আয়না
বিজ্ঞানমনস্ক সাংবাদিক অনিরুদ্ধ অফিসে খুবই পরিচিত ব্যক্তিত্ব। সবাই ওকে ভালবাসে। ওর বলিষ্ঠ সাংবাদিকতা অফিসের সবাই খুব পছন্দ করে। ওর নির্ভীক সাংবাদিকতার জন্য সরকারের তরফেও পুরস্কৃত হয়েছে।
ইদানিং খুবই ব্যস্ত একটা সংবাদের ব্যাপারে। ও একটা সিরিজ করতে চাইছে। পরপর কয়েকটা এপিসোড ধারাবাহিকভাবে চালাতে চায়, ওর সংবাদপত্রে।
ওর সংবাদ পরিবেশনের উপর অফিসের সর্বময়কর্তা রামচন্দ্রবাবুও ভরসা করেন। যেখানে যেতে চায় রামচন্দ্রবাবু এক কথায় রাজি হয়ে যান। সমস্ত খরচখরচা উনিই দেন অনিরুদ্ধকে।
এবার অনিরুদ্ধের গন্তব্য হল এমন একটা জায়গা যেখানে লোকজন যাতায়াত করতে ভয় পায়। দিনের বেলাতেও অনেকেই সেখানে যেতে চায় না। মানে যেতে ভয় পায়। বেশ কয়েকটা জায়গা নিয়ে ওর লেখা ইতিমধ্যেই সংবাদপত্রে বেরিয়েছে এবং খুব সাড়া ফেলে দিয়েছে।
এবার ও যে জায়গায় গেল তা হলো কলকাতার কাছেই একটি মফস্বল শহর। মফস্বল হলেও বেশ ঘনবসতিপূর্ণ। অনেক রাত অব্দি লোকজন রাস্তায় চলাচল করে। ঘন ঘন লোকাল ট্রেন এবং এক্সপ্রেস ট্রেনের হুইসেল বা আওয়াজ শোনা যায়।
প্রথম দিন বিকেল বিকেল ও চলে গেল। কাছাকাছি একটি জায়গায় রাত্রিবাস করবার সিদ্ধান্ত নিল। ওখানে নিজের জিনিসপত্র রেখে ও রাস্তায় বের হল একটু পায়চারি করতে। সে সময় ও সবার থেকে বাড়িটা সম্পর্কে খোঁজ খবর নিল। ওর মনের মধ্যে একটা জেদ চেপে গেল।
রাত তখন সাড়ে দশটা হবে। ও রাতের খাবার খেয়ে একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে রওনা দিল বাড়িটার উদ্দেশ্যে। ও ধীরে ধীরে পায়চারি করতে করতে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালো। বাড়িটা একটা সময় কোন রাজবাড়ি ছিল। বর্তমানে ইতিহাসের সাক্ষী। বাড়িটা দেখলে মনে হয় প্রায় শ’খানেক বছর আগে তৈরি হয়েছিল। বাড়ির বাইরের দেয়াল থেকে প্লাস্টার খসে পড়েছে। মনে হচ্ছে যেন দাঁত বের করে হাসছে।
এদিক ওদিক থেকে বটের ঝুরি নেমে এসেছে। ঝুরিগুলি বাড়িটিকে মনে হচ্ছে চারিদিক থেকে জড়িয়ে রেখেছে। অনেক খুঁজবার পর বাড়ির দরজাটা পেল। বাড়িটা অন্ধকার। ও সাথে করে একটা টর্চ লাইট নিয়ে এসেছে। সেটা জ্বালাতেই বাড়িটার চারদিকে যে অন্ধকার ছিল তা কেটে গেল। চারিদিক এখন আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত।
তবে ঝিঝিপোকার একটানা আওয়াজের বিরাম নেই। কান যেন ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। ও দরজায় গিয়ে প্রথমে একটু আস্তে ধাক্কা দিল। খুলল না। এবার বেশ জোরের সাথেই দরজাটা ধাক্কা দিতেই ক্যা……..চ করে দরজাটা খুলে গেল।
চারিদিকে মাকড়সার জাল। মাটিতে এদিকে ওদিকে পায়রার বিষ্ঠা ছড়িয়ে রয়েছে। টর্চের আলোটা উপরের দিকে তুলতেই বেশ কয়েকটা বাদুড় ডানা ঝাপটে উড়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ও তখনই মাথা নিচু করে নিল। নাহলে ওর মাথায় ঠুকড়ে দিত। টার্চের আলো দেখে পায়রাগুলো ডেকে উঠলো। বাড়িটার নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে গেল।
খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে এগোতে লাগল ও। মাঝে একটা বিরাট উঠান। যার চারদিক বাড়িটা দিয়ে ঘেরা। সবগুলো ঘরের দরজা বন্ধ চেষ্টা করেও খুললো না।। ও উঠোনের একটা কোনার দিকে বসে পড়ল। আরো কিছুটা সময় অতিবাহিত করবার উদ্দেশ্যে। এখন অন্ধকারটা অনেকটাই চোখ সয়ে গেছে। এমন সময় ও একটা সিঁড়ি দেখতে পেল।
ও খুব সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো। উপরে বেশ কয়েকটা ঘর দেখে খুলবার চেষ্টা করল। তার মধ্যে একটা ঘরের সামনে দাঁড়াতেই আপনা আপনি খুলে গেল দরজাটা। এক মুহূর্তের জন্য হলেও ও একটু ঘাবড়ে গেল।
যাইহোক ঘরের ভেতর ও প্রবেশ করল। আর সাথে সাথেই দরজাটাও বন্ধ হয়ে গেল। নিচের তলা থেকে উপরের এই ঘরটা তুলনামূলক অনেক বেশি পরিষ্কার। ও এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। টর্চের আলোতে ঘর ভরে রয়েছে। ঘরের দেওয়ালে বেশ কিছু জিনিস কাপড় মোড়ানো অবস্থায় ঝুলছে। ও একেকটা করে কাপড় সরিয়ে দেখতে পেল বেশ কিছু ছবি। ওর মনে হল এটা বোধহয় পারিবারিক বংশতালিকা।
ঘরের ভেতরে একটা আয়না ছিল। ও আয়নার সামনে দাঁড়াতেই আয়নার ওপার থেকে ওর ছবির বদলে একটা ভয়ংকর ছবি ভেসে উঠলো।
ছবিটি একটি মহিলার। বেশভূষা বেশ দামী এবং ধোপদূরস্ত। কিন্তু চুলগুলো সব উশকো খুশকো। কাঁচা পাকা চুল। চোখ দুটি দিয়ে রক্তের ধারা বইছে। হাতের আঙ্গুল গুলো দেখে মনে হচ্ছে শুধু হাড়ই আছে কোন চামড়াই নেই।
হঠাৎ ওর মনে হল মহিলার গায়ের থেকে মাংস গুলো খসে খসে পড়ছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মহিলাটি একটি কঙ্কালে পরিণত হলো।ওর মনে হচ্ছে মহিলাটি আয়নার ওপার থেকে আর্তচিৎকার করছে।
ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। এর আগে অনেক জায়গায় ও গেছে কিন্তু এরকম ঘটনা কখনো ঘটেনি। ও আর আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। হাত থেকে টর্চটা নিচে পড়ে গিয়ে নিভে গেল।
টর্চটা নিভে যেতেই ওর মনে হলো আয়নার ভিতর থেকে কিছু একটা বেরিয়ে এলো। ও হাতড়ে হাতড়ে টর্চটা খুঁজে পেল। টর্চটা জ্বালাতেই ও দেখল একটা কুচকুচে কালো বিড়াল। আলো দেখে ম্যাও ম্যাও করে ডেকে উঠলো। আবার আয়নার ভেতরে ঢুকেও গেল।
ওর মুখ থেকে আর কোন কথা বেরলো না। ও বুঝতে পারছিল ওর মুখ দিয়ে একটা গোমানির মত আওয়াজ বেরোচ্ছে।।
এদিকে পরের দিন বেলা এগারোটার দিকে অনিরুদ্ধ যেখানে উঠেছিল সেখানকার কয়েকজন এলো বাড়িটাতে। ওরা অনিরুদ্ধকে ডেকেও কোন সাড়া না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে উপরে উঠে এলো। যে ঘরে অনিরুদ্ধ ঢুকতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেছিল এই ঘরটা এখন হাট করে খোলা। ওরা ঘরের ভেতর ঢুকতেই দেখল অনিরুদ্ধ মাটিতে পড়ে রয়েছে। হাতের টর্চটা অনেক দূরে পড়ে আছে। মুখের দুকোনা দিয়ে গ্যাজা মতন বেড়িয়ে শুকিয়ে গেছে।
ওরা অনিরুদ্ধর নাড়ি পরীক্ষা করে দেখল এখনো জীবিত। ওরা ওর চোখে জলের ছিটা দিয়ে জ্ঞান ফেরালো। ওর চোখে একটা ভীতি দেখা যাচ্ছে। আবার কোন কথা না বলেই অজ্ঞান হয়ে গেল। সবাই মিলে তখন ওখান থেকে ওকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেল।।