Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আমার স্ত্রীর আততায়ী || Anish Deb

আমার স্ত্রীর আততায়ী || Anish Deb

ফ্ল্যাটের দরজা হাট করে খোলা দেখেই বুকটা যেন ছ্যাঁৎ করে উঠল।

কোনও-কোনওদিন অফিস থেকে ফিরে দরজা যে সামান্য খোলা পাই না তা নয়। কিন্তু আজ এমনভাবে এমন ভঙ্গিতে দরজার পাল্লাদুটো খোলা রয়েছে যে, দেখামাত্রই একটা অশুভ ঘণ্টা বুকের ভেতরে ঢং-ঢং করে বাজতে শুরু করেছে। ঘুমন্ত মানুষ ও মৃতদেহের মধ্যে ঠিক এইরকম তফাতই বুঝি থাকে। অজান্তেই বুকের ভেতরে ঘণ্টা বাজতে শুরু করে।

চকিতে নজর চলে গেল হাতঘড়ির দিকে। সাড়ে সাতটা সবে পেরিয়েছে। রোজ এরকম সময়েই অফিস থেকে ফিরি। বন্ধ দরজায় ঠকঠক করলে কুসুম এসে দরজা খুলে দেয়। সকালে আমি অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে সারাটা দিন বলতে গেলে ও একাই থাকে। শুধু কাজলের মা এসে সকাল-বিকেল দু-বেলার ঠিকে কাজটুকু সেরে দিয়ে যায়। কুসুমকে সবসময় বলি দরজা বন্ধ করে সাবধানে থাকতে। দরজায় কেউ নক করলে হুট করে দরজা না-খুলতে। ওর সুবিধের জন্য দরজায় একটা ম্যাজিক আই বসিয়ে দিয়েছি। যাতে দরজায় দাঁড়ানো মানুষটিকে ভেতর থেকেই ও দেখতে পায়। বুঝতে পারে সে চেনা কি অচেনা।

ফ্ল্যাটের দরজায় আলোটা জুলছিল। পঁচিশ পাওয়ারের বাম্ব। এ-বাড়ির অন্যান্য ফ্ল্যাটগুলোর বেশিরভাগেরই দরজায় কোনও আলো নেই। বাদ্ধ লাগানোর দরকার মনে করেনি ভাড়াটেরা। একইসঙ্গে বিদ্যুৎ খরচ বাঁচিয়েছে। কিন্তু আমার স্ত্রী কুসুম একা থাকে। রাতে দরজায় কেউ নক করলে ম্যাজিক আই দিয়ে নজর করে আগন্তুককে ওর দেখা দরকার। তাই আমি বিদ্যুৎ-খরচের কথা ভাবিনি।

খোলা দরজা পেরিয়ে সরু একচিলতে করিডর। ডানদিকে রান্নাঘর আর বাথরুম। দুটোই অন্ধকার। বাঁদিকে বসবার ঘর। সেখানে আলো রয়েছে। সামনে শোওয়ার ঘর। সেখানেও আলো জ্বলছে।

কুসুমের নাম ধরে মাঝারি গলায় বারদুয়েক ডাকলাম। কোনও সাড়া নেই। বুকের ধুকধুকুনি বাড়তে লাগল।

জুতোজোড়া করিডরে একপাশে চটপট খুলে রেখে বসবার ঘরে ঢুকলাম। আবার কুসুমের নাম ধরে ডাকলাম।

বসবার ঘর খালি। একজোড়া সোফা, টেবিল, বুককেস, ফুলদানিসবই জায়গা মতো পরিপাটি করে সাজানো। ঘরে কেউ নেই। এসেছিল বলেও মনে হয় না। কারণ সোফার গদিতে কোনও গভীর ছাপ নজরে পড়ল না।

উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠায় প্রথমে খেয়াল করিনি। কিন্তু এখন একধরনের থমথমে নীরবতার মধ্যে একজন পুরুষের গলা কানে এল। ভেতরে শোওয়ার ঘরে কেউ যেন কথা বলছে। কিন্তু সদর দরজা হাট করে রেখে শোওয়ার ঘরে বসে কুসুম কারও সঙ্গে কথা বলবে কি? বসবার ঘর থেকে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে এলাম। প্রায় ছুটে শোওয়ার ঘরে গেলাম। পুরুষের কণ্ঠস্বর ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল।

শোওয়ার ঘরে ঢুকেই একটা ভীষণ ধাক্কা খেলাম।

যে-লোকটির কথা বসবার ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম এখন তাকে দেখতে পেলাম। টিভি-র চৌকো ফ্রেমের মধ্যে সে অভিব্যক্তিহীন মুখে খবর পড়ছে। ঘরে কেউ নেই। গোটা ঘর লন্ডভন্ড। যেন একডজন কালবৈশাখী জানলা দিয়ে ঢুকে পড়ে ঘরে হাডুডু খেলেছে।

প্রথমেই চোখে পড়ে বিছানা। কুসুম খুব গোছানো স্বভাবের মেয়ে। ঘর গোছানো ওর শখ। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে, বিছানার যে-হাল চোখে পড়ছে তা আর বলার নয়। বেডকভারটা কেউ খামচে টেনে এনেছে খাটের কিনারায়। কিছুটা অংশ শাড়ির আঁচলের মতো ঝুলছে। বম্বে ডাইং এর সুন্দর চাদরটা ছিঁড়ে ফালাফালা। একটা বালিশ মেঝেতে। অন্য আর-একটা বিছানার মাঝখানে। ফেটে তুলো বেরিয়ে এসেছে। অন্য বালিশগুলো এলোমেলো।

টিভি-তে পড়া খবরের একটা শব্দও আমার কানে ঢুকছিল না। বুকের ভেতরে বারবার বাজ পড়ছিল। চেষ্টা করে চোখের নজর পরিষ্কার রাখতে হচ্ছিল।

চট করে হাত বাড়িয়ে টিভি অফ করে দিলাম। নিস্তব্ধতার প্যারাশুট নিঃশব্দে ঘরে নেমে এল। আমি কুসুমের নাম ধরে নরম গলায় বারকয়েক ডাকলাম। দেখছি ঘর খালি, অথচ কেন যেন মনে হচ্ছিল, আমি যদি তেমন করে ডাকতে পারি তা হলে কুসুম নিশ্চয়ই অলৌকিক কোনও উপায়ে কোথাও-না-কোথাও থেকে আমার সামনে এসে হাজির হবে।

অগোছালো ঘরের ছোট-বড় টুকিটাকি চিহ্নগুলো একে-একে নজরে পড়ছিল। ড্রেসিং টেবিলের আয়না ভেঙে চৌচির। মাকড়সার জালের মতো ফাটল একটা বিন্দু থেকে জন্ম নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আয়নার পরিসীমার দিকে। ড্রেসিং-টেবিলে সাজিয়ে রাখা চিরুনি, পাউডার, লিপস্টিক, সিঁদুর–সবই এখন ছত্রখান। কুসুম সাজতে ভালোবাসত, সাজাতে ভালোবাসত। এখন কষ্ট করেও সেটা বোঝবার উপায় নেই।

মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে একটা পেতলের ফুলদানি, জল, তেলানো রজনীগন্ধার স্টিক, কাচের চুড়ির টুকরো, ভাঙা শাঁখা, আর ছোট মাপের কয়েকটা কালচে ছোপ। রক্ত কি না জানি না। পরীক্ষা করে দেখতে ভয় করল।

আমার কান্না পাচ্ছিল। নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু একটা ঘটে গেছে এই ফ্ল্যাটের শোওয়ার ঘরে। ভাঙা গলায় কুসুমের নাম ধরে আবার ডাকলাম। কোনও সাড়া নেই।

এখন কী করব? চেঁচিয়ে তোক জড়ো করব, না পুলিশে খবর দেব? সন্দেহ নেই, চোর, লুঠেরা অথবা ডাকাতের দল হানা দিয়েছিল ফ্ল্যাটে। কিন্তু তারপর তারা কী করেছে? কুসুমকে কিডন্যাপ করেছে, না কি…?

ভয়ংকর কতকগুলো সম্ভাবনা মাথায় রঙিন বাবের মতো দপদপ করে উঠল। মাথায় হাত চেপে ছন্নছাড়া মেঝেতে বসে পড়লাম। শরীরের ভেতর থেকে তৈরি হয়ে নির্লজ্জভাবে বেরিয়ে আসা থরথর কাঁপুনিকে চেষ্টা করেও বশে আনতে পারলাম না। আর ঠিক তখনই একটা অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ আমার কানে এল। আমাকে দারুণভাবে চমকে দিল।

বেডকভারটা খাটের কিনারায় ঝুলে থাকায় খাটের তলাটা একরকম আড়ালই হয়ে গিয়েছিল। মনে হল যেন গোঙানির শব্দটা সেখান থেকেই আসছে। দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে খাটের কাছে এগিয়ে গেলাম। একটানে বেডকভারটাকে ফেলে দিলাম মেঝেতে। খাটের তলায় চোখ গেল। কুসুম–অথবা কুসুমের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেলাম।

খাটের তলায় আধো অন্ধকার, তবে দেখতে কোনও অসুবিধে হল না। বিচিত্র ভঙ্গিতে দলা পাকিয়ে কুসুম পড়ে রয়েছে। জায়গার অভাবে একটা ট্রাঙ্ক আর একজোড়া সুটকেস খাটের নীচে থাকত। সেগুলো এখন ছিটকে গেছে দেওয়ালের গায়ে কোনের দিকে। সেই একটা সুটকেস অদ্ভুতভাবে আঁকড়ে ধরে কুসুম কুঁকড়ে পড়ে রয়েছে। গোঙাচ্ছে।

কুসুম। কুসুম! অনেক কিছু মিশে ছিল এই ডাকের মধ্যে ও উবেগ, ভয়, স্বস্তি, আনন্দ, আরও কত কী!

