Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অভিজিৎকে যেভাবে চিনি || Taslima Nasrin

অভিজিৎকে যেভাবে চিনি || Taslima Nasrin

অভিজিএর সঙ্গে আমার পরিচয় আজ থেকে পনেরো-ষোলো বছর আগে। অভিজিৎ তখন সিঙ্গাপুরে থাকতেন। বেশ কয়েকদিনের আলাপে এবং ওঁর বেশ কিছু ব্লগ পড়ে আমি বুঝি যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, বিবর্তন, দর্শন, ধর্ম, কুসংস্কার নিয়ে অভিজিৎ আর আমার বিশ্বাসের মধ্যে কোনও অমিল নেই। আমরা মূলত একই আদর্শের মানুষ। অভিজিৎ আমার লেখা বই আগেই পড়েছেন, সুতরাং নারীবাদ, মানববাদ এবং অস্তিত্ববাদে আমার বিশ্বাসের কথা তিনি জানতেন। মুক্তমনা নামে সবে একটা ব্লগ খুলছেন তখন। মুক্তমনার জন্মটা একেবারে আমার চোখের সামনে। মুক্তচিন্তায় আর যুক্তিবাদে বিশ্বাসী যে কোনও মানুষই তাঁদের মত প্রকাশ করতে পারবেন মুক্তমনায়। এর চেয়ে চমৎকার ঘটনা আর কী হতে পারে, বিশেষ করে আমার কাছে, যার বাক স্বাধীনতা প্রায় নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের প্রকাশকরা তখন আমার বই ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে আজ বই বেরোয় তো বাংলাদেশে পরদিন সে বই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর থেকেই দেশের সমস্ত পত্রপত্রিকা আমার লেখা ছাপানোও বন্ধ করে দিয়েছে। তারা কি আমাকে ভুলে গিয়েছে, না, ভুলে যায়নি, ভুলে গেলে আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতেও ভুলে যেত, ওটি কিন্তু ভোলেনি। আমার মত অন্য অনেকের মতের চেয়ে ভিন্ন। এ কারণে আমাকে নিরন্তর পোহাতে হয়েছে দুর্ভোগ। অভিজিৎএর মুক্তমনা আমার মত প্রকাশের জন্য ছিল খুব প্রয়োজনীয় প্ল্যাটফর্ম। যে কথা আমি কোথাও বলতে পারিনি, সবসময় জানতাম সে কথা বলার জন্য একটি মাত্র জায়গা যদি কোথাও থাকে, সে মুক্তমনা। বিস্মিত আমি লক্ষ্য করি, আমি একা নই। অভিজিৎও একা নন। আমাদের মতের সঙ্গে আরও অনেক সাহসী উজ্জ্বল তরুণ-তরুণী একমত। সবাই বাঙালি। বেশির ভাগই বাঙালি মুসলিম পরিবারের, কিন্তু ধর্মমুক্ত। আমি যে কী ভীষণ উত্তেজিত এবং উচ্ছ্বসিত ছিলাম মুক্তমনা নিয়ে। প্রগতিশীল কারও সঙ্গে দেখা হলে মুক্তমনা পড়তে অনুরোধ করতাম। পৃথিবীর অনেক মানুষের অনেক মতই অন্য অনেকের মতের চেয়ে ভিন্ন। বিভিন্ন বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের বিভিন্ন মত প্রকাশ, আর একই সঙ্গে বিভিন্ন মত নিয়ে আলোচনা চলতে লাগলো মুক্তমনায়। মুক্তমনা দিন দিন সমৃদ্ধ হতে থাকে। বিস্তৃত হতে থাকে। একটা অশিক্ষিত মৌলবাদী মানুষের দেশ আমার দেশ–এই ভাবনাটি আমাকে মাথা নত করিয়েছিলো, অভিজিএর মুক্তমনা আমার নতমস্তক উঁচু করিয়েছে। ওই মুক্তমনার ব্লগগুলো, বিজ্ঞান আর দর্শন নিয়ে আলোচনাগুলো মানুষকে পড়তে দিয়ে আমি বলতে পেরেছি, আমার দেশেও শিক্ষিত সচেতন মানুষ আছেন, বুদ্ধিজীবী,বিজ্ঞানী আছেন, দার্শনিক আছেন, ধর্মমুক্ত, কুসংস্কারমুক্ত, চিন্তক, ভাবুক আছেন। ওই সময় ইংরেজিতে লেখা হতো ব্লগ। পরে বাংলা শুরু হয়েছি। ধীরে ধীরে লক্ষ্য করেছি, বাঙালি ছাড়াও ভিনভাষী বিজ্ঞানমনস্ক নিরীশ্বরবাদী আসছেন মুক্তমনায়।

অভিজিৎ রায় বয়সে আমার চেয়ে প্রায় আট-ন বছরের ছোট। কিন্তু স্নেহ নয়, ওঁকে আমি সবসময় শ্রদ্ধা করেছি। বিজ্ঞানের এবং দর্শনের যে সব কঠিন জটিল খুঁটিনাটি সাধারণের পাঠযোগ্য করে অভিজিৎ একের পর এক বই লিখে গেছেন, আমার পক্ষে সেসব লেখা কখনই সম্ভব হতো না। অভিজিৎ রায়ের মতো ধৈর্য আর ধীশক্তি আমার নেই। ওঁর সঙ্গে কখনও আমার সামনাসামনি দেখা হয়নি। কিন্তু কখনও মনে হয়নি দেখা হয়নি। বিশ্বাসে কোনও দুরত্ব না থাকলে বসবাসের জায়গার দুরত্বটাকে ঠিক দুরত্ব বলে কখনও মনে হয় না। এই তো গত বছরের ডিসেম্বরে যখন ফোনে কথা হলো, আমি তখন নিউইয়র্কে। অভিজিৎ অনেকক্ষণ নানা বিষয়ে কথা বলার পর বললেন জর্জিয়ায় ওঁর বাড়িতে বেড়াতে যেতে। কয়েকদিনের জন্য একবার সত্যি যাবো, কথা দিয়েছিলাম। অভিজিৎ আর তাঁর স্ত্রী কন্যার সঙ্গে জমিয়ে আড়া হবে ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম এ বছরের গ্রীষ্মে নয়তো শরতে। অভিজিৎএর সঙ্গে যে আমার কখনও আর দেখা হবে না, অভিজিৎ যে এই পৃথিবীতে আর মাত্র মাস তিনেকও নেই, তা কি আমি জানতাম! তা কি আমার চরম দুঃস্বপ্নের মধ্যেও ছিল! অভিজিৎএর সঙ্গে দেখা না হলেও ওঁর বাবা অজয় রায়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আমার কলকাতার বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি, তাও প্রায় দশ বছর হয়ে গেল। সজ্জন, সচেতন, উদার, আদর্শবান শিক্ষাবিদ মানুষটির স্নেহ এবং সমর্থন আমি অনেককাল থেকে পাচ্ছিলাম। আমার যে কোনও দুর্যোগে দুঃসময়ে তিনি পাশে দাঁড়াতেন। আমার জন্য দুশ্চিন্তা করতেন। আমাকে না আবার হাতের কাছে পেলে কুপিয়ে মেরে ফেলে। হিংস্র বর্বর মৌলবাদীর দল! মৌলবাদীর দল মেরেছে কুপিয়ে, তবে আমাকে নয়, হাতের কাছে পেয়েছে ওরা আমার চেয়েও বেশি প্রতিভাবান, আমার চেয়েও বেশি জ্ঞানী যুক্তিবাদী অভিজিৎ রায়কে, অজয় রায়ের হীরের টুকরো ছেলেকে।

এখনও আমারকাছে এ অবিশ্বাস্য একটি ঘটনা যে অভিজিৎ নেই। তাঁকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে মেরেছে ইসলামী মৌলবাদীরা। আমি ওদের দুর্বৃত্ত বলছি না, ইসলামী মৌলবাদী বলছি। জেনেবুঝেই বলছি। ইসলামী সন্ত্রাসীরাই অভিজিৎকে দুবছর যাবৎ খুন করার হুমকি দিচ্ছিল ফেইসবুকে। ওদের অ্যাকাউন্ট ব্লকও করা হয়নি, এদের গ্রেফতারও করা হয়নি। বরং নাস্তিকদের অ্যাকাউন্ট ঘন ঘন উধাও করে দেওয়া হয়, চরম হেনস্থাও করা হয়। চাইলে খুনীদের নাড়িনক্ষত্র বের করে ফেলা সরকারের জন্য কঠিন নয়। সরকারকে তো চাইতে হবে। প্রধানমন্ত্রীও জনসমক্ষে এই বীভৎস মৃত্যু নিয়ে একটি শব্দ উচ্চারণ করলেন না। হয়তো অভিজিৎএর খুনীদের কোনও শাস্তি হবে না, যেমন হয়নি রাজিব, হুমায়ুন হত্যার খুনীদের। বাংলাদেশের এই নোংরা রাজনীতিকে আমি ঘৃণা করি। আমি ঘৃণা করি বাংলাদেশের নোংরা কুৎসিত রাজনীতিকে।

