অমৃতা (Amtrita) – ২৪
রেজাল্ট সম্পর্কে অনেক রকম গুজব রটতে শুরু করেছে। কেউ বলছে শর্মিষ্ঠা পাইন ফার্স্টক্লাস পেয়েছে, সে হলফ করে বলতে পারে, ভেতরের খবর। কেউ বলছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এবারের ফলাফল, কে? কে? দোলার ফোনটা যখন এল অমৃতা এরকম কিছু গুজবই আশঙ্কা করছিল। মা ডেকে দিল। দোলার মনের মধ্যে এত তাড়া যে সে অমৃতার মায়ের কুশল জিজ্ঞাসা করতেও ভুলে গেছে।
—কে?
—আমি দোলা বলছি।
—বল, চঞ্চল ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েছে এই তো!
—না, না, ও সব না।
—তবে বল কেমন আছিস। দুজনে, না, না, তিনজনে?
—ভাল না রে অমৃতা
—এখনও শরীরটা…
—শরীর ঠিকই আছে। মন…
—সে কী? কেন? —নিজের জীবনে চূড়ান্ত দুর্দৈব ঘটে গেছে, তবু যেন অমৃতার বিস্ময় আর ফুরোতে চায় না।
—একটু আসবি?
—তোদের বাড়ি? বড্ড দূর যে রে! টুটুলকে ছেড়ে অতক্ষণ
—তা হলে মাঝামাঝি কোথাও। ধর ব্লু-ফক্স?
—আমার সে রেস্ত কোথায় বল?
—খরচ তো করব আমি। তোর কী?
—ঠিক আছে।
ব্লু-ফক্সের আবহে অমৃতা আর দোলা। অমৃতার পছন্দের রং নীল, হালকা সমুদ্র-সবুজ, লাইল্যাক, দোলার পছন্দের রং কমলা, মেরুন, গোলাপি। অথচ দুজনেই আজ হলুদ বনের কলুদ ফুল হয়ে এসেছে। কলেজ হলে এই নিয়ে কত বিস্ময় কত উচ্ছ্বাসে ঘণ্টাখানেক তো কাটতই। সবই তো বুদবুদ, কথা ভাবের, ভাব মেজাজের। এখন বুদবুদ নেই, দুজনে একই রঙের শাড়ি পরে, সে সম্পর্কে একেবারে অচেতন হয়ে গ্রিল্ড্ ফিশ-এর সাজানো প্লেটের সামনে বসে আছে।
দোলার মুখ এমন যে আর দু-এক বছর আগে হলেই অমৃতা ভাবত দোলা এখ্খুনি বলে উঠবে—জানিস অমৃতা, আমার তোর ওপর ভীষণ রাগ হয়েছে। তুই কেন…। চা, ক্ষমা চা। কিন্তু সেই ছেলেমানুষির মায়া আর বোধ হয় সে মুখে নেই।
সে বলল—এমন জরুরি তলব? কী ব্যাপার রে?
—অমৃতা, একটা বাচ্চাকে একা একা বড় করতে খুব কষ্ট, না রে?
—খুব কষ্ট, আবার খুব আনন্দও রে। পৃথিবীর সব মায়েরা কাজটা স্বচ্ছন্দে করে এসেছে। নইলে কি আর পারত!
—কিন্তু তাদের তো পাশে কেউ একজন থাকত! ন্যাপি-বদলে না দিলেও, ফিড না করলেও, একজন…। তুই এমন একা-একা…কথা শেষ করতে পারে না দোলা।
—হ্যাঁ, মাসি আছেন, মা-বাবা আছে, তবু শেষ পর্যন্ত আমি টুটুলের বাবা-মা দুটোই।
—কী করে পারিস?
—আমি তো গোড়ার থেকেই… জানতামই তো।
—অমৃতা, তুই বিয়ের আগেও অনেক দায়িত্ব নিয়েছিস। নিতিস। হয়তো তাই পারছিস। কিন্তু আমি…আমার পক্ষে একা একা
অমৃতা চমকে বলল—একা? কেন?
দোলা মুখ নিচু করে ফেলেছে। ফর্সা মুখ কেমন রক্তহীন দেখাচ্ছে। সে বলল—কাউকে বলিস না অমৃতা, আমার কেমন মনে হচ্ছে বাচ্চাটাকে আমায় একা একাই মানুষ করতে হবে। ওর বাবা…ওর বাবা..।
—ওর বাবা কী? ও কি তুই কাঁদছিস দোলা?
—বিয়েটা বোধহয় আমি ঠিক করিনি রে। সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়েছিলাম। আমার বাবা-মা, ওর বাবা-মা, দিদি-পার্থদা সব্বাই। কী জানি হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে, হয়তো এসব সংশয়ের কথা এখনই কাউকে বলাও আমার উচিত হচ্ছে না। কিন্তু একমাত্র তোকেই বিশ্বাস করে বলতে পারি।—দোলার স্বর ভেঙে গেছে।
—ব্যাপারটা কী বলবি তো?
—ও তো গোড়ার থেকেই বাচ্চাটা চায়নি৷
অমৃতার মুখ শক্ত হয়ে গেল নিজের অভিজ্ঞতার কথা ভেবে। সে বলল—তো?
—আমিও এটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। বিয়ের আগেই…অমৃতা প্লিজ আমাকে খারাপ ভাবিসনি।
—ভাবছি না। তুই বল।
—আমি টার্মিনেট করতে চাইনি বলেই বিয়েটা হল।
অমৃতা তার চূড়ান্ত বিস্ময়কে যত কম পারে প্রকাশ করে বলল—টার্মিনেট করা গেলে কি বিয়েটা হত না?
—আমি জানি না, জানি না অমৃতা—দোলার চোখে রুমাল। রুমালের আড়ালে চোখ রাঙা হতে থাকে।
—আমি ওকে বুঝি না। উন্মাদের মতো ভালবাসি ওকে। কিন্তু প্রতিদান পাই কি না বুঝতে পারি না।
উন্মাদের মতো? সে ব্যাপারটা কী রকম? নিজেকে একেবারে হারিয়ে ফেলা কী অমৃতা জানে না। বইয়েতে পড়েছে, কবিতায়, উপন্যাসে কত গল্প লেখা হল এ নিয়ে, প্রচুর, প্রচুর। লিখেছে সে সেসবের কথা পরীক্ষার খাতায় খাতায়। কিন্তু কোনও ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা নেই তার। দোলা পারে। সে পারে না। কিন্তু দুজনেই শেষ পর্যন্ত এক অবস্থানে পৌঁছচ্ছে। এই এক রঙের শাড়ির মতো। দোলার কমলা লাল উন্মাদনাও তাকে রক্ষা করতে পারছে না, তার শান্ত নীল প্রসন্ন সুমিত সবুজ কাণ্ডজ্ঞানও তাকে পারেনি। সে কী বলবে দোলাকে? কী বলবে এখন?
—দোলা, একটু ধৈর্য ধর।
—থাকেই না রে, কোথায় কোথায় ঘোরে জানি না। কতটা ওর কাজ, কতটা শখ…। ট্যুরে গেছে বলে জানি অথচ পার্থদা একদিন ওকে জে-ইউয়ের ক্যাম্পাস থেকে একদঙ্গল ছেলে মেয়ের সঙ্গে বেরোতে দেখেছে। তিলক দেখেছে রবীন্দ্রসদনে।
—আর কেউ সঙ্গে ছিল?
—জানি না। তিলক বলল তোর রোমিওকে দেখলুম অথচ তুই জুলিয়েট পাশে নেই!..আমি ওকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না অমৃতা। এ যে কী কষ্ট, কী ভয়ানক যন্ত্রণা…বলতে বলতে দোলা একেবারে ভেঙে পড়ল।
এখন লাঞ্চের আগের সময়টা। টেবিলগুলো রেডি করা হচ্ছে। খুব বেশি লোক নেই ভেতরে। দু একজন বেয়ারা ফিরে তাকাল।
—দোলা প্লিজ।
—অমৃতা, আমি যে এই অবস্থায় বাবা-মায়ের কাছে এতদিন আছি, ওর তো কিছু দেওয়া উচিত। বাবা-মাকে না-ই দিল, আমাকে? আমাকে তো দেবে? দেয় তো না-ই। উল্টে আমার কাছ থেকে আজ পাঁচশো, পরের সপ্তাহে হাজার এমনি করে চায়। বলে শোধ দিয়ে দেব। অমৃতা এ আমি কী করলাম! এখন এই জালের মধ্যে থেকে…তা ছাড়া ওকে দেখলেই আমার বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুল হয়ে যায়।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে অমৃতা বলল—আমাকে কী করতে বলিস!
অমৃতা সেই অমোঘ বাক্য বলতে পারত। আমাকে জিজ্ঞেস করে তো এগোসনি, আমি কী বলব! কিন্তু বলতে পারল না। তার বিপদের দিনে দোলা ব্লু-ফক্স থেকে বেরচ্ছিল। কিন্তু তবু দোলা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
—কিছু বল, কিছু অন্তত বল। তোর কী মনে হচ্ছে, কী মত!
—এখনই এসব নিয়ে মাথা ঘামাসনি দোলা, সে বলল, হয়তো তিলকে তাল করে দেখছিস। বাচ্চাটাকে নির্বিঘ্নে হতে দে। তবে…টাকাকড়ি আর একেবারেই দিস না। বলবি এক পয়সাও আর তোর কাছে নেই। তোকেই বরং ও কিছু দিয়ে যাক। মা-বাবার কাছে চাইতে তোর মানে লাগে। মানের কথাটা বেশি করে বলবি। যেগুলো নিয়েছে সেগুলোও তাড়াতাড়ি ফেরত দিক। কারও কাছে ও যেন ছোট না হয়ে যায়। তুই যে অবিশ্বাস করছিস, এটা জানতে না দেওয়াই ভাল বুঝলি দোলা? ঝগড়া, মান-অভিমান করিস না। হালকাভাবে জিজ্ঞেস করতে পারিস—পার্থদাকে ও জে.ইউয়ের গেটে দেখতে পেয়েছিল কি না, রবীন্দ্রসদনে কেন তিলককে চিনতে পারেনি। নিজেকে শান্ত রাখ দোলা। বাচ্চাটার ক্ষতি হবে নইলে। কোনও উন্মাদনার দোহাই দিয়েই বাচ্চাটার ক্ষতি করবার অধিকার তোর নেই।
মুখ ঢেকে হাউ-হাউ করে কাঁদতে লাগল দোলা। অপরিমিত যৌন আকর্ষণ, সন্দেহ, নিরাপত্তাবোধের এই তছনছ হয়ে যাওয়া কীভাবে ভেতরের সেই ছোট্ট হতে থাকা মানুষটিকে প্রভাবিত করছে তাতে এখন তার বিন্দুমাত্র এসে যায় না। অন্তত এখনও না। হুঁশই নেই তার।
শেষে সে বলল—অমৃতা, ঈশ্বর, ঈশ্বরই তো এই আকর্ষণ সৃষ্টি করেছেন। এ তো একটা ফাঁদ দেখছি। প্রকৃতি চায় যেন তেন প্রকারেণ জন্ম হোক। আমাদের জন্য কোনও ভাবনা তো করে না! তা হলে হোক জন্ম—এই সন্দেহে, সংকটে, হোক, এভাবেই, যদি হয়।
চৌরঙ্গির রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অমৃতা ভাবছিল—কী আশ্চর্য! বুঝতে পারছে লোকটা সৎ নয়, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নয়, তবু দোলা ছুটে যাচ্ছে? এ কী রকম ভালবাসা? একেই কি ভালবাসা বলে? প্রাকৃতিক, জৈবিক, রাসায়নিক! সংকট দেখে, ত্রিভুজ দেখে আয়েষা নিজেকে ফিরিয়ে নিয়েছিল, লাবণ্য নিজেকে ফিরিয়ে নিয়েছিল, অচলা পারেনি, যতই তাকে পরিস্থিতির শিকার করে এঁকে থাকুন না লেখক, সে পারেনি। কিন্তু মিথ্যা কথা বলে, টাকা নেয় এরকম চরিত্রেরা কি নায়ক হয়? শরৎচন্দ্রের সেই ‘শুভা’র স্বামী এরকমটা করত বটে। গোবিন্দলাল এবং নগেন্দ্র এবং মহেন্দ্রও অবিশ্বাসী হয়েছিল, কিন্তু তারা কেউ মিথ্যাবাদী, চোর বা ইতর ছিল না। অথচ জীবনের নায়কদের দেখো। এরা খল, প্রেমহীন, বিবেক ও মর্যাদাবোধশূন্য, সে অমিতাভ সেনই হোক আর অরিসূদন গোস্বামীই হোক।
লাল আলো জ্বলেছে। সে জেব্রা দিয়ে রাস্তা পার হয়ে ওদিকে যাচ্ছে। এখনও চিন্তামগ্ন।
—এত কী ভাবছেন? জওহরলাল নেহরু রোডে ভাবসমাধি? সর্বনাশ! চমকে সে ফিরে দেখে—অরিন্দম ঘোষ। তার ভঙ্গিতে খানিকটা গতিবেগ তখনও বোঝা যাচ্ছে।
লাল বাতিতে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। সারি সারি সারি। নিজের গাড়ি ছেড়ে ঝুঁকি নিয়ে নেমে এসেছে অরিন্দম।
—শিগগির আসুন, শিগগির…
এত তাড়া যে প্রতিবাদ করবার সুযোগই পেল না সে। অরিন্দমের পেছন পেছন তার মারুতি এইট হানড্রেডের সামনের সিটে গিয়ে বসল।
—এদিকে কোথায় এসেছিলেন? আপনাকে এখানে দেখে একটু অবাকই হয়ে গেছি।
—পার্ক স্ট্রিটে এসেছিলাম, দোলার সঙ্গে।
—বাঃ খুব আড্ডা মারছিলেন? তা দোলা কই?
—ও তো সাউথে। চলে গেছে। আমি এখন সল্টলেক। তা আপনিই বা এমন উত্তরমুখো কেন? এই ঠিক দুপ্পুরবেলায়?
—বাঃ আমার শ্বশুরালয় যে গোয়াবাগানে। ভুলে গেলেন?
—দুপ্পুরবেলা…ছুটির দিন নয়… শ্বশুরবাড়িতে কেন যাচ্ছেন? ঢেলা মারতে?
—ঢেলাই বটে। আজ শনিবার ম্যাডাম, খেয়াল আছে? শনিবারগুলো আমাদের ছুটি থাকে। প্রজেক্টের কাজ পেন্ডিং থেকে গেলে অবশ্য যেতেই হয়। এ তো আর সরকারের খাস খিদমতের চাকরি নয়! তবে এ সপ্তাহে ফর্চুনেটলি আমার তেমন কিছু নেই। ছোট গিন্নি মানে আমার বউ বাপের বাড়িতে আছেন। রাত্তিরে খুব খ্যাঁট হবে। তারপর তাঁকে ট্যাঁকে নিয়ে বাড়ি ফিরব।
সুখী-সুখী, নতুন বিয়ে হওয়া, ফুরফুরে রসিক মেজাজের জামাই বেশ।
সে বলল—বউ তো বুঝলাম। ছোট গিন্নি কেন? আপনার কি দুই বিয়ে?
—ওহো! অরিন্দম হেসে উঠল—বাড়িতে আমার মাতৃদেবীই বড় গিন্নি পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন, লাবণির কাজে কাজেই ছোটগিন্নি হতে হয়। তা, দুই গিন্নিতে দিব্যি জমে গেছে দেখছি। এখনও পর্যন্ত। নারদ ঠাকুরকে ডাকতে হয়নি।
অমৃতা হেসে ফেলল।
—খুব আদর আপনার সব বাড়িতে? না? মায়ের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি?
—অর্জন করতে হয়! গর্বের ভাব অরিন্দমের গলায়। এমনি এমনি হয় না। কত তেল যে মারি! কী বাবা-মা, কী শ্বশুর-শাশুড়ি-শালাকে—তা যদি জানতেন?
—আর লাবণিকে?
—লাবণি! ওরে বাবা। তাকে তো তেলের ওপরই রেখেছি। ভাসিয়ে। তেল কইয়ের মতো। তা আপনার খবর বলুন? আপনার দেবশিশু কেমন আছে?
—ভাল। কিন্তু দেবশিশুর খবরে আপনার কাজ কী?
অরিন্দম সামান্য চমকাল। একটু মন দিয়ে গাড়ি চালাতে লাগল। চিত্তরঞ্জন-হ্যারিসন রোডের বাঁকটা পেরিয়ে বলল—একথা কেন বললেন?
কেন যে বলল কথাটা অমৃতা জানে না। একটা সময় এসেছিল, যখন দৈব-দুর্বিপাকে পড়ে সে বহুজনের সাহায্য ও মনোযোগ পেয়েছে। সেটা তো চিরকাল চলতে পারে না! অথচ কেমন একটা অভিমানের সুর তার কথাগুলোয়। এ অভিমান কার প্রতি? সে এমন অভিমান করতে চায়নি তো!
—এখনও যদি আপনাদের খবর নিতে যাই, আপনি বা অন্য কেউ হয়তো ভুল বুঝবেন, খুশি হবেন না। অরিন্দম আস্তে আস্তে বলল।
—সে আবার কী! আমি কেন অখুশি হব!
অরিন্দম হেসে বলল—অখুশি হয়তো হবেন না। কিন্তু খুব খুশি হয়ে উঠবেন, এমন মানুষ কি আমি? হয়তো ভুলেই যাবেন আমি এসেছি, বসে আছি…
এ-ও তো অভিমান!
অমৃতা বলল—এরকম করেছি বুঝি কখনও?
অরিন্দম আবারও হাসল, বলল—কী জানেন? সবাই তো নায়ক হবার ভাগ্য নিয়ে ভবরঙ্গমঞ্চে আসে না। সামান্য সহ-নায়ক, পার্শ্ব-চরিত্র বেশির ভাগই। দূতিয়ালির বেশি কিছু বরাতে জোটে না।
—অরিন্দমদা, জানি না নিজের অজান্তে আপনাকে কোনও… আপনার কাছে কোনও দোষ করে ফেলেছি কিনা, আপনি যা উপকার করেছেন, সে ঋণ আমি সারাজীবনেও…আপনি ভাববেন না সে সব আমি ভুলে যাব।
—আরে, আরে, অরিন্দম শশব্যস্ত হয়ে বলে—এসব কী বলছেন? দোষ-টোষ, কৃতজ্ঞতা, ঋণ-টিন! ছি! ছি!
অমৃতা এভাবে কখনও দাদা ডাকেনি অরিন্দমকে। না, লালটুদাও না, ঘোষদা তো নয়ই। হয়তো এই-ই ভাল। এই দাদা ডাক। এই কৃতজ্ঞতা, এই ঋণ স্বীকার!
অমৃতাকে তার বাড়িতে নামিয়ে দিল সে। নিজে কিছুতেই নামল না। শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে সে, শ্বশুরবাড়ি বলে কথা!
—আপনি এলে, আপনারা এলে, আমি, আমরা ভীষণ খুশি হব— অমৃতা গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল।
অরিন্দম ভাবল— এ-ও হয় তো ভাল। ‘আপনি’ থেকে চকিতে ‘আপনারা’য় যাওয়া, ‘আমি’ থেকে এই ‘আমরা’। এই খুশি হওয়ার প্রতিশ্রুতি। এই সুস্বাগতম জানানো। অভ্যাগতকে।
আর অমৃতা তার বাড়ির ঘণ্টিতে হাত রেখে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। সে ‘জীবনে’র নায়কদের ব্যর্থতার কথা ভাবছিল না? এই অরিন্দম, সুপুরুষ, বলিষ্ঠ, ক্ষমতাবান, উদার, মার্জিত, দায়িত্বশীল—এ-ই তো জগৎ সিংহ? নাকি মানিকলাল? না কি বেহারি? শ্ৰী-বিলাস? কেন এমন নির্ভুল মানুষ নায়ক হতে পারে না? কিংবা হয়তো পারে। সে-ই জানে না।