পাণিপীড়নবিধেরনন্তরম
প্রিয়দর্শিক ও কালিদাস পরস্পরের মুখের দিকে চাহিয়া হাসিলেন। এই বারাঙ্গনা ও কবির মধ্যে এমন একটি অন্তৰ্গঢ় পরিচয় ছিল যে, একে অন্যের মুখের দিকে চাহিয়াই তাহার মনের অন্তরতম কথাটি জানিতে পারিতেন। আজ কবির চিত্ত কোনও কারণে উৎক্ষিপ্ত হইয়াছে, তাহা প্রিয়দর্শিকা বুঝিয়েছিল। কিন্তু সে সে-কথা না বলিয়া শ্রদ্ধাবিগলিত অস্ফুট কাকলিতে কহিল— কবি, অবলার দুঃখমোচনে যদি পুণ্য থাকে, তবে সে পুণ্য আপনার। –কিন্তু ওদিকে যে গজকূর্মের যুদ্ধ বাধিল বলিয়া।
কবি প্ৰাণে এক অপরূপ শান্তি অনুভব করিতে লাগিলেন। কেবলমাত্র এই নারীর সাহচৰ্যই যেন তাঁহাকে প্ৰসন্ন করিয়া তুলিল। তিনি শয্যার উপর অর্ধশায়িত হইয়া প্রিয়দর্শিকার দিকে চাহিয়া রহিলেন। প্রিয়দর্শিক তাঁহার বাহুর নিম্নে সযত্নে একটি উপাধান ন্যস্ত করিয়া দিল।
কিছুক্ষণ দুইজনে মুখোমুখি বসিয়া রহিলেন। কবির চোখে প্ৰশান্ত নিস্তরঙ্গ শান্তি-প্রিয়দর্শিক কিছু বিচলিত।
তারপর প্রিয়দর্শিকা চক্ষু নত করিল; তাম্বুল-করাঙ্ক কবির সম্মুখে ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল–ভট্টিনীর সংবাদ কি?
কবি ঈষৎ চমকিত হইয়া তাম্বুল লইলেন, আলু একটু কুঞ্চিত হইল, বলিলেন–ভট্টিনী? সংবাদ কিছু নাই, তিনি গৃহে আছেন।
একটা দুঃসহ ক্ষোভের ছায়া প্রিয়দর্শিকার মুখের উপর দিয়া বহিয়া গেল। কিন্তু তাহা নিমেষকালের জন্য। সে হাস্যমুখেই বলিল–হায় কবি, এই সপ্তসাগরা পৃথিবী তোমার গুণে পাগল, কিন্তু তোমার গৃহিণী তোমাকে চিনিলেন না।
বিস্ময়ে ভ্রূ তুলিয়া কালিদাস বলিলেন–চিনিলেন না! কিন্তু তিনি তো আমাকে–প্রিয়দর্শিকা পূর্ণদৃষ্টিতে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া ব্যথা-বিদ্ধ কণ্ঠে কহিল–আমি সব জানি কবি, আমার কাছে কোনও কথা গোপন করিবার চেষ্টা করিও না। তারপর মুহূর্তমধ্যে কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করিয়া চটুল স্বরে বলিল–কিন্তু থাক ও কথা! আজি কবির ললাটে চিন্তারেখা দেখিতেছি। কেন? যে কাব্য শেষ হইতে আর দেরি নাই বলিয়া সকলকে আশ্বাস দিয়া রাখিয়াছেন, তাহা কি এখনও শেষ হয় নাই?
কালিদাস উঠিয়া বলিলেন–প্রিয়দর্শিকে, বড়ই বিপদে পড়িয়াছি—গত তিন রাত্রি হইতে আমার নিদ্রা নাই। তোমার পরামর্শ চাহি।
বিস্মিতা প্রিয়দশিকা বলিল–কি ঘটিয়াছে?
কালিদাস বলিলেন–আমি যে কাব্য লিখিতেছি, তাহারই সংক্রান্ত ব্যাপার–অনেক ভাবিয়াও কিছু স্থির করিতে পারিতেছি না। তোমাকে উপদেশ দিতে হইবে।
আনন্দে প্রিয়দর্শিকার মুখ উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, বাষ্পাচ্ছন্ন নোত্রে সে বলিল–কবি, আপনি রসের অমরাবতীতে বিজয়ী বাসব, কল্পনার ধ্যানলোকে আপনি শূলপাণি, আমি আপনাকে উপদেশ দিব? আমাকে লজ্জা দিবেন না।
প্রিয়দর্শিকার জানুতে করাঙ্গুলি স্পর্শ করিয়া কবি কহিলেন–প্রিয়দর্শিকে, অবন্তীরাজ্যে যদি প্রকৃত রসের বোদ্ধা কেহ থাকে তো সে তুমি–এ কথা অকপটে কহিলাম। আর সকলে পল্লবগ্রাহী, মধুর শব্দে মুগ্ধ, বাহ্য সৌন্দর্যে আকৃষ্ট; রসের অতলে কেবল তুমিই ড়ুবিতে পারিয়াছ। তুমি ভাগ্যবতী।
সজলনেত্ৰে যুক্তপাণি হইয়া প্রিয়দর্শিক বলিল–কবিবর, আমি সত্যই ভাগ্যবতী। কিন্তু কি আপনার সমস্যা, শুনি। কাব্য কি শেষ হয় নাই?
কবি বলিলেন–কাব্য শেষ হইয়াছে কি না, তাহা বুঝিতে পারিতেছি না।
বিস্ময়-কৌতূহল-মিশ্রিত স্বরে প্রিয়দর্শিকা বলিল–কাব্য শেষ হইয়াছে কি না বুঝিতে পারিতেছেন না? এ তো বড় অদ্ভুত কথা!
কালিদাস আরও নিকটে সরিয়া আসিয়া আগ্রহে বলিতে লাগিলেন—এ পর্যন্ত অন্য কাহাকেও বলি নাই, তোমাকে প্রথম বলিতেছি, শুন। আমার কাব্যের নাম কুমারসম্ভব। স্বয়ং মহেশ্বর এই কাব্যের নায়ক–পাৰ্বতী নায়িকা। কাব্যের বিষয় এইরূপ-তারকাসুরের উৎপীড়নে অতিষ্ঠ হইয়া দেবগণ ব্ৰহ্মার নিকট উপস্থিত হইলেন। ব্ৰহ্মা কহিলেন, মহাদেবের ঔরসে স্কন্দ জন্মগ্রহণ করিয়া তারকাসুরকে সংহার করিবেন। সতীর দেহত্যাগের পর শঙ্কর তখন ধ্যানমগ্ন; ও-দিকে সতী হিমালয় গৃহে উমা হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। উমা যৌবনপ্রাপ্ত হইয়া হরের পরিচর্যার জন্য তাঁহার তপোভুমিতে উপস্থিত হইলেন। হারের তপস্যা কিন্তু ভাঙ্গে না। তখন দেবগণ মদনকে তপস্যা ভঙ্গের জন্য পাঠাইলেন। মদন তপোভঙ্গ করিলেন বটে, কিন্তু স্বয়ং হরনেত্ৰজন্ম বহ্নিতে ভস্মীভূত হইলেন। মহাদেব তপোভুমি ত্যাগ করিয়া গেলেন। ভগ্নহৃদয়া উমা তখন পতিলাভার্থে কঠোর তপশ্চযা আরম্ভ করিলেন। ক্রমে মহেশ্বর প্রীত হইয়া উমার নিকট ফিরিয়া আসিলেন; তারপর উভয়ের বিবাহ হইল।
এই পর্যন্ত বলিয়া কবি থামিলেন। প্রিয়দর্শিকা তন্ময় হইয়া শুনিতেছিল, মুখ তুলিয়া চাহিল।
কবি বলিলেন–সপ্তম সর্গে আমি হরপার্বতীর বিবাহ দিয়াছি। বধূর সলজ্জ মুখে হাসি ফুটিয়াছে–কন্দৰ্প পুনরুজ্জীবিত হইয়াছে। কুমারসম্ভব কাব্যের যাহা প্রতিপাদ্য, তাহা প্রতিপন্ন হইয়াছে। সুতরাং কাব্যকলা-সঙ্গত ন্যায়ে কাব্য শেষ হইয়াছে–যথার্থ কি না?
প্রিয়দর্শিক উত্তর করিল না, তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কবির প্রতি চাহিয়া রহিল। ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া কবি বলিলেন–আমিও বুঝিতেছি যে শাস্ত্ৰমতে কাব্য এইখানেই সমাপ্ত হওয়া উচিত! তথাপি মনের মধ্যে একটা সন্দেহ জাগিয়াছে।
কিসের সন্দেহ?
মনে হইতেছে যেন কাব্য সম্পূর্ণ হইল না। উমা-মহেশ্বরের পূর্বরাগ ও বিবাহ বৰ্ণনা করিলম বটে, কিন্তু তবু কাব্যের মূল কথাটি অকথিত রহিয়া গেল। প্রিয়দর্শিকে, তোমার কি মনে হয়? দেবদম্পতির বিবাহোত্তর জীবন চিত্রিত করা কি কাব্যকলা-সঙ্গত হইবে?
প্রিয়দর্শিকা বলিল–অলঙ্কার-শাস্ত্ৰমতে হইবে না। প্রথমত বিষয়াতিরিক্ত বর্ণনা বাগবাহুল্য বলিয়া বিবেচিত হইবে। দ্বিতীয়ত জগৎপিতা ও জগন্মাতার দাম্পত্যজীবন-বৰ্ণনা অতিশয় গৰ্হিত বলিয়া নিন্দিত হইবে।
কবি জিজ্ঞাসা করিলেন–তবে তোমার মতে বিবাহ দিয়াই কাব্য শেষ করা কর্তব্য?
প্রিয়দর্শিক দীর্ঘকাল করতলে কপোল রাখিয়া বসিয়া রহিল। অবশেষে বলিল–কবি, কাব্যশাস্ত্রের চেয়ে সত্য বড়। সত্যের অনুজ্ঞায় সকলেই শাস্ত্ৰ লঙ্ঘন করিতে পারে, তাহাতে বাধা নাझ्।
কবি বলিলেন–কিন্তু এ ক্ষেত্রে সত্য কাহাকে বলিতেছ?
প্রিয়দর্শিকা বলিল–হরপার্বতীর মিলনই সত্য।
কবি বলিলেন–তাঁহাই যদি হয় তবে সে সত্য তো পালিত হইয়াছে।
হইয়াছে কি?
হয় নাই?
তাহা আমি বলিতে পারিব না; উহা কবির অন্তরের কথা।
কবি কিয়ৎকাল নীরব থাকিয়া বলিলেন–আমার অন্তরের কথা আমি বুঝিতে পারিতেছি। না-তাই এই সংশয়। তোমার অভিমত কি বল।
প্রিয়দর্শিকা মৃদু হাস্য করিয়া বলিল—আমার অভিমত শুনিবেনই?
হ্যাঁ।
না শুনিয়া নিরস্ত হইবেন না?
না।
ভাল। আজ আপনি গৃহে প্রত্যাবর্তন করুন–রাত্ৰি গভীর হইয়াছে। কাল প্রাতে যদি আপনার মনে কোনও সংশয় থাকে, আমার অভিমত জানাইব।——বলিয়া প্ৰিয়দর্শিক উঠিয়া দাঁড়াইল।
কবি ঈষৎ নিরাশ হইলেন, কিন্তু মুখে কিছু বলিলেন না। প্রিয়দর্শিকা তোরণদ্বার পর্যন্ত তাঁহার সঙ্গে আসিল। বিদায়কালে কবি বলিলেন–চলিলাম। মিহির্যভট্ট ও অমরসিংহ হইতে দূরে দূরে থাকিও। আর কথাটা চিন্তা করিয়া দেখিও। দুইজনের চোখে চোখে স্মিতহাস্য বিনিময় হইল।
প্রিয়দর্শিকা বলিল—দেখিব।
কবি যখন নিজ গৃহদ্বারে পৌঁছিলেন, তখন রাত্রি তৃতীয় প্রহর। দ্বার ভিতর হইতে অগলবদ্ধ-অন্ধকার। কবি উৎকৰ্ণ হইয়া শুনিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কোনও শব্দ পাইলেন না। বোধ হয় সকলে নিদ্ৰিত।
তিনি কবাটে করাঘাত করিলেন।
ভিতর হইতে কণ্ঠস্বর শুনা গেল—কে?
কবি কুণ্ঠিতস্বরে উত্তর করিলেন—আমি–কালিদাস।
গৃহের কবাট খুলিল–কবি সভয়ে দেখিলেন প্ৰদীপ হস্তে স্বয়ং গৃহিণী!
গৃহিণী কহিলেন–আসিয়াছ? এত রাত্রি পর্যন্ত কোথায় ছিলে?
গৃহাভ্যস্তরে প্রবেশ করিয়া কবি ক্ষুব্ধস্বরে কহিলেন–প্ৰিয়ে, তুমি এতক্ষণ জাগিয়া আছ কেন? দাসীকে বলিলেই তো—
কবিপত্নী কঠিন স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন–এত রাত্রি পর্যন্ত কোথায় ছিলে?
সঙ্কচিত হইয়া কবি কহিলেন– সমাপানকে গিয়াছিলাম—
কবিপত্নীর অবরুদ্ধ ক্রোধ এতক্ষণে ফাটিয়া পড়িল, তিনি প্ৰজ্বলিত নেত্ৰে কহিলেন–প্রিয়দর্শিকার গৃহে গিয়াছিলে! বল বল, লজ্জা কি? কেহ নিন্দা করিবে না। তুমি মহাপণ্ডিত, তুমি সভাকবি, তুমি ধর্মনিষ্ঠ ব্ৰাহ্মণ–বেশ্যালয়ে রাত্রিযাপন করিয়াছ, তাহাতে আর লজ্জা কি?
প্রিয়ে—
ধিক! আমাকে প্ৰিয়সম্বোধন করিতে তোমার কুষ্ঠা হয় না? কে তোমার প্রিয়া? আমি–না ঐ সহস্ৰভোগ্য পথকুক্কুরী প্রিয়দর্শিকা?
কবি নিরুত্তর দাঁড়াইয়া রহিলেন। তাঁহার নীরবতা কবিপত্নীর ক্ৰোধে ঘৃতাহুতি দিল–ধিক মিথ্যাচারী! ধিক লম্পট! কি জন্য রাত্রিশেষে গৃহে আসিয়াছ? বেশ্যার উচ্ছিষ্টভোগীকে স্পর্শ করিলে কুলাঙ্গনাকে স্নান করিয়া শুচি হইতে হয়! যাও–গৃহে তোমার কি প্রয়োজন? যেখানে এতক্ষণ ছিলে, সেইখানেই ফিরিয়া যাও!–এই বলিয়া কবিপত্নী শয়নকক্ষে প্ৰবেশ করিয়া সশব্দে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলেন।
অন্ধকারে কবি নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। এই তাঁহার গৃহ! এই তাঁহার ভাযাঁ! গৃহিণী সচিব সখী প্রিয়শিষ্যা! গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কবি ফিরিলেন। যে ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে বসিয়া কাব্য-রচনা করিতেন। সেই প্রকোষ্ঠে গিয়া দীপ জ্বালিলেন।
মৃগচর্ম বিছাইয়া উপবেশন করিতেই অদূরে কাষ্ঠাসনে রক্ষিত কুমারসম্ভবের বৃহৎ পুঁথির উপর দৃষ্টি পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎচমকের ন্যায় আকস্মিক প্ৰভা তাঁহার মস্তিষ্কের মধ্যে খেলিয়া গেল। প্রিয়দর্শিকা ঠিক বুঝিয়াছিল। সে বলিয়াছিল–কাল প্রাতে যদি কোনও সংশয় থাকে—। না, তাঁহার মনে আর লেশমাত্ৰ সংশয় নাই। পত্নীর সহিত সাক্ষাতের সঙ্গে সঙ্গে সংশয়ের অন্ধকার কাটিয়া গিয়াছে।
কালিদাস উঠিলেন। প্ৰদীপদণ্ড আনিয়া আসনপার্শ্বে রাখিলেন, কাষ্ঠাসন-সমেত পুঁথি সম্মুখে স্থাপন করিলেন। মসীপাত্ৰ, লেখনী ও তালপত্র পাড়িয়া আবার আসিয়া বসিলেন।
ক্রমে তাঁহার মুখের ভাব স্বপ্নাচ্ছন্ন হইল। লেখনী মুষ্টিতে লইয়া তালপত্রের উপর পরীক্ষা করিলেন, তারপর ধীরে ধীরে লিখিলেন–অষ্টমঃ সর্গঃ।
এই পর্যন্ত লিখিয়া অতি দীর্ঘকাল দৃষ্টিহীন নয়নে গবাক্ষের দিকে চাহিয়া রহিলেন। বাহিরে তামসী রাত্রি, টিপ টিপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে। কিন্তু কবির মানসপটে যে চিত্রগুলি একে একে ভাসিয়া উঠিতে লাগিল, তাহা বসন্তের গন্ধে বৰ্ণে কাকলিতে সমাকুল–বর্ষা রজনীর শ্যামসজল ছায়া তাহার অম্লান দীপ্তিকে স্পর্শ করিতে পারিল না।
সহসা অবনত হইয়া কবি লিখিতে আরম্ভ করিলেন, শরের লেখনী তালপত্রের উপর শব্দ করিয়া চলিতে লাগিল—পাণিপীড়নবিধেরনন্তরম্—
৩০ আষাঢ় ১৩৪০