আইনানুগ
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। ভারতের সব রাজ্যেই শিকারের পারমিট দিত। বনবিভাগ। যে ব্লকের পারমিট সেই ব্লকের বনবাংলোতেই থাকা হত। আইন করে সারা দেশে শিকার বন্ধ করে দেওয়া হয় ১৯৭২ থেকে। সেবারে ওড়িশার অংগুল ফরেস্ট ডিভিশনে টুকা বাংলোতে কটক থেকে গিয়ে পৌঁছেছি একটি ট্রাক এবং দুটি জিপে করে। সঙ্গে বাবার মারাঠি বন্ধু নাগবেকার সাহেব। জ্যোতি বসুর বড়ো দাদা ডঃ কিরণ বসু (যিনি জলপাইগুড়ির বায়কত রাজার একমাত্র মেয়ে রাজকুমারি প্রতিভা দেবীকে বিয়ে করেছিলেন), ডুয়ার্সের সামসিং চা। বাগানের ম্যানেজার স্কটসম্যান রনাল্ড রস ম্যাকেঞ্জি, দুর্গাপ্রসাদ রায়, কলকাতার ইস্ট ইন্ডিয়া পার্সস এর প্রশান্ত বিশ্বাস, কটকের নরেন্দ্রনাথ সুরের বড়ো ছেলে প্রভাত কুমার সুর ইত্যাদিরা আছেন। আমরা সুর বাবুদেরই অতিথি। সঙ্গে রান্নার লোক এবং সাহায্যকারীরাও গেছে ট্রাকে। নানাবিধ খাদ্যদ্রব্য তো আছেই। সুন্দরবনে যাঁদের লঞ্চ সার্ভিস ছিল এবং মোটরবোট বানাবার কারখানাও ছিল, সেই ক্লেব্যাক কোম্পানির অংশীদার হৃষিকেশ বাগচিও গেছেন এবং আমার বহুদিনের শিকার সঙ্গী ওড়িশার চাঁদুবাবু ইত্যাদি। পারমিটে আছে একটি বড়ো বাঘ, দুটি ভালুক, একটি বাইসন, একটি লেপার্ড, শম্বর, স্পটেড ডিয়ার, শুয়োর যতগুলি খুশি এবং একটি মাউস ডিয়ার।
সেই সময়েই টিকিয়াপাড়াতে বনবিভাগে ব্যাম্বু সিম্পোজিয়াম হচ্ছিল। বনবিভাগ থেকে। সুরবাবুদের কাছে একটি জিপ চাওয়া হয়েছিল। তাঁরা বনবিভাগেরও অনেক কাজ করতেন। কিন্তু তাঁদের অতিথিদের সংখ্যার আধিক্য হওয়াতে প্রভাতবাবু আর বনবিভাগকের জিপ দিয়ে উঠতে পারেননি। সে কারণে তাঁরা সুরবাবুদের উপরে খুবই রেগে ছিলেন। পরে জেনেছিলাম।
আমরা গিয়ে পৌঁছোবার পরদিনই ভোরবেলার হাঁকোয়াতে একটি প্রকাণ্ড শিজল শম্বর শিকার করি আমি। হাতির একটি ছোটোদলও বেরিয়েছিল যদিও টুকার জঙ্গল বিখ্যাত ছিল বাইসন ও বড়ো বাঘের জন্যে। হাতি মারার পারমিট ছিল না আমাদের। তা ছাড়া, বাবা হাতি মারা একেবারেই পছন্দ করবেন না। বলতেন রোগ হয়ে গেলে অন্য কথা নইলে হাতি মারার চেয়ে পাখি মারা অনেক কঠিন।
বাংলোর কাছেই হাঁকা হয়েছিল। আমরা তবু জিপ নিয়ে গেছিলাম। জিপে করে বাংলোতে পৌঁছোবার কিছুক্ষণের মধ্যে হাঁকাওয়ালারা শম্বর বয়ে নিয়ে এসে ফরেস্ট গার্ডের কোয়ার্টারের সামনের জমিতে শম্বরের চামড়া ছাড়িয়ে কাটাকুটিতে লেগে গেল। সকলেই খুব খুশি। অত বড়ো শম্বর। ওরা এতই গরিব যে মাংস তো খেতে পায় না। সেজন্যেই ওরা মাংসকে বলে শিকার। সকলেই মাংসর ভাগ পাবে। হরিণ শম্বরের মাংসর ইংরেজি নাম Venison।
আমরা দেরি করে ব্রেকফাস্ট করছি, বাবা এবং তাঁর বন্ধুরা বাংলোর সামনের একটি মস্ত বড়ো কালো পাথরের উপরে রোদে বসে তেল মাখছেন এমন সময়ে একটি ট্রাকে করে দু-জন রেঞ্জার এসে প্রভাতদার খোঁজ করলেন। প্রভাতদা তখন অন্য জিপটি নিয়ে তাঁর কাঠ-কাটা মুহুরিদের নিয়ে জঙ্গলে গেছিলেন। সেকথা শুনে তাঁরা ভীষণ চটে গেলেন। বললেন, আমাদের জিপ না। দিয়ে উনি জঙ্গল ইনসপেক্ট করতে গেছেন। তারপরই ওঁরা বললেন এই শিকার তো রাতের বেলা করা হয়েছে-আমরা একে কনফিসফেট করব। বাবা ভয়ানক রেগে গেলেন। বললেন সকলের হাঁকাতে শিকার হয়েছে। আপনারা ইয়ার্কি পেয়েছেন। ওঁরা শুনলেন না, বললেন এই শম্বর। আমরা নিয়ে যাব। বাবা বললেন, এতে হাত দিয়েই দেখুন আমি গুলি করব আপনাদের। ওঁরা বললেন ইউনিফর্ম অফিসারদের গুলি করার হুমকি দিচ্ছেন, আপনাকে অ্যারেস্ট করব।
তারপর ওঁদের ভালো করে খাইয়ে-দাইয়ে তুষ্ট করে ফেরত পাঠানো হল। ওঁরা গজগজ করতে। করতে ফিরে গেলেন টিকরপাড়াতে।
সন্ধ্যেবেলা আমরা শম্বরের কাবাব দিয়ে রুটি খাচ্ছি এমন সময়ে অংগুলের ডি এফ ও এবং দু জন আই এফ এস অ্যাসিস্ট্যান্ট কনসার্ভেটর সকালের দু-জন রেঞ্জারকে সঙ্গে করে জিপ নিয়ে চলে এলেন। আমরা শম্বরের কাবাব এবং অংগুল থেকে নিয়ে আসা পোড়পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন। করলাম ওঁদের। নাগবেকার সাহেব হুইস্কিও খাওয়ালেন। ওঁরা প্রভাতদাকে তখন পেয়ে বললেন জঙ্গলের ঠিকাদারি বন্ধ করে দেব। এই অফেন্স কমপাউন্ড করুন না হলে খারাপ হবে। ওঁরা প্রায় একঘন্টা ছিলেন। জঙ্গলে ঠিকাদারি করে ডি এফ ওর সঙ্গে ঝগড়া করা যায় না। শেষে রফা হল দু-শো টাকা ফাইন দিয়ে। রসিদ লিখে দিয়ে ওঁরা খাদ্য-পানীয়তে আপ্যায়িত হয়ে ফিরে গেলেন। কিন্তু বাংলোর কম্পাউন্ড পেরোবার আগে জিপ ব্যাক করে আবার ফিরে এলেন। এসে।
প্রভাতদাকে বললেন, শম্বরের একটা রাং আমাদের জিপে তুলে দিন, আমরা টিকরপাড়াতে গিয়ে সবাই খাব। একটি রাংই ছিল-ইচ্ছে ছিল তাকে তেল নুন মাখিয়ে স্মোক করে কলকাতা নিয়ে যাব। অন্য সব মাংসই হাঁকাওয়ালা এবং গ্রামের মানুষেরা ভাগ করে নিয়ে গেছিল।
তারপর শম্বরের রাংটি জিপে উঠিয়ে নিয়ে তাঁরা চলে গেলেন। বে-আইনি কিছু আমরা করিনি। বনরক্ষকেরা আইন দেখিয়ে অফেন্স কমপাউন্ড করিয়ে শম্বরের রাং নিয়ে চলে গেলেন। যা-কিছু ঘটল তার সব কিছুই আইনানুগ। আইনানুগ বলেই পঁয়তাল্লিশ বছর পরেও এ ঘটনার কথা। আজও ভুলতে পারিনি।