Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আবার যদি ইচ্ছা কর || Narayan Sanyal » Page 8

আবার যদি ইচ্ছা কর || Narayan Sanyal

মাসখানেক ভিন্সেন্টকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। ওখান থেকে ছাড়া পাওয়ার আগে মিসেস ঊর্মিলা ডেভিডসনের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল। বোধকরি না হলেই ভাল হত। মিসেস ডেভিডসন যে ফিরে এসেছেন তা ওর জানা ছিল না। সঙ্কোচে প্রশ্নটা সে কাউকে করতে পারেনি, ডক্টর ডেভিডসনকে তো নয়ই।

একদিন নার্স এসে জানালো ভিন্সেন্টকে বড় সাহেব ডেকে পাঠিয়েছেন। হাসপাতাল থেকে অদূরে, ডক্টর ডেভিডসনের কোয়ার্টার্স। সাহেব সেখানেই ছিলেন। বাগানটা পার হয়ে ওঁর ঘরে গিয়ে পৌঁছতেই ডাক্তার সাহেব ওকে আহ্বান করেন, আসুন, আসুন মিস্টার ভান গর্গ। আপনার জন্য একটি সুসংবাদ আছে।

ভিন্সেন্ট মুখ তুলে দেখতে পায় ডাকপিয়ন রঘু দাঁড়িয়ে আছে। বলে, আপকো এক মনি-অর্ডার আসেছে। চালিশ রূপেয়া।

মাসের মাঝখানে এমন মনি-অর্ডার পেতে অভ্যস্ত নয় ভিন্সেন্ট। কুপনটা পড়ে দেখে দিল্লী থেকে সূরয টাকাটা পাঠিয়েছে। মনি-অর্ডার কুপনে লিখেছে, তোমার একটি ছবি বিক্রি হয়েছে। চল্লিশ টাকায়। টাকাটা পাঠালাম।

অদ্ভুত একটা আনন্দ পেল ভিন্সেন্ট। এই তার জীবনের প্রথম সাফল্য। দশ-পনের বছর ধরে সে একটি ফুলগাছের পরিচর্চা করে চলেছে। জল দিয়েছে, গোড়া খুঁড়ে দিয়েছে, সার দিয়েছে আর দিনের পর দিন লক্ষ্য করেছে ফুলগাছে কুঁড়ি এল কিনা! আজ তার সেই চারা গাছে প্রথম ফুল ফুটল। এর পর শুরু হবে তার জয়যাত্রা। স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে ভিন্সেন্ট।

রঘুর কাছ থেকে টাকাটা হাত পেতে নিয়ে প্রথমেই তাকে এক টাকা বসশিশ দেয়। তারপর ডাক্তার সাহেবের দিকে একখানা দশ টাকার নোট বাড়িয়ে ধরে বলে, মিষ্টি আনতে দিন, সবাই খাবে!

একেবারে দশ টাকা? সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেন ডক্টর ডেভিডসন।

–পুরো টাকাটাই দিতাম। কিন্তু বাকি টাকায় কিছু রঙ আর ক্যানভাস কিনতে হবে। বলেন কি ডাক্তার সাহেব? আজ আমার কতবড় আনন্দের দিন জানেন! আজ প্রথম আমার ছবি বিক্রি হল!

এর আগে কখনও হয়নি বুঝি?

না, এই প্রথম।

প্রায় নাচতে নাচতে ভিন্সেন্ট ফিরে আসে তার কেবিনে। সামনে যাকে পায় খবরটা জানায়। কোবাল্ট ব্লু, সিপিয়া, আর ক্রোম ইয়ালোর টিউবগুলো ফুরিয়েছে। ওগুলো আনাতে হবে। আর কিছু ক্যানভাস। প্রথমেই ধরবে একটা সেলফ-পোর্ট্রেট। আচ্ছা, কোন্ ছবিখানা বিক্রি হল? সূরযের কাছে দশ-পনেরখানা ছবি আছে। তার ভিতর কোনখানা? সূরযটা চিরকালই একটা ক্যাবলা। আসল কথাটাই জানাতে ভুলেছে। কোষ্টা বিক্রি হল, কে কিনল তা তো লিখবি! অজ্ঞাত আর্টিস্টের একখানা ছবি নগদ চল্লিশ টাকায় হুট করে কেউ কেনে না। লোকটার নিশ্চয়ই সেটা বিশেষ কারণে ভাল লেগেছে। কী বলেছিল সে? ক্রেতার নামটা পর্যন্ত বলেনি। দিল্লীর কোন ছবির দোকানে সে কি ভিন্সেন্টের ছবিগুলো বিক্রয়াৰ্থে দিয়েছে? তখনই একটি চিঠি লিখতে বসল ভিন্সেন্ট। ব্যাপারটা জানতে হবে।

কুপনের লেখাটা পুনর্বার দেখবার জন্য সে পকেটে হাত দেয়। তারপর মনে পড়ে সে শুধু টাকাটাই নিয়ে এসেছে-কুপনটা পড়ে আছে ডাক্তার সাহেবের টেবিলে। তখনই উঠে পড়ে। আবার ফিরে যায় ডাক্তার সাহেবের খাস কামরায়। কুপনটা ফিরিয়ে আনতে।

ওঁর দ্বারের সামনে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। কথোপকথন কানে আসে। ঊর্মিলা বলছিল, সত্যি সত্যি ওর ছবি কেউ নগদ চল্লিশ টাকা দিয়ে কিনেছে? আমি তো দেখছি ওর অনেক ছবি

বাধা দিয়ে ডাক্তার সাহেব বলেন, –ক্ষেপেছ? এটা বোধহয় ওর ভাইয়ের একটা কারসাজি। দাদার জন্যই সেই তো সব খরচপত্র করছে। এভাবে একটা চল্লিশ টাকার মনি-অর্ডার করে দাদাকে সান্ত্বনা দিতে চায়। সত্যি সত্যি বিক্রি হলে সে নিশ্চয় সব কথা লিখত। কোন্ ছবিটা বিক্রি হল, কে কিনল

–সে-সব কথা বলেনি?

—অনর্গল কত আর মিথ্যে কথা লিখবে বল?

একটা তীক্ষ্ণ ছুঁচ কে যেন আমূল বিদ্ধ করে দিয়েছে ভান গর্গের মাথায়। ছি ছি ছি! এমন সহজ সরল কথাটা সে বুঝতে পারেনি! সত্যি সত্যি ছবি বিক্রি হলে সূরয লম্বা। চিঠি লিখত না? দাদার মত সেও তো আজ পনের বছর ধরে এই দিনটির প্রতীক্ষা করে আছে। একটা নিদারুণ হাহাকারে ওর মনটা ভরে গেল। চোখ ফেটে জল বার হয়ে আসে। কী মূর্খ সে! ও থেকে আবার দশ টাকা সে সকলকে মিষ্টি খেতে দিল।

লজ্জা! কী অপরিসীম লজ্জা! কেবিনে ফিরে এসে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে।

ভিন্সেন্ট ভান গর্গের জীবদ্দশায় তার একখানি মাত্র ছবি বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু করুণাময় ঈশ্বরের ব্যবস্থাপনায় সেকথা সে জেনে যেতে পারেনি।

এর দিন তিনেক পরে। কেবিনে একা শুয়ে আছে ভিন্সেন্ট, মনে হল কে একখানা হাত রাখল তার কপালে। নার্স এভাবে মাঝে মাঝে ওর কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখত, তাই অভ্যস্ত স্পর্শে চোখ মেলে তাকায়। দেখে ওর শয্যাপার্শ্বে দাঁড়িয়ে আছেন মিসেস ডেভিডসন। অত্যন্ত অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে। অপরাধীর মত।

ভিন্সেন্ট স্লান হাসে। বলে, কবে ফিরলেন?

ঊর্মিলা ওর শয্যাপার্শ্বে বসে পড়ে। বলে, -ঘরে আর কেউ নেই ভিন্সেন্ট।

ভিন্সেন্ট চারদিক তাকিয়ে দেখে। বিকেল হয়ে এসেছে। খোলা জানালা দিয়ে পড়ন্ত রোদ এসে কেবিনের মেঝেতে চতুষ্কোণ একটা আলোর আলপনা এঁকেছে। ঊর্মিলা মেমসাহেবের পোশাকেই সেজেছে; আজকাল সে শাড়ি পরে না বোধহয়। ভিন্সেন্ট তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে ঊর্মিলার সেই চুলের গুচ্ছে অনেকখানি অংশ সাদা হয়ে গেছে। অস্তসূর্য-উদ্ভাসিত পশ্চিমাকাশে যেভাবে সোনালী মেঘের কোনায় কোনায় এসে লাগে প্লাটিনাম ব্লণ্ড সাদা মেঘের আস্তর। চোখের কোলেও বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করেছে।

ভিন্সেন্ট বলে, দেখুন তো কাণ্ড! পাগলামি করলাম আমি, আর পালিয়ে বেড়ালেন আপনি!

মিসেস ডেভিডসন একটু ঝুঁকে পড়েন সামনের দিকে। ভিন্সেন্টের হাতখানা তুলে নিয়ে অস্ফুটে পুনরুক্তি করেন, তুমি আমার কথাটা শুনতে পাওনি, ঘরে আর কেউ নেই!

–শুনেছি। কিন্তু তাতে কি?

তাহলে এখনও আপনি-আপনি বলছ কেন ভিন্সেন্ট?

তবে কি বলে ডাকব? ঊর্মিলা?

না! পঁচিশ বছর আগেই তো একদিন আমার নামের লাটা কোন গাঙে ডুবে গিয়েছিল।

ভিন্সেন্ট হাসতে হাসতে বলে, কী বোকা ছিলাম আমি! তাই নয়!

ঊর্মিলা বলে, –এভাবে কেন শাস্তি দিলে নিজেকে? আমি ঠাট্টা করেছিলাম, সেটা বুঝলে না তুমি?

–ঈশপের গল্প পড়েছ ঊর্মি? তোমার কাছে যা ছিল ঠাট্টা আমার কাছে তাই সেদিন ছিল জীবনমরণের সমস্যা।

মাথাটা নিচু হয়ে গেল ঊর্মিলার। কোন জবাব যোগালো না মুখরা মেয়েটির মুখে। ভিন্সেন্টই পুনরায় বলে, তোমার দোষ দিচ্ছি না, ভুল বুঝো না আমাকে। তুমি স্বভাবতই চপল ছিলে। সব কিছুতেই ঠাট্টা-রসিকতায় উড়িয়ে দিতে। তাছাড়া তুমি বারে বারে আমাকে সাবধানও করেছ। স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলে–আমি আকাশকুসুম। রচনা করছি। জেনেবুঝে আগুনে হাত দিয়েছিলাম আমি। আগুন তার স্বধর্ম অনুযায়ী কাজ করে গেছে। দোষ দেব কাকে? দোষ আমি কাউকে দিচ্ছি না।

নিজের ডান হাতের তালুটার দিকে নির্নিমেষ নেত্রে তাকিয়ে থাকে ভিন্সেন্ট।

-কী দেখছ হাতে?

হাতটা মেলে ধরে ঊর্মিলার সামনে। বলে, জীবনে দুটি নারীকে ভালবেসেছিলাম। তাদের প্রণয়চিহ্ন নিত্যসাথী হয়ে রইল আজীবন! আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখলেই তোমাদের দুজনের কথা মনে পড়বে।

–সেও কি তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল?

–হ্যাঁ। কারণ সে তখনই বুঝেছিল–আমি পাগল, বদ্ধ উন্মাদ।

–তখনই কি তোমার মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ দেখা দিয়েছে?

না হলে স্বেচ্ছায় হাতটা এভাবে প্রদীপ-শিখার উপর কেউ ধরে রাখতে পারে?

ঊর্মিলা ধীরে ধীরে ওর হাতের তালুতে হাত বুলিয়ে দেয়।

–আর কোন নারী আসেনি তোমার জীবনে? বিবাহ হয়নি?

–এসেছিল। বাতাসী। সাঁওতাল মেয়ে। দু বছর ঘর করেছি তার সঙ্গে। কিন্তু যে অর্থে তোমাদের দুজনকে ভালবেসেছিলাম সে অর্থে তাকে ভালবাসিনি।

আমরা দুজনেই তাহলে ব্যর্থ করে দিয়েছি তোমার জীবন! আজ এ অবস্থায় আমার ক্ষমা চাওয়াটা প্রহসনের মত শোনাবে! না ভিন্সেন্ট?

হঠাৎ উঠে বসে উত্তেজিত শিল্পী। ঊর্মিলার হাতখানা জোরে চেপে ধরে। উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, -কে বলেছে, আমার জীবন ব্যর্থ! করুণা করতে এসেছ ঊর্মিলা? দুটো মিঠে কথা বলে সান্ত্বনা দিতে এসেছ আমাকে? শুনে যাও–তোমাদের হাসি, তোমাদের ব্যঙ্গ, তোমাদের বিদ্রূপ আমাকে স্পর্শ করেনি! আমি যা দেখেছি, যা যা বুঝেছি, রঙে আর রেখায় তা বন্দী করে ভবিষ্যতের জন্য রেখে গেলাম! আমার সে সৃষ্টির মূল্য একদিন কড়ায়-গণ্ডায় শোধ করতে হবে পৃথিবীকে! আমার জীবন ব্যর্থ নয়!

ডক্টর ডেভিডসনের স্ত্রীর হাতটা আলগা হয়ে যায়। এ যে এখনও বদ্ধউন্মাদ!

ভিন্সেন্ট ওর আতঙ্ক-তাড়িত দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারে ঊর্মিলা কি ভাবছে। কিন্তু থামতে পারে না। সে পুনরায় বলে, -মিসেস ডেভিডসন! একটা কথা মনে রাখবেন। আজ থেকে একশো বছর পরে যদি আপনার নাম কেউ উচ্চারণ করে তবে তা করবে এজন্য নয় যে, আপনি অপরূপ সুন্দরী ছিলেন, এজন্য নয় যে, আপনার বাড়ি-গাড়ি সম্পত্তি ছিল, এজন্য নয় যে, আপনি প্রখ্যাত ডাক্তারের সহধর্মিণী ছিলেন, তারা আপনার নাম স্মরণ করবে, কারণ আপনি ছিলেন শিল্পী ভিন্সেন্ট ভান গর্গের প্রথম প্রেম!

ভিন্সেন্টের মুঠি আলগা হয়ে যায়। আবার শুয়ে পড়ে সে। চোখ দুটো বুজে যায় তার। মিসেস ডেভিডসন ধীরে ধীরে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যায় ঐ বদ্ধউন্মাদের কেবিন থেকে।

মাসখানেক সে ছিল ঐ উন্মাদাশ্রমে। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে এসে উঠল আমার বন্ধুর বাড়িতে। সূরযের সনির্বন্ধ অনুরোধ সত্ত্বেও সে দিল্লীতে গেল না। সূরযও শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারে আসল সমস্যা কোথায়! সত্যিই দাদাকে এনে সে কোথায় রাখবে? তাছাড়া সাময়িক উত্তেজনায় সে যে-কোন মুহূর্তে একটা বিশ্রী কাণ্ড করে বসতে পারে। মাসখানেকের মধ্যেই যে সুরযের বিবাহ হয়েছিল এ সংবাদ আমি কলকাতায় বসে পেলাম। সূরয নিমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছিল আমাকে।

সূরষের দাদা সেদিন সমস্তদিন একখানা ছবি এঁকেছিল!

নিজের কান নিজের হাতে কেটে ফেলার পর আরও তিন মাস বেঁচে ছিল ভিন্সেন্ট। তার প্রথম মাসটা কাটে হাসপাতালে। বাকি দু মাস আমার বন্ধুর বাড়িতে–ভগলু, রঘুবীর আর সরযুপ্রসাদের তত্ত্বাবধানে। ভিন্সেন্টের সারাটা জীবনই একটানা একটা ব্যর্থতার করুণ ইতিহাস। কোথাও সে দুদণ্ড শান্তি পায়নি। এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে তরী ভিড়িয়েছে; টিকতে পারেনি–আবার ভেসে পড়েছে। কিন্তু শেষের এই দু মাস নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেদনাদায়ক।

রাঁচি তখন আর মোটেই ফাঁকা নয়। পশ্চিমের বায়ুবিলাসী ডেংচিবাবুর দল ক্রমাগত আসছেন। ভিন্সেন্টের বাড়ির আশেপাশে যেসব বাড়ি এতদিন তালাবন্ধ পড়ে ছিল একে একে তার দ্বার খোলা হল। কলরব-মুখরিত পুরুষ-নারী-শিশুর দলে ভরে গেল পাড়াটা। সকাল-বিকাল একঝাক প্রজাপতির মত তারা হাওয়া খেতে বার হয়। কখনও দল বেঁধে যায় হুডু, কখনও জোহা। এ তো আনন্দেরই কথা। কিন্তু কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ! দুর্ভাগা ভিন্সেন্টের বরাতে ঐ কৌতুকপ্রিয় কলরব-মুখরিত আগন্তুকরাই দেখা দিল নিষ্ঠুররূপে। ইতিমধ্যে পাগল আর্টিস্টের মুখরোচক ইতিকথা পাড়ায় কারও জানতে বাকি ছিল না। ওর নাম হল কানকাট্টা!

ভিন্সেন্ট তার রঙ-তুলি ক্যানভাস নিয়ে বার হয় আর দূর থেকে চেঞ্জারবাবুদের কৌতুকপ্রিয় ছেলের দল ফেউ লাগে। হাততালি দিয়ে ওরা ডাকে, কানকাট্টা। এই কানকাট্টা।

ভিন্সেন্ট প্রথম প্রথম ভ্রূক্ষেপ করত না, মাথা নিচু করে দ্রুত-পায়ে পরিচিত পাড়ায় গণ্ডিটা অতিক্রম করে যেত। কিন্তু ও-পক্ষও নাছোড়বান্দা-তারাও পিছু পিছু চলতে থাকে পাড়া থেকে বে-পাড়ায়। ক্রমে সমস্ত শহর জেনে গেল কানকাট্টা সেপাইয়ের। মজাদার ইতিহাস! সবাই হাসে, কৌতুকবোধ করে। কখনও বয়ঃজ্যেষ্ঠ কেউ হয়তো বালকদলকে হাসতে হাসতে ভর্ৎসনা করে।

ভিন্সেন্ট রাগ করছে না, পাগলামোর কোনও বহিঃপ্রকাশ দেখাচ্ছে না দেখে ছেলের দল হতাশ হয়। ওরা আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়। দূর থেকে ঢিল মারে, ধুলো ছিটিয়ে দেয় পিছন থেকে ধাক্কা মেরে ছুটে পালিয়ে যায়। নিরুপায় ভিন্সেন্ট ওদের সঙ্গে ভাব করবার চেষ্টা করে। ও যে পাগল নয় এটা প্রমাণ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে-ভাব জমাতে চায়, ছবি এঁকে দিতে চায়, গল্প শোনাতে চায়। কিন্তু শিশু দৈত্যের দল তাতে খুশি হয় না। আশাভঙ্গে তারা আরও মরিয়া হয়ে ওঠে। রাঁচিতে এসে পাগল দেখার আনন্দকে ওরা ছাড়বে কেন? ভিন্সেন্ট যেন বিশ্বাসঘাতকতা করছে–তার পাগলামিকে প্রচ্ছন্ন রেখে!

বাধ্য হয়ে আউট-ডোর পেইন্টিং বন্ধ করে দিল ভিন্সেন্ট। ঘরে বসেই আঁকতে শুরু করে। অবশ্য শীতকালেই আউট-ডোর ল্যাণ্ডস্কেপ জমে ভাল। কিন্তু উপায় কি? ওরা যে সত্যিই পাগল করে ছাড়বে তাকে।

তা ঘরের ভিতরেই কি শান্তিতে আঁকতে দেবে ছেঁড়াগুলো?

শিশুদলের মধ্যে কবিযশপ্রার্থী কেউ ইতিমধ্যে একটা ছড়া বেঁধে ফেলেছে। সাত সকালে ওরা এসে হাজির হয় বাড়ির আশেপাশে। ক্রমাগত ছড়া কাটেঃ

কানকাট্টা কানকাট্টা ডান কানটা কই?
কোন্ পেত্নী গাছে তুলে কেড়েছে তোর মই?
কানটা নিয়ে ভাগল বুঝি!
বৃথাই তারে মরিস খুঁজি!
বাঁ কানটা দে না কেটে, খেতে দেব দই।

ভিন্সেন্ট বুঝতে পারে–এ শুধু শিশুর চাপল্য নয়, এর পিছনে পরিণত বয়সের ছাপ আছে। না হলে হঠাৎ পেত্নীর প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হত না। এই বালখিল্যদলের হাত থেকে কি করে নিস্তার পাওয়া যায়? সরপ্রসাদ, ভগলু অথবা রঘুবীর মাঝে মাঝে এসে ওদের তাড়িয়ে দেয়। ওরা ছুটে পালায়। আবার যেই ভগলুরা দূরে সরে যায় ওরা ঘনিয়ে আসে। হাততালি দিয়ে শুরু করে যৌথ-সঙ্গীত : কানকাট্টা কানকাট্টা, ডান কানটা কই?

দিবারাত্র এই ছড়া শুনতে শুনতে ভিন্সেন্টের মাথা ঝিমঝিম্ করে উঠত। ওর মনে। পড়ে যেত জোড়-জাঙালের সেই যোসেফ মুর্মুর কথা। যোসেফ মৃত্যুকে অস্বীকার করেছিল, যোসেফ মরতে চায়নি; তাই তার ভাগ্যবিধাতা তাকে এমন অবস্থার মধ্যে। এনে ফেলেছিলেন যখন মৃত্যুই তার একমাত্র কাম্য ছিল। আজ ভিন্সেন্টের অবস্থাও সেই রকম। মস্তিষ্কবিকৃতির সম্ভাবনাকে সে ঠেকাতে চেয়েছিল, সে পাগল হতে চায়নি আজ তার ভাগ্যবিধাতা তাকে এমন অবস্থায় পেড়ে ফেলেছেন তার মনে হচ্ছে ঐ। বালখিল্যদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার একমাত্র উপায় সত্যি পাগল হয়ে যাওয়া। তখন আর ওদের বিদ্রূপ তার গায়ে লাগবে না।

–কানকাট্টা কানকাট্টা, ডান কানটা কই?

আর তো পারা যায় না! ভিলেন্ট দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়। দু হাতে কান চেপে । ধরে বসে থাকে। এ কী বিড়ম্বনা! শিশুর দল কী অপরিসীম নিষ্ঠুরই না হতে পারে!

মাঝে মাঝে ওরা ছন্দ বদলায়। অন্য কোন শিশুকবি একটি ব্যঙ্গ কবিতা লিখে বৈচিত্র্যের সন্ধান করেছে বোধহয়। সেদিন ওরা হাততালি দিয়ে নতুন সুরে শুরু করেঃ

গর্গমশাই গর্গমশাই করছ তুমি কি?
এই দেখ না আমি কেমন ছবি এঁকেছি!
বন্ধু ছিল, নাকটা তাহার কাটতে গিয়েছি;
কচাৎ করে ভুলেই নিজের কানটা কেটেছি!

হল না, কিছুই হল না। অথচ চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি ভিন্সেন্ট নিষ্ঠায় তার কোন ফাঁকি ছিল না। জীবনে কী পেল সে? শুধুই উপেক্ষা, অবহেলা আর বিদ্রূপ! কিন্তু কেন? সে তো এমন প্রকাণ্ড কিছু দাবী করেনি! সে শুধু চেয়েছিল তার অন্তরের আকুতিকে রঙ আর রেখায় মূর্ত করতে। এই দুনিয়ার আলো বাতাস, গাছপালা, ফুল-ফল-পাখি তার ভাল লেগেছিল–দুনিয়াদারী করতে গিয়ে যে হতভাগা-দলের মেরুদণ্ড বেঁকে গেছে তাদের জন্য ও দু ফোঁটা চোখের জল ফেলতে চেয়েছিল; অমর্ত্যলোকের বার্তা পেয়ে যখন তার অন্তর অনির্বচনীয় আনন্দে বিভোর হয়ে গিয়েছিল তখন সে সেই কথা জানাতে চেয়েছিল তার কাগজে আর ক্যানভাসে। তোমাদের তা ভাল লাগেনি। বেশ কথা। তোমরা তা তোমাদের ঘরে সাজিয়ে রেখ না। তার সৃষ্টি না হয় স্রষ্টার সঙ্গে মুছে যাবে। কিন্তু কেন উপেক্ষার সঙ্গে অপমান যোগ করছ? কেন প্রত্যাখ্যানের সঙ্গে বিদ্রুপের কষাঘাত চাপিয়ে দিচ্ছ? কী ক্ষতি আমি করেছি তোমাদের?

‘–বাঁ কানটাও দে না কেটে খেতে দেব দই!’

দই খাওয়ার লোভে নয়, ওদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার লোভে মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় দ্বিতীয় কানটাও ওদের ছুঁড়ে দেয়! তাহলে কি থামবে ওরা? সত্যিই থামবে? পালিয়ে যাবে ওর ঘরের সামনে থেকে? যেমন করে পালিয়ে গিয়েছিলেন মিসেস ডেভিডসন?

‘–কোন্ পেত্নী গাছে তুলে কেড়েছে তোর মই?’

সংযমের সব বাঁধন ভেঙে যায়। দুরন্ত ক্রোধে দরজা খুলে হঠাৎ বেরিয়ে আসে ভিন্সেন্ট। ওদের তাড়া করে ধরতে যায়। ওরাও ছুটে পালায়। চিৎকার করে ওঠে, — পাগলা ক্ষেপেছে রে!

ছুটতে ছুটতে চলে যায় ওর নাগালের বাইরে। সেখান থেকে ঢিল ছুঁড়তে শুরু করে। দ্বিগুণ উৎসাহে ওখান থেকে আবার ছড়া কাটে।

–কানকাট্টা কানকাট্টা, ডান কানটা কই?

রাগে অপমানে ভিন্সেন্ট থরথর করে কাঁপতে থাকে।

হঠাৎ একটা আধলা ইট এসে লাগে ওর মাথায়।

হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় ধুলোর উপর। দু হাতে মাথাটা চেপে ধরে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে ভিন্সেন্ট। আরও কয়েকটা ঢিল এসে পড়ে-মাথায়, মুখে, পিঠে। ভিন্সেন্ট। কী করছে জানে না। সে ধুলোর উপরেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। দু হাত উর্দ্ধ আকাশের দিকে তুলে চিৎকার করে ওঠে, –হে ঈশ্বর! আমাকে সত্যিই পাগল করে দাও তুমি!

পরক্ষণেই ওর সম্বিৎ ফিরে আসে। এ কী করল সে! সে না নাস্তিক? সে না ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী? আজ মর্মান্তিক যন্ত্রণায় সব ভুল হয়ে গেল তার। না! ভিন্সেন্ট ভান গর্গ যোসেফ মুর্মু নয়! হার সে মানবে না! আবার উঠে দাঁড়ায়। টলতে টলতে ফিরে যায় তার ঘরের দিকে।

অমনি গুটিগুটি এগিয়ে আসে বালখিল্যের দলঃ

গর্গমশাই, গর্গমশাই করছ তুমি কি?
এই দেখ না আমি কেমন ছবি এঁকেছি!
বন্ধু ছিল নাকটা তাহার কাটতে গিয়েছি।
কচাৎ করে ভুলেই নিজের কানটা কেটেছি!

.

পরদিন ভিন্সেন্ট বসেছিল একখানা সেলফ-পোর্ট্রেট আঁকতে। আয়নায় নিজের মুখখানা দেখে আঁকবে। নিজের মুখটা দেখেই মনটা খিঁচড়ে যায়। ডান কানটা কাটা! কানকাটা সেপাই! ক্ষণিক উন্মাদনায় সে নিজেই নিজের কান কেটেছে। সে লজ্জার কথা দুনিয়া ভুলে যাবে দুদিন পরে–যেদিন মাটির তলায় ওরা শুইয়ে দেবে ব্যর্থ-আর্টিস্ট ভান গর্গকে। কিন্তু একথা তো নিশ্চিত যে, একদিন পৃথিবী নতমস্তকে স্বীকার করবে তার সৃষ্টিকে। আজ সে যদি সেলফ-পোর্ট্রেট আঁকে তাহলে ওর লজ্জার ইতিহাসটাও শাশ্বত হয়ে থেকে যাবে পৃথিবীতে। সে ভুল ও করবে না। নিজের ছবি সে আর আঁকবে না। আচ্ছা, কতদিন বাঁচবে সে? তা কে বলতে পারে? মিকেলাঞ্জেলো বা তিশান নব্বই বছরের কাছাকাছি বেঁচে ছিলেন। ক্লোদ, গোইয়া, কোরো আশী বছরের চেয়েও বেশিদিন এঁকে গেছেন ছবি। প্রথম দরের শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সে মারা যান রাফাইল, মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে। অর্থাৎ ভিন্সেন্টের বর্তমান বয়সে। কিন্তু এত কম বয়সে নিশ্চয় মারা যাবে না সে! মৃত্যুর পদধ্বনি এখনও শোনা যাচ্ছে না। অনেক দূরে সে দিন। দশ-বিশ-ত্রিশ-পঞ্চাশ বছর! অনেক, অনেক ছবি আঁকতে হবে ইতিমধ্যে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চিত্রকরের ছবির পাশে থরে থরে একদিন সাজানো হবে সেসব ছবি। আচ্ছা, সেই পরিণত বয়সে ভিন্সেন্টকে কেমন দেখতে হবে? দাড়িওয়ালা লিওনার্দোর মত, না কি তোবড়ানো গাল মিকেলাঞ্জেলোর মত?

হঠাৎ ওর মাথায় একটা আইডিয়া এসে গেল। নিজের প্রতিকৃতি তো সব বড় জাতের আর্টিস্টই এঁকেছেন! লিওনার্দো, মিকেলাঞ্জেলো, তিশান, রেমবান্ট, মায় গগনেন্দ্রনাথ, নন্দলাল পর্যন্ত সেলফ-পোর্ট্রেট এঁকেছেন দর্পণে প্রতিবিম্ব দেখে। ভিন্সেন্ট নূতন কিছু করবে। মনের মুকুরে সে দেখবে অনাগত ভবিষ্যতে নিজের পরিণত রূপ! আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর পরে ওর অশীতিতম জন্মদিনে ওকে কেমন দেখতে হবে তাই ফুটিয়ে তুলবে রঙে আর রেখায়। ততদিনে সে নিশ্চয়ই স্বীকৃতি পাবে।

কল্পানায় ভিন্সেন্ট দেখতে থাকে ছবিটা। ভিন্সেন্টের অশীতিতম জন্মোৎসবে সমবেত হয়েছেন দেশের জ্ঞানীগুণী শিল্পীবৃন্দ। মাঝখানে একটা পিঠ-উঁচু ভিক্টোরিয়ান চেয়ারে বসে আছেন জ্ঞাননিধূর্তকল্মশ অশীতিপর ভান গর্গ; তার কপালে চন্দনের ফোঁটা, গলায় থরে থরে শ্বেতপদ্মের মালা। একপাশে ভক্তের দল সারি দিয়ে দাঁড়িয়েছে, আর পাশে কয়েকটি তরুণী এসেছে মাঙ্গলিকী নিয়ে। শঙ্খধ্বনি করছে, বরণ করছে, শ্রদ্ধার্ঘ্য নামিয়ে রাখছে। চিত্রের কেন্দ্রবিন্দু ঐ জ্ঞানবৃদ্ধ শিল্পী! না! ছবিটা সে তিন ধাপে আঁকবে। তিনতলা ছবি। অজন্তার সপ্তদশ বিহারে অন্তরালের বাঁ-দিকের প্রাচীরে যেমন আছে বুদ্ধদেবের ত্রিতল চিত্র-সম্ভার। একতলায় সিংহাসনে আসীন বুদ্ধদেব। তাঁর দক্ষিণে রাজন্যবর্গ–বিম্বিসার, অজাতশত্রু, প্রসেনজিৎ, আর বামে শিষ্যের দল সারিপুত্র, মহা মোগল্ল্যায়ন, আনন্দ প্রভৃতি। দ্বিতলে দেখা যায় বুদ্ধদেব ত্ৰিত্রিংশস্বর্গের সোপান বেয়ে মর্তে নেমে আসছেন, আর ত্রিতলে সর্বোচ্চস্তরে অজন্তা শিল্পী এঁকেছেন স্বর্গের দৃশ্য। সুরসুন্দরী এবং দেবগণের মাঝখানে সদ্ধর্মের ব্যাখ্যা করেছেন গৌতম বুদ্ধ।…. ঐ রকম ত্রিতল চিত্রের মাধ্যমে ভিন্সেন্ট ভান গর্গ রেখে যাবে এক শাশ্বত কীর্তি–তার অনাগত ভবিষ্যৎ জীবনের এক আলেখ্য। সর্বনিম্ন স্তরে শিল্পীর অশীতিতম জন্মোৎসব, দ্বিতীয় স্তরে ভিন্সেন্টের মৃত্যু! মাঝের ছবিটার কম্পোজিশান হবে অজন্তার উনবিংশতিতম গুহায় মহাপরিনির্বাণ বাসরিলিকের মত। অনুগ্রাহী ভক্তের দল হাহাকার করছে। আর সর্বোচ্চস্তরে দেখা যাবে, স্বর্গে একদল দেবদূত মেঘের উপর থেকে ঝুঁকে পড়ে দেখছেন। মর্তের দৃশ্য। তারা অপেক্ষা করছেন নূতন আগন্তুক অতিথির! তারা কারা?-ঐ লিওনার্দো, মিকেলাঞ্জেলো, তিশান, এল গ্রেকো, রেমব্রান্ট, রুবেন্স, ভেলাসকেথ, গোইয়া, মানে, মনে, দেগা… ।

ভিন্সেন্ট ছবি আঁকে আত্মহারা হয়ে। তৎক্ষণাৎ সে নিয়ে বসে রঙ-তুলিক্যানভাস। সর্বনিম্ন স্তরের ছবিখানা তখনই আঁকতে বসে। অশীতিপর বৃদ্ধ ভিন্সেন্ট ভান গর্গের সম্বর্ধনাসভার চিত্র। সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠেছেন শিল্পী, সকলের স্বীকৃতি পেয়েছেন, শ্রদ্ধা পেয়েছেন বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে!

কিন্তু ওরা কি দেবে অনাগত ভবিষ্যতের সে রঙিন কল্পনায় মগ্ন হতে? ভবিষ্যতের সাফল্যকে পিছন থেকে টেনে ধরে বর্তমানের বিদ্রূপঃ

কানকাট্টা কানকাট্টা ডান কানটা কই?
কোন্ পেত্নী গাছে তুলে কেড়েছে তোর মই?

একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায় বারে বারে। বারান্দায় বেরিয়ে এসে হাত দুটি জোড় করে বলে, অন্তত একটা দিন আমাকে রেহাই দাও ভাই! আজ আমাকে একটা ছবি আঁকতে দাও! কাল এসে আমাকে খেপিও; আমি কিছু বলব না!

ওরা হাততালি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে।

–পাগলা ছবি আঁকবে রে! গর্গমশাই করছ তুমি কি? এই দেখ না আমি কেমন ছবি এঁকেছি।

হতাশ হয়ে ফিরে আসে ভিন্সেন্ট। জানালাটা বন্ধ করে দেয়। যতটা এড়ানো যায় ঐ মর্মভেদী শব্দ! কিন্তু জানালা বন্ধ করলে আলোও কমে যায়। সু উপায় নেই।

সমস্ত দিন ধরে ভিন্সেন্ট ছবি আঁকল। শেষ করল তার অশীতিতম জন্মদিনের চিত্র! সমস্ত দিনই ওরা ছড়া কাটল তীক্ষ্ণ স্বরে, পালা কবে। ভিন্সেন্ট স্বজ্ঞানে কিছু আঁকেনি। আচ্ছন্নের মত মন যা চেয়েছে তাই এঁকে গেছে। ডান হাতের উপর তার অধিকার হারিয়ে গেছে যেন।

সন্ধ্যাবেলায় ছেলের দল ক্লান্ত হয়ে ফিরে গেল। ভিন্সেন্টও ক্লান্ত হয়ে উঠে পড়ে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সমস্ত দিনমান যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। যেন আজই তার অশীতিতম জন্মোৎসব পালন করা হল। যেন সারাটা দিনমান ওর অন্ধ ভক্ত আর স্তাবকের দল বাইরের বাগানে ওর জয়ধ্বনি দিয়েছে। এখন উৎসব-শেষে শ্রান্তদেহে ও বিশ্রাম খুঁজছে।

লণ্ঠনটা জ্বেলে নিয়ে সরযূপ্রসাদ ঢুকল ঘরে। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে বাইরে। হঠাৎ লণ্ঠনটা তুলে ধরে সরযূপ্রসাদ সদ্য সমাপ্ত ছবিখানা দেখল। ওর মহোত্তম শিল্পের প্রথম দর্শক। ভিলেন্ট অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে। সরযু কী বলে শুনতে হবে। অনেকক্ষণ ছবিটা নিরীক্ষণ করে অবশেষে সরযূপ্রসাদ তার মতামত প্রকাশ করে, ইয়ে বুঢ়া রোতে কেঁও?।

— রোতে কেঁও? কাঁদছে? কে? সাফল্যের আনন্দে অশীতিপর বৃদ্ধ ভিন্সেন্ট ভান গর্গ কি কেঁদে ফেলেছেন? অসংখ্য ভক্ত আর স্তাবকের মাঝখানে সে অশীতিতম জন্মদিনে বৃদ্ধ ভান গর্গের চোখে আনন্দাশ্রু এঁকেছে নাকি? ভিন্সেন্ট জবাবে বলে, দূর বোকা! কাঁদবে কেন? ও তো হাসছে! দ্যাখ না ভাল করে

-আপ দেখিয়ে না?

আলোটা উঁচু করে ধরে সরযুপ্রসাদ।

হুমড়ি খেয়ে পড়ে ভিন্সেন্ট। যেন ছবিটা এই প্রথম দেখছে সে! কী আশ্চর্য! কী অপরিসীম আশ্চর্য! এ কী এঁকেছে ভিন্সেন্ট! কোথায় তার ভক্ত স্তাবকের দল? সেই বরণমালা হাতে, শঙ্খ হাতে, চন্দনের বাটি হাতে মেয়ের দল কোথায় গেল? এ ছবি কে এঁকেছে?

ক্যানভাস জুড়ে একটি মাত্র বৃদ্ধের ছবি। হাতলহীন চেয়ারে বসে আছে দু হাতে মুখ ঢেকে। নিরতিশয় ব্যর্থতায়, অপমানে ভেঙে পড়েছে বৃদ্ধ। পরনে তার কয়েদীর পোশাক। কয়েদী? না। ওটা উন্মাদাগারের সেই বিচিত্র নিকার-বোকার! বৃদ্ধ উন্মাদ দু হাতে মুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কাঁদছে। ঘরে আর কেউ নেই, কিছু নেই! শুধু ধিকিধিকি জ্বলছে ফায়ার-প্লেসে ফেলে আসা জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার তুষানল!

একটা আর্তনাদ বের হয়ে এল সাঁইত্রিশ বছর বয়সে ভিন্সেন্টের কণ্ঠনালী থেকে অশীতিপর ভিন্সেন্টের দুর্দশা সে সইতে পারল না!

সমস্ত রাত ঘুম এল না ভিন্সেন্টের। পায়চারি করে ফিরল বারান্দায়। এভাবে বেঁচে থেকে কী লাভ? আজ সে সুস্থ সবল আছে, কিন্তু পূর্ণিমা আসতে আর মাত্র দিন সাতেক বাকি। তিন মাসের মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। এবার মানসিক স্থৈর্য হারিয়ে সে কি করবে? উলঙ্গ হয়ে বেরিয়ে যাবে রাস্তায়? আত্মহারা হয়ে কি খুন করে বসবে প্রতিবেশীর ঐ সাত বছরের বাচ্চাটাকে? বিচিত্র নয়! সাতদিন পরে সে হয়তো ওদের বিদ্রুপে উন্মাদ হয়ে ছুটে বেরিয়ে আসবে বাগানে। ঐ ফুটফুটে বাচ্চাটা হয়তো ছুটে পালাতে পারবে না, হুমড়ি খেয়ে পড়বে লাল কাঁকরের রাস্তার উপর। আর বদ্ধ উন্মাদ ভিন্সেন্ট ভান গর্গ ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মত ছুটে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়বে তার উপর। হয়তো দুহাতে টিপে ধরবে ওর সরু কণ্ঠনালী, হয়তো উপড়ে নেবে ওর চোখ দুটো, হয়তো–আঃ!

-ঈশ্বর! এ কী করলে তুমি? আমি শিল্পী হতে চেয়েছিলাম! তুমি আমাকে নররাক্ষস করে তুলেছ!

না না! ঈশ্বর নেই! ঈশ্বরকে অভিশাপ দিয়ে লাভ নেই! সে একটা ব্যাধিতে ভুগছে। সাতদিন পরে নিজের উপর তার কোন অধিকার থাকবে না। সে কী করবে, কী বলবে সে জানে না। আজই বা তাই জানে নাকি? এই যে সারাটা দিনমান সে যে ছবিখানা এঁকেছে, তা কি স্ব-ইচ্ছায়? এখন তো সে উন্মাদ নয়, তবু তার ডান হাতখানা তো স্বেচ্ছাচারিতা করে গেছে, নির্বিচারে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সে আঁকতে চেয়েছিল তার পরিণত জীবনের সাফল্যের চিত্রতার ব্যভিচারী হাত এঁকে বসল চরম ব্যর্থতার ছবি! শিল্পী যদি নিজের ইচ্ছানুসারে শিল্পসৃষ্টি করতে অসমর্থ হয়ে পড়ে তবে তার বেঁচে থাকার কী অর্থ? এর পর স্বেচ্ছাচারী ডান হাতখানা তার নির্দেশ অমান্য করে হয়তো এমন সব ছবি এঁকে যাবে–যা সে আঁকতে চায় না, যার বিষয়বস্তু তার অন্তরের নির্দেশে রূপায়িত নয়! লোকে বলবে, ভান গর্গের ভীমরতি হয়েছে–এত নিম্নস্তরের ছবি সে এঁকেছে? আলুর ভোজ, সিঙারণের সেতু, জোড়-জাঙাল গীর্জা, সূরযমুখী, পোস্টম্যানের আলেখ্য, পাগলাগারদের প্যারেডের দৃশ্য এঁকেছে যে হাত, সেই হাতই এমন অশ্লীল কদর্য ছবি আঁকতে পারে!

না, না, না! সে দুর্ঘটনা ঘটতে দেবে না ভিন্সেন্ট! কিছুতেই নয়!

সূরয তুমি আমাকে ক্ষমা কর। বিশ্বাস কর, মরতে আমি চাইনি, মরতে আমি চাই! কিন্তু আমার উপায় নেই। ডান হাত অন্যায় করলে তাকে আমি শাস্তি দিতে পারি– কিন্তু মনকে আমি ধরব কোন্ প্রদীপ শিখায়? তাই বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবার আগে আমি সজ্ঞানে নিজে হাতে টেনে দিতে বাধ্য হলাম এ-জীবনের যবনিকা! মিকেলাঞ্জেলো, তিশান, গোইয়ার মত পরিণত বয়সে শিল্পসৃষ্টি করার ভাগ্য নিয়ে আমি আসিনি। ক্ষতি কি তাতে? রাফাইল তো সাঁইত্রিশ বছর বয়সেই অমর হয়ে আছেন। আমিও তাই থাকব।

বিদায় সূরয! বিদায় পৃথিবী!

