অমৃতা (Amtrita) – ১২
ক’দিন ধরে শ্রাবণ অঝোরে ঝরছে। আকাশের মুখ দিনরাত দুপুর বিকেল সন্ধে-সকাল নীলগাইয়ের মত নীলচে কালো। ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে’—গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে ডক্টর কার্লেকর ছাই-ছাই রঙের টি-শার্টের তলায় নীলচে কালো রঙের প্যান্ট পরছিলেন বোধহয় আকাশের সঙ্গে রং মিলিয়ে। রম্ভা ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলেন।
—কোথায় বেরচ্ছ? এখন? এই আনআর্থলি ওয়েদারে?
—তোমাদের বেবিরা তো ওয়েদার চার্ট-ফার্ট মানে না অপ্সরী!
মন খুব ভাল থাকলে রঞ্জন রম্ভাকে অপ্সরী বলে ডেকে থাকেন। আদরের ডাকে কান না দিয়ে রম্ভা বললেন—এত তাড়াতাড়ি তো তুমি নার্সিংহোমে যাও না? এখনও এগারোটা বাজেনি।
—এগারোটা না বাজলেও বারোটা বেজে যেতে পারে ডার্লিং। পায়ে মোকাসিন গলাতে গলাতে রঞ্জন বললেন।
—এই পোশাকে তুমি নার্সিংহোমে যাবে? রম্ভার অবাক হওয়া এখনও ফুরোয়নি।
—তা এই শ্রাবণধারাপাতে কি তুমি আমায় সুটেড বুটেড হয়ে যেতে বলো?
—তোমাকে কখনও ক্যাজুয়াল পরে নার্সিংহোমে যেতে দেখিনি।
—খেয়াল করোনি ডার্লিং। গেছি গেছি, এমন বর্ষায় গেছি।
—গাড়িটা তো বারান্দার তলাতেই দাঁড়াবে। ড্রেস করতে তোমার আপত্তি কী?
—সেটা এখানে। ‘উজ্জীবন’-এ বারান্দার তলা নেই। সেখানে আর পাঁচজন গাড়িহীনের মতোই আমাকে ছাতা মাথায় ঢুকতে হবে।
—কী জানি বাবা! রম্ভার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে রঞ্জন নার্সিংহোমে যাচ্ছে না। তা না-ই যাক। অন্য কোথাও কোনও এমার্জেন্সি কল থাকতেই পারে। ডক্টর কার্লেকরের সব কেসই তো উজ্জীবনে আসে না! কিন্তু বলল না কেন সে কথা! রঞ্জন সাধারণত কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, আনুমানিক কত ঘন্টা লাগতে পারে, কেস জটিল কি না এ সবই রম্ভাকে বলে থাকে। প্রথমত স্ত্রী একজন ডাক্তার, তারই মতো স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বলে। দ্বিতীয়ত স্ত্রী সন্দেহপ্রবণ বলে।
রম্ভাকে একবার গম্ভীর পরক্ষণেই বিষণ্ণ হয়ে যেতে দেখে রঞ্জন বললেন—আরে, এর ওপর তো একটা এপ্রন চাপিয়ে নেব। তলায় ফর্ম্যাল শার্ট আছে না ক্যাজুয়্যাল আছে তখন কে দেখছে?
অনেক কথাই এর উত্তরে রম্ভার বলার ছিল। বলার ছিল নার্সিংহোমের স্টাফ যাতে সবসময়ে শতকরা শতভাগ পেশাদার চেহারায় থাকে, তাই ডক্টর কার্লেকরও নিজেকে তাদের আদর্শ হিসেবে গড়েছেন। এটাই নাকি তাঁর ‘ইমেজ’। সেই ‘ইমেজ’আজকে হঠাৎ ভাঙার কী দরকার পড়ল? কিন্তু এসব বলে রম্ভা কথা বাড়ালেন না। এই যে ঈষৎ বিষণ্ণ, সামান্য অবহেলিত, অবহেলিত বলেই সূক্ষ্মভাবে আহত তাঁর নিজের ‘ইমেজ’ এটাকে এই মেজাজটাকেও তিনি উপভোগ করেন। রঞ্জন বেরিয়ে গেলে, তার গাড়ি যতদূর দেখা যায় তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখবেন। এখন বৃষ্টি সোজা ছাটে পড়ছে, তবুও বারান্দায় রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালে তিনি ভিজে যেতে পারেন। সেই সামান্য ভেজা কামিজটা তিনি বদলাবেন না। বর্ষাকালে এমনিতেই তিনি একটু অ্যালার্জিতে ভোগেন। ভিজলে তো আর কথাই নেই। সন্ধে নাগাদ জ্বরটা এসে যেতে পারে। তখন তিনি কপালে একটু বাম ঘষে নীল আলো জ্বেলে বিছানায় শুয়ে থাকবেন। চেম্বারে বসবার আগে রঞ্জন আর তিনি একসঙ্গে বসে একটু কফি খান। কফি খাওয়ার একটা সুন্দর জায়গাও আছে তাঁদের। খাবার ঘরের একদিকে দুটো কোণা জুড়ে এত বড় জানলা যে মনে হয় জানলা নেই, কাচের ওপারেই বাগান, বাগানের ওপারে শান্ত পথঘাট। এই কোণটাতে তাঁদের স্মোকড গ্লাসের কফি-টেব্ল পাতা। সেদিকে যেতে গিয়ে যখন রম্ভাকে দেখতে পাবে না, রঞ্জন ওপরে আসবেই। বেডরুমে।
—কী ব্যাপার? নীচে নামোনি এখনও?
—তুমি রেডি? চান করেছ?
—শিওর! ওডি কলোনের গন্ধটা পাচ্ছ না!
—নাঃ!, নাক বন্ধ।
—আবার সর্দি হল না কি? —রঞ্জনের গলায় থাকবে উৎকণ্ঠা।
—সর্দি হয় তো হয়েছে। চলো।—বলে রম্ভা মন্থর ভঙ্গিতে উঠবেন। নীল-এর ওপর ধূসর ছাপের সেই শিফনটা পরনে। রঞ্জন কাছে এসে গালে গাল রাখবে। রেখেই চমকে উঠবে।
—এ কী? তোমার তো বেশ গা গরম।
—ও, তাই মাথাটা ব্যথা করছিল।
—করছিল, এখন?
—কমে গেছে।
—থাক তা হলে নীচে গিয়ে কাজ নেই। এখানেই আনতে বলে দিই। বাজার টিপবেন রঞ্জন। কালীচরণ, ওঁদের বেয়ারা কফি পট সুদ্ধু ট্রলিটা বেডের পাশে রেখে যাবে।
কফিতে একটু করে চুমুক দেবেন আর রম্ভার জ্বর-লালচে মুখের দিকে চিন্তান্বিত দৃষ্টিতে তাকাবেন রঞ্জন। কফিটা যখন দেড় কাপ মতো শেষ তখন রঞ্জন ঝুঁকে পড়বেন, রম্ভার বুকের ওপর। —ডার্লিং …
—আঃ, কী করছ? ছোঁয়াচ লাগবে।
—দূরে থাকলেও লাগতে পারে যখন তখন কাছেই থাকি। রঞ্জনের গলার স্বর এখন বদলে যাবে। গাঢ়, গভীর। সেই অনেকদিন আগেকার, বিবাহপূর্ব রঞ্জন, মেডিক্যাল কলেজের থার্ড ইয়ারের রঞ্জন আর রম্ভা।
সামান্য জ্বর গায়ে অসময়ের সেই গাঢ় সঙ্গমের জন্যে আজ অপেক্ষা করবেন রম্ভা। সারাদিন ধরে তার প্রস্তুতি চলবে, প্রস্তুতি এবং প্রতীক্ষা। এইরকম অসময়ে না হলে তো রঞ্জনের আর সময়ই হয় না।