অবসরের পর প্রেম
সুমি আর সমীরণের আঠাশ বছরের বিবাহিত জীবন।
যৌথ পরিবারের সব কাজের গুরু দায়িত্ব সমীরণের উপর ছিল—সেই সমীরণ সংসারের ঝড় সামলাতে সামলাতে বৌয়ের সাথে দুদন্ড কথা বলার ফুরসৎ পেতোনা—এর মধ্যে সমীরণ ও সুমির ছেলে ও মেয়ে জন্মায়—-তারা মানুষ হয় —-বিবাহিত বর্তমানে।
চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছে সমীরণ—-বৌয়ের সঙ্গে বর্তমানে সময় কাটাতে চান— সমীরণ মাঝে মধ্যেই নানান উপহার দেন সুমিকে।
মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে হঠাৎ একদিন নিমন্ত্রণ আসে।
মা ও বাবা মেয়ের বাড়ি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যায়।
মেয়ে বলে—মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে লাল কালো ঢাকাই জামদানি কেউ পরে আসে?
দেখো মা সবাই তোমায় দেখছেন ?তোমাকে দেখে আমারই কেমন লাগছে ।
সুমি মেয়ের কথা শুনে খুব লজ্জা পেয়ে বলে —আসলে তোদের বাড়িতে আজকে নিমন্ত্রণ শুনে— কালরাতে তোর বাবা এই শাড়িটা কিনে নিয়ে এসেছেন।
জানিস মা আমিও শাড়িটা পরে আসতে
চাইনি— কিন্তু তোর বাবাকেতো চিনিস —-যা বলে— না করলে কেমন রাগ করে ।
সুমিরা একটু থেকে খাবার খেয়ে তাড়াহুড়ো করে মেয়ের বাড়ি ফিরে আসে। আজকে মেয়ের বাড়ি যাবার সময়ও সুমি বলেছিল নুতন শাড়িটা পরবোনা। তাতে বাপুর রাগ।
শাড়িটা পরার পরে বউমাও একবার বলল শাড়িটা পরে ফেললেন মা । ভাবলাম দাদার মেয়ের মুখেভাতে পড়ব।তার মানে বৌমা বুঝাতে চেয়েছে এটা সুমির পড়ার বয়স নয়।এখনো তো সুমির পঞ্চাশ হয়নি।
সমীরণ বলে—আমরা তাড়াতাড়ি চলে এলাম কেন??।মেয়ের বাড়ি কিছুক্ষণ থাকতাম।
সুমি বলে তোমাকে এতবার বললাম এই বয়সে এই রঙের শাড়ি পরলে লোকে হাসবে।
সমীরণ গম্ভির কণ্ঠে বলেন—” তোমাকে কেউ কিছু বলেছে” ?
মেয়েই বলল এতো কটকটে লাল শাড়ি পরে এসেছো ?
এই শাড়ি বউমাকে দিয়ে দিবো । দেখলাম ওর শাড়িটা খুব পছন্দ।সমীরণ আর কোন কথা বলেনা ।
এই ঘটনার ঠিক সাতদিন পরেই সকালে সমীরণ সুমিকে বলে —– চলো আজকে ডায়মন্ডহারবার বেড়াতে যাব। রাতে একবারে খেয়ে বাড়ি ফিরব।আজকে তুমি একটা ভালো ড্রেস পরে চলো । কারো বাড়িতেতো যাচ্ছি না । তাই কেউ কিছু বলার ভয় নেই ।
সুমি বলে আজ ছেলের বন্ধুরা আসবে।আমাকে রান্না করতে হবে। উনি রাগ করে বললেন – ওদেরতো রোজ বন্ধু আসে,একদিন কেনা খাবার খাবে।
নাহলে ওদের বলো আজকে পার্টি বাতিল করতে ।
সুমি বলে আমরাতো বাবা – মা।আমাদের ফূর্তির বয়স আছে?আমাদের বেড়াবার বয়স পার হয়ে গেছে। ।সমীরণ রাগে গজগজ করতে করতে বাইরে গিয়ে একগুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে আসেন । দেখে সুমির খুব ভালো লাগে ।
সুমি বলে বউমা যদি দেখে ফেলে তাহলে কি ভাববে বলতো???
সমিরণ অবাক হয়ে বলে বউমা দেখলে কি হতো? আমি কি তোমার জন্য ফুল আনতে পারিনা ?
কিন্তু কি জানো বর—- আর সুমির কথা শেষ না হতেই সুমির খোঁপায় একটি গোলাপফুল লাগিয়ে দেয় ।
সুমি বরকে বলে তোমার আগেতো এত ভালোবাসা ছিলনা ।এখন বয়স বাড়ছে ভালোবাসা বাড়ছে দেখছি।
সুমি বলে বৌমার সামনে আদিখ্যেতা না দেখালেই নয়।লুকিয়ে ফুলটা দিতে পারতে??
কয়েকদিন পর কাজের মেয়েটি বলে দিদি দাদাবাবুর আনা ফুলগুলো শুকিয়ে গেছে ,ফেলে দেব??
বৌদি বলেছে মাকে জিজ্ঞাসা করে ফেলো। মার সখের ফুলতো।
সুমি গম্ভির মুখে জানতে চায় দাদাবাবু এনেছে কে বলল তোকে এই কথা ?
কেন বৌদিমনিতো তার বান্ধবীকে হাসতে হাসতে বলছিল জানিস আমার শ্বশুরের কি প্রেম।শাশুড়ির জন্য লাল কালো জামদানি শাড়ি কিনে দেয় , ফুল এনে বৌয়ের মাথায় লাগিয়ে দেয়।বেড়াতে যায়।
অপমানে সুমির চোখ মুখ লাল হয়ে যায়।সুমি কাজের মেয়েকে বলে বেশ করে এনে দেয়।
শোন পদ্মা বৌমা আজকালকার মেয়ে এইসব গল্প করতে ভালবাসে।
আশা করি তুই একথা পাঁচ বাড়ি ঘটা করে বলিসনা।মোটা মাহিনার চাকুরীটা যাবে।
সুমি সমীরণকে জানায়—বৌমা এখন নিজের বন্ধুদের সাথে আমাদের নিয়ে হাসি তামাসা করছে। সমীরণ অবাক হয়ে সুমির দিকে তাকিয়ে বলেন পাত্তা দিওনা।
সুমি ঘুমিয়ে যাবার পর সমীরণ মুনিয়াকে ফোন করে।মেয়ে তাই পরদিন আসে।
সুমি বলে– মেয়েকে হঠাৎ এলি?
মুনিয়া বলে বাবাতো বলল — গোলটেবিল বৈঠক আছে সকালে চলে আয়।সুমি অবাক হয়ে বলে তোর বাবা কোথায়? মুনিয়া বলে বাবা বসার ঘরে আছে।তোমাকেও যেতে বলেছে।ছেলে মাকে দেখেই বলল মা কফি নিয়ে এসো। সমিরণ বলে বউমা তুমি কফি করে আনো ।ছেলে বলল —- বাবা
তুমিতো জানো মায়ের হাতের কফি ছাড়া আমি খেতে পারিনা ।
শুভমএখন থেকে অভ্যাস করো বউয়ের হাতের রান্না।
সামনের সপ্তাহে মা আর আমি শান্তিনিকেতনে চলে যাবো । ওখানেই কিছুদিন আগে একটি ছোট বাড়ি কিনেছি । ঠিক করেছিলাম চাকরি থেকে অবসরে গেলে তোমার মাকে চমকে দিবো । এখন ঠিক করেছি তোমার মাকে নিয়ে একেবারে গিয়ে থাকবো ।
মেয়েটা মুখ ফুলিয়ে বলল দাদা কি তোমাদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করেছে ?
সমীরণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে তুমিও করেছো । শুনো তোমাদের আজকে কিছু কথা বলি । আমার সাথে তোমার মায়ের কুড়ি বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল । তোমরা জানো আমাদের ছিল যৌথ পরিবার ।আমি চাকরি করতাম বেনারসে । তোমার মা থাকতো আমাদের বাড়িতেই সবার সঙ্গে তাই যৌবনে তেমন করে আমি তোমার মাকে নিয়ে নিজের শখ আহ্লাদ মিটাতে পারিনি। আমাদের সময় যৌথ পরিবারের বউরা স্বামীকে নিয়ে একা কোথাও বেড়াতে যেতে পারতো না ।এমন কি দিনের বেলায় দুইজনে একসাথে কথা বলা যেতনা । আমি ছুটিতে বাড়ি গেলেও তোমার মার সাথে রাতেই দেখা হতো ।
কখনো তোমার মায়ের জন্য কিছু কিনে নিয়ে গেলে বাড়ির সদস্যরা নানা কথা শোনাতো । তারপরে একে একে তোমাদের জন্ম হল । তোমারাও বড় হয়েছো ।তোমাদের ভালো স্কুলে পড়ানোর জন্য সেই সময় চাকরির সাথে প্রচুর টিউশনি করেছি। এখন বলবে জন্ম দিয়েছ তাই দায়িত্ব পালন করেছো।তবে তোমার মাকে সব সময় বঞ্চিত করেছি। তাই তোমার মাকে নিয়ে বাড়তি কোন কিছু করার কথা ভাবতেও পারিনি ।পূজায় বোনাস পেলে তোমার মাকে বলতাম দামি একটা শাড়ি কিনতে ।কিন্তু ও বাজারে গিয়ে তোমাদের জন্য কিনে
আনত । সুমি রাগ করলে মা আমাকে বলতো তোমরা বড় হলে শাড়ি কিনে দেবে । তোমাদের রেখে আমরা কখনো বেড়াতে যাইনি।মাঝে মাঝে মার জন্য ফুল
আনতাম । একদিন বলল ফুল এনোনা ।সেই টাকা দিয়ে বাচ্চাদের জন্য চকলেট কিনে এনো। আমি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি । তোমরাও বিয়ে করে সংসারী হয়েছ । অবসরে যাবার পরে লক্ষ্য করলাম তোমার মায়ের অবসর নেই । রান্না তাকে করতে হয় কারণ তোমরা তার হাতের রান্না ছাড়া খাবেনা । তোমার মাকে আমি পছন্দ মতো শাড়ি কিনে দিলে তোমাদের সন্মান নষ্ট হয় ।ফুল আনলে বৌমার ফোন করে বন্ধুদের জানায়।বুড়োর অবসর নিয়ে রস বেড়েছে।। যে ঠাট্টার ভয়ে বিয়ের পর আমি কিছুই করতে পারতামনা সেই ঠাট্টা আমার মেয়ে বৌমা করে ।
জীবনের সবটুকু শেষ করে এখনো যদি অন্যর পছন্দ মতো চলতে হয় তাহলে কি পেলাম এই জীবনে ? তাই আমরা আমাদের মতো থাকবো । তোমাদের ইচ্ছা হলে আমাদের গিয়ে দেখে আসবে । অন্তত জীবনের শেষ দিনগুলো নিজেদের মতো বাঁচতে চাই । আমি আর তোমাদের মা সবসময় চেয়েছি তোমরা ভালো থাকো ।
সুমি ভাবে ঠিক বলেছে মানুষটা । ছেলে মেয়ে সংসারের কথা চিন্তা করতে করতে মানুষটার চাওয়া পাওয়ার কথা ভুলেই
গেছি । এখন বাকি জীবন সবকিছু ভুলে আমাদের কথাই ভাববো ও মনের আনন্দে থাকব।