অমৃতা (Amtrita) – ২৩
অমৃতা যেন অনেক দূরের একটা তারা। বহু আলোকবর্ষ পার হয়ে তার স্নিগ্ধ স্তিমিত আলো এসে পৌঁছেছে অরিন্দমের কাছে। তা ছাড়াও আছে র্যাফেইলো, সেই ইতালীয় শিল্পীর তৈরি ম্যাডোনা ব্যক্তিত্ব। এখন অরিন্দমের আর ম্যাডোনার কাছে আসার কোনও যুক্তি নেই। তখন আসত বার্তা পৌঁছতে, বার্তা নিয়ে যেতে। অমৃতার বাবা-মা তাকে খুব পছন্দ করে ফেলেছেন। পছন্দ করেছেন শিবানী মাসিও। অরিন্দম ভেবে দেখে সব বাবা-মা-মাসি-মেসোদের কাছেই সে খুব প্রিয়। কিন্তু এইসব মাসি-মেসোদের মেয়েদের সে তেমন আকৃষ্টই করতে পারছে না আজকাল। লাবণি তো খুবই মোহিত হয়েছিল প্রথমটায়। কিন্তু তারপর রুক্ষ ব্যবহার করতে আরম্ভ করে। খানিকটা ঠেস দিয়ে কথা। অরিন্দম বোঝে না কেন। লাবণিকে তার ভালই লাগে। কিন্তু যাকে বলে প্রেমে পড়া, সেটা ঘটে ওঠেনি। অরিন্দম একজন লোভনীয় পাত্র—সিভিল এঞ্জিনিয়ার, অমুক কোম্পানিতে এই পোস্টে আছে, এত টাকা মাইনে পায়। নির্ঝঞ্ঝাট সংসার। বাবা-মা উভয়েই কাজ করেন। শিক্ষিত, কালচার্ড ফ্যামিলি। নিজেদের বাড়ি বকুলবাগানে। আর লাবণি এক লোভনীয় পাত্রী—এম. এ. পাশ করতে যাচ্ছে, ফুটফুটে দেখতে, বেশ আকর্ষণীয় চেহারার একটি মেয়ে, যাকে তার বাবা-মা যত্ন করে বড় করে তুলেছেন, যাকে এবং যার বিবাহিত জীবনকে ঘিরে তাঁদের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা। ব্যাপারটা এই রকম। তাঁরা অরিন্দমকে মিনতি করে বলেছেন—বড় মেয়েকে যেমন দিয়েছি, ছোটকেও আমরা তেমনই দেব। এটা ওদের প্রাপ্য। তুমি লক্ষ্মীটি না করো না।
—আপনারা কি সেইসব খাটবিছানা, ড্রেসিং টেব্ল, আলমারি-টালমারি স-ব দেবেন? সর্বনাশ! আমার মান থাকবে?
—এগুলো তো দেবই।
—যদি আমি সিঙ্গাপুরে কি আমেরিকায় থাকতাম?
—তবু দিতাম। এখানে থাকত, এলে ব্যবহার করতে। আর টি. ভি. ফ্রিজ তো আজকাল সবার ঘরেই থাকে। বাহুল্যটা সত্যিই বিশ্রী। ভাবছি একটা মাইক্রোওয়েভ ওভন দেব আর একটা এয়ার-কন্ডিশনার।
—সর্বনাশ! মাইক্রো-ওয়েভও আমাদের আছে। মাকে সিঙ্গাপুর থেকে এনে দিয়েছিলাম। আর এ.সি. আমি দু চক্ষে দেখতে পারি না। লাবণির ঘরের জন্য দিতে পারেন। তার যদি এতই শখ।
—বলছ কী! লাবণির আর তোমার ঘর কি আলাদা হবে না কি? অরিন্দমের মাইডিয়ার হবু-শাশুড়ি শঙ্কিত হয়ে বললেন।
—এ.সি. থাকলে হতেই হবে।
—সিঙ্গাপুর-আমেরিকায় কী করতে?
—ওখানে? গ্রীষ্মের দিনে যতক্ষণ পারি বাড়ির বাইরে থাকতাম। শীতে অবশ্য সেন্ট্রাল হিটিংটা লাগতই আমেরিকায়। সিঙ্গাপুরে এ.সি.টা অফ করে দিয়ে জানলা খুলে দিতাম চুপিচুপি।
—তা হলে কী হবে? লাবণির জন্যেও তো ওর দিদির মতোই টাকা রাখা আছে আমাদের।
—এক কাজ করুন না, মেয়ের নামে ইনভেস্ট করে দিন সব টাকাটা। আর কিছু দিতে হবে না। ফার্নিচার আমরা পছন্দ করে করিয়ে নেব। আমি যদ্দূর বুঝেছি আর কিছু থাক আর না থাক লাবণির একটা পেল্লাই ড্রেসিং টেবিল চাইই!
সব্বাই হাসতে থাকে। লাবণি বলে— এইজন্যে আপনার সঙ্গে কথা বলতে ভাল্লাগে না। আমার সবকিছুই আপনার হাস্যকর লাগে। তাই না?
—কী মুশকিল, ড্রেসিং টেবিল কি খারাপ? আমি যেমন সেদিন একটা কমপ্যুটার স্ট্যান্ড কিনলাম। সাড়ে পাঁচ হাজার দাম নিল। ওটা না হলে আমার চলছিল না।
—হ্যাঁ এমনি করে বেশ বুঝিয়ে দিলেন, আপনার কমপ্যুটার, আপনি আঁতেল, টেকনোক্র্যাট, আর আমার ড্রেসিং টেবল,—একটা ফুলিশ ইম্ম্যাচিওর মেয়ে যে খালি রূপচর্চা করে।
লাবণির কথা শুনে অরিন্দম অবাক হয়ে গেল। আশ্চর্য! সে ঠিক এই কথাগুলোই ভেবেছিল লাবণির সম্পর্কে। তবু যে সে তাকে বিয়ে করতে সম্মত হয়েছে, সেটা ওই দূর নক্ষত্র যে এখন ভার্জিন মেরি—তার কাছে যাওয়া অসম্ভব বলে। অমৃতার জন্য তার যা আছে, তা একটা শ্রদ্ধা, আর দুর্নিবার আকর্ষণও। শ্রদ্ধাটা ঠেকে যায়, অমৃতার ঠাট্টা-তামাশায়।
—কী নিজেকে লালটু ঘোষ বলতেন কেন? অরিসূদন আর অরিন্দম-এ অনেক তফাত, সাউন্ডের দিক থেকে। আপনাদের দুজনের পার্সন্যালিটিতেও তফাত আকাশ-পাতাল। বুঝলেন লালটু ঘোষ! হুঁঃ।
আর আকর্ষণ? আকর্ষণটা ঠেকে যায় যখন স্নেহার্দ সুখে অমৃতা তার দেবশিশুকে কোলে তুলে নেয়। আদর করে। মনে হয়, সারা জীবনে এই একটা সম্পর্কই তাকে কিছু দিতে পেরেছে, এই একটা সম্পর্ককেই সে স্বীকার করতে প্রস্তুত। সেই ভার্জিন মেরিমাতার কাছে অরিন্দমরা অবাস্তব, অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। কোনও কোনও রাতে একটি ‘অস্পষ্ট’ মেয়েকে দূর থেকে হাতছানি দিতে দেখে সে স্বপ্নেই ডাকে ‘অমৃতা, অমৃতা’, কখনও তার স্বপ্নমগ্ন মগজ নামটা গুলিয়ে ফেলে ডাকে ‘মৈত্রেয়ী! মৈত্রেয়ী!’ মেয়েটির যেন ছায়াশরীর, ছায়াতেই মিলিয়ে যায়। প্রথম দিকে স্বপ্নের মধ্যে অমৃতাকে মনে করে তার যেমন রেতঃস্খলন হত, এখন আর তা হয় না। কিন্তু গভীর একটা মায়া, মমতা, অরিন্দমের তরফ থেকে অমৃতাকে ঘিরে আছে। সে-ই তার ঈপ্সিতা অমৃত হরিণী। কিন্তু জীবন, প্রণয়, বিবাহ কোনওটাই এ জগতে খুব সরল ব্যাপার নয়। যাদের সরল, তাদের মধ্যে অরিন্দম পড়ে না। সে ভালবাসবে অমৃতাকে, কিন্তু কাছে যেতে পারবে না। কাছে যাবে লাবণির, কিন্তু ভালবাসতে হয়তো পারবে না। বিয়ে করবে লাবণিকেই। সে কথা দিয়েছে। আর বিয়ে তো একটা মানুষের সঙ্গেই শুধু হয় না। লাবণির মা, বাবা, তাকে আপন ছেলের মতো স্নেহ করেন। নিজেদের সঞ্চয়, আর্থিক ভবিষ্যৎ কী ভাবে সুরক্ষিত করবেন সে নিয়ে পর্যন্ত অরিন্দমের সঙ্গে আলোচনা করতে দ্বিধা করেন না। লাবণির ভাই অবন, একটা চার্মিং ছেলে। সে-ও তাকে দাদার মতোই দেখে। বিয়ের ব্যাপারে এদের কথাও তো তাকে ভাবতে হয়। আর এগুলোর চেয়েও বড় কথা বোধহয় সমাজের সম্মতিহীন কোনও কাজ করবার দুঃসাহসের অভাব। যে অমৃতার বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা চলছে, যার কোলে তার পূর্বতন স্বামীর ছেলে তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিতে গেলে যে কলজের জোরের দরকার হয়, সাধারণভাবে সাহসী ছেলে অরিন্দমেরও সে জোর নেই। এটা হয়তো অরিন্দম বোঝে না, নিজেকে কে আর কাপুরুষ ভাবতে চায়? তাই সে নিজের সপক্ষে একটা প্লেটনিক থিয়োরি খাড়া করেছে। বিয়ে করে গতানুগতিক একটা জীবন যাপন করবার যে সমাজসম্মত সমালোচনাহীন সোজা পথ সেই পথেই অধিকাংশ মানুষের চলাফেরা। কাজকর্মও তো আছে না কী? অসম্ভব প্রেশার কাজের। তার মধ্যে যদি বিবাহ নিয়ে, প্রণয় নিয়ে জটিলতা ঢুকে পড়ে তাহলে তা সামলানো শক্ত।
উপরন্তু সে রকম জমজমাট প্রেমময় বিবাহ আর কটা লোকের ভাগ্যে জোটে? যদি জমাট প্রেমের বিবাহ হয়ও সে প্রেম ঠিক সেই অনুপাতে কখনও বেশিদিন থাকে না। একটা সমঝোতা থাকে। একটা মমতা থাকে এই পর্যন্ত। যেমন তার মা-বাবার। তা, সে যদি সেই সমঝোতা, আর মমতা দিয়েই বিবাহিত জীবন আরম্ভ করে, ক্ষতি কী? সত্যি বলতে কী তার তো আরও অনেক মনোযোগের বিষয় আছে। সে ভালবাসে তার পেশাগত কাজের চ্যালেঞ্জ, সে ভালবাসে গান—নানা ধরনের, সে ভালবাসে পড়তে—শুধু গল্প-উপন্যাসও নয় আবার শুধু সায়েন্স জার্নালও নয়। সবরকম। তার ওপরে আছে তার রসিক মেজাজ। মজাদার ফাজলামো, বুদ্ধিমান ইয়ার্কি, সহৃদয় রসিকতা দিয়ে সে অনেক অনেক পাল্টে ফেলতে পারে তার চারপাশের আবহাওয়া। কাউকে বেশিক্ষণ মুখ গোমড়া করে থাকতেই দেবে না। নিজেকেও না। এমনি সুখী, সদানন্দ তার স্বভাব।
জানুয়ারিতে সুতরাং লাবণি-অরিন্দমের বিয়ের ঠিক হয়। রীতিমতো ঘটাপটার বিয়ে। সাবেকি সব রকম নিয়ম পালন করে। লাবণির ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের চারদিন নেমন্তন্ন। চঞ্চল আর নিশান তো গায়ে-হলুদের তত্ত্ব এলেই ভোঁ ভোঁ করে শাঁখ বাজাল। অবন বলল— চঞ্চলদা, নিশানদা বাজাল, তিলকদা তুমি একপাশে দাঁইড়ে দাঁইড়ে শুধু দেখলে? কেন?
তিলক গম্ভীরভাবে বলল—কারও বিয়েতে শাঁখ বাজালে আইবুড়োর নিজের বিয়ে হয় না।
চঞ্চল-নিশান তেড়ে এল সে কথা শুনে—আগে বলতে কী হয়েছিল? স্বার্থপর কোথাকার? এখন আমাদের কী হবে?
তিলক বলল—গোময় খেয়ে প্রাচিত্তির করে নিস৷ আসলে, কটা ট্রে পাঠাতে হবে দেখতে এত ব্যস্ত ছিলুম যে খেয়াল করিনি। মাফ করেছি, দোষ করে দে।
চঞ্চল বলল—তবে রে শালা, কটা ট্রে পাঠাতে হবে তার তুই কী জানিস? তার জন্যে লাবণির মা-বাবা-জামাইবাবু-কাকা-কাকিমা গুচ্ছের রয়েছেন। ফপরদালালি করার আর জায়গা পাসনি?
তিলক আবার গুরুগম্ভীর মুখে বলল—লাবণির বিয়ের ট্রে নিয়ে আমার কোনও মাথা-ব্যথা নেই। যে মাছ অন্যে খাবে তার দিকে নজর দিয়ে লাভ?
—কী বলতে চাইছ তিলকদা? অবন জিজ্ঞেস করে।
—আরে আমি দেখছি আমার বিয়েতে আমাদের কটা ট্রে পাঠাতে হবে। চল্লিশ হাজারি বরের বাড়ি থেকে এম.এ. সুন্দরীর বাড়িতে ক’টা ট্রে আসে, চার হাজারি বরের বাড়ি থেকে স্কুল-ফাইনাল ফেল খেঁদিপেঁচির বাড়িতে তো ঠিক তটা ট্রে যাবে না। হিসেবটা করছিলুম। তা টেন পার্সেন্ট কমালেও দেখলুম আমার হিসেবে আসছে না।
—শ্শালা—নিশান বলল—বলে ভাত-মাংস খাবি? না আঁচাবো কোথায়? এম.এ. তে ফেল করবি কি পাশ করবি তার কিনারা হল না। চাকরি পাবি, অ্যাট অল পাবি, না কোচিং করে সারা জীবন চালাতে হবে তার কিনারা হল না উনি দেখছেন নিজের বিয়ের গায়ে হলুদের স্বপ্ন।
—অতটা না অতটা না, অবন তিলকদার হয়ে সাফাই গায়।—ও তো শুধু ট্রে গুনছিল। ট্রে আসবে তবে তো গায়ে-হলুদ হবে। দিদিকে তো সবে ছাদনাতলায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হলুদ ট্রে থেকে আগে বার হোক! ওরিন্দমের গায়ের হলুদ!
শর্মিষ্ঠা, অনিন্দিতা, এমন কি চঞ্চল তিলক নিশান পর্যন্ত লাবণির গায়ে হলুদ মাখাল আচ্ছা করে। ছেলেগুলো বলল, হলুদ লাগাতে না দিলে কনের পিঁড়ি ওঠাব না।
এ তো আচ্ছা শয়তান! —লাবণির কাকিমা বললেন। ওরা তেল-হলুদ নিয়ে রৈ রৈ করে তেড়ে আসছে, লাবণি কনের লাজ লজ্জা ভুলে খ্যাঁক খ্যাঁক করে চেঁচিয়ে উঠল—এই চঞ্চল, এই নিশান, খবরদার গায়ে মাখাবি না, হোলির মজা পেয়েছিস না? এই কপাল পেতে দিচ্ছি, যা খুশি কর।
নিশান ফক্কড় নাম্বার ওয়ান—বললে, যাঃ প্রিয় বান্ধবী বলে কথা, সবটাই অরিন্দম ঘোষ একাএকি পেয়ে গেল? গায়ে-হলুদের একটু নিষ্পাপ-নির্দোষ ‘গা’ সেটুকুও আমাদের জুটল না? ছ্যাঃ, কপালটাই গা প্লাস ধা’র।
লাবণি মুখভঙ্গি করে বলল— হ্যাঁ, হ্যাঁ ছ্যাঃ! তোদের মতলব আমি বুঝি না ভেবেছিস? সব অরিন্দমকে বলে দেবো, দেবে তখন তোদের শয্যা-তুলুনির টাকা! তুড়ং ঠুকে দেবে একেবারে।
এই সময়ে দোলা এসে হাজির হল। উদরের সামান্য স্ফীতিটুকু আড়াল করতে সে একটা জমকালো শাল গায়ে দিয়েছে। মুখটা বড় সুন্দর দেখাচ্ছে। গাঢ় মেরুন শালের পটে ম্যাগনোলিয়া ফুলের মতো ফুটে আছে মুখটা। কানে দিয়েছে বড় বড় রিং। তাতে এক ফোঁটা মুক্তো টলটল করছে। দোলার কপালে ছোট্ট খুব ছোট্ট একটা তিলের মতো মেরুন টিপ। হাতে মোটা সোনার বালা, গলায় মফ চেন। তিন হালি করে পরেছে। সে সাধারণত সালোয়ার কামিজ, কিংবা মিডি-স্কার্ট পরত। বাইরে জিন্স। গয়নার ধার ধারত না। কানের নানারকম গয়নার শখ ছিল তার, ধুম্বো ধুম্বো আংটি, কিন্তু হাতে ও ঘড়ি ছাড়া কিছু পরবে না, গলায়ও না। সেই দোলা সোনার মোটা বালা, তিন হালির হার পরে এসেছে, কপালে ছোট্ট হলেও টিপ, সিঁথিতে সরু একটা লাল রেখা, তাকে দেখাচ্ছে একেবারে অন্যরকম।
লাবণিকে ছেড়ে সবাই এবার দোলাকে নিয়ে পড়ল।
—কী হল! হরতনের বিবি। তোর সাহেব কোথায়? —নিশান বলল।
—সাহেবদের সকালের দিকে চাকরি-বাকরি থাকে, তোদের মতো বেকার? দোলার জবাব।
—তা রাতে আসবে তো গুরু? একটু গায়ে গা ঠেকিয়ে নিতাম মাইরি!
ঈষৎ গর্বের সুরে দোলা বলল— তার চেয়ে একটু ব্যায়াম-ট্যায়াম কর দেখি! গায়ে গা ঠেকিয়ে নিতে হবে কেন? কে আমার এলেন রে?
—আহা হা, ব্যায়াম করে না হয় চাট্টি মাসকুল করলুম, কিন্তু স্ট্রাকচার? স্ট্রাকচার পাব কোথায়? অমন মলাট বলেই না তোর মতো মালদার বাপের একমাত্তর কন্যেকে গেঁথে তুলেছে!
—একমাত্র কোথায় আবার? আমার দিদি আছে, জানিস না?
—ওই হল। ওই হল। যাঁহা দুই মাত্তর তাঁহাই একমাত্তর। ছোট মেয়েকেই মেসোমশাই-মাসিমা বেশির ভাগ সম্পত্তি দিয়ে যাবেন, দেখিস!
—যা না বলগে যা না আমার দিদিকে। কী করে দ্যাখ একবার।
দোলার আজ মেজাজ অসম্ভব ভাল। আগের মতো। পুরোপুরি নয়, অনেকটা। তাদের বাড়ি থেকে স্থির হয়েছে যত দিন না তার বাচ্চা হয় সে বাপের বাড়িতেই থাকবে। ক দিনের জন্য শ্বশুরবাড়ি অবশ্য তাকে যেতে হয়েছিল। নাম কা ওয়াস্তে একটা বউভাত ও প্রীতিভোজের ব্যবস্থাও হয়েছিল। কিন্তু সেখানে দোলার অভিজ্ঞতা খুব খারাপ। তার শ্বশুরবাড়িটা একটা বাড়িই না।
টেবিলে ওঁরা এক সঙ্গে বসে প্রায় খানই না। বাবা সকালে আগে খেয়ে বেরিয়ে যান, মা ভোর থেকে রেওয়াজ শুরু করে খেতে বসবেন ঠিক এগারোটা। অমিতাভ বেরিয়ে যায় কোনওদিন নটা। কোনওদিন দশটা। সেই সময়েই রান্নার লোক তার খাবার বেড়ে দেয়। দোলার এখন অখণ্ড অবসর। শরীরের মধ্যেও সর্বদাই খাই-খাই। শ্বশুরের খাওয়ার সময়ে সে একদফা জলখাবার খায়, শাশুড়ি নিজে খাবার সময়ে গম্ভীরভাবে বলেন—তুমি বরং পরে খেও। একটা নাগাদ রান্নার লোক এসে তাকে খেতে ডাকে। তখন খিদেয় তার বত্রিশ নাড়ি পাক দিচ্ছে। একদিন সে শুনেছিল রান্নার মাসি তার শাশুড়িকে বলছে—নতুন বউয়ের খাউন্তি দাউন্তি ভালই মা, মেয়েছেলের অতটা খাওয়া, ঘরে লক্ষ্মী থাকে কি না দেখেন। লোকটি নাকি এদের অনেকদিনের। শাশুড়ি শুধু বললেন— আচ্ছা আচ্ছা সে আমি বুঝব। তোমাকে আর কর্তাত্বি করতে হবে না।
রাত্রেও যে এরা একসঙ্গে খাবে তা প্রায় ঘটেই ওঠে না। হয় মা বাড়ি নেই, নয় বাবা এখনও ফেরেননি, নয় অমিত এত সকাল সকাল খেতে চাইছে না কি সে-ও ফেরেনি। দোলার খিদের কষ্টে চোখে জল এসে যায়, শাশুড়ি অনেক সময়ে তাকে খাটো গলায় বলেন—তুমি কারও জন্যে বসে থেকো না দোলন, খিদে পেলেই খেয়ে নেবে, তোমার এখন যা অবস্থা …। কিন্তু অপরের বাড়িতে গিয়ে তো আর অমন চেয়ে চেয়ে আগে আগে খাওয়া যায় না!
একদিন রাত্রে একসঙ্গে বসা হয়েছিল। অমিতাভ সবে একটা ট্যুর থেকে ফিরেছে। অমিতাভর বাবা বললেন— বিয়ে করেছ তুমি। বউকে আমাদের ঘাড়ে গছিয়ে দিয়ে যে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াবে তা হবে না। এ মাস থেকে পাঁচশো করে টাকা বেশি দিও।
—পাঁচশো? তুমি তো জানো বাবা তা হলে আমার চলবে না।
—আজকালকার দিনে একটা মানুষের খাইখরচ পাঁচশোর থেকে বেশিই হয় অমু …।
দোলা রাত্রে অমিতের বুকে মুখ রেখে বলেছিল— আচ্ছা অমিত, তোমার সেই বন্ধু, সেই সল্টলেকের? তিনি তো থাকেন না, আমরা কিছুদিন সেখানে থাকতে পারি না? কেয়ার-টেকার তো সবই দেখে, রান্নাটা যা হোক করে আমি চালিয়ে নেব!
—উপাধ্যায়ের বাড়ি? ওরে বাবা সে মহা জেলাস হাউজ-ওনার। দেখি, বলে দেখতে পারি। তবে ও বাড়িটা আমার একটা দুঃস্বপ্ন।
—দুঃস্বপ্ন কেন? আহত, বিস্মিত দোলা বলেছিল।
—ওই আর কি! একটা আনন্দ, একটা উপভোগ, যদি বাধ্যবাধকতায় এসে দাঁড়ায়…।
—এ কথা তুমি বলতে পারছ আমিত?
—আই ডোন্ট মীন টু হার্ট ইউ ডিয়ার, অমিত তৎক্ষণাৎ তাকে আদর করে। দোলাও আর কথা বাড়ায় না। কিন্তু কথাগুলো তার বুকে কাঁটার মতো বিঁধে থাকে।
এরপর বাবা-মা যখন প্রস্তাব করলেন বাচ্চা হওয়া পর্যন্ত সে তাঁদের কাছেই থাকুক, কেউ আপত্তি করল না। দোলা বাঁচল।
অমিত উইক-এন্ডে এসে ঘুরে যায়। কিন্তু তার রাতে থাকাটা সুমনা খুব পছন্দ করেন না। জনান্তিকে মেয়েকে বলেন— এ সময়ে সাবধান থাকতে হয়। একবার চরম সংযমহীনতার পরিচয় দিয়েছ দোলা, সেটা সামলানো গেছে, বাড়াবাড়ি করলে তোমার এবং বাচ্চার দুজনেরই ক্ষতি হবে।
এর মধ্যে অমৃতার সঙ্গে দোলার আবার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়েছে। অমৃতা এই অবস্থাটা সম্পর্কে সব জানে, সে দোলাকে উপদেশ দেয়। ডক্টর রঞ্জন কার্লেকরই দোলাকেও দেখছেন। দোলার খালি একটাই ভয়। ভয়টার কথা সে নিজেকেও স্পষ্ট করে বলতে পারে না। ভয়টা হল— এতদিন দোলা-সংসর্গহীন অমিতাভ কী করবে? কী করতে পারে? কালীপ্রসন্ন সিংহর ‘মহাভারত’ তার পড়া আছে। সবটা না হলেও বেছে বেছে মূল গল্পটা, আর যা যা ভাল লাগে সে পড়েছে। সেখানে উল্লেখ আছে গান্ধারী যখন এক বৎসর গর্ভধারণ করেছিলেন, তখন ধৃতরাষ্ট্রর মনোরঞ্জন করত এক দাসী। অর্থাৎ গর্ভধারণের সময়ে স্ত্রীসংসর্গ না হলে স্ত্রীলোক-সংসর্গ দরকার হয় পুরুষদের। এই সময়টায় ‘মহাভারতের কথা অমৃত-সমান’ মনে পড়ে তার পুরো শরীর-মন গরল-সমান বলে মনে হয়। বিশেষত এই এত দিনেও অমিতাভর মনের নাগাল সে পায়নি বলে। কী আছে ওই রূপবান পুরুষের মনে? ওর বাবা বলেন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন, মা বলেন ও চঞ্চলস্বভাব, সব মানুষ যারা ওর অল্পস্বল্প সংসর্গে এসেছে তারা বলে ও চা-র্মিং, ফ্যানটাসটিক, বউভাতে ওর অফিসের কাউকে নেমন্তন্ন করেনি অমিত। বন্ধু-বান্ধবী কজন এসেছিল। বান্ধবীরা বলল ‘দেখি ভাগ্যবতীটি কে? কেমন?’ আর বন্ধুরা বলল সেই এক স্ট্যান্ডার্ড কথা, ক্লিশে,—‘লাকি গাই। লটারির প্রাইজ জিতে গেলি রে শালা।’ তার নিজের অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ দোলা করতে পারে না। যদি ভাল না লাগত তবে কি আর অমন উন্মাদের মতো প্রেমে পড়ত সে? কিছুতেই সে ভুলতে পারে না, অমিত তার সেই উন্মাদনার সুযোগ নিয়ে … না না অবশ্যই তারও অংশ আছে, আর কে এ কথা বলেছে যে অমিতও উন্মাদ হয়নি? তার সেই ফোনালাপ, হুগলি নদীর ধারে জেটিতে, জু-গার্ডেনে, ভিক্টোরিয়া বা মিউজিয়ামের অভ্যন্তরের পাতা সিটগুলোয় কি স্তম্ভের অন্তরালে সে-ও তো এক অমিতকে দেখতে পেয়েছিল, যে তার প্রেমে উন্মাদ! তবু, দোলার গর্ভিণী হওয়ার সংবাদে সে অত বিরক্ত কেন? প্রেশারাইজ করার কথাই বা কেন তুলল সে? বিয়ের কথায় বিষণ্ণ হয়ে গেল কেন?
দোলার বিয়ের বাসর খুবই জমেছিল। দোলাকে ছাড়াই। কিছুক্ষণ হই-চইএর পর দোলার শরীর খারাপ লাগছিল, সুমনা তাকে অন্য ঘরে শোয়াতে নিয়ে গেলেন। সেখান থেকেই সে বাসর ঘরে অমিতের উল্লাসভরা গান, সমবেত শালা শালিদের উচ্ছ্বাস, চিৎকার যাকে বলে হট্টরোল, আর হাহা হিহি হুহু শুনতে পাচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল তাকে যে-ভাবে সম্মোহিত করে ফেলেছিল অমিত, তার অ্যাপলো, না কি ডায়োনিসাস, ঠিক সেই একই ভাবে সে সম্মোহিত করে ফেলছে এক ঘর মানুষ-মানুষীকে। অনেক মানুষ ঈর্ষা করছে ডায়োনিসাসকে তার রূপ, তার জমাবার অসাধারণ ক্ষমতা দেখে, কিন্তু সে আর কতটুকু? বড়র কাছে ছোটর তো হারই হয় সব ক্ষেত্রে। তাই আত্মসমর্পণ করে কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা চেলা বনে যাচ্ছে ডায়োনিসাসের। অনেক মানুষীও ঈর্ষা করছে তাকে, দোলাকে, এই অপরূপকে সে পেতে যাচ্ছে বলে, ঈর্ষার কাঁটা বুকে নিয়ে তারা অন্তত একটা রাত এই বাসররাতটুকু তাকে, ডায়োনিসাসকে মুগ্ধ করবার জন্যে নানা ছলাকলা প্রয়োগ করছে, দেবদাসী বনে যাচ্ছে, এবং তুমুল হয়ে উঠছে গান, রসিকতা, ইয়ার্কি। আদিরসাত্মক। আর ভিন্ন ঘরে গাঁটছড়া সুদ্ধ তার ওড়না আর অমিতাভর উত্তরীয় বুকে জড়িয়ে তার মনে হচ্ছে ওই গাঁটছড়াটা লাল নয়, নীল, কিংবা সবুজ, তার ঈর্ষার গরলে। এত তো বন্ধু তার। কত জন তার চেয়ে রূপসী, তার চেয়ে লেখাপড়ায় ভাল, তার চেয়ে সফল, জনপ্রিয়, কিন্তু কারও ক্ষেত্রে এই সর্বগ্রাসী ঈর্ষা তো তাকে কখনও আক্রমণ করেনি! তার ইচ্ছে করে, গাঁটছড়াশুদ্ধ ওড়না আর উত্তরীয় দুটোকে সে ছুড়ে ফেলে দেয় এক কোণে, লাল টকটকে বেনারসি আর প্রচুর অপূর্ব-অপূর্ব গয়নায়-প্রসাধনে সত্যিকারের রানির মতো ক্রোধে, অধিকার বোধে, মর্যাদায়, আদেশে— আপাদমস্তক শরের মত সোজা করে সে প্রবেশ করে ওই বাসর ঘরে, বলে, বন্ধ কর বন্ধ কর এই স্যাটার্নেলিয়া— এই অশ্লীল উৎসব, বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা সবাই। ওই পুরুষ, রাজাই বলিস আর দেবতাই বলিস—ও আমার, একা আমার। বড় কঠিন মূল্যে ওকে জয় করেছি, তবু ভয় যেতে চাইছে না। তোরা যা-আ-আ।
কিন্তু যাবে কী! বমির ভাব তার অনেকটা দূর হয়েছে। এখন সবকিছুতে সে একটা মারাত্মক শ্বাসরোধী গন্ধ পায়, পেট বুক মগজ সব কিছু গুলিয়ে উঠছে রজনীগন্ধার গন্ধে, নানারকম সুগন্ধির সৌরভে, খাবারের গন্ধে। তার এই অবস্থার জন্য দায়ী পুরুষটি কেমন মুক্তমনে মুক্ত শরীরে মজা লুঠছে! সে, খালি সে, নারী বলে ওই পুরুষের সঙ্গে কামক্রীড়ার যাবতীয় দায় বহন করে এক ধনীর নিষ্পাপ আদরের দুলালী থেকে এক রোগগ্রস্ত, ভয়কাতর, ঈর্ষা-কাঙালিনী মানবীতে পরিণত হয়েছে। হে জিউস! হে ঈশ্বর! হে আল্লাহ্! এ তোমার কেমন বিচার?
ফুলের গয়নাগুলো ছুড়ে ছুড়ে খুলে ফেলে দেয় সে যেখানে সেখানে। সে, যে নাকি ফুল পাগল ছিল এককালে। ফুলের গন্ধে কেমন একটা বিশ্রী নারকীয় ভয়, যেন এ পৃথিবী মানুষের নয়। ভূতের, পেত্নির, শাঁকচুন্নির, এখানে বড় বড় উনুনে বড় বড় কড়াইয়ে নরমাংস সেদ্ধ হচ্ছে।
এই সময়ে সুমনা আবার ঢুকলেন। সারাদিন মেয়েটাকে কঠিন কিছু খাওয়াতে পারেননি। এই মাঝরাত্তিরে নিজের হাতে চামরমণি চালের গলা গলা ভাত আর কইমাছের ঝোল নিয়ে এসেছেন। সময় মতো ঝোলটা রান্না করে ফ্রিজে রেখে দিয়েছিলেন, ভাতটা এইমাত্র করলেন প্রেশার-কুকারে, তিনি জানেন বাসমতী খেতে পারছে না দোলা। গন্ধঅলা জিনিস সে যত সুগন্ধই হোক, তার কাছে বিষ লাগছে।
মৃদু আলো জ্বলছে ঘরে। চারদিকে মালা, ওড়না ছড়ানো। যেন বিয়ের রাতেই বিধবা হয়েছে মেয়ে। তিনি কাছে গিয়ে বুঝলেন, দোলা চোখ বুজিয়ে আছে বটে কিন্তু ভেতরের কান্নার আবেগে তার ঠোঁট ফুলে ফুলে উঠছে। দোলা, তাঁরই দোলা, দোলনসুন্দরী।
তিনি নরম গলায় ডাকলেন—দোল।
অনেকদিন পরে মায়ের এই আদরের ডাক শুনতে পেল দোলা। তার কান্না আর বাধা মানল না। কূল ছাপিয়ে বন্যার মতো ফুঁসতে লাগল।
— দোল বড্ড কষ্ট হচ্ছে গন্ধে, না?
দোলা মায়ের বুকে মুখ গুঁজল। রুদ্ধস্বরে বলল— মা, আমার পেটে কে এসেছে? একটা রাক্ষস, না একটা দানো, না কী? যে আমার এমন …
তাকে জড়িয়ে ধরলেন সুমনা, বললেন— আমারও ঠিক এমনি হয়েছিল মা, ঠিক এমনি। কিন্তু জন্মালি তো তুই!
—সত্যি মা? তা হলে তোমাকে এত কষ্ট দিয়েছি বলেই কি আমি এমন …
—দূর। সন্তান জন্মের সময়ে হরমোনের যে বদলগুলো হয়, তার জন্যেই এমন হয়। পুরো সিসটেমটাই … যাই হোক তুই খেয়ে নে।
—আমি খেতে পারব না মা।
—পারবি। ঠিক যা যা তোর ভাল লাগবে তাই-তাই আমি এনেছি।
আগে ফুলগুলো ঘর থেকে বার করে দিলেন সুমনা। বিয়ের সাজ খুলে ফেলে—একটা পুরনো নাইটি পরিয়ে দিলেন। তারপর নিজের কোলের ওপর একটা মেয়ের কোলের ওপর একটা তোয়ালে পেতে—কই মাছের ঝোল দিয়ে চামরমণি চালের গলা-গলা ভাত মেখে, বললেন—খা।
ঘুমের ঠিক আগে তার আবেশে মার কোমর জড়িয়ে শুয়ে দোলার আবছাভাবে মনে হচ্ছিল যুগ-যুগান্ত শুধু এই চেয়ে এসেছে সে। মায়ের কোল, মাতৃসঙ্গ, এর চেয়ে বড় চাওয়া আর পাওয়া তার জীবনে আর নেই। কিন্তু এমনই আয়রনি জীবনের যে এক পুরুষ-আসঙ্গ না ঘটলে সে তো আসতই না মায়ের জীবনে, মা তো মা-ই হত না। এবং এই আশ্রয় ছেড়ে প্রকৃতির অমোঘ বিধানে সে স্বেচ্ছায় ধরা দেবে, দিয়েছে, পুরুষেরই বাহুতে যে তার এত যন্ত্রণার মূল। এবং আবারও সে জন্ম দেবে হয়তো এক কন্যার যাকে সে ভালবাসবে, আশ্রয় দেবে, জীবনসর্বস্ব মনে করবে, এবং এত সব জেনে, উপলব্ধি করেও সেই কন্যা আবার পুরুষকেই চাইবে। যার থেকে হবে আরেক জন্ম, আরেক মা, আরেক যন্ত্রণা … এইভাবে যুগের পর যুগ, যুগের পর যুগ, যুগের পর যুগ …
অদ্ভূত! আজ কিন্তু দোলা লাবণির বিয়েতে এসেছে প্রাণভরে ওই সুগন্ধি, নতুন শাড়ি, রজনীগন্ধারই গন্ধ নিতে। আর খুব লজ্জার কথা সে বিশেষ করে এসেছে—খেতে। গায়ে হলুদের সকালবেলায় ঘরযোগে একটা ভারী সুন্দর খাওয়া হয়। উত্তর কলকাতায় যে সামান্য কটি বাড়িতে হালুইকর বামুনের ট্র্যাডিশন এখনও চলছে, লাবণিদের বাড়ি তাদেরই একটা। আজ সে খাবে ছ্যাঁচড়া, বোঁটাশুদ্ধ লম্বা বেগুন ভাজা, মাছের মুড়ো দিয়ে মুগের ডাল, কষে কষে কষে এইটুকু করে ফেলা বাঁধাকপির ঘণ্ট, ওপরে বড়ির গুঁড়ো ছড়ানো থাকবে, আর বড় বড় মাছের দাগা দিয়ে কালিয়া। কে জানে হয়তো ডিম-ভরা পার্শে মাছ ভাজাও পাতে পড়বে। ভাবতেই জিভে জল এসেছিল তার। আর তাই সে তাড়াতাড়ি সেজে-গুজে বাবার গাড়িতে করে চলে এসেছে লাবণিদের বাড়ি। এসেই গরম-কফি খেয়েছে, তার পরেই বড় বড় দুটো কমলাভোগ, গায়ে-হলুদের তত্ত্বের শিঙাড়া, নিমকি। খাচ্ছে সে, পাল্লা দিয়ে খাচ্ছে তিলক, চঞ্চল, নিশানদের সঙ্গে। চেটেপুটে। এবং কেউ কেউ লক্ষ করছেন টসটসে সুন্দর মুখশ্রীর রঙ-ফেটে পড়া জলুষদার মেয়েটির অস্বাভাবিক খাওয়া। গিন্নি-বান্নিরা পরস্পরকে বলাবলি করলেন— ছেলেপিলে হবে। জনান্তিকে মানে মেয়ে-মহলে তাঁরা মেয়েটিকে বাগে পেয়ে জিজ্ঞেসও করেছিলেন।—তোমার ক’মাস গো মেয়ে?’
দোলা লজ্জায় লাল হয়ে সেখান থেকে সরে যায়। বিয়ের রাতে সে আরও খাবে। তখন নাম-করা কেটারার। নিজের বিয়েতে যা-যা খেতে পায়নি, স-ব খাবে সে প্রাণ ভরে, আশ মিটিয়ে।
এবং রাতে আসবে তার অমিত, অমিতাভও। দুজনে আসবে যুবরাজ যুবরানির মতো সেজেগুজে, হয়তো বা এ বাড়ির বর-কনেকে রূপজৌলুষে ম্লান করে দিয়ে।
‘দোলা, দো-লা’, ট্যাকসিতে তাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করল অমিতাভ। আইসক্রিম পিঙ্করঙের ছোট্ট ছোট্ট রুপোলি টিপ দেওয়া একটা শাড়ি পরেছে দোলা, মুক্তোর গহনা। তার সোজা চুল খোলা, আয়রন করা। কানের পাশ দিয়ে তীক্ষ্ণধার কালো স্রোতের মতো মাঝ-পিঠ অবধি নেমেছে। এমন অপূর্ব রূপবতী তাকে বুঝি কখনও লাগেনি অমিতাভর। তার নেশা লাগছে। নেশার ঘোরে সে ভাল করে নিশ্বাস নিতে পারছে না। বিয়ে-বাড়িতে অত সুসজ্জিত মেয়েদের মধ্যে দোলাকেই বারে-বারে, ঘুরে-ঘুরে দেখেছে সে৷ যেন নতুন বউ। ট্যাকসি-ড্রাইভারকে আগেই দেড়শো টাকা দিয়ে রাখল সে। বলল, চলো গঙ্গার ধার দিয়ে। ট্যাকসির মধ্যেই অদ্ভূত কায়দায় মিলিত হল তারা।
—অমিত, তুমি আমাকে সত্যি সত্যি ভালবাসো না…না?
—চুপ, চুপ এখন ওসব কথা বলে না।
—অমিত, একবার বলো তুমি শুধু আমার, আমাকে ছাড়া আর কাউকে …
—সাইলেন্স ডিয়ার। —আগ্রাসী চুম্বনে মুখ ভরে যায়, কথা থেমে যায়। ভীষণ জরুরি কথা সব।
অনেক রাতে বাড়ি ফেরে তারা। যেন বিবাহিত দম্পতি নয়। প্রেমিক-প্রেমিকা। ঠিক তেমনি গোপনতার সঙ্গে বাড়ির দরজায় তাকে ছেড়ে দেয় অমিত।
সুমনা-সব্যসাচীও ঘরবার করছেন।
—কী রে? এত দেরি?
—ওরা ছাড়ছিল না কিছুতেই।
—এত গয়না-টয়না পরে, আমার খুব ভয় হচ্ছিল দোলা— সুমনা বললেন।
—সোনা তো পরিনি মা, ওইজন্যেই আরও … কথা শেষ করে না দোলা। ওইজন্যেই, কী? সাহস? দেরি? ব্যাখ্যা করে না কিছুই।
—অমিত কোথায়? নামল না একবার?
—না, বড্ড দেরি হয়ে গেছে যে! ওঁরাও তো ভাববেন।
ওঁরা বলতে কৃষ্ণা সেন এবং তাঁর স্বামী? একেবারেই ভাববেন না। সদরের আলাদা চাবি থাকে অমিতাভর কাছে। সে কখন আসে, কখন যায়, আদৌ আসে কি না সে খবর ওঁরা রাখেন না। সাড়ে আটটায় ওঁদের রাতের খাওয়া, সাড়ে নটার মধ্যে শুয়ে পড়েন।
সুমনা বললেন—না হয় একদিন থেকেই যেত! একটা ফোন করে দিতাম!
—ছাড়ো তো!
দোলা আবার ফিরে এসেছে তার পুরনো মেজাজে, ফিরেছে গোপনতায়, মিথ্যায়, নির্লজ্জতায়, নইলে কী ভাবে সে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিতে …
মাঝরাত্তিরে তার ঘুম একটুর জন্য ভেঙে যায়, কে যেন বলে ওঠে ‘আপনাকে তো বাইরে থেকে বেবুশ্যে বলে প্রত্যয় হয় না ; সেকালে ওই ছোকরাটাই বেবুশ্যে। খানকি একটা …’
দোলা একবার চমকে ওঠে। তারপর পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ে।