অসমাপ্ত
আমি একা একা ঘুরছিলাম। নিছক ঘুরছিলাম, নাকি কিছু খুঁজছিলাম? ঠিক জানি না।
আমি একটা খবরের কগজের স্টলের সমনে এসে দাঁড়ালাম। পাতা জুড়ে সব দুর্নীতির খবর।
সেখান থেকে একটা বইয়ের দোকানে এসে ঢুকলাম। বইগুলির উপর চোখ বুলিয়ে দেখলাম, চে গুয়েভারার ডাইরী, মুজিবের আত্মজীবনী, চ্যপলিনের অটোবায়োগ্রাফি। দূর, এসব কিছু না, ও হ্যাঁ। হ্যাঁ ও না, কিন্তু ও যদিও, সুতরাং ও যদি, কারণ ও যুক্তি, আরম্ভ – শেষ। দেখছিলাম একটা কিছুই না, আবার সব-কিছুই, হতাশা বা তার চেয়েও ভাল লাগা কিংবা মন্দ লাগা, যা খুশিই হতে পারে। আমার তাতে কিছু আসে যায় না।
আমার বন্ধু স্বপন মারা গেছে কিছুদিন আগে। তবুও সে আমার কাছে মারা যায়নি। অন্য কোথাও চলে গেছে মাত্র। কোথায় গেছে কে জানে? সমনের ওই বাঁক পেরিয়ে কিংবা অজস্র বাঁক পেরিয়ে, কিন্তু নিশ্চয়ই সে বিপথে যায়নি।এমনও হতে পারে সে এখনই হাজির হবে আমার সামনে যেমন আগে সে ছিল সেভাবেই।
সে যাই হোক এখন যা ভাবছি তা হচ্ছে, এক বছরের মধ্যে, অথবা দশ বছরের মধ্যে কিংবা কুড়ি-ত্রিশ বছরের মধ্যে, এই রকম এক সন্ধ্যায়, সে সময় কি আমি অন্য কোথাও দূরে কোথাও চলে যাব না? থেকে যাব কি? আমি চারিদিকে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। এটা আসলে কোন গল্প নয়। গল্পের আলপথ। কফিহাউজ কিংবা ওই রকম কোন জায়গায়, দোকান বাজারের পাশ দিয়ে, কোন গলিতে কিংবা কানা গলিতে অথবা যে কোন জায়গায়, সে শ্মশান কিংবা মন্দিরের পাশ দিয়ে ঘুরে স্টেশনের দিকে। কারণ আমি ট্রেন ধরতে যাব। একজন পথচারী আমাকে জিজ্ঞাসা করল, স্টেশনের পথটা কি এইদিক দিয়েই? আমি তার উত্তরে বললাম, মাফ করবেন।
সে শুনে বলল, মানে?
আমি আবারও বললাম, মাফ করবেন। সে মাথা নাড়তে নাড়তে, ‘যত সব পাগল জোটে আমার কপালে ‘ বলে বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল।
সে চলে যেতেই আমি ভাবলাম, নিজেকে জিজ্ঞাসা করলাম, সেই জিনিষটা কি তার আছে? সেই সময়ের পর থেকেই আমার একটা আছেই, কিংবা অন্য কারও, অন্ততঃ আমার একটা চোখ আছে, যা দিয়ে আমি দেখতে পাই। মন আছে যা দিয়ে সব বুঝতে চেষ্টা করি। পারি কি? সে ভিন্ন প্রশ্ন। কিংবা আমি দেখতে চাই আমার বন্ধু স্বপনকে। দ্বিতীয় চোখটা যদি ঘুমিয়ে না পড়ত, বা ত্যরছাভাবে না দেখত অথবা অন্য দিকে তাকিয়ে না থাকত, অনেকদূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারত। অদূরদর্শী হতে পারত, তাহলে নিশ্চয়ই আমি তাকে খুঁজে পেতাম। কিন্তু এখন আমি যেমন আছি তাতে সবাইকে দেখছি, লক্ষ্য করছি, অচেনা মানুষ যেমন দেখে, সেই ভাবে। একটা চলমান দৃষ্টি যেন হঠাৎ অন্যদিকে চোখ ফেরানো, কৌতূকবশতঃ।
এটা নিশ্চিত যে প্রত্যেকের নিজের নিজের কাজ আছে। অথচ কেউ আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। অন্যের উপর নির্ভরশীল। প্রত্যেকেই নিজেকে নিয়ে মাথা ঘামায় যেন প্রত্যেকেই তার বন্ধুর বন্ধু, শত্রুর শত্রু, যে কারও জাযগা থেকে নড়ে না। আর যে কারও জাযগা থেকে নড়ে না, সে কখনই জীবিত নয়। আমি যা বললাম, তাতে আমারই যেন কেমন অবিশ্বাস হচ্ছে। সন্দেহ হচ্ছে নিজেকে নিয়ে। বিশেষ করে আমারই বিষয়ে। বেশ তাহলে নড়েচড়ে বসি। কিন্তু কোন ধরনের জায়গা থেকে কোন ধরনের জায়গায় এবং কেন? আমার পক্ষে যা ভাল, তা কি সকলের পক্ষেই ভাল? যে নাকি এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় স্থান পরিবর্তন করে। দু’টি লোকের মধ্যে, বিশেষ করে তারা একই ধরনের হলে, একেবারে অন্য রকম না হলে, ভিড়ের মধ্যে সাধারণতঃ বেশ সজ্জনের মতো। ঠিক আমারই মতো। তারা আমার থেকে সমদূরত্ব বজায় রেখে চলছিল। ওদের একজন প্রায় পঁচিশ বছরের যুবক, সে আসছিল আমার দিকে। অন্য জন তার চেয়ে কয়েক বছরের বড়ই হবে। সে প্রথম জনের দিকে এগোচ্ছিল। তারা যদি সতর্ক না হয়, তাদের মধ্যে ধাক্কা লেগে যেতে পারে, এ ধারণা ছিল না তাদের। কিন্তু আমি ভাবতে লাগলাম অন্য কথা। যদিও তার কোন উল্লেখ আমি করিনি। যদি তাদের দু’জনের কেউ কারও এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়ে, তাহলে তারা কি একে অন্যকে অভিশাপ দেবে, নাকি তারা, দু’জনেই দু’জনের কাছে ক্ষমা চাইবে? এবং সব ভুলে গিয়ে চলে যাবে? আমি যা ভেবেছিলাম তাই হল। তাদের একজন অন্যের এলাকায় ঢুকে পড়ল। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটল অন্য রকমভাবে। তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধার সময় একজন ছিল কিন্তু নিজেরই এলাকায়। অন্যজনও ছিল তার এলাকার মধ্যে, কিন্তু তাদের সংস্পর্শে, তাদের বিরক্তিতে, তাদের ক্রোধে, তাদের বেদনার কেউ কারও সমব্যথী ছিল না। যে নিজের এলাকা ছেড়ে এসে অন্যের এলাকায় ঢুকেছে, সে নিজের এলাকাটা সম্পূর্ণ ত্যাগ করে আসেনি। ফলে এই দোলাচলে কাঁপন লাগে তার সভ্যতায় , ফাটল ধরে, তারপরে একেবারে স্তুপ হয়ে ভেঙে পড়ে। আজন্ম লালিত সব ভদ্রতার পলেস্তরা খসে পড়ে। একটা দৈত্যের মত ধ্বংসাবশেষ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা বন্ধু কিংবা শত্রুর মতো, অবশিষ্ট একাকার চারদিকে নেচে বেড়াতে লাগল। একজন আর একজনের গায়ে পড়ে, ব্যাপারটার মধ্যে জড়িয়ে পড়ল। এবং পরস্পর পরস্পরের শরীরের মাংস ছিঁড়তে লাগল। ওই দু’টি মানুষের দেহ নিয়ে তৃতীয় একটা এলাকা গড়ে উঠল। এখন তারা পথিক নয়,তারা দস্যু।
আমি জানতামই না প্রথমে সে এলাকায় কি ছিল। সুতরাং আমি বুঝতে পারলাম না মোটেও, এই দেহ দু’টি নিয়ে যে এলাকা তৈরী হয়েছে, সেখানেই বা কি ঘটছে।
‘এটি মাত্র একটি দেহ। তাকে কি আমি ঘৃণা করি? আমি তাকে খুন করতে চাই? কিন্তু কেন?’ এই ব্যাপারটা আমি দেখলাম এবং শুনলাম। বয়স্ক লোকটি চ্যাঁচাচ্ছে, অল্প বয়স্কটি তার জবাবে চ্যাঁচাচ্ছে। তারা চ্যাঁচিয়ে চ্যাঁচিয়ে কি বলছে আমি বুঝতে পারলাম না। আমার মনে হল পরস্পরকে তারা গাল দিচ্ছে অশ্রাব্য ভাষায়, যা না শোনাই ভাল। আমি এই রকম ভেবেছিলাম। এ ছাড়াও চ্যাঁচিয়ে তারা একে অন্যের দিকে হাত পা ছুঁড়ছে। সে চিৎকার এমন মারাত্মক ও ভয়ানক ধরনের যে মনে হচ্ছিল তারা যেন একটা শান্ত স্ট্যাশনে ট্রেনের মতো হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে হৈ হল্লা গড়ে তুলেছে। কিংবা তারা ভুলে গেছে তারা একটা শহরে আছে। সে হুঁশই তাদের নেই। তারা যেন মাটির নীচের নর্দমা থেকে উঠে এসেছে। বড়জন অভিযোগ জানাচ্ছিল। ছোটজন নিজের পক্ষ সমর্থন করছিল। কিন্তু আমার মনেহল এর বিপরীতটাও ঘটতে পারত। কারণ তারা দু’জনে একত্র হয়ে যায়নি এখনও। এক হয়ে যেতে পারত। কিন্তু একজনই যেন দু’জন হয়ে গেছে। এদিক থেকে ওদিক থেকে বর্ষিত হতে লাগল অভিযোগ গালি-গালাজ, – তুই বদমাইশ, খুনি। এসব ছেড়ে এখন নিজের বাড়ি যা। আমাকে যেতে দে। অযথা আমার মাথা গরম করে দিস না। না হলে তোকে আমি শেষ করে ফেলব। ওদিক থেকে এদিকে, আবার এদিক থেকে ওদিকে চলতে লাগল সেই কথা। তার প্রত্যেকটা শব্দ, প্রত্যেকটা বর্ণ ভেঙে টুকরো হয়ে কানে আসতে লাগল। শব্দগুলি ভঙ্গুর, ছিন্নভিন্ন। দৃঢ় মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ছুঁড়ে ঘুসি মারা, চোখে মুখে হিংস্রতার ছাপ, চাহনিতে ধ্বংস করে ফেলার হুমকি, দাঁতে দাঁত চেপে দাঁতের ঘসটানি। গলা দিয়ে বীভৎস চিৎকার। আমি তোকে ছিঁড়ে, ছুঁড়ে ফেলে দেব ডাস্টবিনে। আমাকে শান্ত থাকতে দে। নিজের ভাল চাইলে যা এখন এখান থেকে। না হলে তোর ধ্বংস অনিবার্য।
এখনও বোধহয় যথেষ্টভাবে তোকে বোঝাতে পারিনি। আমার মাথা গরম করিস না আর। ভালোয় ভালোয় চলে যা এখন এখান থেকে।
আমি নীরবে দাঁড়িয়ে, দেখে গেলাম সব ব্যাপারটা। যেমনভাবে শুরু হয়েছিল, সেই ভাবেই আবার সব থেমে গেল। বড়জন তার দুই হাত নীচে নামাল। বাহু দু’টি কাঠের তৈরী। তার জামায় আঙুলগুলি মুছল। আঙুলগুলি পাথরের তৈরী। দশটি পাথর,তা’তে কোন রক্ত নেই। যেইদিক থেকে সে এসেছিল সেই দিকেই আবার সে চলে গেল। ছােটজন টেনে-টেনে নিঃশ্বাস নিল বেশ শব্দ করেই, তারই মধ্যে সে একটু হাসল, সে তার প্যান্টে হাত ঘষে নিল, তাতে কেবলই ঘাম, কোন রক্ত নেই, তার চুলের মধ্যে আঙুল চালাল, তার জামার গুটানো হাতা টেনে নীচে নামাল , শার্টের কলার টান-টান করে নিল, সে কি শেষ হয়ে গেছে কিংবা শেষ হয় নি ? মনে মনে ভাবল সে। না, সে ঠিকই আছে, সে স্টেশনের মধ্যে ঢুকল, সেখানে সে যেতে চায় না অবশ্যই। আমার পাশ দিয় যখন সে গেল তখন কী যেন বলল, তার সে কথা উন্মাদের কথার মতন মনেহল আমার। সম্তবতঃ প্রতারিত সে হয় নি, কিন্তু বয়স্ক মানুষটি অমন ক্ষেপে গেল কেন, এবং সে কি একাই ক্ষেপেছিল, ছোটজনও কি ক্ষিপ্ত হয় নি, এবং যারা আমার মতো এই মারামারি দেখল, তারা?
মারামারি প্রায় খুনোখুনিতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারা তা থামায় নি, তারা সেই রক্তপাত রােধ করার সম্তাব্য কোন চেষ্টাই করেনি। আমার ব্যাপার বলতে পারি, আমি পরের ট্রেন ধরেছিলাম। আমি এমন কাপুরুষ হয়ে গেলাম কেন, কিসের কারণে? আমার যা করার তা করেছি, আমি -বাড়ি চলে গিয়ে বয়স্ক লােকটার মধ্যে যে অগাধ খেদ দেখতে পেয়েছিলাম তাতেই আমি কি আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিলাম , কিন্তু ওই লােকটা নিজেই তাে অতলম্পর্শী খাদে পড়ে গিয়েছিল।
আমি বাড়ি ফিরে একটা ডিম, দু’টি রুটি ও খানিকটা পনীর খেয়ে শুয়ে পড়লাম, একটা ডিটেকটিভ গল্পের বই হাতে নিয়ে। তারপর ঘুমোলাম। আবার জেগে উঠলাম। কে আমার ঘরে ঢুকেছে? বয়স্ক লােকটি কি? কে এ ? সে কি নিজেই ? কিংবা অন্য কেউ ? যে- কোনও একজন ? সেই অল্পবয়সীটা ? আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। আবার জাগলাম।
বয়স্ক লােকটি আছে দেখছি। সে কে ? যে মানুষ সব পাগলের মতো কান্ড করে চলেছে কিস্তু কেউ্ তা লক্ষ্য করেনি, কিন্তু ওই মুহর্তাটিতে যা প্রকট হয়ে উঠেছিল ? কিংবা একটা মানুষ যে নাকি কখনও উন্মাদ হয়ে ওঠেনি, কিন্তু ওই স্টেশনের এলাকায় অন্য মানুষদের উন্মাদনার আবর্তে পড়ে গিয়েছিল ? এ কি যুদ্ধ ফেরত কোন সৈনিক ? যে লাোক ভুল করে “ভেবেছিল যে সে যুদ্ধে যােগ দিতে পারে না। যে মানুষ কাউকে-না-কাউকে খুন করতে চেয়েছিল, সে লোকটি কে তা অবাস্তর, কেবল খুন করা, শুধু মেরে ফেলা। এতদিন তার যা অভাব ছিল তা তার সাহস, কিন্তু এখন হঠাৎ তার ভিতরে জেগে ওঠেছে আত্মবিশ্বাস, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হঠাতই তার স্নায়ু আবার দুর্বল হয়ে পড়ে, সাহস হারিয়ে ফেলে। যে মানুষ সবাইকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, কেননা সকলেই তারা ছিল তার বিরোধী। কিন্তু সকলেই যখন বিরোধী হতে পারে না তখন ঐ ব্যক্তিটিই তার বিরােধী, কিস্তু তার পরেই বােঝা গেল জিনিসটা অতি সামান্য। কিংবা, সে কি নিজের কাছ থেকে নিজেই রেহাই চেয়েছিল, সে নিজে বহু আগেই খতম হয়ে গেছে, নিশ্চয়ই তা তার জানা ছিল না কিন্তু ঠিক ঐ সময়ে তার বেপরােয়া মন বুঝতে পারল ব্যাপারটা, কিন্তু তবুও তা সত্ত্বেও সে তেমন করে শক্ত হয়ে উঠতে পারল না , নিজেই সে নিজের বিকল্প এক ব্যক্তি হয়ে উঠল, তবুও সে যা করতে চেয়েছিল তা কি সে করে উঠতে পারল?
আর, আমার সম্বন্ধেই বা কী বলব ? ভয়ে ভীত হয়েছিলাম কেন আমি ? জানি না ঠিক। আমি রেডিয়ােত খবর শুনলাম, খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম, তারপর ঘুমলাম। আমার ঘুম ভেঙে গেল। জাগলাম। আবার ঘুমালাম।
সমস্তটাই একটা হাস্যকর ব্যাপার। বেকুবের গল্প যার উপসংহার হচ্ছে উত্তরের বদলে জিজ্ঞাসার চিহ্ন দিয়ে, সুতরাং বােঝা যাচ্ছে গল্পটার শেষ এখানে নয়।