শফরী নিজের কক্ষে ফিরিয়া গেল
শফরী নিজের কক্ষে ফিরিয়া গেল, অনেকক্ষণ শয্যায় মুখ খুঁজিয়া পড়িয়া রহিল। মন বুদ্ধি অবশ হইয়া গিয়াছিল, আবার ধীরে ধীরে ফিরিয়া আসিল; তখন সে শয্যায় উঠিয়া বসিল।
তাহার হৃদয় হিংসায় পূর্ণ হইয়া উঠিল। কোথাকার একটা ঘৃণ্য বিজাতীয় বন্দিনী রূপের লোভ দেখাইয়া তাহার ভাইকে ভুলাইয়া লইবে। না না, আমি দিব না। আমার ধন দিব না, তার চেয়ে–
শয্যা হইতে উঠিয়া শফরী দেওয়ালের কুলঙ্গি হইতে একটি শল্য তুলিয়া লইল। পিত্তল নির্মিত তীক্ষ্ণধার শল্য। শফরীর পিতা একজন অতি নিপুণ ধাতুশিল্পী, তিনি এই শল্যটি স্বহস্তে নির্মাণ করিয়া কন্যাকে উপহার দিয়াছিলেন। শফরী শল্যটির সূক্ষ্ম অণি নিজের বুকের মাঝখানে ফুটাইয়া পরখ করিল, তারপর আবার শয্যায় আসিয়া বসিল।
সোমভদ্র নিজ শয্যায় ঘুমাইতেছে। তাহার মন ওই মায়াবিনী রাক্ষসীর রূপে নিমজ্জিত হইয়া আছে; হয়তো ঘুমাইয়া তাহাকে স্বপ্ন দেখিতেছে। কাল সকালেই সে রাক্ষসীকে আনিতে যাইবে। না না, তার পূর্বেই। সোমভদ্রের বুকের মাঝখানে, যেখানে সে চুম্বন করিয়াছিল, ঠিক সেইখানে এই শল্য বসাইয়া দিবে; তারপর শল্য নিজের বুকে বিঁধিয়া দিয়া দুজনে একসঙ্গে পরলোকে যাইবে। জন্মাবধি যে বন্ধন আরম্ভ হইয়াছিল, মৃত্যুর পরও তাহা ছিন্ন হইবে না। একই তরণীতে হাত ধরাধরি করিয়া তাহারা মৃত্যু-নদীর খরস্রোত পার হইবে।
শফরী দৃঢ়মুষ্টিতে শল্য ধরিয়া সোমভদ্রের শয্যাপাশে গিয়া দাঁড়াইল, তাহার নিশ্চিন্ত নিদ্রিত মুখের পানে চাহিল। সহসা অদম্য রোদনের বেগ তাহার বক্ষ হইতে কণ্ঠ পর্যন্ত ঠেলিয়া উঠিল। অতি কষ্টে বাষ্পেচ্ছাস সংবরণ করিয়া সে ফিরিয়া গেল, নিজের শয্যায় পড়িয়া অশ্রুর উৎস মুক্ত করিয়া দিল। না, সোমভদ্রের বুকে সে শল্য বিধিতে পারিবে না।
শুইয়া শুইয়া অসহায়ভাবে সে মেরুকাকে গালি দিতে লাগিল রাক্ষসী! পিশাচী! ডাকিনী!–পিশাচী! রাক্ষসী! ডাকিনী!
নদীতীর হইতে একটা সারসের কেংকার ভাসিয়া আসিল। শরীর মনে হইল, সারস বলিল— ডাকিনী!
ডাকিনী! এতক্ষণ শফরীর স্মরণ ছিল না, নদীতীরে শর-কাণ্ডের কুটিরে এক ডাকিনী বাস করে। ডাকিনী তন্ত্রমন্ত্র জানে, মারণ বশীকরণ জানে। শফরী নদীতীরে তাহাকে অনেকবার দেখিয়াছে, দু-একবার কথাও বলিয়াছে, শীর্ণ কৃষ্ণকায়া বিকট-দশনা বৃদ্ধা, প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় বাস করে। কিন্তু রাত্রে তাহার কাছে লোক আসে, যাহারা মন্ত্রৌষধির বলে গোপন অভিসন্ধি সিদ্ধ করিতে চায় তাহারা অন্ধকারে গা ঢাকিয়া চুপি চুপি ডাকিনীর কাছে আসে।
শফরী ক্ষণকাল নিশ্চল বসিয়া রহিল। তারপর উঠিয়া নিঃশব্দে গৃহের বাহির হইল। তীক্ষ্ণ শল্যটি বস্ত্রের মধ্যে লুকাইয়া লইল। সে ডাকিনীর কাছে যাইবে, ডাকিনীর মন্ত্রবলে শত্রু নিপাত করিবে।
গৃহ হইতে অল্প দূরে শরবনের মধ্যে ডাকিনীর কুটির; কুটিরের মাঝখানে মাটির উপর অঙ্গার-কুণ্ড। কিন্তু অঙ্গারের রক্তাভ আলোকে কুটিরের মধ্যে মানুষ দেখা যাইতেছে না।
শফরী শঙ্কিত বক্ষে দ্বারের বাহিরে কিয়দ্দূরে আসিয়া দাঁড়াইল; বেশি কাছে যাইতে ভয় করে। সে কম্পিত কণ্ঠে ডাকিল—ডাকিনি।
যেন মন্ত্রবলে ডাকিনী তাহার সম্মুখে আবির্ভূত হইল; বিকট হাসিয়া বলিল— বিদেশিনী তোর ভাই-এর মন কেড়ে নিয়েছে, তাই এসেছিস?
শফরী ভয় ভুলিয়া গেল, ডাকিনীর হাত ধরিয়া আবেগভরে বলিল—হ্যাঁ ডাকিনি, তুই আমার ভাইকে ফিরিয়ে দে।
ডাকিনীর আঙুলে দীর্ঘ নখ, সে নখযুক্ত আঙুল শরীর মুখে বুলাইয়া বলিল—ভাই ওমনি পাওয়া যায় না। কি দিবি?
শফরী বলিল—তুই যা বলবি তাই দেব।
বুকের রক্ত দিতে পারবি?
পারব।
তবে তাই দে। বলিয়া ডাকিনী শফরীর বুকের সামনে নিজ করতল গণ্ডূষ করিয়া ধরিল।
শফরী শল্য বাহির করিয়া নিজের বুকে আঁচড় কাটিল, দরদর করিয়া রক্ত ডাকিনীর গণ্ডষে পড়িতে লাগিল। গণ্ডূষ পূর্ণ হইলে ডাকিনী বলিল—এতেই হবে। তুই দাঁড়া, আমি আসছি।
সে কুটিরে প্রবেশ করিল। শফরী রক্তক্ষরিত বক্ষে বাহিরে দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল, অঙ্গার-কুণ্ডের সম্মুখে নতজানু হইয়া ডাকিনী পূর্ণ করতল আগুনের উপর উপুড় করিয়া দিল। অগ্নি ক্ষণকাল স্তিমিত হইয়া রহিল, তারপর দপ্ করিয়া শিখা তুলিয়া জ্বলিয়া উঠিল। ডাকিনী তখন মন্ত্র পড়িতে পড়িতে বামাবর্তে অগ্নি পরিক্রমণ করিতে লাগিল।
অন্ধকারে দাঁড়াইয়া শফরী কম্প্রবক্ষে বিস্ফারিত নেত্রে চাহিয়া রহিল।
অগ্নিশিখা প্রশমিত হইলে ডাকিনী ধুনী হইতে এক টিপ ভস্ম লইয়া শরীর কাছে ফিরিয়া আসিল, বলিল—ভয় নেই, ভাইকে ফিরে পাবি। বিদেশিনী তোর ভাইকে কেড়ে নিতে পারবে না।
রুদ্ধশ্বাসে শফরী বলিল—পারবে না?
না, আমার মন্তর মিথ্যে হয় না!—এই ভস্ম বুকের কাটায় লাগিয়ে দে, কাটা জুড়ে যাবে।
ভস্ম লইয়া শফরী বুকে মাখিল; মনে হইল ভস্ম নয়, চন্দন। ডাকিনী তখন বলিল এবার আমায় কি দিবি বল।
তোমায় কী দেব? ডাকিনীকে শফরীর অদেয় কিছুই ছিল না, কিন্তু সঙ্গে যে কিছুই নাই। সে অমূল্য শল্যটি ডাকিনীর হাতে দিয়া বলিল—এই নাও। আমার বাবা আমার জন্যে নিজের হাতে গড়ে দিয়েছেন, সারা দেশে এর জোড়া নেই।
দে দে–শল্য লইয়া ডাকিনী কুটিরে ফিরিয়া গেল। শফরী দেখিল, সে শল্যটি আগুনের কাছে ধরিয়া লোলুপ চক্ষে দেখিতেছে এবং শিশুর মতো খিলখিল করিয়া আসিতেছে।
টলমল উদ্বেল হৃদয়ে শফরী গৃহে ফিরিয়া গেল। আশার উৎকণ্ঠায় সারা রাত্রি শয্যায় পড়িয়া জাগিয়া রহিল।
বন্দিনীদের অবরোধে মেরুকাও সারা রাত্রি ঘুমায় নাই। ঊষার উদয়ে সোমভদ্র আসিবে, তাহার প্রতীক্ষ্ণয় জাগিয়া আছে। গৃহহীনা বন্দিনী গৃহ পাইবে, স্বামী পাইবে, মেষ-ছাগের মতো দাসীহাটে বিক্রীত হইতে হইবে না। তাই আশার উৎকণ্ঠায় তাহার চোখে ঘুম নাই।
ঊর্ধ্বে নক্ষত্রগুলি ধীরে ধীরে ম্লান হইয়া আসিল, আকাশের অগ্নিকোণে যে উজ্জ্বল নক্ষত্রটি সূর্যোদয়ের পূর্বে উদিত হইলে নদীতে জল বাড়ে, সেই নক্ষত্রটি দপদপ করিতে লাগিল। ক্রমে সে নক্ষত্রটিও নিষ্প্রভ হইয়া পড়িল; প্রত্যুষের ধূসর আলো অলক্ষিতে পরিস্ফুট হইতে লাগিল।
সোমভদ্র কিন্তু আসিল না। মেরুকার ব্যাকুল চক্ষু নগর-দ্বারের দিকে চাহিয়া আছে—ঐ বুঝি সে আসিতেছে। ঐ বুঝি সোমভদ্র!
কিন্তু না, যাহারা আসিতেছে তাহাদের মধ্যে সোমভদ্র নাই। অন্যান্য সেনাপতিরা আসিতেছেন, তাঁহারা স্বচক্ষে দেখিয়া বাছাই করিয়া নির্ধারিত সংখ্যক বন্দী বন্দিনী লইয়া যাইবেন। সকলের সঙ্গে বহু সশস্ত্র রক্ষী।
সূর্যোদয় হইলে সেনাপতিরা বন্দিনীদের অবরোধে প্রবেশ করিলেন। আর আশা নাই। মেরুকার বুক ফাটিয়া নিশ্বাস বাহির হইল। যুদ্ধে বন্দিনী ক্রীতদাসীর ভাগ্য এত শীঘ্র সুপ্রসন্ন হইবে, ইহা সে কেমন করিয়া আশা করিয়াছিল? ছিন্নমূল লতায় কি ফুল ফোটে!
মেরুকা মনে মনে নিজের ভবিষ্যৎ জীবন কল্পনা করিল। একজন মাংসলোলুপ সেনাপতি তাহাকে লইয়া যাইবেন। কিছুদিন পরে তাহার ভোগতৃষ্ণা চরিতার্থ হইলে তিনি তাহাকে দাসীহাটে বিক্রয় করিবেন। কোনও মধ্যবিত্ত ব্যক্তি তাহার ক্লান্ত-যৌবন দেহটা ক্রয় করিবে। আবার কিছুকাল পরে সেও তাহাকে কোনও দরিদ্র কৃষকের কাছে বিক্রয় করিবে। তারপর একদিন তাহার ভগ্ন জীর্ণ দেহটা নদীর গর্ভে সমাধি লাভ করিবে। ইহাই তাহার জীবনের সুনিশ্চিত পরিণাম।
অমোঘভল্ল নামক এক সেনাপতি মেরুকার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। বয়স অনুমান চল্লিশ, দৃঢ় গঠন, মাংসল দেহ, ললাটে গভীর অস্ত্ৰক্ষত চিহ্ন, চক্ষে কর্তৃত্বের অভিমান। আঠারো বছর হইতে চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে যুদ্ধ করিয়া তিনি বুঝিয়াছিলেন, জীবনে সারবস্তু কেবল দুইটি আছে : শত্রুর শোণিত এবং নারীর যৌবন। মেরুকার দেহ নিরাবরণ করিয়া তিনি ভোগপ্রবীণ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করিলেন, চিবুক ধরিয়া তাহার মুখ তুলিয়া চোখের উপর চোখ। রাখিয়া সহজ গম্ভীর স্বরে বলিলেন—নাম কি?
তুষারশীতল কণ্ঠে মেরুকা নাম বলিল।
অমোঘভল্ল প্রশ্ন করিলেন—হাসতে জানো?
অন্তরে বিদ্বেষের তুষানল জ্বালিয়া মেরুকা দশনপ্রান্ত উন্মোচিত করিয়া মুখে হাসির ভঙ্গিমা করিল।
সেনাপতি অমোঘভল্ল সন্তুষ্ট হইলেন। মেরুকার কণ্ঠস্বর মিষ্ট, দন্তপংক্তি সুন্দর। তিনি দুইজন। ভৃত্যকে ডাকিয়া বলিলেন—একে আমার প্রমোদ-বাটিকায় নিয়ে যাও।
মেরুকা একবার চোখ তুলিয়া মহানায়ক অমোঘভল্লের পানে চাহিল, তারপর নিঃশব্দে দুই ভৃত্যের মধ্যবর্তিনী হইয়া দাঁড়াইল। ভৃত্যেরা তাহার দেহে একখণ্ড লঘু উত্তরীয় জড়াইয়া দিল।