অমৃতা (Amtrita) – ৯
ডঃ রঞ্জন কার্লেকরের সঙ্গে অরিন্দম ঘোষের কথা হচ্ছিল। এখন ভোর ছটা। এই সময়টায় কার্লেকর কর্মমুক্ত থাকেন, হঠাৎ কোনও কঠিন ডেলিভারি কেস না এলে। এই সময়টায় তিনি তাঁর ছোট্ট বাগানে কাজ করেন। খুরপি দিয়ে গাছের গোড়ার মাটি কুপিয়ে দেওয়া, সার টার দেওয়া, জল দেওয়া এগুলো সব তিনি নিজেই করেন। একজন মালি আছে, সে দু সপ্তাহ পরপর এসে ঘাস ঘেঁটে দিয়ে, অন্য কিছু করবার থাকলে করে দিয়ে যায়। কিন্তু সেটা পাক্ষিক ব্যবস্থা। দৈনিকেরটা তিনি নিজেই করেন, যদি কোনও দিন পেশার কারণে করতে না পারেন তাঁর অস্বস্তি হয়। গাছগুলোও তাদের অভ্যস্ত পরিচর্যা না পেয়ে বোধহয় মনমরা থাকে। কিন্তু আর কারও থেকে কিছু আশা করে না।
কার্লেকরের স্ত্রী রম্ভা কার্লেকর নটার আগে ঘুম থেকে ওঠেন না। উঠে হাই-টাই তুলে আড়মোড়া-টোড়া ভেঙে তিনি বেড-টি খান। তারপর সংসারের কাজে লাগেন। রম্ভা ছিলেন রঞ্জনের ক্লাস ফেলো। তুমুল প্রেম করে দুজনের বিয়ে হয়েছে। রম্ভা উত্তর প্রদেশীয়, কিন্তু এমন ভাবে রঞ্জনের পরিবারের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন যে কোনও তফাত বোঝা যেত না। রঞ্জনের পদবি কার্লেকর হলেও এঁরা আর মারাঠি নেই। বাপ-ঠাকুর্দা—তাঁর ঠাকুর্দা এই রকম বহু পুরুষ বাংলায় বাস করা মানুষদের মতো তাঁরাও বাঙালি হয়ে গিয়েছিলেন। রম্ভাকে কিন্তু প্রেমিকের পরিবারের বাঙালিয়ানা শিখতে হয়েছিল। রঞ্জনের কেরিয়ার ডিগ্রির অর্থে যখন তুঙ্গে, অর্থাৎ ইংল্যান্ডে এম.আর.সি.ও.জি করছেন তখন অন্য কোনও তরুণীর সঙ্গে রঞ্জন জড়িয়ে পড়ছেন বুঝে রম্ভা নিজের প্র্যাকটিস জলাঞ্জলি দিয়ে, লন্ডন পাড়ি দিয়েছিলেন। হয়তো তিনি যতটা উতলা হয়েছিলেন, ততটা কিছু হয়নি। কিন্তু সেই থেকে রঞ্জনকে চোখের আড়াল না করা তাঁর অভ্যাস হয়ে গেছে। প্র্যাকটিস করেন না। উপভোগ করেন জীবন এমনি অলসভাবে, ছেলেটি দুন স্কুলে পড়ে, মেয়েটি দার্জিলিং লোরেটোয়। রঞ্জন বহুবার বলেছেন তাঁর নার্সিংহোমে যোগ দিতে, কিন্তু রম্ভা ওসব দিকে আর যাননি। সুন্দরী রোগিণী দেখলেই তাঁর বুক কাঁপত। এখন একটা বিউটি পার্লার করেছেন। পার্লারের সঙ্গে আস্তে আস্তে যোগ করে চলেছেন হেলথ ক্লাব, কসমেটিক সার্জারি ইউনিট, কিন্তু দুপুরবেলা অর্থাৎ বারোটা থেকে চারটে কি বড় জোর পাঁচটার পর তিনি আবার বাড়িতে। সল্টলেকের এই বাড়ির অঙ্গসজ্জা তিনি কয়েকমাস পরপরই পাল্টে দেন। কেউ যদি গৃহসজ্জা নিয়ে তাঁর কাছে পরামর্শ নিতে আসে তাও তিনি সানন্দে দিয়ে থাকেন, সাহায্য করেন। কিন্তু সে অর্থে তিনি কোনও পেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েননি। তাঁর মন সব সময়ে সতর্ক হয়ে থাকে রঞ্জনকে নিয়ে। তার যত্ন হচ্ছে কিনা, সে ঠিক সময়ে খাওয়া-দাওয়া-ব্যায়াম করছে কিনা, তার পোশাক-আশাক, তার গাড়ি, তার শোফার, তার নার্সিংহোমের স্টাফ, রাত্তিরে নিতান্ত দরকার না পড়লে তার বেরোনো বা না বেরোনো—এই সবেরই তিনি খোঁজ রাখেন। এক হিসেবে তিনিই রঞ্জনের জগতের মালকিন। রঞ্জন তাঁকে জানতে না দিয়ে তাঁর কিছু মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা করিয়েছেন। ছেলে-মেয়েকে দূর স্কুলে পাঠাবারও তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু রম্ভাকে তাঁর বেছে নেওয়া জীবন যাত্রা ও সিদ্ধান্ত থেকে একচুল নড়ানো যায়নি।
ভোরবেলার বাগান। খুব সুন্দর ভোরালো হাওয়া দেয়। হাওয়ার মধ্যে মিশে থাকে স্বাস্থ্যের গন্ধ, গাছপালার এবং মানুষের। এ দিকটাও তো একটু খোলামেলা, অনেক নিয়মিত পদচর্চাকারী এই সময়ে তাঁর বাগানের পাশ দিয়ে চলে যান। হয় যাচ্ছেন, নয় ফিরছেন। তাঁদের সকাল আরও অনেক আগে হয়। কিন্তু ডঃ কার্লেকর বহু চেষ্টা করেও এর আগে বাগানে নামতে পারেন না। তাঁর অনেক রাত পর্যন্ত কাজে যায়, অনেক দিনই রাতে নার্সিংহোম থেকে কল আসে, নার্সিংহোমের কাজ সেরে এসে তিনি দেখেন উৎকণ্ঠিত রম্ভা ঘরবার করছে। রোগীর জন্যে, স্ত্রীর জন্যে এই ডবল উৎকণ্ঠায় তাঁকে সিডেটিভ খেতে হয়। এর আগে তিনি উঠতে পারেন না। তবে এই সময়টুকু তিনি একেবারে পরিপূর্ণ উপভোগ করেন। মনটাকে করে দেন সম্পূর্ণ চিন্তাশূন্য। চোখ থাকে গাছের মূলে, হাতে থাকে আদিম লোহার স্পর্শ আর চিরকালীন মাটির ছোঁয়া। শরীরের ত্বকে লাগে অলৌকিক ভোরের হাওয়া।
—ডঃ কার্লেকর!
প্রথমে শুনতে পেলেন না উনি। এত নিবিষ্ট ছিলেন।
—ডঃ কার্লেকর!
এবার তিনি মুখ তুলে আর একটি মুখ দেখলেন। বাগানের জাফরি কাটা গেটের ওধারে। বেশ চমৎকার চেহারার একটি যুবক। মানে, এমন চেহারার যে তাকে সমীহ না করে পারা যায় না। সে যুবকটি ডেকে সাড়া পেতেই অভ্যস্ত।
—হ্যাঁ বলুন।—কোনও রোগিণীর বিবরণ আশঙ্কা করেছিলেন তিনি। এ সময়ে তিনি কোনমতেই কোথাও যান না বলে হয়তো ছেলেটি প্রিয়জনের জন্য তাঁর কাছে ছুটে এসেছে।
কিন্তু তাঁর আশঙ্কা ও অনিচ্ছার কথা প্রকাশ করার আগেই ছেলেটি নমস্কার করে বলল—আমি অরিন্দম ঘোষ, সিঙ্গাপুর থেকে আসছি।
আশ্চর্য! ছেলেটি এমন করে বলল যেন সিঙ্গাপুরটা এই কয়েক ব্লক দূরে।
রঞ্জন কার্লেকর ততক্ষণে গেট খুলে দিয়েছেন। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ছেলেটিও বলেছে … অশেষ ধন্যবাদ।
—আমার বিয়ের ব্যাপারে আপনাকে একটু সাহায্য করতে হবে ডক্টর।
এমন কথা কার্লেকর কখনও শোনেননি। বিয়ের পরের ব্যাপারে তাঁর কাছে সাহায্যের জন্য অবশ্য লোককে আসতেই হয়, কিন্তু তিনি ঘটকালি তো কখনও করেননি!
—ঠিক এক সপ্তাহ পরে ফিরে যেতে হবে আমাকে। এর মধ্যে অন্তত রেজিস্ট্রেশনটা করে নিতে চাইছি। কিন্তু আমার হবু-পত্নী আমাকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছেন না, যদি আপনি আমাকে সাহায্য না করেন।
হতভম্ব হয়ে ছেলেটির দিকে চেয়ে রইলেন ডঃ কার্লেকর।
—মেয়েটির বন্ধু ওই অমৃতা নামের মেয়েটি, সে নিখোঁজ হয়েছে। যতদিন তার খোঁজ না পাওয়া যাচ্ছে …
—সে ক্ষেত্রে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে—এতক্ষণে ডাক্তার বলতে পারলেন।
—আর একটা কমপ্লিকেশনও আছে। অমৃতার স্বামীর নাম অরিসূদন, আমার নাম অরিন্দম, দুটোই অরি দিয়ে শুরু। সেইজন্য অরি নামের কলঙ্ক ঘোচাতে না পারলে মেয়েটি আমায় বিয়ে করতে চাইছে না।
—তা হলে বোধহয় আপনার এ বিয়েটা হচ্ছে না—বলেই ডঃ কার্লেকর আচমকা চুপ করে গেলেন।
অরিন্দম ঘোষ খুব আন্তরিক চোখে চেয়ে বলল—ওই লোকটাই কালপ্রিট, নয়? আমরা ঠিকই বুঝেছি।
—আমি আপনার সঙ্গে আর কথা বলব না।
—কিন্তু কেন ডঃ কার্লেকর? আমি তো পুলিশের কাছ থেকে খুব রিলায়েব্ল সোর্স থেকে জেনে এসেছি যে আপনি অমৃতার হোয়্যারঅ্যাবাউটস সম্পর্কে সঠিক সংবাদ ওদের দিয়েছেন। অমৃতা লিখিতভাবে তার স্বেচ্ছায় চলে যাবার কথা তাদের জানিয়েছে। মাঝখানের মিষ্ট্রিটাই খালি সল্ভ করতে পারছি না। কেনই বা অমৃতা নার্সিংহোমে গেল, আর অরিসূদন যদি নিজেই কোনও অপরাধ করে থাকে তাহলে কেন আপনাকে মারধর করল, আপনার অফিস ভাঙচুর করল! এফ. আই. আর. করল!
—হাতের শিকার ফসকে গেলে রাগে মারধর করতে পারে না?—ডঃ কার্লেকর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বললেন।
—শিকার? অরিসূদন অমৃতাকে খুন করতে চেয়েছিল?
—ষোলো সপ্তাহের প্রেগন্যান্সির পর একটা চূড়ান্ত অ্যানিমিক মেয়েকে এম. টি. পি. করতে আনলে তাকে খুন করার মতলব ছাড়া আর কী বলা যায়?
চোখ বড় বড় করে অরিন্দম বলল—আই সি, আই সি। একটু পরে বলল—তা হলে আপনিই ওকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গিয়ে রেখেছেন।
—আমি কাউকে রাখিনি। নিরাপদ জায়গার চয়েসটা পেশেন্টের। আমি শুধু সাহায্য করেছি।
—কোথায় গেছে একটু যদি বলেন।
—কী করে জানব আপনি তার বন্ধু না শত্রু? কী করে জানব আপনি আর এক অরিসূদন নন!
—বাঃ সেদিন অতজন ওর বন্ধুর সঙ্গে আপনার কাছে গেলাম।
—বন্ধুদের হয়তো বুঝিয়েছেন আপনিও বন্ধু, আসলে …
—আমি তো সিঙ্গাপুরে থাকি। জাস্ট বিয়ে পাকা করতে এসে এই ঝামেলায় পড়ে গেছি। আমি এসবের বিন্দুবিসর্গও জানি না। অমৃতাকে চিনিই না।
—আপনি তো অদ্ভূত লোক!
—সেটা অবশ্য ঠিক, অরিন্দম বলল—কোনও জিনিসের শেষ না দেখে আমি ছাড়ি না। তা ছাড়া লাবণির যদি সত্যি অরি নামে ঘেন্না এসে যায়, সত্যিই যদি তার অমৃতার নিরুদ্দেশের কিনারা না হলে বিয়ে করতে ভয় হয় বা অনিচ্ছা হয়, সেটা তো স্বাভাবিক মানবিক রি-অ্যাক্শন! আই অ্যাপ্রিশিয়েট হার কনসার্ন। মেয়েটা যে মানুষ সেটা প্রমাণ করেছে আমার কাছে … আজকাল এইগুলো কিন্তু মানুষের মধ্যে দেখা যায় না বড় একটা।
—দেখুন যত কথাই আপনি বলুন, পেশেন্টের ঠিকানা আমি আপনাকে বলছি না। ওরা কেস করেছে, পেশেন্টকে আমি অসাবধানে মেরে ফেলে ভয়ে কোথাও পাচার করে দিয়েছি। ঠিক সময়ে কোর্টে হাজির করে সব ফাঁস করে দেব। পেশেন্টের ঠিকানা যতই লোক জানাজানি হয়ে যাবে, ওরা ঠিক খবর পাবে, পিছিয়ে যাবে।
—সেক্ষেত্রে আপনি কেস করবেন, অমৃতা কেস করবে। আমরা আপনাকে সাহায্য করব।
—আপনি কীভাবে সাহায্য করবেন, আপনি তো সিঙ্গাপুরে …
—সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এখানেও ওদের ব্রাঞ্চ আছে। তেমন হলে চাকরি ছেড়ে দেব। তাই বলে অরিসূদন গোস্বামীকে ছাড়ব না। সে আমার নামে কালি ছিটিয়েছে। শুনুন ডক্টর, আমাকে ওরা কেউ চেনে না, ফলো-টলো করবে না। আমি অমৃতার কাছে যাব, প্লিজ ঠিকানাটা বলুন, আর ওকে আমার পরিচয় দিয়ে একটা ফোন করে দিন।