদিন বিয়ে হলো। রূপোর মিনিয়েচার কুলোতে নেমন্তন্নর চিঠি করেছিল। দেখার মতো। সারা কলকাতা শহরেরই নেমন্তন্ন ছিল।
রানী কে? রীতা? দেবাশিস সিনহার স্ত্রী তো।
হ্যাঁ। ও আপনি চেনেন?
চিনতাম বইকি। অল্প বয়সে দুম করে চলে গেল। রীতা তো নর্থ ক্যালকাটা রাইফেল ক্লাবে রাইফেলও ছুঁড়ত। ন্যাশনালেও গেছিল। তাই না?
হ্যাঁ। আপনি তো সবই জানেন দেখছি।
ঐ ক্লাবে আমার কিছু চেলা আছে। তাদের মাধ্যমেই চিনতাম।
আপনি ক্ষেপুখেনু ‘ক্লাব’-এ যান কি? আপনাকে তো কখনও দেখিনি!
না আমি যাই না।
কেন?
ভাল লাগে না। তাছাড়া আমি পায়জামা-পাঞ্জাবি পরি। তা পরে তো যাওয়া বারণ। কিছু মানুষ মূর্খের স্বর্গে বাস করে প্রকৃত মূর্খজনোচিত আনন্দ ও শ্লাঘা বোধ করেন। তাদের আহ্লাদ নিয়ে তারা থাকুন। বকমধ্যে হংস হতে যাবই বা কেন? এ সব ক্লাব-এর চেয়ে অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশনও ভাল। মেম্বারদের সঙ্গে সাহিত্য, সঙ্গীত, ছবি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা যায়। ওইসব ক্লাবের অধিকাংশ মেম্বারই তো বড়লোক বাবার ঢ্যাঁড়শ ছেলে। নিজেরা জীবনে করেছেটা কি?
আপনি কি কখনও Black-balled হয়েছিলেন? এত রাগ কেন? দ্রাক্ষাফল টক?
Apply করলে তো Black-balled হবার প্রশ্ন! আমার কি ল্যাজ গজাবে সেখানের মেম্বার হলে?
হারিত বলল, যাই বলল চিকু, গামহারদা একজন ওরিজিনাল মানুষ।
তা ঠিক। কলকাতা শহরটাই ভরে গেছে প্রোটোটাইপ-এ আর দুনম্বরীতে।
অত সব জানি না। আমি আজেবাজে মানুষের সঙ্গে মেশার চেয়ে ভাল গান শুনতে, ভাল বই পড়তে ভালবাসি। ছবি আঁকি নিজের মনে। চানঘরে গান গাই। মেশার মতো মানুষ নইলে মিশে লাভ কি?
তা ঠিক। দু-ঠ্যাঙে মাত্রই তো আর মানুষ নয়।
চিকু বলল।
আমি পুরনো দিনের মানুষ। কত ‘কল্লোল-যুগ’ ‘কৃত্তিবাস-যুগ’ হেজে-মজে গেল। রবীন্দ্রনাথ, লেসার মটালসদের সব নিন্দামন্দ সত্ত্বেও এখনও রবীন্দ্রনাথই। কোনো বিকল্প হয়নি আজ অবধি। হবে কি না, তাও জানি না। এখনও তিনি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। মৃত্যুর পরে পাঁচ যুগ পেরিয়ে এসেও।
বলেই, আবৃত্তি করল গামহার,
‘প্রলয় সৃজন না জানি এ কার যুক্তি
ভাব হতে রূপে অবিরাম যাওয়া আসা
বন্ধ ফিরিছে খুঁজিয়া আপন মুক্তি
মুক্তি মাগিছে বাঁধনের মাঝে বাসা।‘
.
আমরাই তাহলে আগে যাচ্ছি?
যেমন বলবে।
তাই যাও। হারিত বলল, চিবুকে।
হারিত একটু বেশি রাম খেয়ে ফেলেছে মনে হল। আন্ডা-তড়কা আর চিকেন-ভার্তা দিয়ে রুটিও কম খায়নি। স্বাস্থ্যও খুব ভাল হারিতের। তাছাড়া রীতিমতো সুদর্শন। ফ্রেঞ্চকাট দাড়িসমেত ‘মড’ চেহারা। প্রাইস ওয়াটারহাউসের রূপেন রায় রূপেন রায় দেখতে অনেকটা, তবে রূপেনের চেয়ে অনেক লম্বা এবং ওয়েল-বীল্ট হারিত। দেখে মনে হয় না চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, মনে হয়, ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইনস-এর পাইলট বুঝি।
কতরকম মুহুরীই যে আছে! ভাবছিল গামহার। ছেলেবেলাতে মুহুরীদের দেখেছে ধুতির সঙ্গে হাতের বোতাম না-আটকানো ফুল শার্ট পরতে আর লাগাতার নস্যি নিতে। তাদের একেকজনের হাতের লেখার রকম আবার আলাদা আলাদা ছিল হিগলোগ্রাফির মতো। নিজস্ব হরফ উদ্ভাবন করতেন একেকজনে, পাছে তার হাতের লেখা ইনকাম-ট্যাক্স বা সেলস-ট্যাক্স অফিসারের সামনে অন্য কোনো মুহুরী পড়ে দিয়ে তার চাকরিটি খেয়ে দেয়। মালিককে তাঁবে রাখার ওই একটা উপায় ছিল মুহুরীবাবুদের, মালিকদের যেমন ছিল অজস্র, তাঁদের তাঁবে রাখবার।
ভাবছিল গামহার, হারিতও একজন মুহুরী আর গামহারদের পাশের বাড়ির তেলকল- ধানকলের মালিক হরিপদ খাঁ-এর কর্মচারী প্রসন্নবদনও মুহুরীই ছিলেন অথচ দু’যুগের দুই মুহুরীর মধ্যে কত তফাৎ। প্রসন্নবদন দলুই-এর কোনো ডিগ্রী-টিগ্রী ছিল না। হারিত এম. কম এবং চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। প্রসন্নবদন খেতে পেতেন না, হারিতের সল্টলেক-এ বাড়ি, মারুতি এস্টিম গাড়ি, সে ‘ক্ষেপুখেনু’ ক্লাবের মেম্বার। তাকে দেখলে এবং তার কথাবার্তা হাবভাব দেখলে মনে হয় তার জীবনে সবই পাওয়া হয়ে গেছে। মনুষ্যজীবন কানায় কানায় সার্থক। মানুষ অথবা ঈশ্বর কারো কাছেই চাইবার কিছুমাত্রই আর নেই।
যুগ ও কাল সত্যিই পাল্টেছে। গামহারদের যুগ শেষ হয়ে গেছে। সত্যিই যুগান্তর ঘটেছে সবকিছুর। যুগান্তরই নয়, এখন তো নতুন শতাব্দীরও মুখোমুখি এসে পৌঁছল ওরা। যন্ত্রপাতি, ইনফরমেশন-টেকনোলজি সবেতেই অভাবনীয় সব পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে মানুষের চেহারায়, সাজ-পোষাকে। তার চেয়েও বেশি এসেছে ধ্যান-ধারণাতে, চাওয়া-পাওয়ায়, মানসিকতাতে এবং চরিত্রে। মানুষের সঙ্গে গাড়ির শক-অ্যাবসরবার বা কম্প্যুটারের ফ্লপির তফাৎ নেই আর কোনো। কথা ছিল যে, বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি যন্ত্রকে দাস বানিয়ে মানুষকে সম্রাট বানাবে। বিজ্ঞান, মনে হয়, মানুষকে শিব গড়তে গিয়ে বাঁদরই গড়ে ফেলল। মানুষ শিব হলো না বাঁদর, তা আর কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা যাবে।
কী হল গামহারদা? ঘুম পাচ্ছে না কি?
চিকু বলল, গাড়ি চালাতে চালাতে।
নাঃ।
তবে? একেবারে চুপচাপ কেন!
ভাবছি।
কী এতো ভাব বলো তো সবসময়।
তাই তো। কত কী। কেটে-যাওয়া ঘুড়ির মতো ভাবনা আমার ভেসে যায় নিরুদ্দেশে। কারো কাছে জবাবদিহির দায়িত্ব নেই। তুমিও জবাবদিহি চেও না।
একজনের ভাবনা অন্যে দেখতে পেলে বেশ হতো। না?
জারুল বলল, পেছন থেকে।
তা হতো। তবে তা বেশ না হয়ে বিপদ ডেকে আনতে পারত নানারকম।
গামহার-এর এই কথাতে ওরা তিনজনেই হেসে উঠল একইসঙ্গে।
গামহার বলল, একটা গান শোনাবে নাকি জারুল।
আমার গান আর কি শুনবেন, জঙ্গলে পৌঁছে ঝাঁঝির গান শুনবেন। চণ্ডীদাস মালের কাছে পুরাতনী গানের তালিম নিচ্ছে। নিধুবাবু, শ্রীধর কথক, গোপাল উড়ে, গিরীশ ঘোষ, বর্ধমানের মহারাজা আরও কত জনের গান যে তুলেছে কী বলব! আশ্চর্যময়ী দাসী, আঙুরবালা, গহরজান, ইন্দুবালা এঁদের নানা পুরনো রেকর্ড থেকেও অনেক গান তুলেছে। সেসব গান শুনলে অবাক হয়ে যাবেন।
সে কি! ঝাঁঝি না ছায়া সেনের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখত।
চিকু বলল অবাক হয়ে।
তা শিখত। তবে কবে ছেড়ে দিয়েছে।
কেন?
হারিতও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখছে ছায়া সেন-এর কাছে। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়াই ঝাঁঝি ছেড়ে দিয়েছে।
চিকু বলল, সে কি! এ যে চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়া। বেচারী রবীন্দ্রনাথ কি দোষ করলেন! বা ছায়া সেন?
আঃ তুমি একটু চুপ করবে। চিকুকে বকে বলল জারুল।
চাঁদটা উঠেছে। দু’পাশের মাঠপ্রান্তর কী চমৎকার দেখাচ্ছে! জঙ্গলও।
আমি ছিন-ছিনারি দেখলে গাড়িকে কে দেখবে?
কোথায় চুপ করে দেখবে না বকর বকর করেই চলেছ।
আমরা বিসোই-এর ঘাট-এ পৌঁছব কখন?
দেরি আছে। বঙ্গভূম ছেড়ে লাল্লুভূমে পড়েই বেশ কয়েক কিমি পথের এমনই অবস্থা যে মনে হবে চাঁদে বাইচুং চাষ করছ।
শব্দটা বাইচুং না ভাইচুং। প্রথমটি ভাইচুং ফুটবলার, দ্বিতীয়টি তাইচুং ধান।
ওই হলো।
সামনের ওই রাস্তাটুকুর নাম গিনেস বুক অফ রেকর্ডস-এ অবশ্যই উঠতে পারে। দৈত্যর মতো মার্সিডিস ট্রাকগুলো পর্যন্ত হালে পানি পায় না আর আমার তো মারুতি জেনই। রাজপথেরই মধ্যে এমন পথ-ভোলানো ব্যাপার-স্যাপারের কথা ভাবাই যায় না।
তবে কী হবে?
উদ্বিগ্ন গলাতে বলল জারুল।
“যা হবার তা হবে। যে আমারে কাঁদায় সে কি অমনি ছেড়ে রবে?/পথ হতে যে ভুলিয়ে আনে পথ যে কোথায় সেই তা জানে,/ঘর যে ছাড়ায় হাত সে বাড়ায় – সেই তো ঘরে লবে।”
চিকু বলল।
জারুল বলল, এটা কার কবিতা? তুমি কটা হুইস্কি খেয়েছ? থুরি, রাম? কবিতা আওড়াচ্ছ যে বড়! কোন কবির এতো সৌভাগ্য?
সরি। এটা গান। রবি ঠাকুরের। সৌভাগ্য না বলে দুর্ভাগ্য বলো। নইলে চিকুতে গান গায়? তোমরা তো সব রিমেক আধুনিকের আর্টিস্ট। রবিঠাকুরকে তোমরা তথাকথিত শিক্ষিতরা দল বেঁধে ছাড়লে বলেই তো পীযুষকান্তির মতো কুমীরেরা এসে তাকে ঠ্যাং কামড়ে ডোবাতে ডুবিয়ে মারার মতলব করেছে।
গানটা জানেন গামহারদা?
না।
তবে অন্য একটা গান করুন।
প্লীজ! চিকুর এই ভ্যাজভ্যাজানি আর সহ্য হচ্ছে না।
গামহার ধরে দিল বিনা ওয়ার্নিং-এ ‘তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে তখন ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে।’
গামহারের গান গাওয়া শেষ হলে জারুল বলল, হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ! কী সুন্দর ভাব আপনার গলাতে, কী দারুণ গলা। গান শেখাবেন আপনি আমাকে?
স্টুডিওর দরজা বন্ধ করে নগ্না মডেলদের কী শেখান গামহারদা তা তিনিই জানেন। দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পরও তুমি কি শুধু গানই শিখবে?
অন্য অনেক কিছুই শিখতে পারি। সেটা আমার ব্যাপার। সীরিয়াস কথার মধ্যে ইয়ার্কি আমার ভাল লাগে না।
সীরিয়াসলি বলছি গামহারদা। শেখাও না জারুলকে রবীন্দ্রনাথের গান। রুচিটা ভাল হয়ে যাবে।
রুচি তুলে কথা বলবে না চিকু। মানা করছি।
গামহার ওদের ঝগড়া বন্ধ করার জন্যে ধরে দিল হঠাৎ ‘ও যে মানে না মানা, আঁখি ফিরাইলে বলে, না, না, না।/যত বলি নাই রাতি – মলিন হয়েছে বাতি/মুখপানে চেয়ে বলে, না, না, না।/বিধুর বিকল হয়ে খেপা পবনে/ফাগুন করিছে হা-হা ফুলের বনে।/আমি যত বলি তবে এবার যে যেতে হবে/দুয়ারে দাঁড়ায়ে বলে, না, না, না।’
তারপর বলল, গানের বাণী শুনলে? রবীন্দ্রনাথের গানের কথাই শুনবে? না সুর। কথা ও সুরের মধ্যে এমন সুষম প্রতিযোগিতা সম্ভবত আর অন্য কোনো গানেই পাবে না। এমন বসন্তের মধ্যরাত, চাঁদে ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী, চলেছ এমন চাঁদ-চকচক বনের মধ্যে দিয়ে আর এখনই কি তোমাদের খুনসুটি করার সময়! ছিঃ। চুপ করো দু’জনেই।
জারুল বলল, সত্যি। কী সুন্দর কথা আর কী দারুণ সুর। এটাও কি রবীন্দ্রসঙ্গীত?
হ্যাঁ। বাঙালি হয়েও রবীন্দ্রনাথকে পড়লে না, তার গান গাইলে না, তোমরা সত্যিই জানো না তোমরা কি হারালে।
এইবার দেখো, আরম্ভ হলো লাজী কি খেল। বিহারে পড়েছি আমরা।
চিকু বলল। গামহার কী বলল তা না শুনেই।
এ কী! এই পথ দিয়ে যেতে হবে আমাদের? একে কি পথ বলে। বলল গামহারদা? জারুল বলল আতঙ্কিত গলায়।
গত বছর আমাদের ওয়েস্ট-বাংগালকি রাস্তা এর চেয়েও খারাপ ছিল। অসীম দাশগুপ্ত ক্ষিতি গোস্বামীকে বে-ইজ্জৎ করার জন্যে টাকা ছাড়ছিলেন না, তাই বেচারী পূর্তমন্ত্রী গভীর খাদে ছিলেন। নিজে উঠবেন তবে না রাস্তা মেরামত হবে। এতদিনে হয়েছে।
জারুল বলল, এবারে চুপ করে গাড়িটা চালাও। জানি না, এ পথ পেরোবে কী করে। খুব মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাও। উল্টো থেকে লাইন দিয়ে আসা ট্রাকগুলোর হেডলাইটে চোখ যে ঝলসে যাচ্ছে। কিছু একটা করা যায় না?
চিকু বলল, মাইক স্যাটো, ফাস্ট রেসিং-এর ড্রাইভার একজায়গাতে লিখেছিলেন, উল্টোদিকের হেডলাইট থেকে নিজের চোখ এবং গাড়ি বাঁচাবার ফর্মুলা।
কি?
‘ডোন্ট লুক অ্যাট দ্যা হেডলাইট। ডোন্ট লুক অ্যাট দ্যা হেডলাইট। ডোন্ট লুক অ্যাট দ্যা হেডলাইট।’ শুধু তোমার বাঁদিকে কতটুকু জায়গা আছে তা দেখে চোখ নামিয়ে গাড়ি চালাও।
বাঃ।
বেশ কিছুক্ষণ তটস্থ হয়ে সোজা বসে থেকে ওই পথটুকু পেরিয়ে বহড়াগড়ার দিকে যখন গাড়ি এগোল তখন গামহার বলল, মনে হলো যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ।
বহড়াগড়াতে একটু চা খাবার জন্যে দাঁড়াবে নাকি? হারিত যতগুলো রাম খেল, একটা কাণ্ডই না বাধায়।
মন্দ বলোনি। চা খাবার সঙ্গে সঙ্গে ওর অবস্থাটাও একটু চেক করে নেওয়া দরকার। হাওয়া ঠিক আছে কি নেই!
গাড়ির চাকার হাওয়া?
আজ্ঞে না। হারিতের।
চলো, বহড়গড়ার মোড়ে দাঁড়াব ধাবাতে।
তারপরে কোন কোন জায়গা পড়বে?
বহরাগড়াতে গিয়ে পথের একটা হাত ডানদিকে চলে গেছে ধলভূমগড়, ঘাটশিলা, টাটা, বু হয়ে রাঁচী। আর সোজা পথটি গেছে বম্বে। ওড়িশা এবং আরও নানা রাজ্য পেরিয়ে। বাংরিপোসির আগে ন্যাশনাল হাইওয়ে ফাইভ আর সিক্স মিলেছে…
বাংরিপোসি! নামটা চেনা চেনা লাগছে যেন।
জারুল বলল।
গামহার বলল, ‘বাংরিপোসির দু রাত্তির’ নামের একটা উপন্যাস আছে। ইন ফ্যাক্ট, শুনেছি যে ওই উপন্যাসটিই বাংরিপোসিকে এক বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পটে পরিণত করেছে।
কার লেখা?
জারুল জিজ্ঞেস করল।
জারুলের কথার উত্তর না দিয়ে চিকু বলল, ওরা তো আবার চিন্তায় ফেলল।
কারা?
আরে হারিতরা।
কেন?
পিছনে তো ওদের দেখছি না। কোনো মার্সিডিস ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি ভিড়িয়ে দিল না তো!
উদ্বিগ্ন হয়ে বলল জারুল।
খারাপ রাস্তাতে কখনও অ্যাকসিডেন্ট হয় না। প্রত্যেক ড্রাইভারই তখন তীব্র তীক্ষ্ণ সজাগ থাকে। রাতের বেলা অ্যাকসিডেন্টের ভয় দারুণ থাকে ভাল রাস্তাতে। কখন সে চোখ জুড়ে আসে তা আগের মুহূর্তেও বোঝা যায় না। আর সেই ঘুমই চিরঘুম হয়ে যায়। চলল তো, চায়ের অর্ডার দিই। আশা করি এসে যাবে।
আসবে না তো যাবে কোথায়?
চিকু বলল।
গামহার ঝাঁঝির মুখটিকে মনে করল। ওর মুখটি যেন কোনো দূরের নদীর হাঁসুলি বাঁক। জলজ গন্ধ মাখা তার ঠোঁটদুটিতে, বুনো হাঁসের ডানার আঁশটে গন্ধ, আর তলপেটের মসৃণ নরম পালকের ওম। মনে মনে বারবার আঁকল বারবার মুছল সেই মুখের ছবিটি কিন্তু তবু ঠিকঠাক সেই মুখের ভাবটি কিছুতেই ফুটল না। কখন যেন চুরি হয়ে গেছে।
গামহার ভাবল, এবার ওরা এসে পৌঁছলে অনেকক্ষণ এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ঝাঁঝির মুখটার ছবি নিজের চোখের তারাতে জলছবির মতো সেঁটে নেবে।
দেখতে দেখতে হারিতরা এসে পড়ল।
বলল, এক ব্যাটা ট্রাক কিছুতেই সাইড দেবে না। হর্ন দিয়ে দিয়ে আঙুল ব্যথা হয়ে গেল। সে জন্যেই দেরী হয়ে গেল।
চা খাওয়ার সময়ে দেখা গেল হারিত একেবারে Fit as a fiddle! ঝাঁঝিও নামল গাড়ি থেকে। বলল, বাবাঃ, পা দুটো একটু ছাড়িয়ে নিই। ধরে গেছে একেবারে।
চিকু বলল, পা টিপে দেব?