ঝুঁকে পড়ে খাটের নীচে ঢুকে গেলাম খানিকটা। হাত বাড়িয়ে কুসুমকে ধরলাম। ছোঁওয়ামাত্রই ও যেন আঁতকে উঠল। ছিটকে যেতে চাইল আমার কাছ থেকে। একটা অদ্ভুত চাপা-আর্তনাদ করে উঠল।

আমি অন্ধকারের মধ্যেই ওর কাছে মুখটা এগিয়ে নিয়ে গেলাম। বললাম, কুসুম, আমি রণবীর রুণু।

তারপর ওকে টেনে বের করে নিয়ে এলাম খাটের তলা থেকে। পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে শুইয়ে দিলাম ছত্রখান বিছানার। দেখলাম, সেখানে ও চমৎকার মানিয়ে গেছে। কারণ, ওর শরীরটাও ছত্রখান।

খোঁপা খুলে চুল এলোমেলো। সিঁদুর ঘষে গিয়ে ফরসা কপাল লালচে। ডান-চোখের নীচটা বিশ্রীভাবে ফুলে রয়েছে, কালসিটে পড়ে গেছে। বাঁ-গালে দুটো ক্ষতের দাগ, চামড়া কেটে মাংস দেখা যাচ্ছে। ওপরের ঠোঁট জখম হয়ে কষ বেয়ে রক্তের দাগ নেমেছে। একইরকম রক্তের দাগ দেখলাম হাতে, বাহুতে, কোমরে। শাড়ি ছিঁড়ে জট পাকিয়ে কোমরের কাছে জড়ানো। ব্লাউজ গলার কাছে টান মেরে ছেঁড়া। ধবধবে গলায়, বুকে, নখের আঁচড়ের কয়েকটা সমান্তরাল দাগ চোখে পড়ল। অন্তর্বাস জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। ছিঁড়েছে ব্লাউজের হাতা, কোমরের কষি।

সব মিলিয়ে সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য।

কুসুম কোনওরকমে চোখ খুলে দেখতে চেষ্টা করল। তারপর আমার কোলে মুখ গুঁজে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। আমি আলতো করে জড়িয়ে ধরলাম। বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছিল।

.

কুসুম, কী হয়েছিল?

যতটা সম্ভব শুশ্রূষা, পরিচর‍্যা করে কুসুমকে কিছুটা সুস্থ করে তুলেছি। এক্ষুনি ডাক্তারকে খবর দিতে যাব। কিন্তু তার আগে, সবকিছু জানাজানি হওয়ার আগে, পরিস্থিতির ওজনটুকু আঁচ করা দরকার।

কুসুমের সামনে যতই সহানুভূতির ভাব ফুটিয়ে তুলি না কেন ভেতরে-ভেতরে একটা ভয়ংকর রাগ দাপাদাপি করছিল। যে করেই হোক, আমার বউয়ের ওপরে এই অত্যাচারের শোধ তুলতেই হবে। যেমন করেই হোক বদলা আমার চাই-ই চাই। অতি কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে শুয়ে থাকা কুসুমকে আবার নরম গলায় প্রশ্ন করলাম, কী হয়েছিল, কুসুম?

দুর্বল অস্পষ্ট গলায় থেমে-থেমে বহুক্ষণ ধরে ও যা বলল তার সারমর্ম হল এই : হাতের কাজ-টাজ সেরে রোজকারমতো ছটা বত্রিশে ও টিভি দেখতে বসে। কাজলের মা তার একটু আগেই চলে গেছে। কতক্ষণ টিভি দেখছিল খেয়াল নেই, হঠাৎ শোনে দরজায় কেউ নক্‌ করছে। কেন যেন ওর মনে হয়েছিল, নক্ করার ভঙ্গিটা ঠিক আমার মতো। ভেবেছিল, আমি হয়তো অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছি। তবুও অভ্যাসবসে দরজার কাছে গিয়ে ও ম্যাজিক আই-এ চোখ রাখে। যে নক্‌ করেছিল সে একপাশে দাঁড়িয়েছিল, কারণ, শুধু তার কাঁধের খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছিল। আর আশ্চর্য, যে-নীল রঙের জামাটা কুসুমের চোখে পড়ে আমার ঠিক সেইরকম একটা জামা আছে–যদিও আজ অন্য রঙের জামা পরে আমি অফিসে গেছি। কিন্তু সেইমুহূর্তে কুসুমের সেটা খেয়াল হয়নি। মোটামুটিভাবে আমি ফিরে এসেছি ভেবেই ও দরজা খুলে দেয়।

লোকটি ঢুকেই বলে যে, সে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, একটু অপেক্ষা করবে। অস্বস্তি হলেও কুসুম তাকে ঠিক মুখের ওপর না বলতে পারেনি। বসবার ঘরে গিয়ে বসতে বলেছে। অপরিচিত একজন পুরুষ ফ্ল্যাটে ঢোকার ফলে ইচ্ছে করে ফ্ল্যাটের দরজাটা ও আর বন্ধ করেনি। হাট করে খুলে রেখে দিয়েছে। তারপর চায়ের আয়োজন করবে বলে শোওয়ার ঘরে আসে কাচের আলমারি খুলে সুদৃশ্য কাপ-প্লেট বের করার জন্যে ও অতিথি-অভ্যাগত এলে তবেই এগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। শোওয়ার ঘরে ঢুকে আলমারির কাছে পৌঁছোনোর আগেই দরজায় একটা শব্দ শুনতে পায় কুসুম। পেছন ফিরে দেখে সেই লোকটা শোওয়ার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। তখন তাকে অন্যরকম দেখাচ্ছিল। কুসুম কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগেই লোকটা ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। দাঁত বের করে হেসে বলে, শুধু-শুধু ভয় পাচ্ছেন কেন, মাইরি! কুসুম চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু সেই চিৎকার আশপাশের ফ্ল্যাটের লোকেরা বোধহয় শুনতে পায়নি। প্রথমত, ভয়ে কুসুমের গলা প্রায় বুজে গিয়েছিল, তাই চিৎকারের আওয়াজটা হয়তো ঠিকমতো বেরোয়নি। দ্বিতীয়ত, ঘরে টিভি চলছিল। আর তৃতীয়ত, সান্ধ্য আইন অনুযায়ী এ-বাড়ির প্রতিটি ফ্ল্যাটেই জোরালো ভলিয়ুমে টিভি চলে।

এরপর যা হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা কুসুমের পক্ষে অস্বস্তিকর। লোকটা হঠাৎই খ্যাপা জানোয়ার হয়ে ওকে আক্রমণ করে। কুসুম নিজেকে বাঁচানোর জন্যে প্রাণপণ লড়াই করেছে। শেষে মরিয়া হয়ে ও ঢুকে পড়ে খাটের তলায়। ধস্তাধস্তি চলতেই থাকে। হঠাৎই সিঁড়ির কাছে কয়েকজনের কথাবার্তা আর হাসির শব্দ শোনা যায়। লোকটা তাতেই কেমন যেন ভয় পেয়ে কুসুমের মুখে একটা ঘুষি মেরে, অশ্রাব্য গালিগালাজ করে ওকে ছেড়ে দেয়। ওর তখন মাথা ঝিমঝিম করছে, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে রয়েছে, শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করার মতো সাড়টুকুও নেই। দেখল, লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে কাচের আলমারির আড়ালে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর ঘর ছেড়ে চলে গেল।

লোকটা চলে যেতেই কুসুম বোধহয় জ্ঞান হারিয়ে ফ্যালে। কারণ, আমার ডাকে চেতনা ফিরে পেয়ে ও আমাকেই হঠাৎ আততায়ী বলে মনে করেছিল।

ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে কুসুম বারবার কেঁদে ফেলছিল। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিলাম। আমার শরীরের প্রতিটি রোমকূপ জ্বালা করছিল। অনেক প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু একটা অজানা আশঙ্কা আমার টুটি টিপে ধরছিল বারবার।

শেষ পর্যন্ত একটা প্রশ্নই করলাম ওকে।

লোকটাকে কেমন দেখতে? আবার দেখলে চিনতে পারবে?

কুসুম ইতস্তত করে বলল, গায়ের রং কালো। মুখ ভালো করে দেখিনি–আর আমার মুখের ওপরে যখন মুখ নিয়ে এসেছিল তখন কিছু দেখে থাকলেও মনে নেই। তবে মনে হয়, লোকটার ঠোঁটের নীচে ডানদিকে একটা বড় আঁচিল ছিল। আর ভুরু দুটো খুব ঘন, জংলা–তার নীচ দিয়েই লোকটার চকচকে চোখজোড়া তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। আর…।

আমার মনে পড়ল, কুসুম বলেছে লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসেছিল। তাই জিগ্যেস করলাম, লোকটার দাঁতগুলো মনে আছে?

কুসুম ফ্যালফ্যাল করে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল আমার চোখে। তারপর বলল, সত্যিই তো একদম খেয়াল করিনি–লোকটার ওপরের পাটির সামনের একটা দাঁত অর্ধেকটা ভাঙা ছিল। এছাড়া আর কিছু মনে নেই।

আর কিছু? আমি মনে-মনে হাসছিলাম। আততায়ীর যে খুঁটিনাটি বর্ণনা কুসুম দিয়েছে তাতে একে খুঁজে বের করতে পুলিশের সাতদিনও লাগবে না–যদি অবশ্য আমি পুলিশে খবর দিই। চেষ্টা করলে আমি নিজেও হয়তো ওই ইতর ছোটলোকটাকে খুঁজে বের করতে পারব। লোকটাকে খুঁজে পাবই, এ-বিশ্বাস মনের মধ্যে নিশ্চিত হলেও একটা ব্যথা বুকের ভেতরে আঁচড় বসাচ্ছিল বারবার : কলকাতা শহরে এত বাড়ি থাকতে ওই ভয়ংকর ক্ষুধার্ত আততায়ী আমার ফ্ল্যাটটাই বেছে নিল। বুঝতে পারছি, আমার নামটা জানতে তার কোনও অসুবিধে হয়নি। কারণ, সেটা প্লাস্টিকের হরফে ফ্ল্যাটের দরজার গায়েই লেখা আছে।

কুসুমকে বললাম, আমি ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছি।

আমাদের বাড়ির তিনটে বাড়ি পরে ডক্টর দাস থাকেন। অসুখ-বিসুখ হলে উনিই আমাদের দেখেন। ওঁর নানারকম বিলিতি ডিগ্রি আছে। ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরোনোর সময় কুসুমকে বারবার সাবধান করে দিয়ে বললাম, আমার গলা না-পেলে একদম দরজা খুলবে না। শুধু আজ নয়, কোনওদিন এরকম হুট করে আর দরজা খুলবে না।

কুসুম সেই তখন থেকেই মুখ নামিয়ে রয়েছে। আমার দিকে যেন সহজভাবে তাকাতে পারছে । আমার কথায় কুসুম ছোট্ট করে বলল, হু। তারপর দরজা বন্ধ করে ভেতর থেকে খিল দিয়ে দিল।

আমি সিঁড়ি নামতে শুরু করলাম।

.

ডক্টর দাস অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে কুসুমকে পরীক্ষা করলেন।

আমি শোওয়ার ঘরের দরজায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁতে নখ কাটছিলাম। ঘরটা আমিই ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করেছি। আতঙ্কের দুনিয়া আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বাইরেটুকু অন্তত। শুধু ভাঙা আয়নাটা স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। ঘরটা দেখে, কুসুমকে দেখে, বিশ্বাসই হতে চাইছে না কোনও আততায়ী মাত্র ঘণ্টাদেড়েক আগে ঢুকে পড়েছিল এই ঘরে।

সিঁড়িতে কথাবার্তা আর হাসির আওয়াজ শুনে লোকটা ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। সিঁড়ি দিয়ে যারা উঠছিল বা নামছিল, তারা নিশ্চয়ই এই ফ্ল্যাটবাড়িরই বাসিন্দা বা তাদের আত্মীয়স্বজন। আমার ফ্ল্যাটের দরজা হাট করে খোলা দেখেও তারা কৌতূহলী হয়নি, ফ্ল্যাটের ভেতরে উঁকি মারেনি। নিজেদের মনে ঠাট্টা-মশকরা করতে করতে চলে গেছে। যদি কেউ একবার ফ্ল্যাটে ঢুকত তা হলে ওই লোকটা নিশ্চয়ই ধরা পড়ত। আমি এ-বাড়িতে কিছুদিন হল এসেছি। এখনও ভালো করে সবার সঙ্গে আলাপ সালাপ হয়নি। সেইজন্যেই কি সিঁড়ির মানুষগুলো আমার ফ্ল্যাটের খোলা দরজাকে উপেক্ষা করেছে? নাকি এটাই ওদের অভ্যাস?

ডক্টর দাস কুসুমকে ইনজেকশান দিলেন। তারপর ব্যাগ গুছিয়ে উঠে এলেন। আমাকে ডেকে বললেন, একটু বাইরে আসুনকথা আছে।

করিডরে বেরিয়ে আমার আগে লক্ষ করলাম, কুসুম কৌতূহলী নজরে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে।

বসবার ঘরের কাছে এসে ডক্টর দাস আমার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন : ওষুধগুলো আনিয়ে নিন। প্রথম ট্যাবলেটটা রাত দশটা নাগাদ খাইয়ে দেবেন, বাকিগুলো কাল থেকে শুরু হবে। সব লেখা আছে। এখন ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছি–রেস্ট দরকার। যা ধকল গেছে!

আমি যন্ত্রের মতো সব কথা শুনে যাচ্ছিলাম, কিন্তু শেষ কথাটায় একটা ধাক্কা খেলাম। চমকে তার দিকে তাকালাম।

ডক্টর দাস তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, আরে না, না! ঘাবড়াবার কোনও কারণ নেই। আমার কাঁধে একটা হাত রাখলেন সান্ত্বনার ঢঙে। আপনি যা ভাবছেন সেরকম কিছু হয়নি। ভাগ্যিস লোকটা মাঝপথে ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল!

কুসুমের কাছে শোনা সব কথাই ডক্টর দাসকে খুলে বলেছি। কিছুই লুকোইনি। আমি ওঁর মুখটা লক্ষ করছিলাম। লক্ষ করতে করতেই পকেট থেকে ভিজিটের টাকা বের করে ওঁর হাতে দিলাম। শুনতে পেলাম উনি আরও বলছেন? ইউ আর এ লাকি ডগ। নেহাত কপাল ভালো, নইলে আরও অনেক কিছু ঘটে যেতে পারত। যাকগে, এ-নিয়ে আর থানা-পুলিশ করে কোনও ঝামেলা করতে যাবেন না যেন। সেরকম কিছু হলে তখন না-হয় থানা-পুলিশ করতেন। প্রতিবেশি হিসেবে এটাই আমার সাজেশান।

আমি অবাক হয়ে বিলিতি ডিগ্রিওয়ালা মধ্যবয়েসি ডাক্তারবাবুকে দেখছিলাম। একটা অজ্ঞাতকুলশীল লোক আমার স্ত্রীকে আক্রমণ করল, তাকে অপমান করল, এমনকি মারধোরও করল, সেটা আমার মুখ বুজে সইতে হবে। অবশ্য ডাক্তারি মতে আমার স্ত্রীর সতীত্ব ক্ষুণ্ণ হয়নি। হলে পরে থানা-পুলিশ, হইচই, আরও অনেক কিছু করা যেত।

করিডরের উলঙ্গ বালবের আলো ডাক্তার দাসের মুখে পড়েছে। উনি এমনিতে ফরসা, তবে এখন কেন যেন ভীষণ কালো দেখাচ্ছিল। চোখ দুটো কেমন চকচক করছে। ভুরু দুটো কী ঘন, জংলা! ইশ, ঠোঁটের নীচে ডানদিকে যদি একটা বড় আঁচিল থাকত! জানি না, ওর এই চেহারাটা কুসুমের নজরে পড়েছে কি না। পড়লে হয়তো ও আঁতকে উঠত।

ডক্টর দাস ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরোনোর সময়েও বারবার বলতে লাগলেন, ওঃ আপনার স্ত্রী খুব বাঁচান বেঁচে গেছে মশাই, খুব বাঁচান বেঁচে গেছে। কলকাতা শহর বলে কথা, এখানে একটু সাবধানে না-থাকলে চলে।

উনি চৌকাঠ পেরোনোমাত্রই আমি দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলাম। সঙ্গে-সঙ্গে কী খেয়াল হতে ম্যাজিক আই-এ চোখ রাখলাম। দেখলাম, নীল জামা পরা একটা শরীরের অংশ দরজায় ওপিঠে সরে গেল।

.

পরদিন সকালেই অন্যান্য ফ্ল্যাটের ভাড়াটেরা আমার সঙ্গে আলাপ করতে এল।

মনে হল, গতকাল ওরকম একটা ঘটনা না-ঘটলে ওদের সঙ্গে কবে ভালো করে আলাপ হত কে জানে! হয়তো কোনওদিনই হত না। কী করে ওরা খবর পেল জানি না। আমি ওদের কিছু বলিনি। কিন্তু গতকাল রাতে কি ওরা খবর পায়নি? কাল তো কেউ আসেনি। আজ, এই রোদ-ঝকঝকে সকালে, ওরা এসে হাজির। ওদের দেখলে মনে হয় পৃথিবীর কোথাও কোনও বিপদের সম্ভাবনা নেই–কোনওদিন ছিল না।

আমি খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়লাম। কুসুমের এখন বিশ্রাম দরকার। তা ছাড়া, এমন একটা সময়ে অপরিচিতি মানুষগুলোর মুখোমুখি হওয়াটা ওর কাছেও রীতিমতো অস্বস্তিকর। কিন্তু কাউকে সে কথা বলতে পারছিলাম না, আর ওরাও নিজে থেকে বুঝতে পারছিল বলে মনে হল না। যথাসম্ভব সংক্ষেপে গতকালের ঘটনা ওদের বলতে একরকম বাধ্য হয়েছি।

নানাজনে নানা কথা বলছিল।

আচ্ছা, আমাদের পাড়ার পুঁটেদা, চ্যাংলাদা, ওদের দলের কারও কি সামনের দাঁত ভাঙা আছে?

রণবীরবাবু, আপনি খবরের কাগজের আপিসে যান। ওদের সব খুলে বলুন। এইসব রেপ কেসগুলো আজকাল বড্ড বেড়েছে। ব্যাপারটা নিয়ে বেশ নাড়াচাড়া হওয়া দরকার।

আমার মনে হয়, ঘটনাটা পুলিশে জানানো উচিত। লোকটা যখন একবার এই বাড়িটা নোট করে গেছে তখন আবার এখানে ঘুরে আসতে পারে। আপনার ফ্ল্যাটে হয়তো আর কিছু করবে না, তবে আমাদের কারও ফ্ল্যাটে হানা দিতে পারে। আপনারা কী বলেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। সিকিওরিটি বলে একটা ব্যাপার আছে তো!

আমার স্ত্রীও তো মশাই সারাটা দিন একা বাড়িতে থাকে!

চ্যাটার্জিদা, আপনার ওসব ভয় নেই! বুড়োবুড়িদের ফ্ল্যাটে ওসব লোক ঢুকবে না।

তুমি তো ভালো কথাই বললে, ভায়া! আমাদের বুড়োবুড়ির না-হয় ভয় নেই, কিন্তু ছুঁড়ি ঝি-টা রয়েছে না!

ও, হ্যাঁ-হ্যাঁ, কী যেন নাম? লতা, তাই না। হ্যাঁ, ওর চেহারাটা বেশ ডাগর-ডোগর…।

আপনার স্ত্রীর কমপ্লিট রেস্ট দরকার। একটা মেন্টাল চাপও তো গেছে। আপনি না-হয় কিছুদিন অফিস ছুটি নিয়ে নিন।

যদি বলেন তো আমি লোক্যাল থানায় ইনফর্ম করতে পারি। থানার ও.সি. আমার চেনা।

আপনার স্ত্রীর ক্ষমতা আছে! ওইরকম একটা অবস্থার মধ্যেই লোকটার চেহারা মনে রেখেছে। দেখবেন, পুলিশ দু-দিনেই লোকটাকে পাকড়াও করে ফেলবে।

শুনেছি এসব লোকদের আবার নাকি পুলিশে হাত থাকে। কে জানে, ধরার দু-দিন পরে আবার ছেড়ে দেবে কি না। তখন লোকটার আক্রোশ আরও বাড়বে।

আচ্ছা, আপনি আমাদের সত্যদাকে একটু ধরুন না।

সত্যদা?

আরে আমাদের লোকাল এম-এল-এ। সত্যরঞ্জন চাকলাদার। শুনেছি লোকাল লোকদের খুব হেল্প-টেল্প করেন। ওঁর হেল্প পেলে লোকটার সাজা হবেই হবে। গ্যারান্টি।

চলি, আমার আবার অফিস যাওয়ার সময় হয়ে গেল।

ভাবছি, বউকে আর ছেলেকে কদিনের জন্যে বাপের বাড়িতে রেখে আসব।

আপনিও সেখানে চলে যান না, মিস্টার গুপ্ত, তা হলে একটা ফ্ল্যাট খালি হয়। আমার শালা অনেকদিন ধরে বলছিল।

কেন, আমার কি শালা নেই নাকি?

চলি, কাল আবার খবর নেব।

খবরের কাগজের ব্যাপারটা ভুলবেন না যেন।

চলি–।

ওরা সব চলে গেল। আমি বসবার সোফায় মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলাম। জানি, কর্তারা অফিস-কাছারিতে বেরিয়ে গেলেই এরপর একে-একে এ-বাড়ির নানা ফ্ল্যাটের মেয়েরা-বউরা আসবে!

কিন্তু এখন কী করব? কী করা উচিত! নাঃ, থানায় খবর একটা দেওয়া দরকার। আমি খবর না-দিলেও অন্য কেউ খবরটা দিতে পারে। সকলের সিকিওরিটির ব্যাপার রয়েছে।

সুতরাং কাজলের মাকে সতর্ক থাকতে বলে, কুসুমকে ওষুধ খাইয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরোলাম। ডক্টর দাস আজ রাতে একবার দেখতে আসবেন বলেছেন। কিন্তু আমার মনে হয় তার বোধহয় আর দরকার হবে না। ঠিক করলাম থানায় যাওয়ার পথে ওঁর বাড়িতে জানিয়ে দেব।

রাস্তায় পা দিয়ে প্রতিটি পথচারীকে আমি খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। খুঁজতে লাগলাম নীল জামা, জংলা ভুরু, আঁচিল, আর ভাঙা দাঁত। এই শহরেই কোথাও-না-কোথাও আত্মগোপন করে রয়েছে শয়তানটা।

আমার শরীর আবার জ্বালা করছিল।

.

রেপ কেস?

ডায়েরির খাতার ওপরে পেনসিল থামিয়ে অফিসারটি আমার মুখের দিকে তাকালেন।

আমি কী জবাব দেব বুঝে উঠতে পারলাম না।

ওসির সঙ্গে দেখা করেছিলাম। উনিই একজনকে ডেকে আমাকে এই ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। ঘরটা বেশ বড়। তিনটে টেবিল, গোটাচারেক চেয়ার আর কয়েকটা বেঞ্চ পাতা রয়েছে। মাথার ওপরে, পরস্পরের কাছ থেকে কিছুটা দুরে দুটো জম্পেশ ফ্যান কাচকাচ করে ঘুরছে।

ফাঁকা ঘরে মিনিটখানেক অপেক্ষা করার পর একজন উর্দি পরা অফিসার খাতা-পেনসিল হাতে নিয়ে ঢুকেছেন। হয়তো এস-আই টেস-আই হবেন। আমার মুখোমুখি বসে খাতা খুলে প্রথমেই আমার নাম-ঠিকানা সব টুকে নিলেন। তারপর বললেন, কী কমপ্লেন বলুন।

আমি মোটামুটি সব খুলে বলতেই তিনি বললেন, রেপ কেস?

এটা প্রশ্ন না মন্তব্য ঠিক বুঝতে পারলাম না। চুপ করে রইলাম।

অফিসার পেনসিল দিয়ে দাঁত খুঁটতে লাগলেন। শব্দ করে ডায়েরির খাতাটি বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে বসলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হাই তুলে বললেন, লোকটা ধরা পড়লে আপনার ওয়াইফকেই ঝাটে পড়তে হবে। উকিলদের জানেন তো, ওদের মুখে কিছু আটকায় না। কাঠগড়ায় আপনার বউকে দাঁড় করিয়ে উকিলরা অনেক খারাপ-খারাপ প্রশ্ন করবে। যেমন, লোকটা ঠিক কী কী করেছে। শরীরের ঠিক কোথায়-কোথায় হাত লেগেছে। তারপর, ধরুন ইয়ে করার সময় আপনার বউ ঠিক কী কীভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সরকারি ডাক্তাররা আপনার স্ত্রী-কে নানা পরীক্ষা করে দেখবে, জোর করে–মানে ইয়ের সময় জবরদস্তির চিহ্ন আছে কি না…।

হঠাৎই টেবিলে দু-হাতের ভর দিয়ে অফিসার সামনে ঝুঁকে এলেন। আমার মুখের কাছে মুখ এনে বললেন, পারবেন এসব সহ্য করতে?

আমি মিনমিন করে বললাম যে, উনি যা ভাবছেন ঠিক তা নয়। মানে, এটা ঠিক রেপ কেস নয়। বরং অ্যাসাল্ট বা মলেস্টেশান বলা যেতে পারে। আমি সেইরকমই একটা অভিযোগ দায়ের করতে চাই। সোশ্যাল সিকিওরিটির একটা ব্যাপার রয়েছে…।

অফিসার অবাক চোখে আমাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন। তারপর হেসে বললেন, আপনি তো আজব লোক মশাই। রেপ-টেপের ব্যাপার কিছু হয়নি আর ফালতু-ফালতু ডায়েরি লিখিয়ে গায়ে কাদা ছেটাতে চাইছেন! আপনি জানেন…।

অফিসার আরও কীসব বলতে লাগলেন, কিন্তু আমার কানে কিছুই ঢুকছিল না। আমি একনজরে অফিসার ভদ্রলোককে দেখছিলাম। ওঁর বাঁ-গালের ওপরে একটা আঁচিল রয়েছে। গায়ের রং কালো। মোটা জংলা গোঁফ। সামনের কোনও দাঁত ভাঙা নেই।

খুব ইচ্ছে করছিল ওঁর গালের আঁচিলটা এক খাবলায় তুলে নিয়ে ঠোঁটের নীচে ডানদিকে বসিয়ে দিই। গোঁফজোড়া উপড়ে নিয়ে সমান দু-ভাগে কেটে বসিয়ে দিই চকচকে দু-চোখের ওপরে সূক্ষ্ম ভুরুর জায়গায়। আর ভারী নোড়ার গুঁতোয় ভেঙে দিই ওপরের পাটির সামনের একটা দাঁত। তারপর শুধু একটা নীল জামা পরিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা।

হঠাৎ দেখি আমার চোখের সামনেই আঁচিলটা গালের ওপর দিয়ে হেঁটে পৌঁছে গেল ঠোঁটের নীচে ডানদিকে। গোঁফজোড়া জায়গা ছেড়ে উঠে এল, দুভাগে ভাগ হয়ে বসে গেল ভুরুর ওপরে। একটা অদৃশ্য নোড়া যেন দাঁতের পাটিতে পুঁতো মারল। একটা নীল জামা…।

আমি বললাম, ডায়েরিটা ক্যানসেল করে দিন।

এরপর থানা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।

এখন কী করা উচিত? কুসুমের নিরাপত্তার জন্য কিছু একটা আমাকে যে করতেই হবে। আর ওই অত্যাচারের শোধ নিতে চেয়েছিলাম, তাই-বা নেব কেমন করে? শরীরের ভেতরে রক্ত যেন ফুটছে।

অজান্তেই আমার পা-জোড়া এগিয়ে যাচ্ছিল সত্যরঞ্জন চাকলাদারের পার্টি-অফিসের দিকে, কিন্তু আমি জোর করে তাদের থামালাম। রাস্তায় গনগনে রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার চোখের সামনে সত্যরঞ্জন চাকলাদারের মুখটা ভেসে উঠছিল । গায়ের রং কালো, চকচকে চোখ, জংলা ভুরু, ঠোঁটের নীচে আঁচিল, ভাঙা দাঁত। আমি জানি, সত্যি-সত্যি যদি ভদ্রলোককে ওরকম দেখতে নাও হয়, আমার স্ত্রীর আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা শুনলেই তার মুখের চেহারার রদবদল হবে। শেষ পর্যন্ত ওই একইরকম হয়ে যাবে। এমনকী প্রতিবেশীদের পরামর্শমতো খবরের কাগজের অফিসে গেলেও সেখানকার সাংবাদিক বা সম্পাদকের চেহারাও হয়তো পালটে যাবে একইভাবে। সুতরাং বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।

ফেরার পথে আশ্চর্য হয়ে দেখছিলাম, রাস্তায় প্রত্যেকটি মানুষকে একইরকম দেখতে ও কালো রং, চকচকে চোখ, জংলা ভুরু…।

জানি, বাড়ি ফিরে গিয়ে অন্যান্য ফ্ল্যাটের মানুষগুলোকে যদি দেখতে পাই তা হলে তাদেরও হয়তো একইরকম চেহারা দেখব। সত্যিই কি গোটা শহরের প্রত্যেকটি মানুষ একইরকম দেখতে হয়ে গেছে? এবং গতকাল রাতের ঘটনার জন্য কি আমি, আমরা, প্রত্যেকটি মানুষ, সমানভাবে দায়ী? আমরা প্রত্যেকেই কি সমানভাবে কুসুমের আততায়ী? তাই যদি হয়, তা হলে এখন থেকে শোওয়ার ঘরের ওই ভাঙাচোরা আয়নার মুখোমুখি দাঁড়াতে আমার বেশ ভয় করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *