ও হেনরী পুরস্কার বিজয়ী একমাত্র ভাতীয় লেখক আমার বন্ধু গল্পকার অমর মিত্র
অমরের জন্ম- ৩০শে আগস্ট ১৯৫১, বসিরহাট, উত্তর ২৪ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ। আমার জন্ম কলকাতায় ২রা মার্চ ১৯৫১ সালে। অমর আমার চেয়ে প্রায় ছ’মাসের ছোট বয়সে। ওর লেখা গল্প
‘মেলার দিকে ঘর’ গল্পটি পড়ে (৭৪/৭৫ সাল) ওর সাথে আমার পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। তারপর অনেক গল্প ওর পড়েছি। ওর প্রথম প্রকাশিত গল্পের বই ‘মাঠ ভাঙে কালপুরুষ’ অমর আমাকে উপহার দিয়েছিল সে সময়।
ওর লেখা ‘পার্বতীর বোশেখ মাস’ আমার একটি প্রিয় গল্প। ওই ‘মাঠ ভাঙে কালপুরুষ’-বইয়েই গল্পটি আছে। তাছাড়া, ‘বারুদ বালিকা’ আমার প্রিয় গল্প আর একটি। আরও ওর অনেক গল্প পড়ে আমি মোহিত হয়েছি।
প্রায় ৪৭/৪৮ বছর ওর সাথে বন্ধুত্ব আমার। বর্তমানে ও এখন কলকাতা শহরের বাসিন্দা।
১৯৭৪ সালে ‘মেলার দিকে ঘর’ গল্প নিয়ে বাংলা সাহিত্যে তার আত্মপ্রকাশ। ধীরে ধীরে নিজেকে বিকশিত করেছে। প্রথম উপন্যাস ‘নদীর মানুষ’ ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়।প্রথম গল্পের বই ‘মাঠ ভাঙে কালপুরুষ’ ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয়। বইটি সে নিজের খরচে প্রকাশ করেছিল। তখন খরচ হয়েছিল দু’হাজার টাকা। সেই সময় ওই টাকায় মফঃস্বল শহরে দু’কাঠা জমি কেনা হয়ে যেত। কিন্ত সে তা না করে তার প্রথম গল্পের বইটি প্রকাশ করেছিল ওই টাকায়।
তখন সে একটি সরকারী অপিসে কাজ করে। সেই টাকাটা সে তার অফিসের কো-অপারেটিভ সোসাইটি থেকে ঋণ নিয়ে ছিল।
তখন তার বেতন ছিল মাত্র চার’শ টাকা। তা থেকেই সেই ঋণ শোধ বাবদ ১০৪ টাকা কেটে নেওয়া হতো তার বেতন থেকে। ১০০ টাকা মূলধন বাবদ আর সুদ বাবদ ৪ টাকা, মোট ১০৪ টাকা।
সেই টাকা শোধ করতে তার ২০ মাস সময় লেগেছিল বটে, তবে সাহিত্যে তার আসন পাকা হয়ে গিয়েছিল বইটি প্রকাশের পরেই। আমরা বন্ধুরা তার এই বইটি পড়ে ভীষণ আলোড়িত হয়েছিলাম সে-সময়।
২০১৯ সালের ৪-ই সেপ্টেম্বর থেকে ৬-ই সেপ্টেম্বরে কাজাখস্তানের রাজধানী নূর-সুলতান শহরে প্রথম এশিয়ান লেখক সম্মেলনে ( The First Forum Of Asian Countries’ Writers ) একমাত্র ভারতীয় লেখক হিশেবে আমন্ত্রিত হয়। এবং কাজাখস্তানের রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে কংগ্রেস হলে উনুষ্ঠিত উদ্বোধনী মঞ্চে তাঁর লিখিত প্রতিবেদন ‘ মিথিকাল লাইফ’ পাঠ করে। এশিয়া মহাদেশের পাঁচজন লেখককে উদ্বোধনী মঞ্চে আমন্ত্রণ জানান হয়েছিল। সে ছিল তাঁদের অন্যতম একজন লেখক।
ও’ হেনরি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন বাঙালি লেখক অমর মিত্র। ‘গাওবুড়ো ও অন্যান্য গল্প’ বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ ‘দি ওল্ড ম্যান অব কুসুমপুর’-এর জন্য এই পুরস্কার পেলেন তিনি।
‘গাওবুড়ো’ গল্পটি তার ২৬ বছর বয়সে লেখা।
তার জন্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার এল তার কাছে
তার সত্তর বছর বয়সে (যখন সে নিজেই বুড়ো একজন)।
ছোটগল্পের অনবদ্য স্রষ্টা ছিলেন ও’ হেনরি। তাঁর সম্মানে বিশ্বের বাছা বাছা ছোটগল্পকারদের দেওয়া হয় ও’ হেনরি পুরস্কার।
এবারে সেই পুরস্কারে ভূষিত হলেন ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক অমর মিত্র। বহু বছর পর এমন আন্তর্জাতিক পুরস্কার এলো বাংলা সাহিত্যের আঙিনায়।
১৯৭৭ সালে অমর মিত্র লিখেছিলেন একটি ছোটগল্প, গল্পের নাম ‘গাঁওবুড়ো’। গ্রামীণ রাঢ়বাংলার আটপৌরে জীবনের ছবি।
কুসুমপুরের বুড়ো ফকিরচাঁদের অনবদ্য কাহিনি-চিত্র। গত বছর আমেরিকার একটি সাহিত্য পত্রিকা ‘দ্য কমন’-এ গল্পটি প্রকাশিত হয়। ইংরেজি ভাষায় অনূদিত এই গল্পের নাম হয় ‘দি ওল্ড ম্যান অব কুসুমপুর’। অনুবাদ করেছেন অনীশ গুপ্ত। আর সেই গল্পই ও’ হেনরি সাহিত্য পুরস্কার পেলো। তার মুকুটে যুক্ত হল একটি পালক।
পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউসের চিফ এডিটর বৈশালী মাথুর ও’ হেনরি পুরস্কারের সংবাদ শেয়ার করে লিখেছেন—
Thrilled to share Amar Mitra sir’s short story gets the O’Henry prize for short fiction. In a couple of months we publish his beautiful novel, ‘Dhanapatir Char’ translated by dear Jhimli Mukherjee Pandey. Wish she’d been there to see this project come to fruition.
(অমর মিত্র স্যারের ছোট গল্প শেয়ার করতে পেরে রোমাঞ্চিত হলাম ছোট কথাসাহিত্যের জন্য ও’হেনরি পুরস্কার। মাস দুয়েকের মধ্যে প্রিয় ঝিমলি মুখার্জি পান্ডে অনূদিত তাঁর সুন্দর উপন্যাস ‘ধনপতির চর’ প্রকাশ করি। আশা করি তিনি থাকলে এই প্রকল্পটি সফল হতে দেখে যেতে পারতেন।)
ও’ হেনরি পুরস্কারের প্রাপক তালিকায় রয়েছে সল বেলো, অ্যালিস মুনরো, উইলিয়াম ফকনার, ফ্রেডেরিক টুটেন, স্টিফেন কিং এর মতো একের পর এক ভারী নাম। যাঁদের অনেকেই নোবেলজয়ী। এখন সেই তালিকায় যোগ হল বাঙালি সাহিত্যিক অমর মিত্রের নাম। বিশ্ব মানচিত্রে আরও উজ্জ্বল হলো বাংলা ভাষা ও সাহিত্য।
সাহিত্যিক অমর মিত্র তাঁর নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, “রাতে ঘুমতে দেরি হলো, রাতে আমার ঘুম হলো না। এক প্রত্যাখ্যাত গল্প গাঁওবুড়ো। অমৃত পত্রিকার পুজো সংখ্যার বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হওয়ার পরেও গল্প প্রকাশিত হয়নি পত্রিকার বিজ্ঞাপন এসে যাওয়ায়। সাধারণ সংখ্যায় প্রকাশিত হওয়ার পর সম্পাদক বড় লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক আড্ডায় হাজির। মস্ত শরীর নিয়ে চারতলায় উঠে এলেন। হাতে কুবেরের বিষয়-আশয়। জোড়হাতে বললেন, তুমি আমাকে মার্জনা করবে ভাই, পুজো সংখ্যার সেরা গল্প আমি বাদ দিলাম। এই বইটা তোমায় দিলাম। সেই প্রথম পুরস্কার।
এই গল্পের অনুবাদ নিয়ে ১৯৯০ নাগাদ দিল্লি গিয়েছিলাম সাহিত্য অকাদেমির ভারত-আমেরিকা লেখক কর্মশালায়। আমেরিকান লেখক কিট রিড এসেছিলেন। তিনি গল্প পড়ে আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, চাকরি ছেড়ে পেশাদার লেখক হতে। বলেছিলাম, দিদি, তা হবে না, আমার সংসার চলবে না। খাওয়াবে কে? কিটের সঙ্গে এয়ার মেল চিঠিতে যোগাযোগ ছিল বহুদিন। ২০১৭ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর তিনি লস এঞ্জেলস শহরে প্রয়াত হন। কিট এবং শ্যামলদা বেঁচে থাকলে আনন্দ হতো আরো আরো। ”
ধ্রুবপুত্র লেখা হয়েছিল ৭ বছর ধরে। এই উপন্যাস খরা পীড়িত প্রাচীন উজ্জয়িনী নগরের কথা। এর যা কাহিনি তার সমস্তটাই লেখকের নির্মাণ। কবির নির্বাসনে নগর থেকে নির্বাসনে যায় জ্ঞান। মেঘে তার যাত্রাপথ বদল করে নেয়। প্রকৃতির এই পরিবর্তনে নগরে নেমে আসে বিপর্যয়। দীর্ঘ এই আখ্যান শেষ পর্যন্ত শূদ্র জাতির উত্থান ও কবির প্রত্যাবর্তন এ পৌঁছয়। এই কাহিনি যেন কবি কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের বিপরীত এক নির্মাণ। খরা, জলের অভাবে আমার দেশ নিরন্তর দগ্ধ হয়। সেই কাহিনি এখানে এসেছে রূপক হয়ে। মেঘের অভাব জ্ঞানের অভাব। সৃজন কাল বন্ধ্যা হয়ে থাকে। দেশ তার ভিতরে পোড়ে। ক্ষমতা কী ভাবে মানুষকে অন্ধকারে ঠেলে নিরন্তর, এই উপন্যাস সেই কথাও খুঁজে বের করতে চেয়েছে। ২০০৬ সালে এই উপন্যাস সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছে।
১৯৯৮ সালে প্রকাশিত উপন্যাস অশ্বচরিত তথাগত বুদ্ধের ঘোড়া কন্থক ও তার সারথী ছন্দকের কাহিনি। তারা এই আড়াই হাজার বছর ধরে অপেক্ষা করছে রাজপুত্রের প্রত্যাবর্তনের জন্য। এতদিনে এই পৃথিবী হিংসায় পরিপূর্ণ। বঙ্গোপসাগরের তীরে দীঘার ছোট এক হোটেলের খরিদ্দার সংগ্রহকারী ভানুদাস নিজেকে নিজেকে বলে ছন্দক। হোটেলওয়ালার টাট্টু ঘোড়ার পালক সেই ভানুদাস ঘোড়াটিকে বলে কন্থক। বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে ঘোড়াটি পালায়। ভানুদাস সেই ঘোড়ার খোঁজে যায় চারদিকের গ্রামে গ্রামে, হাটে হাটে। রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে কোথায় না ? এই উপন্যাস সময় থেকে সময়ান্তরে যাত্রা করেছে বারে বারে। তথাগত বুদ্ধের সময় থেকে হিংসাদীর্ণ এই সময়ে। সেই ঘোড়াটিও পালাতে পালাতে শেষ পর্যন্ত যেন হিরোসিমায় গিয়ে কালো বৃষ্টির ভিতরে গিয়ে পড়ে। লেখক ভারতীয় প্রতিবেশে জাদু বাস্তবতার ব্যবহার করেছেন এই উপন্যাসে। ঘোড়াটি প্রতি আশ্বিনে পালাত। এইবার পালিয়েছে ঘোর বৈশাখে। প্রকৃতি এক দিনেই দুই ঋতু যেন পার হয়ে গিয়েছিল। এই উপন্যাসের কোনো শেষ নেই যেন। চলতেই থাকে। অশ্বচরিত বাংলা উপন্যাসে এক আলাদা রীতির জন্ম দিয়েছে যেন। লেখক হিংসা আর মৃত্যুর বিপক্ষে জীবনের কথা শুনিয়েছেন। পরমাণু অস্ত্রের বিপক্ষে কথা বলেছেন। ২০০১ সালে এই উপন্যাস বঙ্কিম পুরস্কারে ভূষিত হয়।
কলকাতার সুখ্যাত নাট্যদল অভিনয় করেছে চারটি নাটক, তার গল্প ও উপন্যাস অবলম্বনে। যথাক্রমে, ১) পিঙ্কি বুলি ( গল্প বালিকা মঞ্জরী ),২) দামিনী হে ( গল্প আকাল ও অন্য কয়েকটি তারই গল্প)
৩) পাসিং শো ( নভেলা পাসিং শো )
৪) পুনরুত্থান ( ঐ নামের উপন্যাস )
কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র ধ্রুবপুত্র এবং অশ্বচরিত মঞ্চস্থ করেছেন।
একটিই নাটক লিখেছেন, “শেষ পাহাড় অশ্রু নদী”। করিমপুরের নাট্যদল অশ্রুনদী নামে অভিনয় করেছেন। এবং বেঙ্গালুরুর নাট্য দল স্মরণিক শেষ পাহাড় নামে অভিনয় করছেন।
অমর মিত্রের গ্রন্থ তালিকা
————————————————
১). অমর মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প
২). অর্ধেক রাত্রি
৩). ডানা নেই উড়ে যায়
৪). ধুলোগ্রাম
৫). অশ্বচরিত ( বঙ্কিম পুরস্কার-২০০১ )
৬). আগুনের গাড়ি
৭). ধ্রুবপুত্র ( সাহিত্য একাদেমি-২০০৬)
৮). নদীবসত
৯). কৃষ্ণগহ্বর
১০). আসনবনি
১১). পাঁচটি উপন্যাস
১২). নিস্তব্দ নগর
১৩). প্রান্তরের অন্ধকার
১৪). ভি আই পি রোড
১৫). শ্যাম মিস্ত্রী কেমন ছিলেন
১৬). গজেন ভূঁইয়ার ফেরা
১৭). জনসমুদ্র
১৮). সবুজ রঙের শহর
১৯). নয় পাহাড়ের উপাখ্যান
২০). সারিঘর
২১). শূন্যের ঘর শূন্যের বাড়ি
২২). সোনাই ছিলো নদীর নাম
২৩). হাঁসপাহাড়ি
২৪). পুনরুত্থান
২৫). বহ্নিলতা
২৬). কুমারী মেঘের দেশ চাই
২৭). কন্যাডিহি
২৮). ধনপতির চর
২৯). সেরা ৫০টি গল্প
৩০). একান্নটি গল্প
৩১). প্রিয় পঞ্চাশটি গল্প
৩২). নিসর্গের শোকগাথা
৩৩). ভুবনডাঙা
৩৪). মালতী মাধব
৩৫). কুসুমকুমারী ও মধুবালা
৩৬). বাতাসবাড়ি জ্যোৎস্নাবাড়ি
৩৭). সূর্যাস্তের পথে সূর্যাস্তের দেশে ( ভ্রমণ কাহিনি )
৩৮). ভালো মানুষ মন্দ মানুষ ( অভিজ্ঞতার নির্যাস )
৩৯). হারানো দেশ হারানো মানুষ ( দেশভাগ বিষয়ক আখ্যান)
৪০). একটি গ্রাম একটি নদী
৪১). দশমী দিবসে
৪২). নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান ও অন্যান্য কাহিনি
মোমেনশাহী উপাখ্যান
৪৩). ২১টি গল্প
৪৪). সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে ( জীবন বিষয়ক রচনাদি )।
কিশোর গ্রন্থ :
——————–
১). চাঁদু গায়েনের ডাকাত ধরা
২). পালিয়ে গেল গরম সিং
৩). স্টিফেন হকিঙের চিঠি
৪). ভূতুড়ে কথা
৫). জামাই ষষ্টীর ভূত
৬). রয়াল সার্কাসের গণেশ দাদা
৭). দশটি দশ রকম
৮). নরেন হরেন সাধু মানুষ