অসভ্য।
বলল ঝাঁঝি।
মেয়েরা এই ‘অসভ্য’ শব্দটা যে কত কীই বোঝাতে ব্যবহার করে, তা বলা যায় না। বিরাট রেঞ্জ।
হারিতের ইচ্ছে করল ঝাঁঝির পা-টা সত্যি সত্যিই টিপে দেয় একটু।
চুপ করে ঝাঁঝির মুখের দিকে চেয়ে রইল গামহার। ছবিটার যেখানে যেখানে রঙ ফিকে হয়ে গেছিল, অদৃশ্য কল্পনার তুলি দিয়ে সেখানে সেখানে রঙ লাগিয়ে দিল। ঝাঁঝিকে আজ সন্ধে থেকে গামহার একজন চিত্রীর চোখ দিয়েই দেখছে। যে চোখের কথা শুধু আর্টিস্টরাই জানেন।
চা খাওয়ার পরে চিকুরাই এগিয়ে গেল। যেমন গ্রীনফিল্ডস ছাড়ার পর থেকেই এগিয়েছিল। ঝাড়ফুকুরিয়ার মোড় হয়ে বাংরিপোসি হয়ে বিসোই-এর ঘাটে উঠতে লাগল গাড়ি। পাহাড়ের উপরে ঘুরে ঘুরে উঠেছে পথ। ডানদিকে একটা মন্দির পড়ল। চিকু গাড়ি থামিয়ে সেখানে পুজো দিতে গেল।
গামহার বলল, চিকু এসব মানে নাকি?
ও তেমন মানে না। তবে একেবারে মানে না যে তাও নয়। কিন্তু হারিত বার বার করে বলে দিয়েছে এই বাংরিপোসির ঠাকুরানি নাকি খুবই জাগ্রত। পুজো না দিলে অ্যাকসিডেন্ট হবেই।
জারুল বলল।
তাই? ইনফোটেক এক্সপার্ট আর চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদেরও এতো কুসংস্কার।
কুসংস্কার এমনই একটা ব্যাপার গামহারদা যে, It runs in the blood. বাইরের ইংরেজিয়ানাতে ভিতরের এইসব ব্যাপারগুলো আনএফেক্টেড থাকে। তবে আমি বাধা দিই না। আমি নিজে বিশ্বাস করি না বলেই আমার অবিশ্বাস জোর করে কারো উপরে চাপাব কেন? সেই অধিকার তো আমাকে কেউ দেয়নি। যে যা ভাল মনে করবে, করবে। এসব জিনিস এতই ব্যক্তিগত যে এতে কোন জোর চলে না। চালানো উচিতও নয়।
তা অবশ্য ঠিকই।
চিকু পুজো দিয়ে এল। তারপর গাড়ি স্টার্ট করল।
বিসোই জায়গাটা একটা মালভূমির মতো। সমতল। দুপাশে বন। ভারী ভাল লাগল গামহার-এর।
এগুলো কি গাছ জারুল? চাঁদের আলোতে চকচক করছে পাতা।
এগুলো সব শালগাছ। চলুন সিমলিপালে। আপনাকে গাছ চেনাবো। পাখি চেনাবো।
বেশ। মানুষ চেনার চেয়ে গাছ পাখি প্রজাপতি চেনা অনেকই ভাল, তাই না? তবু মানুষকে যদি চেনা যেত নিশ্চিত। মানুষকে হাড়ে-হাড়ে চেনার চেয়ে এদের চেনা হয়তো অনেক সহজও। তাই না?
তারপরই বলল, ঝাঁঝিও কি গাছটাছ চেনে? তোমার মতো?
চেনে কিছু কিছু হয়তো। তবে ওরা তো আমাদের দুজনের মতো জঙ্গলের পোকা নয়। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘোরে না। এই রাস্তা দিয়ে একবার রাইরাংপুরে গেছিল নাকি, তাই বিসোইর ঘাটটা চেনে। ওরাও তো এই প্রথমবার যাচ্ছে সিমলিপালে। তবে ঘাটশিলা যায় প্রায়ই। বহড়াগড়া অবধি তো রাস্তা একই। তাই গ্রীনফিল্ডস-টিল্ডস চেনে। ঘাটশিলাতে ওদের একটা বাড়ি আছে একেবারে সুবর্ণরেখার উপরে।
তাই? তা ঘাটশিলাতে তো বিভূতিভূষণের ডেরা ছিল। ধারাগিরি পাহাড়। সেখানের জঙ্গল দেখেনি ওরা?
হাঃ। ওদের এসব ব্যাপারে ইন্টারেস্ট তো নেই। ঝাঁঝির কথা বলতে পারব না। তবে হারিতের নেই। যখন যায়, তখন খায়, ড্রিঙ্ক করে, তাস খেলে, ঘুমোয়। নিজেকে আনওয়াইন্ড করতেই যায়। এ পর্যন্ত ধারাগিরিতেও নাকি যায়নি একবারও। তবে হারিত এখানে Stag-Party নিয়েই আসে। ঝাঁঝি বিশেষ আসে না। দু’জনের মধ্যে অনেকই অমিল। ঝাঁঝি খুব গভীর মেয়ে। ও যে সুখী নয় আদৌ, তা বোঝা যায়।
গামহার বলল, সংসারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সুখী আর ক’জন মানুষ? তাছাড়া অধিকাংশ সুখী মানুষেরাই স্থূল হয়, সাধারণ হয়। সুখ সকলকে মানায়ও না।
অন্য অ্যাকাউন্ট্যান্টরা, ওর বন্ধুস্থানীয়, ইনকাম ট্যাক্সের কমিশনাররা আসেন বলে শুনেছি ওর সঙ্গে। ওঁরা নির্মল প্রশ্বাস নিয়ে যান আর কী। গাছপালা পাখিতে তো সকলের ইন্টারেস্ট নেই।
.
০৪.
আধঘণ্টার মধ্যে ওরা গভীর জঙ্গলের মধ্যে চলে এল। এখন রাস্তা চমৎকার। চওড়া এবং মসৃণ। চাঁদের আলো দুপাশের জঙ্গলে যেমন চকচক করছে মনে হচ্ছে পথের উপরে যেন আলোছায়ার ডোরাকাটা সতরঞ্জি বিছিয়ে দিয়েছে কেউ।
আপনি আর্টিস্ট, আপনার ভাবনাচিন্তা অন্যরকম। আমি সাধারণভাবে কথাটা বলেছিলাম।
গামহার এককলি ওড়িয়া গান গেয়ে উঠল, ‘ওরে মোর সজনী ছাড়ি গল্বা গুণমনি/কা কর ধরিবি?’
বাঃ। জারুল বলল।
মানেটা তো বলবে। আমরা কি ওড়িয়া জানি?
চিকু বলল।
মানে হলো, ও আমার প্রিয়া, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে, আমি কার হাতে হাত রাখব এখন?
বাঃ। ভারী সুন্দর হতো।
তোমার কাছে সুন্দর। যার প্রিয়া ছেড়ে গেল তার পক্ষে প্রাণান্তকর।
হেসে বলল, গামহার। ওরাও হেসে উঠল।
ওড়িশার রাস্তা দেখেছ গামহারদা? গত সপ্তাহে চারমল-এর জঙ্গলে গেছিলাম ঝাড়গুদা থেকে সম্বলপুর হয়ে। একটা রাস্তা বানিয়েছে ওড়িশা সরকার রাউরকেলা থেকে সম্বলপুর, দুশো কিমি, দেখার মতো। সব গাড়ি ও বাস থেকে টোল নিচ্ছে। কয়েক বছরের মধ্যেই খরচা উঠে আসবে। সেই পয়সাতে আবার অন্যত্র রাস্তা করা যাবে। ও রাজ্যে সেন্ট্রাল রোডওয়েজ করপোরেশনের পথঘাটও বেশ ভাল।
আমাদের পশ্চিমবঙ্গে এমন করা যায় না?
আমি কী করে বলব বলল। এম এল এ-দের বলো, মন্ত্রীদের বলো। পশ্চিমবঙ্গে যা করা সবচেয়ে সোজা তা হচ্ছে নাম বদল। এতোদিনের ওল্ড বালিগঞ্জ রোড হয়ে গেল, আশুতোষ চৌধুরী অ্যাভিন্যু।
তিনি কে? কোনো বড়লোক অবশ্যই।
শুনেছি প্রমথ চৌধুরীর দাদা, যিনি ছোটভাই-এর সঙ্গে কমপিটিশনে নেমে নাকি হেরে গেছিলেন।
কোন প্রমথ চৌধুরী? বীরবল?
ইয়েস!
কিসের কমপিটিশন?
