Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অর্থমনর্থম্‌ – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 3

অর্থমনর্থম্‌ – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

এমন সময় নীচে একটা গণ্ডগোল শোনা গেল; পরক্ষণেই আমাদের ঘরের দরজা সজোরে ঠেলিয়া একজন লোক উত্তেজিতভাবে বলিতে বলিতে ঢুকিল, ‘ফণী, দাদাকে অ্যারেস্ট করে এনেছে—’ আমাদের দেখিয়াই সে থামিয়া গেল।

ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনিই মাখনবাবু?’

মাখন ভয়ে কুঁচকাইয়া গিয়া ‘আমি—আমি কিছু জানি না।’ বলিয়া সবেগে ঘর ছাড়িয়া পলায়ন করিল।

নীচে নামিয়া দেখিলাম, বসিবার ঘরে হুলস্থুল কাণ্ড। বিধুবাবু ঘরে নাই, থানার ইনস্পেক্টর তাঁহার স্থান অধিকার করিয়াছেন। একটা পাগলের মত চেহারার হাতকড়া-পরা লোককে দু’জন কনস্টেবল ধরিয়া আছে আর সে হাউমাউ করিয়া বলিতেছে, ‘মামা খুন হয়েছেন? দোহাই মশাই, আমি কিছু জানি না—যে দিব্যি গালতে বলেন গালছি—আমি মাতাল দাঁতাল লোক—ডালিমের বাড়িতে রাত কাটিয়েছি—ডালিম সাক্ষী আছে—’

ইনস্পেক্টরবাবুটি সত্য সত্যই কাজের লোক,এতক্ষণ নিস্পৃহভাবে বসিয়াছিলেন, আমাদের দেখিয়া বলিলেন, ‘আসুন ব্যোমকেশবাবু, ইনিই মতিলাল—বিধুবাবুর আসামী। যদি কিছু জিজ্ঞাসা করতে চান, করতে পারেন।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘কোথায় একে গেপ্তার করা হল?’

যে সাব-ইনস্পেক্টরটি গ্রেপ্তার করিয়াছিল, সে বলিল, ‘হাড়কাটা গলির এক স্ত্রীলোকের বাড়িতে—’

মতিলাল আবার বলিতে আরম্ভ করিল, ‘ডালিমের বাড়িতে ঘুমুচ্ছিলুম—কোন্ শালা মিছে কথা বলে—’

ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া তাহাকে নিবারণ করিয়া বলিল, ‘আপনি তো ভোর না হতেই বাড়ি ফিরে আসেন, আজ ফেরেননি কেন?’

পাগলের মত আরক্ত চক্ষে চারিদিকে চাহিয়া মতিলাল বলিল, ‘কেন? আমি—আমি মদ খেয়েছিলুম—দু’বোতল হুইস্কি টেনেছিলুম—ঘুম ভাঙেনি—’

ব্যোমকেশ ইনস্পেক্টবাবুর দিকে চাহিয়া ঘাড় নাড়িল, তিনি বলিলেন,, ‘নিয়ে যাও—হাজতে রাখো—’

মতিলাল চীৎকার করিতে করিতে স্থানান্তরিত হইলে, ব্যোমকেশ বলিল, ‘বিধুবাবু কোথায়?’

‘তিনি মিনিট পনের হল বাড়ি গেছেন—আবার চারটের সময় আসবেন।’

‘আচ্ছা, তাহলে আমরাও উঠি, কাল সকাল আবার আসব। ভাল কথা, বাড়ির ঘরগুলো সব খানাতল্লাস হয়েছে?’

‘করালীবাবুর আর মতিলালের ঘর খানাতল্লাস হয়েছে, অন্য ঘরগুলো খানাতল্লাস করা বিধুবাবুর দরকার মনে করেননি।’

‘মতিলালের ঘর থেকে কিছু পাওয়া গেছে?’

‘কিছু না।’

‘উইলগুলো দেখা হল না, সেগুলো বোধহয় বিধুবাবু সীল করে রেখে গেছেন। থাক, কাল দেখলেই হবে। আচ্ছা,চললুম। ইতিমধ্যে যদি নতুন কিছু জানতে পারেন, খবর দেবেন।’

বাসায় ফিরিলাম। রাত্রে করালীবাবুর বাড়ির একটা নক্সা তৈয়ার করিয়া ব্যোমকেশ আমাকে দেখাইল, বলিল, ‘করালীবাবুর ঘরের নীচে মতিলালের ঘর; মাখনের ঘর তার পাশে। ফণীর ঘরের নীচে বৈঠকখানাঘর অর্থাৎ যেখানে পুলিস আড্ডা গেড়েছে। সত্যবতীর ঘরের নীচে রান্নাঘর, আর সুকুমারের ঘরের নীচের ঘরে চাকর বামুন শোয়।’

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এ প্ল্যান্ কি হবে?’

‘কিছু না।’ বলিয়া ব্যোমকেশ নক্সাটা মনোনিবেশ সহকারে দেখিতে লাগিল। আমি বলিলাম, ‘তোমার কি রকম মনে হচ্ছে? মতিলাল বোধহয় খুন করেনি—না?’

‘না—সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার।’

‘তবে কি?’

‘সেইটে বলাই শক্ত, মতিলালকে বাদ দিলে চারজন বাকী থেকে যায়—ফণী,মাখন,সুকুমার আর সত্যবতী। এদের মধ্যে যে কেউ খুন করতে পারে। সকলের স্বার্থ প্রায় সমান।’

আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম, ‘সত্যবতীও?’

‘নয় কেন?’

‘কিন্তু মেয়েমানুষ হয়ে—’

‘মেয়েমানুষ যাকে ভালবাসে, তার জন্যে করতে পারে না, এমন কাজ নেই।’

‘কিন্তু তার স্বার্থ কি? করালীবাবুর শেষ উইলে তার ভাই-ই তো সব পেয়েছে।’

‘বুঝলে না? যে লোক ঘণ্টায় ঘণ্টায় মত বদলায়, তাকে খুন করলে আর তার মত বদলাবার অবকাশ থাকে না।’

স্তম্ভিত হইয়া গেলাম। এদিক হইতে কথাটা ভাবিয়া দেখি নাই। বলিলাম, ‘তবে কি তোমার মনে হয়—সত্যবতীই—?’

‘আমি তা বলিনি। সুকুমার হতে পারে, সম্পূর্ণ বাইরের লোকও হতে পারে। কিন্তু সত্যবতী মেয়েটি সাধারণ মেয়ে নয়।’

খানিক্ষন চুজ করিয়া ভাবিতে লাগিলাম। গত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এত প্রকার খাপছাড়া ও পরস্পর-বিরোধী মালমশলা আমাদের হস্তগত হইয়াছিল যে, তাহার ভিতর হইতে সুসংলগ্ন একটা কিছু বাহির করা প্রায় অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছিল। ব্যাপারটা এতই জটিল যে, ভাবিতে গেলে আরও জট পাকাইয়া যায়।

শেষে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘মৃতদেহ দেখে তুমি কি বুঝলে?’

‘এই বুঝলাম যে,হত্যা করবার আগে হত্যাকারী করালীবাবুকে ক্লোরোফর্ম করেছিল।’

‘কি করে বুঝলে?’

‘তাঁর ঘাড়ে হত্যাকারী তিনবার ছুঁচ ফুটিয়েছিল। ক্লোরোর্ফম না করলে তিনি জেগে উঠতেন। তাঁর নাকে ছোট দাগ দেখেছিলে মনে আছে? সেগুলো ক্লোরোর্ফমের চিহ্ন।’

‘তিনবার ছুঁচ ফোটাবার মানে?’

‘মানে, প্রথম দু’বার মর্মস্থানটা খুঁজে পায়নি। কিন্তু সেটা তেমন জরুরী কথা নয়; জরুরী কথা হচ্ছে এই যে, ছুঁচটা বিঁধিয়ে রেখে গেল কেন? কাজ হয়ে গেলে বার করে নিয়ে চলে গেলেই তো আর কোনও প্রমাণ থাকত না।’

‘হয়তো তাড়াতাড়িতে ভুল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আর একটা কথা—রাত বারোটার সময় খু্ন হয়েছে, তুমি বুঝলে কি করে?’

‘ওটা আমার অনুমান। কিন্তু সত্যবতী যদি কখনও সত্যি কথা বলে,দেখবে, আমার অনুমানটা ঠিক। ডাক্তারের রিপোর্ট থেকেও জানা যাবে।’

কিছুক্ষণ উর্ধ্বমুখে বসিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘সুকুমারের টেবিলের ওপর একখানা বই রাখা ছিল—গ্রে’র অ্যানাটমি। সারা বইয়ের মধ্যে কেবল একটা পাতায় কয়েক লাইন লাল পেন্সিল দিয়ে দাগ দেওয়া ছিল।’

‘সে কয় লাইনের অর্থ?’

‘অর্থ—মেডালা এবং প্রথম কশেরুর যদি ছুঁচ বিঁধিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হবে।

আমি লাফাইয়া উঠিলাম—‘বল কি! তাহলে?’

‘কিন্তু আশ্চার্য! লাল পেন্সিলটা সুকুমারের টেবিলে দেখলুম না।’ বলিয়া হঠাৎ উঠিয়া গভীর চিন্তাক্রান্তমুখে ঘরময় পায়চারি করতি লাগিল। আমার মনের মধ্যে অনেকগুলো প্রশ্ন গজগজ করিতেছিল,কিন্তু ব্যোমকেশের চিন্তাসূত্র ছিন্ন করিতে ভরসা হইলা না। জানিতাম, এই সময় প্রশ্ন করিলেই সে খেঁকী হইয়া উঠে।

রাত্রে শয়ন করিয়া সে একটা প্রশ্ন করিল, ‘তুমি তো একজন সাহিত্যিক, বল দেখি thimble-এর বাঙরা কি?’

আমি আশ্চার্য হইয়া বলিলাম, ‘thimble? যা আঙুলে পরে দর্জিরা সেলাই করে?’

‘হ্যাঁ।’

আমি ভাবিতে ভাবিতে বলিলাম, ‘অঙ্গুলিত্রাণ হতে পারে—কিম্বা—সূচীবর্ম—’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওসব চালাকি চলবে না, খাঁটি বাঙালা প্রতিশব্দ বল।’

স্বীকার করিতে হইল, বাঙালা প্রতিশব্দ নাই, অন্তত আমার জানা নাই। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তুমি জানো?’

‘উঁহু। জানলে আর জিজ্ঞাসা করব কেন?’

ব্যোমকেশ আর কথা কহিল না। আমিও বাঙলা ভাষার অশেষ দৈন্যের কথা চিন্তা করিতে করিতে কখন ঘুমাইয়া পড়িলাম।

পরদিন সকালে উঠিয়া দেখি, ব্যোমকেশ বাহির হইয়া গিয়াছে। একটু রাগ হইল; কিন্তু বুঝিলাম, আমাকে না লইয়া যাওয়ার কোনও মতলব আছে—হয়তো আমি গেলে অসুবিধা হইত।

যখন ফিরিল, তখন বেলা প্রায় এগারোটা; জামা খুলিয়া পাখাটা চালাইয়া দিয়া সিগারেট ধরাইল। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কি হল?’

সে একপেট ধোঁয়া টানিয়া আস্তে আস্তে ছাড়িতে ছাড়িতে বলিল, ‘উইলগুলো দেখা গেল। উইলের সাক্ষী বাড়ির বামুন আর চাকর—তাদের টিপসই রয়েছে।

‘আর?’

‘বাড়ির অন্য ঘরগুলো ভাল করে খানাতল্লাস করতে বললুম। কিন্তু বিধুবাবু গোঁ ধরেছেন, আমি যা বলব, তার উল্টো কাজটি করবেন। শেষ পর্যন্ত ভয় দেখিয়ে এলুম, যদি খানাতল্লাস না করেন, কমিশনার সাহেবকে নালিশ করব।’

‘তারপর?’

‘তারপর আর কি! তিনি এখনও মতিলালকে কামড়ে পড়ে আছেন।’ কিয়ৎকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, ‘মেয়েটা ভয়ানক শক্ত, এমন মুখ টিপে রইল, কিছুতেই মুখ খুললে না! অথচ এ রহস্যের চাবিকাঠি তার কাছে। যা হোক, দেখা যাক, বিধুবাবু যদি শেষ পর্যন্ত খানাতল্লাস করা মনস্থ করেন হয়তো কিছু পাওয়া যেতে পারে।’

‘কি পাওয়া যাবে, প্রত্যাশা কর?’

‘কে বলতে পারে? সামান্য জিনিস, হয়তো একটা ডাক্তারি দোকানের ক্যাশমেমো কিম্বা একটা পেন্সিল, কিম্বা—কিন্তু বৃথা গবেষণা করে লাভ নেই। চল, নাইবার বেলা হল।’

দুপুরবেলাটা ব্যোমকেশ আরাম-কেদারায় চোখ ‍বুজিয়া শুইয়া কাটাইয়া দিল; মনে হইল, সে যেন প্রতীক্ষা করিতেছে। তিনটা বাজিতেই পুঁটিরামচা দিয়া গেল, নিঃশব্দে পান করিয়া ব্যোমকেশ পূর্ববৎ পড়িয়া রহিল।

সাড়ে চারটা বাজিবার পর পাশের ঘরে টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। ব্যোমকেশ দ্রুত উঠিয়া গিয়া ফোন ধরিল, ‘কে আপনি?… ও ইনস্পেক্টরবাবু, কি খবর? …সুকুমারবাবুর ঘর সার্চ হয়েছে! বেশ বেশ, বিধুবাবু তাহলে শেষ পর্যন্ত…তাঁর ঘরে কি পাওয়া গেল?…অ্যাঁ, সুকুমারবাবুকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। তারপর—কিছু পাওয়া গেল? ক্লোরোফর্মের শিশি—আলমারিতে বইয়ের পেছনে ছিল—আর? উইল! আর একখানা টাইপ—করা উইল? বলেন কি? কোন্ তারিখের?…যে রাত্রে করালীবাবু মারা যান, সেইদিন তৈরি—হুঁ। কোথায় ছিল? বাকা্র তলায়! এ উইলে ওয়ারিস কে?…ফণীবাবু!

‘হ্যাঁ—ঠিক বলেছেন, পর্যায়ক্রমে এবার তারই পালা ছিল বটে। …সুকুমারবাবুর বোনকে কি গ্রেপ্তার করা হয়েছে? …না…ও বুঝেছি…ঘরে আর কিছু পাওয়া যায়নি? এই ধরুন—একটা লাল পেণ্সিল? পাননি? আশ্চার্য! সেলাইয়ের কোনও উপকরণ পাননি? তাই তো! বিধুবাবু আছেন?… মতিলালকে খালাস করতে গেছেন…তবু ভাল, বিধুবাবুর সুমতি হয়েছে। সুকুমারবাবুর ঘর ছাড়া আর কোন্ কোন্ ঘর সার্চ হয়েছে? আর হয়নি! কি বললেন, বিধুবাবু দরকার মনে করেননি! বিধুবাবু তো কিছুই দরকার মনে করেন না। আমার আজ যাবার দরকার আছে কি? নুতন উইলখানা দেখতুম…ও নিয়ে গেছেন…আচ্ছা—কাল সকালেই হবে। লাল পেণ্সিল আর ঐ সেলাইয়ের উপকরণটা যতক্ষণ না পাওয়া যাচ্ছে—ততক্ষণ—কি বলছেন? সুকুমারের বিরুদ্ধে overwhelming প্রমাণ পাওয়া গেছে? তা বলতে পারেন—কিন্তু ডাক্তারের রিপোর্ট পাওয়া গেছে? মৃত্যুর সময় সণ্বন্ধে কি লিখেছেন? আহারের তিন ঘন্টা পরে…তার মানে আন্দাজ রাত বারোটা…আচ্ছা,কাল সকালে নিশ্চয় যাব।’

ফোন রাখিয়া ব্যোমকেশ ফিরিয়া আসিয়া বসিল। তাহার চিন্তা-কুঞ্চিত ভ্রু ও মূখ দেখিয়া মনে হইল, সে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হইতে পারে নাই। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সুকুমারই তাহলে? তুমি তো গোড়া থেকেই সন্দেহ করেছিলে—না?’

কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘এ ব্যাপারে যত কিছু প্রমাণ, সবই সুকুমারের দিকে নির্দেশ করছে। দেখ, করালীবাবুর মৃত্যুর ধরনটা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, এ ডাক্তারের কাজ। যারা ডাক্তারি কিছু জানে না, তারা ওভাবে খুন করতে পারে না। যে ছুঁচটা ব্যবহার করা হয়েছে, তাও তার বোনের সেলায়ের বাক্স থেকে চুরি করা, এমন কি, সুতোটা পর্যন্ত এক। সুকুমার বারোটার সময় বাড়ি ফিরল—ঠিক সেই সময় করালীবাবুও মারা গেলেন। সুকুমারের ঘর সার্চ করে বেরিয়েছে ক্লোরোফর্মের শিশি, আর একটা টাইপ-করা উইল—করালীবাবুর শেষ উইল, যাতে তিনি সুকুমারকে বঞ্চিত করে ফণীকে সর্বস্ব দিয়ে গেছেন। সুকুমার নিজের মুখেই স্বীকার করেছে যে, সেদিন সন্ধ্যাবেলা করালীবাবুর সঙ্গে তার ঝগড়া হয়েছিল—সুতরাং তিনি যে আবার উইল বদলাবেন, তা সে বেশ বুঝতে পেরেছিল। খুন করার মোটিভ্ পর্যন্ত পরিষ্কার পাওয়া যাচ্ছে।’

‘তাহলে সুকুমারই যে আসামী, তাতে আর সন্দেহ নেই?’

‘সন্দেহের অবকাশ কোথায়?’ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘আচ্ছা, সুকুমারকে দেখে তোমার কি রকম মনে হল? খুব নির্বোধ বলে মনে হল কি?’

আমি বলিলাম,‘না। বরঞ্চ বেশ বুদ্ধি আছে বলেই মনে হল।’

ব্যোমকেশ ভাবিতে ভাবিতে বলিল, ‘সেইখানেই ধোঁকা লাগছে। বুদ্ধিমান বোকার মত কাজ করে কেন?’

বলিয়াই ব্যোমকেশ সচকিতভাবে সোজা হইয়া বসিল। দ্বারের কাছে অস্পষ্ট পদধ্বনি আমিও শুনিতে পাইয়াছিলাম, ব্যোমকেশ গলা চড়াইয়া ডাকিল, ‘কে? ভিতরে আসুন।’

কিছুক্ষণ কোন সাড়া পাওয়া গেল না, তারপর আস্তে আস্তে দ্বার খুলিয়া গেল। তখন ঘোর বিস্ময়ে দেখিলাম, সস্মুখে দাড়াঁইয়া আছে—সত্যবতী!

সত্যবতী ঘরে প্রবেশ করিয়া দ্বার ভেজাইয়া দিল; কিছুকাল শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর হঠাৎ ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিয়া রুদ্ধস্বরে বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু, আমার দাদাকে বাঁচান।’

অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে আমি একেবারে ভ্যাবাচাকা খাইয়া গিয়াছিলাম। ব্যোমকেশ কিন্তু তড়াক করিয়া সত্যবতীর সম্মুখে দাঁড়াইল। সত্যবতীর মাথাটা ঘুরিয়া গিয়াছিল, সে অন্ধভাবে একটা হাত বাড়াইয়া দিতেই ব্যোমকেশ হাত ধরিয়া তাহাকে একখানা চেয়ারে আনিয়া বসইয়া দিল। আমাকে ইঙ্গিত করিতেই পাখাটা চালাইয়া দিলাম।

প্রথম মিনিট দুই-তিন সত্যবতী চোখে আঁচল দিয়া খুব খানিকটা কাঁদিল, আমার নির্বাক লজ্জিত মুখে অন্য দিকে চোখ ফিরাইয়া রহিলাম। আমাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনেও এমন ব্যাপার পূর্বে কখনও ঘটে নাই।

সত্যবতীকে পূর্বে আমি একবারই দেখিয়াছিলাম; সাধারণ শিক্ষত বাঙ্গালী মেয়ে হইতে সে যে আকারে-প্রকারে একটুও পৃথক, তাহা মনে হয় নাই। সুতরাং ঘোর বিপদের সময় সমস্ত শঙ্কাসঙ্কোচ লঙ্ঘন করিয়া সে যে আমাদের কাছে উপস্থিত হইতে পারে, ইহা যেমন অচিন্তনীয়, তেমনই বিস্ময়কর। বিপদ উপস্থিত হইলে অধিকাংশ বাঙালীর মেয়েই জড়বস্তু হইয়া পড়ে। তাই এই কৃশাঙ্গী কালো মেয়েটি আমার চক্ষে যেন সহসা একটা অপূর্ব অসামান্যতা লইয়া দেখা দিল। তাহার পায়ের মলিন জরির নাগরা হইতে রুক্ষ অযত্নসম্বৃত চুল পর্যন্ত যেন অনন্যসাধারণ বিশিষ্টতার ভরপুর হইয়া উঠিল।

ভাল করিয়া চোখ মুছিয়া সে যখন মুখ তুলিয়া আবার বলিল, ‘ব্যোমকেশবাবু, আমার দাদাকে আপনি বাঁচান,’ তখন দেখিলাম, সে প্রাণপণে আত্মসম্বরণ করিয়াছে বটে, কিন্তু তাহার গলার স্বর তখনও কাঁপিতেছে।

ব্যোমকেশ আস্তে আস্তে বলিল,‘আপনার দাদা অ্যারেস্ট হয়েছেন, আমি শুনেছি—কিন্তু—’

সত্যবতী ব্যাকুলভাবে বলিয়া উঠিল, ‘দাদা নির্দোষ, তিনি কিছু জানেন না—বিনা অপরাধে তাঁকে—’ বলিতে বলিতে আবার সে কাঁদিয়া ফেলিল।

ব্যোমকেশ ভিতরে ভিতরে বিচলিত হইয়াছে বুঝিলাম, কিন্তু সে শান্তভাবেই বলিল, ‘কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে যে সব প্রমাণ পাওয়া গেছে—’

সত্যবতী বলিল, ‘সে সব মিথ্যে প্রমাণ। দাদা কখনও টাকার লোভে কাউকে খুন করতে পারেন না। আপনি জানেন না—তাঁর মতন লোক; ব্যোমকেশবাবু, আমার মেসোমশায়ের টাকা চাই না, আপনি শুধু দাদাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করুন, আমার আপনার পায়ে কেনা হয়ে থাকব।’ তাহার দুই চোখ দিয়া ধারার মত অশ্রু ঝরিয়া পড়িতে লাগিল, কিন্তু সে আর তাহা মুছিবার চেষ্টা করিল না—বোধ করি, জানিতেই পারিল না। ব্যোমকেশ এবার যখন কথা কহিল, তখন তাহার কণ্ঠস্বরে একটা অশ্রুতপূর্ব গাঢ়তা লক্ষ্য করিলাম, সে বলিল, ‘আপানার দাদা যদি সত্যই নির্দোষ হন, আমি প্রাণপণে তাঁকে বাঁচাবার চেষ্টা করব—কিন্তু—’

‘দাদা নির্দোষ, আপনি বিশ্বাস করছেন না? আমি আপনার পা ছুঁয়ে বলছি, দাদা এ কাজ করতে পারেন না—একটা মাছিকে মারাও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়—’ বলিতে বলিতে সে হঠাৎ নতজানু হইয়া ব্যোমকেশের পায়ের উপর হাত রাখিল।

‘ও কি করছেন? উঠে বসুন—উঠে বসুন?’ বলিয়া ব্যোমকেশ নিজেই চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া পা সরাইয়া লইল।

‘আপনি আগে বলুন, দাদাকে ছেড়ে দেবেন?’

ব্যোমকেশ দুই হাত ধরিয়া সত্যবতীকে জোর করিয়া তুলিয়া চেয়ারে বসাইয়া দিল, তারপর তাহার সম্মুখে বসিয়া দৃঢ় স্বরে বলিল,‘আপনি ভুল করছেন—সুকুমারবাবুকে ছেড়ে দেবার মালিক আমি নই—পুলিস। তবে আমি চেষ্টা করতে পারি। কিন্ত চেষ্টা করতে হলে সব কথা আমার জানা দরকার। বুঝেছেন না, আমার কাছ থেকে যতক্ষণ আপনি কথা গোপন করবেন, ততক্ষণ কোন সাহায্যই আমি করতে পারব না।’

চক্ষু নত করিয়া সত্যবতী বলিল, ‘আমি তো কোনও কথা গোপন করিনি।’

‘করছেন। আপনি সেই রাত্রেই করালীবাবুর ঘরে গিয়ে তাঁর মৃত্যুর কথা জানতে পেরেছিলেন, কিন্তু আমাকে বলেননি।’

ত্রাস-বিস্ফারিত নেত্রে সত্যবতী ব্যোমকেশের মুখের পানে তাকাইল, তারপর বুকে মুখ গুঁজিয়া নীরব হইয়া রহিল।

ব্যোমকেশ নরম সুরে বলিল, ‘এখন সব কথা বলবেন কি?’

কাতর চোখ দুটি তুলিয়া সত্যবতী বলিল, ‘কিন্তু সে কথা আমি কি করে বলব? তাতে দাদার ওপরেই সব দোষ গিয়ে পড়বে।’

অনুনয়ের কণ্ঠে ব্যোমকেশ বলিল, ‘দেখুন,আপনার দাদা যদি নির্দোষ হন, তাহলে সত্যি কথা বললে তাঁর কোনও অনিষ্ট হবে না, আপনি নির্ভয়ে সমস্ত খুলে বলুন, কোনো কথা গোপন করবেন না।’

সত্যবতী অনেকক্ষণ মুখ নীচু করিয়া ভাবিল, শেষে ভগ্ন স্বরে বলিল,‘আচ্ছা, বলছি। আমার যে আর উপায় নেই—’উদগত অশ্রু আঁচল দিয়া মুছিয়া নিজেকে ঈষৎ শান্ত করিয়া সে ধীরে ধীরে বলিতে আরম্ভ করিল—

‘সেদিন সন্ধ্যেবেলা মেসোমশায়ের সঙ্গে দাদার একটু বচসা হয়েছিল। মেসোমশাই দাদাকে সব সম্পত্তি উইল করে দিয়েছিলেন, তাই নিয়ে মতিদা’র সঙ্গে দুপুরবেলা তুমুল ঝগড়া হয়ে গিয়েছিল। কলেজ থেকে ফিরে তাই শুনে দাদা মেসোমশাইকে বলতে গিয়েছিলেন যে, তিনি সব সম্পত্তি চান না, সম্পত্তি যেন সকলকে সমান ভাগ করে দেওয়া হয়। মেসোমশাই কোনও রকম তর্ক সইতে পারতেন না, তিনি রেগে উঠে বললেন, ‘আমার কথার ওপর কথা! বেরোও এখান থেকে—তোমাকে এক পয়সা দেব না।’

‘মেসোমশাই যে এ কথায় রাগ করবেন, তা দাদা বুঝতে পারেননি; তিনি সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ফণীদা’র ঘরে গিয়ে বসলেন। ফণীদা খোঁড়া মানুষ, বাইরে বেরুতে পারেন না—তাই দাদা রোজ সন্ধ্যেবেলা তাঁর কাছে বসে খানিকক্ষণ গল্প করতেন। ফণীদা’কে আপনারা বোধহয় দেখেছেন? তিনি ইস্কুল-কলেজে পড়েননি বটে, কিন্তু বেশ ভাল লেখাপড়া জানেন।

তাঁর আলমারির বই দেখে বুঝতে পারবেন—কত রকম বিষয়ে তাঁর দখল আছে। অনেক সময় আমি তাঁর কাছে পড়া বলে নিয়েছি।

‘মেসোমশায়ের সঙ্গে বচসা হওয়াতে দাদার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল,তিনি রাত্রি আন্দাজ আটটার সময় আমাকে বললেন, ‘সত্য, আমি বায়স্কোপ দেখতে যাচ্ছি, সাড়ে এগারটার সময় ফিরব—সদর দরজা খুলে রাখিস।’ এই বলে খাওয়া-দাওয়া সেরে তিনি চুপি চুপি বেরিয়ে গেলেন।

‘আমাদের বামুনঠাকুর রাত্রির খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়ে যাবার পর বাইরে গিয়ে অনেক রাত্রি পর্যন্ত নিজের দেশের লোকের আড্ডায় গল্পগুজব করে, আমি জানতুম—তাই দাদাকে দোর খুলে দেবার জন্যে আমি আর জেগে রইলুম না। রাত্রি দশটার পর হাঁড়ি-হেঁসেল উঠে গেলে আমিও গিয়ে শুয়ে পড়লুম।

‘ঘুমিয়ে পড়েছিলুম—হঠাৎ এক সময় ঘুম ভেঙ্গে গেল। মনে হল, যেন দাদার ঘরে একটা শব্দ শুনতে পেলুম। মেঝের ওপর একটা ভারী জিনিস—টেবিল কি বাক্স সরালে যে রকম শব্দ হয়, সেই রকম শব্দ। ভাবলুম দাদা বায়স্কোপ দেখে ফিরে এলেন।

‘আবার ঘুমবার চেষ্টা করলুম; কিন্তু কি জানি ঘুম এল না—চোখ চেয়ই শুয়ে রইলুম। দাদার ঘরে থেকে আর কোনও সাড়া পেলুম না; মনে করলুম তিনি শুয়ে পড়েছেন।

‘এইভাবে মিনিট পনের কেটে যাবার পর—বারান্দায় একটা খুব মৃদু শব্দ শুনতে পেলুম, যেন কে পা টিপে টিপে যাচ্ছে। ভারী আশ্চার্য মনে হল; দাদা তো অনেকক্ষণ শুয়ে পড়েছেন, তবে কে বারান্দায় দিয়ে যাচ্ছে? আমি আস্তে আস্তে উঠলুম; দরজা একটু ফাঁক করে দেখলুম—দাদা নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। চাঁদের আলো বারান্দায় পড়েছিল, দাদাকে স্পষ্ট দেখতে পেলুম।’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘একটা কথা; আপনার দাদার পায়ে জুতা ছিল?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাঁর হাতে কিছু ছিল?’

‘না।’

‘কিছু না? একটা কাগজ কিম্বা শিশি?’

‘কিছু না।’

‘তখন ক’টা বেজেছিল; দেখেছিলেন কি?’

সত্যবতী বলিল, ‘দেখবার দরকার হয়নি, তখন শহরের সব ঘড়িতেই বারোটা বাজছিল।’

ব্যোমকেশের দৃষ্টি চাপা উত্তেজনায় প্রখর হইয়া উঠিল। সে বলিল, ‘তারপর বলে যান।’

সত্যবতী বলিল, ‘দেখার দরকার হয়নি, তখন শহরের সব ঘড়িতেই বারোটা বাজছিল।’

ব্যোমকেশের দৃষ্টি চাপা উত্তেজনায় প্রখর হইয়া উঠিল। সে বলিল, ‘তারপর বলে যান।’

সত্যবতী বলিতে লাগিল,‘প্রথমটা আমি ‍কিছু বুঝতে পারলুম না। দাদা পনের মিনিট আগে ফিরে এসেছেন—তাঁর ঘরে আওয়াজ শুনে জানতে পেরেছি—তবে আবার তিনি কোথায় গিয়েছিলেন? হঠ্যাৎ মনে হলো হয়তো মেসোমশায়ের শরীর খারাপ হয়েছে, তাঁর ঘরেই গিয়েছিলেন। মেসোমশাই কখনও কখনও রাত্রিবেলা বাতের বেদনায় কষ্ট পেতেন—ঘুম হত না। তখন তাঁকে ওষুঝ খাইয়ে ঘুম পাড়াতে হত। আমি চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে মেসোমশাইয়ের ঘরের দিকে গেলুম।

‘তাঁর ঘরের দোর রাত্রে বরাবরই খোলা থাকে—আমি ঘরে ঢুকলুম। ঘর অন্ধকার—কিন্তু সেই অন্ধকারের মধ্যেও কি রকম একটা গন্ধ নাকে এল। গন্ধটা যে ঠিক কি রকম তা আমি আপনাকে বোঝাতে পারব না—তীব্র নয়, অথচ—’

‘মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ?’

‘হ্যাঁ—ঠিক বলেছেন, মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ।’

‘হুঁ—ক্লোরোফর্ম। তারপর!’

‘দোরের পাশেই সুইচ। আলো জ্বেলে দেখলুম, মেসোমশাই খাটে শুয়ে আছেন—ঠিক যেন ঘুমাচ্ছেন। তাঁর শোবার ভঙ্গী দেখে একবারও মনে হয় না যে তিনি—, কিন্তু তবু কি জানি কেন আমার বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করতে লাগল। সেই গন্ধটা যেন একটা ভিজে ন্যাকড়ার মতন আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করবার উপক্রম করলে।

‘কিছুক্ষণ আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলুম। মনকে বোঝাবার চেষ্টা করলুম যে, ওটা ওষুধের গন্ধ, মেসোমশাই ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন।

‘পা কাঁপছিল, তবু সন্তর্পণে তাঁর খাটের পাশে দাঁড়ালুম। ঝুঁকে দেখলুম—তাঁর নিশ্বাস পড়ছে না। তখন আমার বুকের মধ্যে যে কি হচ্ছে, তা আমি বোঝাতে পারব না—মনে হচ্ছে এইবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। বোধহয় মাথাটা ঘুরেও উঠেছিল; নিজেকে সামলাবার জন্যে আমি মেসোমশায়ের বালিশের ওপর হাত রাখলুম। হাতটা ঠিক তাঁর ঘাড়ের পাশেই পড়েছিল—একটা কাটার মত কি জিনিস হাতে ফুটল। দেখলুম,একটা ছুঁচ তাঁর ঘাড়ে আমূল বেঁধানো—ছুঁচে তখনও সুতো পরানো রয়েছে।

‘আমি আর সেখানে থাকতে পারলুম না। কিন্তু কি করে যে আলো নিবিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলুম, তাও জানি না। যখন ভাল করে চেতনা ফিরে এল, তখন নিজের বিছানায় বসে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছি আর কাঁদছি।

‘তারপর তো সবই আপনি জানেন। দাদাকে আমি সন্দেহ করিনি, আমি জানি, দাদা এ কাজ করতে পারেন না, তবু একথা যে কাউকে বলা চলবে না, তাও বুঝতে দেরি হল না। পরদিন সকালবেলা কোনোরকমে চা তৈরি করে নিয়ে মেসোমশায়ের ঘরে গেলুম—’

সত্যবতীর স্বর ক্ষীণ হইয়া মিলাইয়া গেল। তাহার মুখের অস্বাভাবিক পাণ্ডুরতা, চোখের আতঙ্কিত দৃষ্টি হইতে বুঝিতে পারিলাম, কি অসীম সংশয় ও যন্ত্রণার ভিতর দিয়া সেই ভয়ঙ্কর রাত্রিটা তাহার কাটিয়াছিল। ব্যোমকেশের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, তাহার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিতেছে। সে হঠাৎ বলিয়া উঠিল, ‘আপনার মত অসাধারণ মেয়ে আমি দেখিনি। অন্য কেউ হলে চেঁচামেচি করে মূর্ছা—হিস্টিরিয়ার ঠেলায় বাড়ি মাথায় করত—আপনি—’

সত্যবতী ভাঙ্গা গলায় বলিল,‘শুধু দাদার জন্যে—’

ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘আপনি এখন তাহলে বাড়ি ফিরে যান। কাল সকালে আমি আপনাদের ওখানে যাব।’

সত্যবতীও উঠিয়া দাঁড়াইল, শঙ্কিত কণ্ঠে বলিল, ‘কিন্তু আপনি তো কিছু বললেন না?’

ব্যোমকেশ কহিল, ‘বলবার কিছু নেই। আপনাকে আশা দিয়ে শেষে যদি কিছু না করতে পারি? এর মধ্যে বিধুবাবু নামক একটি আস্ত—ইয়ে আছেন কিনা, তাই একটু ভয়। যা হোক, এইটুকু বলতে পারি যে, আপনি যে সব কথা বললেন, তা যদি প্রথমেই বলতেন, তাহলে হয়তো কোনও গোলমাল হত না।’

অশ্রুপূর্ণ চোখে সত্যবতী বলিল, ‘আমি যা বললুম তাতে দাদার কোনও অনিষ্ট হবে না? সত্যি বলছেন? ব্যোমকেশবাবু, আমার আর কেউ নেই—’ তাহার স্বর কান্নায় বুজিয়া গেল।

ব্যোমকেশ তাড়াতাড়ি গিয়া সদর দরজাটা খুলিয়া দাঁড়াইল, একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, ‘আপনি আর দেরি করবেন না—রাত হয়ে গেছে। আমাদের এটা ব্যাচেলর এস্টাব্ বলিশমেন্ট—বুঝলেন না—’

সত্যবতী একটু ব্যস্তভাবে বাহির হইয়া যাইবার উপক্রম করিল। সে চৌকাঠ পার হইয়াছে, এমন সময় ব্যোমকেশ মৃদুস্বরে তাহাকে কি বলিল শুনিতে পাইলাম না। সত্যবতী চমকিয়া ফিরিয়া চাহিল। ক্ষণকালের জন্যে তাহার কৃতজ্ঞতা-নিষিক্ত মিনতিপূর্ণ চোখ দুটি আমি দেখিতে পাইলাম—তারপর সে নিঃশব্দে ছোট্ট একটি নমস্কার করিয়া দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া গেল।

দরজা ভেজাইয়া দিয়া ব্যোমকেশ ফিরিয়া আসিয়া বসিল, ঘড়ি দেখিয়া বলিল,‘সাতটা বেজে গেছে।’ তারপর মনে মনে কি হিসাব করিয়া চেয়ারে হেলান দিয়া বলিল, ‘এখনও ঢের সময় আছে।’

আমি সাগ্রহে তাহাকে চাপিয়া ধরিলাম, ‘ব্যোমকেশ, কি বুঝলে? আমি তো এমন কিছু—কিন্তু তোমার ভাব দেখে বোধ হয়, যেন তুমি ভেতরের কথা বুঝতে পেরেছ।’

ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল—‘এখনও সব বুঝিনি।’

আমি বলিলাম, ‘যাই বল, সুকুমারের বিরুদ্ধে প্রমাণ যতই গুরুতর হোক, আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে খুন করেনি।’

ব্যোমকেশ হাসিল—‘তবে কে করেছে?’

‘তা জানি না—কিন্তু সুকুমার নয়।’

ব্যোমকেশ আর কিছু বলিল না, সিগারেট ধরাইয়া নীরবে টানিতে লাগিল। বুঝিলাম, এখন কিছু বলিবে না। আমিও বসিয়া এই ব্যাপারে অদ্ভুত জটিলতার কথা ভাবিতে লাগিলাম।

অনেক্ষণ পরে ব্যোমকেশ একটা প্রশ্ন করিল, ‘সত্যবতীকে সুন্দরী বলা বোধ হয় চলে না—না?’

আমি চমকিয়া উঠিয়া বলিলাম, ‘কেন বল দেখি?’

‘না, অমনি জিজ্ঞাসা করছি। সাধারণে বোধহয় কালোই বলবে।’

বর্তমান সমস্যার সঙ্গে সত্যবতীর চেহারার কি সম্বন্ধ আছে, বুঝিলাম না; কিন্তু ব্যোমকেশের মন কোন্ দুর্গম পথে চলিয়াছে, তাহা অনুমান করা অসম্ভব। আমি বিবেচনা করিয়া বলিলাম, ‘হ্যাঁ, লোকে তাকে কালোই বলবে, কিন্তু কুৎসিত বোধহয় বলতে পারবে না।’

ব্যোমকেশ একটু হাসিয়া উঠিয়া পড়িল, বলিল, ‘অর্থাৎ তুমি বলতে চাও—‘কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ।’—কেমন?—ভাল কথা, অঞ্জিত, তোমার বয়স কত হল বল দেখি?’

সবিস্ময়ে বলিলাম, ‘আমার বয়স—’

‘হ্যাঁ—কত বছর ক’মাস ক’দিন, ঠিক হিসেব করে বল।’

কে জানে—হয়তো আমার বয়সের হিসাবের মধ্যেই করালীবাবুর মৃত্যু-রহস্যটা চাপা পড়িয়া আছে। ব্যোমকেশের অসাধ্য কার্য নাই; আমি মনে মনে গণনা করিয়া বলিলাম, ‘আমার বয়স হল ঊনত্রিশ বছর পাঁচ মাস এগারো দিন।–কেন?’

ব্যোমকেশ একটা ভারী সস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘যাক তুমি আমার চেয়ে তিন মাসের বড়। বাঁচা গেল। কথাটা কিন্তু মনে রেখো।’

‘মানে?’

‘মানে কিছুই নেই। কিন্তু ও কথা থাক। এই ব্যাপার নিয়ে ভেবে ভেবে মাথা গরম হয়ে উঠেছে। চল, আজ নাইট-শো’তে বায়স্কোপ দেখে আসি।’

ব্যোমকেশ কখনও বায়স্কোপে যায় না, বায়স্কোপ থিয়েটার সে ভালই বাসে না। তাই বিস্ময়ের অবধি রহিল না। বলিলাম, ‘তোমার আজ হল কি বল দেখি? একেবারে খেপচুরিয়াস্ মেরে গেলে না কি?’

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘অসম্ভব নয়। আমি লগনচাঁদা ছেলে—ভট্টাচায্যিমশাই কুণ্ঠী তৈয়ার করেই বলেছিলেন, এ ছেলে ঘোর উষ্মাদ হবে। কিন্তু আর দেরি নয়। চল, খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়া যাক। ‘চিত্রা’য় ক’দিন থেকে একটা ভাল ফিল্ম দেখাচ্ছে।’

আহারাদি করিয়া বায়স্কোপে উপস্থিত হইলাম। রাত্রি সাড়ে নয়টার চিত্র-প্রদর্শন আরম্ভ হইল। ছবিটা কিছু দীর্ঘ—শেষ হইতে প্রায় পৌনে বারোটা বাজিল।

অনেক দূর যাইতে হইবে—বাসও দু’একখানা ছিল; আমি একটাতে উঠিবার উপক্রম করিতেছি, ব্যোমকেশ বলিল, ‘না না হেঁটেই চল না খানিকদূর।’ বলিয়া হনহন করিয়া চলিতে আরাম্ভ করিল।

কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট ছাড়িয়া সে যখন পাশের একটা সরু রাস্তা ধরিল, তখন বুঝিলাম সে করালীবাবুর বাড়ির দিকে চলিয়াছে। এত রাত্রে সেখানে কি প্রয়োজন, তাহা হৃদয়জম হইল না। যাহা হউক, বিনা আপত্তিতে তাহার সঙ্গে চলিলাম।

স্বাভাবিক অপেক্ষা কিছু বেশি দ্রুতপদেই আমরা চলিতেছিলাম, তবু করালীবাবুর বাড়ি পৌঁছিতে অনেকটা সময় লাগিল। করালীবাবুর দরজার পাশেই একটা গ্যাস-পোস্ট ছিল, তাহার নীচে দাঁড়াইয়া ব্যোমকেশ হাতের আস্তিন সরাইয়া ঘড়ি দেখিল। কিন্তু ঘড়ি দেখিবার প্রয়োজন ছিল না, ঠিক এই সময় অনেকগুলো ঘড়ি চারিদিক হইতে মধ্যরাত্রি ঘোষণা করিয়া দিল।

ব্যোমকেশ উৎফুল্লভাবে আমার পিঠে একটা চাপড় মারিয়া বলিল, ‘হয়েছে। চল, এবার একটা ট্যাক্সি ধরা যাক।’

Pages: 1 2 3 4 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress