ঢাকা ক্লাবে
রাত নটার কিছু পরে ফয়েজুর রহমান ঢাকা ক্লাবে এলেন। তার মিনিট দশেক আগে অর্জুন ফিরেছে। তাকে রিসেপশনে পৌঁছে দিয়ে জোনাকি গাড়ি নিয়ে তার বাড়ি চলে গিয়েছে। তখনই ফয়েজুর রহমান জানিয়েছিলেন তিনি ঢাকা ক্লাবে দেখা করতে এসেছেন।
বেশ বড় ঘর। সুন্দর বিছানা, ব্যালকনিও আছে। বাথরুমটি চমৎকার। ফয়েজুর রহমান ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞাসা করলেন, ফিরে এসে ফ্রেশ হয়েছেন তো?
হ্যাঁ। বসুন।
ফয়েজুর রহমান চেয়ারে বসে বললেন, আমার খুব খারাপ লাগছে। আজ যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যেত তা হলে–। কী ভয়ংকর!
দুর্ঘটনা তো ঘটেছে। আপনার গাড়ির অবস্থা খুব খারাপ।
আহা, আমি আপনার কথা ভেবে বলছি। আপনি আমার অনুরোধে এই দেশে এসেছেন। ঠিক কী ঘটেছিল আর একবার বলুন তো!
অর্জুন বলল। ফয়েজুর রহমান মাথা নাড়লেন, আপনাকে আমি নিষেধ করেছিলাম। আজ না যেতে বলেছিলাম। দিনের বেলায় তেমন কিছু ঘটে না, সন্ধের অন্ধকার নামলে কী হবে কেউ বলতে পারে না। তবে এতদিন যা হত তা বাড়ির কম্পাউন্ডের মধ্যেই হত। চায়ের দোকানটা বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে। ওখানে কেন ঘটল তা বুঝতে পারছি না।
অর্জুন বলল, আপনি বলতে চাইছেন যে আজ দুর্ঘটনা ঘটাবার চেষ্টা করেছে সে-ই এতকাল বাড়ির ভেতরে রহস্যজনক কাজকর্ম করত?
রহস্যজনক বললে কম বলা হবে। ফয়েজুর রহমান ঘড়ি দেখলেন।
অর্জুন সোজা হয়ে বসল, এবার আমাকে সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলুন। আপনার বাড়ি বাইরে থেকে দেখে এসেছি। বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাই ভাল। শুনলাম আপনি ওখানে রাত্রিবাস করেন না। দিনের আলোয় যান এবং ফিরে আসেন। তাও মাঝে মাঝে। সন্ধে হয়ে গেলেও ওই বাড়ির কোথাও আলো জ্বলতে দেখলাম না। অথচ ওই বাড়িতে আপনার পূর্বপুরুষরা থাকতেন, নিশ্চয়ই আপনার বাল্যকাল ওখানে কেটেছে। এমন কী ওখানে ঘটেছে যে আপনি ওখানকার বাস তুলে দিয়েছেন!
একটু ভাবলেন ফয়েজুর রহমান। তারপর বললেন, আমার ঠাকুরদারা ছিলেন দুই ভাই। তখন বিশাল জমিদারি ছিল। বড়ভাই হলেন আমার বাবার বাবা। ছোটভাই বিয়ের একবছর পরে মেঘনায় সাঁতার কাটতে গিয়ে ডুবে যান। তার শরীর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তখন তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা ছিলেন। সেই সন্তানকে আমার ঠাকুরদা নিজের ছেলের মতো মানুষ করেন। আমার বাবাকে জমিদারি দেখার জন্যে নিজের কাছে রেখে ভাইয়ের ছেলেকে কলকাতায় পাঠান পড়াশোনার জন্যে। কিন্তু সেখানে তিনি অসৎ সংসর্গে পড়েন। সবসময় তার টাকার দরকার হত। মৃত ভাইয়ের ছেলে বলে তার দাবি মেনে নিতেন ঠাকুরদা। কিন্তু ছুটি হলেও তিনি বাড়িতে আসতেন না। তেইশ বছর বয়সে তিনি একজন মহিলাকে নিয়ে ফিরে এসে জানালেন, বিয়ে করেছেন। ওই মহিলা তার স্ত্রী। ঠাকুরদা প্রথমবার প্রতিবাদ করলেন। বাড়ি থেকে চলে যেতে বললেন। কিন্তু তারা থেকে গেলেন। ওঁদের একটি ছেলে হল। বাড়ির কারও সঙ্গে তারা মিশতেন না। কিন্তু মাঝে মাঝেই অদ্ভুত সব লোক তাদের কাছে আসত। তাদের মধ্যে কয়েকজন তান্ত্রিকও ছিল। আমরা। মুসলমান। তন্ত্রমন্ত্রে যারা বিশ্বাস করে তাদের সঙ্গে আমাদের মেলে না। কিন্তু ঠাকুরদা ওদের বাড়ি থেকে জোর করে বের করে দিতেও পারছিলেন না। এই সময় দুর্ঘটনাটা ঘটল। ঢাকা থেকে গাড়ি চালিয়ে ফিরছিলেন সেই কাকা। সঙ্গে তার স্ত্রী ও ছেলে। সোনার গাঁ পেরিয়ে গিয়ে ওঁর গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে। পোস্টমর্টেম করে পুলিশ জানায় কাকা মদ খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে কাকার মৃত্যু হয়। কাকিমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, ছেলেটির তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি।
ফয়েজুর রহমান শ্বাস নিলেন। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ওই ছেলেটি আপনার ভাই?
হ্যাঁ। কিন্তু হাসপাতাল থেকে সে চুরি হয়ে যায়!
সেকী!
হাতে পায়ে কেটে গিয়েছিল বলে তাকে মায়ের সাথে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ডাক্তার ভাল করে পরীক্ষা করার জন্যে ভরতি করে নিয়েছিলেন। পরের দিন থেকে তাকে হাসপাতালে পাওয়া যায়নি। থানা-পুলিশ করা হয়। কাগজেও অনেক লেখালেখি হয়েছে সেই সময়। কে ওকে। চুরি করেছে তা রহস্য থেকে গেল। আমার তখন বছর আটেক বয়স। সেই ছেলে দুই বছরের ছোট। তারপর আমার ঠাকুরদা দেহ রাখলেন। আমার বাবা আর জমিদারি দেখতে সক্ষম না হওয়ায় সব বিক্রি করে দেওয়া হল। আমি ঢাকায় ব্যাবসা শুরু করলাম। বাবা থেকে গেলেন দেশের বাড়িতে। বছর দশেক আগে বাবাকে বাড়ির ছাদে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেল। তখন সবে সন্ধে হয়েছে। বিকেলে ছাদে পায়চারি করা তাঁর অভ্যাস ছিল। সন্ধের আগেই নেমে আসতেন। কিন্তু সেদিন কেন সন্ধের পরেও ছাদে ছিলেন তা জানি না। পুলিশ মৃত্যুর কারণ খুঁজে পায়নি। অজ্ঞাত কারণে মৃত্যু হয়েছিল বলে তারা পোস্টমর্টেম করিয়েছিল। কিন্তু তাতে বলা হয়েছে। শ্বাসরুদ্ধ হওয়ায় মারা গিয়েছিলেন বাবা।
বাবার মৃত্যুর ঠিক কুড়ি দিন পরেই ফোনটা এল। পরিচয় না দিয়ে আমাকে বলা হল ওই বাড়িতে যেন আমি না যাই, গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমার সন্দেহ হল, এই ফোন কে করতে পারে। ভাবতে ভাবতে সেই ছয় বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের কথা মনে এল। আমি ঢাকার এক গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়িত্ব দিলাম তাকে খুঁজে বের করতে। বহু বছর আগে সে যখন হাসপাতাল থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল তখন সেখানে যে সমস্ত পেশেন্ট ছিল তাদের রেকর্ড খুঁজে বের করা সম্ভব হল না। কিন্তু ওই হাসপাতালে তখন কাজ করত এমন একজন আয়ার খোঁজ পেলেন গোয়েন্দারা। সে এখন বেশ বৃদ্ধা। একাই থাকে। তাকে কিছু টাকা দিয়ে অনেক চেষ্টা করে কথা বের করলেন ওঁরা। ছেলেটির স্মৃতি দুর্ঘটনার কারণে লোপ পেয়ে গিয়েছিল। সবার নজর এড়িয়ে তাকে হাসপাতাল চত্বরে ঘোরাফেরা করতে দেখে ওই আয়ার পরিচিত একটি আয়া বাসায় নিয়ে যায় কারণ তার সন্তান ছিল না। তল্লাশি আরম্ভ হওয়ায় সেই আয়ার অনুরোধে এই আয়া মুখ খোলেনি। বৃদ্ধা তার ঠিকানা জানিয়ে দিলে গোয়েন্দারা সেখানে গিয়ে দেখে যেখানে বস্তি ছিল সেখানে এখন হাউজিং এস্টেট তৈরি হয়ে গেছে। সেই আয়া ক্ষতিপূরণের টাকা এবং ছেলেকে নিয়ে ইন্ডিয়ার অসমে চলে গিয়েছে।
মহিলা হঠাৎ ভারতে চলে গেলেন কেন তা জানা গেছে?
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল। ফয়েজুর রহমান বললেন, হ্যাঁ। যে বৃদ্ধা আয়া খবরটা দিয়েছিল সে বলেছে ওই আয়া হিন্দু ছিল। ইন্ডিয়ার গৌহাটির কাছে কামাখ্যা নামে একটা জায়গা আছে। যেখানকার মন্দির হিন্দুদের কাছে খুব বিখ্যাত। সেখানে ওই আয়ার বোন থাকত। তার কাছেই চলে গেছে ওরা।
আর খুঁজে পাননি? অর্জুন প্রশ্ন করল।
খোঁজ করেছিলাম। লোক পাঠিয়েছিলাম সেখানে। জায়গাটা বড় নয়। সেই আয়া এখনও বেঁচে আছে। তবে জরাগ্রস্ত। তাকে সবাই ভৈরবী মা বলে। ডাকে। লোকে বলেছে তার একমাত্র সন্তান ব্রহ্মপুত্র নদীতে নৌকাডুবিতে মারা যাওয়ার পরই সে তন্ত্রসাধনার পথ বেছে নিয়েছে। খবরটা শোনার পর, বলতে খারাপ লাগছে, আমার স্বস্তি হল। লক্ষ করলে দেখা যাবে, আমার এই কাকার ছেলে, তার বাবা এবং তার ঠাকুরদা, তিনজনের মৃত্যু হয়েছে অপঘাতে। আমার কাকা অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। নিয়মিত মদ্যপান করতেন, কাউকে সম্মান জানাতেন না। তার মৃত্যু হল গাড়ি দুর্ঘটনায়। এঁদের রক্ত ছিল ছেলেটির শরীরে। সে যে তার বাবার স্বভাব পেত না তা কে বলতে পারে। তাই স্বস্তি পেলাম কিন্তু নিশ্চিন্ত হলাম না। আমার বড়মেয়ের তখন বিয়ে হয়ে গিয়েছে। দুই মেয়ে, জামাই এবং স্ত্রীকে নিয়ে দেশের বাড়িতে গিয়ে কয়েকদিন থাকব ভেবেছিলাম। কিন্তু ওরা অভিযোগ করত সন্ধে হলেই কীরকম গা ছমছম করত। ছাদে ওঠার যে সিঁড়িটা দিনের বেলায় শক্তপোক্ত ছিল সেটাই মাঝরাতে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল।
আধ মিনিট অপেক্ষা করে অর্জুন বলল, এ তো ভৌতিক ব্যাপার!
না। ভৌতিক নয়। পরের দিন মিস্ত্রিদের ডেকে সিঁড়ি সারাতে বলেছিলাম। তারা বলল সিঁড়ির ওপরের ধাপের নীচের দিকের কয়েকটা ইট খুলে ফেলার জন্যেই ওটা ভেঙে পড়েছে। পরের দিন মেয়ে-জামাই সোনার গাঁ-তে গিয়েছিল লক্ষ্মণ সেনের গড় দেখতে। ফিরে আসার সময় বিকেল হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির সামনে এসে তাদের গাড়ির ব্রেক ফেল হয়ে গেল। আল্লার দয়ায় ওরা কোনওরকমে বেঁচে যায় যদিও গাড়িতে চোট লাগে। ওটা হতেই পারে। কিন্তু পরের দিন আমাদের ড্রাইভার জানায়, ব্রেক ঠিক আছে। কী করে সম্ভব হল? বাড়ির সবাই ভয় পেয়ে ঢাকায় ফিরে এল। আমি এখন মাঝে মাঝে লোকজন নিয়ে দিনের বেলায় যাই। কখনওই বিকেল তিনটের পরে থাকি না। ফয়েজুর বললেন।
তা হলে ওই বাড়িতে এখন কেউ থাকে না?
থাকে। তবে দিনের বেলায়। আমার বাবার আমলের কাজের লোক করিমচাচা ওই বাড়িতে দিনের বেলায় থাকে। সকালে আসে, বিকেলে চলে যায়। বয়স হয়েছে তাই একা যেটুকু পারে তাই করে। ওটা না করলে মাইনে পাবে না বলেই বোধহয় করে।
করিমচাচা থাকেন কোথায়?
নদীর কাছে গিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে বাঁক ঘুরছে যে রাস্তাটা তার পাশেই ওর বাসা। আশ্চর্য ব্যাপার, আজ অবধি করিমচাচার কোনও ক্ষতি হয়নি।
অর্জুন মাথা নাড়ল। এতক্ষণ আপনি যা বললেন তাতে মনে হচ্ছে এর অনেকটাই আপনাদের কল্পনা। যে কেউ শুনলে বলবে ওটা ভূতের বাড়ি। যা ঘটেছে তা ভূতেরাই ঘটিয়েছে। সিঁড়ি ভেঙে পড়া বা গাড়ির ব্রেক খারাপ হওয়ার ঘটনা দুটোর পেছনে অন্য কারণ থাকতে পারে কিন্তু যারা ভূতে বিশ্বাস করেন তারা বলবেন ভূতেরই কাজ। কিন্তু আমি ভূত বিশ্বাস করি না। তাই ভৌতিক ব্যাপার বলে আমার কাছে কোনও রহস্য নেই।
দেখুন, আমিও মনে করি এই ব্যাপারগুলো ভৌতিক নয়। কোনও মানুষের কাজ, যে চাইছে না আমি ওই বাড়িতে থাকি। ইন ফ্যাক্ট, আমার মেয়েরা কখনওই ওই বাড়িতে বাস করবে না। যেহেতু আমার ছেলে নেই তাই মৃত্যুর পরে ওটা পোড়োবাড়ি হয়ে যাবে। আমি আপনাকে অনুরোধ করছি। প্রকৃত সত্যটাকে সন্ধান করতে। ফয়েজুর রহমান বিনীত গলায় বললেন।
আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন?
যাকে সন্দেহ করেছিলাম সে তো ব্রহ্মপুত্রের পানিতে ডুবে গেছে।
মাথা নাড়ল অর্জুন। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, ওই বিশাল বাড়ি তো আপনার কোনও কাজেই লাগছে না। আপনি বিক্রি করছেন না কেন? তা হলে তো ঝামেলামুক্ত হতে পারতেন!
হাসলেন ফয়েজুর রহমান, কারণটা একদম সেন্টিমেন্টাল। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে বাবার সঙ্গে দেখা করতে ওখানে গিয়েছিলাম। বাড়ির বাগানে দাঁড়িয়ে বাবা বললেন, তোমার ব্যাবসা ভাল চলছে, টাকাপয়সা হয়েছে, খুব ভাল কথা। কিন্তু সেসব হয়েছে এই বাড়িটার জন্যে। আমার পূর্বপুরুষরা বলেছেন এই বাড়ি যতদিন থাকবে ততদিন আমাদের অর্থাভাব হবে না। তাই তোমাকে বলছি, কোনও অবস্থাতেই এই বাড়ি বিক্রি করার কথা ভেবো না। মনে রেখো যাকে বিক্রি করবে তার ভাগ্য খুলে যাবে আর তুমি ক্রমশ দুর্দশায় পড়বে। বাবাকে কথা দিয়েছিলাম কখনওই বাড়ি বিক্রি করব না। কোনও কোনও কথা অকারণেই মেনে নিতে হয়।
অর্জুন বলল, কাল সকালে আমি কখন যেতে পারি?
যখন চাইবেন। কাল থেকে হানিফ অন্য গাড়ি নিয়ে সকাল সাতটায় ঢাকা ক্লাবে পৌঁছে যাবে। ওটা আপনার সঙ্গে থাকবে।
আমি করিমচাচার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
নিশ্চয়ই। করিমচাচাকে দিনের বেলায় ওখানেই পাবেন।
আপনি কি সকালে যেতে পারবেন?
নিশ্চয়ই। সকালে আমার অসুবিধে নেই। দশটায় পৌঁছে যাব ওখানে।
ফয়েজুর রহমান যখন বিদায় নিলেন তখন বেশ রাত হয়েছে। ঘরেই ডিনার খেয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল অর্জুন। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকাল। বোঝা গেল সমস্ত আকাশ এখন মেঘের আড়ালে। আজ রাত্রে ঢাকায় বৃষ্টি হবে।
.অমল সোম বলতেন কখনও আগ বাড়িয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ো না। যে-কোনও ঘটনা যখন ঘটে তখন তুমি তার সামনের দিকটাই দেখতে পাচ্ছ, পাশের দু’দিক একটু আবছা থাকছে আর পেছনের দিকটা একদম অজানা। তাই অন্তত তিনটে দিক দেখা না হওয়া পর্যন্ত চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ো না। অপেক্ষা করো, ধৈর্য ধরো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যা আগ বাড়িয়ে ভেবেছিলে তা উলটে যেতে পারে।
সকালে তৈরি হয়ে ঢাকা ক্লাবের রেস্টুরেন্টে বসে ব্রেকফাস্ট করতে করতে অমল সোমের কথাগুলো মনে করল অর্জুন। এসব কথা অমল সোম বলতেন সেই প্রথমদিকে যখন সে ওঁর সহকারী হয়ে কাজ শুরু করেছিল।
একটা সিঁড়ি ভেঙেছে, গাড়ির ব্রেক সাময়িকভাবে ফেল করেছিল, একজন। ছাদে বেড়াতে গিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। এখন পর্যন্ত এই তিনটে খবর পাওয়া গিয়েছে। ফয়েজুর রহমান সন্দেহ করছেন এর পেছনে কোনও মানুষের হাত আছে। কিন্তু তিনি কাউকে সন্দেহ করতে পারছেন না। আবার তার মনে হচ্ছে না এসব ভৌতিক ব্যাপার। কোনও মানুষের যদি ভূমিকা থেকে থাকে তা হলে তাকে ওই বাড়ির ভিতর থাকতে হবে অথবা যাতায়াত করতে হবে। এরকম কাউকে কেউ দেখেনি। অতএব খোলা মনেই সে ওখানে যাবে। যেভাবে ট্যুরিস্টরা কোথাও বেড়াতে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সেইভাবে দেখবে।
বেয়ারা এসে বলল, স্যর, আপনার গাড়ি এসে গেছে।
ঠিক আছে।
খাওয়া শেষ করে ডেস্কে ঘরের চাবি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে অর্জুন দেখল হানিফভাই দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে নতুন গাড়ি। এটাও বিদেশি। তাকে দেখে কপালে হাত ছোঁয়াল হানিফভাই। গুডমর্নিং স্যর।
গুডমর্নিং। চলুন।
গাড়ি চালাতে চালাতে হানিফভাই বলল, আর আধঘণ্টা ঢাকার রাস্তা ফাঁকা থাকবে। তারপর যে জ্যাম হবে তা চলবে রাত দশটা পর্যন্ত।
তা হলে তো আজ আরও তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব আমরা। পেছনে বসে অর্জুন বলল। গাড়িতে এসি চলছে। বসার জায়গাও বেশ আরামদায়ক। রাস্তায় গাড়ি কম। যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভার, মেঘনার ব্রিজ পার হয়ে সোনার গাঁ-তে চলে এল এক ঘণ্টার মধ্যেই। এই সোনার গাঁয়ের কথা অর্জুন প্রথম পড়ে স্কুলের ইতিহাস বইতে। সেন বংশের লক্ষ্মণ সেন তখন গৌড়ের রাজা। খবর পেলেন বিদেশি শত্রু ঘোড়ায় চড়ে গৌড় আক্রমণ করতে আসছে। নিশ্চিত পরাজয় অনুমান করে যতটা পারেন ধনরত্ন নিয়ে তিনি পালিয়ে গেলেন সপরিবার। বহু নদীপথ অতিক্রম করে আশ্রয় নিলেন পূর্ববঙ্গের এই অঞ্চলে। গড়ে তুললেন তার নতুন রাজ্য। তিনি পরে হয়তো জানতে পেরেছিলেন মহম্মদ ঘোরী মাত্র আঠারোজন অশ্বারোহী নিয়ে গৌড় আক্রমণ করেছিলেন। সেইসব ঘোড়ার পায়ের ধুলোকে ঝড় বলে ভুল করেছিল লক্ষ্মণ সেনের দূতেরা।
হানিফ গাড়ির গতি কমাল, স্যর বাঁ দিকে লক্ষ্মণ সেনের গড়।
ঠিক আছে। আপনি এগিয়ে চলেন।
সেই চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় অর্জুন দেখল তিনজন খদ্দের চা খাচ্ছে। গত সন্ধ্যার ঘটনার কোনও ছাপ এখন থাকতে পারে না, নেইও।
নদীর কাছে এসে গাড়ি ফয়েজুর রহমানের বাড়ির দিকে চলল। কিছুটা যাওয়ার পরে অর্জুন বলল, হানিফভাই, একটু দাঁড়ান।
গাড়ি থামলে অর্জুন নেমে পড়ল। বলল, আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবেন, গাড়ির ইঞ্জিন গরম হয়ে গেছে বলে অপেক্ষা করছেন। এখানে একঘণ্টা অপেক্ষা করে সাহেবের বাড়িতে চলে যাবেন।
স্যর, আপনি চিনে যেতে পারবেন তো? হানিফ জিজ্ঞাসা করল।
হ্যাঁ, সোজা গেলেই তো ওঁর প্রাসাদ। অর্জুন হাঁটতে শুরু করল। মেঘনার গায়ে বাঁধ শুরু হয়ে গিয়েছে। অনেকদিনের পুরনো বাঁধ তাই এখন ওর উচ্চতা অনেক কমে গিয়েছে। ডানদিকে জঙ্গুলে গাছ, দু-তিনটি ছোট বাড়ি। ওপাশের জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে দূরে গ্রাম দেখা যাচ্ছে। অর্জুন দেখল একজন লোক গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে হনহনিয়ে আসছে। তার হাতে কিছু একটা দড়ির মতো জিনিস, নড়ছে। কাছাকাছি হতেই সে অবাক হয়ে দেখল, ওটা দড়ি নয়, সাপ। লোকটার মুঠোয় সাপের মাথা।
মুখোমুখি হতেই হাত তুলে লোকটাকে দাঁড় করিয়ে অর্জুন জিজ্ঞাসা করলও আপনি সাপটাকে নিয়ে কোথায় চললেন?