ইন্দিরা দেবীকে বিয়ে করার।
স-ও-ও-ত্যি, বলে বড় হেঁচকি তুলল একটা জারুল।
সত্যি ।
ড্যালহাউসি স্কোয়ার যে বিবাদী বাগ হলো, আজকালকার ছেলেমেয়েরা তাকে জানে বাদী-বিবাদীর বিবাদী বলেই। কে যে বিনয়? কে যে বাদল? আর কে যে দীনেশ তা কি তারা জানে?
তাও ভাল যে, লেনিন-স্ট্যালিন মার্গ হয়ে যায়নি নাম।
বলা যায় না, এখনও হতে পারে যে-কোনো দিন।
তা অবশ্য ঠিক।
একটু দাঁড়িয়ে, চাঁদনি রাতের জঙ্গলের ছিনছিনারী একটু ভাল করে দেখে গেলে হতো না? চাঁদনি রাতের জংলী রূপ।
এখানে কি দাঁড়াবে গামহারদা? জঙ্গলের রূপ দেখাতেই তো তোমাকে নিয়ে এসেছি এবার। এই মহিলার প্রেমে তুমি একবার পড়লে আর কোনো মহিলাকেই চোখে ধরবে না।
চিকু বলল।
কার প্রেমে? ঝাঁঝির?
অন্যমনস্ক হয়ে-যাওয়া গামহার বলল।
জারুল আর চিকু একসঙ্গে জোরে হেসে উঠল।
চিকু বলল, তুমি ঝাঁঝির প্রেমে পড়েছ মনে হচ্ছে।
গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে গামহার বলল, ঠিক প্রেম নয়। Artist’s Interest। ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না। তাছাড়া প্রেমে পড়লেই বা কি? প্রেম কি দোষের? একেবারেই দোষের নয়।
আমার তো মনে হয় প্রেম একটা আঙ্গিক যা নইলে ব্রহ্মা জগন্নাথ হতেন। তাছাড়া, গামাদা তোমাকে বলি, হারিত, প্রেম যে কাকে বলে, তা আদৌ বোঝে না। ঝাঁঝি মেয়েটা ভীষণই লাভ-সিক। সর্বার্থে। Artist’s Material হিসেবে আইডিয়াল।
বলেই, হাসল চিকু।
হারিত বুঝি ভীষণ আনরোম্যান্টিক। জানি না, সব অ্যাকাউন্ট্যান্টরাই কি এমন হন?
বাঃ। তা হবে কেন? বেরসিক সব প্রফেশনেই থাকে। অধ্যাপক, গায়ক, এঞ্জিনীয়ার, ডাক্তার। জেনারালাইজ করা যায় না কখনওই অমন করে।
তুমি যদি আধমরা হয়ে থাকো তো ঝাঁঝির গান শুনলে যে একেবারেই মরবে। মরে ভূত হয়ে যাবে। বাঁচার কোনো পথই থাকবে না।
জারুল বলল।
মরতে দুঃখ নেই। যদি তেমন মরণ হয়।
কটা হলো, রাত এখন? দেখো তো তোমার ঘড়িটা।
চিকু জিজ্ঞেস করল জারুলকে।
দুটো। ঠিক দুটো।
বাঃ। ভাবতেই ভাল লাগছে। বহু বছর বাদে এমন সারারাত গাড়ি চালিয়ে কোথাও চলেছি। আগে তো রাতেই বেরোতাম খাওয়া-দাওয়া করে। এখন ল অ্যান্ড অর্ডার। সিচুয়েশন যা।
ওড়িশা কিন্তু সেফ।
তাই?
আমরা সাড়ে-চারটে পাঁচটা নাগাদ যোশীপুরে পৌঁছে যাব। যদি চা খেতে চাও গামহারদা তবেই যোশীপুরে যাব নইলে আগেই আমরা ঢুকে যাব জঙ্গলে বাঁ দিকের পথ দিয়ে।
বলল, জারুল।
বাঃ! যযাশীপুরে তো যেতে হবেই ফরেস্ট অফিসে। পাস নিতে হবে না? আমাদের রিসার্ভেশন তো ফোনে করা আছে। সেখানে কোনো গণ্ডগোল হলেই কেলো।
ও তাই তো! ভালই হলো তাহলে। গরম গরম চা-সিঙ্গাড়া খেয়েই যাওয়া যাবে চাহালাতে।