Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অমৃতা || Bani Basu » Page 11

অমৃতা || Bani Basu

অমৃতা (Amtrita) – ১১

আকাশের রং যে এমন মন-কেমনিয়া হতে পারে, বাতাসের স্পর্শ যে এমন শিহরন-জাগানিয়া হতে পারে, গাছের পাতাদের নড়ায়-চড়ায় যে এমন আসঙ্গ কামনা ভেতর থেকে উঠে আসতে পারে, খাদ্যের স্বাদ যে এতটা চমৎকার হতে পারে, সারা দিনরাত যে এমন প্রতীক্ষাময় হতে পারে, পৃথিবীর সব মানুষ যে অমন মোছা-মোছা জলরঙের ছবি হয়ে যেতে পারে, মা-বাবা যে অমন অচেনা অন্যলোক হয়ে যেতে পারে, দোলা কোনওদিন কল্পনাও করেনি।

সে চুপিচুপি একটা সোয়েটার বুনছে। আসলে দুটো বুনছে। একটা প্রকৃত বোনা, আর একটা ক্যামোফ্লাজ। দেখাচ্ছে বাপির জন্য বুনছে একটা রাস্ট কালারের পুলোভার, কিন্তু আসলে বুনছে দুটো। যাতে কেউ বুঝতে না পারে। সবার সামনেই নিশ্চিন্ত মনে একটাতে জোড়াসাপ বুনতে থাকে সে। মায়ের অবশ্য নজর খুব। ‘কী রে? কালকে আর্ম-পিট অবধি এসে গিয়েছিলি না? আবার ভুল করেছিস বুঝি?’

—হ্যাঁ মা, দোলা নির্বিচারে মিথ্যা বলে। আর্ম-পিট অবধি যেটা হয়ে গেছে সেটা ওর, এটা বাপির। এখন বর্ষা পড়ে না গেলেও মাঝেমধ্যেই বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু সোয়েটার দুটো সে শুরু করেছে ঘোর গ্রীষ্মে। যখন পশম হাতে করলেই মনে হয় একবার বরফজলে হাতটা ডুবিয়ে আসি। এখন অবশ্য বৃষ্টি নামছে। ‘আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে যখন বৃষ্টি নামল।’ তার সারা দেহ জুড়ে বৃষ্টি। কামনার স্বেদ-এর সঙ্গে গ্রীষ্মের ঘাম, বর্ষার রাঙা জল বাইরে থেকে তফাত করা যায় না। কিন্তু এ সেই কামনার স্বেদ, কামনার রোমাঞ্চ যার কথা জয়দেবরা বলে গিয়েছিলেন। পদকর্তারা বলে গিয়েছিলেন। এ-কি মানুষের জন্য? না দেবতার জন্য? বোঝা দায়। দোলা আগে জানত না দেবতা হয়, বিশ্বাসই করত না। কিন্তু এখন জানে, হয়, একটা মানুষের দেবতা। সব মানুষের অবশ্য হয় না। হাতে-গোনা যে কয়েকজনের হয় তাদের মধ্যে দোলন একজন। কখনও সে মেট্রোর সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসে, কখনও নন্দন চত্বরে ফোয়ারার পাশ থেকে ঈষৎ সিক্ত অবস্থায় বেরিয়ে আসে। কখনও বা সিনেমা হলের অন্ধকারের অন্তরালে গাঢ় আকার নেয়, কখনও ভিক্টোরিয়া কি মিউজিয়ামের থামের আড়ালে একটা অদ্ভূত অভ্যন্তরীণ নেশা লাগানো স্বাদ-গন্ধঅলা চুম্বন হয়ে নেমে আসে। দোলার অন্তর্বাস ভিজে যায়। এই ভেজায় কী অস্বস্তি। কিন্তু কী অপার্থিব আনন্দ!

দোলার চেহারার মধ্যে আগে একটা বালিকা-বালিকা ভাব ছিল। এমন বালিকা, বড়রা দেখলেই যাঁদের গালে টুস্কি মেরে বলে কী রে কোন ক্লাস হল? কিন্তু আসলে বলতে চায় কী রে কত বড় হলি? কিন্তু সেই বালিকা-ভাবটা মুছে না গেলেও দোলার মধ্যে এমন একটা তরুণীত্ব, সময়ে সময়ে যুবতীত্ব এসে গেছে, যে অনেক মানুষের কামনার ধন। কী যে একটা অধরা লাবণি তার অঙ্গে অঙ্গে বয়ে যায়। মেয়েবন্ধুরা বলে—যত দিন যাচ্ছে কী সুন্দর যে হচ্ছিস দোলা! কী মাখিস রে?

—কী আবার মাখব? চিরকাল যা মাখি। মনে মনে অবশ্য সে জানে মেখেছে, সে প্রেম মেখেছে।

ছেলেবন্ধুদের অনেকে বলে—দোলা তোকে কি ফ্যানটাসটিক লাগছে রে, কোথায় লাগে প্রীতি জিনটা, কোথায় লাগে আমিশা পটেল-ফটেল, রানি মুখার্জি-টুখার্জি!

ছবি তোলো, ভাল অ্যাঙ্গল থেকে, যত্ন করে কমপোজ করে— এ লাবণ্যের ছবি কিন্তু উঠবে না। এ এক অলৌকিক অশরীরী লাবণ্য। তিশান তো একদিন বলেই ফেলল— কিরে দোলা আমার সঙ্গে একদিন ডেট করবি নাকি? আইসক্রিমের বেশি কিছু খাওয়াতে পারব না কিন্তু।

দোলা বলল—দুটো আইসক্রিম তুই একাই খেগে যা, একটা আমার কথা ভেবে ভেবে খাবি।

দোলার দিদি ঝুলন বলে—মা, দোলার সেই বয়সটা এসেছে, যে বয়সে বিয়ে দিতে হয়।

মা বলে—সাত বুড়ির এক বুড়ি হয়েছিস তুই।

লজ্জা পেয়ে ঝুলন বলে—সত্যি মা, খেয়াল কোরো।

—কেন, এত সুন্দর সময়টা ও যদি মা-বাবার আশ্রয়ে থেকে জীবনটা সত্যিকার উপভোগ করে তাতে তোর আপত্তি কেন? কীরে দোল বল কিছু?

দোলা লজ্জা পেয়ে বলে—তাই তো!

ঝুলন বলে—আমাদের হাতে খুব ভাল একটা পাত্র আছে মা, যেমন দেখতে ভাল, তেমনই ভাল ছেলে, নেহাৎ অল্পবয়স তাই হয়তো পার্থর মতো অতটা এস্টাবলিশড না। কিন্তু হবে, আস্তে আস্তে হবে।

দোলার বুকের ভেতরটা ধড়াস ধড়াস করতে থাকে—এই বুঝি, এই বুঝি—তার নামটা করল দিদি।

—কেমন ছেলে, শুনি?

—সুপ্রতিম রায়চৌধুরী ওদের কলিগ, জুনিয়র এগজিকিউটিভ হয়ে যোগ দিয়েছে। আমার তো ভীষণ পছন্দ।

দোলা বলে ওঠে, তোর পছন্দ যদি তো তুইই বিয়ে করগে যা না। ভীষণ রাগ হয়ে যায় তার। অমন একটা জ্বলজ্বলে মানুষ রিলিফ ম্যাপের মতো বহুলোকের চ্যাপ্টা পশ্চাৎপটে উঁচু-উঁচু হয়ে রয়েছে, অথচ ওদের চোখে পড়ে না? সে অবশ্য এখনও জানে না পার্থদার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা ঠিক কী! পার্থদার ও দূরসম্পর্কের তুতো ভাইয়ের কাজিন না কী। ঠিক আছে তা না-ই হল, তাহলে পার্থদাদের অফিসের ডিনার-পার্টিতে এসেছিল কেন? এত কথা জিজ্ঞেস করেছে ওকে, এ কথাটা কখনও জিজ্ঞেস করেনি। ‘পার্থদা আপনার কে হন?’ এরকম একটা প্রশ্ন করে জবাব শুনেছিল ‘ও পার্থদার কেউ বুঝি হতেই হবে? নইলে আমার সঙ্গে মিশবে না?’ দোলাকে অপ্রস্তুত দেখে অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কটা ব্যাখ্যাও করে দিয়েছিল। পার্থদার অফিসের একজনের সঙ্গে ওর সম্পর্ক। খুড়তুত শালা। বাব্বাঃ এইসব খুড়তুতো জ্যাঠতুতো পিসতুতো মাসতুতো বড্ড গুলিয়ে যায় দোলার। ওর ভাবখানা হল : আমি অমিতাভ। আমার নামের আগে-পিছে কিছু নেই। অতীত অবশ্যই আছে, কিন্তু তাকে তো ফেলে এসেছি! ভবিষ্যৎ? যখন আসবে, তখন আসবে। এখন, এই মুহূর্তটুকুকে এই মুহূর্তেই উপভোগ করে ফেলো, রোমন্থন করবার জন্য যেন ফেলে রেখে দিও না। দিলে শেষ পর্যন্ত পস্তাবে।

—অমিত, তোমার বাবা-মা মানে ফ্যামিলির কথা একদম বলো না—সে অনুযোগ করে।

অমিতের জবাব আসে সঙ্গে সঙ্গে—তাহলে আমার বাবা-মা মানে ফ্যামিলির সঙ্গেই তোমার ডেট করতে হয়! করবে? বলো! আমি সরে যাই।

—আহা! কী কথার কী উত্তর। বন্ধুদের বাবা-মা’দের বিষয়ে বুঝি জানতে ইচ্ছে হয় না! আমার বাপি-মা-দিদিকে আমি ভীষণ ভালবাসি। আমার যত বন্ধু আছে, সবাইকার বাবা-মা’কে আমি চিনি, ওঁরাও আমাকে ভীষণ ভালবাসেন…

—আচ্ছা দোলা, তোমাদের মেয়েদের এই ভীষ্‌ষণ ভালবাসাটা খুব খুব সস্তা, না? খু-উ-ব ইজি!

আহত হয় দোলা, অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে।

—ডোন্ট বি হার্ট প্লিজ! বি প্র্যাক্টিক্যাল। বন্ধুদের সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব কেন? একসঙ্গে পড়েছ বলে৷ আজ থেকে দশ বছর পরে কে কোথায় থাকবে তার কিন্তু কোনও ঠিক নেই। হয়তো শপিং করতে গিয়ে একজন পিসিমা মতো মহিলাকে দেখে বলবে…আরে! লাবণি না? কী মুটিয়েছিস রে! কিংবা তোমার হট ফেভারিট নিলয় চন্দরকে তোমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে তুমি বিরক্ত হয়ে পেভমেন্ট বদলই করে ফেলবে, কেননা দাড়ি-না-কামানো উড়োখুড়ো চুল এই লোকটাকে তুমি আদৌ চেনো না।

—কেন? কেন? নিলয় কেন অমন হবে? বেশ তো!

—আরে বাংলায় এম.এ পাস করে আজকালকার দিনে একটা ছেলের চাকরি জোটানো কী অসম্ভব তা জানো? কী করবে ও? টুইশানি। সারাটা জীবন ট্যুইশানি করে কাটিয়ে দেবে। তা ওর দাড়ি কামানো থাকবে না তো কার থাকবে না?

—এ ধরনের অ্যাসাম্পশন কিন্তু খুব বাজে যাই বল। হার্টলেস।

—আরে বাবা, হার্ট-ফার্টের ব্যাপারই এ নয়। প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল ট্রুথ।

—আর লাবণি? লাবণি কেন পিসিমা হয়ে যাবে? তুমি ওকে দেখেছ?

—জানতে হলে দেখতে হয় না। দেখতে হয় না, জি.কে অ্যাবাউট লাইফ মেন অ্যান্ড উইমেন দিয়েই হয়ে যায়। জি.কে অর্থাৎ জেনার্‌ল নলেজ বলে নাইনটি নাইন পার্সেন্ট মেয়ের বিয়ের দু-এক বছর পরেই বাচ্চা হয়, তার পরেই জমে মেটারনিটি ফ্যাট, পেটে, কাঁধে, বিশেষ করে আরও আরও প্রত্যঙ্গে, মুখচোখ অতি পরিশ্রমে-দুশ্চিন্তায় কালি-কালি হয়ে যায়। প্রেগন্যান্সির সময়ে চুল উঠে টিকটিকির ল্যাজ হয়, নয় টাক পড়ে যায়। তো তারপরেও একটা মেয়েকে পিসি-মাসি দেখানোটা এত কী আশ্চর্যের হল?

—মোটেই না, মোটেই এরকম আজকাল হয় না, সবার হয় না, এখন সবাই বিউটি-কনশাস, ফিগার-কনশাস। তা ছাড়া, আলাদা করে লাবণির কথাই যদি বলতে হয় তো ও তো সিঙ্গাপুর যাচ্ছে বিয়ের পর।

—সিঙ্গাপুরে তাহলে লোকের বাচ্চা-কাচ্চা হয় না, বলছ! ওখানে তো ওকে আরও খাটতে হবে। আরও কালি পড়বে চোখে। সিঙ্গাপুর তো শিশু, খোদ আমেরিকার নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডি.সি-তে তো আর যাওনি। ওফ্ফ্ কিছু মোটা দেখেছি বাবা ওখানে। অত মোটা মহিলা আর তুমি কোত্থাও পাবে না।

—নিউ ইয়র্কে? ওয়াশিংটনে? অবিশ্বাসের গলায় দোলা বলে—যাঃ। কী ভাঁওতা তুমি কাকে দিচ্ছ বলো তো? যাদের দেশে জিম আর এরোবিক্স আর হেলথ ক্লাবের ছড়াছড়ি, মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতা হয় যাদের দেশে…

—মিস ফ্যাটিয়েস্ট প্রতিযোগিতাটাও ওরা করলে পারে, প্রতোক বছর ওরাই ক্রাউনটা পাবে।

ব্যাস, অমিতের বাবা-মা, তার ভাই-বোন আছে কিনা, থাকলে তারা কী রকম, কে কী করে, অমিতের ব্যক্তিগত জীবন এ সমস্ত প্রসঙ্গই এই ধরনের তরল হাসাহাসি, তর্কাতর্কিতে চাপা পড়ে যায়। তারপর থাকে কোনও রেস্তোরাঁর মৃদু আলো, কোনও সিনেমাহলের অন্ধকার। সাধারণত হল অন্ধকার হয়ে যাবার পরই ওরা ঢোকে। অন্ধকারে দুটো হাত লতার মতো পরস্পরকে জড়িয়ে থাকে, একটা বড় হাত, ছোট হাতকে চাপ দেয়, ছোট হাতের পাতা বড় হাতের পাতাকে চিমটি কাটে ; অন্ধকারে অদ্ভূত অদৃষ্ট অশব্দ কায়দায় চুম্বন-বিনিময় হয়, হাতে হাত, পায়ে পা, গায়ে গা, সেই উদ্‌ভ্রান্ত শরীরী অভিজ্ঞতার সময়ে কিছু মনে হওয়া সম্ভবই নয়। বাইরে বেরিয়েও আসে ওরা শো ভাঙবার বেশ আগে, জনস্রোতে যদি চেনা কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! কী ছিল? কী ছিল ছবিটা? যাঃ কেউ জানে না। দোলার চোখে লজ্জা জড়িয়ে থাকে, ওর চোখে গাঢ়, গাঢ় প্রেম। অন্যদিকে যেন চোখ সরাতেই পারছে না। তারপর দোলা এক বাসে উঠে যাবে, সজল শরীর, তার পিঠ দিয়ে উরু দিয়ে আকাঙক্ষার লাভা-ঢল নামবে, কিন্তু কিছু করার নেই। এরপর রাত হয়ে যাবে। তার বাস চোখের আড়াল হলে ও কোথায় যাবে? ওর শরীর কেমন করবে? ওর মন কেমন করবে? দোলা জানে না, জানে না, জানে না। শুধু জানে সে এই জন-জঙ্গলে একা, একেবারে একা, তাকে কেউ অশোভন ধাক্কা দিলে এ সময়টা সে কিছু বুঝতে পারে না। তার হাত-ব্যাগটা ছিনিয়ে নিতে কিংবা কেটে পয়সাকড়ি নিয়ে নিতে এ সময়টায় পকেটমার, ছিনতাইবাজদের কোনওই অসুবিধে হবে না। রাস্তা দিয়ে, বিশেষত গড়িয়াহাটের কাছাকাছি সব সময়ে পুজোর ভিড়, দোলার মনে হবে রাস্তাগুলো কেন এত ফাঁকা, চারদিকে কেন এত অন্ধকার, অথচ লোডশেডিং হয়নি, রাস্তায় প্রচুর আলো, বিজ্ঞাপনের বড় বড় ল্যুমিনাস রঙের সাইনবোর্ড, বিজলির কত রকম কেরামতি, অন্ধকার একটা ফাঁকা কানা গলি দিয়ে দোলা হাঁটবে, অবশ্যই বুকের আলোয় পথ চিনে চিনে, যে চাঁদ আকাশে ওঠেনি, যে আকাশ শহরের সমস্ত দূষিত বাষ্প নিয়ে, বিজলি আলোর দাবড়ানিতে শাদা, একদম ময়লাটে শাদা হয়ে আছে, সেই আকাশকে আকাশ-নীল রঙে চুবিয়ে তারপর তাতে একটি স্নিগ্ধ দ্বাদশীর চাঁদ এঁকে দিলে তবে দোলার বুকের ভেতরটা তৈরি হবে। সেই চাঁদের চাঁদনিতে পথ দেখে দেখে সে কর্নফিল্ড রোড থেকে এক স্টপ এগিয়ে যাবে। একটা মস্ত খেলার মাঠ, কে জানে কতদিন থাকবে, একটা মস্ত পুকুর, কে জানে কতদিন থাকবে, তাদের যে-কোনও একটার পাশ দিয়ে দোলা বাড়ির ঘনিষ্ঠ রাস্তাটি ধরবে। যে কেউ এখন দোলাকে দেখলে বলে দিতে পারবে এ হল একটা প্রেমে-পড়া মেয়ে, প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া মেয়ে। অথচ তার বাবা-মা বোঝেন না, তার বন্ধুরা বোঝে না—কেননা সে তো বলেনি কাউকে! ঘুণাক্ষরেও বলেনি। তারা সবাই, বাবা-মা এবং বন্ধুরা সব্বাই মনে করে দোলাটা একটা আদুরি, দোল দোল দুলুনি, সে নিজের দায়িত্বে নিজেকে নিয়ে কিছু করতে পারে না, কখনও করেনি। তার চেয়েও বড় কথা, দোলার নিষ্পাপ মুখকে দোলার অকপট কথাবার্তাকে তারা সবাই বিশ্বাস করে। বাবা, মা, দিদি, পার্থদা, নিলয়, শর্মিষ্ঠা, লাবণি, চঞ্চল..সবাই, সব্বাই।

এই যে গোপনতা এ-ও কিন্তু দোলার পক্ষে সত্যিই স্বাভাবিক নয়। কেন সব কিছু গোপন করছে দোলা? আরও কত ছোটবেলায় ওর বাবার বন্ধু যখন ওর সবে কুঁড়ি-ধরা বুক চটকে চটকে আদর করেছিলেন তখন সে কথা সে মাকে বলে দিয়েছিল। হিস্ট্রির একটা ঝাঁকড়াচুলো মাকড়ামুখো ছেলে কী যেন নাম, তার সঙ্গে জমাবার চেষ্টা করেছিল প্রাণপণ সেটাও সে নিলয়, অমৃতা, লাবণি সব্বাইকে বলে দিয়েছিল। এমন যদি দাঁড় করানো যায় যুক্তিটা যে এদের দিকে তার নিজের বিন্দুমাত্র আকর্ষণ ছিল না তাই বলে দিতে তার বাধেনি, তাহলেও কিন্তু ভুল হবে। বাবার বন্ধু সেই পরিমলকাকুকে সে খুব ভালবাসত। তাহলে? তাহলে এই একটা সোয়েটার বোনবার ছলে দুটো সোয়েটার বোনা, লাইব্রেরি যাবার ছল করে সিনেমা যাওয়া, কেন? কেন য়ুনিভার্সিটিতে যাবার কথা বলে সারাদিন ওর সঙ্গে ঘোরা জলে ভিজে, রোদে পুড়ে, টই টই টই টই? সে তো বলতেই পারত—বাপি জানো, পার্থদাদের স্টিমার-পার্টিতে একজনের সঙ্গে আলাপ হল, অমিতাভ সেন। খুব মজাদার ছেলে, জানো বাপি? একদিন বাড়িতে ডাকব? এটাই তার পক্ষে ষোলো আনা স্বাভাবিক হত। বাপি নির্ঘাত বলত—তাই নাকি রে! আমার হবু ছোট সান-ইন-ল’ মনে হচ্ছে? ডাক, ডাক, ডাক। মা শুনলেই বলত গাছে কাঁটাল গোঁফে তেল। তোমার ওই স্বভাব আর গেল না। ঝুলনের সময়েও এগজ্যাক্টলি এমনি করেছিলে। বাড়িতে ছেলেবন্ধু আনলেই হবু সান-ইন-ল’ মনে হচ্ছে? আচ্ছা লোক যা হোক।

এরপর অমিতাভ বাড়িতে আসত। বাপি-মা অবাক, মুগ্ধ হয়ে যেতেন। দুই বাড়ির মধ্যে কথা বলাবলি, খেতে ডাকাডাকি শুরু হয়ে যেত। বাপি-মা’র লাইসেন্স নিয়ে পরিষ্কার বিবেকে দোলা লজ্জা-লজ্জা হাসিমুখে ওকে মিট করতে বেরত, ও পৌঁছে দিত। বন্ধুরা বলত—ওঃ দোলা, ফ্যানটাসটিক, কেউ হয়তো বলত—এৎ তূ দোলা?

কেন? কেন? কেন এমন ঘটাল না সে? তবে কি নিষিদ্ধ প্রেমের মতো গোপন প্রেমেও একটা আলাদা উত্তেজনা থাকে? মা-বাবাকে ঠকানোর, মিথ্যে কথা বলারও কি একটা আলাদা রোমাঞ্চ থাকে? আর বন্ধুদের?

সেদিন লাবণি যখন বলল—অমৃতাটার কী হল বল তো!

নিলয় বলল—ঘাবড়াচ্ছিস কেন? অরিন্দমদা তো বলছে ও ভাল আছে, সেফ আছে।

লাবণি মুখভঙ্গি করে বলল—আচ্ছা দোলা তুই-ই বল অরিন্দম ঘোষ কি পেশাদার টিকটিকি? শার্লক হোমস? না ফেলুদা? না ভাদুড়িমশাই? নিলয়টা এমন করছে যেন…

দোলার মনে হল—কে? কার কথা বলছে ওরা? কে অমৃতা? কে অরিন্দম ঘোষ? এদের কথা তো সে জানত না?

লাবণি বলল—বল না, তোর তো চিরকাল ও বেস্ট ফ্রেন্ড। তোর ওপিনিয়নের তো একটা আলাদা মূল্য আছে, তুই নিশ্চিন্ত হতে পারছিস?

হঠাৎ যেন বহু যুগের ওপার থেকে আষাঢ় আসার মতো অমৃতা তার মনে এল। ধোঁয়া ধোঁয়া। আবছা আবছা। কুয়াশার মধ্যে যেমন দেখা যায় বা ধুনো-গুগগুলের ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে যেমন চেনা যায়! অমৃতা। অমৃতা, তাই তো! তার এক সময়ের হার্ট-থ্রব অমৃতা চক্রবর্তী-গোস্বামী হঠাৎ হারিয়ে গিয়েছিল বটে। সে ভীষণ উদ্বিগ্ন ছিল। লাবণিকে নিয়ে…। অরিন্দম ঘোষ তো লাবণির হবু? তার যেমন ও? না, না, লাবণির হবু আর তার হবুতে এক সমুদ্র তফাত, এক সমুদ্র তফাত তাদের সম্পর্কের সুর-লয়-তালেও।

কিন্তু অমৃতার কথা, তার নিরুদ্দিষ্ট হবার কথা সে একেবারে ভুলে গিয়েছিল? কী আশ্চর্য! কী ভীষণ লজ্জাজনক! বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে ব্যথা, গলার কাছে একটা পিণ্ড অনুভব করে সে। বলে— অরিন্দমদা কী বলছেন?

নিলয় বলল—উনি বলছেন ও সেফ অ্যান্ড সিকিওর।

লাবণি বলল—বাট দ্যাট ইজ জাস্ট আ হাঞ্চ!

নিলয় বলল—না রে লাবণি, আমার মনে হয় উনি ডেফিনিট কিছু জানেন।

—তাহলে বলছেন না কেন সেটা?—দোলা বলল।

—সেটাই তো! রহস্য করছে কেন? লাবণি বিরক্ত সুরে বলল।

সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে দোলার মনে হল—ইস্‌স সে কী স্বার্থপর! যে অমৃতাকে সে চোখে হারাত, যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে সে ভয়ে, রাগে, ক্ষোভে অস্থির হয়ে গিয়েছিল, অরিন্দমদার সঙ্গে সেই নার্সিংহোম যাত্রা! এ সমস্তর ওপর একটা পর্দা পড়ে গিয়েছিল যেন। আজ নিজের কাছে স্বীকার করতেই হয় অরিন্দম ঘোষ যে বলছেন অমৃতা ঠিক আছে, ভাল আছে, কোনও প্রমাণ ছাড়াই এটা মেনে নিতে পেরে সে বেঁচে গেছে। অমিতাভ এখন তার মন থেকে সব কিছু, সব্বাইকে হঠিয়ে দিয়েছে। তার মগজে জায়গা নেই, হৃদয়ে জায়গা নেই। কাউকে কিছু বলবার তাগিদ নেই ; আপনাতে সে আপনি মগ্ন, আপনি সম্পূর্ণ। একটা সুখ আর অলৌকিক আনন্দের বলয়ের মধ্যে এখন তার ঘোরাফেরা। কাউকে সে-সুখের কথা, আনন্দের কথা বলে সুখ ভাগ করে নেবার প্রশ্নই ওঠে না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress