অমৃতা (Amtrita) – ৭
টু-বি’তে চড়ে নামতে হবে গড়িয়াহাটের মোড়ে। তারপর অটো নিয়ে বিজন সেতু পার হয়ে কর্নফিল্ড-এর ঠিক পরেই দোলাদের নতুন বাড়ি। একটুও ভাল লাগে না জায়গাটা দোলার। বাড়ির পেছনে কারখানা, সামনে একটু ডানদিক ঘেঁষে একটা গ্যারাজ। তবে তাদের দোতলা বাড়িটা বেশ জায়গা নিয়ে, অতি আধুনিক মেজাজের ছিমছাম বাড়ি। বাড়িটা সুন্দর। তাছাড়া জায়গাটা খোলা, অনেকদূর পর্যন্ত চোখ চলে যায়। অবশ্য চারদিকে উঁচু-উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি উঠছেই, উঠছেই। কেন যে তারা ডোভার লেনে থাকতে পারল না। হোক না ভাড়াবাড়ি, সম্পদরা কত কাছে ছিল, অমৃতারা…। অমৃতার কথা মনে হতেই মনটা কীরকম তছনছ হয়ে গেল তার। এই অন্তর্ধান, অমৃতার এই কর্পূরের মতো উবে যাওয়া কি শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে হবে তাদের? সেই বন্দনা ব্যানার্জি, তারও আগে লাভলি গুপ্তর মতো? টিভি খুললে আজকাল যখন নিরুদ্দেশের বিবরণ দিতে আরম্ভ করেন ঘোষক বা ঘোষিকা, সে আগে আরম্ভ হলেই অন্য চ্যানেলে চলে যেত, আজকাল কিন্তু ওই খবরগুলোর জন্যই বসে থাকে। দীপাঞ্জন চ্যাটার্জি, বয়স ১৭, হাইট : পাঁচ-সাত…হারিয়ে যাবার সময়ে পরনে ছিল খাকি ফুলপ্যান্ট আর লাল চেকশার্ট, সন্ধান দেবার ঠিকানা—ভবানী ভবন। অলকা মাজি—বয়স ২৯ হাইট—পাঁচ এক…গত তেরো জানুয়ারি ১৯৯৮ থেকে নিরুদ্দেশ…। আবদুস সামাদ বয়স বারো…রং কালো…হারিয়ে যাবার সময়ে পরনে ছিল…। যেগুলো মানসিক ভারসাম্যহীন সেগুলো বাদ দিয়ে বাকিগুলো বিশ্লেষণ করতে থাকে সে। এ অভ্যেস নাকি তিলকেরও হয়েছে। তিলকই তাকে ফোন করে জানায়—দোলা শিগগিরই টিভি খোল—অমৃতার খবর দিচ্ছে। ওর বিয়ের ঠিক আগের একটা ফটো দিয়েছে। এ ফটোটা খুব ভাল করে চেনে দোলা। কেমন কাঠ-কাঠ রাগী-রাগী উঠেছে। অমৃতা গোস্বামী—নিরুদ্দেশ ‘উজ্জীবন’ নার্সিংহোম থেকে, ফর্সা রং, উচ্চতা ৫’-৪” রোগা, নিরুদ্দেশ হবার সময়ে পরনে ছিল নার্সিংহোমের গাউন। সম্ভবত সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন।
দোলা সঙ্গে সঙ্গে তিলককে ফোন করে—‘সম্ভবত সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন’ মানেটা কী রে?
—অমৃতার মাথাটা যদি কাঁধের ওপর ঠিক জায়গায় বসানো না থেকে থাকে তো আমাদের কারও মাথাই নেই—তিলক বলল।
—এটা কী চাল বল তো ওর শ্বশুরবাড়ির?
সীজারকে টেলিফোন করে দোলা—সীজার আছে?
—বলছি
—আমি দোলা রায়, অমৃতার…
—বুঝেছি
—আজ নিরুদ্দেশের খবরটা দেখেছ?
—দু’ দিন ধরে তো দিচ্ছে। প্রমাণ করতে চাইছে ওর মানসিক গোলমাল হয়েছিল। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় নার্সিংহোমে নিয়ে যায়। সেটা এপিলেপ্সি হতে পারে। তার পরে হয়তো খানিকটা অ্যামনেসিয়া…এখন তো সব জানাজানি হয়ে গেছে। পাড়ার ছেলেরা মারমুখো। নার্সিংহোমের ডাক্তারকে ধরেছিল পুলিশ। বেল পেয়ে গেছেন শুনেছি। অরিদাকে যে কোনওদিন পাড়ার ছেলেরা ধোলাই দেবে। ওর শাশুড়ি বেরলেই টিটকিরি খান।
—কীরকম?
—আমাদের ছেলেদের মধ্যে একটা এই ধরনের কথাবার্তা হয়, ধরুন
—ধরুন বলো না ধরো…
—আচ্ছা ধরো—এক নম্বর বলল—কে যায়?
—দ্বিতীয় জন জবাব দিল—বউমারির খাল।
—কোথায় যায়?
—নদীনালায়
—কেন যায়
—বউ-মারার সুলুক দিতে
—কেমন সুলুক?
—ধোবার পাটে আছড়ে মারো, পাথর বেঁধে জলে ফেলে দাও
—আর?
—সুযোগ পেলে গলা টিপ্যা ভাসাই-আ দাও।
—কী রি-অ্যাকশন?
—কী বলবে? কিচ্ছু তো বলতে পারে না। মুখ কালো হয়ে যায়। হনহন করে চলে যায়। তবে রি-অ্যাকশন দেখতে হয় পাড়ার অন্য শাশুড়িদের।
—সেটা কীরকম?
—এক মাসিমা একদিন আমায় ডেকে চোখের জল মুছে বললেন— শাশুড়িদের পেছনে লেগেছ বাবা, আমাদের তাহলে ঘরেও খোয়ার, বাইরেও খোয়ার? আমি বললাম—বেশ মাসিমা, জানতে দিন, আমাদের জানতে দিন, কেমন খোয়ার কেন খোয়ার আমরা আপনার হয়েও লড়ব।
—সত্যি জীবনটা কী অসম্ভব রকমের জটিল, তাই না সীজার?
—না দোলাদি, জীবন-টিবন নয়, মানুষ, মানুষই বড্ড গোলমেলে। কোনও দরকার হলেই আমায় ডাকবেন,
—বা রে! কোনও দরকার হলেই তোমায় ডাকব? তোমার অসুবিধে হবে না?
—কোনও অসুবিধে হবে না। অমৃতা-বউদিকে আমরা, মানে আমি খুঁজে বার করবই, আপনাদের কারও অসুবিধে হলে আমি যদি কাজে লাগতে পারি…
দোলা খুব অবাক হয়ে গেল। ছেলেটা আচ্ছা ছেলেমানুষ তো! এখন দিনকাল যা দাঁড়িয়েছে মানুষ খালি ছুটছে। তাদের মতো যারা কেরিয়ার গড়ছে, তাদের তো কথাই নেই। তার মধ্যে হাইস্কুলে পড়া সীজারের মতো একটা ছেলে যদি সব দিদি, সব বউদি, সব শাশুড়িদের আশ্বাস দিতে থাকে যে কারও কোনও অসুবিধে হলেই সে সাহায্য করতে এক পায়ে খাড়া আছে, তবে একটু অবাক লাগে বইকি! ছেলেটা পড়াশোনা সত্যিই করে তো! না স্কুল ড্রপ-আউট? কোনও রাজনৈতিক দলের কেডার-ফেডার নয় তো?
সেদিন য়ুনিভার্সিটিতে গিয়ে একটা ভারী মজার ব্যাপার শুনল দোলা। দোলা কেন সব্বাই। লাবণির বিয়ের ঠিক হয়ে গিয়েছিল, লাবণি বেঁকে বসেছে। ওর মা না কি আজকে আসবেন য়ুনিভার্সিটিতে বন্ধুদের অনুরোধ করতে যেন তারা ওকে বোঝায়।
—কী ব্যাপার রে লাবণি? বন্ধুরা তো সব একখানা গল্পের গন্ধ পেয়ে হামলে পড়ল একেবারে।
লাবণি বলল—আমার ব্যাপার আমি বুঝব, তোদের কী? তোরা কেন নাক গলাচ্ছিস?
—আমরা একটা নেমন্তন্ন পেতে চলেছিলুম, সেটা যে ফস্কে যায়, সেটাই আমাদের নাক গলাবার কারণ, —চঞ্চল বলল।
—পেটপুজো ছাড়া আর কিচ্ছু বুঝিস না, না? কফিহাউজে গিয়েও বলবি খাওয়া, বিয়ের কথা উঠলেও হাত ধুয়ে বসে থাকবি। কেন বাড়িতে খেতে পাস না? আর শিওর হচ্ছিস কী করে তোকে নেমন্তন্ন করবই!
চঞ্চল বলল—করবি না? যদি না করিস কেন করবি না, তা-ও জানি।
—কেন? দোলা জিজ্ঞেস করল।
—কেন আর—বর বা বরযাত্রীরা যদি মনে করে এ মেয়েটার গুচ্ছের বয়ফ্রেন্ড আছে, তাই। নিলয় বলল, লাবণির বর মোটামুটি রক্ষণশীল, একটু গাঁইয়া মতো তো হবেই।
—মানে? লাবণি তো খেপে লাল।
—চটছিস কেন? চটছিস কেন? জেনার্যালি তোর মতো মেয়েরা একটু কনজারভেটিভ পছন্দ করে। গাছেরও খাবে, তলারও কুড়োবে।
—এরই বা মানে কী?
—কেন? দ্যাখ কনজারভেটিভ বলে ওরা ডাউরি-টাউরি বাবদ তোর বাবা-মা’র কাছ থেকে গুচ্ছের জিনিস বাগিয়ে নেবে। ধর নানান কিসিমের শাড়ি গয়না, আসবাবপত্র, ফিরিজ, ভি.সি.আর., আরও সব যা-যা আছে। তা শাড়ি গয়নাগুলো তো তোরই মাপসই হবে, তোর বর বা তোর শাশুড়ি তো আর পরবে না। জিনিসপত্রগুলোও তোর সম্পত্তি প্রধানত। গাছের খাওয়া হল তো? এইবারে তুই আধুনিকা ছিল নাকো হেনকাল ছিল না হয়ে যাবি। বুদ্ধিবৃত্তি আছে, লেখাপড়া শিখেছিস বরের নাকে দড়ি দিয়ে একবার উত্তর একবার দক্ষিণ একবার পূর্ব একবার…
তিলক বলল—ধুর, নিলয় এসব ফালতু ইয়ার্কি ছাড় তো। আমাদের মাঝখান থেকে একটা মেয়ে বেমালুম গায়েব হয়ে গেল, এখনও ইয়ার্কি মারছিস? ধ্যুৎ তোদের একটা ইয়েও নেই।
লাবণি এতক্ষণে মুখ খুলল—দ্যাখ, এদেরও একটা বাবা, একটা মা, একটা ছেলে, একটা মেয়ে। ঠিক অমৃতার শ্বশুরবাড়ির মতন। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। আর সবচেয়ে ভয়ের কথা—এই ভদ্রলোকও এঞ্জিনিয়ার আর এর নাম হচ্ছে…নাম হচ্ছে অরিন্দম। ছোট করলে তো অরিই দাঁড়ায়। ওর বাবা-মা যখন এসে অরি এই অরি তাই করতে আরম্ভ করেন না তখন আমার বুক হিম হয়ে আসে।
লাবণির আপত্তির কারণটা হয়তো খুবই হাস্যকর। কিন্তু ওরা কেউ হাসতে তো পারলই না, উড়িয়ে দিতেও পারল না। চঞ্চলসুদ্ধ ওর ভেতরে কী হচ্ছে সেটা বুঝতে পারল। তবু একবার ফাজলামির চেষ্টা করে বলল—এই অরিসূদন না ফরিসূদন অমৃতার অ-ভদ্রলোকটি এমন একটা কাজ করে বসলেন যে সারা পৃথিবীর অরিন্দম, অরিত্ররা আইবুড়ো হয়ে গেল।
কেউই হাসল না।
তিলক আবার জিজ্ঞেস করল—থাকেন কোথায়?
—কোথায়? শুনলে আঁতকে উঠবি। সিঙ্গাপুর! একটা বিদেশ-বিভুঁই, তারপর শুনেছি ইন্টারন্যাশন্যাল জোচ্চোরদের আড্ডা। সেইখানে আমার মতো একটা মেয়েকে হাপিস করে দেওয়া কোনও ব্যাপার? তোরাই বল। আবার ওর বাবা-মা যখন-তখন ওখানে গিয়ে থাকেনও। যদি তিনজনে মিলে… প্লিজ, আমার বাবা-মা এলে তোরা বুঝিয়ে বলিস।
—তুই অমৃতার ঘটনাটা বলেছিস মাসিকে?
—অমৃতার ঘটনা বিশ্বসুদ্ধ লোক জানে।
—তাতে মাসিদের কোনও দুশ্চিন্তা হয়নি?
—উঁহু। বাবা বলছে তুমি এরকম ভীরু দুর্বলচিত্ত মেয়ে আমার জানা ছিল না। আর মা বলছে যার ভাগ্য তার তার। একজনের দুর্ভাগ্য হয়েছে বলে আর পাঁচজনেরও তাই-ই হবে তার কোনও মানে নেই। আর আমরা খুব চেকিং ক্রস চেকিং করে নিয়েছি। কোনও ভয় নেই।
—তা হলে আর ঘাবড়াচ্ছিস কেন? —তিলক বলল।
—ওরে বাবা অরি নামের লোকেরা আমার জন্মশত্রু হয়ে গেছে। মা কালীর দিব্যি আমি কোনও বরকে অরি বলে ডাকতে পারব না।
—ওগো হ্যাঁগো বলে ডাকিস। তোর অত মড হবার দরকারটা কী? —এবারও চঞ্চল।
ওরা কথা বলছিল, ক্যান্টিনে বসে। এখানেই লাবণির মায়ের আসার কথা। এই সময়ে শর্মিষ্ঠা, রঞ্জনা, অয়ন সব হইহই করে ঢুকল, ওরাও লাবণিকে ঘিরে বসে গেল।
শর্মিষ্ঠা বলল—ইস্স্, আমার একটা এমন দুর্দান্ত সম্বন্ধ আসে না রে! পড়াশোনায় ইস্তফাটা দিয়ে দিই।
রঞ্জনা বলল—যা বলেছিস, পরীক্ষা ভাল্লাগে না আর।
একটি ভদ্রলোক মানে ওদের চেয়ে কিছু বড় একটি বেশ ঝা-চকচকে ছেলে এই সময়ে ক্যান্টিনে ঢুকল। আর সমস্ত ক্যান্টিনকে চমকে দিয়ে লাবণি বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে মুখটা ঝট করে নিচু করে লুকিয়ে ফেলল।
কী হল রে?
—ওই যে অরিন্দম ঘোষ।
তিলক তাড়াতাড়ি উঠে এগিয়ে গিয়ে ভদ্রলোককে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এল।
—আপনি লাবণি মজুমদারকে খুঁজছেন তো৷
—হ্যাঁ মানে, এখানেই তো আসার কথা বলা হয়েছিল আমায়। কিন্তু…
—লাবণি ইজ দেয়ার। হাইডিং
—হাইডিং? হোয়াই? ফ্রম হোয়াট?
—ফ্রম ইউ।
—ওঃ, খুব অবাক করে দিয়েছি না? কী বন্ধুদের সামনে এমব্যারাসড্ না কী?
—আপনি আসুন। এই একটা চেয়ার নিয়ে আয় তো রে। গোপাল এখানে একটা এক্সট্রা চেয়ার দে বাবা। আমাদের জামাইবাবু এসেছেন।—চঞ্চল হাঁকল।
ক্যান্টিনে অন্য যারা বসেছিল সব চকিত হয়ে এদিকে তাকাল। কিন্তু ততক্ষণে হুল্লোড়ের মধ্যে লাবণি এবং অরিন্দম ঘোষ সবাই চাপা পড়ে গেছে।
—আপনারা সব লাবণির বন্ধু। চেয়ারটাতে বসতে বসতে অরিন্দম ঘোষ, সবার দিকে চোখ ঘুরিয়ে এনে বলল।
—হ্যাঁ, এই আমরা সবাই। আরও তিন চার গুণ বাইরে আছে। আমাদের সবাইকেই আপনাকে নেমন্তন্ন করতে হবে। আমরা ন’জন ব্যাটাছেলে আছি, আর সব মেয়েছেলে, আমাদের ন’জনকে স্পেশ্যাল গেস্ট করতে হবে।
—কেন? স্পেশ্যাল কেন?
—বুঝতে পারছেন না? এবারও চঞ্চল—আমরা এই ন’জন আপনার কুড বি রাইভ্যাল। ছেড়ে দিয়েছি।—মাছি তাড়াবার মতো একটা ভঙ্গি করল চঞ্চল।
লাবণি এই সময়ে জিভ ভেঙিয়ে বলল,—শখ কত?
—আপনাদের দয়া-দাক্ষিণ্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ—অরিন্দম ঘোষ হাসতে হাসতে বলল।—কিন্তু শুভ ঘটনাটা আগে ঘটুক। শুনছি লাবণির নাকি প্রচণ্ড অমত। পাঁচ-ছ’ মাস ধরে কেস-স্টাডি চলছে। হঠাৎ লাস্ট মোমেন্টে বেঁকে বসেছে।
নিলয় বলল, আপনার নামটা এফিডেভিট করে পাল্টে ফেলুন।
—কেন বলুন তো!
—আর একটি বোন অন্তত আমদানি করুন।
—আশ্চর্য ব্যাপার। একটা বোন? আমদানি? কোথা থেকে? কেন?
—তাহলে একটা অন্তত তফাত হয় অমৃতার কেসটার সঙ্গে।
—ব্যাপার কী? লাবণি, বুঝিয়ে বলো তো! আমি কিছুই…
—লাবণির বদলে আমি বোঝালে কোনও আপত্তি আছে? —তিলক বলল।
—আছে বইকি? লাবণির মুখ আছে, দু’ পাটি দাঁত, জিভ, গলার স্বর, মাথায় বুদ্ধি অনুভূতি সবই তো আছে, লাবণির মাউথপিস লাগবে কেন?
—লাগবে। দোলা বল তো! একটু ইনট্রোডাকশন দে।
দোলার খুব নার্ভাস লাগছিল। অরিন্দম ঘোষ, খুব স্মার্ট, কিন্তু চালিয়াত টাইপ নয় একেবারেই। খুব সদয় এবং স্বাভাবিক দেখতে।
অরিন্দম বললেন—বলো। দোলা, বাঃ তোমার নামটা খুব নতুন ধরনের তো!
তখন দোলা বলল।
—আশ্চর্য! অরিন্দম ঘোষ বললেন, এই জন্যে? ইসস্ তোমাদের বন্ধু অমৃতা মেয়েটির কী হল তোমরা আর কিচ্ছু জানো না?
—কিচ্ছু না।—অনেকেই বলল একটু আগে পরে।
তিলক বলল, ডাক্তারকে অ্যারেস্ট করা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে জামিনে খালাস।
—দাঁড়াও দাঁড়াও এই যে তোমরা মেয়েটির স্বামীকে সন্দেহ করছিলে?
—ডাক্তারের সঙ্গে যোগসাজশ থাকতে পারে—তিলক বলল।
—হয়তো ওকে খুব মেরে অজ্ঞান করে ফেলেছিল, সীজার বলে ওদের পাড়ার একটি ছেলে বলছে, আধা-অজ্ঞান অবস্থায় ওকে গাড়িতে তোলা হয়। তারপর হয়তো পরিচিত ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। মারা যেতে…
দোলা, লাবণি দুজনেই এই সময়টা ককিয়ে উঠল—তিলক প্লি…জ!
অরিন্দম অসন্তুষ্ট গলায় বললেন—এ আবার কী! বিপদের প্রসঙ্গই সহ্য করতে পার না, তো সত্যিকারের বিপদ এলে তোমরা কী করবে? তোমাদের তো কোনও ডিফেন্সই নেই। তিলক প্লিজ কনটিনিউ।
—ও মারা যেতে, বডি পাচার করে এখন রটিয়ে বেড়াচ্ছে ও নিখোঁজ হয়ে গেছে। নিজেই উঠে ঘোরের মাথায় কোথাও চলে গেছে। এখন নিরুদ্দেশে অ্যানাউন্স করছে … এই ভাবে ব্যাপারটা এসটাবলিশ্ড হয়ে যাবে বুঝেছেন?
—ওয়েল, তোমার রিজনিং খারাপ না।— কখন যে ভদ্রলোক আপনি ছেড়ে ওদের তুমি বলতে শুরু করেছেন …
—এই নার্সিংহোম আর ওই ডাক্তারের নামটা আমায় দেবে?
—‘উজ্জীবন’, বালিগঞ্জ প্লেসে। আর ডাক্তারের নাম রঞ্জন কার্লেকার।
—আমি আজ উঠছি। লাবণি প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড, … অরিন্দম ঘোষ কেমন অন্যমনস্ক ভাবে চেয়ার সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, যেন কিছু ভাবছেন।
—কোথায় যাচ্ছেন?
তিলক, চঞ্চল দুজনেই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
—ওই ডক্টর কার্লেকরের সঙ্গে একবার …
তিলক বলল—আমি যাব।
দোলা বলল—আমিও।
—আমার একটা ছোট্ট মারুতি আছে বাইরে। তিনজনের বেশি নিতে পারব না। লাবণি তো অফ কোর্স যাবেই। যাচ্ছেই।
উনি চলতে শুরু করলেন, যেন আর কোনও কথা নেই। কথা হয় না। গাড়ির দরজা খুলে বললেন—তিলক তুমি ভাই ফ্রন্ট সিটে বসো। মেয়েরা পেছনে থাক। ও হ্যাঁ, তোমাদের বাড়িতে একটু জানিয়ে দাও—ফিরতে দেরি হতে পারে। মোবাইল ফোনটা ওদের হাতে দিলেন তিনি। তারপর গাড়ি ঘোরালেন।
‘উজ্জীবন’ নার্সিংহোমে ওরা যখন পৌঁছল তখন ভিজিটিং আওয়ার শুরু হতে যাচ্ছে। প্রচুর ভিজিটর ভিড় করেছেন লাউঞ্জে। ওদের দিকে না তাকিয়ে অরিন্দম সোজা চলে গেলেন অর্ধবৃত্তাকার এনকোয়ারি কাউন্টারে।
—ডঃ কার্লেকরের সঙ্গে একটু দেখা করতে পারি?
—সার তো এখন নেই। সাতটার পর ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলে আর.এম.ও.-কে নিয়ে রাউন্ড দেবেন।
—তো এখন ওঁকে কোথায় পাব?
—কী করে বলব? খুব সম্ভব উডল্যান্ডস-এ। অপারেশন আছে।
—সাতটার পরে এখানে আসবেনই?
—ওরে বাবা, কাঁটায় কাঁটায়। কী দরকার আপনাদের? কেসটা কী?
তিলকের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল—কেস জন্ডিস।
—রোগী অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে? ভীষণ বমি করছে?
—না, সেরকম কিছু নয়।—অরিন্দম তাড়াতাড়ি বললেন।
—সারের সঙ্গে দেখা করতে হলে সাতটা পর্যন্ত …
অরিন্দম বললেন—চলো, আমরা সময়টা কোনও রেস্তোরাঁয় গিয়ে কাটিয়ে দিই। আলোচনাও করা যাবে।
বালিগঞ্জ ধাবায় ভীষণ ভিড়, অরিন্দমের পছন্দ হল না, কোয়ালিটিও তাই। ওরা একটা অল্প নামী দোতলার রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসল।
হালকা রং ভেতরটায়। স্বপ্ন-স্বপ্ন আলো জ্বলছে। খাবারের অর্ডার দেবার সময়ে দোলা আর লাবণি হাঁ হাঁ করে উঠল। আমাদের জন্য শুধু চা, বাস।
—সময়টা অনেকখানি। তিন ঘণ্টা এখানে কাটাতে হবে। এইটা প্রথম কথা। দ্বিতীয় কথা খালি পেটে যেমন বেদ বেদান্ত হয় না, তেমনি ইনভেস্টিগেশনও হয় না। কোনও কাজ ভালভাবে করতে গেলে শরীরটা চাঙ্গা রাখতে হয়। মনটাও। মনটা আবার শরীরের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। কী? খুব জ্ঞান দিচ্ছি? না, তিলক?
—তা একটু দিচ্ছেন, কিন্তু আপনি যে অমৃতার খোঁজে এই ডাক্তারকে ধাওয়া করতে পর্যন্ত পিছপা হবেন না, এটা আমরা কেউই বুঝতে পারিনি। অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে। আমরা, অন্তত আমি ভীষণ অশান্তিতে ভুগছিলাম। যে মেয়েটা গত মাসেও আমাদের সঙ্গে ক্লাস করেছে, ফুচকা খেয়েছে, সে আজ হারিয়ে গেছে, অথচ আমরা এতগুলো দামড়া ছেলে মেয়ে কিছু করছি না, করতে পারছিনা, এই অবস্থা আমি অন্তত সহ্য করতে পারছিলুম না।
অরিন্দম বললেন—হ্যাঁ, অদ্ভূত কেস! কিন্তু এ ধরনের কেস এ দেশে বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে। কোনও প্রতিকার নেই। দ্যাখো তিলক, আমি এখানকারই ছেলে, এখানকারই ইনস্টিটিউশন থেকে পাশ করেছি। আমি এঞ্জিনিয়ারিং-এর ছেলেদের যে অধঃপতন দেখেছি তাতে করে যে কোনও বাবা-মাকে বলতে পারি—এঞ্জিনিয়ার? মেয়ের বিয়ে দেবার আগে দুবার ভাবুন। যে কোনও রেসিডেনশ্যাল কলেজের হস্টেলে যা চলে তার মধ্যে চরমতম ক্রুয়েলটি, ডিবচরি আমি দেখেছি। তোমরা বলবে, আমিই একা ভাল হয়ে এদের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছি? হোয়াটস দা প্রফ? আমি জোর দিয়ে বলছি তিলক, লাবণি, দোলা, আ অ্যাম ওয়ান অফ দা ফিউ হু হ্যাভ কাম ব্যাক আনটেইন্টেড।
এখন কী হয় জানি না, আমাদের সময়ে মেয়েদের ওখানে সাঙ্ঘাতিক র্যাগিং করা হত। তার ডিটেইল্স আমি এই মেয়েদের সামনে বলতে চাই না। ভাল ভাল রেজাল্ট করা ছেলেরা অমানুষের মতো ব্যবহার করে। তাদের ভেতর থেকে নিষ্ঠুরতম, কুৎসিততম সেডিস্ট বেরিয়ে আসে। ওরা জীবনের সবরকম অভিজ্ঞতা ওখানে স্বাধীন থাকার সুযোগে করে নিতে চায়। অন গড, লাবণি আমি ও সবের মধ্যে যাইনি। আমার মা-বাবা দুজনেই প্রোফেসর। একটা অন্য ধরনের ভ্যালুজ-এর মধ্যে আমরা বড় হয়েছি। আমি আর আমার বোন। বোনের যখন এঞ্জিনিয়ার-এর সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ এল, আমিই ফার্স্ট না করেছিলাম। সবচেয়ে ভাল কী জানো দোলা, নিজেদের পছন্দে, অনেকদিন মেলা মেশা করে বিয়ে করা। এখন লাবণির আপত্তি হতেই পারে। দু-চার দিনের মেলামেশায় কে কাকে বুঝতে পারে? আমি তো বুঝতেই পারিনি লাবণি এত ভিতু, এবং…এবং লাবণির মধ্যে এত ফেলো-ফিলিং আছে।
—আপনি কী ভেবেছিলেন?—দোলা খুব আস্তে প্রশ্ন করল।
খাবার-দাবারগুলো আসতে শুরু করেছে।
অরিন্দম বললেন—এগুলোর সদ্ব্যবহার করো ভাই। তিলক প্লিজ। লাবণি বি প্র্যাকটিক্যাল।
কয়েক গ্রাস খেয়ে তিলক বলল—অরিন্দমদা বললেন না লাবণিকে আপনি কী ভেবেছিলেন?
—তুমি শুনে কী করবে ব্রাদার?
—কিছু না, আমাদেরও তো লাবণি সম্পর্কে একটা অ্যাসেসমেন্ট আছে! মিলিয়ে নিতুম।
—আমি ভেবেছিলাম ও খুব সাহসী, খুব স্মার্ট, যে কোনও সিচুয়েশনে ও মানিয়ে নেবে। ওর সঙ্গে যদি কেউ খারাপ ব্যবহার করে ও তার ঠিক উত্তরটা দেবে। কিন্তু সেই সঙ্গে লাবণি প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড, সেলফিস নয়, জাস্ট সেলফ-সেন্টার্ড। দুটোর মধ্যে তফাত আছে বোঝো তো?
—ওটুকু ইংরেজি আমরা বাংলার ছেলেপুলে হলেও জানি।
—ভাষার কথা হচ্ছে না কনসেপ্টটার কথা বলছি। সেলফিশ লোক সব সময়ে নিজের সুবিধেটা দেখবে, কারও সঙ্গে কোনও সম্পদ শেয়ার করতে চাইবে না। একলা খাবে, একলা পরবে, একলা ভোগ করবে। আর সেলফ-সেন্টার্ড লোক নিজের বাইরের পৃথিবীটাকে দেখতেই পায় না। দেখিয়ে দিলে তখন হয় তো তার মনুষ্যত্ব কাজ করে, কিন্তু আদারওয়াইজ সে নিজেকে নিয়েই থাকে। আজকের পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই সেলফ-সেন্টার্ড, সমাজটাই এখন এই ধাঁচের হয়ে গেছে।—বলে অরিন্দম একটু হাসল—লাবণি, কিছু মনে করলে না তো? লাবণি শুধু মাথা নাড়ল, তার চোখ দুটো ভিজে ভিজে উঠছে যদিও সে একেবারেই আবেগপ্রবণ নয়।
তিলক বলল—ঠিক আছে। আমরা সেলফ-সেন্টার্ড। আপনি বুঝি এ জেনারেশনের নন? কত বড় হবেন আপনি আমাদের চেয়ে?
অরিন্দম হেসে বলল—তিরিশ ক্রস করেছি ভাই। আমি এখনও জানি না, আমি সেলফ-সেন্টার্ড কি না। চেষ্টা করি বুঝতে।
দোলা বলল—আচ্ছা অরিন্দমদা, আপনি পাত্রী দেখতে এসেছিলেন, হঠাৎ আমাদের কাছে অমৃতার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলেন কেন? লাবণির কাছে প্রুভ করতে যে আপনি আরেক অরিসূদন নন? মনে করবেন না কিছু। আপনি ফ্র্যাংকলি কথা বলেছেন, তাই আমিও বলতে সাহস পেলাম।
—তুমি যা বললে সেটা আমার সাবকনশাসে থাকতেই পারে, কিন্তু ফার্স্ট রি-অ্যাকশন যেটা হল সেটা হচ্ছে আমি চোখের সামনে দেখতে পেলাম এই দোলা এই লাবণি কী রকম ভ্যানিশ করে যাচ্ছে। পেছনে দু-চারটে ক্রুয়েল মুখ, আমাদের এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের থার্ড ইয়ারের ছাত্রদের মতো, যারা আমাদের ব্যাচকে র্যাগ করেছিল। আমার মাথার মধ্যেটা কেমন করে উঠল। আই রিজলভ্ড্ দেন অ্যান্ড দেয়ার টু সি ইট টু দা এন্ড।
—আপনাকে কী ভাবে র্যাগ করেছিল?—তিলক জিজ্ঞেস করল।
—দে মেড মি ড্রিঙ্ক মাই ওন ইউরিন, দেন দেয়ার্স।
—বলেন কী? আপনার বমি হল না?
—নাঃ, আমি মোরারজি দেশাইয়ের কথা ভাবতে ভাবতে দু গেলাস খেয়ে ফেললাম।
—তারপর!
—তারপর অনেক আদিরসাত্মক খিস্তি করল। মা-বাবাকে নিয়ে।
লাবণি-দোলা শিউরে উঠল।
দোলা বলল—আপনি সহ্য করলেন, কিছু বললেন না।—সে উত্তেজিত।
অরিন্দম বললেন—আমি কী বললাম জানো? বললাম আরে ইয়ার এ সব তো জানা কথা ঔর কুছ নয়া চিজ হ্যায় তো বাতাও।
—বললেন? এই কথা?
অরিন্দম এবার হেসে ফেললেন, বললেন—এখন ভাবি যে এইরকম বললে হত। তখন রাগে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। অজ্ঞান মানে সত্যি-সত্যি অজ্ঞান। একটা বছর আঠারোর প্যাংলা ছেলে তো! ওভার প্রোটেকটেড।
—তারপর?
—তারপর আবার কী? জ্ঞান ফেরাবার নামে বালতি বালতি জল ঢেলে আমাকে ভিজিয়ে আমার বিছানা ভিজিয়ে ছেড়ে দিল। একজন ইউপির ছেলে ছিল—বলল, ডরপুক কাঁহিকা, ভাগ হিয়াসে।
—ইউরিন খাওয়াটা?
—ওটা সত্যি।
—ইহ্হ্হ্—লাবণি মুখ চোখ বিকৃত করে বলে উঠল।
—কী হল, ডিসিশন নিয়ে ফেললে না কি? লাবণি?
লাবণি বলল—চুপ করুন তো। তখন থেকে বক্বক্বক্। খুব গাবাতে পারেন।
—নিজের ঢাক মাঝে মধ্যে নিজেকেই পেটাতে হয়, বুঝলে ম্যাডাম?
ঘড়ির দিকে চোখ, দোলা বলল—সময় হয়ে এসেছে কিন্তু।
বেয়ারাকে ডেকে তাড়াতাড়ি বিল মিটিয়ে দিলেন অরিন্দমদা। গাড়িতে উঠে তিলক জিজ্ঞেস করল—আমাদের লাইন অফ অ্যাকশন কী সেটা একবার বলুন।
—জাস্ট ফলো মি। নিজেরাই বুঝতে পারবে।
সন্ধের আলো জ্বলে উঠেছে নার্সিংহোমে। এখন কিছু কিছু ফিরতি মানুষের ভিড়। সাতটা বাজতে পাঁচ। এনকোয়ারির ভদ্রমহিলা বললেন—ও আপনারা? যান, সার ঘরে আছেন, দশ মিনিটের মধ্যে রাউন্ডে বেরোবেন। দোতলায় উঠে প্রথম বাঁ দিকের ঘর।
ঘরের সামনে লেখা ডঃ রঞ্জন কার্লেকর এম.বি.বি.এস., ডি.জি.ও., এম.ডি. (ও.এন.জি) এম.আর.সি.ও.জি. (লন্ডন), এফ.আর.সি.ও.জি (এডিনবরা)
পর্দা ঠেলে সোজা ঘরে ঢুকে গেলেন অরিন্দম। সামনে বসা একজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন ডাক্তার। অতজনকে একসঙ্গে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে তাকাতে অরিন্দম বললেন—আমরা সবাই অমৃতার বন্ধু। অমৃতা সম্পর্কে জানতে চাই আপনার কাছ থেকে।
চশমাটা খুলে রাখলেন ডাক্তার, চোখের ওপর একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন— মারবেন না কি?
—আমাদের দেখে কি সে রকম মনে হচ্ছে? তিলক বলল। অরিন্দম দোলাকে এগিয়ে দিয়ে বললেন—এ হল দোলা, এ হল লাবণি, এর নাম তিলক, এখন এরা সব্বাই কলকাতা য়ুনিভার্সিটির বাংলা-বিভাগের ছাত্র, মানে অমৃতার সহপাঠী। আমরা ঠিক করেছি, অমৃতাকে আমরা খুঁজে বার করবই। প্রথমেই এসেছি আপনার কাছে। আই হোপ ইউ’ল কোঅপারেট।
সামনে বসা ভদ্রলোককে চোখের ইশারায় চলে যেতে বললেন ডাক্তার। কে জানে, কোনও সিকিওরিটি ম্যানকে ডাকতে পাঠালেন কি না। তারপর বললেন—অমৃতা গোস্বামী নিখোঁজ হয়েছে একমাসের ওপর হয়ে গেছে। তার বন্ধুরা এতদিন কী করছিল?
—আমরা ঠিক কী ভাবে এগোব বুঝতে পারছিলাম না। তিলক বলল।
—আমার যা বলার আমি পুলিসকে বলেছি। এস.ডি.জে.এম আলিপুরকে বলেছি। অমৃতার স্বামী এবং তার লোকজন এখানে ভাঙচুর করে, থানায় এফ.আই.আর. করে ওরা আমাকে থানায় নিয়ে গিয়েছিল। এক রাত হাজতবাস করেছি। তারপর জামিনে খালাস। কেস যখন উঠবে তখন কথা বলব, এখন না। আমার রাউন্ড দেবার সময় হয়ে গেছে। আপনারা এখন আসুন।
ওপাশের একটা দরজা দিয়ে উনি ভেতরে চলে গেলেন। ওরা বোকার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাইরে বেরিয়ে এল।
তিলক বলল—অরিন্দমদা এবার?
—এবার বাড়ি। বাড়ি চলো।
গাড়িতে উঠে স্টিয়ারিং-এ হাত দিয়ে অরিন্দম বললেন—দ্যাট ডক্টর নোজ আ লট। অ্যান্ড হি ইজ বেসিক্যালি নট আ ক্রুয়েলম্যান। দিস ইজ ইমপর্ট্যান্ট। উইদিন আ উইক উই উইল সল্ভ দা অমৃতা রিড্ল। হোপফুলি।
—এক সপ্তাহ?
—আবার কী?
—এত কনফিডেন্স আপনার? দোলা বলল।
—আমার নয় দোলা, ওই ডাক্তারের, কী যেন নাম? কার্লেকর। হি ইজ অ্যাবসলিউটলি শিওর অফ হিমসেলফ।
—তাতে কী হল? তিলক অবাক হয়ে বলল।
—দেখো তিলক, যারা হার্ডনড ক্রিমিন্যাল তাদের কথা আলাদা। কিন্তু একজন ডাক্তার যদি কোনও ক্রাইম করে ফেলেও থাকেন তিনি তো ক্রিমিন্যালের পর্যায়ে পড়েন না? পড়েন?
—সাধারণত না।
—ওঁদের কথাবার্তা হাবভাব প্রকাশ করে দেয় ভেতরে কোনও গণ্ডগোল আছে কি না। এখন এই ডাক্তারের মুখে তোমরা লক্ষ করেছ কি না জানি না, সামান্য হাসি লেগে ছিল। যাকে বলে দুষ্টু হাসি। খেয়াল করেছিলে?
লাবণি বললে—হ্যাঁ, আপনার মুখে যেমনটা মাঝে মধ্যে লেগে থাকে।
—থ্যাংক ইউ ম্যাডাম, ওই ডক্টর কার্লেকর খুব মজা পাচ্ছিলেন আমাদের দেখে। ইনটারেস্টিং ম্যান। ক্রাইম করে ওরকম মুখের ভাব হয় না।
—হোয়াট ইজ আওয়ার নেকস্ট কোর্স অফ অ্যাকশান? তিলক জিজ্ঞেস করল।
—ভাবতে দাও, একটু ভাবতে দাও।
প্রথমে দোলাকে নিউ বালিগঞ্জে নামিয়ে সোজা উত্তরে গিয়ে লাবণিকে গোয়াবাগানে নামাল অরিন্দম। তারপর তিলককে আমহার্স্ট স্ট্রিটে নামিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলল দক্ষিণের দিকে।
লাবণির মা জিজ্ঞেস করলেন—কোথায় গিয়েছিলি রে?
লাবণি বলল—বেড়াতে।
—অরিন্দমের সঙ্গে?
—হ্যাঁ কিন্তু আরও বন্ধুরা ছিল।
—তা হলে কথাবার্তা কিছুই হল না?
—হলও বটে, হল না-ও বটে।
—কী যে হেঁয়ালি করিস! মত কি তার পুরোনো জায়গায় অনড় আছে? না বদলাল।
—হুঁ।
—কী হুঁ হুঁ করছিস! বদলেছে?
লাবণি মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল—বদলেছে মা।—লোকটা বেশ! ওকে ছাড়া আর কাউকেই বিয়ে করব না—কথা দিচ্ছি। কিন্তু এম.এ. ফাইন্যালটা হয়ে গেলে।
—ওকে ছাড়া আর কাউকেই … বাব্বা, এত?
—কেন তোমার হিংসে হচ্ছে মেয়ে পর হয়ে গেল?
—হিংসে তো বটেই। কিন্তু এ হিংসেও যে কী সুখের, নিজে মা না হলে বুঝতে পারবি না।
—তবে একটা কথা মা। অন্য কোনও নাম ওর বার করতে হবে তোমাদের। অরি বা অরিন্দম বলে আমি ডাকতে পারব না। ওর বাবা মা তো অরি বলেই উল্লেখ করছিলেন। আর কোনও নাম নেই?
—আছে, মা খুব গম্ভীর ভাবে বললেন—ওর দিদিমা ওকে একটা অন্য নামে ডাকেন?
—বাঃ ভাল তো! কী নাম?
মা বললেন—নাড়ু। ডাকবি?
সেদিন রাত্রে লাবণি একটা অদ্ভূত স্বপ্ন দেখল। অনেক জল। অনেক, কিন্তু সমুদ্র নয়। স্থির জল। তার একূল ওকূল দেখা যায় না। সেই জলে একটা মড়া ভেসে যায়। কাছে এলে মনে হয় ওটা অমৃতার শব। একটা ফিকে নীল শাড়ি পরনে। চুলগুলো খুলে গেছে, জলে ছড়িয়ে গেছে। আরও কাছে এলে সেই শবের চোখ দুটি খুলে গেল, লাবণি দেখল চোখ দুটো তার। অমনি আয়ত। অমনি কাজল টানা। বড় বড় পাতা ছাওয়া বাদামি মণিওয়ালা চোখ। ভয় পেয়ে সে চিৎকার করে কার নাম ধরে ডাকল। তারপরই সে চমকে উঠে পাশ ফিরে শুল।
পরদিন সকালে ওর আট বছরের ছোট ভাই অবন, ওর পাশের খাটে শোয়, হাসতে হাসতে বলল, দিদি তোর হল কী? ঘুমের মধ্যে বুড়োদের মতো ‘হরি হরি’ করে ডাকছিলি? কবে থেকে তোর এত হরিভক্তি হল জানি না তো?