অলক ঘরে ফেরেনি -2
একটু বেলা হতেই লক্ষী ঘুমন্ত ছেলেকে বুকে তুলে বাজারে ছুটেছিল চাল-ডাল-তেল আনতে। কাল রাতের সমস্ত কালিমা কোন জাদুমন্ত্রে যেন উবে গেছিল মন থেকে । তারবদলে মনে যেন বসন্তের হওয়া বইছিল। কানে বাজছিল কোকিলের অদৃশ্য কুহু ধ্বনি। এক অজানা ভালোলাগায় বিভোর হলো তার মন। ভালোবাসার এক অনাস্বাদিত অমৃত ধারায় তার মনের সুপ্ত তৃষ্ণা মিটছিলো কালরাতে। কাল সেই মুহূর্তে বোঝেনি কিন্তু আজ প্রতিমুহূর্তে অনুভব করতে পারছে।। কেন ,কিভাবে তা কোনদিন মুখ ফুটে বলে বোঝাতে পারবে না। কারণ এ অনুভব যায় শুধু বোঝানো যায় না।
পরেরদিন গভীর রাতেও স্বপনদা এসেছিল লক্ষীর কাছে। লক্ষী কোন বাধা দেয়নি বরং অনায়াসে ,অক্লেশে নিজেকে সমর্পণ করেছিল স্বপনের কাছে। তাহলে কি সে এতদিন শারীরিক প্রেমে বঞ্চিত ছিল, অলোক ঘুনাকরেও বোঝেনি লক্ষীর কামনা, বাসনার কথা ? তাহলে কি চাহিদা মেটাতে সে অক্ষম ? তবে কি স্বপন আজ তার পৌরুষত্ব দিয়ে লক্ষীর গোপন মনকষ্ট দূর করলো। প্রেমের আরেক নতুন দিগন্ত খুলে দিল ? না হলে লক্ষী কেন স্বপনকে এত আপন করে আঁকড়ে ধরে পুলকিত হয়েছিলো কালরাতে ?ভয়তো দুরস্ত, সে অনুভব করছিল এতো তৃপ্তি,সুখ,আনন্দ তার আড়াইবছরের বিবাহিত জীবনে কোনদিন পাইনি। এই মুহূর্তে লক্ষী উল্লসিত,পুলকিত, কামনার পূর্ণতায় রোমাঞ্চিত। স্বপন চলে যাওয়ার পরও লক্ষী উঠলো না,দরজা বন্ধ করলোনা,দেহের অনাবৃত অংশ ঢাকার কোন চেষ্টাও করলো না। কেমন নেশাগ্রস্ত,মোহচ্ছন্ন অবস্থায় পড়ে রইল মেঝেতে।
পরদিন অলোক বাড়ি ফিরলো সম্পর্ণ বিধ্বস্ত, উদভ্রান্তের মতো। চোখেই নিচে কালি। এ কয়দিনে তার শুকিয়ে গেছে শরীর। বসে একটু বিশ্রাম নিয়ে যা বৃত্তান্ত শোনালো তা শুনে লক্ষী পাথরের স্ট্যাচু হয়ে গেল। সেইমুহূর্তে ওঠার ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে ফেললো।
মনে মনে নিজেকে গালমন্দ দিতে লাগলো । এই মানুষটাকে সে মন দিয়েছিল, এমন বোকা,নির্বোধ,অপদার্থ মানুষ কি দুটো জন্মেছে ?
