১. একটি শিশিরবিন্দু
শিশির অফুরন্ত………………………………………………………………………………………………….
হ্যাশ এবং হুস্ন ; মেরি ও মেরিহুইনা; পাতা আর পতন; বিদেশিনী ও ছিনিমিনি । দু-মাসের মাইনে নিয়ে একমাসের জন্য চলে এসো । তাড়াতাড়ি।………………………………………………………………………………………………………
অতুল মূর্খ
আতুলদাস মুখোপাধ্যায়ের মেয়ের মেয়ে, অর্থাৎ নাতনি, ইন্দিরা ব্যানার্জি, শিশির দত্ত নামে কোনো একজনের নামে, বর্ধমানের ঠিকানায় লেখা পোস্টকার্ডটা, যাতে তারিখ নেই কিন্তু পোস্টঅফিসের ছাপ থেকে তার জন্মেরও আগের বলে মনে হয়েছে, প্রয়াত দাদুর একটা ডায়েরির মধ্যে পাবার পর, কৌতুহলবশে শিশির দত্তকে পোস্টকার্ডের জেরক্সসহ চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিল, তিনি এ-ব্যাপারে আলো ফেলতে পারেন কিনা ।
বাংলা পড়তে-লিখতে জানে না বলে ইন্দিরা ব্যানার্জি ইংরেজিতে জানিয়েছিল যে, রেক্সিনে বাঁধানো খাতাটি, অর্থাৎ ডায়েরিতে, তিনরকমের হাতের লেখা রয়েছে, একজনের অংশই বেশি ;তবে সনতারিখ দেয়া রোজনামচা নয় । মা-বাবা, বড়মামা ও তাঁর পাঞ্জাবি স্ত্রী, ছোটোমামা, কেউই বাংলা জানেন না । দিদিমা কেবল জানেন, কিন্তু তাঁকে বা অন্য কাউকে পড়তে দিলে ঝামেলা হলেও হতে পারে । ই-মেল আইডি পাঠিয়ে যোগাযোগ করতে বলেছে ইন্দিরা ।
বর্ধমানের আদিবাড়ি বেচে বহুকাল আগে কলকাতায় চলে এসেছেন শিশির দত্ত, যিনি এখন সল্টলেকের বাড়িতে দোতলায় চব্বিশঘন্টা দিন-মাইনের নার্স-আয়ার রুটিনবদ্ধ পরিচর্যায় থাকেন, দেড় বছর হল পক্ষাঘাতে বিছানায় । শিশির দত্তের স্ত্রী, যিনি শিশির দত্তের চেয়ে তেরো বছরের ছোট, প্রেম করেই বিয়ে করেছিলেন, পুজো-টিভি-প্রৌঢ়াদের আড্ডায় ব্যস্ত । মেয়ে ঝিমলি বিয়ে করে সফটওয়ার ইনজিনিয়ার স্বামী আর ছেলের সঙ্গে বেঙ্গালুরুতে ।
রিডায়রেক্ট হয়ে বর্ধমান থেকে ইন্দিরার চিঠি শিশির দত্তর সল্টলেকের বাড়িতে পৌঁছতে একমাস লেগেছিল । ছেলে, বহুজাতিকে মার্কেটিং অফিসার সুবীর, যে বাবার সঞ্চয়, ইনকাম ট্যাক্স, নিবেশের ওয়ারেন্ট, চিঠিপত্র ইত্যাদি সামলায়, ইন্দিরার সঙ্গে যোগাযোগ করে, নিয়মিত চ্যাটিং, ফোটো এম এম এস, এমেলে ফোটো আপলোড ও ফ্লার্ট করার শেষে ডায়েরির রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য মাস ছয়েক পরে, অফিসের কাজ নিয়ে মুম্বাইয়ে, ইন্দিরার প্রভাদেবী পাড়ার বহুতল ফ্ল্যাটের কাছে ওরলিতে হোটেলে উঠেছে ।
কমপিউটর মনিটর আর মোবাইল স্ক্রিনে যেমন দেখেছিল, কন্ঠস্বর যেমন শুনেছিল, তার চেয়ে পরস্পরকে বেশি আকর্ষক মনে হল সুবীর ইন্দিরার, বান্দ্রার উডিপি রেস্তরাঁয় অফিস-ফেরত বড়া-পাও খেতে-খেতে । সুবি আর দিরা, ডাকনামের আদানপ্রদান হয়ে গেছে এসএমএস, ইমেল, স্কাইপ, চ্যাটিং পর্বের শুরুতেই ।
প্রথম সাক্ষাতে ওরা বেশ কয়েকটা নির্ণয় নিয়ে নিল, প্রজেক্ট রিপোর্ট তৈরির ধাঁচে । চ্যাটিং আর ইমেল স্কাইপে মোবাইলে যা এতদিন ইউ পর্যায়ে ছিল, তা এবার বাংলায় তুমি সম্বোধনে রূপান্তরিত হোক । অফিসের পর প্রতিদিন কোথায় দেখা হবে তা দুপুরে ফোন করে ঠিক করা হবে । ইতিমধ্যে হাতের লেখার পার্ধক্য অনুযায়ী এক-দুই-তিন-চার করে ডায়েরিতে সংখ্যাচিহ্ণ বসিয়ে দিক ইন্দিরা ; বাংলা পড়তে না জানলেও হাতের লেখার পার্থক্য দেখে বর্গীকরণ করতে অসুবিধা হবে না । শনিবার সন্ধ্যায় দাদরের সমুদ্রতীরে, যেখানে বহু বেহায়া যুবক-যুবতী অশালীন ডেটিং করে, ওরাও করবে ; পাঁচতারা হোটেলের রেস্তরাঁর তুলনায় এই প্লেবিয়ান ডেটিঙের পৃথক যৌনতাবোধ আছে, বেশ আদিম-আদিম ।
ইন্দিরা দুবছর আগে এক গুজরাতি যুবককে বিয়ে করে ছ’মাস পরে ডিভোর্স করে দিয়ে থাকলেও, সুবীর ওদের বাড়িতে রবিবার নিমন্ত্রিত হয়ে ইন্দিরার মা-বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখবে । ইন্দিরা চেয়েছিল ওরা লিভ-টুগেদার করে কয়েক বছর থেকে নিক; পছন্দ হলে বিয়ে করে নেবে নয়তো যে যার যেদিকে ইচ্ছে চলে যাবে । সুবীর প্রত্যুত্তরে জানিয়েছে বনিবনা না হলে ডিভোর্স করে আলাদা হয়ে যাওয়া ভালো ; নয়তো আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে মেলামেশা আর মধ্যবিত্ত সমাজে চলাফেরা গোলমেলে হয়ে উঠতে পারে । শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছে যে বিয়ে করে নিলেও তার আগে কোর্টের কাগজে চুক্তি সই করে নেবে যে ডিভোর্স হলে টাকাকড়ি ভাগাভাগি হবে না, ছেলেপুলে হবে না আপাতত পাঁচ বছর । সোমবার ছুটি নিয়ে সুবীরের হোটেলঘরে সকাল থেকে ডায়েরির রহস্য উদ্ধারে দুজনে মাথা ঘামাবে ।
বছর তেইশের ইন্দিরা ব্যানার্জি তেমন ফর্সা নয় । পাতলা ঠোট, ববকাট গ্লোবাল রঙের চুল, পাতলা ফ্রেমের চশমায় ওর বুদ্ধির দীপ্তি আরও উজ্জ্বল । সব সময় রঙিন টপ, ফেডেড জিনস, টপের রঙে ম্যাচিং স্পোর্টস জুতো । দু’হাত নাড়িয়ে কথা বলার অভ্যাস, যার অধিকাংশ শব্দ ইংরেজি, যৎকিঞ্চিৎ বলিউডি হিন্দির মিশেল দেয়া । মাছভাত ভালোবাসে । বিয়ে করলে বাঙালি মতে বিয়ে করতে চায় ; গুজরাতি বিয়ের আচার-খাওয়া দাওয়া পছন্দ হয়নি ।
ইন্দিরা রুপারেল কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক হবার পর বিজ্ঞাপনে ডিপ্লোমা করে যে কোম্পানিতে কাজ করছে, তারা ওকে কলকাতা অফিসে গিয়ে দায়িত্ব নিতে বললেও, এতকাল রাজি হয়নি, চেনাজানা মহল নেই বলে । সুবীরের মনে হয়েছে মেয়েটা জেদি আর আত্মবিশ্বাসী ।
সুবীরের মধ্যবিত্ত বাঙালিয়ানা, যা ওর স্যুট-টাই ল্যাপটপেও আড়াল পড়ে না, আকর্ষণ করেছে ইন্দিরাকে । বাবা শিশির দত্ত গিটার বাজাতেন , শিশিরকেও গিটার বাজানো শিখিয়েছেন । বাবা গিটারে পাশ্চাত্য সুর ভালোবাসতেন । সুবীর পাশ্চাত্য ব্যান্ডগুলোর গান ভালোবাসে কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরও গিটারে বাজাতে ভালোবাসে । সুবীর সবরকম খাবার খেতেই ভালোবাসে ; তাইওয়ানে অফিসের কাজে গিয়ে বেঁজি-বিড়াল-কুকুরের মাংসও খেয়েছে ।জিম-যাওয়া ফর্সা ছয়ফিটের উদারস্বভাব সুবীরকে নিজের পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চের সঙ্গে মানানসই লেগেছে ইন্দিরার । গুজরাতি বর হিমেশ ওর চেয়ে একইঞ্চ ছোটো ছিল ; ফর্সা ছিল না, যদিও অঢেল টাকাকড়ি ওদের পরিবারে । বনিবনা হয়নি ওরা বড় রক্ষণশীল পরিবার, তাই ; এমনকি ওদের ঠাকুর দেবতাগুলোও অচেনা-অজানা ।
কাফে কফি ডে, বারিস্তা, ইরানি হোটেল ইত্যাদিতে অফিস ফেরত কুচিকুর পর, শনিবারের ডেটিঙে ওরা খুশি । দাদর সমুদ্রতীরের অন্ধকারে সবাই যা করে, ওরা-ও তা-ই করেছে । বালিতে তোয়ালে পেতে দেয়ালে ঠেসান দিয়ে বসেছে । আকাশে তারা উঠলে, সুবীরের কোলে বসেছে ইন্দিরা ।
রবিবারের লাঞ্চে ইন্দিরাদের বাড়ি গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে, সুবীরকে ইন্দিরার মা-বাবা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেছেন, সম্ভবত ডিভোর্সি মেয়ে এত ভাল বাঙালি বর পাচ্ছে বলে । সুবীরের পড়াশুনা, চাকরি, মাইনে, গাড়ি, ফ্ল্যাট ইত্যাদি জেনে ওনারা সন্তুষ্ট । ফ্ল্যাটটা ইন্দিরার দিদিমার, যিনি প্রায়-বধির বলে ওনার ঘরে জোরে টিভি চালিয়ে শাহরুখ খানের প্রেমডান্স বা সলমান খানের মারামারি দেখছেন ।
পাশের ফ্ল্যাট থেকে বড়মামা-মামি দেখা করে গেলেন । দুজনেই সোনি টিভির সিরিয়ালে অভিনয় করেন । হিন্দি সিরিয়াল সুবীর দেখে না, সংবাদ ছাড়া টিভিতে ও প্রায় কিছুই দেখে না, সৌজন্য দেখিয়ে ওনাদের অভিনয়ের প্রশংসা করল । স্ত্রী পাঞ্জাবি টিভি-সুন্দরী, প্রধানত খলনায়িকার অভিনয় করেন । বড়মামা বেশ ফর্সা, সায়েবি-রঙের ফর্সা, ঢ্যাঙা, তবে নায়ক-টাইপ মুখ নয়; না হলেও নায়কের অভিনয় দিয়ে শুরু করেছিলেন । মাইমা পাঞ্জাবি হবার দরুণ হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বললেন ।
ছোটোমামা, যিনি নাকি দেখতে-শুনতে ভাল, একসাইজ বিভাগে বড়সড় পদে, থাকেন বান্দ্রার সরকারি আবাসনে, বিয়ে করেননি, করবেন না । কতবার যে প্রেম করেছেন সেই কলেজের দিন থেকে, দিদিমাও বিরক্ত, বলেন তোর গায়ে রক্তের দোষ । কেউ প্রসঙ্গ তুললে বলেন, অলওয়েজ সিঙ্গল রেডি টু মিঙ্গল থাকতে চান ।
সোমবার ডায়েরিতে সংখ্যাচিহ্ণ বসিয়ে-বসিয়ে, সুবীরের হোটেলের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে পৌঁছে গেল ইন্দিরা, বাড়ি থেকে ব্রেকফাস্ট করে । টেবিলে ঠ্যাং তুলে, সোফায় হেলান দিয়ে, রেক্সিনে বাঁধানো খাতা বা ডায়েরি পড়া শুরু করল সুবীর । বিছানায় পা ছড়িয়ে, দেয়ালে বালিশ উঁচু করে, ঠেসান দিয়ে ইন্দিরা । শুনছে চোখ বুজে । এসি চলছে সুইঙে । চুমুক দেবার জন্যে বিয়ারের আধ ডজন টিন ।
লেখাটা আমি এই নিয়ে চারবার পড়লুম । এতদিনে পড়ার ফুরসত হল । মেয়ে আর ছেলেরা বড় হয়েছে । যে যার কাজে-টাজে ব্যস্ত । আমি ঝাড়া হাত-পা । অবশ্য, কাছের জিনিস দেখার চশমা নিতে হয়েছে আজ আট বছর । কানেও কম শুনি, এক কালে ফি হপ্তায় সিনেমা হলে গিয়ে ফিলিম দেখার ফল । কদিন ধরে ঘর বন্ধ করে পড়লুম । পড়ে মনে হচ্ছে, আমারও অনেক কথা বলার আছে । ফাঁকে-ফাঁকে যেখানটায় লেখা হয়নি, শিশির আর নির্মলের বাবা যে পাতাগুলো ছেড়ে দিয়েছে; হয়ত আমার জন্যেই । সেখানে আমার কথাগুলো ঢোকাবো । অগাকান্ত বজ্জাতটা এসব লিখতে গেল কেন জানি না । বোধহয় লেখারও একটা মজা আছে, সব ঘটনা আরেকবার করে ঘটিয়ে তোলা যায় । কিন্তু লিখলি তো লিখলি, এই বিদকুটে মাস্টারি-মার্কা বাংলায় কেন ? সোজা বাংলায় লিখতে গেলে নোংরা করে ফেলতিস, তাই না ? যা একখানা নোংরা কিসিমের ইচ্ছুক ছিলিস তুই ! জানিস শিশু, আজও তোর দেয়া সেই দিনগুলোর কথা ভাবলেই শরীর আনচান করে, তোকে খুঁজে বের করতে ইচ্ছে করে, আরেকবার দুজনে ইচ্ছুক-ইচ্ছুকনি হয়ে ওঠার খাঁই জাগে ।
জীবনটা যে মাংসের উৎসব তা কেন মেনে নেয় না লোকে । আমার শরীরের রক্তমাংসে আমি উৎসব ঘটাব তো তাতে কার কী করার আছে ! বেঁচে থাকা ব্যাপারটা হল এই উৎসবকে সারা জীবন ধরে পালন করে যাওয়া । অবিরাম, অবিরাম, অবিরাম । মনের শান্তি এছাড়া কেমন করেই বা পাবো, কেউ বোঝাক আমাকে । জীবন তো একবারই । তাহলে নিজের জন্যে বাঁচব না কেন ? পল থেকে পল, সবসময় নতুন ; শিশির দেখিয়ে গিয়েছিল সেই পথটা , যে পথটা আমি জানতেই পারিনি শিশিরকে পাবার আগে । ভালবাসা ভালবাসা ভালবাসা ভালবাসা । উন্মাদিনীরা ছাড়া ভালোবাসার কথা আর কেউ বলতে পারে না । নিজেকে ভালবাস, হ্যাঁ, নিজেকে নিজেকে, আর অমন ভালবাসার জন্যে যা ইচ্ছা হয় করো ; ভালবাসার জন্যে বেপরোয়া হতে হবে ।
সৌভাগ্য, যে অতুলের পোস্টকার্ডটি নির্মলদা, আমাদের পাড়ায় যিনি ডাকে-আসা চিঠি বিলি করেন, আমার হাতেই দিয়াছিলেন । বাড়িতে দিবার জন্য বাবার নামে ডাকে-আসা চিঠিগুলি নির্মলদা কিন্তু আমাকে না দিয়া গেটে বসানো কাঠের লেটারবক্সে ফেলিলেন । পোস্টকার্ডটি যে নির্মলদা পড়িয়াছিলেন সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত, নতুবা চিঠিটি আমার হাতেই বা কেন গুঁজিয়া দিবেন । ভালই । বেনারসে কোনো অঘটন ঘটিয়া গেলে যদি গৃহে প্রত্যাবর্তন করিতে না পারি, নির্মলদা আমার বেনারস-অ্যাডভেঞ্চারের সংবাদ মা-বাবাকে দিবেন ।
অফিসে ছুটি মঞ্জুর করাইতে পাঁচ দিন লাগিল । বাড়িতে বলিলাম বন্ধুগণের সহিত কাশ্মীরে বেড়াইতে যাইতেছি । গিটারটি সঙ্গে লইয়াছি, যাহাতে গৃহে সন্দেহের উদ্রেক না হয় ।
বেনারসের যে ঠিকানা অতুল দিয়াছিল, তাহা অতুলের স্হানীয় চিত্রকর বন্ধু নির্মল রক্ষিতের ছবি আঁকার স্টুডিও । বিশাল বনেদি বাড়ির একাংশ।
বাঙালিটোলার জীর্ণ পুরাতন পৈতৃক অট্টালিকার দীর্ঘ হলঘর রূপান্তরিত হইয়াছে নির্মলের ছবি আঁকার স্টুডিওয় । হলঘর-সংলগ্ন গেস্টরুমে আমার সুটকেসটি টেবিলে রাখিয়া নির্মল কহিল, আপনি স্নানাদি সারিয়া লউন, আমার একজন মডেল অপেকআ করিতেছেন, পেইনটিঙের আউটলাইনটি অদ্য সারিয়া লইব । তাহার পর আপনার কথা শুনিব । অতুল আমাকে আপনার আগমনের বার্তা দেয় নাই, তবে উহার মুখে আপনার গল্প শুনিয়াছি, গিটার বাদ্যের কথা শুনিয়াছি ।
ট্রেনের ক্লান্তি অপনোদনের জন্য ভালভাবে সাবান মাখিয়া, শ্যাম্পু করিয়া, স্নান সারিয়া, পোশাক পরিবর্তন করিয়া, অন্ধকার হলঘরে প্রবেশান্তে চোখ ধাঁধাইয়া গেল ।
অন্ধকার হলঘরে স্ট্যান্ড-বাতির বৈদ্যুতিক আলো যাঁহাকে ফোকাস করিয়াছে, তিনি সম্পূর্ণ উলঙ্গ একজন যুবতী শ্বেতাঙ্গিনী, পুরাতন অ্যান্টিক সোফায় হেলান দিয়া, পা ছড়াইয়া, পোজ দিয়াছেন , এবং নির্মল সিগারেট ফুঁকিতে-ফুঁকিতে একমনে তাঁহাকে ক্যানভাসে তুলিয়া আনিতেছে ।
অন্ধকারে, উহাদের অলক্ষ্যে, ছবি আঁকার বহুবিধ পরিত্যক্ত জঞ্জালের আড়ালে, টুলে বসিয়া পড়িলাম । নিঃশব্দে । রক্তমাংসের নগ্ন শ্বেতাঙ্গিনী যুবতীদেহ আমি ইতোপূর্বে দেখি নাই, আলিঙ্গনে পাওয়া তো দিবাস্বপ্ন । অমন একখানি মাখননির্মিত দেহ, সেই দেহের আলো, অন্তত কিয়ৎক্ষণের জন্য, নিজ তপ্ত নিয়ন্ত্রণে পাইব বলিয়া এতদূর ছুটিয়া আসিয়াছি ।
নির্মল, জানি না, কোন জাদুবলে নিজেকে নারীদেহের প্রতি উদাসীন ও নির্লিপ্ত এবং ছবি আঁকার প্রতি একাগ্র ও মগ্ন রাখিয়াছে । শ্বেতাঙ্গিনী ্ইতে এত তফাতে বসিয়াও আমার সরীর টাটাইয়া উঠিতেছে । আনকোরা উত্তেজনা দমনে হইতেছি উত্তাল ; শব্দ করিয়া ফেলিতে পারি এই আশঙ্কায় পায়ের উপর পাও রাখিলাম না ।
কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িবার সময়ে, সমস্বভাবী সহপাঠীগণের সহিত বিভিন্ন শহর ভ্রমণকালে, এবং কর্মোপলক্ষ্যে একা গিয়াও, নারীদেহের রুচিশীল সান্ধ্যবাজারে ঢুঁ মারিয়াছি । ভারতীয় নারীগণের নানাপ্রকার দেহ নাগালের অন্তর্গত করিয়াছি । এরূপও হইয়াছে যে যুবতীর দেহটি সম্পূণ বোধগম্য কিন্তু তাহার ভাষাটি নহে । অদ্য স্পষ্ট হইল যে আশ সম্পূর্ণ করিবার কিছু বাকি রহিয়া গিয়াছে ।
কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিবার পর ঘরের সোঁদাল গন্ধ নাকে আসিলে, নির্মল এবং বিদেশিনী মডেলের নির্লিপ্তির কারণ বোধগম্য হইল । উহারা নিঃসন্দেহে গাঁজাপাতা, মারিহুয়ানা অথবা চরস সেবন করিয়াছে । আমাদের বর্ধমানের বাড়ির পূর্বতন দারোয়ান সর্বসমক্ষে এই নেশা করিত বলিয়া চাকরি খোয়ায় । কোনও-কোনও গিটারসঙ্গীও গোপনে এই নেশা করে, বাজাইবার সময়ে একাগ্রতার উদ্দেশ্যে । আমি তেমন প্রয়োজন বোধ করি নাই ।
নির্মল কেবল আউটলাইন আঁকিতে ছাহিলে ভারতীয় নারীদেহ দিয়া কাজ চলিত । উহাতে পরে বা প্রতিদিনই মাংস ভরিবার কাজ চলিবে । নয় কি ? মনে প্রশ্ন উঠিল ।
ক্ষুধায় আমার পেট ডাকিতেছে । তবুও চক্ষের উজল-পাঁজল ক্ষুধা তাহার চেয়েও তীব্র । মনে হইতেছে এইভাবে নিজেকে গদগদ আহ্লাদের জ্যোতিতে আবরিত রাখি, এবং বিদেশিনীর দেহ হইতে নির্গত তেজোপূঞ্জ আহরণ করিয়া অবিনশ্বর করিয়া তুলি ওই আহ্লাদকে । এই ক্ষুধা না মিটিলেই যেন শ্রেয় ।
খেয়াল করিলাম, আমি এতক্ষণ কেবল বুক হইতে হাঁটু পর্যন্ত দৃষ্টির আনাগোনা সীমাবদ্ধ রাখিয়াছি । মুখশ্রীতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিলাম । গোলমুখ, চওড়া কপাল, ছোট-ছোট চক্ষুদ্বয়, সামান্য চাপা নাক, না-আঁচড়ানো সোনালি চুল । অর্থাৎ মুখটুকু দেখিলে এই নারী আকর্ষণ করিত না । শিল্পী চিত্রকর নির্মল রক্ষিত যে নৈপুণ্যে পোশাকের অন্তরালে গচ্ছিত রক্তমাংসের তুলতুলে দেহটিকে চিহ্ণিত করিয়া যুবতীটিকে স্টুডিওতে আহ্বান করিয়াছে, আমার সেই শৈল্পিক দক্ষতা নাই ।
যা হেরিতেছি, তাহার জন্য আমি নির্মলের নিকট কৃতজ্ঞ ।
অন্ধকারে স্বসৃষ্ট জ্যোতির ভিতর বসিয়া নির্নয় লইলাম যে আমার কাশীবাসের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করিব । কাহার জন্য, কী জন্য, জানি না । প্রথম দিনেই যখন এই আনন্দঘন অঘটন, আমি নিশ্চিত যে আরও প্রীতিপদ চমকদমক এবং তুরীয়তা অপেক্ষা করিতেছে । যে ঘরটিতে আছি তাহা যে নির্মলের প্রয়াত পিতার স্টাডিরুম, তাহাতে সন্দেহ নাই । যৎসামান্য লিখিত বহু ডায়েরি হইতে একটি হাতসাফাই করিব এবং তাহার পৃষ্ঠায় আমার অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করিব ।
পরে জানিলাম যে দেড় ঘন্টা টুলের উপর স্হানু ছিলাম, এবং পীতাভ-গোলাপি মাখনে নির্মিত স্তনযুগল, কটিদেশ, পদদ্বয়ের সঙ্গমস্হল, বাহুমূল ও উরুদ্বয় ঠায় দেখিয়াছি ; নিষ্পলক দেখিয়াছি, চক্ষের পাতা একমুহূর্ত বুজিলেও সেই মুহূর্তটি আর ফিরিয়া পাইব না । মাথার ন্যায় অন্যত্রও চুলের রঙ সোনালি !
বাড়ির বাহির হইতে নির্মলের নাম করিয়া কয়েকজনের ডাকে টনক আত্মস্হ হইল । টুল হইতে উঠিয়া পাশের ঘরে প্রবেশ করিলাম, এবং হলঘরের আলোগুলি জ্বলিয়া উঠিবার দশ-পনের মিনিট পর পুনরায় হলঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, বিদেশিনী খাকি রঙের ট্রাউজার ও এতদ্দেশীয় কুর্তা পরিয়া লইয়াছেন ।
নির্মল রক্ষিত এইভাবে আমাদের পরিচয় করাইয়া দিল, ইনি ম্যাডেলিন করিয়েট, আমেরিকার ওহাবও শহর হইতে আসিয়াছেন । ওনার এক পূর্বপুরুষ ইংল্যান্ডের সমারসেট হইতে পায়ে হাঁটিয়া, ইউরোপ এশিয়া হইয়া আগ্রায় আসিয়াছিলেন, এবং সম্রাট জাহাঙ্গিরের দরবারে চাকরি পাইয়াছিলেন ; টমাস করিয়েটের আত্মজীবনীতে বর্ণিত স্হানগুলির বর্তমান সামাজিক অবস্হা ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য ভারতবর্ষে আসিয়াছেন । আর ম্যাডেলিন, ইনি শিশির দত্ত, আমাদের প্রজন্মের খ্যাতনামা চিত্রকর ও গিটারবাদক ।
পরিচয় করাইয়া দিয়া নির্মল সদর দরজা খুলিয়া দিতে অথবা যাহারা ডাকাডাকি করিতেছিল, তাহাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেল ।
প্রাথমিকে এবং ভূগোলের মানচিত্র বভতীত আমি জীবনে কিছু আঁকিয়াছি বলিয়া মনে পড়ে না । একটিমাত্র কথার ঝাপটায় নির্মল আমাকে চিত্রকর বানাইয়া চলিয়া গেল , তাহাও আবার খ্যাতনামা । যদি ম্যাডেলিন এতদ্বিষয়ে কোনও সূত্র উথ্থাপন করে, তাহা হইলে ঘোর বিপদে পড়িব ।
বিপদে পড়িলাম না । তাহার পরিবর্তে ম্যাডেলিন লজ্জা দিয়া আমার মস্তকটি কাটিয়া লইল । সে জিজ্ঞাসা করিল, আমার দে্ কি কাম্য বলিয়া মনে ্ইল ? আপনি তো বহুক্ষণ যাবৎ বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ করিতেছিলেন ।
ধরা পড়িয়া গিয়াছি । কিন্তু ম্যাডেলিনের কথায় চৌর্যবৃত্তির গ্লানি হইতে যেন মুক্ত হইলাম । তাহার ছোট-ছোট নীল চক্ষের দিকে তাকাইবার সাহস হইল। বলিলাম, আমি এত সুন্দর দেহ, সর্বাঙ্গসুন্দর দেহ, ইতোপূর্বে দেখি নাই ।
ম্যাডেলিন কহিল, নির্মল ও তাহার চিত্রশিল্পী বন্ধুগণের মতো আপনি দাড়ি রাখেন না দেখিতেছি । ভাল করিয়াছেন । আমি যুবকদিগের দাড়ি রাখা পছন্দ করিনা । ছবি আঁকার সহিত দাড়ির কী করার আছে ? তবে, আপনার ওই ফাকিং চশমাটি পরিত্যাগ করুন । গিটার বাদনের সহিত এইরূপ নির্জীব-বুদ্ধিজীবী ফ্রেমের চশমা মানায় না । আপনি কাহার গিটার বাদন পছন্দ করেন ?
আমার নিজস্ব প্রসঙ্গ উথ্থাপিত হইতে আশ্বস্ত হইলাম । বলিলাম, আমি চাক বেরি, জিমি হেনড্রিক্স ও ডেভি জোনসের ভক্ত ।
ওঃ, জিমি হেনড্রিক্স ! ইনডিয়ায় আসিয়া এই প্রথম একজন ভারতীয়ের কন্ঠে জিমি হেনড্রিক্সের নাম শুনিলাম । গিটার তাঁহার হাতে যৌনতায় উত্তেজিত রমণীদিগের ন্যায় হইয়া উঠে ; যেনবা গিটারের অরগ্যাজম ঘটে ! শরীরে আনন্দের ঢেউ তুলিয়া ম্যাডেলিন কহিল । তদ্ব্যাতীত, অরগ্যাজম শব্দটি শুনিয়া প্রীত হইলাম । ইতোপূর্বে কোনো নারীর কন্ঠে এই শব্দটি শুনি নাই ; বস্তুত, ভাষার ভিতরে যে আরাম প্রদানের ক্ষমতা হাছে তাহা মাঝে-মধ্যে অন্যের কন্ঠস্বর নিঃসৃত শব্দে অনেকসময়ে ফুটিয়া উঠে ।
নির্মল তাহার কতিপয় বন্ধুকে লইয়া স্টুডিও ঘরে প্রবেশ করিল । দাড়ি, দীর্ঘ অবিন্যস্ত চুল, খাদি ও জিনসের নোংরা পোশাক ও বাসি চেহারা দেখিয়া অনুমান করিলাম যে তাঁহারাও চিত্রশিল্পী । নির্মল পরিচয় করাইবার সময়ে উপেন সরদার, সুভাষ প্রতিহার, মোহিত কর, উল্লাস মিত্র ও প্রণব ঘোষকে আমার সম্পর্কে বলিল যে ইনি শিশির দত্ত, অতুল মুখোর বাল্যবন্ধু, অতুলের নিকট এনার কথাই আমরা শুনিয়াছি, তোমাদিগের মনে আছে হয়ত ।
অতুল পোস্টকার্ডে নামস্বাক্ষর করিয়াছিল অতুল মূর্খ ; নির্মল উহাকে বলিল অতুল মুখো । অতুল ছিল আমাদের ক্লাসের সর্বাধিক বয়সী ছাত্র । বছর-বছর ফেল করিয়া নাইনে আমাদের যৌন-জ্ঞানদাতারূপে শেষ বেঞ্চে বসিত । আমি তাহার অনুরোধে আমার হাতখরচ হইতে কিয়দংশ দিতাম । স্কুলে সে-ই কেবল সিগারেট ফুঁকিত । এখন কাশীতে আসিয়া ঢাক পিটাইয়া নিজেকে মুর্খরূপে প্রচার করিতেছে ! অদ্ভুত ।
অতুল যে কাশীতে রহিয়াছে, তাহা জানিয়াছি বৎসর দুয়েক পূর্বে । দাড়িগোঁফ কামাইতে-কামাইতে স্কুলপর্ব সম্পূর্ণ না করিয়া হঠাৎ সে একদিন উধাও হইয়া গেল । তাহার পর শুনিলাম অতুল নবদ্বীপে । অতুলচন্দ্র দাসরা জাতবৈষ্ণব । তুলসীর কন্ঠী গলায় অতুলের ভুঁড়িদাস বাবা প্রায় সারাদিন খঞ্জনি বাজাইয়া নাম সংকীর্তন করিতেন । অতুলের মা অন্য আরেকজনের সহিত বৈষ্ণবীরূপে গৃহত্যাগ করিবার পর অতলের পিতা নতুন বৈষ্ণবীর সহিত কন্ঠীবদল করিয়া সংসার পাতিয়াছিলেন, এমনতর কানাঘুষা শুনিতাম । অতুলকে কন্ঠী পরিতে দেখি নাই কখনও । কিন্তু গৃহের কাহাকেও না জানাইয়া, পড়াশুনা ছাড়িয়া, উধাও হইবার পর, অতুলের পিতার নামগান ও খঞ্জনিবাদন মাস কয়েকের জন্য স্তব্ধ হইয়া গিয়াছিল । অথচ উহার পরিবারের সদস্যগণ, সহপাঠীরা এবং শিক্ষকবৃন্দ নিশ্চিত ছিলেন যে পড়াশুনায় ব্যর্থ ও অনাগ্রহী হইলেও, চনমনে করিৎকর্মা, শিক্ষকদিগের গৃহকর্মের জন্য সদাপ্রস্তুত অতুলচন্দ্র দাস একদিন যশস্বী কেউকেটা হইবে ।
অতুল মাঝে-মাঝে আমার মায়ের নিকট আসিত, বলিত কষ্টে আছে, নবদ্বীপে জীবনযাপন কঠিন । মা সাহায্য করিতেন । আমিও করিতাম । আমি বলিতাম, তোমাদের যৌনজীবন তো স্বাধীন, তাই না ? আমাকে তোমার সঙ্গিনীদিগের জমায়েতে লইয়া চলো, আমিও কিঞ্চিদধিক লীলাখেলা করিব ।
অতুল সেদিন কেবল হাসিয়াছিল । কাশী হইতে লিখিত পোস্টকার্ডে আমার সেই ঠাট্টাকে অনুরোধে রূপান্তরিত করিয়া রক্ষা করার প্রয়াস, এতদিন যে আর্থিক সাহাজ্য করিয়াছি, তাহার প্রতিদানের প্রয়াস, এইরূপ প্রতিভাত হইয়াছিল । তবুও, পোস্টকার্ডটি সিরিয়াসলি লিখিত কিনা সন্দেহ ছিল । ম্যাডেলিনের নগ্ন দেহের আভায় মোহিত হইয়া প্রথম দিনের সুখকর অভিজ্ঞতায় সেই সন্দেহের নিরসন হইল ।
নির্মল একটি চারমিনার ধরাইয়া, দীর্ঘ টান দিয়া, ধোঁয়া ছাড়িবার পরিবর্তে গিলিয়া, ম্যাডেলিনকে দিল, এবং কহিল, ঠিক আছে ম্যাডি, দ্বিপ্রহরে দেখা হইবে, এখন শিশিরকে একটি পছন্দমত হোটেলে লইয়া যাই ; অতুলও নিশ্চয় উহার জন্য অপেক্ষা করিতেছে ।
সিগারেটে নির্মলের চেয়ে দীর্ঘ টান দিয়া, নির্মলের ন্যায়ই ধোঁয়া গিলিয়া, তাহা আমাকে দিল ম্যাডেলিন । আমার ধুম্রপানের নেশা নাই । ম্যাডেলিন সিগারেটটি ঠোঁটের রসে আপ্লুত করিয়াছে । তাহার সুস্বাদ ছাড়িব কেন ! সিগারেটটি লইয়া একখানা বুকভরা টান দিলাম । উহাদের ন্যায় ধোঁয়া গিলিলাম না ।
ম্যাডেলিন আমার গালে গাল ঠেকাইয়া বিদায় জানাইল ও কহিল, আমরা নিশ্চয় পরস্পরের সহিত অচিরেই কোথাও আকস্মিক ধাক্কা খাইব , বেনারস বেশ ক্ষুদ্র শহর ।
আমি বাকরহিত । মোহিত মন্তব্য করিল, আমিও ভাবিতেছি দাড়িটি কামাইয়া ফেলিব । সবাই হাসিয়া উঠিল । গোল ঠোঁটে এক ঝিলিক হাসি খেলাইয়া ম্যাডেলিন চলিয়া গেল ; নিতম্বের ইতি-নেতি ঢেউ তুলিতে-তুলিতে । সে চলিয়া গেলে মোহিতকে প্রণব বলিল, কত গাল তো এতাবৎ ঘষিয়াছিস, মন শান্ত হয় নাই ?
নির্মল আমাকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিল, এক্ষণে সুটকেস ও গিটার লইবেন না, কেবল টাকাকড়ি সুটকেসে রাখিবেন না, সেগুলি সঙ্গে রাখুন । রাত্রিতে কোথাও আস্তানা না জুটিলে, আমার গৃহের রেস্টরুম চিত্রকর ও কবি-লেখকদিগের জন্য অবারিত । অদ্য রাত্রিতে আমাদের গেরিলা পেইনটার্স গোষ্ঠীর হ্যাপেনিং হইবে । আপনি তাহাতে অংশগ্রহণ করিলে অভূতপূর্ব আত্মিক আনন্দ পাইবেন ।
আমি শুধাইলাম, আমি তো শিল্পী অথবা কবি নহি ; আপনি ম্যাডেলিনের সহিত পরিচয় করাইলেন চিত্রকররূপে । পুনরায় সাক্ষাৎ ঘটিলে ঘোর বিপদে পড়িব ।
সবাই একযোগে অট্টহাস্য করিয়া উঠিল । উল্লাস কহিল, আপনার বালয়বন্ধু অতুল মুখার্জিও কবেই বা আর্টিস্ট ছিলেন ? অথচ বেনারস হইতে প্রকাশিত অধিকাংশ হিন্দি পত্রিকা ও গ্রন্হের প্রচ্ছদ অতুলের দ্বারা অঙ্কিত ।
সিগারেটে অথবা ম্যাডেলিনের লালায় এমন কিছু ছিল, যাহার কারণে মাথা ঘাড়ের উপর নাই বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছিল । হৃৎস্পন্দন ক্রমে যেন পা হইতে উপর দিকে উঠিয়া আসিতেছে, এবং শীতল করিয়া তুলিতেছে । সিগারেটতি এক্ষণে বাকি তিনজনে ফুঁকিয়া ফিরাইয়া দিয়া থাকিবে , নতুবা আরেকফুঁক মারিয়া পরীক্ষা করিয়া লইতাম ।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, সিগারেটের তামাকে কি কিছু মিশাইয়াছেন ? প্রত্যুত্তরে নির্মল রক্ষিত একটিই শব্দ উচ্চারণ করিল, চরস । মনে হইল, সাধারণ সিগারেটের তুলনায় চরস বস্তুটি শ্রেয় । সিগারেটের ধোঁয়া কিছুই ঘটায় না ।
উহাদের কথপোকথনের মাঝে গেস্টরুম বা রেস্টরুমে প্রবেশ করিয়া নির্মলের পিতার একটি ডায়েরি, যাহার পৃষ্ঠ তিনি কম ভরিয়াছেন, সুটকেসে পুরিয়া জামা-কাপড়ের তলায় লুকাইয়া রাখিলাম, আমার কাশীবাসের অভিজ্ঞতা লিখিবার অভিপ্রায়ে । ডায়েরিগুলি সুদৃশ্য ও মূল্যবান, সাধারণ খাতা নহে । টাকাকড়ি পূর্বাহ্ণেই রাখিয়া লইয়াছি ।
আমরা নির্মলের গৃহ হইতে ডান দিকের পথে হাঁটা আরম্ভ করিয়াচিলাম । পথিমধ্যে দেখিলাম, নোংরা পোশাক পরিহিত, পায়ে হাওয়াই চপ্পল, অবিন্যস্ত চুল বিদেশি যুবক যুবতী, একা অথবা জোড়ায়-জোড়ায় । কোনও-কোনও যুবক বা যুবতী আমাদের দলের কোনো সদস্যকে চিনিতে পারিয়া হাত নাড়িল বা মৃদু হাসির সহিত কহিল, হাই ।
চায়ের দোকানে ঢুকিয়া, ডিম-পাঁউরুটি খাইতে-খাইতে প্রসঙ্গটি উথ্থাপন করিলে, উল্লাস কহিল, ইহারা ভিয়েৎনাম যুদ্ধে যোগদানের আতঙ্কে অধবা তাহার বিরোধীতায় স্বদেশ ছাড়িয়া পলাইয়া আসিয়াছে । আমেরিকার সমাজটিতে ম্যাককার্থি নামক এক নেতা এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ গড়িয়া তুলিয়াছিল যে প্রথম সুযোগেই আত্মহারা হইবার সুযোগের সদ্ব্যবহার করিতেছে ।
মোহিত বলিল, ভারতের মতন খোলামেলা স্বাধীন দেশ আর নাই । তদ্ব্যতীত বেনারস যেহেতু সাধুসন্তদের শহর, হেথায় যে কেউ যে কোনও নেশা যথেচ্ছ করিতে পারে । শিব নেশা করিয়া তাণ্ডব নৃত্য করিতেন । ইহারা নিজেদের মস্তিষ্কে সেই প্রকার তাণ্ডবনাট্য ঘটাইবার প্রয়াসী ।
নির্মলের তৃতীয় বন্ধুটি, যাহার নাম উপেন সরদার, কহিল, কাশী বিশ্বনাথের দয়ায় এই তীর্থে কোনও কর্ম পাপ বলিয়া গণ্য হয় না । আমি এই তীর্থে যা ইচ্ছা করিয়া লউন । গ্লানি হইলে, দশাশ্বমেধে গিয়া গঙ্গাস্নান করিয়া লইবেন । ব্যাস , ছুটি ।
সনাতন সমাজে, জীবন ও আতিকথায় আদর্শ মূল্যবোধ জিতে যেত, আর আদর্শহীনতা হেরে যেত, যাকে বলা হয় ধর্মের জয় । আধুনিকতার জীবনদর্শন, প্রথমে ইউরোপে এবং তারপর উপনিবেশগুলোয়, ধর্মের মানে পালটে দিলে । ফলে, রাষ্ট্রের ক্ষমতাবিন্যাস থেকে বিচ্যুত ভাবুকরা, নিজেদের বৌদ্ধিক ও আত্মিক অধঃপতনকে বৈধতা দিতে, আক্রমণ করতে লাগলেন ‘ধর্মের জয়’ মূল্যবোধটিকে । আমরা দেখলুম উপন্যাসে, গল্পে, নাটকে, চলচ্চিত্রে নায়কোচিত সন্মান পাচ্ছে মূল্যবোউহীন সমাজবিরোধী চরিত্র , ইউরোপের প্রতিটি ভাষায় । আর গণসমাজ, মায় এদেশের ইংরেজি-জানা পাঠক, লুফে নিচ্ছে অমন নেতিবাচকতা । নানা কুকর্ম করে বেড়ায় কেন্দ্রচরিত্র, আর তার অধঃপতনে গরিমা আরোপ করেন লেখক । ভাবুক ও আলোচকগণ সেসব কাণ্ডকারখানার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আহ্লাদে আটখানা হন । তার কারণ লেখক ভাবুক সমালোচক নিজেরাই অধঃপতিত নষ্ট বিবেকহীন লোভী দুষ্কৃতী ।
একে তো কামুক ভোঁদাটা বিটকেল বাংলায় নিজের কাশীবাসের স্মৃতি লিখেছে, তাও আবার এমন ইজগুড়ি-বিজগুড়ি হাতের লেখায় যে তরতর করে পড়া যায় না ; তার ওপর মাঝে-মধ্যে ঢোকানো নির্মলের বাবার জ্ঞানবাক্যি ! হাতসাফাই যখন করলি, তখন ফাঁকা দেখে একটা খাতা নিতিস । নয়তো ছিঁড়ে ফেলে দিতিস নির্মলের বাবার লেখা জ্ঞানবাক্যির পাতাগুলো । ওনার দুয়েকটা পাতা পড়লুম । কী যা মাথামুন্ডু কিছুই তো বুঝলুম না । শিশির যেমন বাংলায় মাস্টারি ফলিয়ে কাব্যি করেছে, উনি তেমনি নিজেই নিজেকে জ্ঞান দিয়েছেন । অমন খাতার পর খাতা সারাজীবন ভরিয়ে কী হল ? একটা অন্তত কাজে লাগল, আমার আর শিশুর । বাকিগুলো তো গুষ্টির লোকেরা নিশ্চই বেচে দিয়েছে বাজে কাগজের দরে ।
ভারতে স্বদেশী আন্দোলনের নেতারা প্রায় সবাই আইন ব্যবসায়ী ছিলেন । আইন ব্যবসায়, ইংরেজি ভাষায় দখল না থাকলে, সম্ভব ছিল না । আমাদের জাতীয়তাবাদী নেতারা ইংরাজ শাসকদের বুঝতে-বোঝাতে সক্ষম ছিলেন । তাঁদের ওজস্বী বক্তৃতাগুলো মানুষ গড়ার বাগ্মীতায় গমগমে, ভারতীয়দের মানব বানাবার স্বপ্নে ঝিলমিল। এনারা লিখেছিলেন স্বাধীন ভারতের সংবিধান, যা আমাদের কিছু-কিছু দিলেও, এদেশে বহু সমস্যার উৎসসূত্র । আইনভঙ্গকারীরা ক্ষমতার অনুস্তর কেন্দ্রগুলোর দখল নিচ্ছে আজকের দিনে, তা কালক্রমে ভয়াবহ হয়ে উঠবে ; তখন কি তাকে সামাল দেবার মতো নেতা বা নেত্রী পাবে ভারতীয় সমাজ ? রাজনীতিক-আমলা-অপরাধী মাফিয়ার যে চক্রব্যুহ গড়ে উঠছে, তার বীজ পুঁতে গিয়েছেন উপরোক্ত আইনব্যবসায়ীরা ।