এজেন্টের কাছে।
মানে বুঝলাম না।
বিষধর সাপ জ্যান্ত ধরে দিলে নগদ দুশো টাকা দাম দেবে এজেন্ট। ঢাকা থেকে এসেছে। আধমরাও চলবে না। এটাকে বলে কালকেউটে। এক ছোবলেই কবরে যেতে হবে। সকালে উঠে ওটাকে দেখে মাথায় লাঠি চাপা দিয়ে ধরে ফেললাম। এখন মুঠো খুললেই ব্যাটা ছোবল মারবে আমাকে। এজেন্টের কাছে যন্ত্র আছে, ও মুঠো থেকে খুলে নেবে। লোকটা বলল।
এদিকে অনেক বিষধর সাপ আছে? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
এখন সব শালা বাসা বেঁধেছে জমিদারের বাসায়। মাঝে মাঝে এটার মতো কেউ কেউ ব্যাং, ইঁদুর খেতে বেরিয়ে আসে। চলি বাবু। মুঠো টনটন করছে। লোকটা দৌড়াল।
বিষধর সাপ দুশো টাকায় কিনছে কোনও কোম্পানির এজেন্ট। সাপের বিষে ওষুধ তৈরি হয় বলে চাহিদা আছে। কিন্তু ফয়েজুর রহমানের প্রাসাদে যখন প্রচুর বিষধর সাপ রয়েছে তখন এজেন্ট সরাসরি সেখানেই চলে যাচ্ছে না কেন?
আর একটু যেতেই লোকটাকে দেখতে পেল। খুব ধীরে লাঠিতে ভর করে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন এক বৃদ্ধ। পরনে ফতুয়া এবং লুঙ্গি। পা চালিয়ে বৃদ্ধের পাশে চলে এল অর্জুন, নমস্কার চাচা। কোথায় যাচ্ছেন?
মুখে সাদা দাড়ি, মাথায় টাকের ওপর ছোট সাদা সুতোর টুপি। মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন, নতুন তাই জানা নেই। দশ মাইলের মধ্যে সব মানুষ জানে। হাসলেন বৃদ্ধ, পেটের দায়ে হাঁটছি। কবরে যাওয়ার জন্যে যতক্ষণ না চোখ বন্ধ করব ততক্ষণ তো পেটের আগুন নিভবে না।
আপনাকে এই বয়সেও পরিশ্রম করতে হচ্ছে?
আমাকে খাওয়াবে এমন কাউকে তো আল্লা পাঠাননি। অবশ্য মিথ্যে বলব না, আমাকে বলেছিল, রোজ যেতে হবে না। মাসে দু-তিনবার গেলেই চলবে। কিন্তু মাত্র তিনবার গিয়ে আমি গোটা মাসের বেতন হাত পেতে কেন নেব? জীবনে কখনও ফাঁকি দিইনি, শেষবেলায় দেব কেন? তাই যাই। আস্তে আস্তে যাই। রাত নামলে চোখে ভাল দেখতে পাই না তাই আলো নেভার আগেই চলে আসি। বৃদ্ধ বললেন।
তা হলে আপনিই করিমচাচা? অর্জুন হাসল।
অবাক হলেন বৃদ্ধ, আপনার পরিচয়?
আমি অর্জুন। ভারতের কলকাতায় থাকি। গতকাল এসেছি।
গতকাল এসেছেন আর আমার নাম জেনে গেছেন?
হ্যাঁ। ফয়েজুর রহমান সাহেবের কাছে শুনেছি।
অ মাথা নাড়লেন করিমচাচা। তাই বলুন। তা আপনি এখানে?
ফয়েজুর রহমান সাহেবের বাড়িতেই যাব। অর্জুন বলল, উনিও আসবেন।
আপনি এলেন কী করে?
গাড়িতে। একটু হেঁটে দেখছি।
অ। কিন্তু মুশকিলে ফেলে দিলেন বাবু। এখন তো ওই বাড়ির পাকঘরের দরজা অনেকদিন বন্ধ আছে। আপনাকে খাবার দূরের কথা চা দেব কী করে? আসার কথাটা যদি আগে জানতে পারতাম! করিমচাচা আফশোস করলেন।
না না। আমি পেট ভরে খেয়ে এসেছি। আপনি তো সারাদিন ওই বাড়িতে থাকবেন। আপনি কী খাবেন?
করিমচাচা বললেন, আমি দু’বার খাই। এই এখন পান্তা খেয়ে বেরিয়েছি। আবার সন্ধেবেলায় বাসায় গিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়ি। এই বয়সে এর বেশি খাওয়ার দরকার হয় না। কিন্তু বাবু, আপনার এখানে আসার কারণ কী?
আপনাদের বাড়ি নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি। তাই দেখতে এলাম।
এখন আর দেখার কিছু নেই। সব ধ্বংসস্তূপ। ফয়েজুরের বাবা চলে যাওয়ার পর থেকেই সব শেষ। বাড়িঘর ভেঙে পড়ছে, জঙ্গল জমছে। আমি এই বয়সে যেটুকু পারি সেটুকু করি। আর সেই ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি কত লোকজন, খাওয়াদাওয়া, বাড়ি একেবারে ভরে থাকত। আসুন, এই হল বাড়ি। করিমচাচা বন্ধ গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। ফতুয়ার পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুললেন। ভিতরে ঢুকে বললেন, তবু ভাগ্য বাড়িটা এখনও বেঁচে আছে। অন্য কোনও বাড়ি হলে এতদিনে কয়েকটা ভাঙা ইট পড়ে থাকত। যে যেমন পারত জানলা, দরজা গোটা ইট খুলে নিয়ে যেত।
আপনি আছেন বলে সাহস পায় না?
আমি তো থাকি দিনের বেলায়। ওসব নেওয়ার সময় তো রাত বাড়লে। কিন্তু ওই যে, খবরটা মুখে মুখে রটে গেছে, এই বাড়ি রাত বাড়লেই ভূতের বাড়ি। এখনও তো মানুষ ভূতকে ভয় পায়। সেই ভয়ে ধারে কাছে আসে না।
অর্জুন চারধারে তাকাল। এককালে সুন্দর বাগান ছিল। এখন জঙ্গলে ভরে গিয়েছে। এখানে সাপ না থাকাটাই অস্বাভাবিক ব্যাপার। করিমচাচা গাড়ি বারান্দার নীচে পৌঁছে গিয়েছেন। অর্জুন কাছে যেতে বললেন, ওই নলকূপটা দেখছেন, ওটা তৈরি করেন ফয়েজুরের বাবা। খুব মিষ্টি জল। এখনও ওখানে জল পাওয়া যায়।
আপনি এখানে এসে কী করেন?
কিছুই না। এই দরজার সামনের বারান্দায় শুয়ে বসে থাকি। নামাজ পড়ি, আল্লাকে ডাকি। বলি বিছানায় ফেলে দিয়ে যন্ত্রণা না দিতে। হাঁটাচলা করতে করতে যেন মারা যাই।
বাড়ির ভেতর যান না?
যাই। মাসে দু’বার। ছাদে উঠতে পারি না। আপনার নামটা কী যেন বললেন?
অর্জুন।
গল্পটা জানি। মহাভারতের গল্প। খুব বড় বীর ছিলেন। হ্যাঁ, আপনাকে বলি, আজকাল বাড়ির ভিতরে গেলে খুব কটু গন্ধ নাকে লাগে। কথাটা আমি ফয়েজুরকে বলেছিলাম। সে বলল, ভেতরে যাওয়ার দরকার নেই।
কটু গন্ধ কীসের হতে পারে? অ্যাসিডের?
তা আমি জানব কী করে?
আচ্ছা, এখানে ঢাকা থেকে লোক এসেছে যারা বিষধর সাপ কিনছে। একটা বিষধর সাপের জন্যে দুশো টাকা দিচ্ছে। তারা আপনার কাছে এসে এখানে সাপ ধরতে চায়নি?
এসেছিল। আমি তাদের বলেছি এ বাড়ির সাপগুলো তো আমার কোনও ক্ষতি করছে না। আমি কেন তাদের ক্ষতি করব। হ্যাঁ, যদি ধরতেই চাও তো রাতের বেলায় এসো। তখন আমি থাকব না, চোখেও দেখতে হবে না। শুনে সেই যে চলে গেল আর আসেনি। তবে দিনের বেলায় বাড়ির চারপাশে সাপের লোভে লোক ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে পেয়েও যায়। দাঁড়ান, আপনাকে একটা চেয়ার ভিতর থেকে এনে দিই, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন। করিমচাচা ভিতরে যাওয়ার চেষ্টা করলে অর্জুন বাধা দিল। বলল, আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি এখন বসব না। বাড়িটাকে ঘুরে দেখতে পারি?
মুখে কথা না বলে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন করিমচাচা।
বন্ধ জানলা-দরজা থাকলে বাড়ির ভিতরে ভ্যাপসা গন্ধ ভাসে। কিন্তু বসার বড় ঘরটায় সেই গন্ধ পেল না অর্জুন। করিমচাচা রোজ এই বাড়িতে যখন আসেন তখন নিশ্চয়ই ঘরের দরজা-জানলা খোলেন, হাওয়া ঢোকে। এই সকালের সময়টার যথেষ্ট আলো কাঁচের জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকছে। বসার ঘরে যেমন সোফা-টেবিল সাজিয়ে রাখা আছে তেমনি দেওয়ালে ফয়েজুর রহমানের পূর্বপুরুষদের ছবিও রাখা হয়েছে। চেহারা এবং স্বাস্থ্য যদি সঠিক হয় তা হলে বুঝতে অসুবিধে হয় না এঁরা যথেষ্ট অর্থবান ছিলেন। নীচে ঘরের সংখ্যা আটটি। বোঝাই যাচ্ছে কোনওটা শোওয়ার ঘর, কোনওটা খাওয়ার ঘর। সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের, ডাইনিং টেবিলে যে দামি কাপপ্লেট চামচ রাখা আছে তা এরকম প্রায় পোড়োবাড়িতে সাধারণত থাকে না। অর্জুন নিঃসন্দেহ হল, চুরি-চামারি করতেও কেউ এই বাড়িতে ঢোকে না।
দোতলার সিঁড়ি শ্বেতপাথরের। কয়েকধাপ উঠতেই গন্ধটা পেল অর্জুন। করিমচাচা ঠিকই বলেছেন, গন্ধটা কটু। ওটা ওপর থেকেই আসছে। ইঁদুর বা বেড়াল মরে পচে গেলে যে দুর্গন্ধ বের হয় সেটা আলাদা। এই গন্ধে ঝাঁঝ রয়েছে। দোতলায় ওঠার সময় নাকে রুমাল চাপতে হল। লম্বা করিডরের গায়ে একটার পর একটা ঘর। প্রতিটি ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। অর্থাৎ এগুলো এখন কারও প্রয়োজনে লাগছে না।
ছাদের সিঁড়ির দরজা বন্ধ কিন্তু ভিতর থেকে তালা বা ছিটকিনি লাগানো নেই। অর্জুন ঠেলতেই দরজা ঈষৎ ফাঁক হল কিন্তু খুলল না। অর্জুন দেখল বাইরের দুটো কড়ার মধ্যে কাঠের কিছু গোঁজা থাকায় দরজাটা খুলছে না। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর কাঠটাকে সরালে দরজা খুলল। নিচু হয়ে কাঠের টুকরো তুলে নিল সে। সরু দশ ইঞ্চিটা লম্বা কাঠ। খুব নিরীহ ব্যবস্থা। কিন্তু দরজাটা ছাদ থেকে বন্ধ করা হয়েছিল কেন? ওটা বন্ধ করে নীচে নেমে যাওয়ার আগে ভিতর থেকেই বন্ধ করার ব্যবস্থা তো আছে। বাইরে থেকে যে বন্ধ করেছে তাকে তো বাইরেই থাকতে হবে। অর্জুনের মনে হল ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। ছাদে পা দিতেই কটু গন্ধটা হারিয়ে গেল। নদী থেকে ছুটে আসছে হুহু বাতাস। এই বাতাসে গন্ধ উড়ে যাবেই। অথচ বাড়ির ভিতরে গন্ধটা আটকে আছে। অর্জুন আবার ছাদের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় নেমে এল। গন্ধটা এখানে তীব্র। নাক টেনে টেনে বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পরে সে উৎসটা খুঁজে পেল। ছাদের দিকের একটা বন্ধ জানলার কাচ ভাঙা। সেই ভাঙা অংশের ভেতর দিকে একটা চৌকো কাঁচের পাত্র রাখা আছে। সিঁড়ি থেকে সেখানে পৌঁছানো অসম্ভব। সে আবার ছাদে চলে এল। জানলাটার পাশে গিয়ে দেখল ওটা ভেতর থেকে বন্ধ। ভাঙা অংশের ফাঁক দিয়ে পাত্রটাকে দেখা যাচ্ছে। ওটাকে যে ছাদ থেকে ওখানে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সন্তর্পণে ওই পাত্র বাইরে বের করে আনল অর্জুন। খুব কড়া কোনও অ্যাসিড ওর মধ্যে রাখা হয়েছে। কার্বলিক অ্যাসিড অর্জুন দেখেছে। এটা তার চেয়েও কড়া। কে রাখল ওখানে? যে রেখেছিল সে নিশ্চয়ই জানলার কাচ ভেঙে রেখেছিল। কিন্তু কেন রেখেছিল?
উত্তরটা একটু পরেই পেয়ে গেল অর্জুন। বিরাট ছাদের চারপাশে হাঁটতে হাঁটতে সে কার্নিশের কাছে এল। নীচে জঙ্গুলে বাগান, পাঁচিল, পাঁচিলের পর উঁচু বাঁধ পেরিয়ে মেঘনা নদী। চমৎকার দৃশ্য। সে অন্যপাশে আসতেই ঝাকড়া গাছটাকে দেখতে পেল। একটা ডাল প্রায় ছাদের কাছাকাছি চলে এসেছে। সেখানে কিছু একটা নড়ে উঠতেই চমকে গেল অর্জুন। একটা কালো সাপ গাছের ডালে আরাম করে বসে আছে। লম্বায় চারফুটের কম হবে না। মাঝে মাঝেই সাপটার জিভ বেরিয়ে আসছে। ছাদে মানুষ দেখতে পেয়ে আর নজর সরাচ্ছে না। ওই সাপ দরকার হলে লাফিয়ে ছাদে চলে আসতে পারে। এখানে সাপ আছে তা বলে গিয়েছিল সাপ বিক্রি করতে যাওয়া লোকটা। করিমচাচাও তা সমর্থন করেছে। ওই সাপ যাতে ছাদে আসতে না পারে, বাড়ির ভিতর ঢুকতে না পারে তাই অ্যাসিডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওই কটু গন্ধ থেকে সাপ নিজেকে দূরে রাখবে। অর্জুন ভাল করে তাকাল। ওই গাছে আর সাপ দেখতে পেল না। কাঠের টুকরোটা উঁচিয়ে হেট হেট করে সে সাপটাকে তাড়াবার চেষ্টা করল কিন্তু সে উপেক্ষা করল। তারপর নিজের শরীরটাকে পাতার আড়ালে নিয়ে গেল। অর্জুন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে সাপটাকে দেখে যাচ্ছিল। ওই অ্যাসিড যে ফয়েজুর রহমান রাখেননি তা স্পষ্ট। রাখলে জানলার কাচ ভাঙতেন না, দরজাটাকে ভিতর থেকেই বন্ধ করতেন। করিমচাচার শরীরের যে অবস্থা তাতে তাঁর পক্ষে ছাদে এসে এই কাজ করা সম্ভব নয়। উলটে তিনি নিজেই কটু গন্ধের কথা বলেছেন। তা হলে কি এই বাড়িতে অন্যলোক আসে? কিন্তু সে নিশ্চয়ই সিঁড়ি দিয়ে ছাদে ওঠে না। উঠলে ছাদ থেকে দরজা বন্ধ করত না। তা হলে সে বাইরে থেকে এসে ছাদের দরজা খুলে নীচে নামে। প্রশ্ন হল বাইরে থেকে সে ছাদে ওঠে কী করে? অর্জুন আবার ছাদের কার্নিশগুলো ঘুরে দেখল। নীচ থেকে ওপরে ওঠার কোনও ব্যবস্থা নেই। বরং উঠতে গেলে কার্নিশটা বাধা হয়ে দাঁড়াবে। হঠাৎ পাখির চিৎকার কানে এল। চিৎকারটা থেমে গেল তৎক্ষণাৎ। অর্জুন ঘাড় ঘুরিয়ে গাছটার দিকে তাকাতেই দেখল সেই সাপটা একটা ছোট পাখিকে গেলার চেষ্টা করছে। নিশ্চয়ই নিজেকে আড়ালে রেখে তক্কে তক্কে ছিল সাপটা। পাখি এসে ওর সামনের ডালে বসতেই খপ করে ধরে ফেলেছে। অর্জুন দেখল ধীরে ধীরে পুরো পাখিটাকে গিলে ফেলল সাপটা। ওর গলা থেকে পেট পর্যন্ত অংশটা ফুলে ফুলে উঠল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে সড়সড় করে গাছ থেকে নীচে নেমে জঙ্গলে হারিয়ে গেল।
ছাদের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে একতলায় নেমে এল অর্জুন। বাইরের বারান্দায় করিমচাচা বসে আছে নির্বিকার মুখে। পাশে একটা খালি চেয়ার। তাকে দেখে বলল, বসুন।
অর্জুন চেয়ারে বসলে করিমচাচা জিজ্ঞাসা করল, দেখলেন? তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করে বলল, এখন দেখার কিছু নেই। আগের আমলে আসলে চোখ জুড়িয়ে যেত। এখনও দেখবেন একটুও দাগ পড়েনি। আয়নাগুলোয়। বিদেশ থেকে কেনা।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, করিমচাচা, সিঁড়ি দিয়ে না উঠে অন্য কোনও উপায়ে ছাদে কি যাওয়া সম্ভব?
কিছুক্ষণ ভেবে মাথা নাড়ল করিমচাচা, অসম্ভব বলে কিছু নেই বাবু। সব সম্ভব।
আপনি কাউকে অন্যভাবে ছাদে উঠতে দেখেছেন?
অনেক বছর আগে। তখন বাড়ি জমজমাট ছিল। আমিও রাত্রে এখানেই থাকতাম। এক বর্ষার রাত্রে চোর ঢুকেছিল। তখন বাগান পরিষ্কার ছিল। বাড়ির সবাই ঘুমাচ্ছিল, আমিও। হঠাৎ চিৎকার এবং কান্না কানে আসতেই ঘুম ভেঙে গেল। আলো জ্বালতেই দেখতে পেলাম একটা লোক ওপাশের গাছের উপর উঠে ভয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। বলছে, সাপ, সাপ। ফয়েজুরের বাবা। টর্চের আলো ফেললে দেখা গেল সাপটা গাছের উপর উঠছে। ভয়ে লোকটা প্রায় মগডালে উঠে লাফ দিতেই ছাদের ওপর এসে পড়ল। তাকে ধরা হলে সে স্বীকার করল সামান্য কিছু চুরি করার জন্যে এসেছিল। কিন্তু সাপের তাড়া খেয়ে প্রাণ বাঁচাতে গাছে উঠে পড়েও নিস্তার পায়নি। বেঁধে রাখা হল লোকটাকে। কিন্তু সকালে তাকে ছেড়ে দেওয়া হল। ও যে ভুলেও এই বাড়িতে কখনও আসবে না তা বোঝা গিয়েছিল। করিমচাচা ফোকলা দাঁতে হাসল। স্মৃতি তাকে আনন্দ দিল।
এর মানে তখনও এই বাড়িতে সাপ ছিল? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
মাঝেমধ্যে ঢুকে পড়ত। নদীর পাশে বাড়ি। পথ ভুলে চলে আসত!
এখন?
ঘর ব্যবহার না করলে ধুলো জমে বাবু। বাগান পরিষ্কার না করলে জঙ্গল হয়ে যায়। তেমনি বসতবাড়িতে বাস না করলে সাপের আস্তানা হয়ে যেতে পারে। এই যে আমি এখানে বসে থাকি, মাঝে মাঝে তারা আসে। খানিক দূরে ফণা তুলে দাঁড়ায়, আমাকে দেখে। তারপর ফণা নামিয়ে চলে যায়। আমায় কিছু বলে না।
আপনি বললেন আগে এখানে রাত্রে থাকতেন। এখন থাকেন না কেন?
চোখে ভাল দেখি না। সেই কারণে উলটোপালটা দেখি।
কীরকম?।
এই ধরুন, একটা সাদা কাপড় সোজা হয়ে বাগান দিয়ে চলে গেল। কোনও মানুষ নেই, শুধু লম্বা সাদা কাপড়।
এটা আপনার চোখের ভুল।
হঠাৎ দেখলাম বাগানটা যেন কবর হয়ে গিয়েছে। অনেকগুলো কবর। আর সেই কবর থেকে আধপচা মানুষের শরীর বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করছে।
অর্জুন হেসে ফেলল। পৃথিবীতে মানুষ যেখানেই থাকুক তাদের কল্পনা মাঝে মাঝেই মিলে যায়। ইংরেজি হরর ফিল্মে কবর থেকে উঠে আসা বিকৃত মৃতদেহদের হাঁটতে দেখা যায়। করিমচাচার পক্ষে সেসব ছবি দেখার কোনও সুযোগ নেই। কিন্তু তার কল্পনার সাথে ওই হরর ফিল্মের কোনও পার্থক্য নেই।
অর্জুন উঠে বাইরে এসে দেখল ডানদিকে একটা টিনের ঘর রয়েছে। সে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ওটা কীসের ঘর?
ওই ঘরে বাবুরা গাড়ি রাখতেন। সেসব গাড়ি কবে বিক্রি হয়ে গেছে। এখন ফয়েজুরের একটা মাল বইবার গাড়ি থাকে ওখানে। পড়েই থাকে। অর্জুন এগিয়ে গিয়ে বন্ধ দরজায় হাত দিল। তালা নেই। টানতেই খুলে গেল। গ্যারাজের ভিতর ঢুকল সে। একটা ছোট লরি। বেশ পুরনো। ঘুরে অন্যদিকে আসতেই অর্জুনের চোখ ছোট হল। গাড়ির এদিকটা একটু দুমড়ে গিয়েছে। দুমড়ে যাওয়া জায়গাগুলোতে অন্য রং লেগে গেছে। এই লরি নির্ঘাত অ্যাকসিডেন্ট করেছিল। যার সাথে করেছিল সেই গাড়ির রং এর গায়ে লেগে গেছে। হঠাৎ কালকের ঘটনাটা মনে এল অর্জুনের। লরিটার যেদিকে ধাক্কা লেগেছে সেই দিকটাই তো তাদের দাঁড়ানো গাড়িটাকে আঘাত করেছে। হানিফভাই যে গাড়ি চালাচ্ছিল তার বডির রং এই লরিতে লেগে যাওয়া রঙের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। এই গাড়িটাই কি কাল অ্যাকসিডেন্ট করেছিল। সে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। চারপাশে তাকাল। তারপরই পায়ের কাছে একটা গোটা সিগারেট দেখতে পেল। সিগারেটটাকে তুলে নিয়ে দেখল ওটা একটা ফাইভ ফাইভ ফাইভ সিগারেট। এটা তো বিদেশি সিগারেট। গন্ধ শুকল সে। বাঃ, তামাকের গন্ধ এখনও বেশ তাজা।
সিগারেটটাকে পকেটে রেখে নীচে নামল অর্জুন। চাকাগুলো দেখল। বেশ পুরনো হয়ে গেলেও বোঝা যাচ্ছে অনেকদিন একভাবে পড়ে থাকেনি। সে বাইরে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করল। তারপর গ্যারাজ থেকে গেটের দিকের পথটা ভাল করে পরীক্ষা করল। এই পথ ইট দিয়ে বাঁধানো। তবু মাঝে মাঝে চাকার দাগের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। খুব আবছা হলেও অর্জুনের মনে হল দাগটা টাটকা।
সে করিমচাচার কাছে চলে এল। বুড়ো তখন বসে বসে ঢুলছে। অর্জুন তাকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনি গতকাল এই বাড়িতে কতক্ষণ ছিলেন?
গতকাল? করিমচাচা দাড়িতে আঙুল বোলালেন, গতকাল যেন কী বার ছিল? ও হ্যাঁ। একটা সাপ দেখলাম। অচেনা সাপ। ও আমাকে চেনে না আমিও ওকে চিনি না। ওই গোলাপ গাছটার পাশে এসে আমাকে দেখে ফণা তুলল। এতবছর এখানে আছি, চেনা সাপগুলো তো আমাকে দেখে ফণা তোলে না। বুঝলাম ব্যাটা আমাকে পছন্দ করছে না। লাঠি উঁচিয়ে শাসাতে মুখ নামিয়ে চলে গেল। বুঝলেন?
চাচা, আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছি কাল এখানে কতক্ষণ ছিলেন?
বললাম তো। সাপটা লুকিয়ে পড়ার পর মনে হল আজ আর আমার এখানে থাকা উচিত হবে না। আমি তো আঁধার নামলে চোখে দেখি না। কখন ওর গায়ে পা পড়বে, তার চেয়ে দিনে দিনে চলে যাওয়াই ভাল। চলে গেলাম। করিমচাচা বলল।
তা হলে তখন রোদ ছিল?
ছিলই তো।
আর একটা কথা। ওই গ্যারাজে যে লরিটা রয়েছে সেটা শেষ কবে বেরিয়েছে?
মনে নেই বাবু। আজকাল দু’দিন আগের কথা ভাল মনে রাখতে পারি । তবে মজার কথা কী জানেন, চল্লিশ বছর আগের কথা এখন দিব্যি মনে পড়ে যায়। তা শুনেছি মরণ ঘনিয়ে এলে নাকি এইরকম হয়। করিমচাচা হঠাৎ চোখ ছোট করল। কিন্তু বাবু, আপনি কে? এখানে আসার উদ্দেশ্য কী?
আপনার মনে এই প্রশ্ন কেন এল? অর্জুন হাসল।
বেড়াতে এসে কেউ তো পুলিশের মতো জিজ্ঞাসা করে না। আপনি কি পুলিশ?
হো হো করে হেসে উঠল অর্জুন, না না, আমি পুলিশ নই। নতুন জায়গায় গেলে আমার সবকিছু জানতে ইচ্ছে করে। আচ্ছা, কাল অত তাড়াতাড়ি ফিরে কী করলেন?
কী আর করব? ভাত বানালাম, সঙ্গে আলু আর একটা ডিম সেদ্ধ। বিকেল শেষ হওয়ার মুখে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম। করিমচাচা বলল।
সেটা তো এই বাড়িতে থেকেও করতে পারতেন। অর্জুন মন্তব্য করল।
করিমচাচা একটু চুপ করে থেকে বলল, বাবু, আপনি কে তা আমি জানি না। তবে কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে মানুষটা ভাল। আজকালকার ছেলে ছোকরা দূরের কথা, ফয়েজও বিশ্বাস করে না। কিন্তু–। হঠাৎ চুপ করে গেল বৃদ্ধ। জোরে শ্বাস নিল।
অর্জুন বলল, আপনি স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন। আপনাকে অবিশ্বাস করব না। ভূতের ভয়ে?
মুখে খুশির ছাপ ফুটল করিমচাচার, তা হলে বলি। কথাটা চার কানেই যেন থাকে, পাঁচ কান করবেন না। এই বাড়িতে এখন রাত্রে থাকা যায় না। এখানে রাত্রে কিছু একটা আসে যে বা যারা চায় না আমি থাকি। তাকে ভূত বলতে পারেন, জিন বলাও যায়। সে আসার কিছুক্ষণ পরেই অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ হয়। ওই বাগানে ছায়া ছায়া কিছু দেখা যায় আবার মিলিয়েও যায়। পেছনের জমিতে যেন হাল চাষ করে ও থামতে চায় না। তাই ওখানে যত সাপ ছিল সব সামনের বাগানে চলে এসেছে। এখানে রাতে থাকলে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। শুধু মনে হয় কেউ আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলবে। করিমচাচার কথা শেষ হতেই গাড়ির আওয়াজ কানে এল। গেটের সামনে এসে হর্ন বাজাল। করিমচাচা উঠতে যাচ্ছিল। বাধা দিল অর্জুন। আপনি বিশ্রাম করুন, আমি দেখছি।
দুটো গাড়ি এসেছে। অর্জুন গেট খুলে দিতেই প্রথম গাড়িটা ঢুকে পড়ল আগে। গাড়ি থেকে নেমে ফয়েজুর রহমান বললেন, করিমচাচা কোথায়? আজ আসেননি?
এসেছেন। আমি ওঁকে বিশ্রাম করতে বলেছি। অর্জুন দেখল গাড়ির ওপাশ থেকে জোনাকি বেরিয়ে এল। মাথা ঝুঁকিয়ে নমস্কার জানাল।
ফয়েজুর রহমান বললেন, রাস্তায় হানিফকে গাড়িতে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়েছিলাম। প্রশ্ন করে জানলাম আপনি ওকে ওখানেই থাকতে বলেছেন।
হ্যাঁ। আমি হেঁটে এলাম যাতে কেউ বুঝতে না পারে বাইরে থেকে গাড়ি এসেছে।
ও। কিন্তু মুশকিল হল, অনেকটা সময় ওরকম নির্জন জায়গায় গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে গ্রামের মানুষের মনে সন্দেহ আসবেই। গাড়ি ঘিরে ধরে ঝামেলা করতে পারে ওরা। তাই হানিফকে বললাম সঙ্গে আসতে।
ভাল করেছেন।
বাড়িটাকে মাথা ঘুরিয়ে দেখলেন ফয়েজুর রহমান। এই হল আমার পৈতৃক বাড়ি। বাপ ঠাকুরদারা এখানেই জন্মেছিলেন। এবার বাড়িটার একটু পরিচর্যা করা দরকার। কিন্তু–। আপনি বাড়িটা ঘুরে দেখেছেন?
খানিকটা।
তা হলে চলুন বাকিটা আপনাকে দেখিয়ে দিই।
ব্যস্ত হবেন না। এসেছি যখন তখন সবটাই একটু একটু করে দেখে নেব। নিজের মতো করে। অর্জুন দেখল দুটো গাড়ি গ্যারাজের সামনে পার্ক করল ড্রাইভাররা।
.অনেকগুলো প্যাকেটে প্রচুর খাবার নিয়ে এসেছেন ফয়েজুর রহমান। ডাইনিং রুমের কাঁচের টেবিলে তার কয়েকটা খুলে নাস্তা করা হল। সঙ্গে বোতলে আনা জল আর থার্মোফ্লাস্কের কফি।
খাবার খেতে খেতে ফয়েজুর রহমান জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু বুঝতে পারলেন?
হ্যাঁ। আপনার এই বাড়িতে অনেক বিষধর সাপ আছে। এগুলো বিক্রি করলে বোধহয় কয়েক হাজার টাকা রোজগার করা যায়। অর্জুন হাসল।
সেকী! কে কিনবে?
কেনার লোক ঢাকা থেকে এসে গেছে। যে যেখান থেকে বিষধর সাপ ধরতে পারছে তা নিয়ে ছুটে যাচ্ছে টাকা আনতে। কিন্তু তারা আপনার বাড়িতে ঢুকছে না।
ফয়েজুর রহমান কথা না বলে তাকালেন, চোখে মুখে কৌতূহল।
সাপের ভয় হতে পারে, ভূতের ভয়েও।
খাওয়া শেষ করে কফির মগ হাতে নিয়ে ফয়েজুর বললেন, দেখুন, আমি মুখে যতই বলি ভূত বিশ্বাস করি না কিন্তু দিনের বেলাতেই এই বাড়িতে ঢুকলে অদ্ভুত অস্বস্তি হয়। আপনি সারাদিন থাকুন। আমি যা বুঝতে পারব না নিশ্চয়ই আপনি তা পারবেন। কিন্তু অনুরোধ, বিকেলের মধ্যে ঢাকায় ফিরে যাবেন। আপনার কিছু হয়ে গেলে আমি মিস্টার অমল সোমের কাছেও মুখ দেখাতে পারব না।
দেখুন, আমার তো এখন অবধি সব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। করিমচাচা অতিবৃদ্ধ হয়েছে। তার কল্পনায় অনেক কিছু দেখতে পারে। আচ্ছা, গ্যারাজে একটা লরি দেখলাম। আপনি কি লরির ব্যাবসা করতেন? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
মাথা নাড়লেন ফয়েজুর রহমান, ওটা নিলামে বিক্রি হচ্ছিল। সস্তায়। কিছু না ভেবেই কিনে ফেলেছিলাম। লরিটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল, মালিক দুর্ঘটনাস্থলেই মারা যায়।
তারপর আর ব্যবহার করেননি?
মাঝেমধ্যে মালপত্র নিয়ে যাওয়া-আসা করা হয়েছে। কেন বলুন তো?
কোনও কারণ নেই। আপনার সব গাড়িই বোধহয় বিদেশি। তাই গ্যারাজে একটা দিশি লরি দেখে অবাক হয়েছিলাম। অর্জুন বলল। হাসলেন ফয়েজুর রহমান।
হঠাৎ বাইরে থেকে করিমচাচার গলা ভেসে এল, অ্যাই, হট হট, যা!
ফয়েজুর উঠে দাঁড়ালেন। সঙ্গে অর্জুন ও জোনাকি।
বারান্দায় বসে করিমচাচা লাঠি ঠুকছে মেঝেতে।
ফয়েজুর জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল চাচা?
আর কী হবে। দিন দিন এরা বেড়েই যাচ্ছে। এবার ঠিক ঘরে ঢুকবে। দেখো। লাঠি উঁচিয়ে দিক নির্দেশ করল করিমচাচা।
ওরা দেখল। দুটো কালো পুরুষ্টু সাপ পাশাপাশি ফণা তুলে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছে। লাঠির আওয়াজকে ভয় পাচ্ছে না একটুও। ফয়েজুর রহমান চেঁচিয়ে উঠলেন, লতিফ, লতিফ কোথায়?
জি সাহেব। ফয়েজুর রহমানের ড্রাইভার ওপাশে সাড়া দিল। ফয়েজুর রহমান বললেন, তোমার গাড়ির ডিকিতে যে বড় অ্যাসিডের ড্রাম আছে তা বের করে আনো। সাথে পিচকারিটাও। এগুলোকে দূর করতেই এনেছি।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি সাপগুলোকে মেরে ফেলতে চাইছেন?
হ্যাঁ। দিনদিন এদের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। এর পরে হয়তো গেট খুলে এ বাড়িতে ঢোকাই যাবে না। সাপ দুটোকে লক্ষ করেছেন, আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি অথচ ওরা ভয় পাচ্ছে না।
করিমচাচার মুখে শুনলাম ওরা এখনও কারও ক্ষতি করেনি। অবশ্য আপনার বাড়ির সাপ, ইচ্ছে করলে আপনি মারতেই পারেন। অর্জুন বলল।
ফয়েজুর একটু ভাবলেন। ততক্ষণে লতিফ একটা বড় ড্রাম আর পিচকিরি নিয়ে হাজির হয়েছে। ফয়েজুর বললেন, এক কাজ করো, বাড়ির চারপাশে অ্যাসিড ছড়িয়ে দাও যাতে সাপগুলো ভেতরে না ঢুকতে পারে।
লতিফ জিজ্ঞাসা করল, বাগানে দেব না?
না থাক। ঘুরে দাঁড়ালেন ফয়েজুর রহমান। তা হলে আজও কিছুই পাননি?
এত তাড়াতাড়ি কিছু পাব বলে আশা করিনি। অৰ্জন বলল।
লতিফ বাড়ির বাইরের অংশে অ্যাসিড স্প্রে করে দিল। বেশ কটু গন্ধ এখন বাতাসে ছড়িয়েছে। অর্জুন দেখল সাপদুটো মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেছে। লতিফকে সাহায্য করল হানিফ। কাজ শেষ হয়ে গেলে ফয়েজুর রহমান বললেন, আমাকে এখন যেতে হবে অর্জুন। আপনি হানিফের গাড়িটা রাখুন কিন্তু সন্ধের মধ্যে ফিরে যাবেন, প্লিজ।
এতক্ষণে কথা বলল জোনাকি, স্যর, আমি কী করব?।
তুমি এখানেই থাকো। হানিফের গাড়িতে ফিরবে। কোনও দরকার বুঝলে ফোন করবে। হাত নেড়ে লতিফ ড্রাইভারের গাড়িতে চলে গেলেন ফয়েজুর রহমান।
এবার সহজ হয়ে জোনাকি কথা বলল, সাপগুলোকে বাঁচালেন কেন?
কারণ এখনও ওরা কোনও অপরাধ করেনি। আফটার অল, ওরাও তো প্রাণী। অন্যায় না করলে ওদেরও তো বাঁচার অধিকার আছে। হাসল অর্জুন। আসলে ওরা না থাকলে এই বাড়ি পাহারা দেবে কে? তখন হয়তো সত্যি ভূতের ডেরা হয়ে যাবে।
জোনাকি মাথা ঘুরিয়ে বাড়িটাকে দেখল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, সত্যি কি এখানে ভূত আছে?
করিমচাচা বলল ও নাকি একসময় রাতে এখানে মাটি থেকে মানুষকে উঠে আসতে দেখেছে। অর্ধেক পচে যাওয়া শরীর। আবার কখনও সাদা কাপড়কে সোজা হয়ে চলে যেতে দেখেছে। অর্জুন বেশ গম্ভীর মুখে বলল।
সর্বনাশ! জোনাকির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, সত্যি?
সত্যি কি না দেখতে হলে আপনাকে এখানে রাত্রে থাকতে হবে।
অসম্ভব। আমি থাকতে পারব না।
রাত নামতে অনেক দেরি আছে। চলুন, বাগানের পেছনদিকটায় যাই।
কেন? ওদিকে কেন যাবেন?
এক পা এগিয়ে থেমে গেল অর্জুন, আপনি এক কাজ করুন। হানিফের গাড়িতে গিয়ে বসুন। ওখানে নিরাপদে থাকবেন।
না না, ঠিক আছে, চলুন। আসলে আমি একটু নার্ভাস হয়ে গিয়েছি।
অর্জুন কিছু না বলে বাগানের পাশ দিয়ে সতর্ক পা ফেলছিল। জোনাকি জিজ্ঞাসা করল, কেন নার্ভাস হয়েছি জিজ্ঞাসা করলেন না?
যে-কোনও মুহূর্তে ভূত দেখবেন ভেবে–!
আজ্ঞে না! আপনি আজ আবার আমাকে আপনি বলতে আরম্ভ করেছেন, তাই।
অর্জুন অবাক হয়ে তাকাল জোনাকির দিকে। তার ঠোঁটে মিচকে হাসি।
সাবধানে হাঁটুন, মাটির ওপর থেকে নজর সরাবেন না। অর্জুন বলল।
বাড়ির পেছনে বাগান বা জঙ্গল নেই। দেখে মনে হয় চাষের খেত। করিমচাচা বলেছিল যেন চাষ করা হয়েছে। অর্জুনের মনে হল এখানকার মাটি খোঁড়া হয়েছে। মাঝে মাঝে মাটির ঢিবি হয়ে রয়েছে। কাজটা বেশিদিন আগে করা হয়নি। কাজটা নিশ্চয়ই ফয়েজুর রহমান করিয়েছেন। যে বাড়ি সম্পর্কে তার কোনও ইন্টারেস্ট নেই সেই বাড়ির পেছনের জমি কেন তিনি চাষ করাবেন? অথচ কাজটা একদিনে করা কিছুতেই সম্ভব নয়। বেশ কয়েকদিন কেউ বা কারা এই কাজ করল অথচ তার খবর ফয়েজুর রহমান রাখলেন না, বা কেউ তাকে জানাল না তা কী করে সম্ভব? হঠাৎ অর্জুনের নজরে এল খোঁড়া মাটির ওপর সন্তর্পণে মাটি সমান করে দেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু জায়গায়। কদিন আগে বৃষ্টি হওয়ায় এখনও কাদা-কাদা হয়ে আছে বাকি জায়গাটা কিন্তু কোনও পায়ের ছাপ সে কোথাও দেখতে পেল না। জোনাকিকে সেখানেই দাঁড়াতে বলে সে একটা বুনো ঝোঁপের দিকে এগিয়ে গেল। কাছে যেতেই নজরে পড়ল ঝোঁপের নীচে গোটা পাঁচেক মরা সাপ পড়ে আছে। সাপগুলো মরে গেছে অন্তত তিন-চারদিন আগে। একটা পচা গন্ধ বের হচ্ছে। সে ঝোঁপের দিকে তাকাল। না সেখানে কোনও সাপ নেই। আর একটু কাছে যেতেই কটু অ্যাসিডের গন্ধ নাকে এল। অর্জুন বুঝতে পারল ওই সাপগুলো মারা গিয়েছে অ্যাসিডের কল্যাণে। সে বুনো ঝোঁপের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করল। দেওয়ালের কাছে কোনওমতে পৌঁছাতেই সে একটা বড় বস্তা দেখতে পেল। বস্তার মুখ খোলা। অর্জুন সতর্ক হয়ে হাত বাড়াল।
.ঝোঁপের বাইরে বেরিয়ে আসতেই জোনাকি বলল, এখানে না লোকজন আসে।
কী করে বুঝলেন? অর্জুন পাশে এসে দাঁড়াল।
আপনি এখনও তুমি বলবেন না?
আমার জিভের দোষ। হ্যাঁ, কী বলছিলেন?
ওই দেখুন। সাহেব সিগারেট খান না। ওই করিমচাচা এই বয়সে নিশ্চয়ই দামি সিগারেট খাবেন না। আচ্ছা, ভূতেরা সিগারেট খায় কি না তা জানি না।
নিচু হয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা কুড়িয়ে নিল সে। বিদেশি সিগারেট। খালি। সে ওপরে তাকাল। একটা আমগাছের লম্বা ডাল এদিকে এগিয়ে এসেছে। একটা কাক সেখান থেকে উড়ে গেল। প্যাকেট ফেরত দিয়ে অর্জুন বলল, চলুন, এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও দরকার নেই। বাসা বাঁধতে পাখিরা যা পায় তাই তুলে নিয়ে আসে। হয়তো ওই প্যাকেটটাকেও এনেছিল। ডাল থেকে পড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
ওরা আবার বাইরে ফিরে এল। হানিফ বসে ছিল গাড়িতে। ওদের দেখে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বলল, স্যর, আমি আধঘণ্টার মধ্যে একটু ঘুরে আসব?
অর্জুনের খেয়াল হল। ওরা একসঙ্গে এসেছে। ফয়েজুর সাহেবের সঙ্গে সে লাঞ্চ করেছে কিন্তু হানিফকে খাবার দেওয়া হয়নি। সে বলল, সরি হানিফভাই। আপনি যদি খাওয়ার জন্যে যেতে চান তা হলে যেতে হবে না। ভেতরের ডাইনিং টেবিলে প্রচুর খাবার রয়েছে, ওখান থেকে খাবার নিন।
একটু ইতস্তত করেও হানিফ বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল।
জোনাকি বলল, এটা আমারই ভুল। হানিফ ভাইকে ডেকে খাবার দেওয়া উচিত ছিল। আসলে সাহেব সামনে থাকলে কীরকম গোলমাল হয়ে যায়!
ওঁর অফিসে কতদিন কাজ করছেন?
একবছর কমপ্লিট হয়েছে।
এক কাজ করুন। নিজে নিলে হানিফভাই নিশ্চয়ই কম নেবে। আপনি ওকে একটু হেল্প করুন। বেচারা কখন বাড়ি থেকে বের হয়েছে।
মাথা নেড়ে জোনাকি ভেতরে চলে গেলে অর্জুন করিমচাচার কাছে গিয়ে বসল। আজ ঘুম হচ্ছে না আমাদের জন্যে, তাই তো?
দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিল মানুষটা। মাথা নাড়ল, ঘুম ছাড়া তো আর কিছু করার নেই। বুড়ো মানুষদের কেউ কাজের লোক ভাবে না। এই দেখুন না। ফয়েজুর আসল, কতক্ষণ থাকল, আমার সঙ্গে কথা বলার দরকারই মনে করল না। তবে হ্যাঁ, মাইনের টাকা ঠিক সময়ে পাঠিয়ে দেয় বছরের পর বছর।
ফয়েজুর সাহেবকে তো আপনি ছোটবেলা থেকে দেখছেন?
এই বাসায় তো জন্মাল। দু’বছর বয়স থেকে আমার কাঁধে ঘুরে বেড়াত। তবে তার চাচাতো ভাইটা যখন একটু বড় হল, আমার সঙ্গে ঘুরতে শুরু করল, তখন ফয়েজ খুব অভিমান করত। হে হে হে। বৃদ্ধ ফোকলা দাঁতে হাসল।
ওঁর চাচাতো ভাই-এর সঙ্গে পরে দেখা হয়েছে আপনার? শুনেছি অল্প বয়সেই সে হাসপাতাল থেকে হারিয়ে যায়। অর্জুন তাকাল করিমচাচার দিকে।
বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করে বসে থাকল। দুলতে লাগল শরীর। জবাব দিল না।
তাকে এখন দেখলে আপনি চিনতে পারবেন কি? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
মানুষের শরীর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যতই বদলাক, মনের টান থাকলে ঠিক চেনা যায়। তবে এখন তো চোখে ঝাপসা দেখি, এর সঙ্গে ওকে গুলিয়ে ফেলি! মাথাও কাজ করে না। কী করব!
এরকম কাউকে দেখে শেষ কবে মনে হয়েছিল?
চোখ খুলল করিমচাচা, বাবু, আপনি কে ঠিক করে বলুন তো?
আবার প্রশ্নটা করছেন কেন?
আমার মনে হচ্ছে আপনি কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছেন। ফয়েজ সাপগুলোকে মেরে ফেলতে চাইছিল, আপনি মারতে দিলেন না। বাসার সর্বত্র ঘুরে ঘুরে দেখছেন। আপনি কী করেন?
সত্যসন্ধান।
একটু ভাবল করিমচাচা। তারপর বলল, বড় কঠিন কাজ। আপনারা পড়ালেখা করা মানুষ, কত জানেন! আমি তার কিছুই জানি না। শুধু জানি গাছ থেকে যখন ফল ঝরে পড়ে তখন তা গাছের গোড়ায় এসে পড়ে না, চারপাশের মাটিতে ছড়িয়ে থাকে। তাই সত্যটা ঠিক কোথায় পাওয়া যাবে তাই নিয়ে তো এত সমস্যা!
.হানিফের খাওয়া শেষ হলে জোনাকি বেরিয়ে এল। বলল, সাহেব যা খাবার এনেছেন তাতে চারজনের ডিনারও হয়ে যাবে।
আপনি এখানে ডিনার খাবেন বলে ভাবছেন? অর্জুন হাসল।
না না, একদম না। দ্রুত মাথা নাড়ল জোনাকি।
আচ্ছা জোনাকি, এই যে আপনি এতক্ষণ এখানে আছেন, চারপাশে ভূত দূরের কথা ভূতের ছায়াকেও দেখতে পেয়েছেন?
না।
তা হলে ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনি কি ভাবছেন, অন্ধকার হলেই তারা বাড়িটার দখল নেবে? যদি নেয় তা হলে সেটা দেখাও তো একটা অভিজ্ঞতা হবে।
না না। আমি এসবের মধ্যে নেই। জোনাকি প্রবলভাবে মাথা নাড়ল।
এইসময় ঠুকঠুক করে লাঠির আওয়াজ তুলে করিমচাচা বেরিয়ে এল। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আপনি চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ বাবু। যে পথটা আগে পাঁচ মিনিটে যেতে পারতাম সেটা যেতে এখন আধঘণ্টা লাগে। এই চাবিটা রাখুন। গেটের চাবি। ফয়েজকে দিয়ে দেবেন। যাওয়ার সময় তালা লাগাতে যেন ভুলবেন না। আমার কাছে আর একটা চাবি আছে।
চাবিটা নিয়ে অর্জুন বলল, দাঁড়ান। হানিফভাই, আপনি যদি করিমচাচাকে ওঁর বাসায় পৌঁছে দেন–!
নিশ্চয়ই। হানিফ পেছনের দরজা খুলে দিল।
না না। আমি তো রোজ যাওয়া-আসা করি। কোনও অসুবিধে হবে না। তা ছাড়া আমি তো এই জীবনে কখনও গাড়িতে ওঠার সুযোগ পাইনি, মরণকালে আর কেন!
আমি যা বলছি তাই শুনুন। উঠুন গাড়িতে। অর্জুনের ধমক খেয়ে করিমচাচা গাড়িতে ঢুকে জড়সড় হয়ে বসে থাকল।
গাড়ি বেরিয়ে গেলে অর্জুন বলল, সামনেই তো মেঘনা নদী, চলুন, নদীটাকে দেখে আসি।
জোনাকি যেন স্বস্তি পেল। বলল, চলুন।
রাস্তার একটু পরে যে নদীর বাঁধ। বাঁধে উঠে মেঘনা নদী দেখতে পেল ওরা। জল কম, মাঝে মাঝে চর জেগে উঠেছে। জোনাকি বেশ খুশি হয়ে হেঁটে যাচ্ছিল বাঁধের ওপর দিয়ে। অর্জুন চারপাশে তাকাল। একটু এগোতেই নদীর গায়ে বাঁধের খাঁজে ঢোকানো নৌকাটাকে দেখতে পেল। জলের স্রোতে যাতে ভেসে না যায় তাই হয়তো খাঁজের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। সে সাবধানে নীচে নেমে নৌকার পাশে গিয়ে দেখল ভেতরটা ত্রিপলে ঢাকা রয়েছে।
অর্জুন চারপাশে তাকাল। কোথাও কোনও মানুষ দেখা যাচ্ছে না। দূরের বাঁধের ওপর জোনাকি দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। করিমচাচার কথা মনে পড়ল। গাছের ফল সবসময় গোড়ায় পড়ে না, চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। কথাটা কেন বলল বুড়ো মানুষটা। ফয়েজুর রহমানের বাড়ির রহস্য যদি কিছু থাকে তা হলে সেটা বাড়িতেই যেমন খুঁজে পাওয়া যাবে, বাড়ির বাইরেও পাওয়া যেতে পারে। তার মানে কি করিমচাচা সব জানে। জেনেও না জানার ভান করে থাকে? না, মানুষটাকে অভিনেতা হিসাবে মনে হচ্ছে না অর্জুনের।
বাঁধের পাথরের ওপর পা ফেলে নৌকোর পাশে চলে এসে ত্রিপলের বাঁধন খুলল অর্জুন। ঠিক তখনই হেঁড়ে গলায় একজন চেঁচিয়ে উঠল, হেই, কে রে? কে নৌকায় হাত দেয়। চুরি করার মতলব নাকি?
অর্জুন দেখল বাঁধের ওপাশ থেকে উঠে আসছে একটা লোক। বলিষ্ঠ দেহ। পরনের লুঙ্গি ভাঁজ করে ওপরে তোলা, খালি গা। হাতে লাঠি।
নৌকার কাছে এসে রুক্ষ গলায় জিজ্ঞাসা করল, কী চাই? লোকটার চোখ টকটকে লাল, মুখভরতি কাঁচাপাকা দাড়ি। নৌকাটা পড়ে আছে বলে দেখছিলাম!
আপনার বাপের নৌকা যে দেখছিলেন?
এ নৌকা আমার। আবার হাত দেন ত্রিপলে, এই লাঠির এক বাড়িতে হাড় ভেঙে দেব। লোকটা গজরাল।
আপনি মিছিমিছি উত্তেজিত হচ্ছেন। এত রাগ শরীরের পক্ষে ভাল নয়।
কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল লোকটা। সম্ভবত কথাগুলো খারাপ ছিল। তারপর বলল, দেখে তো মনে হয় ভদ্দরলোকের ছেলে। যান এখান থেকে।
ঝামেলা না বাড়িয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসতেই জোনাকি ছুটে এল, কী হয়েছে? লোকটা চেঁচাচ্ছিল কেন?
তেমন কিছু নয়। বোধহয় মাথার গোলমাল আছে। অর্জুন দেখল লোকটা বেশ কসরত করে নৌকাটাকে জলে নামাল। তারপর লগি বেয়ে ডানদিকে ঝোঁপের আড়ালে চলে গেল। অর্জুন মাথা নাড়ল, চমৎকার!
.বিকেল পৌনে চারটের সময় অর্জুন জোনাকিকে বলল, এবার আপনি রওনা হন। আকাশে মেঘ জমছে। তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে যাবে।
আপনি যাবেন না? জোনাকি অবাক হল।
না। আজ রাত্রে আমি এখানে থাকব।
সেকী! না না। এই ভুল দয়া করে করবেন না। ফিরে চলুন।
জোনাকি, আমি যে জন্যে বাংলাদেশে এসেছি সেই কাজটা দয়া করে করতে দিন। আপনি ভয় পাচ্ছেন, আপনার এখানে থাকা উচিত হবে না।
করিমচাচাকে পৌঁছে দিয়ে হানিফ গেটের বাইরেই গাড়ি রেখেছিল। সে বলল, খুব ঝড়বৃষ্টি হবে।
হ্যাঁ। জোনাকি, চলে যান।
দাঁড়ান। মোবাইল বের করে বোম টিপল জোনাকি, স্যর, আমি জোনাকি। আমরা এখান থেকে যাচ্ছি কিন্তু অর্জুনবাবু থেকে যাবেন বলছেন। ওপাশের কথা শুনে সে আবার বলল, আমার রিকোয়েস্ট উনি শুনছেন না স্যর। তারপর যন্ত্রটা এগিয়ে দিল অর্জুনের দিকে, সাহেব!
অর্জুন ফোন হাতে নিয়ে বলল, বলুন!
আরে। আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? করিমচাচার মতো পোড়খাওয়া মানুষ রাত্রে ওখানে থাকতে চায় না, আপনি কী করে থাকবেন। না ভাই, কোনও দুর্ঘটনা হোক আমি চাই না। আপনি চলে আসুন। ফয়েজুর রহমান বললেন।
দেখুন, কোনও কেস হাতে নিলে আমি নিজের মতো কাজ করি। ক্লায়েন্টের ইন্টারফেয়ারেন্স পছন্দ করি না। এটা অমলদাকে ফোন করলে জানতে পারবেন।
কিন্তু–।
শুনুন। আপনি যদি আমাকে আমার মতো কাজ করতে না দেন তা হলে আমি ফিরে যাচ্ছি। আজ রাত্রে কলকাতায় ফিরে যাওয়ার টিকিট কেটে রাখুন।
ওকে! ওকে! আমি ভাল চেয়েছিলাম। আমি হানিফকে বলব কি আজ আপনার সঙ্গে থেকে যেতে?
হানিফ থাকলে জোনাকিকে কে ঢাকায় পৌঁছে দেবে! ওরা যাক। রাখছি। ফোন ফেরত দিয়ে অর্জুন হানিফকে ইশারা করল চলে যেতে। মুখ কালো করে জোনাকি গাড়ির সামনের আসনে গিয়ে বসল। গাড়ি বেরিয়ে গেল।
গেটে তালা লাগিয়ে গ্যারাজের দরজা খুলল অর্জুন। তারপর লরির পেছনের চাকা দুটোয় হাওয়া যাতে বেরিয়ে যায় তার ব্যবস্থা করল। লরি পেছনের দিকে একটু নিচু হয়ে গেল। গ্যারাজের দরজা বন্ধ করে সে দ্রুত বাড়ির পেছনের বুনো ঝোঁপের পাশে চলে এল। এক ফোঁটা বৃষ্টির জল গায়ে পড়ল। অর্জুন দ্রুত বস্তার মুখ খুলতেই দড়ি দেখতে পেল। দুটো দড়ি পাশাপাশি, মাঝে ছোট ছোট দড়ি বেঁধে জোড়া হয়েছে। দড়ির ওপরের প্রান্তে দুটো হুক আটকানো। ওই হুক দুটো ওপরের কিছুতে আটকে দিলে দড়ির সিঁড়ি হয়ে যায়। গেটের চাবি দিয়ে অর্জুন দু’পাশের দড়ির কয়েকটা জায়গা এমনভাবে আলগা করে দিল যাতে চাপ পড়লে ছিঁড়ে যায়। তারপর আবার যেভাবে রাখা ছিল সেইভাবে বস্তাবন্দি করে দৌড়ে সামনের বারান্দায় ফিরে আসতে আসতেই বৃষ্টি জোরে নেমে গেল। ক্রমশ চোখের সামনের পৃথিবী সাদা হয়ে গেল। ঝড় প্রবলভাবে নাচাচ্ছে গাছগুলোকে।
ভেতরে ঢুকল অর্জুন। এখনই ভেতরটায় অন্ধকার পাতলা হয়ে নেমেছে। সে দরজা বন্ধ করল। এই বাড়িতে নিশ্চয়ই ইলেকট্রিসিটি আছে। কিন্তু আলো জ্বালা যাবে না। এমনকী হারিকেনের আলোও নয়। পাতলা অন্ধকারে সে হাতড়ে হাতড়ে ডাইনিং রুমে চলে এল। দুপুরে খাওয়ার সময় সে পেছনের সেলফের ওপরে একটা টর্চ লাইট দেখেছিল। সেটা হাতে নিয়ে জামার আড়ালে রেখে সুইচ টিপতেই আলো জ্বলতে দেখে নিভিয়ে ফেলল অর্জুন। মাথা নাড়ল সে, এটাই যথেষ্ট। তারপর সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে এল। দোতলায় তবু বাইরের কমে যাওয়া আলোর কিছুটা ঢুকছে। একদম শেষের ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে চট করে টর্চের আলো জ্বেলেই নিভিয়ে ফেলল। এই ঘরে কোনও আসবাব নেই। অর্জুন আবার আলো জ্বেলে জানলাগুলো বুঝে নিয়ে নিভিয়ে ফেলল। জানলায় কাচ নেই। তাই বাইরে থেকে ঘরে জ্বলে ওঠা টর্চের আলো দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে না। তবু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সে ধীরে ধীরে বাগানের দিকের জানলা খোলার চেষ্টা করল। দীর্ঘকাল না খোলার কারণে পাল্লা ভয়ানক এঁটে গিয়েছে।
খানিকটা টানাটানির পর পাল্লা খুলল। কিন্তু মাত্র দুই ইঞ্চি ফাঁক রাখল অর্জুন। নীচ থেকে দেখলে চট করে বোঝা যাবে না জানলা খোলা আছে। সেই ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে প্রথমে কিছুই দেখতে পেল না। বৃষ্টির ধারা সব আড়াল করে দিয়েছে। অ্যাসিড যতই ঝাঝালো হোক, এই বৃষ্টির জলে সব ধুয়ে ভেসে যাওয়াই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে সাপগুলো ফিরে এসে তাদের রাজ্য দখল করে নিতেই পারে। করিমচাচা বলেছে, ওরা বাড়ির ভেতর ঢোকে না। ব্যাপারটাকে বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। পরিত্যক্ত বাড়ি সাপেদের খুব প্রিয় আস্তানা।
কিন্তু এভাবে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। ঘরে কোনও আসবাব না থাকায় বসার সুযোগও নেই। এইসময় হাওয়া প্রবল হওয়ায় জানলার কপাট বন্ধ হয়ে গেল। অর্জুন ওটাকে আবার খুলতেই বিদ্যুৎ চমকাল। আর তখনই গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ কানে এল। বৃষ্টি ও বাতাসের শব্দে সেই আওয়াজ চাপা পড়ে যাচ্ছিল। প্রথমে অর্জুনের মনে হয়েছিল কোনও গাড়ি এই বাড়ির দিকে আসছে। জোনাকিরা আসছে না তো? মেয়েটা তাকে একা ফেলে যেতে চায় না বলেই বোধহয় হানিফকে জোর করে ফিরিয়ে এনেছে। কিন্তু গাড়ি এলে তো তার হেডলাইট জ্বলবে। জানলা থেকে সেই আলো চোখে পড়বেই।
বাতাসের দাপট একটু কমতেই ইঞ্জিনের আওয়াজের উৎসটা বুঝতে পারল অর্জুন। আওয়াজটা ভেসে আসছে গ্যারাজ থেকে। আর যে ইঞ্জিন চালু করেছে সে আলো জ্বলেনি। বিদ্যুতের আলোয় অর্জুন দেখল গ্যারাজের দরজা বন্ধ। ব্যাপারটা রহস্যময়। দরজা না খুলে ইঞ্জিন চালু করেছে এবং লরি বাইরে আসছে না। এবার আওয়াজ থেমে গেল। শুধু জল পড়ার শব্দ, একটানা।
অর্জুন অন্যমনস্ক হল। ব্যাপারটা ভৌতিক হতে পারে না। কোনও ভূত কি গাড়ি চালাতে পারে? কিন্তু চাকায় হাওয়া না থাকলেও লরিটাকে তো ড্রাইভার বাইরে বের করে আনতে পারত। লরিটাকে কি বাইরে বের করার ইচ্ছে ড্রাইভারের নেই? হঠাৎ খেয়াল হল। জলপাইগুড়িতে তাদের পাড়ার এক বৃদ্ধের পুরনো অস্টিন গাড়ি ছিল। ভদ্রলোক নিজে চালাতে সাহসী ছিলেন না। মাসের পর মাস গাড়ি তার গ্যারাজেই পড়ে থাকত। কিন্তু সেই বৃদ্ধ প্রত্যেক বিকেলে গ্যারাজে ঢুকে গাড়িতে স্টার্ট দিতেন দশ মিনিট ধরে। মাঝে মাঝে আওয়াজ বাড়াতেন, আবার কমাতেন। ইঞ্জিন বন্ধ করে আবার চালু করতেন। দশ মিনিট পরে গ্যারাজ বন্ধ করে বাড়ির বারান্দায় গিয়ে বসতেন। অর্জুন একদিন কারণ জিজ্ঞাসা করলে বৃদ্ধ ফোকলা হাসি হেসে বলেছিলেন, নাইনটিন ফিফটি টুর গাড়ি। সব ভাল আছে। শুধু ব্যাটারিটাই গোলমাল করছে। রোজ স্টার্ট না দিলে ব্যাটা ডাউন হয়ে যাবে। আমি তাই চালু করে রাখছি। কখন গাড়িটা কাজে লাগে কে জানে? বৃদ্ধের জীবদ্দশায় ওই গাড়ি কাজে লাগেনি।
এই গাড়িরও কি সেই হাল? কালকে যদি বেরিয়ে থাকে তা হলে তো ব্যাটারি ডাউন হওয়ার কথা নয়। তবে অবস্থা খুব খারাপ হলে প্রতিদিন চার্জ করতেই হয়। আজ বেরুবে না বলে দরজা খোলার দরকার হয়নি। চাকায় যে হাওয়া নেই সে খবরও ড্রাইভার জানে না।
অর্জুন আবার জানলার ফাঁক দিয়ে গ্যারাজের দিকে তাকাল। তাকে বিদ্যুতের আলোর জন্যে অপেক্ষা করতে হল। দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে কোনও আওয়াজ আসছে না। ঠোঁট কামড়াল অর্জুন। যে ভেতরে ঢুকেছিল সে নিশ্চয়ই এর মধ্যে বেরিয়ে গেছে। অন্যমনস্ক না থাকলেও এই বৃষ্টিতে তাকে দেখতে পেত না সে যদি না সেইসময় বিদ্যুৎ না চমকাত।