Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

ঘাট হইতে পথে অবতীর্ণ হইয়া তিনি দেখিলেন, পথ পিচ্ছিল, কর্দমপূর্ণ। সম্মুখেই মহাকালের কৃষ্ণপ্রস্তর-নির্মিত গগনভেদী মন্দির মেঘলোকে চুড়া তুলিয়া আছে। ভট্ট সেইদিকে অগ্রসর হইতেই মন্দির-অভ্যন্তর হইতে ঘোর রবে ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। সন্ধ্যারতির কাল উপস্থিত। মন্দিরের অঙ্গনে বহু লোক আরতি দেখিবার জন্য উপস্থিত হইয়াছে। ভট্ট ভিতরে প্রবেশ করিলেন না, বাহির হইতে বদ্ধাঞ্জলি হইয়া ইষ্টদেবতাকে ভক্তিভরে প্রণাম করিলেন। শঙ্খ-ঘণ্টার রোল চলিতে লাগিল; কালাগুরু ধূপ ও গুগগুলের গন্ধ চারিদিকের বায়ুকে সৌরভে ভারাক্রান্ত করিয়া তুলিল।

আরতি শেষ হইলে ভট্ট আবার চলিতে আরম্ভ করিলেন। অন্ধকার আকাশ হইতে সূক্ষ্ম বারিপতন হইতেছে –রাজপথে লোক নাই। এখন রাত্রি হইয়াছে, অথচ পাষাণ-বনদেবীর হস্তে পথদীপ জ্বলে নাই; মধ্যরাত্রির পূর্বে বনদেবীগণ প্ৰদীপহস্তা হইবেন না। পথিপার্শ্বের সুবৃহৎ অট্টালিকা-সমূহে বর্তিকা জ্বলিতেছে বটে, কিন্তু তাহা অভ্যন্তর মাত্র আলোকিত করিয়াছে; কচিৎ নাগরিকদিগের বিলাস-কক্ষের মুক্ত গবাক্ষপথে আলোক-রশ্মি ও জাতী কদম্ব কেতকী যুখীর মিশ্র গন্ধ নির্গত হইয়া পথচারীকে গৃহের জন্য উন্মনা করিয়া তুলিতেছে। ভট্ট এই ঈষদালোকিত কৰ্দম-পিচ্ছিল পুষ্প-সুবাসিত পথ দিয়া সাবধানে চলিতে লাগিলেন।

উজ্জয়িনীর পথ অতিশয় সঙ্কীর্ণ, কোনওমতে দুইটি রথ বা প্রবহন পাশাপাশি চলিতে পারে। পথ ঋজু নহে, সংসপিত হইয়া আকিয়া-বাঁকিয়া বহু শাখা প্রশাখা বিস্তার করিয়া চলিয়াছে। ভট্ট হেঁট মুণ্ডে গৃহাভিমুখে চলিতে চলিতে অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছেন–কোনও দিকে লক্ষ্য ছিল না; সহসা একটা মোড় ঘুরিয়া সম্মুখে দীপোদ্ভাসিত প্রাসাদ-তোরণ দেখিয়া তাঁহার চমক ভাঙ্গিল।

তোরণের পশ্চাতে প্রাসাদ, সেখানেও দীপোৎসব। তোরণ-সম্মুখে বহু সম্রান্ত ব্যক্তির রথ, দোলা, যানবাহন যাতায়াত করিতেছে। প্রাসাদের অভ্যন্তর হইতে সঙ্গীতের সুমিষ্ট ধ্বনি কানে আসিতেছে। ভট্টের স্মরণ হইল, আজ প্রিয়দর্শিকার গৃহে সমাপানক। স্বয়ং মহামাণ্ডলিক অবন্তীপতি এই সমাপানকে যোগদান করিবেন বলিয়াছেন। ভট্টেরও নিমন্ত্রণ আছে।

ভট্টের মুখ হর্ষোৎফুল্ল হইয়া উঠিল। কি আশ্চর্য! এ কথাটা তাঁহার এতক্ষণ মনে হয় নাই কেন? তাঁহার নিদারুণ সমস্যর যদি কেহ সমাধান করিতে পারে তো সে ঐ মহাবিদুষী চতুঃষষ্টিকলার পারংগতা আলোকসামান্যা বারবধু প্রিয়দর্শিকা। তাহার মতো সর্বশাস্ত্ৰে সুপণ্ডিতা অবন্তীরাজ্যে অন্য কে আছে? সত্য কথা বলিতে কি, তাঁহার কাব্যের নিগূঢ় রস ব্যঙ্গোক্তি প্রিয়দর্শিক যতটা বুঝিবে, এত আর কেহ বুঝিবে না। সে সামান্যা রূপোপজীবিনী নহে–রাজ্যের বারমুখ্যা। স্বয়ং আযাবর্তের অধীশ্বর বিক্রমাদিত্য উজ্জয়িনীতে পদাৰ্পণ করিয়াই প্রিয়দর্শিকাকে স্মরণ করেন; শুধু তাহার অলৌকিক রূপযৌবনের জন্য নহে, তাহার অশেষ গুণাবলীর জন্য তাঁহাকে সম্মান প্রদর্শন করেন। সেই প্রিয়দর্শিকার গৃহে নিমন্ত্রিত হইয়াও তিনি এতক্ষণ ভুলিয়া ছিলেন? ভট্ট সহৰ্ষে তোরণ অভিমুখে অগ্রসর হইলেন।

কিন্তু তোরণের সমীপবর্তী হইয়া ভট্টের মুখে ঈষৎ উদ্বেগের ছায়া পড়িল। গৃহে ভট্টিনী প্ৰতীক্ষ্ণ করিয়া আছেন; তিনি এসব পছন্দ করেন না। বিশেষত প্রিয়দর্শিককে তিনি ঘোর সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন। দেশে নিন্দুকের অভাব নাই, ভট্টের সহিত প্রিয়দর্শিকার গুপ্ত প্ৰণয়ের একটা জনশ্রুতি ভট্টিনীর কানে উঠিয়াছে। তদবধি প্ৰিয়দশিকার নাম শুনিলেই তিনি জুলিয়া যান। সুতরাং গণ্ডের উপর পিণ্ডের ন্যায় আজ যদি ভট্ট প্রিয়দর্শিকার গৃহে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত যাপন করেন, তাহা হইলে আর রক্ষা থাকিবে না।

তোরণের সম্মুখে দাঁড়াইয়া ভট্ট ইতস্তত করিতেছেন দেখিয়া তোরণাপালিকা কিঙ্করীগণ কলকণ্ঠে তাঁহাকে সম্ভাষণ করিল–আসুন কবীন্দ্ৰ। স্বাগত! আসুন পণ্ডিতবর, আযৰ্থ প্রিয়দর্শিকা আপনার জন্য অধীরভাবে প্রতীক্ষ্ণ করিতেছেন। আসুন মহাভাগ, আপনার অভাবে নবরত্নমালিকা আজি মধ্যমণিহীন। স্বাগত! শুভাগত

দাসীগণ সকলেই যৌবনবতী, রসিকা ও সুন্দরী। তাহাদের কাহারও হস্তে পুষ্পমালা, কাহারও হস্তে জলপূৰ্ণ ভৃঙ্গার, কেহ বা সুগন্ধি দ্রব্যপূর্ণ স্থলী লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। তাহারা সকল অতিথিকেই মহা সম্মানপূর্বক স্বাগত-সম্ভাষণ করিতেছে; কিন্তু কবিকে দেখিয়া তাহারা যেরূপ সমস্বরে সাহ্রাদে আহ্বান করিল, তাহাতে কবি আর দ্বিধা করিতে পারিলেন না। গৃহের চিন্তা মন হইতে অপসারিত করিয়া হাস্যমুখে তোরণ-পথে প্রবেশ করিলেন।

মৰ্মর-পট্রের উপর পদার্পণ করিবামাত্র একটি দাসী ছুটিয়া আসিয়া তাঁহার চরণে জল ঢালিয়া দিতে লাগিল, অন্য একজন নতজানু হইয়া বসিয়া পদ প্রক্ষালন করিয়া দিল। তৃতীয় দাসী শুভ্র কার্পাস বস্ত্ৰ দিয়া পা মুছাইয়া দিল। কবিকে উজ্জয়িনীর নাগরিক-নাগরিকা যেরূপ ভালবাসিত, এরূপ আর কাহাকেও বাসিত না। তাই তাঁহার সেবা করিবার সৌভাগ্যের জন্য দাসীদের মধ্যে হুড়াহুড়ি পড়িয়া গেল।

গন্ধদ্রব্যের স্থালী হস্তে দাসী কবির সম্মুখে দাঁড়াইতেই তিনি অঙ্গুলির প্রান্ত চন্দনে ডুবাইয়া সকৌতুকে তাহার ভ্রমধ্যে তিলক পরাইয়া দিলেন। সকলে আহ্বাদে হাস্য করিয়া উঠিল। যাহার হাতে পুষ্পমাল্য ছিল, সে আসিয়া তাড়াতাড়ি কবির গলায় যুখীর একটি স্কুল মালা পরাইয়া দিল। কবি তাহাকে ধরিয়া বলিলেন–সুলোচনে, এ কি করিলে? তুমি আমার গলায় মালা দিলে?

সুলোচনাও বাক্যবিন্যাসে কম নহে, সে কুটিল হাসিয়া উত্তর করিল—কবিবর, এখানে আমরা সকলেই আযা প্রিয়দর্শিকার প্রতিনিধি।

মুখের মতো উত্তর পাইয়া কবি হাসিতে হাসিতে প্রাসাদ অভিমুখে চলিলেন। উদ্যানের মধ্য দিয়া শ্বেত প্রস্তরের পথ, তাহার দুইধারে ধ্যানাসীন মহাদেবের মূর্তি। মূর্তির শীর্ষস্থ জটাজাল হইতে সুগন্ধি বারি উৎসের ন্যায় নিক্ষিপ্ত হইতেছে।

প্রথম মহল নৃত্যশালা। সেখানে প্রবেশ করিয়া কবি দেখিলেন তরুণ নাগরিকদের সভা বসিয়া গিয়াছে। মধ্যস্থলে নর্তকী বাহুবল্লরী বিলোলিত করিয়া অপাঙ্গে বিদ্যুৎফুলিঙ্গ বর্ষণ করিয়া কেয়ুর কিঙ্কিণী মঞ্জীর-শিঞ্জিনে অপূর্ব সম্মোহন সৃষ্টি করিয়া রাগ-দীপক নৃত্যে অন্সরালোকের ভ্রান্তি বহিয়া আনিতেছে। সঙ্গে সঙ্গে নিপুণ চরণনিক্ষেপের তালে তালে মৃদঙ্গ ও সপ্তস্বরা বাজিতেছে। মৃদঙ্গীর চক্ষু নৰ্তকীর চরণে নিবদ্ধ; বীণা-বাদকের ললাটে ভ্রূকুটি, চক্ষু মুদিত। অন্য সকলে নর্তকীর অপরূপ লীলা-বিভ্ৰম দেখিতেছে। সকলেই গুণী রসজ্ঞ–কলা-সঙ্গত বিশুদ্ধ নৃত্য দেখিতে দেখিতে তাহাদের চক্ষু ভাবাতুর। কেহ নড়িতেছে না, মূর্তির মতো বসিয়া দেখিতেছে।

কবি কিছুক্ষণ বসিয়া দেখিলেন, তারপর নিঃশব্দে কক্ষ হইতে নিৰ্গত হইলেন। দ্বিতীয় প্রাসাদ নৃত্যশালার সংলগ্ন, মধ্যে একটি অলিন্দের ব্যবধান। সেখানে গিয়া কবি দেখিলেন, কথা-কাহিনীর আসর বসিয়াছে। বক্তা স্বয়ং বেতালভট্ট। তিনি মণিকুট্টিমের মধ্যস্থলে শঙ্খরচিত কমলাসনে বসিয়াছেন, তাঁহাকে ঘিরিয়া বহু নাগরিক-নাগরিক করতলে চিবুক রাখিয়া অবহিত হইয়া শুনিতেছে। চষকহস্তা কিঙ্করীগণ পূর্ণ পানপত্র সম্মুখে ধরিতেছে, কিন্তু কাহারও ভুক্ষেপ নাই। কিঙ্করীরাও পাত্ৰ হস্তে চিত্ৰাপিতার ন্যায় গল্প শুনিতেছে।

বেতাল ভট্ট গভীর কণ্ঠে কহিতেছেন–পিশাচ আট্ট অট্ট হাস্য করিল; কহিল, মহারাজ, এই শ্মশানভূমির উপর আপনার কোনও অধিকার নাই, ইহা আমার রাজ্য। ঐ যে নরমেন্দঃ-শোণিতলিপ্ত মহাশূল মশানের মধ্যস্থলে প্রোথিত দেখিতেছেন, উহাই আমার রাজদণ্ড।

কবি আর সেখানে দাঁড়াইলেন না, হাস্য গোপন করিয়া চুপিচুপি নিষ্ক্রান্ত হইলেন। যাইবার পূর্বে সকলের মুখ একবার ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিয়া লইলেন, কিন্তু প্রিয়দর্শিকাকে শ্রোতৃমণ্ডলীর মধ্যে দেখিতে পাইলেন না।

তৃতীয় প্রাসাদটি সবাপেক্ষা বৃহৎ ও সুরম্য। সভার ন্যায় সুবিশাল কক্ষ, তাহার চারিদিকে বহুবিধ আসন ও শয্যা বিস্তৃত রহিয়াছে, কেন্দ্ৰস্থলের মর্মর-কুট্টিম অনাবৃত; তাহার উপর মণিময় অক্ষবাটি অঙ্কিত রহিয়াছে। ছাদ হইতে সুবৰ্ণ শৃঙ্খলে অগণিত দীপ দুলিতেছে, কক্ষ-প্রাচীরে সারি সারি দীপ, উপরন্তু হর্ম্যতলে স্থানে স্থানে স্বর্ণদণ্ডের শীর্ষে সুগন্ধি বর্তিকা জ্বলিতেছে। কক্ষের কোথাও লেশমাত্র অন্ধকার নাই। এই কক্ষের দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া কবির মনে হইল, কক্ষে বুঝি কেহ নাই—এত বিশাল এই কক্ষ যে সেখানে প্রায় ত্ৰিশজন লোক থাকা সত্ত্বেও উহা শূন্য মনে হইতেছে। সখী ও পরিচারিকাগণ ছায়ার মতো গমনাগমন করিতেছে; তাহাদের নূপুরগুঞ্জনও যেন মৃদু ও অস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে।

ঘরের মধ্যস্থলে উপস্থিত হইয়া কবি দেখিলেন, মহারাজা অবন্তীশ্বর বররুচির সহিত অক্ষ-ক্রীড়ায় বসিয়াছেন। তাঁহাদের একপাশ্বে রত্নখচিত সুরাভূঙ্গার ও চাষক, অন্যপার্শ্বে তাম্বল—করাঙ্ক। দুইজনেই খেলায় নিমগ্ন। কবি গিয়া দাঁড়াইতেই মহারাজ অন্যমনস্কভাবে চক্ষু তুলিয়া পার্ষ্টি ঘষিতে ঘষিতে বলিলেন–কালিদাস? এস বন্ধু, আমার সহায় হও। বররুচি আমার অঙ্গদ জিতিয়া লইয়াছে–এবার কঙ্কণ পাণ–বলিয়া পার্ষ্টি ফেলিলেন। গজদন্তের পার্ষ্টিতে মরকতের অক্ষি আলোকসম্পাতে ঝলসিয়া উঠিল।

রাজার আহ্বানে কালিদাস বসিলেন। অন্যদিন হইলে নিমেষমধ্যে তিনিও খেলায় মাতিয়া উঠিতেন; কিন্তু আজ তাঁহার মন লাগিল না। বিশেষ ইহারা দুইজনেই খেলায় এত একাগ্ৰ যে, মাঝে মাঝে সুরাপাত্র নিঃশেষ করা ব্যতীত আর কোনও দিকে মন দিতে পারিতেছেন না। কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিয়া কালিদাস উঠিলেন; ঘরের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিতে করিতে দেখিলেন, দূরে নীল পক্ষ্মল চীনাংশুকের আস্তরণের উপর প্রিয়দর্শিকা বসিয়া আছে–যেন সরোবরের মাঝখানে একটি মাত্র কমল ফুটিয়াছে। তাহার সম্মুখে বসিয়া একজন পুরুষ হাত নাড়িয়া কি কথা বলিতেছে, পশ্চাৎ হইতে কালিদাস তাহার মুখ দেখিতে পাইলেন না। প্রিয়দর্শিকা কপোলে হস্ত রাখিয়া তাহার কথা শুনিতেছিল। কালিদাস সেইদিকে ফিরিতেই দুইজনের চোখাচোখি হইল। প্রিয়দর্শিক স্মিত হাসিয়া চোখের ইঙ্গিতে কবিকে ডাকিল।

কবি বুঝিলেন, প্রিয়দর্শিক বিপদে পড়িয়াছে। তিনি মন্দমন্থর পদে সেই দিকে অগ্রসর হইলেন। নিকটে গিয়া দেখিলেন, যে ব্যক্তি প্রিয়দর্শিকার সহিত কথা কহিতেছে, সে অত্যন্ত পরিচিত—তাহার মুখ শূকরের ন্যায় কদাকার, দেহ রোমর্শ, মস্তকের কেশ কণ্টকবৎ ঋজু ও উদ্ধত। কবি মৃদুকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন, কহিলেন–কে ও? বরাহ–না না—মিহির্যভট্ট যে! প্রিয়দর্শিকে, জ্যোতিবিশারদ কি তোমার ভাগ্য-গণনা করিতেছেন??

বাধাপ্রাপ্ত বরাহমিহির ক্রুদ্ধমুখে কবির দিকে ফিরিলেন। প্রিয়দর্শিক যেন ইতিপূর্বে কবিকে দেখে নাই, এমনিভাবে তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইয়া করজোড়ে তাঁহাকে প্ৰণাম করিল। তাহার কৰ্ণে নীলকান্তমণির অবতংস দুলিয়া উঠিল। কণ্ঠস্বরে মধু ঢালিয়া দিয়া বলিল–কবিবর, স্বাগতোহসি। আপনার পদার্পণে আজ আমার গৃহে পরমোৎসব। আসন গ্রহণ করুন আর্য।

—হলা বকুলে, শীঘ্ৰ কবিবরের জন্য পানীয় লইয়া আয় ৷

কালিদাস বসিলেন, বলিলেন—আচার্য মিহির, কিসের আলোচনা হইতেছিল? ফলিত জ্যোতিষ? উত্তম কথা, আমার ভাগ্যটা একবার গণনা করিয়া দেখুন তো। সম্প্রতি বড় বিপদে পড়িয়াছি।

বরাহমিহির মুখে হাসির একটা অনুকৃতি করিয়া বলিলেন–কবি, তুমি এখন বিনাইয়া বিনাইয়া একটা বিষা-সংহার কাব্য লেখা গিয়া। এসব কথা তুমি বুঝিবে না।

পরিচারিকা স্ফটিকপাত্রে আসব লইয়া আসিল, প্রিয়দর্শিকা তাহা স্বহস্তে লইয়া কবিকে দিল। কবি পান করিয়া পাত্ৰ দাসীকে ফিরাইয়া দিলেন, তারপর প্রিয়দর্শিকার হস্ত হইতে তাম্বল লইয়া বলিলেন–কেন বুঝিব না? জ্যোতিষশাস্ত্ৰে শক্ত কি আছে? দ্বাদশ রাশি সপ্তবিংশতি নক্ষত্র আর নবগ্রহ–এই লইয়া তো ব্যাপার। ইহাও যদি বুঝিতে না পারি—

রম্ভ করিলেন। বলিলেন–একবার ভাবিয়া দেখ, আমাদের অপৌরুষেয় শাস্ত্রের উপর এই অর্বাচীন যাবনিক বিদ্যা বলাৎকারপূর্বক বসাইয়া দেওয়া হইয়াছে। ফল কিরূপ বিষময় হইয়াছে

তাহা জান কি? অশ্বিন্যাদি বিন্দু পুরা তিন অংশ সরিয়া গিয়াছে।

বরাহমিহির ক্ষুদ্র রক্তবর্ণ নেত্ৰে প্রিয়দর্শিকাকে দগ্ধ করিবার উপক্ৰম করিলেন, যেন এই অপরাধের পরিপূর্ণ দায়িত্ব তাঁহারই–তিন অংশ! কল্পনা কর–তিন অংশ! ইহার ফলে সমগ্র ভূ-চক্র তিন অংশ সরিয়া গিয়াছে! সর্বনাশ হইতে আর বাকি কি? যে সকল গৰ্ভদাস এই ককার্য করিয়াছে, তাহারা জানে না যে, আকাশচক্র রথচক্ৰ নয়–উহা চিরস্থির চির-নিরয়ন। এই গ্ৰহতারামণ্ডিত ব্যোম নিরন্তর ঘূর্ণমান হইয়াও আচল গতিহীন-

কালিদাস হাসিয়া উঠিলেন; দেখিলেন, বরাহ আজ যেরূপ ক্ষেপিয়াছে, সহজে উহার কবল হইতে প্রিয়দর্শিকাকে উদ্ধার করা যাইবে না। তিনি উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন–মিহির্যভট্ট, ওটা আপনার ভুল। আকাশচক্র সত্যই রথচক্ৰ–মহাকালের নিঃশব্দ ঘর্ঘরহীন রথচক্ৰ। উহা নিরন্তর ঘুরিতেছে এবং সেই সঙ্গে আমরাও ঘুরিতেছি।

বরাহ কবির দিকে কেবল একটা কষায়িত নেত্ৰপাত করিয়া আবার কহিতে লাগিলেন– শুধু কি তাই! এই দ্বাদশ রাশির অভিযানের ফলে ফলিত জ্যোতিষ একেবারে লণ্ডভণ্ড হইয়া গিয়াছে! অভিজিৎ আজি কোথায়? অভিজিৎকে ছগমুণ্ড করিয়া তাহার গলা কাটিয়া তাহাকে নক্ষত্ৰলোক হইতে নির্বাসিত করা হইয়াছে! দ্বাদশ রাশিকে। সুতান্ত্রিত করিবার জন্য অষ্টবিংশতি নক্ষত্ৰ এখন সপ্তবিংশতি হইয়াছে। দুদিন পরে অভিজিতের নাম পর্যন্ত লোকে ভুলিয়া যাইবে–জ্যোতিঃশাস্ত্র মুখের দ্বারা লাঞ্ছিত অবজ্ঞাত হইবে–

শুনিতে শুনিতে কবি অন্যত্ৰ প্ৰস্থান করিলেন। প্রিয়দর্শিক তাঁহার প্রতি একবার করুণ-কটাক্ষ নিক্ষেপ করিল; কিন্তু উপায় নাই। দৈত্য কর্তৃক আক্রান্ত উর্বশীকে পুরুরবা উদ্ধার করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু এ দৈত্য অবধ্য। বিমৰ্ষভাবে চিন্তা করিতে করিতে কবি কক্ষে ইতস্তত ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। রাত্ৰিও ক্রমে গভীর হইতেছে; কবি ভাবিলেন, আজ আর কিছু হইল না, গৃহে ফিরি। এই সময় তাঁহার দৃষ্টি পড়িল কক্ষের দূর কোণ হইতে একব্যক্তি হস্ত-সঙ্কেতে তাঁহাকে ডাকিতেছে। লোকটি বোধ হয় কিছু অধিক মাত্রায় মাদক-সেবা করিয়াছে, কারণ সে আসন হইতে উঠিবার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু পারিতেছে না এবং যতই উঠিতে অসমর্থ হইতেছে, ততই আর এক চষক পান করিয়া শক্তি সংগ্রহে যত্নবান হইতেছে। তিনজন গূঢ়হাস্যমুখী দাসী তাহার আসিব যোগাইতেছে।

লোকটি বৃদ্ধ, কিন্তু বেশভূষা নবীন নাগরিকের ন্যায়। দেহটি স্থল, মুখ বর্তুলাকার ও লোলমাংস; কিন্তু অতি যত্ন সহকারে অঙ্গ-সংস্কার করা হইয়াছে। চক্ষে কজ্জল, কৰ্ণে সুবর্ণ কুণ্ডল, কণ্ঠে মুক্তাহার, রোমশ দেহে পত্রচ্ছেদ্য–নব যুবক সাজিবার কোনও কৌশলই পরিত্যক্ত হয় নাই। কালিদাস তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইলে তিনি চক্ষু তুলিয়াই সহসা কাঁদিয়া ফেলিলেন। দাসীরা মুখ ফিরাইয়া হাসিল।

কালিদাস বৃদ্ধের পাশে বসিয়া উদ্বিগ্নভাবে প্রশ্ন করিলেন–বটু, কি হইয়াছে? এত কাতর কেন?

চক্ষু মার্জনা করিয়া বৃদ্ধ স্থলিত বচনে কহিলেন–বরাহমিহির একটা ষণ্ড!

সমবেদনাপূর্ণ হৃদয়ে কালিদাস বলিলেন–সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। কিন্তু কি হইয়াছে?

বৃদ্ধ পুনশ্চ বলিলেন–বরাহমিহির একটা বৃষ!

কবি বলিলেন–বটু, এ বিষয়ে আমি তোমার সহিত একমত। কিন্তু ব্যাপার কি–বৃষটা করিয়াছে কি?

ভগ্নহৃদয় বৃদ্ধ আবার আরম্ভ করিলেন–বরাহমিহির একটা—

বলীবর্দ! কবি বৃদ্ধের পৃষ্ঠে হাত রাখিয়া বলিলেন–উক্ষা ভদ্রো বলীবর্দঃ ঋষভো বৃষভো বৃষঃ আমার কণ্ঠস্থ আছে–সুতরাং আবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। এখন বলীবর্দটার দুষ্কৃতি সম্বন্ধে সবিশেষ জানিতে পারিলে নিশ্চিন্ত হইতে পারি।

বৃদ্ধ আর এক চষক মদ্য পান করিলেন, তারপর কহিলেন–কালিদাস, তুমি আমার প্রাণাধিক বয়স্য, তোমার সঙ্গে শৈশবে একসঙ্গে খেলা করিয়াছি, তোমার কাছে আমার গোপনীয় কিছুঁই নাই। আমি প্রিয়দর্শিকার প্রেমে মজিয়াছি।–এইখানে বৃদ্ধ আর এক চষক পান করিলেন–তাঁহাকে যে কতবার কত মদীনালঙ্কার উপহার দিয়াছি, কত সঙ্কেত জানাইয়াছি, তাহার ইয়াত্তা নাই। কিন্তু দুষ্টা আমাকে দেখিলেই তাত বলিয়া সম্বোধন করে–এমন ছলনা দেখায় যেন আমার মনের ভাব বুঝিতেই পারে নাই!–আজ আমি সঙ্কল্প করিয়া আসিয়াছিলাম যে, প্রিয়দর্শিকার চরণে আত্মনিবেদন করিব–কোনও ছল-চাতুরী শুনিব না। কিন্তু আসিয়াই দেখিলাম, ঐ বরাহটা উহাকে কর-কবলিত করিয়াছে। সেই অবধি কেবলই সুযোগ খুঁজিতেছি, কিন্তু শূকরটা কিছুতেই উহার সঙ্গ ছাড়িতেছে না। বলিয়া সুরাবিহ্বল নেত্রে যতদূর সম্ভব বিদ্বেষ-সঞ্চার করিয়া যেখানে বরাহমিহির বসিয়া ছিলেন, সেইদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন।

প্রবল হাস্যোচ্ছাস দমন করিয়া কালিদাস কহিলেন–বটু, তোমার বুদ্ধিভ্রংশ হইয়াছে।–প্রিয়দর্শিকার প্রতি প্রেমসঞ্চার তোমার পক্ষে অতীব গৰ্হিত। তুমি বালকমাত্ৰ–প্রিয়দর্শিকা বর্ষীয়সী,–তাহার সহিত তোমার প্রণয় কদাপি যুক্তিযুক্ত নয়। তুমি বরঞ্চ তোমার বয়সোপযোগিনী কোনও কুমারী কন্যার প্রতি আসক্ত হও।

বৃদ্ধ বিবেচনা করিয়া বলিলেন–সে কথা যথার্থ। কিন্তু আমি প্ৰিয়দর্শিককে মনপ্ৰাণ সমৰ্পণ করিয়া ফেলিয়াছি, এখন আর ফিরাইয়া লইতে পারি না। তারপর কালিদাসের হস্ত ধারণ করিয়া কাতরভাবে বলিলেন–কালিদাস, তুমি আমার সখা, আজ সখার কার্য কর, ঐ শূকরটাকে প্রিয়দর্শিকার নিকট হইতে খেদাইয়া দাও। নতুবা বন্ধুহত্যার পাপ তোমাকে স্পর্শ করিবে।

অকস্মাৎ একটা কুটবুদ্ধি কালিদাসের মাথায় খেলিয়া গেল। ঠিক হইয়াছে–কণ্টকেনৈব কণ্টকম! তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন–শুধু প্রিয়দর্শিকার নিকট হইতে খেদাইয়া দিলেই হইবে? আর কিছু চাহ না?

আর কিছু চাহি না।

ভাল, চেষ্টা করিয়া দেখি। কালিদাস উঠিলেন। কিছু দূর গিয়া আবার ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন–একটা কথা। বটু, পৃথিবীর আহ্নিক গতি আছে, এ কথা তুমি বিশ্বাস কর?

বৃদ্ধ বলিলেন—পৃথিবীর আহ্নিক গতি থাক বা না থাক—

কালিদাস বলিলেন—না না, ওটা একান্ত আবশ্যক! বরাহমিহির আহ্নিক গতিতে বিশ্বাস করেন না।

নিজের উরুর উপর প্রচণ্ড চপেটাঘাত করিয়া বটুক বলিলেন–তবে আমি বিশ্বাস করি। মুক্তকণ্ঠে কহিতেছি—

কবি হাসিয়া বলিলেন–থাক, উহাতেই হইবে। একেবারে মিথ্যা বলিতে চাহি না।

দুঃখিতভাবে মস্তক আন্দোলন করিয়া কহিলেন–আর্য মিহির্যভট্ট, বড়ই দুঃসংবাদ শুনিতেছি।

বরাহমিহির বাক্যস্রোত সম্বরণ করিয়া কহিলেন–কি হইয়াছে?

কালিদাস উপবেশন করিয়া বলিলেন–এতক্ষণ তাত অমরসিংহের সহিত কথা হইতেছিল। তিনি বলিলেন, আর্যভট্টের মীমাংসাই সত্য; পৃথিবীর আহ্নিক গতি আছে।

মিহিরভট্ট শূকর-দন্ত নিষ্ক্রান্ত করিয়া সক্রোধে বলিলেন—অমরসিংহ একটা নখদন্তহীন বৃদ্ধ ভল্লুক, তাহার বুদ্ধি লোপ পাইয়াছে।

কালিদাস কহিলেন–তিনি বলিতেছেন যে, আহ্নিক নামে একটি নূতন শব্দ শীঘ্রই অমরকোষে সংযোজিত করিবেন। তাহাতে আর্যভট্টের মীমাংসাই–

মিহিরভট্ট আর স্থির থাকিতে পারিলেন না, অর্ধরুদ্ধ একটি গর্জন ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তারপর–জড়বুদ্ধি জরগদব। শৌণ্ড! উন্মাদ ইত্যাদি কটূক্তি করিতে করিতে অমরসিংহের অভিমুখে ধাবিত হইলেন।

Pages: 1 2 3

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *