Amtrita – ২
রোদে পিঠ দিয়ে বসে থাকতে তার ভীষণ ভাল লাগে। চৈত্রেও, ফাল্গুনেও, এমনকি বৈশাখেও। প্রথম আলো ফোটবার সময়ে। মা বলে তার শরীরে ক্যালসিয়াম কম আছে তাই। পেছনে একটা কীসের যেন কাদের যেন কারখানা আছে। সেখানে একটা চিমনি আছে। চিমনি দিয়ে লকলকে আগুন আর কালো ধোঁয়া ঠিক কখন বেরিয়ে আসবে, কখন বেরিয়ে আসে সে জানে না। খুব সম্ভব রাতে, যখন সে ঘুমোয়, একটা অতীন্দ্রিয় আঘ্রাণ তার স্বপ্ন জুড়ে, ঘুম জুড়ে থাকে, কিংবা হয়তো দুপুরে যখন সে বাড়ি থাকে না। সন্ধেবেলায় জানলা খুললে একটা উৎকট পোড়া-পোড়া গন্ধ সে পায়। সত্বর বন্ধ করে দেয় জানলার কপাট। কিন্তু এটুকু অসুবিধে সে সহ্য করে নিতে রাজি, যদি প্রতিদিন ভোরবেলায় স্রেফ জানলার জাফরির মধ্য দিয়েই ভোরের কমলালেবুকে একটু একটু করে কাঁসার জামবাটি হয়ে উঠতে দেখার অমূল্য সুযোগ সে পায়, এবং যদি কারখানার মালিকরা যত করোগেটের চালি, যত কুশ্রী ভাবেই তুলুক না কেন, দোলনচাঁপা গাছটা তার সতেজ পত্রসম্ভারের সবুজ নিয়ে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে! মৃদুল গন্ধের ওই ফুল আর গাঢ় সবুজ পাতার ওই গাছ যেদিন ওরা আরেকটা টিনের চালি কি আর একটা চিমনি বসাবার জন্যে কেটে ফেলবে, উঃ ভাবতেও গা শিউরোয়, মন ছমছম করে, তা সে যাই হোক সেই দিন থেকে সে পুবের জানলা বন্ধ করে দেবে, অন্য কোনও জানলার আশ্রয়ে চলে যাবার কথা ভাববে। ভাবলেই যে সঙ্গে সঙ্গে আশ্রয় মিলে যাবে তার কোনও স্থিরতা নেই, এটুকু বাস্তববোধ তার আছে। খানিকটা অপেক্ষা করার ধৈর্যও তার মধ্যে দুর্লভ নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই দোলনচাঁপা, ওই কমলালেবুর আকাশে ওঠা, এই মিঠে রোদে পিঠ পাতা—এগুলো তার চাই-ই।
পিওন, শোনো, না না রানার, রানার!
রানারের জন্যে আমি কান পেতে আছি। কারণ তোমার চিঠি ওইরকম গতানুগতিতে আসবে না। হোক দেরি, কিন্তু রানার চাই। তার থলির ভেতর থেকে সাবধানে বার করবে, আমাকে শুধু আমাকেই দেবে আর কাউকে না, এমনকি চিঠি-বাক্সকেও না, তারপর? তারপরই ভেবেছ চিঠিটা আমি তাড়াতাড়ি খামের মুখ ছিঁড়ে পড়ব? ভুল ভেবেছ। চিঠিটাকে আমি অনেকক্ষণ ওম দেব, পাখিমায়েরা যেমন ডিমে তা দেয়! কত কাজ আমার করার থাকে। টেবিল গুছোনো, বই গুছোনো, বুদ্ধদেবের মূর্তি পালিশ করা, ডোকরার যে মূর্তিটা কিছুতেই চকচকে হবে না সেটাকে নিয়েও রোজ আমার পড়ে থাকতে হবেই। তারপর বাপি ডাকবে, বাপিকে খেতে দেবার সময়ে আমাকে উপস্থিত থাকতে হয়। আমার ভাল লাগে, ভাল লাগে রানারের চিঠিতে তা দিতে দিতে এই বসে থাকা। আমার বাপি খুব সকাল সকাল বেরিয়ে যায়। বেচারি! আমাকে আর মাকে সুখে রাখবার জন্যে বাপির কী কষ্ট! কী চেষ্টা! আমি তো বলি দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। আর কেন তুমি এত কষ্ট করো।
—এ হল সিন্দবাদের বুড়োর জোয়াল, বুঝলি তো? একবার কাঁধে নিলে আর নামানো যায় না। তা ছাড়া তুইও তো আছিস। তোকে পার, উঁহু সুখী করতে হবে না?— বাপি বলে।
এইখানটায় আমি আমার লুকোনো হাসিটা হাসি৷ এ কী রকমের হাসি জানো? ঠোঁটদুটো ছড়ায় না। অন্তত বাইরে নয়। ভেতরে, মুখের গভীরে হাসি। কেন তা তুমি নিশ্চয় জানেো। দিদির বিয়েতে বাবাকে অনেক অ-নে-ক দিতে হয়েছে। সব ওরা মুখ ফুটে চায়নি। কিন্তু অন্য কোনওভাবে, হাবেভাবে, বডি-ল্যাঙ্গোয়েজে চেয়েছে। বাপি তো দিদিকে দিতই। গয়নায় রানি করে দিত একেবারে। কিন্তু তুমিই বলো, ওদের বাড়িতে কি টিভি নেই? সি.ডি. প্লেয়ার নেই? ওয়াশিং মেশিন, পি.সি. হয়তো না-ও থাকতে পারে। কিন্তু এ কেমন কথা যে একজন ম্যানেজমেন্টের মাস্টার্স ডিগ্রি-করা, পঁচিশ-তিরিশ হাজার মাইনে পাওয়া লোক মানে ছেলে এসব শ্বশুরবাড়ি থেকে নেবে? পার্থদা অবশ্য চায়নি। কিন্তু বাবা যখন পার্থদার বাবার বডি-ল্যাঙ্গোয়েজ বুঝে এসব দিল, আপত্তি করেনি তো! আমি যদি পার্থদা হতাম, তা হলে শুধু লজ্জা নয়, রাগ পেত আমার। তক্ষুনি সব ফিরিয়ে দিতাম।
ধুস কী সব লিখছি, এক্কেবারে ধুত্তোর ছাই। এসব কি তোমার আমার কথা না কি? আমার মুখের ভেতরের হাসিটা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এসব বলতে হল আসলে।
ফোন বাজছে। আসছি এবার। নিশ্চয় আমার ফোন।
—হ্যালো।
—হ্যাঁ দোলা, আমিই তো বলছি।
—হ্যাঁ, কয়েকদিন অমৃতা আসছে না। বোধহয় তিন দিন। না, আমরা কিছু ভাবিনি তো! সরি মাসি, সত্যি খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল। তুমি সাত দিন খোঁজ পাওনি? ও ফোন করছে না? তুমিও পাচ্ছ না? ওদের ফোন খারাপ?
—অ্যাঁ? তোমার গলা শুনেই রং নাম্বার বলে রেখে দিচ্ছে? আর ইউ সিওর ওটা অমৃতাদেরই ফোন? ওর শ্বশুরের গলা? তুমি ঠি-ক চেনো? আচ্ছা, আমি দেখছি। কিন্তু তুমি, তোমরা একবার যাচ্ছ না কেন? আবার তোমার বেডরেস্ট? যাঃ।
মাসির হৃদয় কেন এত ঠুনকো, কিছুই তো বয়স নয়, তার মায়ের থেকে বেশ কিছু ছোটই হবেন। আশ্চর্য! ওই ভয়েই অমৃতাটার সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিলেন। তারা বন্ধুরা খুব খেপিয়েছিল অমৃতাকে সে সময়ে। অমৃতা বলেছিল—‘আমাকে কেন? আমার বাবা-মা-কে খেপাগে যা। আমার পেছনে লাগলে ভাল হবে না।’
তা বেশ তো, তারা না হয় গিয়ে অমৃতার বাবা মা-কেই খেপাল। সে এক্তিয়ার তাদের আছে। ‘আচ্ছা মেসোমশাই, গৌরীদান করলেই তো পারতেন। এত ভাবনা যখন অমৃতাকে নিয়ে!’
মেসোমশাই পরীক্ষার খাতাগুলো সরিয়ে রেখে বললেন—‘গৌরীদান? তা-ই বটে। তোমাদের মাসিমাকে বোঝাও। তাঁর ধারণা তিনি যে কোনওদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারেন। তখন মেয়েটাকে দেখবার তাঁর কেউ-ই থাকবে না। আ’য়্যাম নট রেস্পনসিব্ল এনাফ।’
বলতে বলতে মেসোমশাই যে সত্যি-সত্যিই খুব গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিলেন এটা ওরা বুঝতে পেরেছিল। অমৃতার মা কিন্তু সত্যিই খুব অসুস্থ। হাই ব্লাড প্রেশার থেকে হার্ট খারাপ, এর ওপর যখন ব্লাড সুগার হল, উনি আর অপেক্ষা করতে রাজি হলেন না। মেয়ের বিয়ের জন্যে পাগলিনীপ্রায় হয়ে উঠলেন। তা সত্ত্বেও তারা মাসিমাকেও খেপিয়েছিল।
কিন্তু অমৃতা? অমৃতাই বা রাজি হয়ে গেল কেন? ও যদি সেভাবে আপত্তি করত তা হলে জোর-জবরদস্তি করে তো আর ওঁরা বিয়েটা দিতে পারতেন না। আসল কথা, অমৃতাও বোধহয় ভয় পেয়েছিল। কিংবা এ-ও হতে পারে অরিসূদনকে দেখে ও তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল।
এরকম হয়, হয়েই থাকে, সে জানে। অমৃতার বাবা-মা-র যেমন প্রেমের বিয়ে। অমৃতার মা দেখতে কী সুন্দরী! কী সুন্দরী! সাধারণ গ্র্যাজুয়েট। কিন্তু ওঁদের সময়ে ওই রূপের জোরেই তো ওঁর অ-নে-ক ভাল বিয়ে হতে পারত। কিন্তু ওই যে প্রেম! প্রেমে পড়লেন। অমৃতার বাবা তখন এম.এ.-র ব্রাইট স্টুডেন্ট, মাসিকে পড়াতেন। মেসোমশাইয়ের আগেকার ছবি সে দেখেছে। সাধারণ ভাল-ছেলে ভাল-ছেলে ভাবটা। অত রূপসী মাসি যে কী করে …। না, এভাবে বাবা মা-দের সম্পর্কে ভাবাটা ঠিক না। বরং নিজের উদাহরণটাই তার ভাবা দরকার। গেল পার্থদাদের ক্লাবের স্টিমার পার্টিতে, সরু সিঁড়িটা দিয়ে আপার ডেকে উঠছে, সিঁড়ির ওপরে যেন নিজের নিয়তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। প্রথম, একেবারে প্রথম দর্শনে এমনটা হতে পারে সে কোনওদিন ভাবেনি। সারাটা স্টিমার-পার্টি ছলচাতুরি করে ও-ও যেমন তার কাছাকাছি আসবার চেষ্টা করেছে, তেমনি সে-ও করেছে। নির্লজ্জের মতো। এক টেবিলে খেতে বসেছে খুঁজে খুঁজে। এক একটা টেবিলে চারজনের করে জায়গা। ওরা দুজন ছাড়া ছিলেন দুজন বয়স্ক ভদ্রলোক। তাঁদের নিয়ে ঠারে-ঠোরে কী ঠাট্টা ওদের। কেটারারকে বলে যখন এক্সট্রা মাছটা ও তার পাতে দেওয়াল, তখন সেই মাছের টুকরোটা রাগের ভান করে সে কি ওর মুখে গুঁজে দেয়নি! পাতেই তো তুলে দিতে পারত! ওভাবে মুখে গুঁজতে গিয়ে তার ডান হাতের সব আঙুলগুলোর আগা যে ওর মুখের মধ্যে চলে গেল সে শিহরনের কথা জীবনেও ভুলবে না কি সে? ও-ও হয়তো ভুলবে না। হুল্লোড়বাজ, চঞ্চল, অস্থির, খেয়ালি, তবুও ও-ও ভুলবে না। সে স্থির জানে। আর এই ভাল লাগা, এই শিহরন, এই ফিরে ফিরে তাকিয়ে দেখার ইচ্ছে, ফিরে ফিরে সামান্য ঘটনাগুলো ভাবার ইচ্ছে, এ একজনের সঙ্গেই হয়। সেই একজন যত দিন না আসে, তত দিন অনেককে ভাল লাগে, অনেকের দিকে একটু একটু ঝোঁকে মন, কিন্তু সে যখন আসে সিঁড়ির মাথায় ওইরকম বিজলি-চুম্বকের মতো তখন বোঝা যায় আরগুলো সব মিথ্যে, হাস্যকর রকমের ছেলেমানুষি। এইটা সত্য। এইটা অমোঘ।
অমিতকে দেখে তার যা হয়েছিল, অরিসূদনকে দেখে অমৃতার যদি তার কণাও হয়ে থাকে, তা হলেই বোঝা যাবে, কেন উনিশ বছর মাত্র বয়সে, ফাইন্যাল পরীক্ষা ঘাড়ের ওপর, মা শয্যায়-শোওয়া, অমৃতা হঠাৎ বিয়েতে রাজি হয়ে গেল। নইলে অমৃতার মতো অত লেখাপড়ামুখি মেয়ে, অত সিরিয়াস, তারপরে অমন মা-অন্ত প্রাণ, মাকে প্রাণ দিয়ে আগলে রাখত যে, বাবা-মার অমন বুকের ধন যাকে বলে সে কেন …
মাসি বেপথু হাতে ফোনটা নামিয়ে রাখছেন, বুঝতে পারল দোলা। অনায়াসে। এখন মানুষের মনের অনেক কথা, শরীরের অনেক ভাবের কথা সে চট করে বুঝতে পারে। প্রেম তাকে এই শক্তি দিয়েছে। একদিক দিয়ে ভাবতে গেলে এটা অমিতেরই দেওয়া। অমিতাভ। অমিতের জন্য সারা শরীরে একটা সজলতা নিয়ে, আর সীমা মাসি অর্থাৎ অমৃতার মায়ের জন্য একবুক করুণা নিয়ে, আর অমৃতার জন্য একমাথা ভাবনা নিয়ে সে অমৃতার ফোনটা ঘোরাল। রিং হচ্ছে, রিং হয়ে যাচ্ছে ওদিকে। ফল্স রিং না কি?
—হ্যাল্লো—একটি বয়স্ক নারীকণ্ঠ জবাব দেয়।
—অমৃতা আছে?
—কে বলছেন?
—আমি দোলা, মাসিমা, অমৃতার বন্ধু। দিন তিনেক কি চারেক হল ওর য়ুনিভার্সিটি কামাই হল, তাই …
—ধরো, ডাকছি।
বেশ কিছুক্ষণ পরে অমৃতার গলা ভেসে এল—দোলা?
—হ্যাঁ আমি, তুই তিন দিন আসছিস না কেন?
উত্তরে অমৃতা বলল—জয়িতাদি খোঁজ করছিলেন? ও।
দোলা বলল—তোর শরীর-টরীর খারাপ না কি?
অমৃতা বলল—তোর আবার জ্বর হয়েছে? কতদিন বলেছি ঠাণ্ডা লাগাস না!
দোলা বলল—ব্যাপারখানা কী বল তো। মাসি ভীষণ ব্যস্ত হয়ে ফোন করেছিলেন। তোদের ফোন পাচ্ছেন না। পেলেও রং নাম্বার বলে কে নামিয়ে রাখছে!
—হ্যাঁ ঠিক আছে। রাখছি—
ফোনের মধ্যে একটা চাপা রাগত গলার ‘এবার রাখো’ শুনতে পেয়েছিল দোলা। সেটা নারী-কণ্ঠ কি পুরুষ-কণ্ঠ সেটা বুঝতে পারেনি।
অমৃতার সমস্ত কথাবার্তাই অসংলগ্ন। তার ওপর ওই ‘এবার রাখো’। দোলা কেমন উদ্ভ্রান্ত বোধ করল। কী হচ্ছে? কী হচ্ছে এ সব?
মা জিজ্ঞেস করল—অমন করে খাচ্ছিস কেন দোলা? তেতো দিয়ে ডাল মাখলি যে!
—ওঃ ভুল হয়ে গেছে, বুঝতে পারিনি মা,।
—বুঝতে পারিসনি ওটা নিম-বেগুন? মাথায় কী ঘুরছে বল তো! ঠিক করে খা। ও ভাতটা সরিয়ে রাখ। আরেকটা মাছ ভাজা দেব?
দোলা বলল—এই তো, ঠিক আছে। খেয়ে নিচ্ছি। উঃ আরেকটা মাছ? বলে একটাই খেতে পারছি না।
মা নিজেও দোলার সঙ্গে খেতে বসেছে। বাবা সাত সক্কালে বেরিয়ে যায়। দোলা য়ুনিভার্সিটি যেতে আর মা মায়ের শখের নার্সারি স্কুলে যেতে একই সঙ্গে বসে। তবে দোলার কোনও কোনওদিন দেরিতে ক্লাস থাকে। সেদিনগুলোতে মা খেয়ে বেরিয়ে যায়। দোলা নিজের মতো বেরোয়। নিজের মতো খেয়ে। ওদের বাড়ির কাজের লোক অর্থাৎ অণিমাও কাজ করে, সকাল দশটার মধ্যে সব রান্না-বান্না সেরে গুছিয়ে, নিজে খেয়ে সে-ও চলে যায়, কোনও গেঞ্জি কারখানায় তৈরি গেঞ্জির সুতো কাটতে। আবার সন্ধে সাতটায় আসবে।
দোলাদের বাড়িটা এমন জায়গায় যে কোনও বাসের টার্মিনাস থেকে ওঠার উপায়ই নেই। এক যদি হাওড়া চলে যেতে চাও! ও অবশ্য পাতাল রেলে করে যায়। অটোয় করে কালীঘাট স্টেশনে উঠে ও সেন্ট্রালে নামে, কলুটোলাটা হেঁটে পার হতে হয়, পেছনের দরজা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে ও।
—খিড়কির দরজা দিয়ে কারা আসে জানিস?—নিলয়, ওদের ক্লাসের সবচেয়ে বিচ্ছুটা বলেছিল একদিন।
—কে?—দোলা ওর ফিচেল হাসি থেকেও কিছু আন্দাজ করতে পারেনি।
—জমাদার।
—আমি জমাদার? আমি জমাদার?—চড় তুলে তাড়া করলে তো নিলয় পালাবেই। পালিয়ে কিন্তু বেশি দূর যাবে না পাজিটা। একটু দূরে দাঁড়িয়ে বলবে—কেন? জমাদার খারাপ? স্ক্যাভেঞ্জার, সংসারের যাবতীয় আবর্জনা, জাল-জঞ্জাল যে পরিষ্কার করে আমাদের জন্য তাকে খারাপ বলছিস? দাঁড়া, জ্যোতিবাবুদের বলে দেব।
তখন অমৃতাই বলে—তুই কিচ্ছু জানিস না নিলয়, খিড়কি দরজা দিয়ে আরও অনেকে আসে, আসে ফুচকাওলা, আসে পাঙ্খা বরফ। দোলাটা তো নির্ঘাৎ ফুচকাওলা। ওর কাছে ফুচকাগুলো যা মচমচে না, আ-হ।
আবার অমৃতা। অমৃতার কথাতেই মাথাটা এখন ভর্তি হয়ে আছে। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠে ক্লাসে ঢোকবার মুখে স্বভাবতই অনেকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। শর্মিষ্ঠা, তানাজি, নিলয়, অনিন্দিতা, লাবণি, তিলক—এক দঙ্গল একেবারে।
কাকে বলবে? নিজের দুশ্চিন্তার কথাটা? শর্মিষ্ঠাকে সে আদৌ নির্ভরযোগ্য মনে করে না, অনিন্দিতাটা অতিশয় তরল প্রকৃতির। লাবণিকে বলা যেত। কিন্তু সময় চাই। এখন ভিড়ের মধ্যে থেকে ওকে ডাকলেই সবগুলো শেয়াল একসঙ্গে খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠবে।
—কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে? অ্যাঁ? আমরা বুঝি কেউ নই। কিছু নই!
তিলক পাশে বসেছিল বলে তিলককেই বলে ফেলল কথাটা দোলা।
—তিলক শোন, অমৃতার নির্ঘাৎ কোনও প্রবলেম হয়েছে।
—তিন চারদিন আসেনি। হ্যাঁ কোষ্ঠকাঠিন্য তো অন্ততপক্ষে বটেই!
—অসভ্যতা করিস না। ওর শ্বশুরবাড়িতে কাউকে ফোন ধরতে দিচ্ছে না। ওর মাকেও কথা বলতে দিচ্ছে না। আমি অনেক কষ্টে কনট্যাক্ট করেছি, উল্টো পাল্টা বকল।
—সর্বনাশ! তিলক বলল,—মাথাটা গেছে। যত বলি, অত পড়িসনি অমৃতা, অত পড়িসনি। আজ বলছি না কি?
—তুই কি কখনও সীরিয়াস হবি না?
—ইন্টারভিউয়ের চিঠি এলে নির্ঘাৎ হব।
—শোন তিলক, ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কারুর সঙ্গে ওকে কথা বলতে দিচ্ছে না, ব্যাপারটা খুব ফিশি লাগছে।
তিলক বলল—দেবে তো না-ই। শ্বশুর-টশুর টের পেয়েছে আমার মতো একটা লাল টুকটুকে ছেলের সঙ্গে ও পড়ে। সন্দেহ, স্বাভাবিক! তোর শ্বশুর-শাশুড়ি হলেও এগজ্যাক্টলি এমনিই করত।
দোলা কিছু না বলে তিলকের থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরে বসল। এক্ষুনি এ. আর. অর্থাৎ অশেষ রায়ের ক্লাস শুরু হবে। এসেই আগে উনি ডিসিপ্লিন সম্পর্কে একটি বক্তৃতা দেবেন। ছেলেরা বলে উনি অশেষ না আরও কিছু, উনি হলেন শেষন। নিজেও শেষ হবেন, আমাদের সবাইকেও পণ্ডিত বানাতে না পেরে শেষ করে দেবেন।
অমৃতার সঙ্গে দোলার বেশিদিনের বন্ধুত্ব নয়। বি.এ. ক্লাসেই। যাতায়াতের রুট এক হলে এইরকম বন্ধুত্ব কারও কারও সঙ্গে হয়ে যায়। তখন অমৃতারা থাকত রমণী চ্যাটার্জি স্ট্রিটে, দোলারা থাকত হিন্দুস্থান রোডে। এত কাছে থাকত অথচ কলেজে পড়তে যাবার আগে ওদের ভাব ছিল না। দোলার খুব ভাল লাগত অমৃতাকে রাস্তাঘাটে দেখে। হয়তো একটা শাড়ির দোকানে ঢুকল, কিংবা রাস্তা পার হচ্ছে। অনেক সময়েই ওর সঙ্গে ওর মাকেও দেখেছে। পোর্সিলেনের মতো রং মাসির। চোখ-মুখ-নাক খুব সুন্দর, বোঝাই যায় এক সময়ে খুব সুন্দরী ছিলেন, তবু ওঁকে ছেড়ে অমৃতার দিকেই চলে যেত চোখ। সুশ্রী তো বটেই, কিন্তু ভারী মিষ্টি। পুতুলের মতো মিষ্টি নয় কিন্তু। ওর চোখের চাওয়ায়, ঠোঁটের হাসিতে মিষ্টত্বের সঙ্গে একটা ব্যক্তিত্ব ছিল, যে ব্যক্তিত্বটা অত সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও ওর মায়ের ছিল না। অমৃতাকে হয়তো ওই ব্যক্তিত্বের জন্যই দূরের মানুষ দূরের মানুষ লাগত। হয়তো বা একটু উন্নাসিক। অন্তত দোলা তো কোনওদিনই যেচে ভাব করতে যায়নি।
আশ্চর্য! দুজনে যখন একসঙ্গে এক কলেজের ক্লাসে মুখোমুখি হয়ে গেল, তখন অমৃতাই জিজ্ঞেস করেছিল—তুমি গড়িয়াহাটের আশেপাশে কোথাও থাকে না?
—তুমিও তো কাছাকাছিই, আমি তোমাকে দূর থেকে দেখেছি।
অমৃতাটা খুব ফাজিল ছিল, বলেছিল—আমি কিন্তু তোমাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, বন্ধুদের নিয়ে ফুচকা খেয়েই যাচ্ছ, খেয়েই যাচ্ছ, ঝালমুড়ি খেয়েই যাচ্ছ, আইসক্রিম খেতে খেতে বেরোচ্ছ, রোল কিনে গলির দিকে গেলে। তোমার রোজ কত টাকার ফুচকা লাগে?
দোলা হেসে ফেলে বলেছিল—আজ প্রথম দিন বলে কিন্তু কিছু মনে করছি না। পরে ফুচকা তুলে কথা বললে আড়ি হয়ে যাবে।
অমৃতার সঙ্গে ভাব হওয়ায় দোলার এত ভাল লেগেছিল। যেন কোনও দূর গ্রহের সঙ্গে নিজের কক্ষপথে দেখা হয়ে যাওয়া। গ্রহ কিংবা নক্ষত্র। তার পর মেলামেশা করতে করতে সেই গ্রহত্ব নক্ষত্রত্ব কেমন আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যায়। কেন অমৃতার ওইরকম ব্যক্তিত্ব, অনেক টাকা বা অনেক বুদ্ধি থেকে নয়, মা চিররুগ্ণ বলে, মায়ের মা হয়ে থাকতে হয় বলে, এ সব দোলা ধীরে ধীরে বুঝেছে। আসলে ফার্স্ট ইমপ্রেশনটা বা ওপর-ওপর দেখাটা কিছু না। একটা মানুষের সামান্য একটু ভেতরে ঢুকলেই বোঝা যায়, সে কে, সে কী এবং কেন। অমৃতা দোলাকে কোনওদিন লক্ষ করেছে বলে দোলার মনে হয়নি, অথচ দেখো, ও দোলার সম্পর্কে দোলার চেয়ে বেশি জানত। জানত দোলা খুব আদুরে, জানত দোলা অনেক বন্ধুর সঙ্গে ঘোরাফেরা, হইচই করতে ভালোবাসে। কিন্তু দোলার মধ্যে যে একটা ভাবুক দোলা, কাঙাল দোলা বসে আছে, অমৃতার বন্ধুত্বের জন্য কাঙাল, তা সে কোনও দিনও বোঝেনি।
বন্ধুত্ব এমন একটা জিনিস যার মধ্যে আবার অন্যান্য আবেগ অনুভূতির কিছু কিছু মাত্রাও থেকে যায়। কখনও থাকে করুণা, কখনও থাকে শ্রদ্ধা, কিন্তু প্রায় সব সময়েই থাকে আস্থা, নির্ভরতা। এটা যদি না থাকে, তাহলে বুঝতে হবে সেটা বন্ধুত্ব নয়, খালি সঙ্গীত্ব। কিছুক্ষণের সঙ্গ দেওয়া নেওয়া।
অমৃতার সঙ্গে দোলার যে বন্ধুত্ব তার মধ্যে দোলার মনোভাবে খানিকটা শ্রদ্ধা সন্ত্রম আছেই। অমৃতা দোলার মতে দোলার চেয়ে সুন্দর, লেখাপড়ায় ভাল, কেমন একটা ধৈর্য একটা রোখ আছে তার জীবনযাপনে। তারও চেয়ে বেশি যেটা আছে সেটা হল ব্যক্তিত্ব। এটা হয়তো ওই রোখ, ওই ধৈর্য থেকেই আসে। আরেকটা কথা, অমৃতা নিজের কথা একদম বলে না। বলার অভ্যাসই নেই। তবে অন্যের কথা শোনে মন দিয়ে। অন্যের সমস্যার সমাধান করতে ওর কোনও আলস্য নেই। দোলা ওদিকে বক্তিয়ার, কোনও কথা পেটে রাখতে পারে না, যদি কারও ওপর রাগ বা অভিমান হয়, যেমন বন্ধুদের মধ্যে হয়েই থাকে, তাহলে দুদিন বড় জোর অপেক্ষা করবে তারপর নিজেই ওপর-পড়া হয়ে বলবে—এই জানিস আমার না তোর ওপর ভী-ষণ রাগ হয়েছে। কেন রাগ, কখন থেকে রাগ, রাগের মাত্রা কতটা এ সব নিয়েও সে রীতিমতো একটা বক্তৃতা দেবে, তারপরে বলবে—কী, এত কথা বললাম, আমার কাছে ক্ষমা চাইলি না? চা, ক্ষমা চা, সরি বল।
দোলা এমনই।
শেষনের ক্লাস হয়ে গেল, প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ পি.এম.-এর ক্লাস হয়ে গেল। তারপর একটা ক্লাস বিরাম। কাকে বলবে দোলা? তিলকের তো ওই ধরনের ফিচেল-ফাজিল প্রতিক্রিয়া।
লাবণির পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগল সে। —এই লাবণি, লাবণি, একটু দাঁড়া। প্লিজ।
—কেন রে? আমি কমনরুমে যাচ্ছি, অনেকক্ষণ থেকে টয়লেট পেয়েছে।
—তা চল। কিন্তু রাস্তার দিকের বারান্দাটায় আমি দাঁড়িয়ে আছি, টয়লেট সেরে আসিস একবার। ভী-ষণ দরকার আছে।
লাবণি আসতে যতটা পারে খুলে বলল কথাগুলো দোলা।
লাবণি বলল—দ্যাখ শ্বশুরবাড়ি-টাড়ির অনেক কমপ্লিকেশন থাকে, চাপা গলায় ‘এবার রাখো’টা তুই ঠিক শুনেছিস?
—সেটা তো ঠিক শুনেছিই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি মিস্টিরিয়াস হল অমৃতার কথাবার্তা।
—কথাবার্তা মোটেই মিস্টিরিয়াস নয়, লাবণি বলল, বোঝাই যাচ্ছে সামনে এমন কেউ দাঁড়িয়ে আছে যার সামনে ও মুখ খুলতে পারছে না।
—কিন্তু মাসিকে ওই রং নাম্বার বলে ফোন নামিয়ে রাখা!
—মাসি ঠিক নাম্বার ঘুরিয়েছিলেন কি না দ্যাখ। ও রকম অনেক সময়ে নার্ভাস হয়ে গেলে হয়। আর অমৃতার মা তো নার্ভাস থার্টি।
—তা হলে তুই বলছিস ভাবনার কিছু নেই?
—না, তা কিন্তু বলিনি। আচ্ছা ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কেমন কিছু জানিস?
—টিপিক্যাল বাঙাল। বউ আসতেই রান্নাঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
—এই খবর্দার বাঙাল বলবি না। আমি বাঙাল তা জানিস?
—তোদের নিয়মকানুন তা হলে তুই-ই ভাল বলতে পারবি। যে বউ য়ুনিভার্সিটিতে পড়ে, তাকে দিয়ে সকালে বিকেলে সব রান্না করানো এটা আমাদের ঘটিদের মধ্যে স্বাভাবিক নয়। চলে না।
লাবণি বলল—আমার তো দুই মাসতুতো বউদি আছে। খোদ শ্যামবাজারের। দুজনেই বেরোয়। রান্নার লোক আছে, তবে বউদিরাও ছোটখাটো ব্যাপারে যেমন চা-ফা করা বা লোক এলে ভাল কিছু এ সব করে। তাই বলে পুরো রান্না…
—তোরা মডার্ন। তা ছাড়া কোনকালে পিওর বাঙাল ছিলি রে? ওর শ্বশুরবাড়ি বোঝাই যাচ্ছে সেকেলে। দোলা বলল।
—তা ওঁরা কি চান না ও পড়াশোনা করুক!
—সেটা ভাই আমি জানি না। অমৃতা কোনওদিন বলেনি। যাবি?
লাবণি বলল—সেটা কি ঠিক হবে? চিনি না জানি না…
দোলা বলল—আহা, অমৃতা কেন যাচ্ছে না সে খবর নিতে যেতে পারি না! চল লাবণি প্লিজ।
পরের ক্লাসটা ওরা আর করল না। যদিও জয়িতা বাগচির ক্লাস। পাতাল রেল ধরল দুজনে, কালীঘাট স্টেশনে নেমে একটা যাদবপুরগামী বাস পেয়ে গেল। লাবণি এখনও বলে যাচ্ছে—লোকেদের শ্বশুরবাড়ি। যাই বলিস, আমার যেতে কেমন-কেমন লাগছে।
ধৈর্য রাখতে পারে না দোলা, ঝাঁঝিয়ে ওঠে—ঠিক আছে, যা, তুই নেমে যা।
—নেমে গিয়ে করবটা কী? বাড়ি কতদূর বল তো!
—তাড়াতাড়ি নেমে গেলে তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারবি।
লাবণি গোমড়ামুখে বলল—অকওয়ার্ড সিচুয়েশন আসলে আমার খুব বাজে লাগে। তাই বলছিলাম। অমৃতার জন্যে দুশ্চিন্তা আমারও কিছু কম হচ্ছে না।
তবে সব সমস্যারই সমাধান হয়ে গেল। ওরা ঠিকানা খুঁজে খুঁজে গিয়ে দেখল 4/1/A, সেন্ট্রাল পার্কের এক নম্বর ফ্ল্যাটে তালা মারা। কোল্যাপসিব্লটা এমন করে বন্ধ, এমন করে তাতে সাত লিভারের বড়সড় একটা তালা লাগানো যেন কোনওদিন কেউ ওখানে ছিল না। ও বাড়ি বহুদিন খালি পড়ে আছে, বিক্রি হয়ে যাবে এবার।
অমৃতাদেরটা একতলার ফ্ল্যাট, দোতলায় ওঠবার সিঁড়িটা পাশ দিয়ে চলে গেছে।
লাবণি হঠাৎ বলল—চল না, দোতলার ফ্ল্যাট-ট্যাটে জিজ্ঞেস করি।
দোলার ভীষণ দুর্ভাবনা হচ্ছিল, সে বলল—হঠাৎ এত স্মার্ট হয়ে গেলি যে!
উত্তর দিল না লাবণি—দোতলায় উঠতে থাকল। বাড়িটা ছোট। তিন তলায় তিনটে ফ্ল্যাট।
দোতলার ফ্ল্যাটে গিয়ে বেল টিপল ওরা। এক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন।
—কে আপনারা?
—আমরা নীচের ফ্ল্যাটের অমৃতা মানে ওঁদের বাড়ির বউয়ের বন্ধু। ওর কাছে এসেছিলাম, দেখছি তালা মারা। আপনারা যদি কেউ কিছু জানেন।
—তালা মারা? সকালেও তো ভদ্রলোককে বাজার বেরোতে দেখেছি। তবে, কিছু মনে করো না ভাই, তোমাদের তুমিই বলছি, ওঁরা যেন কেমন। কারও সঙ্গে মেশেন না। বউটিকেও মিশতে দ্যান না। প্রতিবেশীর সঙ্গে তো প্রতিবেশীর স্বার্থের খাতিরেই একটু মেলামেশা করতে হয়। ওঁরা সেটুকুও করেন না। এসো না ভেতরে, বসো।
দোলা লাবণির দিকে তাকাল। লাবণি দোলার দিকে। এক পা এক পা করে এগোল, সোফার দিকে তাকিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন–বসো, বসো না। তোমরা মেয়েটির বন্ধু! মেয়েটিকে কিন্তু ভাল বলেই মনে হয়। একদিন আমি বেরোচ্ছি, ও-ও বেরোচ্ছে। বলল—বউদি, আপনাকে তো বেরোতে দেখি না!
—আমি বললাম—আজ একটু ব্যাঙ্কে যাবার আছে ভাই। এই পর্যন্ত বলেছি, দরজার ভেতর থেকে ওর শ্বশুরই বোধহয় ডাকলেন, অমৃতা অমৃতা, একটা কথা শুনে যাও। অবভিয়াস আমার সঙ্গে কথা বলতে দেবেন না।
—আশ্চর্য তো! দোলা বলল।
লাবণি বলল—উনি কথা বলতে না দেবার কে? উনি না বললেন আর অমৃতাও শুনে গেল? এত ভিতু মেয়ে তো আমাদের বন্ধু নয়? কেন, আপনাদের সঙ্গে ওঁদের কি কিছু নিয়ে কোনও মনোমালিন্য…
—আরে আলাপ হবে সম্পর্ক হবে তবে তো মনোমালিন্য। আচ্ছা, আমাদের না হয় ওঁরা পছন্দ করেন না, কিন্তু তিনতলা? তিনতলার ফ্ল্যাটের সঙ্গেও ওঁদের কোনও সম্পর্ক নেই। আশপাশের কারও সঙ্গে আছে বলেও জানি না। বউটি, মানে তোমাদের বন্ধু কিন্তু ভাল। দেখো, হয় তো সবাই মিলে কোথাও বেরিয়েছে, তাই তালা। সবাই-ই তো কোল্যাপসিব্ল টেনে তালা দিয়েই বেরোয়।
ভদ্রমহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওরা বেরিয়ে এল। একতলায় নেমে লাবণি আবার জানলা-টানলা দিয়ে একটু উঁকি মারার চেষ্টা করল, জানলাগুলো ভেতর থেকে বন্ধ। খুব স্পষ্ট যে ভেতরে কেউ নেই।
রাস্তাটা পেরিয়ে একটা পুকুরের ধার পর্যন্ত ওরা এসেছে। একটি ছেলে হঠাৎ উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। বছর পনেরো ষোলো হবে বোধহয়, সবে গোঁফ গজিয়েছে। একটা টি শার্ট আর পায়জামা পরা।
ছেলেটা অমনি উর্ধ্বশ্বাসে বলে গেল—অমৃতা বউদির খুব শরীর খারাপ, কোনও হাসপাতাল-টাতালে নিয়ে গেছে। যখন নিয়ে গেল খুব সম্ভব অজ্ঞান মতো ছিল, একটা শাদা অ্যামবাসাডর। অরিদার অফিসের গাড়ি। কিন্তু ব্যাপারটা ভাল নয়।
বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করছে, দোলা বলল—কী হয়েছে অমৃতার? দিন তিনেক য়ুনিভার্সিটি যায়নি। কিন্তু আজ সকালে আমার সঙ্গে কথা বলল, তখনও তো কোনও শরীর খারাপের কথা বলেনি! তুমি কে?
—আমি সীজার, ওদেরই তিনতলায় থাকি। হেয়ার স্কুলে পড়ি তো, একসঙ্গে যাতায়াত করি। সেই থেকে ভাব হয়ে গেছে খুব। আমি জানি বউদির শরীর খারাপ। কোনও মেয়েলি ব্যাপার, তাই আমাকে বলতে পারেনি।
ছেলেটি একটু লাল হয়ে মুখ নিচু করল। তারপর বলে উঠল—আপনারা প্লিজ ওর বাবা-মাকে খবর দিন।
বিমূঢ়ের মতো খানিকটা হেঁটে লাবণি ডাকল—এই সীজার, সীজার, শোনো-ও।
অনেকটা রাস্তা চলে গিয়েছিল ও, রাস্তার কোনও চলতি লোক ওদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ও আবার ছুটে এল। লাবণি বলল—তোমার, মানে তোমাদের ফোন নম্বরটা দাও।
—ফোর টু-ফাইভ টু থ্রি সেভেন ওয়ান।
—তোমাকে ডাকলে বাড়ির সবাই ডেকে দেবেন তো?
—হ্যাঁ, আপনি…
—আমার নাম লাবণি দে, থাকি গোয়াবাগানে। ফোন নম্বরটা মনে রাখা খুব সোজা। ট্রিপ্ল্ ফাইভ-ওয়ান টু ফোর থ্রি। কোনও খবর থাকলে আমাকে জানিও। একটু নজর রাখবে বাড়িটার দিকে।
—সে তো রাখবই—দোলার দিকে ফিরল ছেলেটি, আপনারটাও দিয়ে দিন।
—দোলা রায়, ফোন ফোর সিক্স ফোর নাইন ওয়ান নাইন ওয়ান।
—আপনি তো তাহলে কাছেই থাকেন! ঠিকানাটা বলবেন?
দোলা ঠিকানা বলল।
সীজার বলল, ঠিক আছে। আমি এদিকে কোনও কিছু হলে জানাব।
—কোনও কিছু হলে মানে?
—কেন? আপনারা কাগজ পড়েন না? বধূ হত্যা টত্যা…
—তুমি বলছ কি? —দোলা শিউরে উঠে বলল, তার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।
লাবণি বলল—এ কথা তোমার কী করে, কেন মনে হল সীজার?
—কী জানি! মনে হল! বউদির এত সুন্দর চেহারা ছিল, কী রোগা হয়ে গেছে, ওকে দিয়ে বাড়ির সমস্ত কাজ করায়। আমি জানি। খেতে দেয় না।
—কী করে জানলে? ও তোমাকে বলেছে?
—কিছুই বলেনি। একদিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম—বউদি, ডায়েটিং করছ না কি? বিউটি-কম্পিটিশনে নাম দেবে? তাইতে ও হেসে বলল—অনেকে ডায়েটিং করে, অনেককে কপাল করায় বুঝলি? তখন কথাটা সিরিয়াসলি নিইনি। এখন মনে হয়েছে। এই ক’দিনই মনে হচ্ছিল।