অপরাজিত (Aparajito) : 03
ফাল্গুন মাসের প্রথম হইতেই স্কুল কম্পাউন্ডের চারিপাশে গাছপালার নতুন পাতা গজাইল। ক্রিকেট খেলার মাঠে বড়ো বাদাম গাছটার রক্তাভ কচি সবুজ পাতা সকালের রৌদ্রে দেখিতে হইল চমৎকার, শীত একেবারে নাই বলিলেই হয়।
বোর্ডিং-এর রাসবিহারীর দল পরামর্শ করিল মাম্জোয়ানে দোলের মেলা দেখিতে যাইতে হইবে। মামূজোয়ানের মেলা এ অঞ্চলের বিখ্যাত মেলা।
অপু খুশির সহিত রাসবিহারীদের দলে ভিড়িল। মাম্জোয়ানের মেলার কথা অনেক দিন হইতে সে শুনিয়া আসিতেছে। তাহা ছাড়া নিশ্চিন্দিপুর ছাড়িয়া পর্যন্ত কোথাও মেলা বা বারোয়ারি আর কখনও দেখা ঘটে নাই।
সুপারিন্টেন্ডেন্ট বিধুবাবু দু-দিনের ছুটি দিলেন। অপু অনেকদিন পরে যেন মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল। ক্রোশ তিনেক পথ-মাঠ ও কাঁচা মাটির রাস্তা। ছোট ছোট গ্রাম, কুমারেরা চাক ঘুরাইয়া কলসি গড়িতেছে। পথের ধারের ছোট দোকানে দোকানদার রেড়ির ফলের বীজ ওজন করিয়া লইতেছে—সজিনা গাছ সব ফুলে ভর্তি—এমন চমৎকার লাগে।…ছুটি-ছাটা ও শনি-রবিবারে সীমাবদ্ধ না হইয়া এই যে জীবনধারা পথের দুইপাশে, দিনে রাত্রে, শত দুঃখে সুখে আকাশ বাতাসের তলে, নিরাবরণ মুক্ত প্রকৃতির সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাতাইয়া চঞ্চল আনন্দে ছুটিয়া চলিয়াছে—এই জীবনধারার সহিত সে নিজেকে পরিচিত করিতে চায়।
মাঠে কাহারা শুকনা খেজুর ডালের আগুনে রস জ্বাল দিতেছে দেখিয়া তাহার ইচ্ছা হইল— সে তাহাদের কাছে গিয়া খানিকক্ষণ রস জ্বাল দেওয়া দেখিবে, বসিয়া বসিয়া শুনিবে উহারা কি কথাবার্তা বলিতেছে।
ননী বলিল, তোকে পাগল বলি কি আর সাধে? দূর, দূর-আর কি দেখবি ওখানে?
অপু অপ্রতিভ মুখে বলিল, আয় না, ওরা কি বলছে শুনি? ওরা কত গল্প জানে, জানিস? আয় না
রাজু রায়ের পাঠশালার সেই দিনগুলি হইতে বয়স্ক লোকের গল্পের ও কথাবার্তার প্রতি তাহার প্রবল মোহ আছে-একটা বিস্তৃততর, অপরিচিত জীবনের কথা ইহাদের মুখে শোনা যায়। অপু ছাড়িয়া যাইতে রাজি নয়—রাসবিহারীর দল অগত্যা তাহাকে ফেলিয়া চলিয়া গেল।
সুশ্রী চেহারার ভদ্রলোকের ছেলে দেখিয়া মুচিরা খুব খাতির করিল। খেজুর রস খাইতে আসিয়াছে ভাবিয়া মাটির নতুন ভাড় ধুইয়া জিরান কাঠের টাটকা রস লইয়া আসিল। ইহাদের কাছে অপু আদৌ মুখচোরা নয়। ঘন্টাখানেকের উপর সে তাহাদের সেখানে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া গুড় জ্বাল দেওয়া দেখিল।
মাম্জোয়ানের মেলায় পৌঁছিতে তাহার হইয়া গেল বেলা বারোটা। প্রকাণ্ড মেলা, ভয়ানক ভিড়; রৌদ্রে তিন ক্রোশ পথ হাঁটিয়া মুখ রাঙা হইয়া গিয়াছে, সঙ্গীদের মধ্যে কাহাকেও সে খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিল না। ক্ষুধা ও তৃষ্ণা দুই-ই পাইয়াছে, ভালো খাবার খাইবার পয়সা নাই, একটা দোকান হইতে সামান্য কিছু খাইয়া এক ঘটি জল খাইল। তাহার পর একটা পাখির খেলার তাঁবুর ফাঁক দিয়া দেখিবার চেষ্টা করিল—ভিতরে কি খেলা হইতেছে। একজন পশ্চিমা লোক হটাইয়া দিতে আসিল।
অপু বলিল, কত করে নেবে খেলা দেখতে?…দুপয়সা দেব-দেখাবে?
লোকটি বলিল, এখন খেলা শুরু হইয়া গিয়াছে, আধঘণ্টা পরে আসিতে।
একটা পানের দোকানে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, যাত্রা কবে বসবে জানো?
বৈকালে লোকের ভিড় খুব বাড়িল। দোকানে দোকানে, বিশেষ করিয়া পানের দোকানগুলিতে খুব ভিড়। খেলা ও ম্যাজিকের তাঁবুগুলির সামনে খুব ঘণ্টা ও জয়ঢাক বাজিতেছে। অপু দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল—একটা বড়ো তাঁবুর বাহিরে আলকাতরা-মাখা জন দুই লোক বাঁশের মাচার উপর দাঁড়াইয়া কৌতূহলী জনতার সম্মুখে খেলার অত্যাশ্চর্যতা ও অভিনবত্বের নমুনাস্বরূপ একটা লম্বা লাল-নীল কাগজের মালা নানা অঙ্গভঙ্গিসহকারে মুখ হইতে টানিয়া বাহির করিতেছে।
সে পাশের একটা লোককে জিজ্ঞাসা করিল, এ খেলা কয়সা জানো?
নিশ্চিন্দিপুরে থাকিতে বাবার বইয়ের দপ্তরে একখানা পুরাতন বই ছিল, তাহার মনে আছে, বইখানার নাম রহস্য লহরী। রুমাল উড়াইয়া দেওয়া, কাটামুণ্ডুকে কথা বলানো, এক ঘণ্টার মধ্যে আম-চারায় ফল ধরানো প্রভৃতি নানা ম্যাজিকের প্রক্রিয়া বইখানাতে ছিল। অপু বই দেখিয়া দু-একবার চেষ্টা করিতে গিয়াছিল, কিন্তু নানা বিলাতি ঔষধের ফর্দ ও উপকরণের তালিকা দেখিয়া, বিশেষ করিয়া –নিশাদল” দ্রব্যটি কি বা তাহা কোথায় পাওয়া যায় ঠিক করিতে না পারিয়া, অবশেষে ছাড়িয়া দেয়।
সে মনে মনে ভাবিল—ওই সব দেখেই তো ওরা শেখে! বাবার সেই বইখানাতে কত ম্যাজিকের কথা লেখা ছিল! নিশ্চিন্দিপুর থেকে আসবার সময় কোথায় যে গেল বইখানা!
চারিধারে বাজনার শব্দ, লোকজনের হাসি-খুশি, খেলো সিগারেটের ধোঁয়া, ভিড়, আলো, সাজানো দোকানের সারি, তাহার মন উৎসবের নেশায় মাতিয়া উঠিল।
একদল ছেলেমেয়ে একখানা গোরুর গাড়ির ছইয়ের ভিতর হইতে কৌতূহল ও আগ্রহে মুখ বাড়াইয়া ম্যাজিকের তাঁবুর জীবন্ত বিজ্ঞাপন দেখিতে দেখিতে যাইতেছে। সকল লোককেই সিগারেট খাইতে দেখিয়া তাহার ইচ্ছা হইল সেও খায়—একটা পানের দোকানে ক্রেতার ভিড়ের পিছনে খানিকটা দাঁড়াইয়া অবশেষে একটা কাঠের বাক্সের উপর উঠিয়া একজনের কাঁধের উপর দিয়া হাতটা বাড়াইয়া দিয়া বলিল, এক পয়সার দাও তো? এই যে এইদিকে—এক পয়সার সিগারেটভালো দেখে দিয়ো-যা ভালো।
একটা গাছের তলায় বইয়ের দোকান দেখিয়া সেখানে দাঁড়াইল। চটের থলের উপর বই বিছানো, দোকানী খুব বুড়া, চোখে সুতাবাঁধা চশমা। একখানা ছবিওয়ালা চটি আরব্য উপন্যাস অপুর পছন্দ হইল—সে পড়ে নাই-কিন্তু দোকানী দাম বলিল আট আনা। হাতে পয়সা থাকিলে সে কিনিত।
বইখানা আর একবার দেখিতে গিয়া হঠাৎ সম্মুখের দিকে চোখ পড়াতে সে অবাক হইয়া গেল। সম্মুখের একটা দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া আছে—পটু! তার নিশ্চিন্দিপুরের বাল্যসঙ্গী পটু।
অপু তাড়াতাড়ি আগাইয়া গিয়া গায়ে হাত দিতেই পটু মুখ ফিরাইয়া তাহার দিকে চাহিল–প্রথমটা যেন চিনিতে পারিল না-পরে প্রায় চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, অপুদা?…এখানে কি করে, কোথা থেকে অপুদা?
অপু বলিল, তুই কোথা থেকে?
-আমার তো দিদির বিয়ে হয়েছে এই লাউখালি। এইখেন থেকে দু-কোশ। তাই মেলা দেখতে এলাম—তুই কি করে এলি কাশী থেকে
অপু সব বলিল। বাবার মৃত্যু, বড়োলোকের বাড়ি, মনসাপোতা স্কুল। জিজ্ঞাসা করিল, বিনিদির বিয়ে হয়েছে মামূজোয়ানের কাছে? বেশ তো–
অপুর মনে পড়িল, অনেকদিন আগে দিদির চড়ইভাতিতে বিনিদিব ভয়ে ভয়ে আসিয়া যোগ দেওয়া। গরিব অগ্রদানী বামুনের মেয়ে, সমাজে নিচু স্থান, নম্র ও ভীরু চোখ দুটি সর্বদাই নামান, অসেই সন্তুষ্ট।
দুজনেই খুব খুশি হইয়াছিল। অপু বলিল—মেলার মধ্যে বড্ড ভিড় ভাই, চল কোথাও একটু ফাঁকা জায়গাতে গিয়ে বসি—অনেক কথা আছে তোর সঙ্গে।
বাহিরের একটা গাছতলায় দুজনে গিয়া বসিল—তাহাদের বাড়িটা কিভাবে আছে? …বানুদি কেমন?…নেড়া, পটল, নীলু, সতুদা ইহারা?…ইছামতী নদীটা? পটু সব কথার উত্তর দিতে পারিল না, পটুও আজ অনেকদিন গ্রামছাড়া। পটুর আপন মা নাই, সত্য। অপুরা দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাওয়ার পর হইতে সে সঙ্গীহীন হইয়া পড়িয়াছিল, দিদির বিবাহের পরে বাড়িতে একেবারেই মন টিকিল না। কিছুদিন এখানে ওখানে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল পড়াশুনার চেষ্টায়। কোথাও সুবিধা হয় নাই। দিদিব বাড়ি মাঝে মাঝে আসে, এখানে থাকিয়া যদি পড়াশুনার সুযোগ হয়, সেই চেষ্টায় আছে। অনেকদিন গ্রামছাড়া, সেখানকার বিশেষ কিছু খবর জানে না। তবে শুনিয়া আসিয়াছিল শীঘ্রই বানীদিব বিবাহ হইবে, সে তিন বছর আগেকার কথা, এতদিন নিশ্চয় হইয়া গিয়াছে।
পটু কথা বলিতে বলিতে অপুর দিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিতেছিল।
রূপকথার রাজপুত্রের মতো চেহারা হইয়া উঠিয়াছে অপুদার।…কি সুন্দর মুখ!…অপুদার কাপড়চোপড়ের ধরনও একেবারে পরিবর্তিত হইয়াছে।
অপু তাহাকে একটা খাবারের দোকানে লইয়া গিয়া খাবার খাওয়াইল, বাহিরে আসিয়া বলিল, সিগারেট খাবি? তাহাকে ম্যাজিকের তাঁবুর সামনে আনিয়া বলিল, ম্যাজিক দেখিস নি তুই? আয় তোকে দেখাই—পরে সে আট পয়সার দুইখানা টিকিট কাটিয়া উৎসুক মুখে পটুকে লইয়া ম্যাজিকের তাঁবুতে ঢুকিল।
ম্যাজিক দেখিতে দেখিতে অপু জিজ্ঞাসা করিল, ইয়ে, আমরা চলে এলে রানুদি বলত নাকি কিন্তু আমাদের আমার কথা? নাঃ
খুব বলিত। পটুর কাছে কতদিন জিজ্ঞাসা করিয়াছে অপু তাহাকে কোনো পত্র লিখিয়াছে কি, তাহাদের কাশীর ঠিকানা কি? পটু বলিতে পারে নাই। শেষে পটু বলিল, বুড়ো নরোত্তম বাবাজী তোর কথা ভারি বলতো!
অপুর চোখ জলে ভরিয়া আসিল। তাহার বোষ্টমদাদু এখনও বাঁচিয়া আছে?—এখনও তাহার কথা ভুলিয়া যায় নাই? মধুর প্রভাতের পদ্মফুলের মতো ছিল দিনগুলা—আকাশ ছিল নির্মল, বাতাস কি শান্ত, নবীন উৎসাহ ভরা মধুচ্ছন্দ! মধুর নিশ্চিন্দিপুর! মধুর ইছামতীর কলমর্মর!…মধুর তাহার দুঃখী দিদি দুর্গার স্নেহভরা ডাগর চোখের স্মৃতি!…কতদূর, কত দুরে চলিয়া গিয়াছে সে দিনের জীবন। খেলাঘরের দোকানে নোনা-পাতার পান বিক্রি, সেই সতুদার মাকাল ফল চুরি করিয়া দৌড় দেওয়া!…
একবার একখানা বইতে সে পড়িয়াছিল দেবতার মায়ায় একটা লোক স্নানের সময় জলে ডুব দিয়া পুনরায় উঠিবার যে সামান্য ফঁকটুকু তাহারই মধ্যে ষাট বৎসরের সুদীর্ঘ জীবনের সকল সুখ দুঃখ ভোগ করিয়াছিল—যেন তাহার বিবাহ হইল, ছেলেমেয়ে হইল, তাহারা সব মানুষ হইল, কতক বা মরিয়া গেল, বাকিগুলির বিবাহ হইল, নিজেও সে বৃদ্ধ হইয়া গেল–হঠাৎ জল হইতে মাথা তুলিয়া দেখে—কোথাও কিছু নয়, সে যেখানে সেখানেই আছে, কোথায় বা ঘরবাড়ি, বা ছেলেমেয়ে!…
গল্পটা পড়িয়া পর্যন্ত মাঝে মাঝে সে ভাবে তাহারও ওরকম হয় না? এক-এক সময় তাহার মনে হয় হয়তো বা তাহার হইয়াছে। এ সব কিছু না-স্বপ্ন। বাবার মৃত্যু, এই বিদেশে, এই স্কুলে পড়া–সব স্বপ্ন। কবে একদিন ঘুম ভাঙিয়া উঠিয়া দেখিবে সে নিশ্চিন্দিপুরের বাড়িতে তাহাদের সেই বনের ধারের ঘরটাতে আষাঢ়ের পড়ন্ত বেলায় ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল-সন্ধ্যার দিকে পাখির কলরবে জাগিয়া উঠিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে ভাবিতেছে, কি সব হিজিবিজি অর্থহীন স্বপ্নই না সে দেখিয়াছে ঘুমের ঘোরে!…বেশ মজা হয় আবার তাহার দিদি ফিরিয়া আসে, তাহার বাবা, তাহাদের বাড়িটা।
একদিন ক্লাসে সত্যেনবাবু একটা ইংরেজ কবিতা পড়াইতেছিলেন, নামটা গ্রেভস্ অফ এ হাউসহোল্ড। নির্জনে বসিয়া সেটা আবৃত্তি করিতে করিতে তাহার চোখ দিয়া জল পড়ে। ভাইবোনেরা একসঙ্গে মানুষ, এক মায়ের কোলেপিঠে, এক ছেঁড়া কাঁথার তলে। বড়ো হইয়া জীবনের ডাকে কে কোথায় গেল চলিয়া-কাহারও সমাধি সমুদ্রে, কাহারও কোন্ অজানা দেশের অপরিচিত আকাশের তলে, কাহারও বা ফুল-ফোটা কোন্ গ্রাম্য বনের ধারে।
আপনা-আপনি পথ চলিতে চলিতে এই সব স্বপ্নে সে বিভোর হইয়া যায়। কত কথা যেন মনে ওঠে! যত লোকের দুঃখের দুর্দশার কাহিনী। নিশ্চিন্দিপুরের জানালার ধারে বসিয়া বাল্যের সে ছবি দেখা–সেই বিপন্ন কর্ণ, নির্বাসিতা সীতা, দরিদ্র বালক অশ্বত্থামা, পরাজিত রাজা দুর্যোধন, পল্লীবালিকা জোয়ান। বুঝাইয়া বলিবার বয়স তাহার এখনও হয় নাই; ভাবকে সে ভাষা দিতে জানে না—অল্পদিনের জীবনে অধীত সমুদয় পদ্য ও কাহিনী অবলম্বন করিয়া সে যেভাবে জগৎকে গড়িয়া তুলিয়াছে–অনাবিল তরুণ মনের তাহা প্রথম কাব্য—তার কাঁচা জীবনে সুখে দুঃখে, আশায় নিরাশায় গাঁথা বনফুলের হার।—প্রথম উচ্চারিত ঋক্মন্ত্রের কারণ ছিল যে বিস্ময় যে আনন্দতাহাদেরই সগোত্র, তাহাদেরই মতো ঋদ্ধিশীল ও অবাচ্য সৌন্দর্যময়।
রাগরক্ত সন্ধ্যার আকাশে সত্যের প্রথম শুকতারা।
কে জানে ওর মনের সে সব গহন গভীর গোপন রহস্য? কে বোঝে?
ম্যাজিকের তাঁবু হইতে বাহির হইয়া দুজনে মেলার মধ্যে ঢুকিল। বোর্ডিং-এর একটি ছেলের সঙ্গেও তাহার দেখা হইল না, কিন্তু তাহার আমোদর তৃষ্ণা এখনও মেটে নাই, এখনও ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখিবার ইচ্ছা। বলিল–চ পটু, দেখে আসি যাত্ৰা বসবে কখন-যাত্রা না দেখে যাস্ নে যেন।
পটু বলিল, অপুদা কোন ক্লাসে পড়িস তুই?…
অপু অন্যমনস্কভাবে বলিল, ওই যে ম্যাজিক দেখলি, ও আমার বাবার একখানা বই ছিল, তাতে সব লেখা ছিল, কি করে করা যায়—জিনিস পেলে আমিও করতে পারি–
–কোন্ ক্লাসে তুই—
–ফোর্থ ক্লাসে। একদিন আমাদের স্কুলে চল, দেখে আসবি দেখবি কত বড়ো স্কুল–রাত্রে আমার কাছে থাকবি এখন একটু থামিয়া বলিল—সত্যি এত জায়গায় তো গেলাম, নিশ্চিন্দিপুরের মতো আর কিছু লাগে না—কোথাও ভালো লাগে না–
–তোরা যাবি নে আর সেখানে? সেখানে তোদর জন্যে সবাই দুঃখ করে, তোর কথা তো সবাই বলে-পরে সে হাসিয়া বলিল, অপুদা, তোর কাপড় পরবার ধরন পর্যন্ত বদলে গেছে, তুমি আর সেই নিশ্চিন্দিপুরের পাড়াগেয়ে ছেলে নেই–
অপু খুব খুশি হইল। গর্বের সহিত গায়ের শাটটা দেখাইয়া বলিল, কেমন রংটা, না? ফার্স্ট ক্লাসের রমাপতিদার গায়ে আছে, তাই দেখে এটা কিনেছি—দেড় টাকা দাম।
সে একথা বলিল না যে শাটটা সে অগ্রপশ্চাৎ না ভাবিয়া অপরের দেখাদেখি দরজির দোকান হইতে পারে কিনিয়াছে, দরজির অনবরত তাগাদা সত্ত্বেও এখনও দাম দিয়া উঠিতে পারিতেছে না।
বেলা বেশ পড়িয়া আসিয়াছে। আলকাতরা মাখা জীবন্ত বিজ্ঞাপনটি বিকট চিৎকার করিয়া লোক জড়ো করিতেছে।
পটু সন্ধ্যার কিছু পূর্বে দিদির বাড়ির দিকে রওনা হইল। অপুর সহিত এতকাল পরে দেখা হওয়াতে সে খুব খুশি হইয়াছে। কোথা হইতে অপুদা কোথায় আসিয়া পড়িয়াছে! তবুও স্রোতের তৃণের মতো ভাসিতে ভাসিতে অপুদা আশ্রয় খুঁজিয়া পাইয়াছে, কিন্তু এই তিন বৎসরকাল সে-ও তো ভাসিয়াই বেড়াইতেছে একরকম, তাহার কি কোন উপায় হইবে না?
সন্ধ্যার পর বাড়ি পৌঁছিল। তাহার দিদি বিনির বিবাহ বিশেষ অবস্থাপন্ন ঘরে হয় নাই, মাটির বাড়ি, খড়ের চাল, খানদুই-তিন ঘর। পশ্চিমের ভিটায় পুরানো আমলের কোঠা ভাঙিয়া পড়িয়া আছে, তাহারই একটা ঘরে বর্তমানে রান্নাঘর, ছাদ নাই, আপাতত খড়ের ছাউনি, একখানা চাল ইটের দেওয়ালের গায়ে কাতভাবে বানো।
বিনি ভাইকে খাবার খাইতে দিল। বলিল–কি রকম দেখলি মেলা?…সে এখন আঠারো-উনিশ বছরের মেয়ে, বিশেষ মোেটাসোটা হয় নাই, সেই রকমই আছে। গলার স্বর শুধু বদলাইয়া গিয়াছে।
পটু হাসিমুখে বলিল, আজ কি হয়েছে জানিস দিদি, অপুর সঙ্গে দেখা হয়েচে-মেলায়।
বিনি বিস্ময়ের সুরে বলিল, অপু! সে কি করে—কোথা থেকে—
পরে পটুর মুখে সব শুনিয়া সে অবাক হইয়া গেল। বলি—বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে–আহা সঙ্গে করে আনলি নে কেন?…দেখতে বড়ো হয়েছে?…
—সে অপুই আর নেই। দেখলে চেনা যায় না। আরও সুন্দর হয়েছে দেখতে—তবে সেই রকম পাগলা আছে এখনওভারি সুন্দর লাগে—এমন হয়েচে।…এতকাল পরে দেখা হয়ে আমার মেলায় যাওয়াই আজ সার্থক হয়েছে। খুড়িমা মনসাপোত থাকে বললে।
—সে এখেন থেকে কত দূর?…
—সে অনেক, রেলে যেতে হয়। মাম্জোয়ান থেকে নদশ কোশ হবে।
বিনি বলিল, আহা একদিন নিয়ে আসিস না অপুকে, একবার দেখতে ইচ্ছে করে–
ছাদ-ভাঙা রান্নাবাড়ির বোয়াকে পটু খাইতে বসিল। বিনি বলিল, তোর চত্তি মশায়কে একবার বলে দেখিস দিকি কাল? বলিস বছর তিনেক থাকতে দাও, তার পর নিজের চেষ্টা নিজে করব–
পটু বলিল, বছর তিনেকের মধ্যে পড়া শেষ হয়ে যাবে না-হুসাত বছরের কমে কি পাশ দিতে পারব?…অপুদা বাড়িতে পড়ে কত লেখাপড়া জানত আমি তো তাও পড়ি নি, তুমি একবার চকত্তি মশায়কে বলল না দিদি?
বিনি বলিল—আমিও বলব এখন। বড্ড ভয় করে-শাহে আবার বড়ঠাকুরঝি হাত-পা নেড়ে ওঠে–বঠাকুরঝিকে একবার ধরতে পারিস?—আমি কথা কইলে তো কেউ শুনবে না, ও যদি বলে তবে হয়
পটু যে তাহা বোঝে না এমন নয়। অর্থাভাবে দিদিকে ভালো পাত্রের হাতে দিতে পারা যায় নাই, দোজবর, বয়স বেশি। ওপক্ষের গুটিকতক ছেলেমেয়েও আছে, দুই বিধবা ননদ বর্তমান, ইহারা সকলেই তাহার দিদির প্রভু। ভালোমানুষ বলিয়া সকলেই তাহার উপর দিয়া যোল আনা প্রভুত্ব চালাইয়া থাকে। উদয়াস্ত খাটিতে হয়, বাড়ির প্রত্যেকেই বিবেচনা করে তাহাকে দিয়া ব্যক্তিগত ফরমাইশ খাটাইবার অধিকার উহাদের প্রত্যেকেরই আছে, কাজেই তাহাকে কেহ দয়া করে না।
অনেক রাত্রে বিনির স্বামী অর্জুন চক্রবর্তী বাড়ি ফিরিল। মাম্জোয়ানের বাজারে তাহার খাবারের দোকান আছে, আজকাল মেলার সময় বলিয়া রাত্রে একবার আহার করিতে আসে মাত্র। খাইয়াই আবার চলিয়া যায়, রাত্রেও কেনাবেচা হয়। লোকটি ভারি কৃপণ! বিনি রোজই আশা করে—ছোট ভাইটা এখানে কয়দিন হইল আসিয়াছে, এ পর্যন্ত কোন দিন একটা রসগোল্লাও তাহার জন্য হাতে করিয়া বাড়ি আসে নাই, অথচ নিজেরই তো খাবারের দোকান। এ রকম লোকের কাছে ভাইয়ের সম্বন্ধে কি কথাই বা সে বলিবে!
তবুও বিনি বলিল। স্বামীকে ভাত বাড়িয়া দিয়া সে সামনে বসিল, ননদেরা কেহ রান্নাঘরে নাই, এ ছাড়া আর সুযোগ ঘটিবে না। অর্জুন চক্রবর্তী বিস্ময়ের সুবে বলিল—পটল? এখানে থাকবে?…
বিনি মরীয়া হইয়া বলিল—ওই ওর সমান অপূর্ব বলে ছেলে—আমাদের গাঁয়ের, সেও পড়ছে। এখেনে যদি থাকে তবে এই মামূজোয়ান ইস্কুলে গিয়ে পড়তে পারে—একটা হিল্লে হয়—
অর্জুন চক্রবর্তী বলিল—ওসব এখন হবে-টবে না, দোকানের অবস্থা ভালো নয়, দোলের বাজারে খাজনা বেড়ে গিয়েছে দুনো, অথচ দোকানে আয় নেই। মাম্জোয়ানে খটি খুলে চার আনা সের ছানা-তাই বিকুচ্ছে দশ আনায়, তা লাভ করব, না খাজনা দেব, না মহাজন মেটাব? মেলা দেখে বাড়ি চলে যাক—ও সব ঝক্কি এখন নেওয়া বললেই নেওয়া।
বিনি খানিকটা চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল—বোশেক মাসের দিকে আসতে বলবো?
অর্জুন চক্রবর্তী বলিল—ববাশেখ মাসের বাকিটা আর কি—আর মাস দেড়েক বই তো নয়! …ওসব এখন হবে না, ওসব নিয়ে এখন দিক কোরো না-ভালো লাগে না, সারাদিন খাটুনির পর–বলে নিজের জ্বালায় তাই বাঁচিনে তা আবার—হুঁ—
বিনি আর কিছু বলিতে সাহস করিল না। মনে খুব কষ্ট হইল—ভাইটা আশা করিয়া আসিয়াছিল–দিদির বাড়ি থাকিয়া পড়িতে পাইবে! বলিল—আচ্ছা, অপু কেমন করে পড়ছে রে?
পটু বলিল–সে যে এস্কলারশিপ পেয়েচেতাতেই খরচ চলে যায়।
বিনি বলিল—তুই তা পাস নে? তাহলে তোরও তো–
পটু হাসিয়া বলিলনা পড়েই এস্কলারশিপ পাবোবা তো—পাশ দিলে তবে পাওয়া যাবে, সে সব আমার হবে না, অপুদা ভালো ছেলে-ও কি আর আমার হবে?…
বিনি বলিল—তুই অপুকে একবার বলে দেখবি? ও ঠিক একটা কিছু তোকে জোগাড় করে দিতে পারে।
দুজনে পরামর্শ করিয়া তাহাই অবশেষে যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করিল।
সর্বজয়া পিছু পিছু উঠিয়া বড়োঘরের দরজাটা বন্ধ করিয়া দিতে আসিল, সম্মুখের উঠানে নামিয়া বলিল—মাঝে মাঝে এসো বৌমা, বাড়ি আগলে পড়ে থাকতে হয়, নইলে দুপুর বেলা এক একবার ভাবি তোমাদের ওখানে একটু বেড়িয়ে আসি। সেদিন বা গয়লাপাড়ায় চুরি হয়ে যাওয়ার পর বাড়ি ফেলে যেতে ভরসা পাই নে।
তেলি-বাড়ির বড়ো বধু বেড়াইতে আসিয়াছিল, তিন বৎসরের ছোট মেয়েটির হাত ধরিয়া হাসিমুখে চলিয়া গেল।
এতক্ষণ সর্বজয়া কেশ ছিল। ইহারা সব দুপুরের পর আসিয়াছিল, গল্পগুজবে সময়টা তবুও একরকম কাটিল। কিন্তু একা একা সে তো আর থাকিতে পারে না। শুধুই সব সময়ই, দিন নাই রাত্রি নাই—অপুর কথা মনে পড়ে। অপুর কথা ছাড়া অন্য কোন কথাই তাহার মনে স্থান পায় না।
আজ সে গিয়াছে এই পাঁচ মাস হইল। কত শনিবার কত ছুটির দিন চলিয়া গিয়াছে এই পাঁচ মাসের মধ্যে। সর্বজয়া সকালে উঠিয়া বসিয়াছে—আজ দুপুরে আসিবে। দুপুর চলিয়া গেলে ভাবিয়াছে বৈকালে আসিবে। অপু আসে নাই।
অপুর কত জিনিস ঘরে পড়িয়া আছে, কত স্থান হইতে কত কি সংগ্রহ করিয়া আনিয়া রাখিয়া গিয়াছে—অবোধ পাগল ছেলে! শুন্য ঘরের দিকে চাহিয়া সর্বজয়া হাঁপায়, অপুর মুখ মনে আনিবার চেষ্টা করে। এক একবার তাহার মনে হয় অপুর মুখ সে একেবারে ভুলিয়া গিয়াছে। যতই জোর করিয়া মনে আনিবার চেষ্টা করে ততই সে মুখ অস্পষ্ট হইয়া যায়…অপুর মুখের আদলটা মনে আনিলেও ঠোঁটের ভঙ্গিটা ঠিক মনে পড়ে না, চোখের চাহনিটা মনে পড়ে না…সর্বজয়া একেবারে পাগলের মতো হইয়া ওঠে—-অপুর, তাহার অপুর মুখ সে ভুলিয়া যাইতেছে!
কেবলই অপুর ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। অপু কথা বলিতে জানিত না, কোন্ কথার কি মানে হয় বুঝিত না। মনে আছে.নিশ্চিন্দিপুরের বাড়িতে থাকিতে একবার রান্নাবাড়ির দাওয়ায় কাঁঠাল ভাঙিয়া ছেলেমেয়েকে দিতেছিল। দুর্গা বাটি পাতিয়া আগ্রহের সহিত কাঁঠাল-ভাঙা দেখিতেছে, অপু দুর্গার বাটিটা দেখাইয়া হাসিমুখে বলিয়া উঠিল—দিদি কাটালের বড়ো প্রভু, না মা? সর্বজয়া প্রথমটা বুঝিতে পারে নাই, শেষে বুঝিয়াছিল, দিদি কাঁঠালের বড়ো ভক্ত এ কথাটা বুঝাইতে ভক্ত কথাটার স্থানে প্রভু ব্যবহার করিয়াছে। তখন অপুর বয়স নয় বৎসরের কম নয় অথচ তখনও সে কাজে-কথায় নিতান্ত ছেলেমানুষ।
একবার নতুন পরনের কাপড় কোথা হইতে ছিড়িয়া আসিবার জন্য অপু মার খাইয়াছিল। কতদিনের কথা, তবুও ঠিক মনে আছে। হাঁড়িতে আমসত্ত্ব, কুলচুর রাখিবার জো ছিল না, অপু কোন্ ফাঁকে ঢাকনি খুলিয়া চুরি করিয়া খাইবেই। এই অবস্থায় একদিন ধরা পড়িয়া যায়, তখনকার সেই ভয়ে হোট হইয়া যাওয়া রাঙা মুখখানি মনে পড়ে। বিদেশে একা কত কষ্টই হইতেছে, কে তাহাকে সেখানে বুঝিতেছে!
আর একদিনের কথা সে কখনও ভুলিবে না। অপুর বয়স যখন তিন বৎসর, তখন সে একবার হারাইয়া যায়। খানিকটা আগে সম্মুখের উঠানের কাঁঠালতলায় বসিয়া খেলা করিতে তাহাকে দেখা গিয়াছে, ইহারই মধ্যে কোথায় গেল!…পাড়ায় কাহারও বাড়িতে নাই, পিছনের বাঁশবনেও নাই—চারিধারে খুঁজিয়া কোথাও অপুকে পাইল না। সর্বজয়া কাঁদিয়া আকুল হইল—কিন্তু যখন হরিহর বাড়ির পাশের বাঁশতলার ডোবাটা খুঁজিবার জন্য ও-পাড়া হইতে জেলেদের ডাকিয়া আনাইল, তখন তাহার আর কান্নাকাটি রহিল না। সে কেন কাঠের মতো হইয়া ডোবার পাড়ে দাঁড়াইয়া জেলেদের জাল ফেলা দেখিতে লাগিল। পাড়াসুদ্ধ লোক ভাঙিয়া পড়িয়াছিল—ডোবার পাড়ে অর জেলে টানাজালের বাঁধন খুলিতেছিল, সর্বজয়া ভাবিল অক্রুর মাঝিকে চিরকাল সে নিরীহ বলিয়া জানে, ভালো মানুষের মতো কতবার মাছ বেঁচিয়া গিয়াছে তাহাদের বাড়ি—সে সাক্ষাৎ যমের বাহন হইয়া আসিল কি করিয়া? শুধু অর মাঝি নয়, সবাই যেন যমদূত অন্য অন্য লোকেরা যাহারা মজা দেখিতে দুটিয়াছে, তাহারা—এমন কি তাহার স্বামী পর্যন্ত। সেই তো গিয়া ইহাদের ডাকিয়া আনিয়াছে। সর্বজয়ার মনে হইতেছিল যে, ইহারা সকলে মিলিয়া তাহার বিরুদ্ধে ভিতরে ভিতরে কি একটা ষড়যন্ত্র আঁটিয়াছে—কোন হৃদয়হীন নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্র।
ঠিক সেই সময়ে দুর্গা অপুকে খুঁজিয়া আনিয়া হাজির করিল। অপু নাকি নদীর ধারের পথ দিয়া হন্ হন্ করিয়া হাঁটিয়া একা একা সোনাডাঙার মাঠের দিকে যাইতেছিল, অনেকখানি চলিয়া গিয়াছিল। তাহার পর ফিরিতে গিয়া বোধ হয় পথ চিনিতে পারে নাই। বাড়ির কাঁটাল-তলায় বসিয়া
খেলা করিতে করিতে কখন কোন ফাঁকে বাহির হইয়া গিয়াছে, কেহ জানে না।
যখন সকলে যে-যাহার বাড়ি চলিয়া গেল, তখন সর্বজয়া স্বামীকে বলিল—এ ছেলে কোনদিন সংসারী হবে না, দেখে নিয়ো–
হরিহর বলিল—কেন?…তা ও-রকম হয়, ছেলেমানুষ গিয়েই থাকে–
সর্বজয়া বলিল—তুমি পাগল হয়েছ!…তিন বছর বয়েসে অন্য ছেলে বাড়ির বাইরে পা দেয় না, আর ও কিনা গা ছেড়ে, বাঁশবন, মাঠ ভেঙে গিয়েছে সেই সোনাডাঙার মাঠের রাস্তায়। তাও ফেরবার নাম নেই–হন্ হন্ করে হেঁটেই চলেছে। কখখনো সংসারে মন দেবে না, তোমাকে বলে দিলাম-এ আমার কপালেই লেখা আছে!
কত কথা সব মনে পড়ে নিশ্চিন্দিপুরের বাড়ির কথা, দুর্গার কথা। এ জায়গা ভালো লাগে, এখন মনে হয়, আবার যদি নিশ্চিন্দিপুরে ফিরিয়া যাওয়া সম্ভব হইত! একদিন যে-নিশ্চিন্দিপুর ছাড়িয়া আসিতে উৎসাহের অবধি ছিল না, এখন তাহাই যেন রূপকথার রাজ্যের মতো সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারকার ধরা-ছোঁয়ার বাহিরের জিনিস হইয়া পড়িয়াছে! ভাবিতে ভাবিতে প্রথম বসন্তের পুষ্পসুবাসমধুর বৈকাল বহিয়া যায়, অলস অস্ত-আকাশে কত রং ফুটিয়া আবার মিলাইয়া যায়, গাছপালায় পাখি ডাকে। এ রকম একদিন নয়, কতদিন হইয়াছে।
কোন কিছু ভালোমন্দ জিনিস পাইলেই সেটুকু সর্বজয়া ছেলের জন্য তুলিয়া রাখে। কুণ্ডুদের বাড়ির বিবাহের তত্তে সন্দেশ আসিলে সর্বজয়া প্রাণ ধরিয়া তাহার একটা খাইতে পারে নাই। ছেলের জন্য তুলিয়া রাখিয়া রাখিয়া অবশেষে যখন হাঁড়ির ভিতর পচিয়া উঠিল তখন ফেলিয়া দিতে হইল। পৌষপার্বণের সময় হয়তো অপু বাড়ি আসিবে, পিঠা খাইতে ভালোবাসে, নিশ্চয় আসিবে। সর্বজয়া চাল কুটিয়া সমস্ত আয়োজন ঠিক করিয়া রাখিয়া বসিয়া রহিল—কোথায় অপু?
এক সময় তাহার মনে হয়, অপু আর সে অপু নাই। সে যেন কেমন হইয়া গিয়াছে, কই অনেকদিন তো সে মাকে ই-উ-উ করিয়া ভয় দেখায় নাই, অকারণে আসিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরে নাই, একোণে কোণে লুকাইয়া দুষ্টুমি-ভরা হাসিমুখে উকি মারে নাই, যাহা তাহা বলিয়া কথা ঢাকিতে যায় নাই! ভাবিয়া কথা বলিতে শিখিয়াছে—এসব সর্বজয়া পছন্দ করে না। অপুর ছেলেমানুষির জন্য সর্বজয়ার মন তৃষিত হইয়া থাকে, অপু না বাড়ুক, সে সব সময়ে তাহার উপরে একান্ত নির্ভরশীল ছোট্ট খোকাটি হইয়া থাকুক—সবর্জয়া যেন মনে মনে ইহাই চায়। কিন্তু তাহার অপু যে একেবারে বদলাইয়া যাইতেছে!…
অপুর উপর মাঝে মাঝে তাহার অত্যন্ত রাগ হয়। সে কি জানে না—তাহার মা কি রকম ছটফট করিতেছে বাড়িতে! একবারটি কি এতদিনের মধ্যে আসিতে নাই? ছেলেবেলায় সন্ধ্যার পর এ-ঘর হইতে ও-ঘরে যাইতে হইলে মায়ের দরকার হইত, মা খাওয়াইয়া না দিলে খাওয়া হইত নাএই সেদিনও তো। এখন আর মাকে দরকার হয় না—না? বেশ—তাহারও ভাবিবার দায় পড়িয়া গিয়াছে, সে আর ভাবিবে না। বয়স হইয়া আসিল, এখন ইষ্টচিন্তা করিয়া কাল কাটাইবার সময়, ছেলে হইয়া স্বর্গে ধ্বজা তুলিবে কি না!
কিন্তু শীঘ্রই সর্বজয়া আবিষ্কার করিল—ছেলের কথা না ভাবিয়া সে একদণ্ড থাকিতে পারে। এতদিন সে ছেলের কথা প্রতিদিনের প্রতিমুহূর্তে ভাবিয়া আসিয়াছে। অপুর সহিত অসহযোগ করিলে জীবনটাই যেন ফাঁকা, অর্থহীন, অবলম্বনশূন্য হইয়া পড়ে—তাহার জীবনে আর কিছুই নাই—এক অপু ছাড়া!…
এক একদিন নির্জন দুপুর বেলা ঘরে বসিয়া হাউ হাউ করিয়া কাঁদে।
সে দিন বৈকালে সে ঘরে বসিয়া কার্পাস তুলার বীজ ছাড়াইতেছিল, হঠাৎ সম্মুখের ঘোট ঘুলঘুলি জানালার ফাঁক দিয়া বাড়ির সামনের পথের দিকে তাহার চোখ পড়িল। পথ দিয়া কে যেন যাইতেছেমাথার চুল ঠিক যেন অপুর মতো, ঘন কালো, বড়ো বড়ো ঢেউখেলানো, সর্বজয়ার মনটা হঁাৎ করিয়া উঠিল। মনে মনে ভাবিল—এ অঞ্চলের মধ্যে এ রকম চুল তো কখনও কারও দেখি নি কোনদিন—সেই শত্তুরের মতো চুল অবিকল!…
তাহার মনটা কেমন উদাস অনামনস্ক হইয়া যায়, তুলার বীজ ছাড়াইতে আর আগ্রহ থাকে না।
হঠাৎ ঘরের দরজায় কে যেন টোকা দিল। তখনই আবার মৃদু টোকা। সর্বজয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া দোর খুলিয়া ফেলে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করিতে পারে না।
অপু দুষ্টুমি-ভরা হাসিমুখে দাঁড়াইয়া আছে। নিচু হইয়া প্রণাম করিবার আগেই সর্বজয়া পাগলের মতো ছুটিয়া গিয়া ছেলেকে জড়াইয়া ধরিল।
অপু হাসিয়া বলিল—টের পাও নি তুমি, না মা? আমি ভাবলাম আস্তে আস্তে উঠে দরজায় টোকা দেবো।
সে মাম্জোয়ানেব মেলা দেখিতে আসিয়া একবার বাড়িতে না আসিয়া থাকিতে পারে নাই। এত নিকটে আসিয়া মার সঙ্গে দেখা হইবে না! পুলিনের নিকট রেলভাড়া ধার লইয়া তবে আসিয়াছে। একটা পুটলি খুলিয়া বলিল, তোমার জন্য উঁচ আর গুলিসুতো এনেচি-আর এই দ্যাখো কেমন কাঁচা পাপর এনেছি মুগের ডালের—সেই কাশীতে তুমি ভেজে দিতে!
অপুর চেহারা বদলাইয়া গিয়াছে। অন্য ধরনের জামা গায়ে কি সুন্দর মানাইয়াছে! সর্বজয়া বলে, বেশ জামাটা—এবার বুঝি কিনেছিস?
মার দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছে দেখিয়া অপু খুব খুশি। জামাটা ভালো করিয়া দেখাইয়া বলিল— সবাই বলে জামাটার রং চমৎকার হয়েছে চাঁপাফুলের মতো হবে ধুয়ে এলে—এই তো মোটে কোরা।
বোর্ডিং এ গিয়া অপু এই কয় মাস মাস্টার ও ছাত্রদের মধ্যে যাহাকেই মনে মনে প্রশংসা করে, কতকটা নিজের জ্ঞাতসারে কতকটা অজ্ঞাতসারে তাহারই হাবভাব, কথা বলিবাব ভঙ্গি নকল করিয়াছে। সত্যেনবাবুর, রমাপতির, দেবব্রতের, নতুন আঁকের মাস্টারের! সর্বজয়ার যেন অপুকে নতুন নতুন ঠেকে। পুরাতন অপু যেন আর নাই। অপু তো এ রকম মাথা পিছনের দিকে হেলাইয়া কথা বলিত না? সে তো পকেটে হাত পুরিয়া এ ভাবে সোজা হইয়া দাঁড়াইত না?
সন্ধ্যার সময় মায়ের রাঁধিবার স্থানটিতে অপু পিঁড়ি পাতিয়া বসিয়া গল্প করে। সর্বজয়া আজ অনেকদিন পরে রাত্রে রাঁধিতে বসিয়াছে।–সেখানে কত ছেলে একসঙ্গে থাকে? এক ঘবে কজন? দু-বেলাই মাছ দেয়? পেট ভরিযা ভাত দেয় তো? কি খাবার খায় সে বৈকালে? কাপড় নিজে কাচিতে হয়? সে তাহা পাবে তো!-পড়াশুনার কথা সর্বজয়া জিজ্ঞাসা করিতে জানে না, শুধু খাওয়ার কথাই জিজ্ঞাসা করে। অপুর হাসিতে, ঘাড় দুলুনিতে, হাত-পা নাড়াতে, ঠোঁটের নিচের ভঙ্গিতে সর্বজয়া আবার পুরানো অপু, চিরপরিচিত অপুকে ফিরিয়া পায়। বুকে চাপিতে ইচ্ছা করে। সে অপুর গল্প শোনে না, শুধু মুখের দিকেই চাহিয়া থাকে।
–হাতে পায়ে বল পেলাম মা, এক এক সময় মনে হত-অপু বলে কেউ ছিল না, ও যেন স্বপ্ন দেখিচি, আবার ভাবতাম-না, সেই চোখ, টুকটুকে ঠোঁট, মুখের তিল—স্বপ্ন নয়, সত্যিই তো–রাঁধতে বসেও কেবল মনে হয় মা, অপুর আসা স্বপ্ন হয় তো, সব মিথ্যে—তাই কেবল ওর মুখেই চেয়ে ঠাউরে দেখি
অপু চলিয়া যাইবার কয়েকদিন পরে সর্বজয়া তেলিগিন্নির কাছে গল্প করিয়াছিল।
পরদিনটাও অপু বাড়ি রহিল।
যাইবার সময় মাকে বলিল—মা, আমাকে একটা টাকা দাও না? কতকগুলো ধার আছে এ মাসে, শোধ করব, দেবে?
সর্বজয়ার কাছে টাকা ছিল না, বিশেষ কখনও থাকে না। তেলিরা ও কুণ্ডুরা জিনিসপত্রটা, কাপড়খানা, সিধাটা—এই রকমই দিয়া সাহায্য করে। নগদ টাকাকড়ি কেহ দেয় না। তবু ছেলের পাছে কষ্ট হয় এজন্য সে তেলিগিন্নির নিকট হইতে একটা টাকা ধার করিয়া আনিয়া ছেলের হাতে দিল।
সন্ধ্যার আগে অপু চলিয়া গেল, ক্রোশ দুই দুরে স্টেশন, সন্ধ্যার পরেই ট্রেন।