অষ্টরূপে দেবী চঞ্চলা
জীবনের অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এসেছি এবং স্বভাবে শান্ত হওয়ায় এতগুলো বছর ধরে প্রায় সবার মুখেই একটাই কথা শুনে এসেছি , যে – আমি খুব শান্ত মেয়ে, খুব লক্ষ্মী মেয়ে। কিন্তু এই শান্ত-র সংজ্ঞা (definition) আমি জানি না, লক্ষী মেয়েই বা কাকে বলে? ‘আমার মেয়ে খুব চুপচাপ একদম লক্ষ্মীমন্ত, আমার সব কথা শোনে ‘ – কিন্তু এই কি লক্ষ্মীর প্রকৃত রূপ?
বাড়ির মেয়ে লক্ষ্মী হতে হবে, বাড়ির বউ লক্ষ্মীমন্ত হতে হবে। কিন্তু আদৌ কেউ কি জানে এই লক্ষ্মী কে? বা কি তার প্রকৃত স্বরূপ? বিষ্ণুশক্তি লক্ষ্মী অর্থাৎ শ্রী হলেন আদতে চঞ্চলা। তার প্রকৃত খ্যাতি – ধনসম্পদ, সৌভাগ্য ও সৌন্দর্য্যের দেবী হিসাবে। কিন্তু তার ছয়টি বিশেষ গুণ শুধু সম্পদ আর সৌন্দর্য্যে ই সীমাবদ্ধ নয় – তিনি সমৃদ্ধি, সুস্বাস্থ্য, জ্ঞান, শক্তি, সন্তানাদি ও ক্ষমতার ও দেবী। তার এক অঙ্গে আটটি রূপ, তাই তিনি অষ্টলক্ষ্মী। একরূপে তিনি কল্যাণসূচক বিষ্ণুপত্নী বা সমুদ্রোদ্ভূতা সাগরকন্যা – তখন তার নাম আদিলক্ষ্মী বা মহালক্ষ্মী । দ্বিতীয় রূপে – অর্থ, স্বর্ণ, সুখ ও সমৃদ্ধি প্রদানকারী ধনলক্ষ্মী। কৃষকের গৃহে ধানদাত্রী ধান্যলক্ষ্মী তার তৃতীয় রূপ। বাড়িতে গবাদি পশু বা হস্তী পালন করে যে অর্থ উপার্জন হয় তা দেবীর চতুর্থরূপ গজলক্ষ্মীর কৃপায় । দেবীর পঞ্চমরূপ সন্তানলক্ষ্মী সন্তান প্রদান করেন। ষষ্ঠরূপে দেবী বীরলক্ষ্মী বা ধৈর্য্যলক্ষী নাম নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্ব ও জীবনের কঠিন সময়ে সাহস প্রদান করেন । সপ্তমে দেবী জয়লক্ষ্মী বা বিজয়লক্ষ্মী – যিনি জীবন যুদ্ধে জয়ী করেন এবং সমস্ত বাধা বিপত্তি দূর করেন । অষ্টমে আছেন কলা ও বিজ্ঞানের জ্ঞান প্রদানকারী দেবী জ্ঞানলক্ষী। এগুলো ছাড়াও ঐশ্বর্য্যলক্ষ্মী, সৌভাগ্যলক্ষ্মী, রাজ্যলক্ষ্মী ও বরলক্ষ্মীর অর্চনার পুরাতন কাহিনী পাওয়া যায় । এই দেবীর বাসও ভিন্ন ভিন্ন স্থানে । সংস্কৃতে একটি শ্লোক আছে –
“করাগ্রে বসতে লক্ষ্মী,
করমধ্যে সরস্বতী,
করমূলে তু গোবিন্দঃ,
প্রভাতে করদর্শনম ।”
আমাদের করের অগ্রভাগে অর্থাৎ হাতের সামনের দিকে দেবী লক্ষ্মীর বাস। এই জন্যই তো বলা হয় আমাদের মধ্যেই দেবতার অধিষ্ঠান।
লক্ষ্মী দেবী গো – পৃষ্ঠে অবস্থান করেন। কারণ গাভী পবিত্র লক্ষ্মী স্বরূপ এবং গরুকে দেবী ভগবতী জ্ঞানে পুজো করা হয়। দেবীর আর এক বাসস্থান পদ্মের উপরে । পদ্ম একান্ত ভাবেই শ্রী ও স্ত্রী প্রতীক। ভগবান শিবের প্রিয় সত্বেও বিল্বপত্র অর্থাৎ বেলপাতার উল্টোদিকে দেবী লক্ষ্মীর বাস। হাতির কপালের উচুঁ অংশ যাকে সাধারণভাবে ‘গজকুম্ভ’ বলা হয় সেই স্থানেও দেবী বাস করেন।
মহর্ষি দুর্বাসার অভিশাপে দেবরাজ ইন্দ্রের দেব সাম্রাজ্য লক্ষ্মীছাড়া হয়। বিশাল ধনসম্পদ নিয়ে দেবীর আশ্রয় হয় সমুদ্রগর্ভে। ওই একই সময়ে ভগবান নারায়ণ অভিশাপ পান তার প্রতি জন্মে লক্ষ্মী বিয়োগের । তাই সবার ভাগ্যেই লক্ষ্মী অস্থায়ী। তাকে ধরে রাখা কখনোই সম্ভব নয়। এটাই লক্ষ্মীর স্বভাব । তার আসল প্রবৃত্তি তিনি চঞ্চলা। সেই জন্য সমুদ্রদেব নিজেও দেবীকে ধরে রাখতে পারেন নি। সমুদ্র মন্থনে দেবী সমুদ্রকে ত্যাগ করে আবার বিষ্ণুবক্ষে ফিরে যান এবং দেবতাদের শ্রী – যুক্ত করেন।
কোনো জন্মে তিনি কুশধ্বজ কন্যা বেদবতী – তখন তার বেদ প্রভৃতি শাস্ত্রে এবং সতীত্বে যার জুড়ি মেলা ভার। এখানে তিনি বিদ্যালক্ষ্মী। কোনো জন্মে নারায়ণ প্রদত্ত অভিশাপে তিনি ঘটকী ( মেয়ে ঘোড়া) হয়ে জন্মান এবং মহাদেবের তপস্যা করায় তার আশীর্বাদে বিষ্ণু হয়গ্রীব অবতার নিয়ে জন্মে দেবীকে বিবাহ করেন। পশু হয়ে এইরূপটি তার গজলক্ষ্মীর। দেবীর আর এক জন্মে তিনি ভূমি-পুত্রি, নিজেই ভূমি স্বরূপা। জনক রাজার লাঙ্গলের ফলায় যার আবির্ভাব এবং এরই সাথে মিথিলায় শস্য শ্যামলা যুগের শুরু হয় অর্থাৎ এখানে তিনি শস্যলক্ষ্মী। কখনো তিনি কৃষ্ণের প্রেমিকা রাধা বা কখনো স্ত্রী রুক্মিণী। লক্ষ্মী জন্মে তিনি তপস্যা করে নারায়ণকে পেলেও বিশ্বরূপ দেখতে চেয়ে আগে নারায়ণকে পরীক্ষা করে নিয়েছেন – যে এই লোকটিই তার প্রকৃত আরাধ্য কিনা। কোনো জন্মে আবার এই দেবীই মহর্ষি নারদের অভিশাপে রাক্ষসী হয়ে জন্মেছেন। আবার গজানন অর্থাৎ গণেশের পাশে তিনি জ্ঞান ও ব্যবসার দেবত্বেও আসীন।
তাই লক্ষ্মী মানে শান্ত-শিষ্ট কোনো পুতুল নয়, যাকে ঘরে সাজিয়ে রাখা যায়। লক্ষ্মী মানে জ্ঞান , লক্ষ্মী মানে ঐশ্বর্য্য, লক্ষ্মী মানে তপস্যা, লক্ষ্মী মানে স্থিরতা – তেমনি লক্ষ্মী মানে গভীর চঞ্চলতা। যাকে বন্ধন করা যায় না , ছলনা রাখা যায় না – শুধু ভক্তি দিয়ে আগলে রাখতে হয়। কিন্তু নিজের বাসস্থান তিনি নিজেই ঠিক করেন এটাই তার বিশেষত্ব। (সমাপ্ত)