কোটি মানুষের ভিড়ে অন্ধকারে অভিজিৎ ছিলেন আলো হাতে দাঁড়িয়ে। অভিজিৎ বিদেশে থাকতেন বটে, কিন্তু তিনি বাংলায় বই লিখতেন, ব্লগ লিখতেন, ফেইসবুক লিখতেন। অশিক্ষিত আর অজ্ঞানকে জ্ঞান দিতেন, শিক্ষিত করতেন। লিখেছেন আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে, অবিশ্বাসের দর্শন, শূন্য থেকে মহাবিশ্ব, স্বতন্ত্র ভাবনার মতো অনেক মূল্যবান গ্রন্থ। অভিজিৎ রায় বাংলা আর বাঙালির জন্য ছিলেন অমূল্য সম্পদ। বাংলাদেশের ধর্মান্ধদের সেকথা বোঝার কোনও কথা নয়। কিন্তু সরকারের বোঝা উচিত ছিল। সরকারের উচিত ছিল অভিজিৎএর জন্য কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। অভিজিৎ এবার দেশে গেছেন তাঁর মাকে দেখতে, বইমেলায় ঘুরতে, নিজের দুটো বইএর মোড়ক উন্মোচনে অংশ নিতে। যে কোনও বাঙালি লেখককের জন্য বাংলা বইমেলার আকর্ষণ অদম্য। আমি দুই বাংলা থেকেই বিতাড়িত এক বাঙালি লেখক, দুই বাংলার কোনও বইমেলায় যাওয়ার কোনও অধিকার আমার নেই। আমি বুঝি আমি কী হারাচ্ছি। বাংলার দুর্ভাগা কূপমণ্ডুকরা তাদের অমূল্য সম্পদকে শুধু পায়ে ঠেললোই না, কুপিয়ে মেরে ফেললো। শুনেছি মুসলিম মৌলবাদীরা নাকি বলেছে, অভিজিৎ হিন্দু ছিল, মুসলমানের ধর্ম নিয়ে নিন্দা করেছিল, মরেছে, বেশ হয়েছে। আবার ভারতের কিছু হিন্দু মৌলবাদী বলছে, ঢাকার রাস্তা ভিজেছে আজ হিন্দুর রক্তে। মুসলিমরা মেরে ফেলেছে অভিজিৎ রায় নামের এক হিন্দুকে। ভুল সংশোধনটা এখনই হয়ে যাক। অভিজিৎ রায় হিন্দু ছিলেন না। হিন্দু ছিলেন না অভিজিৎ। অভিজিৎ হিন্দু ছিলেন না। অভিজিৎ রায় হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করতেন না। অভিজিৎ ছিলেন সকল ধর্মমুক্ত বিশুদ্ধ পবিত্র মানুষ, মানববাদী। আমি যেমন মুসলমান নই, আমি যেমন ধর্মমুক্ত, মানববাদী।

পৃথিবীকে সুস্থ সুন্দর বাসযোগ্য করার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন অভিজিৎ রায়। এরকম নিঃস্বার্থ সবাই হয় না, হতে পারে না। একদিন অভিজিৎ আমার কাছে আসিফ মহীউদ্দিনের ওপর যা যা লিখেছি, সব চাইলেন। তিনি অনেকের লেখা জড়ো করে, অনেকের উদ্ধৃতি দিয়ে, অনেকের সই নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। পৃথিবীর সব মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী মানববাদী সংগঠনগুলোকে আসিফের ব্যাপারে জানিয়েছিলেন অভিজিৎ, অনুরোধ করেছিলেন আসিফকে মৌলবাদীর কবল থেকে বাঁচিয়ে আনার জন্য। আসিফের ওপর মৌলবাদী আর সরকারী হামলার পর আমি ইংরেজিতে এবং বাংলায় কিছু ব্লগ লিখেছিলাম ওর সমর্থনে। আসিফকে বাঁচানোর জন্য আমি আর কী করেছি, অভিজিৎ করেছেন শতগুণ। আসিফ আজ অনিশ্চয়তা, অনিরাপত্তা, হত্যার হুমকি আর মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে বেরিয়ে একটি নিরাপদ দেশে বাস করছে, সেখানে বসে ও নিশ্চিন্তে ভাবতে পারছে, লিখতে পারছে, এর পেছনে অভিজিৎএর অবদান সম্ভবত প্রায় সবটুকুই। আসিফ বেঁচেছে। অভিজিৎ নিজেকে বাঁচাতে পারেননি। আমরাও পারিনি অভিজিৎকে বাঁচাতে। কিছু কিছু মানুষ আছেন যাঁরা অন্যকে বাঁচানোর জন্য পৃথিবীতে বেঁচে থাকেন, নিজেকে বাঁচানোর জন্য নয়। অভিজিৎ রায় ছিলেন সেরকম দুর্লভ একজন মানুষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress