অমৃতা (Amtrita) – ২৬
সেইদিনই বাড়ি ফিরে জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখবরটা পেল অমৃতা। তার, তিলকের দুজনেরই ফার্স্ট ক্লাস এসেছে। শর্মিষ্ঠা বেচারি চার নম্বরের জন্য পায়নি। লাবণি মোটামুটি, দোলা কোনওমতে। চঞ্চল, নিশানেরও খুবই ভাল হয়েছে। ইংরেজিতে নিশান শতকরা ছাপ্পান্নরও বেশি পেয়েছে, রীতিমতো ভালই বলতে হবে। এই ফলাফল সে আর তিলক আশা তো করছিলই। তবু, যতক্ষণ না হচ্ছে একটা কিন্তু থেকে যায়ই। তিলকই তাকে ফোন করে জানিয়েছিল খবরটা। সে সর্বপ্রথম জানাল শিবানী মাসিকে।
মাসি বললেন—কম খেটেছিলি? তার দাম পেয়েছিস। তারপর করল জয়িতাদিকে।
উনি বললেন—খুব, খুব ভাল লিখেছ অমৃতা।
—দিদি, আপনি তো জানেন কৃতিত্বটা কার!
—আমি যথাসাধ্য সাহায্য করেছি। কিন্তু আয়ত্ত করার কৃতিত্বটা নিশ্চয়ই তোমার। একটা ভাল কলেজে লেকচারারশিপ পাওয়ার আর কোনও বাধা তোমার রইল না। নেট-স্লেট-এ বসো। ইচ্ছে হলে আই. এ. এস.ও দিতে পারো। কিন্তু তাতে বোধহয় টুটুলের অসুবিধে হবে।
তৃতীয় ফোনটা শম্পাকে।
শম্পার গলা ভিজে, বলল—কত যে আনন্দ হচ্ছে, বলে বোঝাতে পারব না রে। অমৃতা, যত বাধাই আসুক, তুই অনে-ক অনে-ক দূর যাবি।
—একটা রেজাল্ট থেকেই এই কংক্লুশনে এসে গেলি?
—আমার কেমন মনে হচ্ছে রে। তা ছাড়া, এটা আমার উইশ-ও বটে। যেন যাস। যেন অনেক উঁচুতে উঠিস অমৃতা!
তারপরের ফোনটা সে করল ডক্টর কার্লেকরকে। সকাল আটটা, এই সময়ে ওঁকে পাওয়া গেলেও যেতে পারে।
—ডক্টর কার্লেকর আছেন?
—কে বলছেন?
রম্ভার গলা সে শোনেনি, কিন্তু শুনেই বুঝতে পারল। কণ্ঠস্বরেও যে এমন বিষাদের স্পর্শ থাকতে পারে, আগে কখনও বোঝেনি অমৃতা।
—আমার নাম অমৃতা চক্রবর্তী, আমি এম.এ.-তে খুব ভাল রেজাল্ট করেছি, তাই ওঁকে জানাচ্ছিলাম।
—আচ্ছা, আমি বলে দেব।
অমৃতা হঠাৎ বলে ফেলল—আপনাকেও, আপনাকেও জানাচ্ছি।
—কংগ্রাচুলেশন্স্।
—আপনি ভাল আছেন দিদি? ছেলেমানুষের মতো বলে উঠল অমৃতা।
ও পক্ষ চুপ। কিছুক্ষণ পর টেলিফোনটা রেখে দেবার শব্দ হল। উনি কি কিছু মনে করলেন? এত অন্তরঙ্গ সম্বোধন, অন্তরঙ্গ প্রশ্ন কি তার করা উচিত হয়নি! ওঁদের মহলে এ রকম কি কেউ করে না? একটা মাখামাখি করবার চেষ্টা সে করেছে এমনটাই কি মনে করলেন উনি? ছি! ছি! এমন ভুল তো সে কখনও করেনি! ওঁর ব্যক্তিত্ব এত উঁচু দরের এত জোরালো যে খানিকক্ষণের জন্য যেন তাকে অভিভূত, ছোট্ট ছেলেমানুষ করে দিয়েছিল। ছেলেমানুষ হবার সুযোগ যে কারও কাছেই পায়নি সে। না। মা, বাবার কাছেও না। এত দাম্ভিক উনি! স্নব! কেন যেন তার বোধিসত্তা বারবার বলতে লাগল না, না, দম্ভ নয়, এ দম্ভ নয়, আর কিছু।
পরদিন, তখন খুব সুন্দর শীত-শেষ প্রথম-বসন্তের অপূর্ব সকাল, আকাশে-বাতাসে কোথাও যেন কোনও মালিন্য নেই, সে বেরোচ্ছিল শিবানী মাসির কাছে যাবে বলে। সাফল্যের হর্ষ ছোঁয়া লাগিয়েছে তার দেহে মনে, সুদ্ধু একটু সামান্য ধূসরতা, রম্ভা কার্লেকরের রহস্যময় আচরণের কারণে, ডক্টর কার্লেকরের গাড়ি এসে থামল।
—কী? ফার্স্টক্লাস হয়েছে?
—ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট।
—ওহ্, ওয়ান্ডারফুল, ওয়ান্ডারফুল। থ্যাংক গড। তিনি তোমাকে দেখছেন অমৃতা। গাড়ির বুট থেকে একটা মস্ত কিছু টেনে বার করলেন উনি। বললেন, টুটুল কোথায়?
—টুটুল মায়ের কাছে।
—দাঁত বেরোল?
—হুঁ, দুটো। ওল্টাচ্ছে, পাল্টাচ্ছে, পিছলে পিছলে সর্বত্র যাচ্ছে …
—ওর জন্যে একটা প্লে পেন এনেছি।
—প্লে-পেন?
—হ্যাঁ, ওটা ফোল্ডিং, ফাইবারের তৈরি, লাগবে টাগবে না, খুলে চার-চৌকো করে পেতে ওকে ভেতরে বসিয়ে দেবে, ভেতরে খেলনা রাখবে, টীদিং রিং রাখবে একটা, দেখবে ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা …
—ও, পাশ করলাম আমি, আর উপহার এল টুটুলের।
—টুটুল আমার ছেলে না হয়েও ছেলেই, এটা বোধহয় তুমি বুঝতে পারো না, না?
—বুঝি বইকি। আপনিই তো ওকে বাঁচিয়েছেন। … আমাকেও।
—না অমৃতা, ঈশ্বর বাঁচিয়েছেন ওকে, তোমাদের। কিন্তু তার জন্য তিনি নির্বাচন করেছিলেন আমাকে। দুরূহ সৌভাগ্য সেই বহি প্রাণপণে…।
—আপনার কবিতাও মনে আছে!
কোনও উত্তর দিলেন না কার্লেকর। আহত দৃষ্টিতে চাইলেন তার দিকে। তারপর বললেন—গিফ্ট তোমার জন্যেও আছে। নেবে?
অমৃতা কিছু বলবার আগেই পেছন ফিরলেন কার্লেকর, তারপর গাড়ির ভেতর থেকে এক বিশাল লাল গোলাপের তোড়া বার করে তুলে দিলেন অমৃতার হাতে। আর ঠিক সেই সময়েই ফাটল অ্যাসিড বাল্বটা।
বাঁদিকের শাড়ি তার কুঁকড়ে যাচ্ছে, কুঁকড়ে যাচ্ছে তার বাম অঙ্গ। অ্যাসিডের বিকট ঝাঁঝালো গন্ধে, যন্ত্রণায় সে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে, ডক্টর কার্লেকর বিদ্যুৎগতিতে তাকে তুলে নিলেন গাড়িতে। শোফারকে বললেন—পি. জি, ছোটাও কুইক।
দুঃসহ যন্ত্রণার একটা গাছ। তার ডালে ডালে আগুনের ফল। পাতাগুলো সেঁকো বিষের। শিকড় চারিয়ে গেছে বুঝি অনেক গভীরে যেখানে পৃথিবী স্বয়ং জ্বলছে। মাটিতে আগুন, আকাশে আগুন, বাতাসে ড্রাগনের নিশ্বাস। আগুনের শিখাগুলো ছোট ছোট ছেলেদের মতো দাপাদাপি করছে।
তিনদিন তিনরাত। জ্ঞান ফিরলে সে শুধু কোনওমতে বলল—‘টুটুল!’
—টুটুল তোমার মাসির কাছে। ভেবো না অমৃতা। ও ঠিক আছে।—সামনে ডাক্তারের সর্বরোগহর সেই মুখ দেখে সে চোখ বুজল।
চাপা কান্নার শব্দ। মা বোধহয়, ঘোরের মধ্যে ভাবল সে। কান্নাই মায়ের একমাত্র সম্বল। মায়ের নামে সে ছেলের নাম দিয়েছে সীমান্ত। শম্পা, শম্পা, সৌমিত্র কি বুঝল? দোলা তুই ধৈর্য ধরিস? কী করছে তোর রোমিও? লাবণি তুই আমাকে এত ভালবাসতিস … জানতাম না, অরিন্দমদা উঃ মাফ করুন। কী যে আনন্দ তুই ফার্স্টক্লাস সেকেন্ড হয়েছিস, তিলক! এবার একটা ভাল চাকরি পাবি … কলেজ সার্ভিস কমিশন, জয়িতাদি আপনার নোটসগুলো এবার ফেরত নিন … কী ভাল, কী ভাল তোরা সবাই। উঃ, মা-আ-আ।
নেট, স্লেট পরীক্ষার বিজ্ঞাপন বেরোল, ফর্ম জমা দেবার তারিখ পেরিয়ে গেল, তিলক-শর্মিষ্ঠা-নিশান বসল। তখনও অমৃতার চিকিৎসা চলছে। ফলাফল বেরোল, তারপর ভাইভা। তিলক নিশানের চাকরি হয়ে গেল, শর্মিষ্ঠাকে নর্থ বেঙ্গলে দিয়েছিল বলে সে গেল না, তখনও অমৃতার চিকিৎসা চলছে। কাচের ঘেরাটোপের মধ্যে, কেউ তার কাছে যেতে পারে না। অসম্ভব যত্নে, সেবায়, ওষুধে, সতর্কতায় প্রথম পি.জি., তারপর ‘উজ্জীবন’, আবার পি. জি. অবশেষে ঘা শুকোল। বাঁ হাতের পোড়া অংশ প্লাস্টিক সার্জারি। হাসপাতাল থেকে অবশেষে যখন ছাড়া পেল, কার্লেকর বললেন—মিসেস দত্ত, আপনার কাছে না হলে তো …
শিবানী বললেন—কী আশ্চর্য! সে তো বটেই …
—টুটুলকে নিয়ে পারবেন? না একজন সিসটার…
—রাখাই যায়, তবে টুটুলের তো প্লে-পেন আছে।
কথা শুনে এত কষ্টেও রোগিণী এবং তার ডাক্তার হাসলেন।
সীমা বললেন—টুটুলকে বরং আমি নিয়ে যাই।
—বাচ্চা ছেলের ধকল কখনও তুমি সামলাতে পারো? —বিশ্বজিৎ বললেন।
অবসাদে চোখ বুজল অমৃতা।
সেই সময়ে সন্ধ্যার ভিজিটিং আওয়ারে ওরা সবাই দেখতে এসেছিল তাকে। শম্পা-সৌমিত্র, লাবণি-অরিন্দম, দোলা-অমিতাভ, তিলক, শর্মিষ্ঠা, নিলয়, চঞ্চল, নিশান সবাই। কেউ কোনও কথা বলতে পারছিল না। সব একেবারে চুপচাপ। রোগিণীই ক্ষীণ হাসল, ভাল ডান হাতটা একটু তুলল।
অনেক যন্ত্রণা দেখেছেন রঞ্জন। তাঁর পেশাটা তো যন্ত্রণা দেখারই! কত রকম ভঙ্গি দেখেছেন যন্ত্রণা সইবার। কিন্তু এত সাহস, এমন শান্ত সাহস একটি এই বয়সী মেয়ের—এ তিনি কখনও দেখেননি যেন। ও তো বলছে না একবারও—কেন এমন হল? কেন আমার কপালেই বারে বারে হয়! আমাকে মেরে ওদের কী লাভ? যতদিন ওদের কাছে ছিলাম, ওদের উপকারই তো করেছিলাম। তাহলে কেন? কিন্তু ও কিচ্ছু বলছে না। ফরিয়াদ বুঝি ফুরিয়ে গেছে আজ ওর। ও ধরে নিয়েছে এটাই, এরকমটাই ওর হবে। ও শুধু লড়ে যাচ্ছে। অবশ্যই ডাক্তাররা আছেন, নার্সরা আছেন, শিবানী মাসি আছেন! কিন্তু, শেষ পর্যন্ত দাঁতে দাঁত চাপা ভয়ঙ্কর লড়াইটা তো ওর একারই! অথচ জীবনের কোনও পর্বেই ও নিজের হাতে নির্বাচন তুলে নেয়নি। না বিবাহ, না সন্তানধারণ। এমনকি আইনি-লড়াই ও বিবাহ-বিচ্ছেদও ঘটেছে যেন কারণ ও ফলাফলের স্বাভাবিক যুক্তিতে। যে অত্যাচার, যে যন্ত্রণা ও ভোগ করল, করে চলেছে, তার কোনও দায়ভাগ ওর নেই। ও যদি আজ বিমূর্ত নৈর্ব্যক্তিক এই সমাজকে প্রশ্ন করে—কেন? তো করতেই পারে। যদি ছিঁড়ে খুঁড়ে দিতে চায় সব, ধ্বংস চায় তো চাইতেই পারে। তখন কারও কাছে কোনও উত্তর থাকবে না। সমাধান থাকবে না।
সেই কথাটাই আজ তিনি বলছিলেন রম্ভাকে। বলছিলেন সেই কাচের জানলার সামনে বসে। সেখান থেকে খোলা আকাশ দেখা যায়, দেখা যায় গাছপালার এক সবুজ সমৃদ্ধ রূপ। প্রথমটা বলছিলেন বলিষ্ঠ দৃপ্ত ভঙ্গিতে, তারপর আবেগে আপ্লুত হয়ে—
বোঝ তো রম্ভা? শক! সুদ্ধু শকেই ওর মরে যাওয়ার কথা! কী প্রাণ যে মেয়েটাকে দিয়েছিলেন ঈশ্বর!
অনেক, অনেক দিন পর নিজের অভিজ্ঞতা, অনুভব, বিস্ময়, শ্রদ্ধার কথা অকপটে রম্ভার কাছে পেশ করলেন তিনি।
জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে অমৃতা। দাঁড়িয়ে আছে প্রতীক্ষায়। কখন তিনি আসবেন। এ যদি ডোভার লেনের জানলা হয় তা হলেও আসবেন, যদি করুণাময়ীর জানলা হয় তা হলেও আসবেন। একটা ধূসর রঙের মারুতি এসটিম। জানলার কাছে এসে গাড়ির স্মোক্ড গ্লাস একটু নামাবেন, ওপর দিকে তাকাবেন, ডান হাতটা ঈষৎ তুলে। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেবে, ডান হাতটা একটু তুলবে। আবার একটা পুরো দিনের প্রতীক্ষা। ইতিমধ্যে আছে মা-বাবা এবং শিবানী মাসি, শম্পার ফোন, দোলার আর্তি, সম্পদের চিঠি, লাবণি-অরিন্দমের এক আধ দিনের আসা-যাওয়া, আছে তিলক, আছেন জয়িতাদি আর আছে টলটল পায়ে টুটুল, সীমান্ত! আগে ছিল তার রক্তের মধ্যে একটা ওতপ্রোত কর্তব্যবোধ, দায়িত্বনিষ্ঠা। সন্তোষ ছিল না, সবটাই শুষ্ক, এমন নয়। কোনও কাজ সময়মতো, সুন্দর করে শেষ করতে পারলে মনটা খুশি হত। অদ্ভূত একটা স্বস্তিবাচন শুনতে পেত ভেতরে। কিন্তু এ অন্যরকম। এ বেদনা, এ যন্ত্রণা, এ আনন্দও, অসীম অপার রোমাঞ্চক। সারা দিনের মধ্যে ‘উজ্জীবন’ যাবার পথে তিনি একটিবার এই পথ দিয়ে ঘুরে যাবেন। ওপর দিকে তাকাবেন। বেশিক্ষণ নয়, কিন্তু মনে হবে নির্নিমেষ, অনন্তকাল। তার আত্মার গভীরে চোখ রাখবেন তিনি। এমন একটা কিছুর বিনিময় হবে যার অস্তিত্বের কথা সে-ও জানত না, তিনিও জানতেন না। এই প্রথম যেন সেটা আবিষ্কৃত হল পৃথিবীতে। অ্যান্টি-বায়োটিকের মতে, কোয়ার্কের মতো। রঞ্জন তো তাদের বাড়িতে আসেনই। আসেন টুটুলকে দেখতে, চোখের দেখা এবং ডাক্তারের দেখা, দেখেন তাকেও—‘কী অমৃতা! কনুইয়ের কাছে সেই পেইনটা নেই তো আর? কী বললে? ডান কনুইয়ে? এঃ, ওটা তোমার কল্পনা।’ বাম বুকের ওপর থেকে পা পর্যন্ত ঝলসে আংরা হয়ে গিয়েছিল। অসীম কষ্টে ও ধৈর্যে হাত সুদ্ধ ওপর দিকটা প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়েছে। দপদপে যন্ত্রণা এখনও ফিরে ফিরে আসে। কিন্তু সেটা বাঁ দিক। ডান দিকের কোনও ব্যথাকে স্বীকার করতে দেবেন না তিনি।
—মিসেস দত্ত নার্সিংটা পড়ে নিতে পারতেন, সুদ্ধু কতকগুলো টেকনিক্যাল জিনিস… দেখি গভীর করে নিশ্বাস নাও—হ্যাঁ ঠিক আছে।
—কী বিশ্বজিৎবাবু আপনাকেও একটু দেখে দেব না কি? আমার তো মনে হয় মিসেসের চেয়ে আপনারই ব্লাড-প্রেশারটা বেশি যাচ্ছে আজকাল। —টুটুলকে কোলে তুলে তিনি হাসবেন।
দুই পরিবারেরই বন্ধু। প্রায় পারিবারিক চিকিৎসক। ছোটখাটো হাসি-ঠাট্টা, টুটুলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আধা-সিরিয়াস জল্পনা, মাঝেমাঝেই ঘোষণা—‘টুটুল কিন্তু আমারই, সে আপনারা মানুন, আর নাই মানুন।’
অমৃতাও স্বাভাবিক। চা কিংবা কফি এনে দিচ্ছে।—আজ টুটুলের দু বছর পূর্ণ হল, পায়েস, মানে পরমান্ন, খাবেন না কি?
—সুগার-ফুগার আবার হয়নি তো? কী? মিসেস দত্ত?
—আপনার সুগার হয়েছে কি না আমি কেমন করে জানব?
—আমার কী হয়েছে, না হয়েছে জানবার সুযোগ পাই না কি? এই এরা, অমৃতার দিকে তাকিয়ে বলল—‘এরা’ সে সুযোগ দেয়? একদিন ধড়াস করে পড়ব আর মরব।
—বলেই চোখ গোল করে ফেলবেন—এ কী! ‘ষাটষাট, এ আবার কী কথা, ষেটের বাছা ষাট’ এ সব কিছু বললেন না? নাঃ আধুনিককালের মাসি-পিসিরাও দয়ামায়ায় খাটো হয়ে পড়ছেন।
কিন্তু জানলার সামনে যখন গাড়িটার গতি ধীর হয়ে আসে! কাচ নামিয়ে উর্ধ্বমুখ হন যে রঞ্জন, তিনি অন্য রঞ্জন, যিনি কথা জানেন না, হাসি জানেন না, যাঁর শুধু চোখ ছাড়া আর অন্য ইন্দ্রিয় নেই। অমৃতাও স্থাণু হয়ে থাকে সেই দৃষ্টির সামনে। সে-ও তখন কথা হারা, দৃষ্টি, শুধু দৃষ্টি, আর কিছু না, কিচ্ছু না।
সেদিন গিয়েছিলেন ‘উজ্জীবন’ থেকে হাসপাতাল, হাসপাতাল থেকে অন্য একটি নার্সিংহোমে, আবার ‘উজ্জীবন’। অপারেশন করতে হয়েছে ছোটয় বড়য় মিলিয়ে সাতটা। বাড়ি ফিরতে একটু রাত হয়ে গেছে। প্রায় এগারোটা। ভয়ানক ক্লান্ত তিনি আজ। না, এরকম শিডিউল চলবে না, চলবে না আর। চান করলেন, রম্ভা নামল না। একটা হুইস্কি নিলেন, রম্ভা নামল না।
—মেমসাব কোথায়?—তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেমসাব’ কথাটা তিনি পছন্দ করেন না আদৌ, কিন্তু তাঁর কেতাদুরস্ত বেয়ারারা করে। তাই তাঁকেও …। কত কাজই যে নিজের পছন্দের বিরুদ্ধে করতে হয় মানুষকে।
—কী জানি! জানি না তো! নামেননি!