যথানিয়মে সকালবেলা সেজেগুজে গরম জামা পরে বালখিল্যের দল এল পাগলাকে খেপাতে। কিন্তু ছড়া কাটার সুযোগ পেল না তারা। আজকের লুকোচুরির খেলায় পাগলা তাদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে। প্রতিবেশীর সেই সাত বছরের ছেলেটা–যাকে বাঁচাতে ভিন্সেন্ট এই শেষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই প্রথম আবিষ্কার করল তার দেহটা। চিৎকার করে উঠল সে।

বারান্দার উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে ভিন্সেন্ট। মাথাটা ঝুলছে বারান্দার ধার থেকে। আর ঝুলে পড়েছে তার বিশ্বাসঘাতক ডান হাতখানা। সেই হাতের একটা শিরা পেন্সিল কাটা ছুরি দিয়ে কেটে ফেলছিল ভিন্সেন্ট। রক্তের ধারা নেমে এসেছে সান বাঁধানো মেঝে থেকে সিঁড়িতে বাগানের ফুলে-ভরা সূরযমুখী ফুলের গাছগুলোর দিকে বিসর্পিল রেখায়। ক্রমাগত রক্তক্ষরণে নিস্তেজ হয়ে সে লুটিয়ে পড়েছে মেঝের উপর। মাঘের শীতে তার শরীর হিম হয়ে পড়ে আছে!

তবু দুর্জয় তার প্রাণশক্তি! এর পরেও তিনদিন বেঁচে ছিল। খবর পেয়ে দিল্লী থেকে আবার ছুটে এসেছিল ওর ছোটভাই সূরযভান।

দেড়দিন পরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে ভিন্সেন্ট দেখতে পেল তাকে। স্নান হাসল ভিন্সেন্ট। অস্ফুটে বললে, –আশ্চর্য সূরয! যখনই তোর জন্যে প্রাণ কেঁদে উঠেছে তখনই চোখ মেলে দেখি তুই বসে আছিস! সেই কান কাটার দিনটার কথা মনে আছে সূরয?

শেষ বারো ঘন্টা সূরয একাই বসে ছিল মৃত্যুপথযাত্রীর শয্যাপার্শ্বে।

শিশুদৈত্যের দল আর ছড়া কাটতে আসেনি। তারাও ওকে মুক্তি দিয়েছিল। ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছিল ভিন্সেন্ট কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জ্ঞান ছিল তার। সূরযকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছিল? দুঃখ করিস না রে! এই ভাল হল! এ ছাড়া পথ ছিল না!

উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়েছিল সূরয। প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পায়নি।

–আমার ছবিগুলো সব যত্ন করে রেখে দিস! বিশ্বাস রাখিস্যাবার আগে বলে গেলাম–একদিন না একদিন ওর দাম পৃথিবীকে কড়া-ক্রান্তি হিসাবে মিটিয়ে দিতে হবে!

সূরয ওর হাতখানা ধরে শুধু বলেছিল, চুপ কর, দাদা!

-এখনই চুপ করব রে। শুধু একটা কথা কানে কানে বলে যাই। এ আমার অন্তিম ইচ্ছা। তোর ছেলে হলে তার নাম রাখিস ভিন্সেন্ট ভান গর্গ। আমি আবার ফিরে আসব; তোর ছেলে হয়ে জন্মাব, নামটাও তাই রাখিস।

সূরয ওর হাতখানা ধরে শুধু বলেছিল, চুপ কর, দাদা!

প্রদীপ নেববার আগে একবার শেষবারের মত দপ্ করে জ্বলে ওঠে। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে তেমনি হঠাৎ উঠে বসতে চেয়েছিল ভিন্সেন্ট। শূন্য দ্বারপথে সে কোন অপার্থিব মূর্তি দেখতে পেয়েছিল। বললে, –ঐ, ঐ ওরা এসেছে।

সূরয সচকিত হয়ে দ্বারের দিকে তাকায়। কেউ নেই সেখানে। ভিন্সেন্ট চিৎকার করে ওঠে, কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে?..শিবলোক, বৈকুণ্ঠ? ওসব আমি বিশ্বাস করি না। না, আমি যাব না!…এরা আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে থাকে তাতে তোমাদের কি?…হা হা, কতবার বলতে হবে?…আমি এই পৃথিবীতেই আবার জন্মাতে চাই। আবার এই নরক যন্ত্রণা সইতে চাই সর্বাঙ্গ দিয়ে!…তাতে তোমাদের কি? ঐ সূরযের বৌয়ের কোলে ফিরে আসব আমি! যাব না! না, আমি কিছুতেই যাব না তোমাদের সঙ্গে!

এই তার শেষ কথা।

যাব না, যাব না, বলতে বলতেই চলে গেল সে!

কাহিনী শেষ করে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলে দ্বৈপায়নদাদু।

বুঝতে পারি, বেশ অভিভূত হয়ে পড়েছেন বৃদ্ধ। চোখ থেকে চশমাটা খুলে কঁচটা মুছতে মুছতে বলেন, নরেন, তুমি কি ভান গর্গের জীবনী লিখবে, না উপন্যাস?

না, জীবনী নয়, উপন্যাসই লেখবার ইচ্ছে আছে আমার। কেন বলুন তো?

–তাহলে এবার যে কথাটা বলছি সেটা তোমার বইতে লিখ না। ভিন্সেন্টের শেষ ইচ্ছাটাও করুণাময় পূরণ করেনি! ভিন্সেন্টের মৃত্যুর শোক সহ্য করতে পারেনি সূরয। সে উন্মাদ হয়ে যায়। মাত্র ছ মাসের মধ্যে বদ্ধ উন্মাদ অবস্থায় সে মারা যায়। ওর সদ্য বিবাহিত স্ত্রী তার চিতাভস্ম নিয়ে এসে ভিন্সেন্টের কবরের পাশে প্রোথিত করে। দুই ভাইয়ের সমাধিক্ষেত্রে একটি আইভিলতা রোপন করে দেয়। তাই বলছিলাম, ভিন্সেন্ট ভান গর্গের নামটা পর্যন্ত টিকে থাকতে দেননি ঈশ্বর।

আমি অবাক হয়ে বলি, –একথা আমার বইতে লিখতে বারণ করছেন কেন?

কারণ তোমার পাঠক হয়তো বিশ্বাস করবেন না-টুথ ইস স্ট্রেঞ্জার দ্যান। ফিকশান; ভাববেন ছ মাসের মধ্যে সূরযের উন্মাদ অবস্থায় মৃত্যুটা সাহিত্যের বিচারে করুণরসের একটা ওভারডোস! যদি জীবনী লিখতে তাহলে কোন কথা ছিল না–কারণ ভিন্সেন্ট ভান গর্গের ভাইয়ের এটাই হচ্ছে সত্য ইতিহাস।

.

১৬.

এরপর দীর্ঘ পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের ব্যবধান দিয়ে শুরু করি–

আমি দ্বৈপায়নদাদুকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, আপনার গল্প কি এখনও শেষ হয়নি?

তুমি কি ভেবেছিলে, শেষ হয়ে গেল সব কথা?

-তাই তো ভেবেছিলাম। বটুকেশ্বর দেবনাথ বরিশালে ফিরে গেলেন, গগন পাল দেশত্যাগী হলেন আর ভান গর্গ উন্মাদ অবস্থায় আত্মহত্যা করলেন–এরপর আর বাকি থাকল কে?

বাকি থাকল দ্বৈপায়ন লাহিড়ী। ভূষণ্ডী কাকের মত আশী বছর বয়সে সে আজও টিকে আছে।

আমি লজ্জা পাই।

দ্বৈপায়নদাদু কিন্তু থামলেন না, বলে চলেন, শিল্পীর শেষ আছে, শিল্পের শেষ নেই। গল্প আমার শেষ হয়নি। বটুকেশ্বরের সঙ্গে তার শেষদিন পর্যন্ত আমার পত্রালাপ অব্যাহত ছিল। বরিশাল থেকে মাঝে মাঝৈ তার চিঠি পেতাম। তার পরিবারে ফিরে গিয়েছিল সে। বাপ-মা তাকে গ্রহণ করেছিলেন। সে আর বিবাহ করেনি কোনদিন। সুলেখাকে সে ভুলতে পারেনি সারাজীবন। মহাজনী কারবারে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিল। ছবি আর কখনও আঁকেনি সে। দেশ স্বাধীন হবার আগেই সে মারা যায়। বরিশালেই।

গগ্যার খবরও আর পাইনি। একটি বিদেশী জাহাজে খালাসীর কাজ নিয়ে সে কোন্ সুদূরে পাড়ি জমায় এটুকু জেনেছিলাম। তারপর আর বিশ-ত্রিশ বছর তার খবর রাখিনি। তবু অদ্ভুতভাবে গগনের শেষজীবনের কাহিনীটা আমার গোচরে এল। অনেক অনেক দিন পরে। সেটা বোধহয় উনিশশো তিপ্পান্ন সাল। হঠাৎ বিলাতি ডাকটিকিট দেওয়া একটা খাম এল আমার নামে। অভাবনীয় ব্যাপার! চিঠিখানা লিখেছেন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে একজন মার্কিন ভদ্রলোক-প্রফেসর রবার্ট ম্যাকগ্রেগরী। একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিস। সেটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়। মার্কিন মুলুকের একজন বিশ্ববিশ্রুত কলারসিক–আর্ট-কনৌসার। লিখেছেন–নিতান্ত ঘটনাচক্রে জানতে পেরেছি আপনার সঙ্গে মিস্টার গগন পাল আর্টিস্টের পরিচয় ছিল। গগনবাবুর পুত্র, বর্তমানে ঢাকা-নিবাসী মিস্টার আর. জি. পাল অ্যাডভোকেট আমাকে জানিয়েছেন যে, আপনি তার সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এ কথা যদি সত্য হয় তাহলে অনুগ্রহ করে শিল্পীর বাল্যজীবন সম্বন্ধে আপনার যেটুকু জানা আছে তা আমাকে জানাবেন কি? তাঁর শিল্পকর্ম কোথায় দেখতে পাওয়া যেতে পারে তাও জানাবেন। আপনার উত্তর পেলে কলকাতাস্থিত আমেরিকান কনস্যুলেটকে আমি অনুরোধ করব আপনার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে।

আমি তো আকাশ থেকে পড়ি। গগন পালের বাল্যজীবন সম্বন্ধে ক্যালিফোর্নিয়ার শিল্প-বিশারদ আগ্রহী! গগ্যার খবর তিনি কোথায় পেলেন? গগ্যার ছেলের সন্ধানই বা। তিনি জানলেন কেমন করে? বাবলু তাহলে অ্যাডভোকেট হয়েছে? সেই হাফ-প্যাডেল করা বাবলু! যাই হোক জবাবে আমি লিখলাম, -গগন পাল আমার সতীর্থ ও বন্ধু। তার জীবনের অনেক কিছুই আমি জানি। উনিশশো চব্বিশ সালে তার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি। তারপর সে কোথায় আছে আমি জানি না। তার শিল্পকর্মও কোথায় আছে তা আমার অজ্ঞাত। তবে তার আঁকা একটি অয়েলকালার আমার কাছে আছে। সেটা আমি নিলামে কিনেছিলাম।

ম্যাকগ্রেগরী পত্রপাঠ জবাব দিলেন, –আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি আপনার বন্ধু জীবিত নেই। তাঁর ছবিখানি আপনি কোনক্রমেই হস্তান্তরিত করবেন না। ঘটনাচক্রে আগামী মাসে এখান থেকে ওঙ্কারভাট, বরভুদর যেতে হবে আমাকে। সেই সময় ভারতবর্ষে যাবারও চেষ্টা করব। সম্ভব হলে আপনার সঙ্গে দেখা করব।

মাসছয়েক পরে ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। বছর পঞ্চাশ বয়স। বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল চেহারা। ইতিপূর্বে আরও দুবার ভারতবর্ষে এসেছেন! অজন্তা খাজুরাহো সাঁচি-মহাবলিপুরম চষে বেড়িয়েছেন। সৌজন্য-বিনিময়ের পরে বলেন, কই, নিয়ে আসুন আপনার বন্ধুর ছবিটা!

যখন আমি ছবিখানা দ্বিতলের ঘর থেকে নামিয়ে আনলাম তখন উনি সিগারেট ধরাতে ব্যস্ত। আমি ছবিটা জানালার সিলের উপর রাখি; ভদ্রলোক কয়েক পা পিছু হটে এলেন। একদৃষ্টে ছবিখানা দেখতে থাকেন। নির্বাক নিস্পন্দ। না টানলে একটা সিগারেট আদ্যন্ত পুড়তে কতক্ষণ লাগে? অতটা সময় ছবিখানা দেখেছিলেন। যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন আঙুলে আগুনের ছেঁকা লাগায়।

য়ায়াম সরি! ইতিমধ্যে সিগারেটের লম্বা ছাই ঝরে পড়েছে মেঝের কার্পেটে। স্টাম্পটা অ্যাসট্রেতে ফেলে দিয়ে উনি দ্বিতীয় একটি সিগারেট ধরান। আমার দিকে ফিরে বলেন, আপনি কি এই ছবিটা বিক্রি করতে সম্মত? আপনি চিঠিতে লিখেছিলেন এটি আপনি নিলামে কিনেছেন–এ কোন উপহার নয়; তাই প্রশ্ন করছি।

–এ ছবি নিয়ে আপনি কি করবেন?

–কোন একটি সংগ্রহশালায় রাখব।

আমি বলি, প্রফেসর ম্যাকগ্রেগরী, আমার বন্ধু এ দেশে তাঁর প্রাপ্য সম্মান পাননি। এ ছবিটি অতি অল্প দামে কিনেছিলাম আমি। আপনি যদি একে কোন বিখ্যাত সংগ্রহশালায় রাখতে চান আমি বাধা দেব না। আপনি এখানা নিয়ে যান।

কত দাম দিতে হবে?

আমি হেসে বলি, –আমি ছবির কি বুঝি? আপনি আর্ট কনৌসার। এ ছবির ন্যায্য দাম যা হওয়া উচিত তাই দেবেন।

কৌতুক উপচে পড়ে অধ্যাপকের চোখ দুটিতে। বলেন, বর্তমানে আমি আর্ট কনৌসার নই, সামান্য খরিদ্দার মাত্র। আপনি ছবিটি নিলামে কিনেছেন, তাই ন্যায্য দর না জানলেও ওর বাজার-দরটা আপনি জানেন!

শিল্পীরা আত্মভোলা হয়। শিল্প-বিশারদরা সে জাতের নয় তাহলে।

তবে একটা কথা আপনাকে আগেই বলে রাখা উচিত। আমি আপনাকে ঠকিয়ে নিয়ে গেছি একথা যেন আমাকে শুনতে না হয়। তাই প্রথমেই বলে রাখছি—ছবিটি মূল্যবান। আপনি বুঝেসুঝে দর দিন ডক্টর লাহিড়ী।

আমি ফস্ করে বলে বসি, –পাঁচশ টাকা দামটা কি খুব বেশি হবে?

প্রফেসর আমার কথার জবাব দিলেন না। তিনি তৈরী হয়েই এসেছিলেন। হাতব্যাগ খুলে পঞ্চাশখানি একশো টাকার নোট টেবিলের উপর রেখে বলেন, এক হাজার ডলার এর মিনিমাম্ প্রাইস্!

আমি স্তম্ভিত।

একটি পোর্টেবল টেপ-রেকর্ডার আমার টেবিলের উপর রাখেন। মাউথ-পীসটা আমার মুখের সামনে বাড়িয়ে ধরে বলেন, –আর্টিস্ট গগন পাল সম্বন্ধে আপনি যা জানেন এবার বলে যান।

আমি বলি, আগে আপনি বলুন গগন পালকে কেমন করে চিনলেন আপনি! কেনই বা ওর বিষয়ে এত উৎসাহ আপনার!

প্রফেসর ম্যাকগ্রেগরী বলেন, ডক্টর লাহিড়ী, আমিও আপনাকে একটি চমকপ্রদ কাহিনী শোনাব; কিন্তু সেটা পরে। আমি চাই সেকথা না জেনে খোলা মনে আপনি আপনার বন্ধুর সম্বন্ধে যা জানেন তা বলে যান। তার শেষ জীবনের কথা জানা হয়ে গেলে তার জীবনের প্রথম অধ্যায়টা ঠিকমত বলতে পারবেন না আপনি।

অগত্যা গগন পাল সম্বন্ধে আমার স্মৃতির ঝাপি খুলে ধরলাম। স্কুলজীবনের নানান। খুঁটিনাটি। পড়াশুনায় সে ভাল ছেলে ছিল না। ক্লাসে সেই ছিল বয়ঃজ্যেষ্ঠ। তারপর আমরা একসঙ্গে এনট্রান্স পরীক্ষা দিলাম। গগন এর আগেও দুবার ঐ পরীক্ষা দিয়েছিল, পাস করতে পারেনি। এবার পরীক্ষার পর আমরা ক বন্ধু কোম্পানির বাগানে কেমন করে সেই সন্ন্যাসী দর্শন করতে গিয়েছিলাম তাও বললাম। সন্ন্যাসী তুলসীদাসজীর একটি দোঁহা শুনিয়েছিলেন–তেরা বনৎ বনৎ বনি যাই; তেরা বিগড়ি বনৎ বনি যাই। চন্দ্রভানকে বলেছিলেন, -যবন কাহাকা!

বাধা দিয়ে ম্যাকগ্রেগরী বলেন, দাঁড়ান, দাঁড়ান। আপনার এই বন্ধু চন্দ্রভান গর্গ কি পরে খ্রীষ্টান হয়ে যান!

-হ্যাঁ। সেও পরবর্তী জীবনে চিত্রকর হতে চেয়েছিল। তার নাম হয়েছিল ভিন্সেন্ট ভান গর্গ। বেচারীর ছবি কোন সমাদর পায়নি।

প্রফেসর বললেন, আপনি খবর রাখেন না ডক্টর লাহিড়ী। আপনার বন্ধু ভিন্সেন্ট ভান গর্গ অতি সম্প্রতি পশ্চিম-জগতে একজন স্বীকৃত মহাশিল্পী। আমার কাছে তার এ পর্যন্ত উদ্ধার-পাওয়া আটচল্লিশখানি ছবির হিসাব আছে। সাতটি অরিজিনাল এ পর্যন্ত আমি নিজে দেখেছি। বাকিগুলি য়ুরোপে ও আমেরিকায় আছে।

আমি অবাক হয়ে বলি, কী বলছেন আপনি! চন্দ্রভানের কোন্ ছবি আপনি দেখেছেন? তার ছবি য়ুরোপে আছে মানে? কেমন করে গেল সেখানে? নিশ্চয় আপনার ভুল হচ্ছে। সে আমার বন্ধু চন্দ্রভান নয়।

-আমি দেখেছি-আলুর ভোজ, সিঙারণের সেতু, সূরযমুখী, ইলিশমাছের ঝুড়ি, একটি গীর্জা, খান দুই সেলফ-পোর্ট্রেট।

কী আশ্চর্য! ওর এসব ছবি কোথায় আছে?

–পৃথিবীর বিভিন্ন বিখ্যাত সংগ্রহশালায়। আমস্টার্ডাম, জুরিখ, ওটেলো, মস্কো, লণ্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারী, প্যারীর লুভার সংলগ্ন ইম্প্রেশনিস্ট মিউজিয়ামে।

আমি স্তব্ধ বিস্ময়ে প্রশ্ন করতেও ভুলে যাই। অধ্যাপক বলেন, আর্টিস্ট ভান গর্গের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী আমি পড়েছি। লিখেছেন মিসেস ডেভিডসন; তিনি ছিলেন ওঁর চিকিৎসকের স্ত্রী। লেখাটা আমেরিকান আর্ট-জার্নালে ছাপা হয়েছিল। অদ্ভুত জীবনী! ভদ্রলোক সমস্ত জীবন অর্থকষ্টে কাটিয়েছেন; অথচ তার যে-কোন একখানি ছবির আজ যা বাজার-দর তাতে সারাজীবন তিনি পায়ের উপর পা দিয়ে কাটাতে পারতেন।

আমি তখনও কথা বলতে পারছি না। মনে পড়ে যাচ্ছে কত কথা! বিশেষ করে ভিন্সেন্টের সেই উক্তিটি, –তুমি কি আমাকে করুণা করতে এসেছ ঊর্মি? সহানুভূতি জানাতে এসেছ?

শুধু ধ্রুবানন্দ অগ্নিহোত্রী একাই নন, ভিন্সেন্টও ছিল ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। সে বলে গিয়েছিল –একদিন পৃথিবী নতমস্তকে স্বীকার করবে তার সৃষ্টিকে।

তারপর বলুন?

আবার শুরু করি আমার কাহিনী। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে গগনের সেই উদাত্ত কণ্ঠের গান, বাঙলার মাটি বাঙলার জল। তারপর সে ফেল করল। গগ্যা মুছে গেল আমার জানা দুনিয়া থেকে। এরপর কী ভাবে ঢাকার পল্টনবাজারে তার সন্ধান পাই, কী ভাবে সে স্ত্রী-পুত্র কন্যাকে ত্যাগ করে চলে আসে বরানগরের বস্তীতে, রঙলালের স্ত্রীর স্কেচ করার অপরাধে তার মাথা ফেটে যাওয়া

তারপর আমি সঙ্কোচে থেমে যাই। বলি, -প্রফেসর, এরপর গগন পালের জীবনে এমন একটি অধ্যায়ের কথা আমি জানি যার সঙ্গে অন্যের জীবন যুক্ত। সেটা প্রকাশ করা বোধ হয় সঙ্গত হবে না!

যন্ত্রটা বন্ধ করে দিয়ে অধ্যাপক জানতে চান ব্যাপারটা কি। গগন তার বন্ধুর স্ত্রীকে ইলোপ করেছিল শুনে উনি জানতে চান সেই মেয়েটি, তার স্বামী অথবা সন্তান কে কে বেঁচে আছে। কেউ নেই শুনে বললেন, তাহলে আর সঙ্কোচ করবেন না। ইতিহাসকে অস্বীকার করবেন না।

যা জানি অকপটে সব বলে গেলাম।

অধ্যাপক বলেন, এবার আমি কেমন করে ওর সন্ধান পেলাম শুনুন।

বাধা দিয়ে বলি, না, এবার ইন্টারমিশন। একটু জলযোগ করে নিতে হবে।

প্রফেসর বলেন, –সে কি! আমি ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়েছি!

–তা হোক। এই হচ্ছে ভারতীয় শিষ্টাচার। আপনি কিছু না খেয়ে গেলে আমার স্ত্রী অত্যন্ত মর্মাহত হবেন।

প্রফেসর শ্রাগ করেন। হেসে বলেন, -ওরিয়েন্টাল কালচার সম্বন্ধে এখনও অনেক কিছু শিখতে বাকি আছে দেখছি!

আহারের অবকাশে বলি, একটা কথা আমাকে বুঝিয়ে দিন তো। ঐ ছবিখানা আপনি পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে কিনলেন; কিন্তু ওতে আছেটা কি? আমি যে ওটা দশ টাকায় নিলামে কিনেছিলাম!

প্রফেসর অনভ্যস্ত হাতে ফুলকো লুচি ভাঙতে ভাঙতে বলেন, –এ একটি অনবদ্য ছবি! একেবারে নতুন স্টাইল। মৃত বেড়ালছানাটা হচ্ছে ঐ বস্তী-জীবনের অতীত। এভাবেই ঐ বস্তীর মানুষ যুগে যুগে মরেছে; আর ওদের মৃতদেহ মিল-মালিকের দল অবজ্ঞায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে আঁস্তাকুড়ে। উপরের ঐ নিঃসঙ্গ চিলটা হচ্ছে বর্তমান শিল্পী স্বয়ং। বার্ডস্ আই ভিয়ুতে তিনি ঐ অবক্ষয়ী বস্তী-জীবনকে দেখছেন। তিনি ঐ জীবনের ভাগীদার নন, আছেন অনেক অনেক উঁচুতে; কিন্তু এ জীবনের সামগ্রিক অবক্ষয়ীরূপে গরুড়াবলোকনে প্রত্যক্ষ করছেন তিনি। শিল্পী হতাশ হননি। রক্তের মত জমাট কাদার দটাই এ বীর শেষ কথা নয় তিনি দেখেছেন ঐ নগ্ন শিশু ভোলানাথকেও! আবহমান কালের লজ্জা-ঘৃণা-ভয়ের নির্মোকও টান মেরে খুলে ফেলেছে–তাই ও উলঙ্গ। ওর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দুর্বল, ও শিশু, কিন্তু ওর মধ্যেই আছে বটগাছের বীজ! ওর প্রাণে তারুণ্যের সবুজাভা–ও নগ্ন বিদ্রোহী। ঐ শিশু ভোলানাথই কালে হবে রুদ্র ভৈরব! ইটস্ এ মাস্টার পীস্! ভরে রাখার উপযুক্ত।

কী আশ্চর্য! কী অপরিসীম আশ্চর্য! কালোহয়ং নিরবধি, বিপুলা পৃথ্বী। উপেক্ষিত নগণ্য গেয়ো যোগী মদের ঝেকে যে কথা বলেছিল বটুককে–যে কথা আমরা পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলাম তারই অনুরণন আজ ত্রিশ বছর পরে শুনলাম সাগরপারের এক আর্ট কনৌসারের মুখে।

অধ্যাপক প্রশ্ন করেন, এ ছবিটি কোথায় বসে শিল্পী এঁকেছিলেন ধারণা করতে পারেন?

ধারণা কেন? জায়গাটা আমি চিনি। বরানগরের একটা কুলিবস্তী।

অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরী তৎক্ষণাৎ উঠে পড়েন। বলেন, তাহলে আর দেরী নয়। চলুন, এখনই সেখান থেকে ঘুরে আসি।

–সে কি? আপনার গল্পটা যে শোনা হয়নি।

-সেটা ফিরে এসে বলব। সকালের আলোতে ঐ বস্তীর কয়েকটা ফটো নিতে চাই। বেলা বেড়ে গেলে এফেক্টটা থাকবে না।

অগত্যা পাগল অধ্যাপককে নিয়ে এলাম সেই বরানগরের বস্তীতে। বিশ-ত্রিশ বছর পরে এলাম সেখানে। আশপাশের অনেক কিছুই বদলে গেছে। নতুন নতুন বাড়ি উঠেছে। রাস্তা পাকা হয়েছে। উদ্বাস্তু কলোনি জেগে উঠছে এখানে-ওখানে। কিন্তু কী আশ্চর্যভারতবর্ষের সেই ট্রাডিশান তবু সমানতালে চলেছে। বস্তীর জীবন আছে অপরিবর্তিত। রাস্তার উপর জমে আছে তেমনি ঘোলা জল, আঁস্তাকুড়ে উপচীয়মান আবর্জনার স্তূপ, পথের উপর বেওয়ারিশ উলঙ্গ শিশুর দল গাড়ির চাকার তলায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ভাজিওয়ালার সেই চিনেবাদামগুলো এই ত্রিশ বছরেও ভাজা শেষ হয়নি । রাস্তার কলে সেদিন যে যুবতী মেয়েটিকে স্নান করতে দেখেছিলাম এ পঁচিশ ত্রিশ বছরেও তার স্নান শেষ হয়নি, তার পীনোদ্ধত যৌবন একটুও টলেনি।

গগন পালের সেই তের নম্বর ছাপরাটা খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। এখন সেটা নাকি একটা তীর্থ।

সাহেব দেখে ওরা থতমত খেয়ে যায়। মেয়েরা গায়ের কাপড় সামলায়। বাচ্চাগুলো মায়ের পিছনে আড়াল খোঁজে। সাহেব অনেকগুলি ফটো নিলেন। আমার খুব খারাপ লাগছিল। স্বদেশের এই নিরতিশয় দারিদ্র্যের ছবি মার্কিন দেশের আইভরি ফিনিশ আর্ট পেপারে ছাপা হবে। কিন্তু বাধাও দিতে পারলাম না।

অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরীর কাছে শুনেছিলাম গগন পালের শেষ জীবনের ইতিকথা :

বছর তিনেক আগের কথা। একজন চিত্র ব্যবসায়ী ওঁকে খানকতক ছবি এনে দেখায়। বলে, এগুলি সে নামমাত্র মূল্যে কিনেছে একজন স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ান নাবিকের কাছে। ছবিগুলো দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন ম্যাকগ্রেগরী। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন নাবিক সেগুলি সংগ্রহ করেছিল প্রশান্ত মহাসাগরের তাহিতি দ্বীপে। চিত্রকরের নাম পল গগ্যা। সে তাহিতির লোক নয়, বিদেশী। ছবি আঁকত ঐ একান্ত দ্বীপে। অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরী চিত্রকর সম্বন্ধে যেটুকু জেনেছিলেন তার ভাষ্য দিয়ে ঐ ছবি কখানি ছাপালেন আমেরিকার একটি বিখ্যাত আর্ট-ম্যাগাজিনে। হৈ-হৈ পড়ে গেল তাতে। পত্র পত্রিকায় চিঠিপত্র লেখালেখি শুরু হয়ে গেল। কে এই আর্টিস্ট? তার আর কি ছবি আছে? যে কখানি ছবি সংগৃহীত হয়েছিল সেগুলি আশাতীত মূল্যে বিক্রয় হয়ে গেল। ম্যাকগ্রেগরী সেবার দূর প্রাচ্যে আসবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। ইউরোপ ঘুরে না এসে উনি প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এলেন। উদ্দেশ্য ঐ তাহিতি দ্বীপের রাজধানী পাপীত্তিতে নেমে অজ্ঞাত চিত্রকরের সম্বন্ধে সন্ধান করা।

প্রথম দু-চারদিন কোন সংবাদ পান না। পল গগ্যা নামে কোন বিদেশীর খবর কেউ দিতে পারে না। শেষে একটি হোটেলের একজন বার-মেড বললে, –গগ্যা? সেই দৈত্যের মত লোকটা? একমুখ দাড়ি আর একমাথা চুল?

অধ্যাপক বলেন, –তা জানি না, কিন্তু লোকটা ছবি আঁকে।

-হ্যাঁ হ্যাঁ, ছবি আঁকে আর বাঁশী বাজায়। তবে সে-ই হবে। সে তো এখানে থাকে । বিয়ে করার পর সে মারকুয়েশাস দ্বীপে চলে গেছে।

বিয়ে করেছে? এখানে? কাকে?

–য়ামায়াকে। সে ছিল আত্তাই-এর মেয়ে। আত্তাই এখনও বেঁছে আছে! সে জানে।

মায়ের সন্ধান পেলেন অধ্যাপক। হ্যাঁ, সে পল গগ্যাকে চেনে। বিদেশী। কোন্ দেশের মানুষ জানে না। একদিন জাহাজে চেপে এসেছিল। খালাসীর পোশাকে। জাহাজে সে নাকি ইঞ্জিন-ঘরে কয়লা ঢালত। জাহাজটা এ বন্দরে দিন তিনেক ছিল। লোকটা পালায়। সে নাকি প্রথম দর্শনেই এই দ্বীপের প্রেমে পড়ে যায়। জাহাজ বন্দর ছেড়ে যাবার দিনে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। দৈত্যের মত প্রকাণ্ড জোয়ান। বছর পঞ্চাশ বয়স, কিন্তু খাটতে পারত ভূতের মত। লোকটা ছবি আঁকত আর বাঁশী বাজাত। দিনের বেলা ডকে কুলি-মজদুরের কাজ করত। গগ্যার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের বর্ণনা দিল আত্তাই?

গ্রেট তাহিতির পূর্ব-উপকূলে তখন আত্তাই-এর বাস। একদিন সন্ধ্যাবেলা ঘোড়ায় চেপে একজন বিদেশী তার কুটিরে এসে উপস্থিত। দৈত্যের মত প্রকাণ্ড চেহারা, একমাথা লম্বা লম্বা চুল, একমুখ দাড়ি, সর্বাঙ্গ ধূলায় ভরা। ঘোড়ার মুখে সাদা ফেনা। অনেকটা দৌড়ে এসেছে বোধহয়। দাড়িওয়ালা লোকটা বললে, সুন্দরী, আজ রাতটা তোমার বাসায় থাকতে দেবে?

আত্তাই-এর বয়স তখন চল্লিশের উপর। সুন্দরী সম্বোধনে সে গলে গেল। বললে, একটা রাত বই তো নয়। তা বেশ, থাক। তা তুমি কে? কোথা থেকে আসছ?

লোকটা বললে, আমি বিদেশী। জাহাজের খালাসী ছিলাম। তোমাদের দেশটা ভাল লেগে গেল। তাই এখানেই রয়ে গেছি।

-কি কর তুমি?

ছবি আঁকি আর বাঁশী বাজাই।

আত্তাই অবাক হয়ে যায়। লোকটা তার ঘোড়ার পিঠ থেকে মালপত্র নামিয়ে রাখে।

–তা এখন ঘোড়ায় চেপে কোথায় চলেছ?

লোকটা হাসতে হাসতে বলে, রাজপুত্রেরা ঘোড়ায় চেপে কোথায় যায়? রাজকন্যার সন্ধানে। অনেক বয়স হয়ে গেছে তো। তাই আমি বউ খুঁজতে বেরিয়েছি।

আত্তাই বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ে। লোকটা নিঃসন্দেহে বিদেশী। চেহারাটাই তার প্রমাণ। তাছাড়া কথা বলছে ভাঙা ভাঙা তাহিতিতে। আহা বেচারি। এত বয়সেও বউ যোগাড় করতে পারেনি। বললে, –তা বউ খুঁজতে এত ঘুরে মরছ কেন? আমার একটা মেয়ে আছে। তাকেই বিয়ে কর না।

লোকটা হা-হা করে হেসে উঠল। খড়ের বিছানায় সে তার কম্বলটা বিছিয়ে শোবার উপক্রম করছিল। বললে, –তোমার মেয়ে? আমার বয়স কত জান? তুমি বিয়ে করতে রাজী হলে না হয় ভেবে দেখা যেত। তুমি সুন্দর দেখতে

আত্তাই লজ্জা পেল না। বললে, না গো, আমার মরদ আছে। তা আমার মেয়েও বেশ সুন্দরী।

বটে বটে! কই, ডাক দেখি তোমার মেয়েকে!

আত্তাই তার মেয়েকে নিয়ে এল। বছর চোদ্দ বয়স। ডাগর দুটি চোখ মেলে সে অদ্ভুতদর্শন আগন্তুককে দেখতে থাকে। চোদ্দ বছর বয়স হলে কি হবে, মেয়েটি বাড়ন্ত গড়নের। বিষুব অঞ্চলের প্রখর রৌদ্রে চৌদ্দটি বসন্তেই কিশোরী মেয়েকে এনে দেয়। নারীত্বের মহিমা। লোকটা আপনমনে নিজের ভাষায় কি যেন বললে। ভাষাটা অজানা। আত্তাই বলে, কি বলছ?

বলছি তোমার মেয়েটি খাসা। তোমার নাম কি গো মেয়ে?

–য়ামায়া।

লোকটা য়ামায়াকে আপাদমস্তক ভাল করে দেখল। তাহিতি দ্বীপের যাবতীয় পলিনেশিয়ান মেয়ের মতই নাকটি চ্যাপ্টা, ঠোঁট পুরু, গভীর কালো দুটি ব্যঞ্জনাময় চোখে অবাক চাহনি। কটিদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত পিঙ্গল চুল, মসৃণ কোমল গাত্রচর্ম, সুশ্রোণী। ঊর্ধ্বাঙ্গ নিরাবরণ, যৌবনের যুগ্ম পূর্ণকুম্ভ প্রমাণ দেয় মেয়েটি কিশোরী নয়। বন্যমার্জারির মত এস্তা।

লোকটা বললে, আমাকে ভয় করছে?

মাথা নেড়ে মেয়েটি বলে, না!

আমাকে বিয়ে করবে?

য়ামায়া মাথা নেড়ে সায় দেয়।

-আমাকে ফেলে পালাবে না তো?

না।

লোকটা আত্তাইকে বললে, কনে আমার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু ও কি এই বুড়ো বরকে বরাবর বরদাস্ত করতে পারবে? জোয়ান তাহিতির ছেলে ইশারায় ওকে ডাক দিলেই আমাকে ছেড়ে পালাবে।

আত্তাই বলে, –আমার মেয়ে তেমন নয় গো। আর তোমাকে ও সহ্য করতে পারবে কিনা সেটা আজ রাতেই পরখ করে দেখতে পার। যদি তোমার ওকে পছন্দ না হয়, অথবা ও তোমাকে সইতে না পারে তবে বিয়ে কর না।

লোকটা বোধহয় তাহিতিতে নতুন এসেছে। এমন সহজ হিসাবটা বুঝতে তার বেশ সময় লাগল। শেষমেষ সে রাজী হয়ে যায়। আত্তাই বলে, –তোমার নাম কি গো? কি বলে ডাকব?

–আমার নাম পল গগ্যা।

রাত্রে ওরা তিনজনে একসঙ্গে খেল। আত্তাই-এর মরদ কোথায় যেন গেছে। সে বেচারি পাশের ঘরে একাই শুতে গেল। য়ামায়া কাজকর্ম সেরে যখন শুতে এল লোকটা তখন বিছানা পেতে বসে বাঁশী বাজাচ্ছে। য়ামায়া অবাক হয়ে গেল সে বাঁশী শুনে।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে লোকটা বললে, বউ তার পছন্দ হয়েছে। য়ামায়াও বললে, বর তার মনমতো হয়েছে। ব্যস! পরদিনই বউ নিয়ে লোকটা মারকুয়েশা দ্বীপের দিকে চলে গেছে। তারপর আত্তাই আর জানে না।

মারকুয়েশাস্ একটি দ্বীপ নয়, দ্বীপাবলী; কিন্তু প্রফেসর ম্যাকগ্রেগরী অত সহজে হতাশ হবার পাত্র নন। একটি জেলে-ডিঙি ভাড়া করে তিনি চলে এলেন ঐ দ্বীপে। প্রফেসর প্রথমেই এসেছিলেন ডমেনিক দ্বীপে। এবার আর খোঁজ পেতে অত দেরী হল না। শুনলেন, ঐ দ্বীপের বৃহত্তম গ্রাম আটুয়ানাতে গগ্যা একটা পাতায় ছাওয়া কুটির তৈরী করে তার বউ নিয়ে বাস করত, কিন্তু বছর ছয়েকের মধ্যেই একবার প্রবল সাইক্লোনে ওর বাড়িটি ভেঙে যায়। ঐ সময় তার উপর পুলিসের অত্যাচার হয়। তিন মাসের জন্য জেল খাটতে হয় তাকে। অপরাধ–তাহিতির Le Sourire নামে একটি স্থানীয় পত্রিকায় সে একটি প্রবন্ধ লিখেছিল ঔপনিবেশিক শাসকের দল স্থানীয় তাহিতি দ্বীপবাসীর উপর যে অত্যাচার করে তার প্রতিবাদ করে। জেল থেকে বেরিয়ে গগ্যা দেখে প্রচণ্ড ঘূর্ণিবায়ুতে তার বাড়ি ভেঙে গেছে, অথচ গাছতলায় অপেক্ষা করে বসে আছে তার বিয়ে না করা বউ য়ামায়া। গগ্যা নাকি ঐ অরণ্যচারিণীর হাত ধরে আরও গভীর অরণ্যে চলে যায়। কোথায়, তা কেউ জানে না।

চারিদিকে বিষুব-অঞ্চলের ঘন জঙ্গল। সমুদ্র-খাড়ি, পাহাড় আর অরণ্যদূরে দূরে গ্রাম্য জনপদ। সেখানে যারা বাস করে তারা কেউ ইংরাজি জানে না। অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরী এমন বিজন অরণ্যে কেমন করে খুঁজে বার করবেন সেই বিদেশীকে–যার নামটুকু মাত্র জানা আছে! সে কোন্ দেশের মানুষ তা পর্যন্ত জানা নেই। তবু তীক্ষ্ণবুদ্ধি পণ্ডিত মানুষ। দু-দিক থেকে অনুসন্ধান চালালেন। গগ্যার একটা দৈহিক বর্ণনা পাওয়া গেছে তার শাশুড়ীর কাছ থেকে দৈত্যের মত প্রকাণ্ড শরীর, একমাথা কাঁচাপাকা চুল, একবুক দাড়ি। প্রফেসর প্রথমেই বাজারে গিয়ে রঙ-তুলি ক্যানভাসের খোঁজ করলেন। তাহিতিতে বসে কারও ছবি আঁকবার বাসনা হলে সে কোথায় তা সংগ্রহ করতে পারে? নিজেই বের হলেন তার খোঁজে। মাতালকে যদি খুঁজে বার করতে চাওসব কটা শুড়িখানায় তালাস কর। এদিক থেকে সহজেই সন্ধান পাওয়া গেল। শহরে একটি মাত্র দোকান আছে যেখানে রঙ-তুলি পাওয়া যেতে পারে। দোকানদার স্বীকার করলা, পল গগ্যা নামে একজন বিদেশী লোক তার কাছ থেকে আঁকার সরঞ্জাম এককালে কিনত বটে। সাত-আট বছদ্র আগে। লোকটার সঙ্গে তার আলাপও হয়েছিল। কী একটা প্রবন্ধ লেখার অপরাধে তার জেল হয়ে যায়। জেল থেকে বেরিয়ে সে কোথায় যেন চলে যায়। এর বেশি সে কিছু জানে না।

–লোকটাকে শেষ কবে দেখেছিলেন?

-ঐ যে বললাম, বছর সাত-আট আগে। সে যখন আটুয়ানা ছেড়ে চলে যায় লোকটা আমার দোকানে এসেছিল কিছু রঙ-তুলি কিনতে। আর কাগজ। ক্যানভাসও চেয়েছিল, তা আমার কাছে ছিল না। মনে আছে, লোকটা আমাকে বলেছিলাম নগদে দিতে পারছি না, খানকতক ছবি রেখে যাচ্ছি। তা আমি রাজী হয়ে যাই।

কই কই, দেখি সেই ছবি?

না, ছবিগুলি আমার কাছে নেই। লোকটা রঙের দাম যখন মিটিয়ে দিতে এল না তখন আমি সেগুলি বিক্রি করে দিয়েছিলাম–

কাকে?

কাকে তা কি আর মনে আছে?

প্রফেসর তার অ্যাটাচি-কেস খুলে একটি মার্কিন আর্ট-ম্যাগাজিন বার করে বলেন, — দেখুন তো, এই ছবিগুলি কি?

দোকানদার অবাক হয়ে যায়। বলে, কী আশ্চর্য! হ্যাঁ, এই ছবিগুলিই তো বটে!

ম্যাকগ্রেগরী বলেন, আমি ঐ লোকটার সন্ধানে আমেরিকা থেকে এসেছি। আপনি কি আর কিছুই মনে করতে পারেন না তার সম্বন্ধে? আর কোন ক্লর সন্ধান দিতে পারেন না?

দোকানদার ভদ্রলোক শিক্ষিত। দ্রুতগতিতে সে প্রবন্ধের পাতা উল্টে যায়। বলে, — আশ্চর্য! উনি যে এমন প্রতিভাধর শিল্পী তা আদৌ ভাবতে পারিনি আমি! আচ্ছা, দাঁড়ান।

অনেকক্ষণ চিন্তা করে বলেন, হ্যাঁ, তার সম্বন্ধে আর একটি কথা আমার মনে পড়ছে।

কী? ..

যাবার দিনে উনি বলেছিলেন, মাস কয়েক পরে এসে খবর নিয়ে যাব ছবিগুলো বিক্রি হল কিনা।

কিন্তু তা তিনি আসেননি?

না আসেননি; কিন্তু আমার মনে পড়ছে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম–আপনি কি দূরে কোথাও চলে যাচ্ছেন। উনি জবাবে বলেন, হ্যাঁ, আরও গভীর অরণ্যে। আর কিছু মনে পড়ছে না।

দ্বিতীয়ত উনি খোঁজ করলেন স্থানীয় ডাকঘরে। পোস্টমাস্টার মশাই নামটা শুনে, বলেন, না, পল গগ্যা নামের কোন লোক এ দ্বীপের ত্রিসীমানায় বাস করে না। অন্তত ঐ নামে কোন চিঠি তাঁর ডাকঘরে পনের বিশ বছরের ভিতরে আসেনি। তারপর হঠাৎ কি খেয়াল হওয়াতে বলেন, দাঁড়ান প্রফেসার! কী নাম বললেন? পল গগ্যা? গগন পল নয় তো?

-কেন, গগন পল নামে কাউকে চেনেন?

পোস্টমাস্টার মশাই তার বাক্স থেকে একটি জীর্ণ পোস্টকার্ড বার করে বলেন, দেখুন তো এই লোক কিনা?

প্রফেসর গভীর মনোযোগ দিয়ে পোস্টকার্ডখানা লক্ষ্য করে দেখেন। পেনসিলে লেখা চিঠিকিছুই পড়া যায় না। অন্ততঃ ভাষাটা যে ইংরাজি নয় এটুকু বোঝা যায়। অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরী প্রাচ্যশিল্পী-বিশারদাঁ। সংস্কৃত ও পালি ভাষা জানেন, ব্রাহ্মী ও মাগধী হরফ চিনতে পারেন। তিনি এটুকু বুঝতে পারেন ভাষাটা ভারতীয়। সংস্কৃত অথবা পালির অপভ্রংশ–অর্থাৎ দাক্ষিণাত্যের নয়, আর্যাবর্তের ভাষা। ঠিকানাটা অবশ্য ইংরাজি ভাষায় লেখা। সেটা কালিতে লেখা এবং স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। পত্রলেখকের নাম গগন পাল, প্রাপকের নাম শান্তিরাণী পাল। ঠিকানা–পল্টন বাজার, ঢাকা, ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষের অনেকগুলি ডাকঘরের ছাপের নামাবলী গায়ে জড়িয়ে পোস্টকার্ডখানি আবার প্রেরকের কাছে ফেরত এসেছিল। ঠিকানা ভুল, প্রাপককে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাহিতি ডাকঘরে পোস্টমাস্টার মশাই আবার এদিকে প্রেরককে খুঁজে পাননি। ফলে দীর্ঘদিন সেটি পড়ে আছে ঐ বাক্সে।

অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরী অনেকক্ষণ সেই পোস্টকার্ডখানি হাতে নিয়ে নির্বাক বসে থাকেন। কে এই পল গগ্যা অথবা গগন পাল? কোন্ দেশের লোক? ভারতীয়? কী সম্পর্ক ছিল ঐ লোকটার অজ্ঞাত শান্তি পালের সঙ্গে? দুজনেরই উপাধি পাল-ওরা। স্বামী-স্ত্রীও হতে পারে। প্রফেসর জানতেন ঢাকা একটি শহরের নাম। পূর্ব-পাকিস্তানের। রাজধানী। সেটা ভারতবর্ষে নয়। সে খবরটা জানে না এই গগন পাল। হয়তো ভারতবর্ষে অথবা পাকিস্তানে সে কখনও যায়নি। ঢাকা আগে ছিল ভারতবর্ষে, বর্তমানে পাকিস্তানে। এমনও হতে পারে ঐ লোকটা এই অরণ্যে বাস করতে করতে সংবাদই পায়নি যে, ভারতবর্ষ ইতিমধ্যে স্বাধীন হয়েছে। সে খবর রাখে না–ঢাকা বর্তমানে ভারতবর্ষে নয়। সে ক্ষেত্রে অবশ্য ধরে নিতে হবে গগন পাল আর শান্তি পাল স্বামী-স্ত্রী নয়। গগন পাল ভারতীয়ই নয়। কারণ লোকটা শিক্ষিত, সংবাদপত্রে ফরাসী ভাষায় প্রবন্ধ লিখবার মত ক্ষমতা তার আছে। এমন একজন শিক্ষিত মানুষ খবরই রাখবে না যে, তার মাতৃভূমি দুশো বছর পরাধীনতার পর স্বাধীন হয়ে গেছে? বিশেষ যদি তার স্ত্রী। সেখানেই থাকে? গোয়েন্দা কাহিনীর মত কোন সমাধানই মনঃপুত হচ্ছিল না। আর আশ্চর্য বুদ্ধি ভারতীয় ডাকঘরের কর্মকর্তাদের। তারা চিঠিখানি দূর তাহিতিতে প্রেরকের কাছে ফেরত না পাঠিয়ে পাশের বাড়ি ঢাকায় পাঠালে প্রাপক হয়তো সময়ে চিঠিখানি পেতেন। অন্ততঃ তখনও চিঠির পাঠোদ্ধার করা চলত।

মোট কথা লোকটা শিক্ষিত। ফ্রেঞ্চ জানত। Le Sourire পত্রিকার প্রবন্ধটাই তার প্রমাণ। ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে কলম ধরে জেল খেটেছিল শিল্পী মানুষটা। প্রবন্ধটা সংগ্রহ করে পড়লেন। বেশ জোরালো ভাষা। প্রবন্ধ লেখক ফ্রেঞ্চ ভাষাটা ভালই। জানেন। আদালতে খোঁজ নিতে গিয়ে আবার কতগুলো অদ্ভুত সংবাদ পাওয়া গেল। আদালতের নথী বলছে, লোকটা নিজেকে নির্দোষ বলেছিল, এবং বলেছিল সে ফরাসী ভাষা আদৌ জানে না! তার তরফে কোন উকিল ছিল না, সে নিজেই সওয়াল করে। স্থানীয় বার অ্যাসোসিয়েশনের একজন নবীন উকিল-কামিল দমিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে আসামীর তরফে মামলা পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আসামী তাঁকে। ওকালতনামা দিতে অস্বীকার করেন। বিচারে তিন মাস সশ্রম কারাদণ্ড হয়ে যায়।

অধ্যাপক অতঃপর কামিল দমিয়ে, অ্যাডভোকেটের সঙ্গে দেখা করলেন।

কামিল দমিয়ে জাতে ফরাসী। উদারনৈতিক তরুণ উকিল। বললেন, হ্যাঁ, পল গগ্যাকে আমি চিনতাম। সাত-আট বছর আগে। সত্যি কথা, তিনি ফরাসী জানেন না। তিনি কোন্ দেশের লোক তা জানা নেই। Le Sourireতে প্রকাশিত প্রবন্ধটা গগ্যারই লেখা, তবে তিনি ইংরাজিতে লিখেছিলেন। অন্য কেউ সেটা অনুবাদ করে দেন। কে যে। অনুবাদ করেন তা গগ্যা স্বীকার করেননি। গগ্যা ছিলেন ডাকাবুকো ধরনের দুঃসাহসী লোক। আদালতে তিনি বলেছিলেন তিনি ফরাসী ভাষা জানেন না–সেকথা বিচারক বিশ্বাসও করেছিলেন। কিন্তু গগ্যা বলেন প্রবন্ধের বক্তব্য তারই, তিনি ইংরাজিতে ওটা লিখেছিলেন। কে অনুবাদ করেছেন এ প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে অস্বীকার করেন।

–অদ্ভুত লোক তো! বলেন ম্যাকগ্রেগরী।

দমিয়ে বলেন, অতি অদ্ভুত লোক। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করেন। আমি যে বিনা পারিশ্রমিকে তার কেস হাতে নিতে চেয়েছিলাম এজন্য আমাকে ধন্যবাদ জানান। আমি জিজ্ঞাসা করি–আপনি কি এ দ্বীপের দেশীয় আন্দোলনে যোগ দিতে চান? জবাবে গগ্যা বলেছিলেন না। আমি এই তথাকথিত সভ্য দুনিয়ার সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে গভীরতর অরণ্যে চলে যাচ্ছি। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম সেখানে। কী করবেন আপনি? জবাবে উনি বলেছিলেন–ছবি আঁকব। বুঝলেন প্রফেসর, জিনিসটা আমার কাছে একেবারে উদ্ভট লেগেছিল–শিক্ষিত সভ্য একজন মানুষ এভাবে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে একটা পলিনেশিয়ান মেয়েকে নিয়ে অমন জঙ্গলে গিয়ে কেমন করে বাস করতে পারে আমি তো ভেবে পাইনি। ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম–How could you explain yourself? আপনি এই অদ্ভুত সিদ্ধান্তের কি ব্যাখ্যা দেবেন? লোকটা জবাবে কি বললেন জানেন?

-কি?

বললে, A mans work is the explanation of that man–একটা মানুষের সৃষ্টিই তার অস্তিত্বের ব্যাখ্যা!

প্রফেসর মাথা নেড়ে বলেছিলেন, এর চেয়ে খাঁটি কথা হয় না!

মোটকথা চেষ্টার কোন ত্রুটি করেননি ম্যাকগ্রেগরী–তবু শিল্পীর কোন সন্ধান পেলেন না। শিল্পীর সৃষ্টির মাধ্যমেও যে কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাবেন তারও সুযোগ হল না। গগন পালের হাতের কোন কাজ দেখতে পেলেন না কোথাও। বাধ্য হয়ে ব্যর্থমনোরথ ম্যাকগ্রেগরী ফিরে এলেন মারকুয়েশাস্ দ্বীপ থেকে মূল দ্বীপেতাহিতির রাজধানী পাপীতিতে।

নিতান্ত ঘটনাচক্রই বলতে হবে, –জাহাজ ছাড়ার দিন-ছয়েক আগে ওঁর সামান্য জ্বর হল। তাহিতিতে ম্যালেরিয়া আছে; অধ্যাপক তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের শরণ নিলেন। ওঁর হোটেলের অনতিদূরে ডক্টর ওয়াটকিন্স-এর চেম্বারে গিয়ে হাজির হলেন এবং ঘরে ঢুকেই জ্বরের কথা ভুলে গেলেন।

হোয়াট ক্যান আই ডু ফর য়ু, স্যার?

ডাক্তার ওয়াটকিন্স-এর আহ্বান কানে গেল না অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরীর। প্রাচীরে। বিলম্বিত একটি তৈলচিত্রের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেন, ডক্টর! এ ছবি আপনি কোথায় পেলেন? এ কার আঁকা?

শিল্পীকে চিনবেন না। খ্যাতনামা কেউ নয়। আমার একজন পেসেন্ট ছিলেন।

–ছিলেন? এখন তিনি কোথায়? কি নাম ওঁর?

–ওঁর নাম পল গগ্যা। মারা গেছেন।

অধ্যাপক নির্নিমেষ নয়নে দেখছিলেন তৈলচিত্রটি। একটি নিসর্গ দৃশ্য। পশ্চাৎপটে কালো মেঘ আর পাহাড়। দু-একটি নারকেল গাছ, একটি কুঁড়ে ঘর। চওড়া একটা পথ এঁকেবেঁকে সরু হতে হতে পাহাড়ের কোলে হারিয়ে গেছে। টুপি-মাথায়, বাঁকাঁধে একজন স্থানীয় মালবাহী মেহনতি মানুষ দর্শকের দিকে পিছন ফিরে চলেছে ঐ অরণ্যমুখো। দর্শকের দিকে সে পিছন ফিরেছে; তার একলা চলার পথে শুধু অরণ্য আর পর্বত-সামনে সূরযকরোজ্জ্বল এক উপত্যকা। কাঁধের ভারে লোকটা নুয়ে পড়েছে।

-আপনার কি কোন অসুখ করেছে? ডক্টর ওয়াটকিন্স-এর প্রশ্ন।

–তা করেছে। জ্বর। কিন্তু সে কথা পরে। আপনি ঐ চিত্রকর সম্বন্ধে যা জানেন তাই আগে বলুন। তাতেই হয়তো আমার জ্বর ছেড়ে যাবে।

অধ্যাপক তার তাহিতি আগমনের কারণ অতঃপর জানান। ডক্টর ওয়াটকিন্স শুধু কুইনাইন দিলেন না, –পল গগ্যার শেষ জীবনের একটি বিচিত্র কাহিনীর সুগার-কোটও দিলেন। অদ্ভুত সে কাহিনীঃ

ডক্টর ওয়াটকিন্স পাপীতিতে প্র্যাকটিস করছেন আজ ত্রিশ বছর। একটি ঘোড়ায় টানা গাড়ি আছে তার। তাতেই রুগী দেখতে যান। বছর পাঁচেক আগে একবার মারকুয়েশাস্ দ্বীপ থেকে তার ডাক এল। টারাভাও গ্রামের মোড়লনীর অসুখ। সমুদ্র পার হয়ে ঐ। গ্রামে যেতে হয়। ওরা একটা এক-ঘোড়ায় টানা গাড়ির ব্যবস্থা করেছিল। নৌকো ছেড়ে সাত-আট মাইল ঘোড়ার গাড়িতে পাড়ি দিয়ে ডাক্তার সাহেব টারাভাও গ্রামে এসে। পৌঁছলেন। ডাক্তার সাহেব ভাল কথক। টারাভাও গ্রামের বৃদ্ধা মোড়লনীর স্থলকায় দেহ, তার প্রকাণ্ড খাটখানা, তার পাতায় ছাওয়া ঘর, চুরুট খাওয়ার নিখুঁত বর্ণনা দিলেন। রোগী দেখা শেষ হলে ওরা ডাক্তার সাহেবকে পাশের ঘরে নিয়ে এল। সেখানে তার আহারের আয়োজন হয়েছে। সাহেব মানুষের জন্য একটা চারপায়া টেবিল আর টুলের ব্যবস্থাও ওরা করেছিল–না হলে ওরা সচরাচর মাটিতে বসেই খায়। কাঁচা মাছ, কঁকড়া কঁচকলা ভাজা, ঝলসানো মুরগী আর নারকেলের একটা তরকারী। এলাহী আয়োজন। ডাক্তার সাহেব আহার করতে করতেই লক্ষ্য করেন বছর সাতেকের একটা ছোট মেয়ে বারে বারে সে ঘরে ঢুকতে চাইছে, আর সকলে তাকে বারে বারে তাড়িয়ে দিচ্ছে। ছোট মেয়েটির মাজায় বাঁধা ন্যাকড়াটা শতছিন্ন এবং ধূলি-ধূসরিত। মাথার চুলগুলো জটা পাকানো। ও কি ভিখারীর মেয়ে? ভিক্ষা চাইছে? আহারান্তে গাড়িতে চড়বার সময়ও ডাক্তার সাহবের নজর পড়ল মেয়েটির দিকে। ডাগর চোখ মেলে সে তাকিয়ে আছে ওঁর দিকে। সবার ধমকে আর কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না। ডাক্তার সাহেব পকেট থেকে একটি মুদ্রা বার করে ওকে দিতে গেলেন, মেয়েটি নিল না। দু হাতে মুখ ঢেকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে রইল।

–ও কার মেয়ে? কি চায়? জানতে চাইলেন উনি।

ভীড়ের মধ্যে কে যেন বলে, –ও হচ্ছে দাড়িওয়ালা পাহাড়িয়ার মেয়ে। ভিখারী নয়।

দাড়িওয়ালা পাহাড়িয়া? সে আবার কে? ওরা বুঝিয়ে বলে, –উই পাহাড়ের মাথায় জঙ্গলের ভিতর বাস করে একজন দাড়িওয়ালা বিদেশী। আর থাকে তার বউ। মেয়েটি ওদেরই। ডাক্তার সাহেব গ্রামে এসেছেন শুনে ও তাঁকে ডাকতে এসেছে। ওর বাপ, ঐ বিদেশীটার কি অসুখ করেছে বলছে। কিন্তু মুশকিল এই যে, ওদের ঐ কুঁড়েঘরে যেতে হলে পাকদণ্ডী পথ দিয়ে হাঁটাপথে যেতে হবে। গাড়ি যাবে না। তাও পাক্কা তিন মাইল। ডাক্তার সাহেব জানতে চান বিদেশীর পরিচয়, কোন্ দেশের লোক, কি নাম। ওরা বললে, তা ওরা জানে না। লোকটা কোন কাজকাম করে না। স্রেফ ছবি এঁকে দিন কাটায়। আর বাঁশী বাজায়। তবে খায় কি?কি আবার খাবে? জঙ্গলের ফলমূল, নারকেল; আর ওর বৌ য়ামায়া একপাল মুরগী পুষেছে। শহরে এসে ডিম, মুরগী বেচে যা পায় তাই খায়। গাঁয়ের লোকেরা ঐ বিদেশীর উপর চটা। লোকটা জেলখাটা দাগী আসামী। সেটা বড় অপরাধ নয়–পুলিসের হাতে পড়লে জেল তো খাটতেই হবে, সে কথা নয়, কিন্তু লোকটা অমন ছন্নছাড়া কেন? না ধরে মাছ, না করে চাষবাস, না পারে নারকেল গাছে উঠতে, না যায় সাহেবের খামারে খাটতে।

ছোট মেয়েটা তখনও পিছন ফিরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ডাক্তার সাহেবের শুধু কৌতূহলই নয়, করুণাও হল। একটা বিদেশী অসুস্থ মানুষকে না-দেখে ফিরে যেতে তার মন সরল না। বলেন, চল্ রে, আমি যাব তোর বাপকে দেখতে।

মেয়েটি তুরুক করে এদিকে ফেরে। খুশিতে ওর জলভরা দুটি চোখ জ্বলজ্বল করছে।

পাক্কা তিন মাইল চড়াই ঠেঙিয়ে ডাক্তার সাহেবের মেজাজ খিঁচড়ে গেল। দেহও ক্লান্ত। পাহাড়ের ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটি পাতায়-ছাওয়া কুটির। পথের উপরেই বিদেশীর স্ত্রী–ঐ য়ামায়া দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা মুখকাটা ডাব। মেয়েটিকে বুদ্ধিমতী বলতে হবে। এতটা পথ চড়াই ভেঙে এসে ডাক্তার সাহেব যে প্রথমেই জল চাইবেন তা ঠিকই আন্দাজ করেছে সে।

ডাবটা নিঃশেষ করে ডক্টর ওয়াটকিন্স বলেন, কোথায় তোর মরদ?

মেয়েটি তার ডান হাতটা বাড়িয়ে পাতায়-ছাওয়া কুটিরখানি দেখিয়ে দিল। দরজাটা খোলাই আছে। দাওয়ার উপর বস্ত্র দেড়েকের একটা উলঙ্গ শিশু খেলা করছে।

কি হয়েছে রে তোর মরদের? কি করছে সে? ঘুমোচ্ছে?

না, ও ছবি আঁকছে।

–ছবি আঁকছে! বলিস কি রে? তাহলে পাহাড়ের মাথায় আমাকে হটিয়ে আনলি কেন? সে গাঁয়ে যেতে পারত না?

য়ামায়া একথার জবাব দিল না। মুখ নিচু করে নখ খুঁটতে থাকে। বাচ্চাটাকে তুলে নিল কোলে। তারপর এগিয়ে যায় ঘরের দিকে। ঘরে ঢোকে না কিন্তু। দ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে ইঙ্গিত করল ওঁকে ভিতরে যেতে। ওর ব্যবহারে একটু অবাক হলেন ডাক্তার সাহেব। এগিয়ে এলেন তিনি ঘরের ভিতর। সেখানে একজন বিদেশী লোক মাটিতে বসে একখানা ছবি আঁকছে আপন মনে। রঙ-তুলি চারদিকে ছড়ানো। লোকটা কোন্ দেশের তা বোঝা যায় না। একমাথা রুক্ষ চুল, একমুখ দাড়ি-ঊধ্বাঙ্গ অনাবৃত। পদশব্দে সে পিছনে ফিরে তাকায়। ডাক্তার সাহেবকে দেখে সে উঠে দাঁড়ায়। তার চোখে বিস্ময়ের চেয়ে বিরক্তিই বেশি। ওর ভ্রতে জেগেছে একটা কুঞ্চন। হঠাৎ রুখে ওঠে জঙলি লোকটা। বলে, কি চাই?

ডাক্তার সাহেব এক কথায় জবাব দিতে পারলেন না। বলতে পারলেন না আমি কিছু চাই না, তোমার স্ত্রী আমাকে ডেকে এনেছে। অভিজ্ঞ ডাক্তার ওর মুখে শুধু বিরক্তির ব্যঞ্জনাই দেখেননি–দেখতে পেয়েছিলেন গভীরতর আর কিছু। গ্রহণের আগে সূর্যের উপর যেমন একটা ধূসর বর্ণের পেনাস্ত্রীয় স্নান ছায়াপাত হয়, তেমনি ঐ দৈত্যের মত মানুষটার মুখে কোন্ অলক্ষ্য মহাকাল এক করাল ছায়াপাত করেছেন। ওঁর পা দুটি যেন মাটিতে প্রোথিত হয়ে গেল। মানুষটার অভদ্র ব্যবহারে রাগ করতে ভুলে গেলেন। তিনি। নিরতিশয় বেদনা আর করুণায় তার অন্তঃকরণ আপ্লুত হয়ে গেল। বললেন, আপনার নাম কি? আপনি কোন্ দেশের লোক?

–সে খোঁজে আপনার কি প্রয়োজন? বডি-ওয়ারেন্ট আছে?

ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনি ভুল বুঝছেন!

কিছু ভুল বুঝিনি। আমি তো দুনিয়াকে ছেড়ে এসেছি। তবু

-আপনি অহেতুক রাগ করছেন। আমি পুলিসের লোক নই। আমার নাম ডক্টর ইভান ওয়াটকিন্স। আমি পাপীতিতে প্র্যাকটিস করি। টারাভাওয়ে রুগী দেখতে এসেছিলাম। আপনার স্ত্রী য়ামায়া আমাকে ডেকে এনেছে। আপনি নাকি অসুস্থ।

য়ামায়া একটা গাড়োল। আমার কিছু হয়নি। একটু জ্বর মত হয়েছিল, আর গা হাত পায়ে ব্যথা আছে। ও কিছু নয়, দুদিনেই সেরে যাবে। ভাল কথা, আপনার ব্যাগে কুইনিন আছে?

-আপনি আমার আগের প্রশ্নের জবাব দিন। আপনার পরিচয়?

আমার নাম গগন পাল। আমি ভারতীয়। কুইনিন আছে আপনার ব্যাগে?

–আছে। কিন্তু আপনার ম্যালেরিয়া হয়নি। কুইনিন খেতে হবে না আপনাকে।

—ও!

আপনি ঐ আয়নায় নিজের মুখটা একবার দেখুন দেখি—

–কেন?

ডাক্তার সাহেব জবাব দেন না। লোকটা একটু অবাক হয়ে যায়। তার দৃষ্টি চলে যায় ঘরের ওপ্রান্তে। সেখানে পড়ে ছিল কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো একটা সস্তা হাত-আয়না আর কাকুই। য়ামায়ার প্রসাধনের সরঞ্জাম হয়তো। বারকতক পর্যায়ক্রমে ডাক্তার সাহেব এবং ঐ আয়নাটার দিকে তাকিয়ে লোকটা সেদিকে এগিয়ে যায়। তুলে নেয় হাত-আয়নাটা। সরে আসে জানালার কাছে, আলোর দিকে। নির্নিমেষ নেত্রে তাকিয়ে থাকে নিজ প্রতিবিম্বের দিকে।

আয়নায় কিছু দেখতে পাচ্ছেন?

জঙলি মানুষটা আজ দশ বছর চুল আঁচড়ায়নি, দাড়ি কামায়নি। কত যুগ-যুগান্তর পরে সে নিজের প্রতিবিম্ব দেখল তা তার মনেই পড়ে না। সত্যি কথা বলতে গেলে তাকে স্বীকার করতে হত্যা, আমার বয়স দশ বছর বেড়ে গেছে।

–তা সে বলল না কিন্তু। বললে, কী আবার দেখব? নিজের মুখটাই দেখছি।

কিছু নজরে পড়ছে না? একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন না? নাকটা ফোলা ফোলা, গাল দুটো লাল লাল–মুখখানা কেশর ফোলানো সিংহের মত মনে হচ্ছে না কি?

গগন জবাব দেয় না। একদৃষ্টে নিজ প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু যেন দিশেহারা।

মিস্টার পাল, আমি দুঃখিত–আপনার একটা দুরারোগ্য ব্যাধি হয়েছে!

দুরারোগ্য ব্যাধি?…আমার?…কি হয়েছে আমার?

দুটি মাত্র অক্ষর। কিন্তু কথাটা আটকে গেল অভিজ্ঞ ডাক্তার সাহেবের মুখে।

ডক্টর ওয়াটকিন্স অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরীকে বলেন, –প্রফেসর, ত্রিশ বছর প্র্যাকটিস করছি আমি। দুরারোগ্য ব্যাধি যেখানে ধরা পড়েছে আমার সন্ধানী দৃষ্টিতে সেখানে আমি অকপটে সেকথা জানিয়ে দিতে দ্বিধা করিনি কখনও। এই আমার নিয়তি। লোকে বলে, আমি কর্কশভাষী। কি করব বলুন? কিন্তু এ জাতীয় মর্মান্তিক দুসংবাদ আমি সচরাচর রোগীকে বলি না; বলি তার নিকট আত্মীয়কে। যেখানে নিকট আত্মীয় কেউ নেই, সেখানে বাধ্য হয়েই কথাটা রোগীকে বলতে হয়েছে। কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে তার অনিবার্য মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছি যাতে হতভাগ্য মানুষটা সেটা সহ্য করার কিছু সময় পায়। কিন্তু এবার আমি ছিলাম নিতান্ত নিরুপায়।

জঙলি মানুষটা আয়নাখানা মাটিতে নামিয়ে রাখে। এগিয়ে আসে সামনে। দু হাত মাজায় রেখে ডাক্তার সাহেবের মুখোমুখি সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বলে, বলুন! কী হয়েছে আমার?

এবার চুপ করে থাকা চলে না। দুটি মাত্র অক্ষরে মৃত্যুদণ্ডজ্ঞা ঘোষণা করলেন ডাক্তার ওয়াটকিন্সঃ

কুষ্ঠ!

আশ্চর্য লোকটার মনের জোর! এত বড় বজ্রাঘাত সে গ্রহণ করল অবিচলিত চিত্তে। কেঁপে উঠল না থরথর করে, বসে পড়ল না মেঝেতে; মুখের একটি পেশীও কুঞ্চিত হল না। মিনিটখানেক নির্বাক দাঁড়িয়ে থেকে বললে, মায়া জানে?

এ রোগ এ দ্বীপে এত ব্যাপক যে, ওর বুঝতে অসুবিধা হয়নি বোধহয়। না হলে আপনার সামান্য জ্বর দেখে সে এভাবে আমাকে ডেকে আনত না।

গগন পাল ঘর থেকে বেরিয়ে আসে বারান্দায়। দেখে, দাওয়ায় ও-প্রান্তে বসে আছে। য়ামায়া। দু হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওর নগ্ন বুকে বাচ্চাটা লেটে আছে। বড় মেয়েটা দূরের আমগাছের আড়ালে আত্মগোপন করেছে-তার চোখে আতঙ্ক। গগন হাত বাড়িয়ে বাঁশের খুঁটিটা ধরে। ঊর্ধ্ব আকাশের দিকে মুখ তুলে অস্ফুটে কি যেন স্বগতোক্তি করে। দুর্বোধ্য ভাষায়। তার মাতৃভাষায়। ডাক্তার ওয়াটকিন্স জানেন না–সে কী বলেছিল, কাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল। অনুমান করতে পারেন না–সেটা খেদোক্তি, অভিশাপ, না প্রার্থনা।

..কী বলেছিল গগন? কাকে বলেছিল? তাহিতির রৌদ্রকরোজ্জ্বল নীল আকাশের দিকে মুখ তুলে কার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তার? পুরনো পল্টনের মেয়েদের স্কুলের কোন দিদিমিণি? তার আঁকড়াচুলো ফ্রক-পরা মেয়েটা, না কচি শালের চারার মত তার দাদাকে? অথবা হয়তো মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার মনে পড়ে গিয়েছিল আর একটি শ্যামাঙ্গী মেয়েকে সুলেখা দেবনাথকে। ও কি দুনিয়াকে ডেকে বলেছিল–তোমরা দেখে যাও, তোমাদের সব অভিশাপ আমি মাথা পেতে নিয়েছি! ঈশ্বরকে অভিশাপ। দিয়েছিল কি? অথবা হয়তো জীবন-মৃত্যুর সীমানায় দাঁড়িয়ে সে তার অনবদ্য উদাসীনতায় ঝট দিয়ে বিদায় করতে চেয়েছিল ডাক্তার ওয়াটকিন্স-এর ঐ ছেঁদো মৃত্যুদণ্ডাদেশ; বলেছিল, ঝাঁট দে!

ঘুরে দাঁড়ায়। দেখে অপরাধীর মত মাথা নিচু করে অপেক্ষা করছেন ডাক্তার সাহেব।

–ডক্টর! কতদিনের মেয়াদ আমার?

-তা কে বলতে পারে? কখনও কখনও দীর্ঘ বিশ বছরও এ রোগের মানুষকে ভুগতে দেখেছি। দু-এক বছরের মধ্যে যার যন্ত্রণার অবসান হয় সেই তো ভাগ্যবান। মৃত্যুই এরোগে একমাত্র আশীর্বাদ!

গগন পাল ধীরে ধীরে ফিরে যায় তার কুটিরে। বেরিয়ে আসে পরক্ষণেই। হাতে তার সদ্য সমাপ্ত একটি অয়েলকালার। সেটা বাড়িয়ে ধরে আগন্তুকের দিকে বলে, — ডক্টর, ভিজিট দেবার ক্ষমতা য়ামায়ার নেই। তুমি এই ছবিটা নিয়ে যাও বরং।

ডাক্তার সাহেব বলেন, ধন্যবাদ। ভিজিট তোমাকে দিতে হবে না।

হঠাৎ চটে গেল জঙলি লোকটা। গম্ভীর স্বরে বললে, –ডক্টর! আমার স্ত্রী গরীব। কিন্তু গরীবের আত্মসম্মানজ্ঞান থাকবে না, এমন কোন কথা নেই। এটা ধর। আর তুমি যা ভাবছ তা ঠিক নয়। এখানা যত্ন করে রেখে দিও। একদিন এ ছবি তোমার ভিজিটের শতগুণ তোমাকে ফেরত দেবে। কথাটা আজ তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না, নয়?

বিশ্বাস সত্যিই হয়নি ডাক্তার ওয়াটকিন্স-এর। তাহিতির একটি নিসর্গচিত্র। পাহাড় আর গাছ, পিছন-ফেরা বাঁক কাঁধে একটি মাত্র মেহনতি মানুষ। ছবির ফ্রেমটাও নিতান্ত বাজে কাঠের। বিশ্বাস হবার কথাও নয়। তবু একটি মৃত্যুপথযাত্রী চিত্রকরের শেষ অভিমানটাকে আঘাত করতে মন সরেনি। হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করেছিলেন ছবিটা। ও পাশে য়ামায়া তখন ফুলে ফুলে কাঁদছে। গগন তাকে ধমকের সুরে সান্ত্বনা দেয়, আরে বুদ্বুর মত কাঁদছিস কেন রে পাগলি?

তাহিতি দ্বীপে কুষ্ঠরোগোক্রান্তদের পৃথকীকরণের কোন ব্যবস্থা নেই।

হঠাৎ অশ্রুআর্দ্র মুখ তুলে য়ামায়া বলে ওঠে, ওরা তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে না?

গগন বলে, -না। তার আগেই আমি জঙ্গলে চলে যাব।

ডাক্তার সাহেব বলেন, জঙ্গলে মানে? এটাই তো জঙ্গল।

-না। আরও গভীর জঙ্গল আছে পাহাড়ের ওপাশে। সেখানে আদিবাসীরাও যায় । সেখানে এই ন্যাকড়াখানাও মাজায় জড়াবার দরকার হবে না। মিশে যাব অরণ্যে।

ডাক্তার সাহেব মনের চোখ দিয়ে দেখতে পান দৃশ্যটা। সভ্য জগতের একটা মানুষ আদিম অরণ্যে সম্পূর্ণ অরণ্যচারী হয়ে গেছে! বেবুন- সিম্পাঞ্জি-গেরিলার স্বগোত্র সে। একমাথা চুল, একবুক দাড়ি নিয়ে এই বিংশ শতাব্দীতে তাহিতি দ্বীপের কোন অনাবিষ্কৃত। পর্বতকরে আবার একটা উলঙ্গ নিও-হোমোস্যাপিয়ান নূতন আলতামেরার সৃষ্টি করছে!

য়ামায়া উঠে আসে। ককালে নিয়েছে উলঙ্গ বাচ্চাটাকে। তার ঊর্ধ্বাঙ্গ নিরাবরণ। শুধু। মাতৃত্বের অমৃতরসে নয়, উত্তেজনাতেই যেন ফুলে উঠেছে তার বুক। কটিদেশে একমাত্র লাজবস্ত্র। দুচোখে আর তার জল নেই, আছে আগুন। বললে, না! তোকে আমি একলা যেতে দেব না! আমরা সবাই যাব!

কী পাগলি রে তুই!–ওকে ধমক দেয় গগ্যা। বলে, –তোর তো আর অসুখ করেনি। তুই পাপীতিতে ফিরে যা। তোর আবার বিয়ে হবে, নতুন মরদ পাবি, সংসার পাবি। ছেলেমেয়েরা রইল। তুই কেন মরতে যাবি আমার সঙ্গে? কী এমন বয়স তোর?

হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল য়ামায়া। বাঁ কাঁকালে শিশু–ডান হাত দিয়ে সে জড়িয়ে ধরল প্রকাণ্ড দৈত্যটার হাঁটু; আর্ত চিৎকারে সচকিত হয়ে উঠল বনভূমি—

-না, না, না! তুই আমার মরদ! তোকে ছেড়ে আমি বাঁচব না!

পাথরে গড়া পল গগ্যার অক্ষিকোটরেও তাহলে জল থাকে! অর্ধশতাব্দীকাল দুনিয়াদারি করে গগন পাল নিজেই কি সেটা জানতে পেরেছিল কোনদিন? ফোলা ফোলা কুষ্ঠগ্রস্ত লাল গাল বেয়ে দু ফোঁটা জল ঝরে পড়ল য়ামায়ার রুক্ষ চুলে। দু চোখে জল, তবু অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল পাগল শিল্পী। সভ্যজগতের একমাত্র সাক্ষীটাকে দেখে ইংরাজীতে বললে, -মেয়েমানুষ জাতটাই এমনি নেমকহারাম! সমাজ আজও ওদের শেখাতে পারেনি সভ্যতার মূল মন্ত্রটা–চাচা আপন প্রাণ বাঁচা! স্রেফ জোঁকের মত! যাকে ধরে তাকে ছাড়ে না! জোঁকের তবু নুন আছে; এরা নিমককেও ভয় পায় না, এমনই নেমকহারাম!

য়ামায়া বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারে না? সচকিত হয়ে মুখ তুলে বলে, -কী কী বলছিস তুই ডাক্তার সাবকে? আমাকে ছেড়ে চলে যাবি?

না রে পাগলি! তাই কি পারি! আমি যে তোর মরদ!

ডাক্তার ওয়াটকিন্স প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুত হলেন। এ-রোগে রোগীকে সান্ত্বনা দিতে যাওয়াটা প্রহসনের মত শোনাবে। তাই নীরবেই বিদায় নিলেন। পাকদণ্ডী পথে ফিরে চললেন ছবিটা নিয়ে। পাপীতিতে ফিরে এলেন পরদিন সন্ধ্যায়। ক্রমে ভুলে গেলেন দ্বীপান্তরের একটি জঙলি কুষ্ঠরোগীর কথা।

প্রায় দু বছর পরে আবার তার কথা মনে পড়ল তার। কারণ বছর দুয়েক পরে আবার তিনি রুগী দেখতে এসেছিলেন টারাভাওতে–সেই মোড়লনীকে দেখতে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল কুষ্ঠরোগীটার কথা। প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, পাহাড়ের মাথায় সেই দাড়িওয়ালা জঙলি বিদেশীটা বেঁচে আছে?

–আছে বোধহয়।

বোধহয়। ওরা ঠিক জানে না। এ শুধু অনুমান। বছরখানেক আগেও তাকে দেখা গেছে। দৈত্যের মত প্রকাণ্ড একটা মানুষ নির্জন পাহাড়-পর্বতে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। একমাথা রুক্ষ চুল, একবুক কাঁচাপাকা দাড়ি, মুখখানা কেশর-ফোলানো সিংহের মত থমথমে। খালি গা, খালি পা। ছবি আঁকত সে পাহাড়ের ধারে, -ঝরনার কিনারে কখনও দূর সমুদ্রের বেলাভূমিতে। কখনও মধ্য রাত্রে ভেসে আসত একটা বাঁশের বাঁশীর সুর। গ্রামের দিকে ভুলেও আসত না। আসত য়ামায়া, গভীর রাত্রে চুপিচুপি। গ্রামের এক দোকানদারের কাছ থেকে সওদা করে নিয়ে যেত। বিনিময় প্রথা। নিয়ে আসত মুরগী, ডিম, নারকেল, কলার কাঁদি। নিয়ে যেত নুন, মোমবাতী, দেশলাই, কাপড়। দিনের বেলা আসত না। গ্রামের মানুষ সহ্য করত না তাকে। ও যে ছোঁয়াচে রুগীর রোগজীবাণু সর্বাঙ্গে বয়ে নিয়ে বেড়ায়। ওর ছেলেমেয়েরাও আসে না গ্রামে। তারপর আর বছরখানেক লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না। তবু সে মরেনি বোধহয়। কারণ তাহলে য়ামায়া ফিরে আসত। য়ামায়া যে বেঁচে আছে এটুকু ওরা জানে, তাকে চোখে না দেখলেও। বাঁশীর শব্দটাও বন্ধ হয়েছে।

এবার কেউ ওঁকে যেতে বলেনি। তবু ডাক্তার ওয়াটকিন্স একটা মলম, কিছু বিস্কুট, গুঁড়ো দুধ, দেশলাই আর নুন নিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন বলে স্থির করলেন। কেউ পথ দেখিয়ে সঙ্গে যেতে রাজী হল না। ও পাহাড়টা নিষিদ্ধ-অঞ্চল বলে মেনে নিয়েছে ওরা। অগত্যা একাই রওনা হলেন তিনি।

বনপথটা মুছে এসেছে। পায়ে-চলা পথে পায়ের দাগ আজকাল পড়ে না। দু পাশের আদিম অরণ্য তার সাবেক অধিকার ফিরে পাওয়ার উৎসাহে ঝুঁকে পড়েছে। পথে অসংখ্য ডাব পড়ে আছে; কেউ কুড়িয়ে নিয়ে যায়নি। গতবার এত বন্য জন্তুও দেখেননি। এবার খরগোশ আর বন্য মোরগদের দেখলেন নির্ভয়ে পথের উপর চলাফেরা করতে। পায়ে-চলা পথটা ক্রমশঃ মিলিয়ে এসেছে–বু ক্ষীণ একটা চিহ্ন আজও আছে। তাই শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছতে পারলেন পাহাড়ের মাথায় সেই পাতায় ছাওয়া কুটিরের সামনে।

কাত হয়ে পড়েছে ঘরটা। সংস্কারের অভাবে। য়ামায়া কুটিরের সামনে একটা ধারালো অস্ত্র দিয়ে নারকেলের ছোবড়া ছাড়াচ্ছিল। সম্পূর্ণ উলঙ্গ সে। পদশব্দে ব্ৰস্তা হরিণীর মত ঘরের ভিতর ছুটে পালিয়ে যায়। ডাক্তার-সাহেব থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন। একটু পরে ফিরে আসে য়ামায়া, তার মাজায় জড়ানো একখণ্ড কাপড়। কাকালে সেই শিশুটি। বছর দুই বড় হয়েছে ইতিমধ্যে।

-তোমার মরদকে দেখতে এসেছি. সে কোথায়?

–আচ্ছা, ওকে খবর দিই।

য়ামায়া ঢুকে গেল ঘরের ভিতর। ডাক্তার সাহেবও ওর পিছন পিছন যাচ্ছিলেন, হাত নেড়ে বারণ করল মেয়েটি। দ্বারের বাইরেই দাঁড়িয়ে পড়েন উনি। খোলা দরজা দিয়ে ভেসে আসছে একটা দুর্গন্ধ। এ গন্ধ ডাক্তার সাহেবের পরিচিত। গলিত কুষ্ঠের পুঁজের গন্ধ। ঘরের ভিতরে যে কথোপকথন হল তা সবই স্বকর্ণে শুনলেন উনি। গগনের কণ্ঠস্বর বিকৃত। ডাক্তার সাহেব বুঝতে পারেন ওর গলার স্বরনালীও এতদিনে মহামারীর আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত। য়ামায়া বেরিয়ে আসে। বলে, –ও দেখা করবে না। তুই চলে যা।

একথা স্বকর্ণেই শুনেছিলেন ডাক্তার সাহেব। তবু তিনি পীড়াপীড়ি করেন। কিন্তু প্রভুভক্ত কুকুরীর মতই য়ামায়া দরজা আড়াল করে দাঁড়াল। ভিতরে যেতে দিল না ওঁকে। ডাক্তার সাহেব হতাশায় কাঁধ ঝাঁকালেন। উপহারের পুটলিটা দাওয়ায় রেখে পিছন ফিরলেন। অহেতুক এতটা পথ হেঁটে এসেছেন তিনি। তারপর য়ামায়াকে বলেন, তোমার মেয়েকে ডাক, আমাকে ফিরে যাবার রাস্তাটা দেখিয়ে দিক।

-সে নেই।

নির্বিকার মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দূরের আমগাছ তলাটা দেখিয়ে দিল। সদ্য কবর দেওয়া হয়েছে কাউকে, মাটিটা উঁচু হয়ে আছে। সহানুভূতিতে ডাক্তার সাহেবের মনটা ভারী হয়ে আসে। বলেন, এখানে তুমি কেন পড়ে আছ? তুমি পাপীতিতে ফিরে যাও। ও বাঁচবে না। ওকে মরতে দাও।

আয়ত দুটি চোখ মেলে য়ামায়া একবার তাকায়। সে রীতিমত রোগা হয়ে গেছে। চোখ দুটি বসে গেছে। চোয়ালের হনু দুটো উঁচু হয়ে উঠেছে। আজকাল সেও বোধকরি চুল আঁচড়ায় না, মাথায় জটা হয়ে গেছে তার। বললে, –ও যে আমার মরদ!

এত দুঃখেও হাসি পেল ডাক্তার সাহেবের। ঠিকই, বলেছিল সেদিন ঐ জঙলি মানুষটা! মেয়েমানুষ জাতটাই নিমকহারাম! যুগ-যুগান্তর ধরে তালিম দিয়েও সভ্য সমাজ ওদের শেখাতে পারেনি মানব-জীবনের সেই মূল মন্ত্রটা–চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা!

–আবার যদি কখনও এদিকে আসি, তোমাদের জন্য কি নিয়ে আসব?

–কিছু রঙ। ।

রঙ? ও কি এখনও ছবি আঁকতে পারে?

–ও তো ছবিই আঁকছে বসে। দিন-রাত ছবি আঁকে।

–ও ক্যানভাস পায় কোথায়?

না, দেওয়ালে ছবি আঁকছে এখন।

–কী রঙ চাই, ওকে জিজ্ঞাসা করে এস।

য়ামায়া মাথা ঝাঁকিয়ে বললে, –যে কোন রঙ। ও তো চোখে দেখে না। দুটি চোখই ওর নষ্ট হয়ে গেছে।

এ আবার কী কথা? যে চোখে দেখতে পায় না সে ছবি আঁকে? ডাক্তার সাহেব আর কথা বাড়াননি। য়ামায়া ওঁকে অনেকটা পথ এগিয়ে দিয়ে গেল। লোকালয়ের কাছাকাছি এসে বললে, –এবার আমি যাই। ওরা দেখতে পেলে ইট মারবে!

আরও মাস দুয়েক পরের কথা। সেদিন বিলাতের ডাক এসেছে। ডাকে এক বাক্স স্যাম্পেল ওষুধ পেলেন ডাক্তার সাহেব। সদ্য আবিষ্কার। কুষ্ঠ রোগের। তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে গেল টারাভাওয়ের সেই অন্তেবাসী শিল্পীর কথা। য়ামায়া কিছু রঙ চেয়েছিল, তাও তো দিয়ে আসা হয়নি। এবার কেউ তাকে ডাকেনি। তবু অন্তরে য়ামায়ার আহ্বান শুনতে পেলেন যেন। ওষুধের প্যাকেট, কিছু খাবার আর কয়েক টিউব রঙ নিয়ে উনি স্বতঃপ্রবত্ত হয়ে আবার এলেন টারাভাওয়ে।

টারাভাওয়ের লোকেরা বললে, য়ামায়া এখনও ফিরে আসেনি। এবারও একাই তাকে সেই পাকদণ্ডীর পথ বেয়ে পাহাড়ে উঠতে হল। এবার আদিম অরণ্য আরও নির্ভয়ে অগ্রসর হয়ে এসেছে পথ-চলতি পাকদণ্ডী সড়কের উপর। সেটার চিহ্নমাত্র নেই। তবু দুবার এ পথে এসেছেন। অনেকটা চেনা হয়ে গেছে। অবশেষে পাহাড়ের মাথায় সেই পাতায় ছাওয়া কুঁড়েঘরখানির সামনে এসে দাঁড়ালেন। এবার য়ামায়ার সাড়া পাওয়া গেল না। চারদিক একেবারে নিস্তব্ধ। শুধু অজানা পাখির ডাক, আর বন-ঝিঁঝির একটানা একটা শব্দ। ডাক্তার ওয়াটকিন্স পোঁটলাটা নামিয়ে রেখে এগিয়ে যান ঘরের দিকে। হাট করে ভোলা আছে দরজাটা। ঘরটা আরও বেঁকে গেছে। বারান্দায় ভাঙা একটা মাটির কলসী। জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই। য়ামায়ার নাম ধরে ডাকলেন বার দুয়েক। প্রতিধ্বনিই ফিরে এল শুধু। খোলা দরজা দিয়ে একটা দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। নাকে রুমালটা চেপে ধরেন তিনি। তারপর ভিতরে ঢুকে পড়েন।

ভিতরটা রীতিমত অন্ধকার। দরজাটা অত্যন্ত ছোট–তা দিয়ে অল্প আলো আসছে, জানলাটা বন্ধ। প্রখর সূর্যালোক থেকে ও-ঘরে ঢুকে কিছুই দেখতে পেলেন না উনি। তারপর আস্তে আস্তে অন্ধকারে চোখটা সয়ে গেল। সান্ধ্য-আকাশের তারার মত এখানে ওখানে একটি একটি করে ফুটে উঠল কয়েকটি দৃশ্য। কেমন যেন গা ছমছম করে উঠল ওঁর। এ কী! উনি তো কোন ঘরের ভিতর নেই–তার চারদিক ঘিরে শুধু গভীর অরণ্য! গাছ গাছ আর গাছ! পাহাড় ঝরনা-ঘন বেতের ট্রপিক্যাল জঙ্গল! দূরে দূরে কিছু নারকেল গাছ, আম গাছ–আর বাদবাকি সবই অচেনা গাছ। কিন্তু জঙ্গল তো নির্জন নয়। ঐ তো কতকগুলি সম্পূর্ণ উলঙ্গ মানুষ!

–প্রফেসর ম্যাকগ্রেগরী, আমি ছবির কিছুই বুঝি না। ও ছবিরও কিছু বুঝতে পারলাম না। মেঝে থেকে সিলিঙ পর্যন্ত চারদিকের দেওয়ালে একতিল কোথাও ফাঁকা নেই, এটুকু দেখলাম শুধু। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। একটা অতিকায় আদিম জন্তু যেন তার আঁশওয়ালা লেজ দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরছে। আমি সিসটিন চ্যাপেলে মিকেলাঞ্জেলোর লাস্ট-জাজমেন্টও দেখেছি কিন্তু সেখানে মনকে তৈরী করেই নিয়ে গিয়েছিলাম–আমি জানতাম মিকেলাঞ্জেলো মহান শিল্পী, আমি জানতাম, সিটিন চ্যাপেল বিশ্বের এক বিস্ময়! কিন্তু এ কী! তাহিতি দ্বীপের এক দূরপ্রান্তে পর্ণকুটীরে এ জিনিস যে আমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। আমার কেমন মনে হল জানেন? একবার ইংল্যাণ্ডে ডার্টমুরে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। নীর অন্ধকার রাত্রি। শুধু আকাশ ভরা তারা ছিল। আমি হাতড়ে হাতড়ে পথ চলছিলাম। মনে হচ্ছিল–এ পথ অসীমে গিয়ে মিশেছে, এ রাত্রিও বোধহয় নিষ্প্রভাত! বিশ্ব চরাচরে আমি একা, নিতান্ত একা! হঠাৎ আমি হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। অন্ধকারে হাত বুলিয়ে দেখি যাতে হোঁচট খেয়েছি সেটা একটা কবর। আমার হাত-পা অবশ হয়ে গিয়েছিল। তারার আলোয় হঠাৎ নজর হল, পথ ভুলে আমি একটা গোরস্থানে এসে পৌঁছেছি! আমার চারদিকে শুধু কবর, কবর আর কবর! সারি সারি ক্রুশচিহ্ন! তারা হাতছানি দিয়ে আমায় ডাকছিল! কারা যেন উইলো পাতার নিঃসরণের সঙ্গে তাল রেখে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে আমাক বলতে চাইছিল তাদের অতীত ইতিহাসের কথা যখন তারা রক্ত মাংসের জীব ছিল! অথচ কবরগুলো বোবা! ভয়ে আমি সেবার আর্তনাদ করে উঠেছিলাম!…এখানেও ঐ প্রাচীরচিত্রের উলঙ্গ নরনারীর দল যেন আমাকে কী কথা বলতে চায়, বলতে পারছে না-বলছে, অথচ আমি বুঝতে পারছি না; এখানেও তেমনি কে যেন আমার কাঁধের উপর উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলল! কে যেন বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে। আমি চিৎকার করতে গেলাম, কিন্তু স্বর ফুটল না আমার কণ্ঠে! ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি য়ামায়া!

ছুটে বেরিয়ে এসেছিলাম অন্ধকূপ থেকে। হ্যাঁ, য়ামায়াই। বারান্দার খুঁটি ধরে বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে প্রেতাত্মার মত।

–য়ামায়া! য়ামায়া!

মেয়েটা মুখ তুলে তাকায়। মেয়ে নয়, তার কঙ্কাল! তার প্রেতাত্মা!

তোমার মরদ কোথায়?

একই ভঙ্গিতে তার ডান হাতখানা বাড়িয়ে এবারেও সে দেখিয়ে দিল দূরের আমগাছটা। আগের বার যে সমাধিস্থূপটা দেখেছিলাম তারই অদূরে পড়ে আছে গগন পালের মৃতদেহ। গলিত কুষ্ঠের অন্তিম অবশেষ! দুর্গন্ধটা তারই। গাছের ডালে বসে আছে কটা শকুন। গাছের আড়ালে ওগুলো শেয়াল অথবা নেকড়ে!..

গগ্যা মারা গিয়েছিল দুদিন আগে। য়ামায়া তাকে টানতে টানতে ঐ গাছতলা পর্যন্ত নিয়ে গেছে। একটা গর্ত খুঁড়বার চেষ্টাও সে করেছে দুদিন ধরে। কিন্তু অনাহারে সে দুর্বল। একা হাতে অতবড় দানবটাকে সে মাটির বুকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি। ঐ শকুন আর শেয়ালের হাত থেকে তার মরদকে রক্ষা করতেই বেচারি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

ডাক্তার ওয়াটকিন্স ওর হাত থেকে কোদালটা তুলে নিলেন। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সমাধিস্থ করলেন জঙলি মানুষটাকে। খাদ্যদ্রব্য কিছু ছিল না। ভাগ্যে উনি কিছু বিস্কুট আর পাঁউরুটি এনেছিলেন। কতদিনের অনাহার কে জানে? য়ামায়া দুর্ভিক্ষপীড়িতের মত খেল। ডাবের জল খেল। একটু সুস্থ হয়ে বসল দেওয়ালে ঠেস দিয়ে।

-ওর বাড়ির ঠিকানা জান?

য়ামায়া তার রুক্ষ চুলের মাথাটা ঝাঁকালো।

-তোমার ছোট ছেলেটাকে দেখছি না! সে কই?

এবারও একইভাবে মাথা ঝাঁকায়, অর্থাৎ সেটাও গেছে!

ডাক্তার সাহেব বলেন, ভেবে আর কি হবে য়ামায়া! তুমি আমার সঙ্গে চল, তোমাকে গ্রামে পৌঁছে দিয়ে যাব।

আবার মাথাটা ঝাঁকায় বলে, -ঐ ঘরটা–

-ঘরটা?

তাই তো। ঘরখানার কথা মনে পড়ল এতক্ষণে। ওটার কথা মনেই ছিল না। ঘরটায় কি যেন অদ্ভুত সব ছবি আঁকা আছে না? কি ছবি? মনে পড়ছে না। অথচ ঘন্টাখানেক আগে ওটার ভিতর অদ্ভুতদর্শন কি যেন দেখেছিলেন মনে পড়ছে। ভয় পেয়েছিলেন। এবার য়ামায়াকে সঙ্গে নিয়ে দ্বিতীয়বার প্রবেশ করেন সেই পাতায় ছাওয়া ঘরখানায়। দেওয়ালের ছবিগুলো ভাল করে দেখতে।

অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরী আর কৌতূহল দমন করতে পারেন না। বলেন, চিত্রের বিষয়বস্তুটা ঠিক কি ছিল বলুন তো? কী বলতে চেয়েছেন শিল্পী।

তা আমি কি জানি? কিছুই বোধগম্য হয়নি আমার। একটা আদিম অরণ্যকে দেখেছিলাম, এটুকু মাত্র মনে আছে। সৃষ্টির আদিতে আদম আর ঈভ যে অরণ্যে বাস করত সেই হারিয়ে যাওয়া বনভূমিই যেন এতদিনে প্রাণ পেয়ে উঠেছে। অদ্ভুত সুন্দর সে বনভূমি বীভৎস আর ভয়াবহ। প্রকৃতির অন্তর্লীন আত্মাকেই উদঘাটিত করেছেন শিল্পী। গাছপালা, পাহাড় আর নদী–সবই যেন জীবন্ত। সবই যেন প্রাণরসে ভরপুর প্রতিটি পার্চিং স্টোন! আর সেই আদিম অরণ্যে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াচ্ছে কতকগুলো অপার্থিব অদ্ভুত জীব। তারা বিশ কোটি বছর আগেকার জুরাসিক যুগের অতিকায় টিরানোসরাসের স্বগোত্র হতে পারে, আবার অতি আধুনিক মানব-মনের অবচেতন-অরণ্যের বাসনা কামনাও হতে পারে! আর ছিল মানুষ–হ্যাঁ, পুরুষ-স্ত্রী-শিশু বৃদ্ধ-পূৰ্ণযৌবনা নারী! সবাই সম্পূর্ণ উলঙ্গ। তাদের কেউ কেউ আবার টেরোডেটিলের মত আকাশে ভেসে। চলেছে। তাদের সত্তা আছে, ওজন নেই। ওরা মানুষের মত দেখতে, অথচ ঠিক মানুষ। নয়। যেন অস্থি-মজ্জা-মেদ-রক্ত-মাংস দিয়ে ওদের গড়েননি সৃষ্টিকর্তা–গড়েছেন ঈর্ষা প্রেম-দ্বন্দ্ব-করুণা আর জিঘাংসা দিয়ে। তারা মানুষখেকো বাঘের মত নিষ্ঠুর অথচ দেহাতীত প্রেমের মত স্বর্গীয়! আমি আপনাকে বোধ হয় ঠিক বোঝাতে পারছি না প্রফেসর। তবে এটুকু বলব, আপনি নিজেও সে ছবি দেখলে চমকে উঠতেন। কারণ আপনার মনে হত ওগুলো কোন অলৌকিক জীবের চিত্র নয়। মনে হত ওগুলো আদৌ কোন ছবি নয়–দেওয়াল-জোড়া ওটা একটা আয়না; কারণ আপনার প্রতিবিম্বই দেখতে পাচ্ছেন আপনি! ও ছবি আপনারই!

অধ্যাপক ম্যাকগ্রেগরী উৎসাহে উঠে দাঁড়ান। বলেন, –ডক্টর! আমাকে নিয়ে চলুন সেখানে। ও-ছবি নিয়ে আসা যাবে না । কিন্তু আমার কাছে কালার্ড ফিল্ম আছে। প্রতিটি দেওয়ালের

বাধা দিয়ে ডাক্তার সাহেব বলেন, আমি দুঃখিত প্রফেসর। সে ছবি নেই।

–নেই! কেন? কি হল ঘরখানার?

ডাক্তার সাহেব তার শেষ দিনের অভিজ্ঞতা বলতে থাকেন। য়ামায়াকে তিনি সভ্য দুনিয়ায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন সঙ্গে করে। মেয়েটি রাজী হয়নি। বলেছিল, সে পরে আসবে। তার বুঝি কী একটা কাজ ওখানে বাকি আছে। কী কাজ, জানতে চেয়েছিলেন ডাক্তার-সাহেব। জবাবে য়ামায়া বলেছিল–ঘরখানা জ্বালিয়ে দিতে হবে!

মৃত্যুর পূর্বে গগন নাকি য়ামায়াকে নির্দেশ দিয়ে যায়–তার জিনিস কাপড়, রঙ, তুলি, ছবি সব কিছু ঐ ঘরখানায় ভরে যেন তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। কুষ্ঠব্যাধির বীজের যেন কোন অবশেষ না থাকে। ডাক্তার সাহেব য়ামায়াকে বারণ করলেন। ছবির কিছু না বুঝলেও উনি এটুকু বুঝেছিলেন যে, এ এক অদ্ভুত সৃষ্টি। কিছু ফটো তুলে রাখার কথা তার মনে হয়েছিল। সেকথা তিনি জানিয়েছিলেন জঙলি মেয়েটিকে। বলেছিলেন আমি নিজে ডাক্তার, এ রোগের সংক্রামতার কথা আমার চেয়ে কেউ বেশি বোঝে না। আমি বারণ করছি। দু-চারদিন পরেই আমি ফিরে আসব, দুদশখানা ফটো নেব। তারপর আমি নিজেই জ্বালিয়ে দিয়ে যাব।

য়ামায়া চুপ করে অবসন্নের মতো বসে রইল। হা-না কিছুই বলল না। অগত্যা একাই ফিরে চললেন ডাক্তার সাহেব। আধখানা পথও আসেননি–হঠাৎ দেখতে পেলেন পাহাড়ের মাথায় আগুন লেগেছে। আবার চড়াই ভেঙে উপরে উঠে গেলেন। দেখেন, প্রভুভক্ত কুকুরীর মত য়ামায়া তার মরদের শেষ আদেশ পালন করেছে নিঃশব্দে। পাতায় ছাওয়া কুঁড়েঘরখানা একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত!

…একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে প্রফেসর ম্যাকগ্রেগরীর।

ডাক্তার ওয়াটকিন্স তার দীর্ঘ কাহিনী শেষ করে একটা চুরুট ধরান। বলেন, –শিল্পীর ছবিখানা আমি আমার চেম্বারেই টাঙিয়ে রেখেছি। আচ্ছা, প্রফেসর! গগন পাল কি সত্যিই একজন প্রতিভাধর শিল্পী? এ ছবিখানি আমি যদি বিক্রি করতে চাই তার খদ্দের হবে?

প্রফেসর ম্যাকগ্রেগরীও তার পাইপ ধরাতে ব্যস্ত ছিলেন। বলেন, -হবে। খদ্দের আপনার সামনে উপিস্থত। ছবিখানা আমি কিনব। কত দাম নেবেন?

ডাক্তার সাহেব ইতস্ততঃ করে বলেন, সত্যি কথা বলতে কি, ছবির কী রকম দাম হয় আমার কোন ধারণা নেই। আপনি যা ন্যায্য মনে করুন, দিন।

–বেশ। তাই দিচ্ছি আমি। একটু হিসাব কষি তাহলে। আগে বলুন, আপনি সারাদিনের জন্য দূর গ্রামে রুগী দেখতে গেলে কত ভিজিট নেন?

–একথা কেন?

বলুনই না!

দশ ডলার।

অধ্যাপক তার বুক-পকেট থেকে ভারি ওয়ালেটটা বার করে বলেন, আপনি তিনবার শিল্পী গগন পালকে দেখতে গিয়েছিলেন। সুতরাং ত্রিশ ডলার আপনার প্রাপ্য। আপনি নিজেই বলেছেন যে, শিল্পী আপনাকে বলেছিলেন–গরীবের যে আত্মসম্মান জ্ঞান থাকবে না এমন কোন কথা নেই

–আপনি কি পুরো ত্রিশ ডলার দাম দিতে চান? ঐ সামান্য ছবিটার?

না। তাহলে শিল্পী গগন পাল হবেন মিথ্যাবাদী, আর আমি জোচ্চোর।

তার মানে?

–শিল্পী আপনাকে আরও বলেছিলেন–এ ছবি ভবিষ্যতে আপনার ভিজিটের শতগুণ আপনাকে দেবে। এই নিন–তিন হাজার ডলার ।

ডক্টর ওয়াটকিন্স জবাবে কি বলেছিলেন তা আর বলেননি অধ্যাপক। দ্বৈপায়ন-দাদুকে শুধু বলেছিলেন, ডক্টর লাহিড়ী! আপনি জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। বাড়ি-গাড়ি-পশার প্রতিপত্তি সবই হয়েছে। তবু কিছু মনে করবেন না–আজ থেকে একশো বছর পরে কেউ যদি আপনার নাম উচ্চারণ করে তবে তা করবে এজন্য যে, আপনি গগন পাল আর চন্দ্রভান গর্গের বন্ধু ছিলেন!

কথাটা জীবনে এই প্রথম শুনছেন না ডক্টর দ্বৈপায়ন লাহিড়ী। তফাত এই যে, প্রথমবার সেটা পাগলের প্রলাপ মনে হয়েছিল–এবার আর তা হল না!

.

১৭.

দীর্ঘ কাহিনীর উপসংহারে দাদু বললেন, গগনের বিরুদ্ধে আমার পর্বত-প্রমাণ অভিযোগ ছিল। তাকে আমি আজীবন ক্ষমা করিনি। শান্তি দেবীর প্রতি তার নিষ্ঠুরতা, বাবলু-মিণ্টির প্রতি তার নিমর্ম ঔদাসীন্য, বটুকের প্রতি নিক্ষিপ্ত তার পৈশাচিক বিদ্রূপ এবং সুলেখার প্রতি নৃশংস বিশ্বাসঘাতকতায় আমি মর্মান্তিক ক্ষুব্ধ ছিলাম। অর্ধশতাব্দীকাল ধরে আমার মনে যে হিমালয়ান্তিক অভিযোগ পুঞ্জীভূত হয়েছিল তার কৈফিয়ৎ গগন দিয়ে গেছে একটিমাত্র ছত্রে :

—A mans work is the explanation of that man!
একটা মানুষের সৃষ্টিই তার অস্তিত্বের কৈফিয়ত!

আর চন্দ্রভান! ভিন্সেন্ট ভান গর্গ মরেনি, মরতে পারে না! সে বেঁচে আছে এই আমাদেরই আশেপাশেই, –সে নিশ্চয় ফিরে এসেছে এই পৃথিবীতে। শুধু আমরা তাকে ঠিকমত চিনতে পারছি না। তোমাকে কি বলব নরেন, এই বৃদ্ধ বয়সে গোলদীঘির ধারে, কফি-হাউসের কোণায়, মুক্তি-মেলার আসরে আজও তাকে খুঁজে বেড়াই আমি। নিদারুণ দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত কোন আর্টিস্টকে যখন কলকাতার ফুটপাতে স্কেচ করতে দেখি আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি! মনে হয়?–ঐ তো ভিন্সেন্ট! সেই খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সেই ময়লা পায়জামা আর ছেঁড়া পাঞ্জাবি! হাতে ভঁড়ের চা, মুখে সবুজ-সুতোর বিড়ি! মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত-ঘরের সন্তান, –কোথায় লেখাপড়া শিখে চাকরিবাকরি করবি, বিয়ে-থা করবি, র‍্যাশন আনবি, সংসার করবি–তা নয়, ওরা ছবি আঁকতে বসেছে। বাড়িতে নিত্য গঞ্জনা, বন্ধুমহলে পাগলা বলে পাত্তা পায় না, বিয়ের বাজারে ওরা কানাকড়ি! কণ্ঠা বারকরা ঘাড় কুঁজো থুবড়িগুলো পর্যন্ত ওদের দিকে চোখ তুলে তাকায় না! ওরা যে পাগলামির আগুনে ওদের হাতের সব রেখা–সৌভাগ্য-রেখা, আয়ু-রেখা, যশঃ-রেখা–সব পুড়িয়ে ফেলেছে! ভাল কথা বললে শোনে না, গাল দিলে ভ্রূক্ষেপ করে না–বেহায়াগুলোর দু কান কাটা! আমি ওদের মধ্যে খুঁজে বেড়াই–ওর মধ্যে নতুনকরে-জন্ম-নেওয়া কোষ্টা আমার সেই হারানো বন্ধু ‘কানকাট্টা সেপাই’ ভিন্সেন্ট ভান গর্গ?

.

পরিশিষ্ট

[Vincent Van Gogh]

১৮৫৩ : ৩০শে মার্চ হল্যাণ্ডের পল্লীতে ভান গখ-এর জন্ম। অনুজ তেও ভান গখ ছিলেন চার বছরের ছোট।

১৮৬৮ : হেগ শহরে গোপিল আর্ট ডীলার্স কোম্পানিতে শিক্ষানবিশ হিসাবে প্রথম চাকরিতে প্রবেশ। পাঁচ বছর পরে ভঁার্স হেগ থেকে লণ্ডন অফিসে বদলি হয়ে যান এবং হেগ অফিসে তার শূন্য পদে অনুজ তেও বহাল হন। তেও ঐ কোম্পানিতে সারা জীবন চাকরি করেন।

১৮৭৩-৭৪ : লণ্ডনে যে বাড়িতে ভ্যাস থাকতেন সেই ল্যাণ্ড-লেডির চটুল-স্বভাবা কৌতুকময়ী কন্যা উরসুলা লায়রকে ভালবেসে ফেলেন। রহস্যময়ী উরসুলার হৃদয় জয় করেছেন বলে বিশ্বাসও করেন; কিন্তু যেদিন মেয়েটির কাছে বিবাহের প্রস্তাব করলেন সেদিন সে জানালো যে, সে বাকদত্তা। প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে ভ্যাঁসঁ ধর্ম-জগতের দিকে ঝুঁকলেন। কাজে মন নেই, ফলে চাকরি গেল।

১৮৭৬-৭৯ : ভান গখ নানান জীবিকার সন্ধানে ফেরেন–স্কুলে শিক্ষকতা, বইয়ের দোকানে সেলসম্যানের চাকরির চেষ্টা করেন, কিন্তু মন বসে না। মনে হয় তিনি কোন মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন; সেটা কী তা বুঝতে পারেন না। ঐ সময় তিনি দিনে আঠারো ঘন্টা পড়াশুনা করতেন–বাইবেল ও সাহিত্য। আমস্টার্ডামে গিয়ে যাজক হবার চেষ্টা করেন এবং গ্রীক ও ল্যাটিন শিক্ষা করেন। ১৮৭৮ সালে শিক্ষানবিশী ঈভানজেলিস্ট হিসাবে ছয় মাসের জন্য নিযুক্ত হন। বেলজিয়ামের বরিনেজ বা কয়লাখনি অঞ্চলে ধর্মপ্রচারের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে প্রেরিত হন। দুর্ভাগ্যক্রমে কয়লাকুঠির কর্তৃপক্ষ এবং চার্চ-সম্প্রদায় উভয়পক্ষের কাছেই তিনি বিরাগভাজন হয়ে পড়েন। অপরাধ–মালকাটাদের তিনি নিজ বিবেকের নির্দেশ অনুসারে সেবা করতে চেয়েছিলেন। কোলিয়ারির একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহত মজদুরদের আত্মার সদ্গতি কামনায় যখন তিনি ফিউনারাল সার্ভিসে রত তখন নাটকীয়ভাবে চার্চ-সম্প্রদায়ের কর্মকর্তারা আসেন, তাঁকে পদচ্যুত ও চার্চ থেকে বিতাড়িত করেন।

১৮৮০ : মালকাটাদের প্রতিকারহীন দুর্দশায় ঈশ্বরের ঔদাসীন্যে মর্মাহত হয়ে ভান গখ ঈশ্বরে বিশ্বাস হারান। হঠাৎ ছবি-আঁকা শুরু করেন। শিল্পগুরু রেভারেণ্ড পিটারসন ছিলেন ব্রাসেল্স-এ। আশি কিলোমিটার হেঁটে তাঁকে ছবি গুলি দেখাতে আসেন। পিটারসন তাঁর ছবিগুলি প্রথম দেখে হতাশ হন। পরে ঐ স্কেচগুলির ভিতরেই তার প্রতিভার সন্ধান পেয়ে তাকে শেখাতে শুরু করেন। ভান গখ কিন্তু প্রাথমিক পাঠ শেষ করে পুনরায় কয়লাকুঠিতে ফিরে আসেন। নিদারুণ অর্থাভাবে অনশনে যখন তিনি মৃত্যুমুখে, সহসা তেও এসে তাকে উদ্ধার করেন। এই বছরই তিনি তার বিধবা ফার্স্ট কাসিন বা ভগ্নী (মতান্তরে ভাগ্নি) কী ভস্-এর প্রেমে পড়েন; কিন্তু কী তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর্স কী-এর পিতার সম্মুখে তার প্রেমের একনিষ্ঠার প্রমাণ দিতে নিজ দক্ষিণ হস্ত প্রদীপ শিখায় বাড়িয়ে ধরেন। এ দহন চিহ্ন তাঁর বাকি জীবনের সঙ্গী হয়ে ছিল।

১৮৮১-৮৩ : কী-এর কাছে পুনর্বার প্রত্যাখ্যাত হয়ে শিল্পী সর্বতোভাবে চিত্রশিল্পে আত্মনিয়োগ করেন। তেও প্রতি মাসে তাঁকে মাসোহারা পাঠাতেন। তাতেই তার গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা হত। এই সময়ে ক্রিস্টিন হুর্নিক নামে একটি গর্ভবতী বারাঙ্গনাকে একদিন তার বাসায় নিয়ে আসেন। অভিশপ্ত জীবনের ফলশ্রুতি হিসাবে ক্রিস্টিনের একটি সন্তান হয়। শিল্পী ক্রিস্টিনকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন, সমাজে প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দু বছরের মাথায় ক্রিস্টিন তাকে ত্যাগ করে অভ্যস্ত জীবনে ফিরে যায়। গার্হস্থ্য জীবনের মাধুর্য, রমণীর স্নেহ-ভালবাসা এই দু বছরই পেয়েছিলেন শিল্পী।

১৮৮৩-৮৬ : পুনরায় দেশে ফিরে আসেন। শিল্পদর্শনে নূতন চিন্তাধারা জাগে। সৌন্দর্যের প্রতি সভ্যজগৎ-স্বীকৃত তথাকথিত বুর্জোয়া মনোভাব তিনি অস্বীকার করেন দুঃখ, দারিদ্র্য, অবহেলিত মনুষ্য-সমাজের যন্ত্রণার চিত্র তার শিল্পে তুলে ধরতে সচেষ্ট হন। কুৎসিত কদাকার বিষয়বস্তুও যে শিল্প-পদবাচ্য হতে পারে এই নূতন সত্য প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হন। ফলে তাঁর সৃষ্টি স্বীকৃতি পায় না। এমিল জোলার সাহিত্য এবং দেলাক্রোয়ের শিল্পদর্শন তার উপর প্রভাব বিস্তার শুরু করে। Potato Eaters এই যুগে আঁকা।

১৮৮৬-৮৭ : আন্টওয়ার্পে এসে রুবেন্স-এর শিল্প দেখে আকৃষ্ট হন। এই সময়ে অনেকগুলি জাপানী উডকাট দেখেন। সেগুলি প্রচণ্ড ভাল লাগে। তার পরবর্তী জীবনে চিত্রের পশ্চাৎপটে প্রায়ই জাপানী ছবির নক্সা দেখা যায়। পারী আগমন। তুলোজ-লুত্রেক, গুইলমিন, বার্নার্ড, লাভাল, গোগ্যাঁ, রাসেল, পিসারো প্রভৃতি শিল্পীবৃন্দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। উচ্চবিত্তের তথাকথিত বিশুদ্ধ-আর্টের বন্ধন থেকে চিত্রশিল্পকে মুক্ত করতে এই সময়ে ঐ শিল্পীবৃন্দ একটি কম্যুনিস্ট আর্ট কলোনি স্থাপন করার পরিকল্পনা করেন, যা বাস্তবায়িত হয়নি।

১৮৮৮ : পারী অসহ্য লাগে। ভান গখ আর্সেতে চলে যান। সেখানে প্রখর রৌদ্র। সূরয হয়ে উঠল শিল্পীর মূল কেন্দ্রবিন্দু। রোলিন নামে একজন প্রতিবেশী ডাকপিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। রোলিন ও তার পুত্রের পোর্ট্রেট আঁকেন। সূরযমুখী ও সাঁকো এই যুগের সৃষ্টি। বন্ধু পল গোগ্যাঁর নিরতিশয় দারিদ্র্যের কথা জানতে পেরে ঐ সময় তাঁকে নিজের কাছে এনে রাখবার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন। গোগ্যাঁর কাছে ট্রেনভাড়া ছিল না। তেও শেষ পর্যন্ত গোগ্যাঁকে দাদার কাছে পাঠিয়ে দেন। গোগার আর্লে আগমন। দুই শিল্পীর মতান্তর থেকে মনান্তর। একদিন ক্ষুর দিয়ে উন্মাদ অবস্থায় ভান গখ বন্ধুকে আক্রমণ করেন। গোগ্যাঁ তৎক্ষণাৎ পারীতে পালিয়ে যান। সেই রাত্রেই ভান গখ ঐ ক্ষুর দিয়ে নিজের দক্ষিণ কর্ণ ছেদন করেন এবং সেটি একটি বার-মেড এর কাছে পাঠিয়ে দেন। মেয়েটি নাকি তার কানের প্রশংসা করেছিল এবং ঠাট্টার ছলে কানটা উপহার চায়।

১৮৮৯ : সেন্ট-রেমি উন্মাদাগারে আশ্রয় লাভ। এই সময় (১৭. ৪. ৮৯) তেও বিবাহ করেন। তাঁর্স ভবিষ্যতের চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েন। বিবাহিত অনুজের উপার্জনে ভাগ বসাতে স্বতঃই তিনি কুণ্ঠা বোধ করেন। এর পর তাঁর চিত্রে সূর্যের বদলে চাঁদ ও তারার দল প্রাধান্য পেতে থাকে। বন্দীদলের চক্রাবর্তন এবং শোকাহত বৃদ্ধ এই যুগে আঁকা। প্রতি তিন মাস অন্তর পর্যায়ক্রমে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারাতে থাকেন।

১৮৯০ : ২৭শে জুলাই একটি পিস্তল বুকে লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। খবর পেয়ে তেও ছুটে আসেন। ২৯শে জুলাই সজ্ঞানে তার মৃত্যু হয়। শেষ বারো ঘন্টা একমাত্র তেও ছিলেন তাঁর শয্যাপার্শ্বে। ভান গখ-এর মৃত্যুর তিন মাসের মধ্যে তেও উন্মাদ হয়ে যান। উন্মাদ অবস্থায় তিনি স্ত্রীকে আক্রমণ করেন কারণ, ঐ সময় তাঁর ধারণা হয়েছিল স্ত্রীর আগমনেই তাঁর দাদা আত্মহত্যা করেছেন। আরও তিন মাস পরে উন্মাদ অবস্থাতেই তেও প্রাণত্যাগ করেন।

তার তেইশ বছর পরে তেও-এর বিধবা পত্নী হল্যাণ্ড থেকে স্বামীর দেহাবশেষ সংগ্রহ করে আনেন। তাঁর দাদার সমাধির পাশে স্বামীর দেহাবশেষ সমাধিস্থ করেন। পারীর অনতিদূরে দুটি কবর পাশাপাশি আছে–শিল্পরসিকদের তীর্থ। একটি আইভিলতা দুটি সমাধিকে জড়াজড়ি করে আছে!

ভ্যাস ভান গখ-এর জীবদ্দশায় তাঁর একখানি মাত্র চিত্র স্বল্পমূল্যে বিক্রীত হয়েছিল। মৃত্যুর অনতিকাল পর থেকেই তিনি বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পীদের অন্যতম বলে স্বীকৃত!

.

য়োজেন অঁরি পল গোগ্যাঁ [Paul Gauguin]

১৮৪৮ : ৭ই জুন তারিখে পারীতে পল গোগ্যাঁর জন্ম। তাঁর বাবা ছিলেন একজন প্রগতিবাদী ফরাসী সাংবাদিক, মা স্পেন দেশের মেয়ে। স্পেনের লোক হলেও ওঁর দাদামশাই দীর্ঘদিন দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে ছিলেন।

১৮৫১ : গোগ্যাঁর বয়স যখন তিন তখন তৃতীয় নেপোলিয়ন ফরাসী দেশের ক্ষমতা দখল করেন। ঐ সময়ে তাঁর বাবা সপরিবারে পেরুতে যাত্রা করেন ইচ্ছা ছিল সেখানেই বাস করবেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই জলযাত্রায় শিল্পীর পিতৃ-বিয়োগ হয়। সন্তানদের নিয়ে ওঁর মা চার বছর পেরুর রাজধানী লিমাতে ছিলেন।

১৮৬০ : মায়ের সঙ্গে প্যারীতে ফিরে আসেন এবং ওর্লেতে স্কুলে ভর্তি হন।

১৮৬৫ : সতের বছর বয়সে সদাগরী জাহাজে কাজ নিয়ে কয়েকবার ফ্রান্স ও দক্ষিণ আমেরিকার ভিতর যাতায়াত করেন। পরে ফরাসী নৌবাহিনীতে যোগ দিয়ে সেকেণ্ড লেফটেনান্ট-পদে উন্নীত হন।

১৮৭১-৮২ : নৌবাহিনীর কাজ ছেড়ে দিয়ে শেয়ারের দালালীর কাজ ধরেন। স্টক ব্রোকার হিসাবে তার যথেষ্ট রোজগার হয়। ঐ সময় তিনি মেটি সোফিয়া গ্যাড নামে একটি ওলন্দাজ মহিলাকে বিবাহ করেন। অবসর সময়ে ও ছুটির দিনে, গোগ্যাঁ ছবি আঁকতেন। ১৮৭৬ সালে তার একটি ছবি সালোতে প্রদর্শনের জন্য নির্বাচিত হয়। গোগ্যাঁ এতে অত্যন্ত উৎসাহ বোধ করেন এবং স্টক ব্রোকার-এর কাজের ক্ষতি করেও দিবারাত্র ছবি আঁকতে থাকেন। সংসারে এজন্য স্বতঃই অশান্তির সৃষ্টি হয়। কামীল পিসারোর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়।

১৮৮৩ : এতদিনে গোগ্যাঁ তিনটি সন্তানের জনক। এই বছর তিনি সর্বক্ষণ ছবি আঁকার জন্য দালালী সম্পূর্ণ ছেড়ে দেন। পুত্রকন্যাসহ স্ত্রীকে তাঁর পিত্রালয়ে কোপেনহেগেন-এ পাঠিয়ে দিয়ে পারীতে স্টুডিও খুলে দিবারাত্র আঁকতে শুরু করেন। নিতান্ত দারিদ্র্যে মাঝে মাঝে তাকে রাস্তায় পোস্টার সাঁটার কাজ করতে হত। ঐ সময় তাঁর বড় ছেলে ক্লোভিস্ তাঁর সঙ্গে ছিল।

১৮৮৬ : চালর্স লাভাল নামে একজন চিত্রকরের সঙ্গে পানামা যাত্রা করেন। সেখানে লাভালের একজন ধনী ভগ্নীপতি ছিলেন। তাঁর কাছে বিশেষ সাহায্য পাওয়া গেল না। গোগ্যাঁ পানামা খালে মাটি কেটেও গ্রাসাচ্ছাদন করেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি য়ুরোপ ফিরে আসেন।

১৮৮৮ : আর্সেতে ভ্যাঁসঁর সঙ্গে বাস ও ভ্যাঁসঁর কাছ থেকে পলায়ন। প্রায় এই সময়েই তেও ভান গখ-এর আগ্রহে ও ব্যবস্থাপনায় গোগ্যাঁর একটি চিত্র প্রদর্শনী হয়; তাতে ছবি কিন্তু বিশেষ বিক্রী হয়নি। শিল্পী তখন ব্রিটানিতে বসবাস করেন।

১৮৯০ : ভ্যাঁসঁর আত্মহত্যা ও তেওর মৃত্যুতে গোগ্যাঁ হতাশ হয়ে পড়েন। শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আশা সুদূরপরাহত মনে হয়।

১৮৯১ : ৪ঠা এপ্রিল গোগ্যাঁ এক দুঃসাহসিক অভিযান করেন। পৃথিবীর অপর প্রান্তে প্রশান্ত মহাসাগরের একান্তে তাহিতি দ্বীপের আদিম অধিবাসীদের ছবি আঁকবার অভিপ্রায়ে যাত্রা করেন। প্রায় কপর্দকহীন অবস্থায় তিনি তাহিতির রাজধানী পাপীতিতে পৌঁছান। এই যুগে তিনি তার জীবনের কয়েকটি শ্রেষ্ঠ চিত্র আঁকেন, যার ভিতর Ta Mateti অন্যতম। ঐ সময়ে শিল্পী য়ামায়া নামে একটি নিরক্ষর আদিবাসীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেন। য়ামায়া নিরলস নিষ্ঠায় তাঁর সেবা করেছে। সে জানত শিল্পী বিপত্নীক। অথচ তখন ঐ কুটির থেকেই গোগ্যাঁ কোপেনহেগেনে তার স্ত্রীর সঙ্গে নিয়মিত পত্রালাপ করতেন। তাঁর য়ুরোপীয় স্ত্রী য়ামায়ার কথা কোনদিন জানতে পারেননি। বছর দুয়েকের মধ্যেই তিনি ফ্রান্সে ফিরে আসেন। য়ামায়াকে ফেলে।

১৮৯৪ : মার্সেলএ আন্না নামে একটি জাভা-দেশীয় স্ত্রীলোকের সঙ্গে গোগ্যাঁ বাস করতে থাকেন। আন্নার অনেকগুলি ছবি তিনি এঁকেছেন। এডগার দেগার সঙ্গে এসময়ে বন্ধুত্ব গাঢ়তর হয়। গোগ্যাঁ এই বছরই শেষবারের মত স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ডেনমার্কে আসেন। কিছুদিনের মধ্যেই পুনরায় ফ্রান্সের ব্রিটানিতে ফিরে আসেন ও আন্নার সঙ্গে বসবাস শুরু করেন। এই সময়ে আন্নাকে কেন্দ্র করে একবার তিনি কয়েকজন মদ্যপ নাবিকদের সঙ্গে রাস্তায় মারামারি করেন। ফলে তাঁর পা ভেঙে যায়। এর কিছুদিন পরে আন্না তাঁর স্টুডিও থেকে অনেক জিনিস নিয়ে পালায়। ভাঙা পা ও যৌনব্যাধিগ্রস্ত গোগ্যাঁর অবস্থা চরমে ওঠে।

১৮৯৫ : আন্নার কাছে শেষ মার খেয়ে গোগ্যাঁ পুনরায় তাহিতিতে ফিরে যাবেন বলে মনস্থির করেন। সত্যিই তিনি তাহিতিতে ফিরে আসেন। এবার তিনি গভীরতর অরণ্যে বসবাস শুরু করেন। য়ামায়ার সন্ধান পেয়েছিলেন কিনা জানা যায় না।

১৮৯৭ : কন্যা এলিনের মৃত্যুসংবাদে শিল্পী মূৰ্ছাতুর হয়ে পড়েন। ঐ আঘাতে তিনি তার জীবনের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রূপক চিত্র আঁকতে বসেন। তার বিষয়বস্তু–আমরা কোথা থেকে আসছি-আমরা কি? ও কোথায় যাচ্ছি? পুরো এক বছর দিবারাত্র পরিশ্রম করে ঐ মহান চিত্রটি শেষ করেন।

১৮৯৮ : পূর্বকথিত ছবি আঁকা শেষ হলে আর্সেনিক সেবনে শিল্পী আত্মহত্যার চেষ্টা করেন; কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

১৮৯৯-০৩ : ফরাসী সরকারের পাব্লিক ওয়ার্কসে কেরানীর চাকরি নেন। প্রচণ্ড ঝড়ে তার বাড়িটি ভেঙে যায়। Le Sourire পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখার জন্য তার তিন মাস কারাদণ্ড হয়। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপীল করার পূর্বেই ১৯০৩ সালের ৮ই মে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর এক মাস আগে বন্ধু চালর্স মরিসকে লেখা চিঠির একটি পংক্তি তার সমাধিক্ষেত্রে উৎকীর্ণ হবার যোগ্যঃ

“A mans work is the explanation of that man.”

পারীতে এক সাহিত্যিক বন্ধু তাঁর শিল্পে বর্বরতা দেখে আপত্তি জানানোতে শিল্পী বলেছিলেন, “তোমাদের সভ্যতা হচ্ছে একটা ব্যাধি। আমার বর্বরতা সেই রোগমুক্তির মহৌষধ।”

বর্তমানে গোগ্যাঁ পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদলের অন্যতম।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8
Pages ( 8 of 8 ): « পূর্ববর্তী1 ... 67 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *