অমৃতা (Amtrita) – ১৮
পরের দিন যখন সে এসপ্লানেডে এসে পাতাল রেল ধরল, তার মনে হচ্ছিল সে যাচ্ছে এক দুঃসাহসিক অভিযানে। কতদিন পরে দেখবে অমৃতাকে। অমৃতার প্রতি যে তার বিশেষ কোনও টান আছে তা নয়। আজকাল সমপাঠিনীরা সমপাঠীদের বিশেষ পাত্তা দেয় না। খুব চালাক-চতুর হিসেবি হয়ে গেছে মেয়েগুলো। আগে কত শোনা যেত ক্লাস-বন্ধুদের রোমান্টিক প্রেম, রোমাঞ্চকর বিয়ে। ধুস্স্। মেয়েরা দেবে বাংলার অর্ডিনারি ছেলেকে পাত্তা? ওদের সঙ্গে সম্পর্ক বিশুদ্ধ বন্ধুত্বের, বন্ধুত্বও নয়, ক্লাস-বন্ধুত্বের। ওই একটু ক্যান্টিন কি কফিহাউজে হইচই। নোট্স আর বই দেওয়া নেওয়া, লাইব্রেরিতে চেইন-সিস্টেম তৈরি করে রাখা। শর্মিষ্ঠা ফেরত দিলে দোলা নেবে, দোলা ফেরত দিলে তিলক নেবে, তিলক ফেরত দিলে চঞ্চল। এইরকম। এক বেঞ্চে পাশাপাশি বসে সেন্টের গন্ধ পায় ছেলেরা, কিন্তু কোনও রকম সেন্টু দেওয়ার ধারকাছ দিয়ে যায় না। অমৃতা আবার তার ওপর বিবাহিত মেয়ে। কিন্তু তিলকের এটা বরাবরই মনে হয়েছে অমৃতা একটু আলাদা। বড্ড যেন ঋজু, মেয়েলিপনা কম, বড্ড বেশি ওর আত্মবিশ্বাস, পরীক্ষার ফলাফলে ওর হেলদোল সবার থেকে কম। অথচ ওরা সবাই জানে, অমৃতাও ওদেরই মতো একটা কেরিয়ার চায়। প্রয়োজন অনুভব করে। এম.এ. পার্ট ওয়ানে শর্মিষ্ঠার ফার্স্ট ক্লাস এসেছিল, তিলক এগারো নম্বর কম পায়, অমৃতা মিস্ করে মোটে তিন নম্বরের জন্যে। হেলায় বলে দিল পার্ট টু-তে মেক-আপ দেবার চেষ্টা করব। দেব নয়, চেষ্টা করব।
—তোর আফসোস হচ্ছে না? দোলা জিজ্ঞেস করে।
—দূর! আফসোস করে হবেটা কী? ফিরবে আর রেজাল্টটা?
দোলা পঞ্চান্ন পার্সেন্টও রাখতে পারেনি। কেঁদে কেটে একসা করছিল। অমৃতা ওকে প্রায় ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়।
—করছিস কী দোলা, তুই কি এখনও স্কুলের ছাত্রী? খালি ক্যাসেট বাজিয়ে আর লেট-নাইট মুভি দেখে সময় কাটাবি, আর রেজাল্ট বেরলেই কাঁদবি?
—বেশ, আমি নষ্ট করি আমার সময়, তোরটা তো আর করি না! তোর কেন এক্সপেক্টেড রেজাল্ট এল না? তুই কী করছিলি?
—আমি? আমি এই রেজাল্টই আশা করিনি। আর আমার সময় কী করে কাটে একদিন তোকে তার হিসেব দিয়েছিলাম, হারিয়ে ফেলেছিস হিসেবের খাতাটা?
এরপর দোলা চুপ করে গিয়েছিল। তিলক বলেছিল—ঠিক আছে তুই আশাতীত রেজাল্ট করেছিস। সময় পাস না পড়বার। তো তোর পেপারে পেপারে এত তফাত কেন?
—যেটা ভাল লাগে না সেটা আসলে আমি পড়তে পারি না। যা হোক করে সেরে দিই। বোধহয় এই জন্যেই…
—জানিস যদি তো চেষ্টাটা ঠিকভাবে করলেই পারিস!
—দূর। যেটা ভাল লাগে সেটাই পড়ে শেষ করতে পারি না!
সেই অদ্ভূত মেয়ে অমৃতার আস্তানায় সে যাচ্ছে আজ। যথাসম্ভব গোপনতা অবলম্বন করে। কাউকে বলতে বারণ করে দিয়েছেন জয়িতাদি।
তখন বিকেল বেশ গাঢ় হয়ে উঠছে। বর্ষার গুমোট ভেঙে একটা মেঘলা হাওয়া দিচ্ছে। কালীঘাট স্টেশনে নেমে সে গড়িয়াহাটের অটো নিল একটা। মোড়ের আগে নেমে পড়ল। এইবার খুঁজতে হবে রাস্তাটা। এমন সময়ে সে দোলাকে দেখল। দোলা একটা ট্যাক্সি থেকে নামল। ট্যাক্সিটা তার পাশ দিয়েই বেরিয়ে গেল। ভেতর থেকে একটি যুবক মুখ বার করে হাত নাড়ছে তখনও দোলার দিকে তাকিয়ে। দোলাও দাঁড়িয়ে পড়েছে। আজ ও ক্লাসে আসেনি। এইরকম কামাই করে প্রায়ই। তিলক প্রায় চেঁচিয়ে ডাকতে যাচ্ছিল—দোলা! এই দোলা! হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল তার অভিযানের গোপনতার কথা। সে সুট করে বাসন্তীদেবী কলেজের দেওয়ালে সেঁটে গেল, দোলা কেমন দুলতে দুলতেই রাস্তা পার হল। ওদিকে গিয়ে বোধহয় বাস ধরবে কসবার। অটো-ফটোও ধরতে পারে। কে জানে কোথা থেকে কোথায় অটো চলে এদিকে। ছেলেটা কে? বেশ মডেল মডেল দেখতে। স্টাইলিশ। ট্যাক্সিতে এখানে দোলাকে নামিয়ে দিয়ে মডেল কেন হুশ্ হয়ে যায়? দোলার বয়ফ্রেন্ড না কি? ক্লাস কেটে এর সঙ্গে ঘুরছে দোল দোল দুলুনি! ঘোর বাবা ঘোর। তোরাই ঘোর। বড়লোকের মেয়ে, ব্যাগ-ভর্তি পয়সা-টাকা ঝনঝনিয়ে আসিস। প্রায়ই খাওয়াস ক্লাস-বন্ধুদের। কেরিয়ারের ভাবনা নেই। মডেল বয়ফ্রেন্ডও নিশ্চয় চাকরি-বাকরি ভালই জুটিয়েছে। জীবনের যা কিছু মজা তোরাই লুঠে নে রে দোলা। তিলকদের জন্যে আছে খালি বাবার প্রাণপণ উপার্জনের পাঁচশো টাকা মাস-মাস খরচ। আবার তিনশো টাকা দিয়ে অন্যের নোট্স চুরি।
বাড়িটা খুঁজে পেতে বেশ সময় লাগল। একটা রাস্তা আরেকটা রাস্তার সঙ্গে কাটাকুটি খেলছে এখানে বারবার। এদিকে যাবে? না ওদিকে? এদিকটাও ডোভার লেন। ওদিকটাও ডোভার লেন। লোককে এদিক ওদিক জিজ্ঞেস করতে করতে সঠিক ঠিকানায় এসে যাবার পর বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তিলক কুলকুল করে ঘামতে লাগল। এই সবুজ দরজা তো শুধু একটা দরজা নয়, একটা রহস্যের ঢাকনা। মিসেস শিবানী দত্ত। কে ইনি? অমৃতার বাড়ি সল্টলেক করুণাময়ীতে। সেখানে থাকছে না অমৃতা। ওই শিবানী দত্ত কি ওর মাসি-পিসি জাতীয় কেউ হবেন? ওরা গোস্বামী মানে ব্রাহ্মণ। তবে কি আর ব্রাহ্মণদের কায়স্থ মাসি-পিসি হয় না? হতেই পারে। সে বেল টিপল। হাতটা বেশ কেঁপে গেল। একটু পরে দরজা খুলে গেল।
—কাকে চাই?
—মিসেস শিবানী দত্তর সঙ্গে একটু দেখা করব।
এই সময়ে ভেতরের কোনও ঘরে শাঁখ বেজে উঠল।
—ভেতরে আসুন।
যে ঘরটাতে বসতে দিল মেয়েটি সেটা একটা বৈঠকখানা ঘর। কিন্তু সোফাগুলোর ওপর ডাস্ট-কভার পরানো। বোঝাই যায় খুব বেশি বাইরের লোকের আনাগোনা নেই এখানে। কেমন একটা ধুলো-ধুলো গন্ধ। বদ্ধ ঘরের আবহাওয়াটা। মেয়েটি সুইচ টিপে দিতেই টিউববাতি উলঙ্গভাবে আছড়ে পড়ল আধময়লা ঘরটার ওপর। পাখা চলতে ক্লিক-চিক করে একটা শব্দ হতে লাগল, ক্যানোপিটাতে লাগছে বোধহয়। একটু পরে এক দোহারা চেহারার ভদ্রমহিলা ঢুকলেন। কালো নকশা-পাড় শাড়ি পরা। কালো ব্লাউজ, বেশ ফিটফাট।
—তুমি…তোমাকে তো…
—আমার নাম তিলক মজুমদার। আমি অমৃতার য়ুনিভার্সিটির বন্ধু।
—অমৃতা? কে অমৃতা?
একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও তিলক বলল—জয়িতাদি মানে প্রোফেসর জয়িতা বাগচি আমার হাতে কিছু নোট্স পাঠিয়েছেন অমৃতার জন্য। আমি জানি এ ব্যাপারটা গোপন রাখতে হবে। জয়িতাদি বিশ্বাস করে আমাকে দিয়েছেন।
—বসো একটু। উনি চলে গেলেন।
একটু পরে কাজের মেয়েটি এসে তাকে ওপরে যেতে বলল। উঠোনের ওপাশে ঢাকা দালানের মাঝ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে। মেয়েটি সিঁড়িটা দেখিয়ে দিয়েই চলে গেল।
সিঁড়ির ঠিক মাথায় অমৃতা দাঁড়িয়েছিল। তিলক বিস্ময়ে, ধাক্কায় আর একটু হলেই পড়ে যাচ্ছিল। অমৃতার বুকের তলা থেকে উঁচু হয়ে উঠেছে পেট। তাকে এত অন্যরকম দেখাচ্ছে যে তিলকের প্রথম ধাক্কায় চিনতে অসুবিধে হয়েছিল। খুব তাড়াতাড়ি তার মনে পড়ল জয়িতাদির চিঠিতে অন্তঃসত্ত্বা কথাটা। কেমন লাল হয়ে যাচ্ছিল সে।
—তিলক! তি-লক! তুই এসেছিস? ওঃ আমার কী যে ভাল লাগছে। একেবারে অন্যরকম।
তিলককে প্রায় হাত ধরে একটা ঘরে নিয়ে গেল অমৃতা। একদিকে তার পড়ার টেবিল। স্তূপীকৃত বই আর খাতা। সব গোছানো৷ চেয়ারের পিঠে একটা তোয়ালে ঝুলছে। একদিকে একটা ডিভান। বড় বড় জানলা দিয়ে হাওয়া আসছে। পর্দা উড়িয়ে।
তিলক বলল—এই নে, জয়িতাদি এই প্যাকেটটা তোকে দিয়েছেন।
—কী আছে রে এতে?
—নোট্স। আমার ধারণা।
—তোরা সব কে কেমন আছিস?
—ভাল। তুই?
—আমি? আমি আছি সেই রূপকথার রাজকন্যার মতো রাক্ষসপুরীতে ঘুমিয়ে। সোনার কাঠি রুপোর কাঠি বদল করে আমায় জাগান যিনি, ‘তিনি অবশ্য কোনও রাজপুত্তুর নন। তিনি আমার শিবানী মাসি। আমার ছোটবেলার বন্ধু সম্পদের মা। যাঁকে তুই নীচে দেখলি।
—তোর বিপদ কেটেছে?
—যতক্ষণ না কেসটা উঠছে, কিছু তো বলা যায় না। ও সব কথা থাক। তোকে দেখে আমার য়ুনিভার্সিটির কথা, কলেজের কথা, ছাত্রজীবনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, সেই অ্যাটমসফিয়ারটা তুই বয়ে নিয়ে এসেছিস।
—তোর ছাত্রজীবন তো চলছে এখনও?
—না রে, আমি যেন কোনও বয়স্ক বিধবা প্রাইভেট পরীক্ষা দিচ্ছি। আমার কোনও বন্ধু ছিল না। সহপাঠী ছিল না। কোনও টিচার আমায় কোনও দিন…
—তুই অজ্ঞাতবাসে আছিস তাই। আমরা প্রত্যেকে তোর জন্যে ভাবি। গেলে দেখবি সেই আগের মতো।
—তোরা তেমনি কফিহাউজে গিয়ে গুলতানি করিস?
—যাই। গুলতানিটা খুব জমে না। তুই নেই তো।
—বাজে কথা বলিস না তিলক। মন-ভোলানো কথা বলছিস এবার।
—সত্যি বলছি। মাঝখান থেকে একজন উবে গেলে একটা ভ্যাকুয়াম তৈরি হয়, হাওয়া সেখানে ঢুকতে পারে না।
—দূর, আমি জানি দোলা খুব খুশি আছে, লাবণি খুব ভাল আছে, শম্পা খুব:..অবশ্য শম্পাকে তো তুই চিনিস না।
—হয়তো। ওদের কথা বলতে পারি না। আমি খুব, আমার খুব বাজে লাগত। অরিন্দমদা আমাদের আশ্বস্ত করলেন তাই…
—কে অরিন্দমদা?
—উনি লাবণির…মানে লাবণির সঙ্গে বিয়ের জন্যে সিঙ্গাপুর থেকে এসেছিলেন।
—আচ্ছা? লালটু ঘোষ? উনি তো প্রায়ই আসেন এখানে।
—সত্যি? আসলে তুই হয়তো জানিস না লাবণি তোর ব্যাপারটার পর খুব ভয় পাচ্ছিল বিয়ে করতে। ওকে আশ্বস্ত করতেই উনি আমাদের নিয়ে ‘উজ্জীবন’-এ ডঃ কার্লেকরের সঙ্গে দেখা করেন। পরে ডঃ কার্লেকর ওঁকে কী বলেছেন জানি না। উনি আমাদের নিশ্চিন্ত থাকতে বলেছেন। তা হলে তোর সঙ্গে ওঁর রেগুলার যোগাযোগ আছে!
—আরে উনিই তো মা-বাবার খবর আমায় এনে দেন। আমার খবর মা-বাবাকে দেন। তোদের খবরও মোটামুটি…
—এ সব কিছু কিন্তু উনি আমাদের বলেননি। শুধু বলেছেন ডঃ কার্লেকর তোর ব্যাপারে সব জানেন। ভয়ের কিছু নেই।
শিবানী মাসি প্রচুর খাওয়ালেন তিলককে।
পরদিন সকাল আন্দাজ সাতটা। তিলকদের ফোন বেজে উঠল। তিলকই ধরেছিল।
—হ্যাললো—
—তিলককে একটু ডেকে দেবেন।
—তিলক বলছি।
—ও, তিলক! আমি অমৃতা। শোন ভাল করে, তুই যা আমায় দিয়ে গেছিস সেগুলো অমূল্য রত্ন। ওগুলো আমি তোর সঙ্গে শেয়ার করতে চাই।
—সে কী? জয়িতাদি ওগুলো দিয়েছেন তোকে। আমি তো জয়িতাদির কাছে বাড়িতে কোচিং নিই। আমাদেরও নিশ্চয় দেবেন।
—দিলে ভাল। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এগুলো স্পেশ্যাল নোট্স। উনি আমাকে বিশেষ ভালবেসে, করুণা করে…
—তবেই দেখ। তোরই জন্যে ওগুলো।
—ঠিক। কিন্তু তুই আমাকে এগুলো অখণ্ড, অমলিন পৌঁছে দিয়েছিস, তোর আর আমার স্পেশ্যাল পেপার এক। শোন, আমি এগুলো জিরক্স করিয়ে নিচ্ছি, দুটো করে কপি। একটা তোর, একটা আমার…
এবার তিলক আর থাকতে পারল না। সে অস্ফুট গলায় বলল—অমৃতা, আমি ওগুলো অল রেডি জিরক্স করে নিয়েছি। জয়িতাদির চিঠিটাও পড়েছি। প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করিস।
ও প্রান্তে নীরবতা। কিন্তু তিলক ফোন ছাড়তে পারছে না। একটু পরে সে আবার বলল—বুঝতে পারছি, আমার অপরাধ ক্ষমার যোগ্য নয়। আমি নোট্স বুঝে ওগুলো দেখবার লোভ সামলাতে পারিনি রে। চিঠিটা তো কোনও খামের মধ্যে ছিল না। খুলতেই সামনে জ্বলজ্বল করে উঠল। সত্যি কথা বলতে কি যতই ভাবছি ততই মনে হচ্ছে, নোট্সগুলো ইউজ করবার ক্ষমতাই আমার নেই। কিন্তু চিঠিটার মর্ম থেকে বোধহয় কিছু শিখতে পারব…
ও পাশ থেকে ঈষৎ রুদ্ধ কণ্ঠ ভেসে এল—আমি তোর মনটা বুঝতে পারছি। কিন্তু…কিন্তু জে.বি. ওটা দেবার মতো বিশ্বাস একমাত্র তোকেই করতে পেরেছিলেন।—অমৃতা ফোনটা রেখে দিল।
সারাদিন ছটফট করতে লাগল তিলক। মা, বাবা, দাদা, সবাই লক্ষ করেছেন।
মা বলল—কী হয়েছে বল তো তোর? কাল বোধহয় সারারাত পড়েছিস। অমন করিস না। অত পড়লে পরীক্ষার সময়ে মাথায় সব গোল পাকিয়ে যাবে।
বাবা বলল—তোর কাছ থেকে অসাধারণ কিছু আশা করে আমরা বসে নেই রে তিলু, তুই নিজেকে বেশি কষ্ট না দিয়ে যতটুকু পারবি, তাতেই হবে।
দাদা বলল—তা ছাড়া কম্পিউটারও তো শিখছিস। কিছু না কিছু একটা হয়ে যাবে। ঘাবড়াচ্ছিস কেন?
সবাইকার কথার মধ্যে বাবার কথাগুলোই সবচেয়ে বিঁধল তিলককে। তার কাছ থেকে অসাধারণ কিছু আশা করেন না? কেনই বা আশা করবেন? একটা অর্ডিনারি ছেলের থেকে বেশি কী-ই বা সে? দাদা বেটার। কিন্তু, সব বাবা-মাই নিজের ছেলের কাছ থেকে বড় কিছু আশা করে থাকেন। তার বেলায় সে আশাটুকুও নেই বাবার?
দাদাই বা কী? কিছু না কিছু একটা হয়ে যাবে? দাদা স্ট্যাটিসটিক্স নিয়ে পড়াশোনা করে ভাল রেজাল্ট করে আই এস আই-তে যোগ দিয়েছে। মাইনে-কড়ি ভাল। তার চেয়েও ভাল তার খাতির। দাদার বিয়ের সময়ে ঘটা করে পাত্রী দেখা হবে। প্রকৃত গৌরবর্ণা, উচ্চশিক্ষিতা ইত্যাদি ইত্যাদি। তার বেলায় জুটবে একটা খেঁদি-পেঁচি। কেউ তার জন্যে তার চেয়ে বেশি আশা করে না তো!
য়ুনিভার্সিটি যাবার ইচ্ছে ছিল না তার। যাই হোক। কম ক্লাস, এবং জে.বি.-র ক্লাস নেই। সে আড়াইটের সময়ে বাড়ি ফিরে এল। তারপর তিনটে সওয়া তিনটেয় একটা ঝোলা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ক্লাসে দোলা এসেছিল আজ। প্রথমটা সে লক্ষই করেনি। পরে হঠাৎ দোলা সামনে দিয়ে যেতে সে দেখল দোলার মুখ চোখ কেমন বসে গেছে। রোগা হয়ে গেছে খানিকটা। কালোও।
সে কয়েকটা কথা ছুড়ে মারল দোলার দিকে—কী রে? খুব প্যার মারছিস?
দোলা চমকে ফিরে তাকাল, ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
—ফ্যাকাশে মেরে গেলি কেন? ভাল তো? প্রেম-ট্রেম তো খুব স্বাস্থ্যকর জিনিস, যে বয়সের যা!
—এ ভাবে বলার মানে?—দোলার গলায় রাগ।
—কী আশ্চর্য! দেখলাম মডেল-বাহার এক ছোকরার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিস! বলব না?
—আমার গার্জেন না কি তুই?
—কখনওই না। তোর বন্ধু, সখা। প্রাণসখা নই অবিশ্যি। তা জোটালি কোত্থেকে?
দোলা এবার খেপে গেল—ইয়ার্কি মারিসনি তিলক, ভাল হবে না।
—ভাল তো আমার এমনিতেও হবে না। অমনিতেও হবে না। ইয়ার্কিই তো সম্বল। তো বাড়িতে নুকিয়ে নুকিয়ে, ক্লাস কেটে প্রেম পরীক্ষার মুখোমুখি! খারাপ হলে আবার কাঁদিসনি—ভেউ ভেউ ভেউ।
তিলক সেখান থেকে তাড়াতাড়ি সরে গেল। লাবণি আর শর্মিষ্ঠা আসছে। পেছনে চঞ্চল। এক্ষুনি বলবে—কী হয়েছে রে দোলা? তখন তিলকের চেয়ে দোলাই বেশি অপ্রস্তুতে পড়বে।
এখন ডোভার লেনের ঠিকানাটা পরিষ্কার চেনা হয়ে গেছে তার। সে নেমে, একটা দোকানে একটা চিকেন রোল খেল। আর একটা মুড়ে নিল পলিথিন ব্যাগে।
চারটে বেজে গেছে। আশা করা যায় অমৃতার বিশ্রাম হয়ে গেছে। সে বেল বাজাল। শিবানী দত্ত দরজা খুললেন। সে প্যাকেটটা ওঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল—এটা অমৃতাকে দিয়ে দেবেন।—তারপর পলিথিন প্যাকেটে রোলটাও এগিয়ে দিল—এটাও। মানে আমি খেলাম তো…তাই…।
—চলে যাচ্ছ কেন? বা রে ছেলে। এতটা পথ এসে মাসির বাড়ির দোরগোড়ায় ঢুকবার আগেই খেয়ে এসেছ, আবার চলে যাওয়া হচ্ছে!
—একটু তাড়া আছে আজকে মাসিমা।
—ও সব আমি শুনছি না। ওপরে যাও। তোমার প্যাকেট, রোল সব যার জিনিস তাকে দিয়ে দাও। আমি পারব না।
খুব চালাক মহিলা। একটা জিনিসও হাত দিয়ে ছোঁননি। —এসো। এসো বলছি!
অগত্যা, ভেতরে ঢুকতে হয়। ওপরে উঠতেও হয়, অমৃতা ডিভানে শুয়ে ছিল। তাকে দেখে উঠে বসে বলল—ওমা তুই! আয়! আয়!
—বসব না রে, কাজ আছে, তুই এই প্যাকেটটা রাখ, আর এই রোলটা খা।
রোলটা হাত বাড়িয়ে নিল অমৃতা। প্যাকেটটা নিল না। বলল—তোর?
—আমি খেয়ে ঢুকেছি।
—শিবানী মাসির বাড়ি কক্ষনো খেয়ে ঢুকবি না, উনি রেগে যাবেন।
—কে কীসে রেগে যায় আমি কেমন করে জানব বল।
রোলে একটা কামড় দিল অমৃতা।
—আ-হ৷ কদ্দিন পরে খেলাম। অমৃত, একেবারে অমৃত।
—ভাল লাগছে?
—বলছি তো—অমৃত। আমার এখন নিমপাতাও ভাল লাগে। সে জায়গায় এ তো চিকেন রোল।— তা ওটা কী?
—একটা প্যাকেট!
—আবারও প্যাকেট? এবার কে দিলেন। এ. আর.? সব্বাইকে আমার খোঁজখবর দিয়ে দিয়েছিস, না কী?
তিলক বলল—আমার একটু তাড়া আছে। চলি। পরে খুলে দেখিস।
হাত বাড়িয়ে তাকে খপ করে ধরল অমৃতা।—যাবি কোথায়?
—প্যাকেট খুলে আগে দেখব কী আছে এতে, তবে। যদি আর ডি এক্স থাকে? তিলক হাসল না। বসলও না। দাঁড়িয়েই রইল।
অমৃতা খুলে দেখল ফটোকপিগুলো।
তার দিকে তাকিয়ে বলল—খুব রাগ করেছিস?
—না, না। রাগ করব কেন?
—তবে? অভিমান? লজ্জা? অপমান? অনাদর? ক্ষোভ? অনুতাপ?
তিলক কিছুই বলল না।
—সবগুলোই, না রে? জয়িতাদি তোদের এই সব নোট্স দেন না কেন রে? কত টাকা ফিজ নেন?
—পাঁচশো।
—পাঁ-চ-শো?
—হ্যাঁ আমি পাঁচশো দিই, অন্য কেউ ছশোও দিতে পারে। সাতশো, আটশোও আছে।
—তবু তোদের নোট্স না দেওয়ার কী মানে?
—আমাদের ক্ষমতা কী যে এ সব নোট ব্যবহার করি। বাড়ি গেলে যত্ন করে পড়ান। দরকার মতো নোট্সও দেন বই কি।
—বোস তিলক, প্লিজ। আমি তোর কাছে মাফ চাইছি।
—আমার কাছে? কেন?
—আগে বোস।
তিলক বসলে সে বলল—আগে বল যা বলব তাতে কিছু মনে করবি না?
তিলক কিছু বলল না।
অমৃতা বলল—কাজটা তুই অনৈতিক করেছিস। আমার বিচারে জয়িতাদিও ন্যায় করেননি। এই যদি ওঁর মনে ছিল, উনি নিজে এসে দিতে পারতেন এগুলো। অবশ্য, দ্যাট ইজ এক্সপেক্টিং টূ মাচ। সেটা উনি পারেননি। একজন ছাত্র যে পাঁচশো টাকা নিয়ে ওঁর কাছে পড়ে, তার হাত দিয়ে তিনি অমূল্য সব নোট্স পাঠালেন এমন একজনের কাছে, যে ওঁকে একটা বাড়তি পয়সাও দেয় না।
—অমৃতা, তোর কেস আলাদা। এটা আমরা বুঝি। তুই দিনের পর দিন ক্লাস করতে পারছিস না, লাইব্রেরি ইউজ করতে পারছিস না…। তা ছাড়া তোর এখন ভাল রেজাল্ট করা দরকার।
—কথাটা তা নয় রে, ছাত্রদের বিশেষত কোচিঙের ছাত্রদের প্রতি টিচারদের দায়বদ্ধতা থাকার কথা। ঠিক আছে, উনি তোদের যা দেন, তা-ই দিতে পারতেন আমাকে। দুরকম করলেন কেন? এটা উনি করেছেন ঝোঁকের মাথায়।
—না, না, উনি তোকে বিশেষ ভালবাসেন। ভালবাসার দানের কোনও বিচার নেই।
—ভালবাসা নয়, করুণা, নিজের ভেতরের পাপবোধ।
—আচ্ছা তাই। কিন্তু উনি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। অমৃতা তোকে উনি নমস্কার পর্যন্ত জানিয়েছেন।
—সেই ইমপালসিভ, নিজের বিবেক দংশনের শাস্তির জন্য নমস্কার আমি গলবস্ত্র হয়ে নিতে পারি না তিলক। কী এমন করেছি আমি? যখন অ্যাবরশন করাতে অরাজি হই, তখন কি জানতাম এ নিয়ে আমার প্রাণসংশয় হবে? ওরা আমার ওপর জবরদস্তি করবে? মেরে ফেলবার চেষ্টা করবে? যদি জানতাম তা হলে অবশ্য পালাতাম। কিন্তু সেটা নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে। আমার মধ্যে যে বেড়ে উঠছে তার জন্যে কোনও বাৎসল্যবোধ থেকে নয়।
—এত বিশ্লেষণ করিস না অমৃতা, জয়িতাদির জন্যে তোর কষ্ট হয় না?
—হয়, হয়। কিন্তু সেটা আলাদা কথা। উনি যেটা করেছিলেন তার মধ্যে ওঁর স্বামীর চাপ ছিল ঠিকই, কিন্তু উনিও ওই বাড়ি, ওই গাড়ি, ওই জীবনযাত্রা, ওঁর প্রথম মেয়ের শিক্ষা ইত্যাদিকে বড় করে দেখেছিলেন। এখন কথা হচ্ছে, এখনকার আইনের চোখে এটা ক্রাইম নয়, কিন্তু নৈতিকতা-মানবিকতার দৃষ্টিতে চিরকালই এটা পাপ থাকবে। সেই মানবিকতা বোধ বিকল করে দিয়েছে জয়িতাদিকে। নিশ্চয় তাঁর জন্য আমি ফীল করছি। কিন্তু আমার সিচুয়েশনের সঙ্গে ওঁরটার কোনও ইকোয়েশন আসে না। কে বলতে পারে সে রকম সিচুয়েশনে আমি কী করব। অরিসূদন বলে লোকটা বা তার বাবা বা মা কেউ সামনে এলে এখন আমি অকাতরে এদের খুন করে ফেলতে পারি। একটা রিভলভার আর কিছু কার্তুজ চাই অবশ্য। ছুরি টুরি মারতে পারব না। তা এটাই কি মানবিক?
—না। ওঁরা তোর চরম ক্ষতি করতে চেয়েছিলেন, কাজেই… এটা স্বাভাবিক।
—না স্বাভাবিক নয়। প্রাণ নেওয়ার অধিকার কারও নেই। আর সত্যিই আমি এটা কথার কথা বলছি না। আই ফীল লাইক কিলিং দা হোল লট অফ দেম। ইন কোল্ড ব্লাড, দেম অ্যান্ড দেয়ার লাইকস। ফার্স্ট আই ওয়ান্ট টু ক্যাসট্রেট দ্যাট ফেলো, অ্যান্ড দেন কিল। যদি না করি, সেটাও কিন্তু অন্যায় হবে। আর সেই অন্যায়টা আমি করব আইন আর সমাজের ভয় থেকে। জয়িতাদির পাপবোধ থেকে একটা মনস্তাত্ত্বিক বিকার এসেছে। সেই বিকার থেকেই এই নমস্কার। আমরা কেউ কারও শ্রদ্ধার যোগ্য নই রে, সবাই পরিস্থিতির শিকার। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সবাই।
—তোর হাজব্যান্ডও?
—না, ও পাপিষ্ঠগুলোকে বাদ দিচ্ছি। তবে আমি আজও জানি না ওদের মোটিভটা ঠিক কী? তুই ভাব না—নিজেদের প্রথম সন্তান, নিজেদের প্রথম নাতি আসছে, সংসার সচ্ছল। সুদ্ধু বউ কিছুদিনের জন্যে ওঁদের চাকরানিগিরি করতে পারবে না বলে…নাঃ ভাবা যায় না।
—তাই? এই রকম ব্যাপারটা?
—তাই তো বুঝেছি। আরও কিছু আছে। থাকলে থাকবে, না থাকলে না থাকুক। ইন দ্য মিন টাইম, তিলক আমরা এই নোট্সগুলো একটু ডিসকাস করে পড়তে পারি। এগুলো মুখস্থ করে উগরে দিলে কিছু শেখা যাবে না।
—বলছিস? তুই তাই চাস?
—ভী-ষণ উপকার হয় আমার তা হলে। যদি চাস আমি জয়িতাদিকে জানিয়ে দেব, আমি এগুলো তোর সঙ্গে শেয়ার করছি। বড্ড কঠিন বলে।
—তুই যা ভাল বুঝিস করিস। শনিবার-রবিবার আসছি তা হলে?
—হ্যাঁ। ঠিক দুপুর আড়াইটে। রাইট?