হাসপাতাল থেকে বাড়ি
মিসির আলি হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন। জ্বর সারলেও শরীর খুব দুর্বল। রিকশায় বাসায় আসতে গিয়েই ক্লান্ত হয়েছেন। রীতিমতো হাঁপ ধরে গেছে। বিকেলে এসেছেন। এসেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। খুব ক্লান্ত অবস্থায় ঘুম ভালো হয় না। ঘুমের তৃপ্তি পাওয়া যায় না। তার ওপর বদু কিছুক্ষণ পরপর এসে মাথায় হাত দিয়ে জ্বর এল। কিনা দেখে যাচ্ছে। সন্ধ্যাবেলা সে ডেকে তুলে ফেলল। তার বিখ্যাত দার্শনিক উক্তির একটি শোনাল, সইন্ধ্যাকালে ঘুমাইলে আয়ু কমে। সাইন্ধ্যাকালে মাইনষের বাড়িতে বাড়িতে আজরাইল উঁকি দেয়। এই জন্যে সাইন্ধ্যাকালে জাগানা থাকা লাগে। উঠেন, চা পানি খান।
আজরাইল এসে তাকে যেন ঘুমন্ত অবস্থায় না পায় সে জন্যেই মিসির আলি উঠে হাত-মুখ ধুলেন। চা খেলেন। সিগারেট খেতে এখন আর বাধা নেই। ডাক্তার-নার্স ছুটে আসবে এই আশঙ্কা থেকে তিনি মুক্ত, তবু সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছে না। পার্কের দিকে বেড়াতে যেতে ইচ্ছা করছে। শরীরে বোধ হয় কুলাবে না।
বদু।
জে স্যার।
আমি হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে কেউ আমারক খোঁজ করেছিল?
জে না। আপনেরে কে খুঁজব?
মিসির আলি ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেললেন। তাই তো, কে তাঁকে খুঁজবে? তিনি হালকা গলায় বললেন, I have no friends, nor a toy.
স্যার রাইতে কী খাইবেন?
যা খাওয়াবি তাই খাব।
শিং, মাছ আনছি। অসুখ অবস্থায় স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো।
আচ্ছা।
অতি অখাদ্য শিং মাছের ঝোল দিয়ে মিসির আলিকে রাতের খাবার শেষ করতে হল। রোগীর খাদ্য, এ জন্যেই কোনো রকম মশলা ছাড়া বদু শিং, মাছ রান্না করেছে। মিসির আলি বললেন, মুখে দিতে পারছিনাতোরে বদু।
অসুখ অবস্থায় মুখে রুচি থাকে না।
রুচি আসবে কোত্থেকে? তুই তো মাছগুলো শুধু লবণ পানিতে সেদ্ধ করেছিস।
এই খাওয়া লাগব স্যার। অসুখ অবস্থায় মশলা হইল বিষ।
খাওয়ার পর বদু তার পড়া নিয়ে এল। মিসির আলি বললেন, আজ থাক বদু। খুব টায়ার্ড লাগছে। আজ শুয়ে পড়ি।
বদু বলল, দুই মিনিটের মামলা।
বদু মিসির আলিকে চমৎকৃত করল-বাংলা বর্ণমালার প্রতিটি অক্ষর নির্ভুল বলে গেল। মিসির আলি বললেন, ব্যাপার কী?
শিখলাম।
তাই তো দেখছি। শিখলি কীভাবে?
তন্ময় ভাইজান একবার আইস্যা বলল, শোন বদি তুমি যদি অক্ষরগুলো শিখে ফেলতে পার তা হলে তোমার স্যার হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে তোমার কাণ্ড দেখে খুব খুশি হবেন।
বদু তন্ময়ের কথাগুলো শুধু যে শুদ্ধ ভাষায় বলল তাই না, তন্ময়ের মতো করেই বলল।
মিসির আলি বললেন, আমি খুশি হয়েছি। শিখলি কীভাবে। কে দেখিয়ে দিয়েছে?
তন্ময় ভাইজান দেখাইয়া দিছে। রোজ রাইত কইরা একবার আসত। বুঝছেন স্যার, ভালো লোক। আপনার মতোই ভালো। ভালো লোকের কপালে দুঃখ থাকে। এই জন্যেই আফসোস।
তন্ময় কি রোজই আসত?
জি রোজই একবার আসছেন।
আজ আসবে?
জি আসব। বইল্যা গেছে আসব।
মিসির আলি তনয়ের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। সে এল ঠিক দশটায়। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, স্যার আপনার শরীর এখন কেমন?
মিসির আলি বললেন, খুব খারাপ। শুধু ঘুম পায়। কিন্তু ঠিকমতো ঘুম আসে না।
আমি আজ বরং উঠি।
না না। তুমি বস। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
আপনি কি আমার লেখাগুলো পড়ে শেষ করেছেন?
হ্যাঁ শেষ করেছি। এই নিয়েই তোমার সঙ্গে কথা বলব।
আজ না হয় থাক স্যার। আপনাকে দেখাচ্ছেও খুব ক্লান্ত।
ক্লান্ত দেখালেও আমার যা বলার। আজই বলতে চাই। এবং তোমার আমাকে যা বলার তা আজই বলা শেষ করবে। ব্যাপারটা তোমার ওপর। যেমন চাপ ফেলছে। আমার ওপরও চাপ ফেলছে। তোমার সঙ্গে কি গাড়ি আছে?
আছে।
চল তা হলে পার্কে চলে যাই! যেখানে গল্পের শুরু হয়েছে, সেখানেই শেষ হোক।
এই ঠাণ্ডায় পার্কে যাবেন?
হুঁ।
মিসির আলি চাদর গায়ে দিলেন। বদুকে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়তে বললেন। মিসির আলিকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। ঘর থেকে বেরুবার সময় দরজায় ধাক্কা খেলেন।
পার্কের বাইরে রাস্তায় আলো আছে। পার্কের ভেতর আলো নেই। মিসির আলি এবং তন্ময় বেঞ্চিতে পাশাপাশি বসে আছেন। আজ শীত কম। তারপরেও চাদরে সারা শরীর ঢেকে মিসির আলি জবুথবু হয়ে বসে আছেন। মিসির আলির শীত লাগছে। পার্ক পুরোপুরি ফাঁকা। আকাশে চাঁদ আছে। তবে গাছপালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো আসতে পারছে না। জোছনা খেলছে। গাছের পাতায়। মিসির আলি জোছনা দেখছেন।
তন্ময়।
জি।,
তোমার লেখা আমি মন দিয়ে পড়েছি। খুব মন দিয়ে পড়েছি। আমার মনে হয় না, আমার সাহায্যের তোমার প্রয়োজন আছে। তুমি ঠিক পথেই এগুচ্ছ। একজন মনোবিজ্ঞানীর যেভাবে এগুনো উচিত তুমি সেইভাবেই এগুচ্ছ!
স্যার আমি পারছি না।
আমার তো মনে হয় পারছ। খুব ভালোভাবেই পারছ।
না, পারছি না। রানু খুব শিগগিরই বিপদে পড়বে। মাস্টার সাহেব তাঁকে সরিয়ে দেবেন। রানু একটি চিঠি পেয়েছে। তাকে আমাদের বাড়িতে আসতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমি তাকে কোনো চিঠি লিখি নি, চিঠি পাঠিয়েছেন মাস্টার সাহেব।
মিসির আলি বললেন, মাস্টার সাহেব বলে কেউ নেই। তুমি তা খুব ভালো করে জান। জান না?
তন্ময় চুপ করে রইল।
তোমার মনে কি সন্দেহ আছে?
হ্যাঁ।
কেন?
