Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আপদ || Apad by Lila Majumdar

আপদ || Apad by Lila Majumdar

আয়না দেখে আঁতকে উঠলুম। এ তো আমার সেই চিরকেলে চেহারা নয়! সেই যাকে ছোটোবেলা দেখেছিলুম, ন্যাড়া মাথা নাকে সর্দি, চোখ ফুলো! তারপর দেখেছিলুম চুল খোঁচা, নাক খাঁদা, গালেটালে কাজল! এই সেদিনও দেখলুম খাকি পেন্টেলুন, ময়লা শার্ট, মুখে কালি! এমনকী, আজ সকালেও দেখেছি কালো কোট, ঝাঁকড়া চুল, রাগী রাগী ভাব!

এই সেই চিরকেলে আমি নয়। দেখলুম বয়েসে ঢের, মুখভরা নোংরা ঘেমো কঁচা-পাকা দাড়ি, ঝুলো ঝুলো গোঁফ, চোখে নীল চশমা, গলায় হলদে লাল ডোরাকাটা কম্ফর্টার, গায়ে গলাবন্ধ লম্বা কালো কোট, বুকের কাছে বোতাম নেই, মরচে ধরা সেফটিপিন আঁটা। অবাক হয়ে গেলুম!

আয়নার পিছনে হাতড়ে দেখলুম কেউ যদি লুকিয়ে বসে থাকে। দেখলুম কেউ নেই, খালি কাঠের উপর আঙুলগুলো খচমচ করে উঠল, নখের মধ্যে খানিকটা বার্নিশ না ময়লা কী যেন ঢুকে গেল।

বিরক্ত লাগল।

গলা হহম করে সাফ করে বললুম, কে?

সেই লোকটা দাড়ি চুলকে মুচকি হেসে বলল, ন্যাকা! চেন না যেন! বলে এক হাতে গোঁফ আঁচড়ে উপরে তুলে দিল, অন্য হাতে দাড়ি খামচে নীচে ঝুলিয়ে দিল। দেখলুম নীচে আমারই নাক-মুখ ঢাকাঁচাপা রয়েছে!

বললুম, য়্যাঁ!

লোকটা সিঁড়ি না কী যেন বেয়ে তরতর করে খানিকটা উপরে উঠে গেল, চাপা গলায় বলল, বাকিটাও পছন্দ হল কি? দেখলুম তার মুন্ডু দেখা যাচ্ছে না। তার জায়গায় নোংরা ধুতি হাঁটু অবধি, গোড়ালি-ছেঁড়া লাল মোজা গুটিয়ে নেমেছে; পাম্প-শুর ফাঁক দিয়ে বুড়ো আঙুল বেরিয়েছে, নখগুলো আঁকাবাঁকা মাংসে ঢাকা।

ব্যাপারটা কোনোদিক দিয়ে সুবিধে বুঝলুম না। মুন্ডু ফিরিয়ে চলে গেলুম। যাবার আগে বাতি নিবিয়ে ছায়াটাকে নিকেশ করে দিলুম। তবু মনে হল আয়নার ভিতর বুনো অন্ধকার থেকে কে যেন বুড়ো মানুষ হ্যাঃ হ্যাঃ করে বিশ্রী হাসি হেসে আনন্দ করছে। কী আর বলব! রাগলুম, ভয়ও পেলুম। খেতে গিয়ে মনে হল সবাই যেন একটু অন্যরকম করে আমার দিকে তাকাচ্ছে। মনে হল যেন সুবিধে পেলেই সব কটা গোঁফের ফাঁকে ফ্যাচ ফ্যাচ করে হেসে নিচ্ছে। যেন সেই বুড়ো লোকটার কথা আর গোপন নেই, সবাই জেনে ফেলে আমোদ করছে!

খাবারগুলো বদ লাগল। তাড়াতাড়ি উঠে পড়লুম। তবু রক্ষে নেই। যেখানে যাই কে যেন নীল চশমা পরে সঙ্গে সঙ্গে চলে। ভালো করে লক্ষ করলুম, কানে তার পাকা লোম, শোনবার সময়ে খাড়া হয়ে ওঠে। একবার জোর করে বললুম, এইয়ো। আমি অন্য লোক। তুই কে রে? বলতেই সে কোথায় মিশিয়ে গেল। শার্টের গলার চারপাশে আঙুল চালিয়ে তাগড়া হয়ে নিলুম।

এমন সময় গঙ্গুদা বলল, এদিকে আয়।

গেলুম– বাপরে, না গিয়ে উপায় আছে? ও বাপু ভীষণ লোক। মুখে দাড়ি, রোগা শরীর, বাবাজিদের সঙ্গে ভাব। সাদা শিমুলের শেকড় খাইয়ে নাকি পড়া দাঁত গজিয়ে দিতে পারে। দেখলুম সে চোখ পাকিয়ে পায়ের পাতা উলটে, সটাং হয়ে খাটে বসে দুই হাঁটুতে হাত বুলুচ্ছে, মুখে একটা খিদে খিদে ভাব। বললে, ঘাড়ে সুড়সুড়ি দে। ভাবলুম বলি, এখন পারব না। কিন্তু সে এমন কটমট করে চেয়ে বললে–

ও পারে যেও না ভাই, ফটিংটিঙের ভয়,
তিন মিনসের মাথা কাটা, পায়ে কথা কয়।
তাদের সঙ্গেতে মোর চেনাশোনা আছে রে,
সুড়সুড়ি না দিস যদি বিপদ ঘটতে পারে রে।

দেড়টি ঘণ্টা সে গুনগুন করে গাইতে লাগল–

কেরোসিন! কেরোসিন!
কেরোসিনের সুবাতাসে
মহাপ্রাণী খইসে আসে,
খাও, খাও, ভইরে টিন,
কেরোসিন! কেরোসিন!

রেগে ভাবলুম দিই ব্যাটার ঘাড়ে চিমটি। সে আরও গাইলে–

অনুতাপে দগ্ধ হবি,
ড্যাও দুদু চেটে খাবি।

জিজ্ঞেস করলুম, ড্যাও দুদু কী?

বললে, ড্যাও পিঁপড়ের দুধ। দে, সুড়সুড়ি দে, অত খবরে কাজ কী?

খানিক পরে আয়নার সামনে দিয়ে যাচ্ছি, দেখলুম আবার সেই লোকটা। এবার আবার মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ। বড়ো কান্না পেল। বললুম, এমনিই তো যথেষ্ট ছিল, আবার ওটা কেন?

সে বললে, ছ্যাঃ। গঙ্গুদাকে ভয় পাও, আবার কথা! দুকানে যে তুলো গুজিনি সে তোমার ভাগ্যি আর আমি দয়ালু বলে। ছ্যাঃ, এত প্রাণের ভয়!

আবার বললুম, একটু আগে তো অমন ছিল না। ওটা খুলে ফেলুন বড়ো বদ, বড়ো বদ।

সে বললে, তাপ্পর অনেক জল বয়ে গেছে, অনেক জিনিস অদল-বদল হয়ে গেছে। আর চল্লিশটা বছর সবুর করো, এই এমনটিই হবে। ছ্যাঃ! গঙ্গুটাকে মানুষ হতে দেখলুম, তাকে ভয় পায়! আরে তার দাঁত পড়তে ক্যায়সা চেঁচিয়েছিল আজও মনে আছে। চোখ পিট পিট করে বললুম, আপনি বুড়ো মানুষ, আর কি বেশি বাঁচবেন!

লোকটা চকাত চকাত করে হেসে বলল, ফ্যাচর! ফ্যাচর! সেই আনন্দেই থাকো! বুঝলে না হে? আমিই হচ্ছি তুমি। তুমি যেমন ভীতু, কাপুরুষ, হাঁদা, বুড়ো হলে আমার মতন সাবধান-সাবধান গোছের হবে। তাই তো আমার রাগ ধরে। ইচ্ছে করলেই লক্ষ্মী ডাক্তারের মতন হতে পার। হাফপ্যান্ট আর মাদ্রাজি চটি পরে ফলমূল খেয়ে তেজি-তেজি ভাবে ঘুরে বেড়াতে পার। তা নয়! আরে ছোঁড়া, ওই তো টিকটিকির মতন শরীর, ছারপোকার মতন মন! অত ভয় কীসের? এতে অসুখ করবে, ওতে বকুনি খাব, অত ভাবনা কেন? কর আরও, আর এইরকম চেহারা হবে। আজ মাঙ্কি ক্যাপ, কাল মাথায় কম্বল মুড়ি। আরে হতভাগা তোর মতো একটা অপদার্থ মলেই-বা কী?

এই অবধি শুনে এমন রাগ হল যে ঠাস করে তার গালে এক চড় কষিয়ে দিলুম।

তাতে এক আশ্চর্য কাণ্ড হল।

চড়ের চোটে গাল ঘুরে গেল। দেখি ওমা! সে লক্ষ্মী ডাক্তার হয়ে গেছে! একগাল হেসে সেলাম ঠুকে বললে, সাবাস বেটা! এই তো চাই। বলেই কোথায় মিলিয়ে গেল। আর তাকে দেখিনি। কিন্তু তারপর থেকেই লোকে আমায় বলে: তেজি বুড়ো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *