অমৃতা (Amtrita) – ২১
যে ভোররাতে অমৃতার সন্তান জন্মাচ্ছিল, দোলা সে সময়ে বিছানায় খালি এপাশ ওপাশ করছিল। সারা রাত ঘুমোতে পারেনি, এই ভোরেও ঘুম দূর অস্ত্। উঠে সে এক গ্লাস জল খেল। সঙ্গে সঙ্গে প্রবল বমির ধমকে তার সারা শরীর কাঁপতে লাগল। মাথা ঘুরতে লাগল। ‘মা’ বলে একটা আর্ত চিৎকার করে সে মাটিতেই শুয়ে পড়ল।
তার মা ঘুমের মধ্যে শুনতে পেলেন সেই ডাক। যেন দুঃস্বপ্ন দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন। সেই মুহূর্তে আবার ডাকটা এলো—‘মা-আ-আ’ এবার আরও আস্তে, কিন্তু নির্ভুল। তিনি ছুটে গেলেন পাশের ঘরে। একঘর হড়হড়ে বমির মধ্যে দোলা নিস্পন্দ হয়ে শুয়ে আছে।
—দোলা। দোলা!—তিনি প্রাণপণে দোলাকে তুলে বিছানায় শোয়ালেন, মুখ হাত এক দফা মুছিয়ে দিলেন। আস্তে আস্তে জামাকাপড় বদলে দিলেন। একটু জল খাওয়ালেন। দোলা পাশ ফিরে তাঁকে আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল। যেন শুধু এই মাতৃস্পর্শটুকুর জন্যেই তার ঘুম অপেক্ষা করছিল।
আস্তে মেয়ের আলিঙ্গন ছাড়িয়ে তিনি উঠে মেঝে পরিষ্কার করলেন, বমির মধ্যে কঠিন বস্তু প্রায় নেই-ই। খালি জল, খালি জল, আর গলনালির ভেতরের স্বাভাবিক হড়হড়ানি। ফিনাইল দিয়ে ধুলেন সব। কী হল মেয়েটার। ইদানীং খাওয়া আরও কমে গেছে। জন্ডিস হল না কি? কপালে হাত দিয়ে দেখলেন জ্বর আছে কি না।
সকাল দশটা। খাবার টেবিলের দুদিকে মুখোমুখি বসে আছেন দুজনে। স্বামী আর স্ত্রী। একটু আগেই ডাক্তার তাঁদের মেয়েকে দেখে চলে গেছেন। বাড়ির ডাক্তার। সব কিছুতেই আগে ওঁকে ডাকা হয়।
—কী হল বলুন তো? রক্ত-টক্তগুলো পরীক্ষা করাতে হবে না কী?
—রক্ত নয়, ইউরিন।
—ইউরিন? ইউরিনারি কোনও ইনফেকশন… বাবা সব্যসাচী বললেন।
—না ইনফেকশন নয়, ডাক্তার বললেন, আ অ্যাম শিওর, তবু টেস্টটা করাব। শি হ্যাজ কনসীভ্ড্।
সেই থেকে সব্যসাচী আর সুমনা মুখোমুখি বসে আছেন। দোলা ঘুমোচ্ছে। তাঁরা বসে আছেন। কারও মুখে রক্ত নেই। অফিস যাবার জোগাড় নেই, স্কুল যাবার জোগাড় নেই। কয়েক মিনিটের মধ্যে যেন ইলেকট্রিক শকে তাঁদের আপাদমস্তক ঝলসে গেছে।
অনেকক্ষণ পর সব্যসাচী বললেন—তুমি কিছু জানতে না? এটা আমায় বিশ্বাস করতে হবে?
—কী জানব?
—কারও সঙ্গে ওর কোনও অ্যাফেয়ার চলছে কি না।
—তুমি জানো, আই, উই অ্যাবসলুটলি ট্রাস্ট হার। কিছু হলে ও আমাকে বলবে— এটাই তো প্রত্যাশিত? আই কান্ট টেক ইট সব্যসাচী। আই কান্ট টেক ইট ফ্রম হার।
—আশ্চর্য! তবে কি ওকে কেউ রেপ করল?
—সেটাও কি ও চেপে রাখবে? রাখবার কথা? বলতে বলতে সুমনার চোখ দিয়ে টপ্টপ্ করে বড় বড় ফোঁটা ঝরে পড়তে লাগল।
—এত দেখছে চারদিকে, এত শিখছে! স্কুল কলেজে এ সব সোজাসুজি শেখায় না ঠিকই। তবু তো ঠারে ঠোরে ওরা শিখেই যায়! টি.ভি দেখছে দিনরাত্তির! সুমনার গলা যেন বন্ধ হয়ে আসছে।
—তোমার নজর রাখা উচিত ছিল।—সব্যসাচী ঠোঁট চেপে রূঢ়ভাবে বললেন।
—একশোবার। কালো হয়ে যাচ্ছে, রোগা, ভাল করে খায় না, অন্যমনস্ক। সন্ধে পেরিয়ে বাড়ি ফেরে প্রায়ই। কিন্তু নাকের গোড়ায় পরীক্ষা, এ সব তো হবেই! হতেই পারে!
—কী হবে এখন? সব্যসাচী বললেন।
—প্রথম কথা জানতে হবে ব্যক্তিটা কে!
—ইটস আ ডেলিকেট কোয়েশ্চন ….
সুমনা বললেন—ও বোধহয় জানেও না ওর কী হয়েছে। হঠাৎ জানলে বা হঠাৎ কিছু জিজ্ঞেস করলে যদি সাইকলজিক্যাল কিছু …
—কড়া হলে চলবে না—সব্যসাচী বললেন—যদিও ইচ্ছে করছে বেধড়ক ঠ্যাঙানি দিই।
—প্লি-জ—ককিয়ে উঠলেন সুমনা—বলেনি যখন তখন এটা খুব গোলমেলে ব্যাপার হতে পারে। কোনও আধবুড়ো প্রোফেসর, কি বিবাহিত কেউ, কিংবা ক্লাসের কোনও ছেলে যার কোনও চালচুলো নেই। আচ্ছা—তিলক বলে ছেলেটা তো মাঝে মাঝেই ফোন করত!
—করত! তো সে তো চঞ্চল, নিশান, আরও কী কী সব নামের বন্ধু আছে ওর।
—তিলক একটু বেশি করত!
—ট্রাস্ট! বিশ্বাস! কাউকে করতে নেই সুমনা, এই বয়সের ছেলেমেয়েকে তো একেবারেই না। মা-বাবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, সব কথা আলোচনা হয় …এ সব স্রেফ যাকে বলে বকোয়াস। এজেড পিপ্ল আর এজেড, দা ইয়াং আর ইয়াং, দেয়ার ইজ নো পসিবিলিটি অফ এনি কমিউনিকেশন।
—‘মা-আ’—দোলার ঘর থেকে আবার ডাক ভেসে এল।
—দেখো, কী চাইছে!
সুমনা গিয়ে দেখলেন দোলা উঠে বসে আছে, দু হাত দিয়ে মাথা টিপে ধরেছে।
—কী হল? মাথার যন্ত্রণা?
—না, ভীষণ ঘুরছে। কী হল বলো তো—স্পন্ডিলোসিস? এমন নিষ্পাপ ভঙ্গিতে সে বলল কথাটা যে সুমনার সেই মুহূর্তে মনে হল ডাক্তার একটা ভুল করেছেন। তিনিও খুব সরল মুখ করে বললেন—তোর পিরিয়ড ঠিকঠাক নিয়মিত হচ্ছে তো?
—আমি একটু ইরেগুলার, জানোই তো! আগের মাসে হয়নি।
এই সময়ে ফোনটা বাজল। দোলা উঠতে যাচ্ছিল, সুমনা আটকালেন।
সব্যসাচী ধরলেন ফোনটা।
—আমি তিলক বলছি। দোলাকে একটু দেবেন?
—দোলা একটু অসুস্থ। ঘুমোচ্ছে। কিছু বলার আছে?
—হ্যাঁ, অমৃতার আজ ভোররাতে ডেলিভারি হয়েছে। আমরা সবাই গিয়েছিলাম। আবার বিকেলে যাব। দোলা এল না দেখে …
—শোনো … তুমি একবার আমাদের বাড়ি এসো।
—আমি? আপনাদের? ডোভার লেনে, না?
—উঁহু নিউ বালিগঞ্জ। ঠিকানাটা লিখে নাও।
—আজ পারব না মেসোমশাই, কাল ‘উজ্জীবন’ নার্সিংহোম হয়ে যাব। অমৃতাকে এখন আমরা রোজই … আপনাদের অসুবিধে হবে না তো?
—কিচ্ছু না, কিচ্ছু না …
তিলক এল নীচের তলায়। দোলা জানতেও পারল না। ভী-ষণ দুর্বল শরীর। মাথা ঘুরছে, প্রতিদিন সকালে বমিও হচ্ছে একটু একটু। কাঠ-বমি যাকে বলে।
সে শুয়ে শুয়ে কানে ওয়াকম্যান লাগিয়ে রবিশংকর-মেনুহিন শুনছে।
তিলককে চা এবং প্রচুর খাবার দিয়েছেন সুমনা।
তিলক হেসে বলল—দোলা বুঝি আপনাদের বলেছে আমি ভী-ষণ পেটুক?
জোর করে একটু হাসলেন ওঁরা।
সব্যসাচী বললেন—খুব বন্ধু তো তোমরা! প্রায়ই ফোন করো, একসঙ্গে বেড়াতে-টেড়াতেও যাও নিশ্চয়ই। খুব হালকাভাবে বললেন তিনি কথাটা।
তিলক মুখে একটা ফিশফ্রাই তুলছিল, একটু কামড় দিয়ে বলল—হ্যাঁ আমাদের গ্রুপটা মানে আমি, চঞ্চল, লাবণি, দোলা, অমৃতা আমরা খুব ক্লোজ। তবে কফিহাউজ কিংবা য়ুনিভার্সিটি ক্যানটিন … আর কোথাও যাবার সুযোগই পাইনি … যা পড়ার চাপ! বাব্ব্বাঃ। মাঝে মাঝে এক্সকারসানের কথা হয় আবার ধামাচাপা …।
—না আমি বলছি। ডোন্ট মাইন্ড, তোমার কোনও গার্লফ্রেন্ড নেই?
তিলক একটু অবাক হয়ে গেল, মুখে সেটা প্রকাশ করেও ফেলল—আমার গার্লফ্রেন্ড? বাংলার ছেলেদের কোন গার্ল পাত্তা দেবে, মেসোমশাই! তা এই কথা জিজ্ঞেস করতে আপনি আমায় ডেকে …
—না… না… তুমি অত আপসেট হয়ো না! তোমার না হয় গার্লফ্রেন্ড এখনও হয়নি। কিন্তু তোমার বন্ধুদের আর কারও? ধরো, দোলার?
এইবারে ব্যাপারটা বুঝল তিলক। এই জন্যে। এখন, দোলা যা গোপন করে গেছে সেটা ফাঁস করা বন্ধু হিসেবে তার উচিত কী? সে একটু দ্বিধায় পড়ে গেল, তারপর বলল—থাকলে দোলাই আপনাদের বলবে। তাই না? শী ইজ আ গ্রোন-আপ গার্ল।
—শোনো—সুমনা ব্যাকুল হয়ে বললেন এবার—দোলা ইজ ইন গ্রেভ ডেঞ্জার। যদি কিছু জানো, আমাদের কাছে লুকিও না, প্লিজ—তিনি তিলকের দ্বিধাটা টের পেয়েই বললেন।
—মাসিমা, আমি দোলাকে একটি ছেলের সঙ্গে দেখেছি। প্লিজ দোলাকে বলবেন না আমি বলেছি, আমার ভী-ষণ বাজে লাগছে এটা বলতে হচ্ছে বলে।
—বলব না, তুমি যা জানো বলো।
—ছেলেটা আমাদের চেনা কেউ না। য়ুনিভার্সিটার না। কিন্তু খু-ব হ্যান্ডসাম চেহারা। ফিলমের হিরোদের মতো … কিংবা বলতে পারেন মডেলদের মতো।
—নাম জানো না?
—উঁহু, একদিন দোলাকে এ নিয়ে ঠাট্টা করেছিলাম, ভী-ষণ রেগে গেল। ট্যাকসি থেকে গড়িয়াহাটের মোড়ে ওকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল একদিন। আরেকটা কথা মাসিমা, দোলা কিন্তু ক্লাসে খুব, খু-ব ইরেগুলার।
তিলক চলে গেলে আবারও দুজনে বসলেন মুখোমুখি। একটা সূত্র পাওয়া গেল। ক্ষীণ একটা সুতো। সুমনা হঠাৎ বললেন—তিলক বলে যে ছেলেটা প্রায়ই ফোন করে সে কিন্তু এই তিলক নয়।
—কেন?
—তার গলা একেবারে অন্যরকম। কথা বলবার ধরনও আলাদা। এই তিলক তো টিপিক্যাল একটা কলেজের ছেলের মতো চ্যাঁ-চ্যাঁ করে কথা বলে। যে ফোন করে তার গলা বেশ ভাল, পুরুষালি, খুব মার্জিত ভঙ্গি। ছেলেমানুষি নেই একদম।
—দোলা! দোলা শুনতে পেল না তার কানে ওয়াকম্যান, কিন্তু দোলা দেখতে পেল মা এসে দাঁড়িয়েছে। মুখ খুলে কিছু বলছে। সে ওয়াকম্যানটা খুলে রাখল৷ মায়ের হাতে একটা রিপোর্ট। ডেফিনিটলি রক্ত আর ইউরিন পরীক্ষার।
—দোলা—মা বলল, মায়ের গলা কাঁপছে,—ছেলেটা কে? যার সঙ্গে তুই ট্যাকসি করে ঘুরে বেড়াস?
দোলার মুখ শুকিয়ে গেল। সে ঢোঁক গিলে বলল—কে বলেছে?
—অনেকেই দেখেছে, অনেকেই বলেছে—এই ভিড়ে ভর্তি শহরে এসব লুকোনো যায় না। দোলা, তোমার ইউরিন রিপোর্ট বলছে তুমি কনসীভ করেছ মাস দুয়েকের মতো।
রক্তশূন্য মুখে দোলা কিছু বলতে গেল বারবার, মুখে কথা ফুটল না। অবশেষে সে উপুড় হয়ে পড়ল বিছানার ওপর। যেন খরগোস নিজের বিবরে মুখ লুকিয়েছে। কিন্তু পেছনটা উন্মুক্ত। যে-কেউ থাবা মেরে তুলে নিতে পারে।
তার পাশে বসে সুমনা আস্তে আস্তে বললেন—আমাদের বলনি কেন দোলা? আমরা তোমার বাবা-মা কী দোষ করেছি তোমার কাছে?
কোনও উত্তর এল না।
—তোমাকে কীভাবে আমরা বিশ্বাস করেছি, চিরকাল, কীভাবে শিক্ষা দিয়েছি, বন্ধুর মতো মিশেছি—তা তো তুমি জান। তবে?
এবার দোলার উপুড় শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। সে কোনও মতে বলল—তোমরা ওকে অ্যাপ্রুভ করতে না। পার্থদার মতো বড় কিছু নয়… তা ছাড়া ও কিছুদিন লুকিয়ে রাখতে বলেছিল…
—‘ও’ বলেছিল বলে তুমি ‘আমাদের’ কাছে গোপন করলে? মা বাবাকে গোপন করতে বলে যে ছেলে, তোমার বোঝা উচিত ছিল সে ভাল নয়।
—না, না, ও ভাল, কিছুদিন সময় চাইছিল, এরিয়া ম্যানেজার হয়ে যাবে তারপর!
—ইতিমধ্যে সে এই কাণ্ড বাধিয়ে বসল?
দোলা লালমুখে নখ খুঁটতে লাগল।
—ইন এনি কেস, কে ছেলেটি? কী নাম?
—অমিতাভ সেনগুপ্ত। শুধু সেন লেখে। পার্থদা চেনে।
—পার্থ? পার্থ জানে ব্যাপারটা?
—না, না, পার্থদাদের অফিসের স্টিমার পার্টিতে আলাপ হয়েছিল।
—পার্থ? হ্যাললো পার্থ দত্ত, আছে? হ্যাঁ দিস ইজ হিজ ফাদার-ইন-ল’। ইয়েস ইট ইজ ভেরি-ভেরি আর্জেন্ট।
—ইয়েস, বাবা, কী ব্যাপার?
—অমিতাভ সেনগুপ্ত বা সেনকে চেন? তোমাদের অফিসের স্টিমার পার্টিতে এসেছিল?
—অমিতাভ সেন? কীরকম একটু যদি ডেসক্রাইব করেন…
—তোমার শালির সঙ্গে এত ভাব জমিয়ে ফেলল, আর তুমি এখন ডেসক্রিপশন চাইছ? হাউ ডু আই নো? তোমার রেসপনসিবিলিটি। তোমার জানার কথা।
তাঁর গলার স্বরে রাগ গোপন রইল না আর।
পার্থ বোধহয় কিছু মনে করল। করতেই পারে। বলল—ঝুলনকে জিজ্ঞেস করে বলব। এনিওয়ে কী হয়েছে? অ্যাফেয়ার?
—এসে শুনো।
ঝুলন আর পার্থ সন্ধেবেলায় এল। ওদের নীচেই বসালেন সব্যসাচী। সুমনা সর্বক্ষণ ওপরে দোলাকে পাহারা দিচ্ছেন।
পার্থ বলল—হ্যাঁ আমরা দুজনে মিলে প্লেস করতে পারছি। ছেলেটি খুব সম্ভব আমাদের অ্যাকাউন্ট্যান্টের শালা, সে-ই যদি হয় তো আমাদের অ্যাকাউন্ট্যান্ট বলছেন—একটা অত্যন্ত ইরেসপনসিব্ল ছোকরা। অমন চেহারা, স্মার্টনেস শিক্ষা-দীক্ষা নিয়েও বছরের পর বছর ওষুধের সেলস পার্সন হয়ে আছে। কাজে মন নেই। খালি সিনেমা, থিয়েটার, গার্লফ্রেন্ড, মিউজিক। যা রোজগার করে স-ব উড়িয়ে দেয়। চেহারা দেখে যদি আপনারা পাত্র পছন্দ করে থাকেন তো ঠকবেন। পরিবার ভালই। মা সেতার-টেতার বাজান, বাবাও কোন বড় কোম্পানিতে পার্চেজে আছেন। তিনিও ওইরকম, উন্নতি করতে, খাটতে খুবই অনিচ্ছুক।
—কিন্তু আমাদের কোনও উপায় নেই পার্থ। ওরই সঙ্গে দোলার বিয়ে দিতে হবে। দোলা আর কাউকেই বিয়ে করবে না।
—আমি একটু বুঝিয়ে দেখব বাপি?—ঝুলন বলল।
—নাঃ আর উপকার তোমাকে করতে হবে না। স্টিমার পার্টি বলে বোনকে নিয়ে গেলে, একটু নজর পর্যন্ত রাখলে না। কার সঙ্গে মিশল, কার সঙ্গে কথা বলছে … ছিলে কোথায় ঝুলন? ছি, ছি …
পার্থ পরে বিরক্ত হয়ে ঝুলনকে বলেছিল—একটা বাইশ তেইশ বছরের মেয়ে তাকে কি পাহারা দিয়ে রাখতে হবে নাকি? তোমার বাবা-মার মাথা খারাপ হয়েছে। আমাদের কী দোষ?
অনেক চেষ্টা চরিত্র করে অমিতাভ সেনগুপ্তর বাবা-মাকে যদি বা খুঁজে পাওয়া গেল, অমিতাভকে আর পাওয়া যায় না।
টাউনসেন্ড রোডে, ওদের বাড়িতে গিয়ে প্রস্তাবটা রাখতে অমিতাভর বাবা আকাশ থেকে পড়লেন।
—অমুর বিয়ে দেব? বিয়ে করে দায়িত্ব নেবার মতলবই ওর নেই। কী দেখে আপনারা ভুললেন? চেহারা?
—আমরা ভুলিনি। আমাদের ছোট মেয়ে।
—তাই বলুন। এখন আমার ছেলে ভুলেছে কি না দেখতে হয়।
—দেখুন। সে কোথায়?
—সে ট্যুরে গেছে। ওষুধের কম্প্যানির সেলসম্যান। মাঝে মাঝেই এদিক-ওদিক যেতে হয়।
দোলাদের বাড়ির দোতলার ঘরে একা অমিত ও দোলা। অমিত বলল—দোলা, আমাকে প্রেশারাইজ করাটা আমার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না।
—মানে? এই অবস্থাকে তুমি প্রেশারাইজ করা বলছ?
—দেখো এসব ঘটনা ঝোঁকের মাথায়, ঘোরের মাথায় ঘটে যায়। কিন্তু ঘোরটা উভয় পক্ষেরই।
—মানে?
—তোমার সম্মতি না থাকলে কি আমি …
—বন্ধুর শূন্য বাংলো-বাড়িতে দুপুর কাটাবার প্ল্যানটাও কি আমার? আমার দায়িত্ব …? বলতে বলতে ফ্যাকাশে হয়ে যেতে থাকল দোলা, তার আবার বমি পাচ্ছে। সেই প্রবল উকি দিয়ে দিয়ে কাঠবমি। কিছুক্ষণ মুখ ঢেকে সে নিজেকে সামলাল। যখন হাত সরাল, তখন সমস্ত মুখ টকটকে লাল হয়ে গেছে।
—কী হয়েছে তোমার, দোলা? অমিতের গলায় যেন দুশ্চিন্তা টের পাওয়া যাচ্ছে।
—জানো না কী হয়েছে? তোমাকে তো বলা হয়েছে! হয়নি?
—দোলা প্লিজ, এম. টি. পি করিয়ে নাও। কেন শুধু শুধু কষ্ট পাবে? আমি এখনও প্রস্তুত নই। এতটা দায়িত্ব …
দোলার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল অমৃতার কেস। সে এম. টি. পি করতে রাজি হয়নি বলে কী ভাবে তাকে ..
—তুমি যদি পুরুষ হও, তাহলে যে মুহূর্তে একটি মেয়ের সঙ্গে ইনভলভ্ড হয়েছ, সেই মুহূর্ত থেকে তোমার দায়িত্ব এসে যায়। তুমি কি আমাকে নিয়ে খেলা করছিলে তবে? এ কী মারাত্মক খেলা? … থেমে থেমে কথাগুলো বলল দোলা। ভেতরটা তার ত্রাসে দুঃখে ক্ষোভে কাঁপছে। কিন্তু এগুলোই তার পক্ষে সবচেয়ে কঠিন কথা। বলে ফেলে তার চোখ উপচোতে লাগল।
—আই লভ য়ু, দোলা, প্লিজ ডোন্ট মিসআন্ডারস্ট্যান্ড মি, শুধু আমার অবস্থাটা তোমাকে বুঝতে বলছি।
—আর যদি না বুঝি? যদি আমার মা বাবা না বোঝেন?
—অগত্যা … আর কী বলব? এম. টি. পি আজকাল এত সোজা, বিশেষত তোমার এই স্টেজে। পরীক্ষাও তো তোমার সামনেই …
— ‘অগত্যা’? ‘অগত্যা’ কথাটার মানে কী? —দোলার গলার স্বরে একটা অবাঞ্ছিত কর্কশতা একটা তীক্ষ্ণতা এসে গেল। যেন সে হঠাৎ একটা অতলস্পর্শ খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে, ঝুলছে। পেছনে রিভলভার হাতে খুনি, তার মাথা কিংবা হৃৎপিণ্ড লক্ষ করে অস্ত্র তুলেছে।
—আমি বুঝতে পারছি, তুমি বুঝবে না, দোলা, আসলে তুমি ভাবছ …
—কী ভাবছি?
—না থাক্।
এটা সকালের ঘটনা। দুপুরে আজও অফিস-স্কুল গেলেন না সব্যসাচী সুমনা কেউই, দুজনেই এই প্রথম অমিতাভকে দেখলেন। জামাই করলে ঘর আলো হয়ে যাবে, তাঁরা সত্যি-সত্যিই অবাক হয়ে গেছেন এই সিনেমা-সম্ভব রূপ দেখে। এ যেন সত্যি নয়। রুপোলি পর্দা থেকে কেটে নামিয়ে আনা হয়েছে। কথাবার্তাও অত্যন্ত মার্জিত, নম্র, সপ্রতিভ, অথচ পরিশীলিত। একমাত্র অপরাধ তার তেমন ভালো-নয় চাকরি, আর তার অখ্যাতি বা কুখ্যাতি। তার নিজের বাবা, জামাইবাবু পর্যন্ত তার সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ৷ মায়েরা ছেলেদের দোষ দেখতে পান না। কাজেই, অমিতাভর মা আর কী করে সোজাসুজি তার নিন্দা করেন। তিনি বলেছিলেন—অমিত একটু শিল্পীস্বভাবের ছেলে। এরা ভাল গৃহস্থ হয় না। বিয়ে যদি দেন, তা হলে নিজেদের দায়িত্বে দেবেন। পরে আমাদের দোষ দিতে আসবেন না।
সব্যসাচীর রাগ হয়ে গিয়েছিল, তবু রাগ চেপে বলেন—আপনি নিজেই তো একজন শিল্পী, তা আপনারও শিল্পীস্বভাব নিশ্চয়ই। তার জন্য আপনার গৃহস্থালির কোনও ক্ষতি হয়েছে?
ভদ্রমহিলা, নাম কৃষ্ণা সেন, বললেন—পুরুষ আর মেয়েদের মধ্যে আকাশপাতাল তফাত। আমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি অবশ্য স্বীকার করবেন না, যে আমার সেতার, তার জন্য রেওয়াজ, জলসা, রেডিও, দূরদর্শন—এসব ওঁকে কখনও সখনও অসুবিধেয় ফেলে, উনি অসন্তুষ্ট হন। কিন্তু আমার বদলে ‘উনি’ যদি শিল্পী হতেন তাহলে আমাকে চব্বিশঘণ্টা ঘরে-বসা আইডিয়াল গৃহিণীও হতে হত, আবার কিছু রোজগারপাতিও করতে হত। শিল্পীর আয়ে সংসার চলে না তো! আর দেখুন অমুর ব্যাপারটা হচ্ছে, ও শিল্পীস্বভাব, কিন্তু শিল্পী নয়। ও না শিখেও ভাল গান গায়, অভিনয় করতে পারে, স্প্যানিশ গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে আসর মাতিয়ে দেবে, কিন্তু ও অস্থির, চঞ্চল, কিছুতে লেগে থাকতে পারে না, সবসময়েই একটা হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোনখানে ভাব। নাও, য়ু ডিসাইড।
এখন ওঁরা আলোচনা করছেন—অমিতাভ বিয়ের পাত্র হিসেবে আদৌ অভিপ্রেত কি। মেয়ের অবস্থার জন্য তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দিলে, মেয়েটা যদি সারাজীবন অসুখী হয়? এ তো আর আগেকার কাল নয় যে কুমারী গর্ভিণীকে আইনমাফিক গর্ভপাত করানো যাবে না!
সুমনা বললেন—এই গর্ভপাতের সাইকলজিক্যাল এফেক্ট মেয়ের ওপর কী হবে, একবার ভেবেছ? পরে যখন ওর বিয়ে দেওয়া হবে, এ ঘটনা লুকিয়ে দিতে হবে, ধরা পড়ে যেতেই পারে, আর দোলা যা মেয়ে ও ঠিক বলে ফেলবে। তখন …
সব্যসাচী গম্ভীরভাবে বললেন—তা যদি বলো, গোপন করতে তোমার মেয়ে যে ভালই জানে, লোকের চোখে ধুলো দেবার চালাকি যে সে চমৎকার আয়ত্ত করে ফেলেছে, তা তো প্রমাণিতই হয়ে গেছে সুমনা! এ সব কথা আর কেন?
এম. টি. পি-র কথাতে কিন্তু দোলা ভয়ে বাঁশপাতার মতো কাঁপতে লাগল। মুখ রক্তহীন। সে শুধু কোনওমতে বলতে পারলে—মা, ওটা তো টিউমার নয়, একটা বাচ্চা … আমার … আমার মা … তারপর দু হাতে মুখ ঢেকে সে তার পড়ার টেবিলে মাথা গুঁজল।
—ছেলেটি? তোমার ওই অমিতাভ? ও-ও তো একই কথা বলছে? ও-ও চায় না।
—ওরা ছেলে মা, বোঝে না এ সবের ইমপর্ট্যান্স, ফীলিং নেই। ওর একমাত্র আপত্তি টাকা-পয়সার। ফ্যামিলি সাপোর্ট করবার মতো আর্থিক অবস্থা ওর এখন নেই।