আস্তে আস্তে ওপরে উঠলেন তিনি, অবসন্ন পা টেনে টেনে। কেন নীচে এল না রম্ভা যেমন আসে, কেন পানীয় নিয়ে বসল না, যেমন বসে? সবই তো দিয়েছেন তাকে। মেনে নিয়েছেন সন্তানসম্পর্কহীন, সদা-সতর্ক, প্রশ্ন আর সন্দেহের কূট স্পট-লাইটের তলাকার দিনরাত। এতেও কি তাঁর প্রায়শ্চিত্ত হয়নি? এত দিনেও? ও কি জানে না ডাক্তারের জীবন? ডাক্তারের দায়? তবু এই অর্থহীন অবুঝ অভিমান? তাঁকে খুবই ক্লান্ত করে এসব আজ।
রম্ভা! রম্ভা! শোবার ঘরের ঠিক দোরগোড়ায় দুজনের দেখা হয়ে গেল। দ্রুত আসছে রম্ভা, উল্লাসের সুরে বলছে—রঞ্জন, রঞ্জন, আমার আবার হচ্ছে।
—কী হচ্ছে?
—বুঝতে পারছ না? আমি আবার যৌবন ফিরে পাচ্ছি, আবার কনসীভ করব, মা হব, রঞ্জন এই দ্যাখো … |
রক্তরঞ্জিত একটা পেটিকোট রঞ্জনের দিকে জয়ের রক্তনিশানের মতো তুলে ধরেন রম্ভা।
হঠাৎ একটা বিদ্যুৎগতি আসে রঞ্জনের অবসন্ন দেহে। লুকোনো ভাঁড়ার থেকে সঞ্চিত শক্তি কৌটোর ঢাকনা ফাটিয়ে বেরিয়ে আসে।
—রম্ভা, রম্ভা কী বলছ? ঠিক? এ সত্যি?
স্বামীর কাঁধে মাথা পৌঁছয় রম্ভার। গলার স্বর থরথর করে কাঁপতে থাকে, ভীষণ যেন শীত শীত করছে, দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে।
—ঠিক রঞ্জন, ঠিক। চার বছর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আবার দ্বিগুণ বেগে ফিরে এসেছে।—স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন রম্ভা—আবার আমি তোমাকে সন্তান উপহার দিতে পারব। আবার পারব যা বলো সব, স-ব।
কী বলছে রম্ভা? একটা কোয়ালিফায়েড ডাক্তার সে এর মানে বোঝে না? পলিপ? ফাইব্রয়েড? হিস্টেরেকটমি? নাকি—ঈশ্বর, হে ঈশ্বর! তিনি ডাক্তার কিন্তু সব সময়ে তাঁর ঈশ্বরের কথা মনে হয়। সমস্তরকম বিপদে। সম্পদে।
—কবে? কবে থেকে এমন হচ্ছে?
—কতদিন, কতকাল তুমি কাছে আসো না, কত দিন বন্ধ করে দিয়েছ তোমার দ্বার সে আর আমার হিসেব নেই রঞ্জন। সাহস শুধু সাহসে বুক বেঁধে …
—রম্ভা, আমার সোনা, আমার মণি।—তিনি প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেন তাঁর প্রথম প্রণয়িনীকে। বোঝেন এই তাঁর প্রথম, এবং এই তাঁর শেষও। এবার ডায়াগনস্টিক ডি. সি, তারপর অপারেশন, অপারেব্ল না হলে রেডিয়েশন বা কেমো বা রেডিওপ্লাস কেমো, এখানে, না হলে যত দূর দূরান্তেই হোক, যদি থাকে, যদি কোথাও এতটুকু অস্ফুট আশাও থেকে থাকে!
সোমবার। সকাল সাড়ে নটা। শাদার ওপর গোলাপি ডুরে শাড়ি পরা অমৃতা। চান করে চুল মেলে দিয়েছে। এখন আর কিছু সামনে নেই। শুধু একটি জানলা। আধঘণ্টা পার হয়ে যায়, পঁয়তাল্লিশ মিনিট, ধূসর এসটিম আসে না।
টুটুল ডাকে—ম্ মা-আ।
—কী সোনা?
—আমায় কোলে।
সে দু হাত বাড়িয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নেয়। চুমো খায়।
টুটুল ফিরে চুমো খায় তাকে। কপালে, গালে মিষ্টি মিষ্টি শব্দ করে। নাকে নাক ঠেকিয়ে।
মঙ্গলবার। নটা। সে নীলের ওপর শাদা ফুটি-ফুটি একটা তাঁতের শাড়ি পরেছে। যদি আগে চলে যান! এরকম হয় না, তবু … যদি … আধ ঘণ্টা, পঁয়তাল্লিশ মিনিট, পঞ্চাশ মিনিট …।
—খুকি, আজ যে তোর ইন্টারভিউ, ভুলে গেছিস?
—যাই মা!
বুধবার। দশটা। হয় না, তবু কোনও কারণে হয়তো কদিন দেরি হচ্ছে। ঘিয়ে রঙের ওপর তুঁতের আলপনা দেওয়া একটা ছাপা শাড়ি পরেছে সে। কপালে টিপ দিতে ভুলে গেছে। চুল ভালো করে আঁচড়ায়নি।
—বারোটা বাজল।
—টুটুল খেয়েছে মাসি?
—খুব ভাল করে খেয়েছে। এবার তুই বোস।
বৃহস্পতিবার। যেমন তেমন একটা শাড়ি। পরতে হয়, তাই পরা, চুলে চিরুনি চলেনি। ভুলে গেছে। নটা বাজল, দশটা বাজল, এগারোটা বাজল। টুটুল আবদার করে তাকে ধরে নিয়ে গেল। সে ঘুম পাড়াচ্ছে। বুলবুলিতে ধান খেয়েছে … খাজনা দেবো কিসে।
শুক্রবার। সে সল্টলেকের বাড়ির বাঁশের গেটে এসে দাঁড়িয়েছে। রোদ্দুর মাথায় করে। আজও না।
—‘উজ্জীবন’ নার্সিংহোম?
—হ্যাঁ, বলুন।
—সিসটার মাধুরী সেনকে একবার দেবেন?
—ডাকছি।
—হ্যালো!
—মাধুরীদি, আমি অমৃতা, ডক্টর কার্লেকরকে একবার পাওয়া যাবে?
—উনি তো নেই! আসছেন না।
—সে কী! কেন? অসুস্থ?
—উনি নন। ওঁর স্ত্রী। গত পরশু বম্বে রওনা হয়ে গেছেন।
—কী হয়েছে?
—কী আর! দীর্ঘনিশ্বাসের শব্দ টেলিফোনের তার তোলপাড় করে এসে পৌঁছয়।
রিসিভারটা অসাড় হাত থেকে খসে যায়। তার বোধিসত্তা বলে— রম্ভা কার্লেকর ফিরবেন না। রঞ্জন, রঞ্জন কার্লেকরও ফিরবেন না আর। এখন আর প্রতীক্ষা নেই, এখন আর জানলা নেই। এখন সব অন্ধকার। শিথিল হাতে ভবিষ্যযাত্রার সরু পেনসিল-টর্চটা সে হাতে তুলে নেয়।