আপনি একসময় বলেছেন সব প্রশ্নের দুটি উত্তর-হ্যাঁ এবং না। মাস্টার সাহেব বলে কি কিছু আছে? এই প্রশ্নেরও দুটি উত্তর হবে-হ্যাঁ এবং না।
তুমি সামান্য ভুল করেছ তন্ময়। আমি যা বলেছিলাম তা হল প্রশ্নের একটিই উত্তর হয়। হ্যাঁ কিংবা না। কিন্তু মানুষ যেহেতু অস্বাভাবিক একটি প্রাণী সে দুটি উত্তরই একই সঙ্গে গ্রহণ করে। যদিও সে জানে উত্তর হবে একটি।
তন্ময় নিশ্বাস ফেলল। মিসির আলি বললেন, এস এক কাজ করা যাক। তোমার সমস্যাটা আমরা একসঙ্গে সমাধান করার চেষ্টা করি। আমরা ধাপে ধাপে অগ্রসর হব। আমরা ব্যবহার করব লজিক। লজিক হচ্ছে বিশুদ্ধ বিজ্ঞান। লজিকের বাইরে কিছু থাকতে পারে না।
মিসির আলি সিগারেট ধরালেন। একটু ঝুঁকে এলেন তন্ময়ের দিকে–
তন্ময়, তোমার মা খুব ছোটবেলায় তোমাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। তোমার বাবা তোমাকে সহ্য করতে পারতেন না। তোমাকে বাইরের কারো সঙ্গে মিশতে দেওয়া হত না। সর্দার নামের একজন লোক রাখা হয়েছিল শুধুমাত্র তোমাকে অন্যদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যে। এমনকি স্কুল থেকেও তোমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা হল। একজন মাস্টার দেওয়া হয়েছিল, সেও রইল না। তোমাকে সবার কাছ থেকে আলাদা করে দেওয়ার কারণটা কী তন্ময়? এমন কী তোমার আছে যে তোমাকে সবার কাছ থেকে সরিয়ে রাখতে হবে?
আমি জানি না স্যার।
মিসির আলি শীতল গলায় বললেন, তন্ময়, তুমি জান।
না, আমি জানি না?
তুমি জান কিন্তু তুমি তা গ্ৰহণ করতে প্রস্তুত নিও। প্রস্তুত নাও বলেই তোমার মস্তিষ্কের একটি অংশ ব্যাপারটা জানে না। তোমার অবচেতন মন কারণটা জানে–কিন্তু তোমাকে জানাতে চাচ্ছে না। সমস্যাটা এখানেই। তোমার মস্তিষ্ক ধরে নিয়েছে, কারণ জানলে তোমার প্রচুর ক্ষতি হবে। সে ক্ষতি হতে দেবে না। কাজেই সে তোমাকে রক্ষা করার চেষ্টা শুরু করল। সে ঠিক করল, কোনোদিনই তোমাকে কিছু জানাবে না। বুঝতে পারছ?
পারছি।
পারার কথা, মনোবিজ্ঞানের সহজ কিছু প্রিন্সিপালই বলা হচ্ছে। জটিল কিছু নয়। তাই না?
হ্যাঁ তাই। Conflict between conscious and sub-conscious.
এখন আস দ্বিতীয় ধাপে। এখানে আমরা কী দেখছি? এখানে দেখছি তোমাকে ঘিরে যারা আছেন তাঁরা সরে যাচ্ছেন। প্রথম সরলেন তোমার মা। তিনি দূরে চলে গেলেন। তারপর গেলেন তোমার বাবা, তারপর সর্দার চাচা। এরা কারা? এরা তোমার খুব কাছাকাছির মানুষ। তোমার ভেতরে যে অস্বাভাবিকতা আছে, যে অস্বাভাবিকতার জন্যে তোমাকে আলাদা রাখা হচ্ছে–এরা তা জানেন। তোমার মস্তিষ্ক ঠিক করল এদেরও সরিয়ে দেওয়া দরকার। এদের সে সরিয়ে দিল। সরিয়ে দেবার জন্যে একটি ভয়াবহ ব্যাপারের অবতারণা করতে হল-সেই ভয়াবহ ব্যাপার হল মাস্টার সাহেব। তোমার মস্তিষ্ক সেই মাস্টার তৈরি করল। যে কারণে মাস্টার বারবার বলছে-আমি তোমাকে রক্ষা করব, তোমাকে সাহায্য করব। তোমার মঙ্গল দেখব।
তন্ময় শীতল গলায় বলল, আমার অস্বাভাবিকতাটা কী?
মিসির আলি বললেন, সেই অস্বাভাবিকতাটা কী আমি নিজে তা ধরতে পারছিলাম না। যখন রানু প্রসঙ্গ এল তখন ধরতে পারলাম–তুমি হচ্ছ একজন অপূর্ণ মানুষ। তুমি পুরুষ নও, নারীও নও। তুমি হলো–Hermaphrodite, বৃহন্নলা! কথ্য বাংলায় আমরা বলি হিজড়া। দেখ। তন্ময়! কঠিন সত্য তুমি প্রথম জানলে তোমার বয়ঃসন্ধিকালে। নিজে নিজেই জানলে, কেউ তোমাকে জানায় নি! এই সত্য তুমি গ্ৰহণ করলে না। তোমার মস্তিষ্ক এই কঠিন সত্য পাঠিয়ে দিল অবচেতন মনে। সেই অবচেতন মনই তৈরি করল মাস্টার। যে মাস্টারের প্রধান কাজ এই সত্য গোপন রাখা। গোপন রাখার জন্যেই সে এই সত্য যারা জানে তাদের একে একে সরিয়ে দিতে শুরু করল। যখন তারা সরে গেল–তোমার অবচেতন মন নিশ্চিন্ত হল। মাস্টার সাহেবের তখন আর প্রয়োজন হল না। দীর্ঘদিন তুমি আর তার দেখা পেলে না। বুঝতে পারছ?
তন্ময় জবাব দিল না।
আমার লজিকে কি কোনো ভুল আছে?
তন্ময় তারও জবাব দিল না। মিসির আলি বললেন, আবার সেই মাস্টারের প্রয়োজন পড়ল যখন রানু নামের অসাধারণ একটি মেয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইল। সে তোমাকে কামনা করছে পুরুষ হিসেবে। তুমি পুরুষ হিসেবে তার কাছে যেতে পারছ না। তুমি কঠিন সত্য তাকে বলতে পারছ না, অন্য একজন পুরুষ এই মেয়েটির কাছে যাক তাও তুমি হতে দিতে পার না, কারণ তুমি এই মেয়েটিকে অসম্ভব ভালবাস। কাজেই আবার মাস্টার জেগে উঠল। তুমিই তাকে জাগালে। তুমিই ঠিক করলে মেয়েটিকে সরে যেতে হবে। তন্ময়!
জি।
তুমি কি এই দৈত্যটাকে বাঁচিয়ে রাখবে না নষ্ট করে দেবে? খুব সহজেই তাকে ভূমি ধ্বংস করতে পার। যেই মুহুর্তে তুমি রানুকে গিয়ে তোমার জীবনের গল্প বলবেসেই মুহুর্ত থেকে মাস্টারের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। রানুর সঙ্গে কি তোমার যোগাযোগ আছে?
না। তবে মাঝে মাঝে দূর থেকে আমি তাকে দেখি।
সে কি বিয়ে করেছে?
না।
শোন তনয়, গভীর ভালবাসায় এক বর্ষার দিনে সে তোমাকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল–তখন তুমি তাকে কঠিন অপমান করেছিলে। এই অপমান তার প্রাপ্য নয়। তোমার কি উচিত না সেই দিনের ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করা?
হ্যাঁ উচিত।
প্রকৃতি তোমার ওপর কঠিন অবিচার করেছে। তোমাকে অপূৰ্ণ মানুষ করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। সেই প্রতিশোধ তো তুমি মেয়েটির ওপর নিতে পার না! আমি কি ঠিক বলছি?
হ্যাঁ, ঠিক বলছেন। আমি রানুকে সব বলব।
তন্ময় কাঁদছে। মিসির আলি কান্নার শব্দ শুনছেন না, কিন্তু বুঝতে পারছেন। তিনি নিজে অসহায় বোধ করতে শুরু করেছেন।
তন্ময় বলল, স্যার চলুন, আপনাকে বাসায় দিয়ে আসি।
মিসির আলি বললেন, তুমি আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে চল। তোমার মাস্টার সাহেব যে দোতলায় থাকেন তোমাকে নিয়ে আমি সেখানে যাব। তুমি দেখবে সেখানে কেউ নেই।
স্যার, আমি আপনাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছি না।
কেন চাচ্ছ না?
আমার জীবনের কঠিন এবং ঘূণ্য সত্য যারা জানে–তারা কেউ বেঁচে নেই। এই সত্য আপনি জানেন। মাস্টায় আপনার ক্ষতি করতে পারে।
মিসির আলি বললেন, মাস্টার বলে যে কিছু নেই তা-ই আমি তোমাকে দেখাব। তুমি আমাকে নিয়ে চল।