আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়
আজ ২রা অগস্ট, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্ম দিবস। আমাদের সকলের কাছে তিনি “Sir — আচার্য”, যে সম্মান তার অন্যান্য সকল ভূষিত সম্মানের (CIE, FNI, FRASB, FIAS, FCS) চেয়ে ঊর্ধে, সবচেয়ে যথাযথ।
তিনি, আমাদের দেশের রসায়নের জনক। রাসায়নিক থেকেও শিল্পপতি, মানবদরদী, দানবীর, পুস্তক-লেখক, যুবসম্প্রদায়ের প্রেরণা দাতা তথা পথিকৃত, সমাজ সংস্কারক এবং সাহিত্য রসিক।
সর্বদা সব ধরনের বই পড়তে ভালোবাসতেন– প্রবন্ধ, জীবনী , প্রহসন, নাটক, নভেল, দেশী বিদেশী সব ধরণের। জানতেন বিভিন্ন ভাষা– সংস্কৃত, বাংলা, ল্যাটিন, ইংরেজী, জার্মানী, ফরাসী ইত্যাদি।
(আসলে প্রফুল্লচন্দ্র
” গিলক্রাইস্ট” বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে লণ্ডন গিয়েছিলেন। এ পরীক্ষায় , পরীক্ষার্থীর ল্যাটিন, গ্রীক, সংস্কৃত, ফরাসী, জার্মানী ভাষা জানা অপরিহার্য ছিল।)
তাঁর পুস্তক পড়বার সময় নির্ধারণ ছিল তারই বিবেচ্য ও অভিনব পদ্ধতিতে, যেমন ভাবগম্ভীর বা তথ্য বহুল পুস্তক যা কঠিনভাবে মনোনিবেশ করতে হয় অথবা হালকা রসের সাহিত্য বা আনন্দবর্ধক পুস্তক সকল সব— ভিন্ন ভিন্ন সময় নিয়মে পাঠ চলত। ট্রেন যাত্রাপথে একরকম, ভোরেরবেলা কেমন কোন পুস্তক, দিবা- অবসরে একরকম, রাতের খাবার পর ঘুমাতে যাবার প্রাক্কালেই বা কেমন– সে এক জব্বর কঠিন কিন্ত যুক্তিগ্রাহ্য। নিজে শুধু নন, উপদেশও নয়, আদেশ দিতেন ছাত্রদলদেরও এ পদ্ধতি অনুসরণ করতে।
আমার পিতা (অধ্যাপক,বিজ্ঞান কলেজ, কলকাতা), নৃপেন্দ্রনাথ ঘোষ ছিলেন Sir P.C. Roy fellow. কনিষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম। আচার্যের শেষ আট বৎসর আমার পিতা তার গুরুদেবের সাথে একই ঘরে বাস করতেন। বহু প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ আচার্যের সাথে আমার পিতার আছে।
আচার্য দেব, বয়সে ছোট কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের চট্টোপাধ্যায়ের খুব ভক্ত ছিলেন বিশেষ উপন্যাসের চেয়ে তার প্রবন্ধেই মনোনিবেশ বেশী ছিল। বলেছেন , এক “নারীর মূল্য” প্রবন্ধটি পড়লেই, বোঝা যায়, লেখক শরৎচন্দ্রের সাহিত্য প্রতিভা ও ব্যক্তি শরৎচন্দ্রকেও।
“মণি মানিক্য মহামূল্য বস্তু, কেন না তাহা দুষ্প্রাপ্য। এই হিসাবে নারীর মূল্য বেশী নয়,কারণ সংসারে ইনি দুষ্প্রাপ্য নহেন। জল জিনিসটি নিত্য- প্রয়োজনীয়,অথচ ইহার দাম নাই কিন্ত যখন ঐটির একান্ত অভাব হয়, তখন রাজাধিরাজও বোধকরি একফোঁটার জন্য মুকুটের শ্রেষ্ঠ রত্নটি খুলিয়া দিতে ইতস্ততঃ করেন না। তেমনি– ঈশ্বর না করুন, যদি কোনদিন সংসারে নারী বিরল হইয়া ওঠেন, সেই দিনই ইহার যথার্থ মূল্য কত, সে তর্কের চূরান্ত নিষ্পত্তি হইয়া যাইবে— আজ নহে। আজ ইনি সুলভ।” নারীর মূল্য, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
ছবিতে দ্রষ্টব্য শরৎচন্দ্র বৃদ্ধ বয়সেও লিখেই চলেছেন সামতাবেড়ের বাড়িতে, পেছনের জানলা দিয়ে দেখা যায় , রূপনারায়ন নদীর জল বয়ে চলেছে কুল কুল শব্দে ধীর গতিতে , যে নদী এখন প্রায় একশ গজ দূরে সরে গিয়েছে।
১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রকে ডি.লিট উপাধীতে ভূষিত করা হয়।
সেই সমাবর্তন উৎসবে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সাথে শরৎচন্দ্রের এক আলোক চিত্র ঐতিহাসিক স্থান বহন করে। নীচে ছবি দেওয়া আছে।
আচার্য দেবের নানাবিধ ও বহুমুখী কার্যকলাপের কথা এত স্বল্প কথায় বলা সম্ভব নয়। এককথায় বলা যায় সমাজসংস্কারক ও মানব দরদীও । বিদ্যাসাগরের মতো তিনিও ছিলেন দানসাগর।
আমার পিতা তাঁর একান্ত শিষ্য ছিলেন, কিছুটা প্রভাব তাঁর চরিত্রেও পরিলক্ষিত হতো। পিতার মুখে অনেক গল্পও শুনতাম। একটি পুস্তক লিখেছি আচার্যদেবকে নিয়ে, শরৎ সমিতির প্রকাশনায় । বাস্তবিক, এই যে, প্রফুল্লচন্দ্র যে আদর্শে সেই সময়ের যুব সম্প্রদায়কে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেছিলেন তা ফলপ্রসূ হলে, আজ বঙ্গ তথা ভারত যে শুভ অর্থেই অন্য রকম হতো তা বলা বাহুল্যমাত্র । তিনিই ত বলেছিলেন, “জাগো, নবীন তরুণেরা জাগো, সময়কে কাজে লাগাও, তুমি নিজে একাই কত কি করতে পারো, দেখো। ভরসা রাখো নিজের প্রতি। “
(নীচে ছবি তে ১৯৩৬ সালে সমাবর্তন উৎসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাম দিক থেকে স্যঁর যদুনাথ সরকার, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভাইসরয় লর্ড উইলিংটন, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও উপাচার্য এ আর রহমান।)