ঘটনাটা যা ঘটেছিল তা হলো অলোক যা ধুপ ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে গেছিল সবই বিক্রি হয়ে গেছিল,যদি তার কাছে আরও কিছু থাকতো তাও বিক্রি হয়ে যেত। পাঁচ হাজার টাকার জিনিষ সে বারো হাজার টাকায় বিক্রি করে ছিলো। কিন্তু গন্ডগোল বাঁধলো ফেরার আগের দিন। ওরা তিনজন একটা ঘরে এসে ডেরা বেঁধেছিল। ট্রেনেই আলাপ। তিনজনেই নানারকম জিনিষ নিয়ে গেছিল বিক্রির উদ্দেশ্যে। সঙ্গের দুজন বলেছিল একটা একটা ঘর নিয়ে থাকলে অনেক টাকা ভাড়া লাগবে কিন্তু একটা ঘর ভাড়া করে তিনজন থাকলে নামমাত্র টাকা খরচ হবে। মাত্র তিনটি দিন তো। দেখতে দেখতেই কেটে যাবে। সরল,সাদাসিডে অলোক তাদের কথায় রাজি হয়। ফেরার আগের রাতে
রাত্রে খেয়েদেয়ে যার যার ব্যবসা সম্পর্কে আলোচনায় প্রকাশ হয়ে পড়ে অলোকের সাত হাজার টাকা লাভ হয়েছে। বাকি দুজন বললো তারা প্রতি বছর আসে কিন্তু কোনদিন এত লাভের মুখ দেখেনি। পরদিন ভোর পাঁচটায় ট্রেন তাই সবাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো।
পরদিন যখন তার ঘুম ভাঙল তখন দুপুর হয়ে গেছে। মাথার উপর রোদ চড়চড় করছে। ট্রেন সাতঘন্টা আগেই ছেড়ে গেছে স্টেশন। আবার বিকেল পাঁচটায় আর একটা আসবে। মেলার কর্তারাই এসে তাকে
জাগালো। কিন্তু তখন অলোকের মাথা তোলার ক্ষমতা নেই। শরীর অবশ হয়ে গেছে।চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো তার নিজের ব্যাগ পত্রও নেই। কি মনে হতে কোমরের চোরা পকেট দেখতেই চমকে উঠলো সেখানে কোন টাকা পয়সা নেই। মেলা থেকে সস্তায় বউ ও ছেলের জন্য জামা-কাপড় কিনেছিল তাও বেপাত্তা।কর্তারা বুঝলো সঙ্গী দুজন তাকে সর্বশ্রান্ত করে পালিয়ে গেছে। আর এতক্ষণ ঘুমানোর কারণ রাতে যে কোল্ডড্রিংকস দিয়েছিল তাতে ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল। কর্তারাই তার গাড়ি ভাড়া দিয়ে বাড়ি পাঠিয়েছে।
কয়েকদিন লক্ষীর দেহ বিক্রির টাকায় সংসার কোন রকমে চললো। এরপর আবার সেই চরম দৈন-দারিদ্র এসে ওদের নিষ্পেষিত করতে লাগলো। আলোকের অসহায় অবস্থা আর চরম খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে লক্ষী ভাবলো নয়ন বৌদি ফিরলেই তাকে বলে কয়ে দুবাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ জোগাড় করে নেবে। দেড় হাজার করে দিলে তিনহাজারের সংস্থান তো হবে।
দুবাড়ির টিফিন নিজে না খেয়ে বাড়ি এনে সে, স্বামী-সন্তান তিনজনে তো ভাগ করে খেতে পারবে। কথাটা অলোককে বলতে সে অবাক দৃষ্টি মেলে কিছুক্ষণ লক্ষীর দিকে অসহায়ের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিতে থাকলো। তারপর বলল – আমি ভীষণ অপদার্থ পুরুষ মানুষ নাগো। বিয়ে করেছি কিন্তু স্ত্রী-সন্তানকে খেতে দেবার মুরোদ নেই। আমি বেঁচে থাকাও যা,মরে যাওয়া ও একই ব্যাপার। লক্ষী তাড়াতাড়ি অলোকের মুখ চেপে ধরে হাতদিয়ে। বলে – খবদ্দার এমনপানা কথা আর কবা না।আমি শুনতি চাইনে। সংসারডা কি তুমার একার,দুজনি কাজ করলি আপত্তি কিসির ? অলোক আর থাকতে না পেরে লক্ষীকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে। লক্ষী বুঝতে পারে এই কান্না স্বামীর অক্ষমতার,অপারগতার। বাধা দেয়না । নীরবে তার পিঠে-মাথায় গভীর আবেগে,সোহাগে মাথায় হাত বোলাতে থাকে।একসময় সে স্নেহময়ী মায়ের আকার নেয়।
আজ তিনদিন ছেলেটার বেদম জ্বর। অলোক কোলে করে ছেলেকে সরকারি হাসপাতালের নিয়ে গেল। ফ্রির ডাক্তার যে প্রেসক্রিপশনটা হাতে ধারালো ওষুধ কিনতে গিয়ে আলোকের মাথায় হাত। অনেক টাকার ধাক্কা। তারপর অনেক গুলো টেস্ট করানোর কথা লিখেছেন।অলোককে ওষুধ শূন্যহাতে বাড়ি ফিরতে দেখে লক্ষী মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। ক্রোধের সীমা অতিক্রম করে যায়। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে বলে উঠলো- কেমন বাপ তুমি, অসুস্থ ছাবালডার ওষুধ কিনতি পারার মুরোদডাও নেই ? লজ্জা করে না , জন্ম দিতি পারো,কম্মো করতি পারোনা? আবার লকির বাড়ি কাজ করতিও দিবা না। তাহলি কি বেশ্যা খাতায় আমি নাম নিকাবো ?আর সেই টাকায় তুমি বসি,বসি খাবা আর আয়েশ করবা ? অলোক কখনো কল্পনাও করতে পারবে না লক্ষীর কথাগুলো কতটা বাস্তব,চরম সত্য। দুঃখে,অপমানে সারাশরীর থর-থর করে কেঁপে উঠলো আলোকের। সারাদিন লক্ষীর দেওয়া অন্ন মুখে তুলতে পারলো না। কেবলি মনে হতে লাগলো এর থেকে মরে যাওয়াও অনেক শান্তির। অনেক সম্মানের। যে পুরুষ তার সংসার চালাতে পারেনা।বউ-সন্তানের মুখে ভাত তুলে দিতে পারেনা এমন অক্ষম,অপদার্থের বাঁচার কোন অধিকারও থাকতে পারেনা।
পরের দিন ভোররাতে আলোক মাদারিকা খেল” দেখাবার জিনিষপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ল । তখনও সূর্য উঁকি দেয়নি, পশ্চিম আকাশে আবছা একটু চাঁদ ঝুলছে। পাখিরা কুলায় স্তব্দডানায় বিশ্রাম নিচ্ছে।
চারিদিকে চিৎকার ,হাততালিতে ফেটে পড়ছে। এইখেলাটা দেখাতে আলোক ওস্তাদ। শাল বলগার মাথায় দড়ির ফাঁসে নিজেকে ঝুলিয়ে আধ ঘন্টার উপর ঝুলতে পারে সে। তারপর এক সময়ে গলা থেকে ফাঁস খুলে হাসতে হাসতে নেমে আসে।
আজও সে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়লো। হাত,পা ছুঁড়ছে,
জিভ বেরিয়ে আসছে, দর্শক আনন্দে হাততালি দিচ্ছে,নিচের বস্তার উপর হরিলুটের বাতাসার মতো কয়েন ও টাকার নোট পড়ছে।
সবাই দেখছে কি অদ্ভুত নিপুনতায় সত্যিকারের গলায় ফাঁসের দড়িটা চেপে বসছে। চোখের মণি ঠিকরে বেড়িয়ে আসছে,পায়ের পাতা নিচের দিকে টান,টান। জিভটা ছয়ইঞ্চি বেড়িয়ে এসেছে,মলদ্বার দিয়ে মল বেরিয়ে প্যান্ট হলুদ হলো সেটা কারুর চোখে পড়েনি। একসময়ে দেহটা স্তব্ধ হয়ে গিয়ে হওয়ায় দুলতে ,দুলতে শেষ হলো মাদারিকা খেল। যেমনটা বহুদিন আগে দেখতো। অভূতপূর্ব, এও সম্ভব ?
সন্ধ্যাবেলায় পুলিশ এসে লক্ষীকে একটা টাকার পুটুলি আর আলোকের ” মাদারিক খেল ” দেখাবার উপকরণগুলো ধরিয়ে দিয়ে বললো। আলোক ফাঁসের খেলা দেখাতে গিয়ে মারা গেছে। কাল দুপুর বেলায় যেন মর্গ থেকে তার বডিটা নিয়ে আসে।