Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অন্তর্জলী যাত্রা || Kamal Kumar Majumdar » Page 3

অন্তর্জলী যাত্রা || Kamal Kumar Majumdar

বরবেশে সীতারাম সত্যই আকর্ষণীয় হইয়াছিলেন; কেবলমাত্র ক্রমাগত গাল চোষা ছাড়া তাঁহার মুখে অন্য শব্দ ছিল না। বলরাম পিছন হইতে তাঁহাকে বেশ কিছুটা তুলিয়া ধরিয়াছে। এখন তাঁহাদের পরিক্রমণ করিয়া সাত পাক চলিতেছে, সীতারাম অনেকবার আপনার ভারাক্রান্ত মুখোনি তুলিয়া ধরিয়া দেখিতে চাহিলেন, ফলে তাঁহার দুর্বল স্কন্ধই কাঁপিয়াছিল।

শুভদৃষ্টির কালে, লক্ষ্মীনারায়ণ কন্যাকে বরের দিকে ভাল করিয়া চাহিয়া দেখিতে অনুরোধ করিলেন। সীতারাম যশোবতাঁকে দেখিতেই গাল চোষার গতি বাড়িয়া গেল, বৃদ্ধ যেন উত্তেজনা সহ্য। করিতে পারিলেন না, অপ্রকৃতিস্থ হইয়া আপনার পুত্রের হাতে মাথা হেলাইয়া দিলেন, কে জানে হয়ত আপনার প্রৌঢ়ত্ব পার হইয়া যৌবনের উপর হেলিয়া পড়িতে চাহিয়াছিলেন! কিয়ৎকাল এইভাবে অতিবাহিত হইল। তিনি আবার ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহার হস্তে মালা দেওয়া হইল, জরাগ্রস্ত হস্ত মালা লইয়া আগাইতেছিল, সহসা কোথা হইতে কাশি আসিল, তবুও বৃদ্ধ মালা পরিত্যাগ করেন নাই, কিন্তু আর সম্ভবপর হইল না; দমকা হাওয়া তাঁহার হাত হইতে মালা খসাইয়া লইয়া গেল। সকলকে আশ্চৰ্য্য করিয়া মালাটি ধরিবার জন্য সীতারামের বাহু প্রসারিত হইয়াছিল, মালা দূরে গেল, হরেরাম মালা আনিতে ছুটিল কিন্তু অবলীলাক্রমে বৈজুর ছাগল সে মালাখানি সদ্ব্যবহার করিতে তখন মুখ আগাইয়া দিয়াছে।

সীতারাম তখনও প্রবল বেগে কাশিতেছিলেন, এমতাবস্থায় মন্ত্রচালিত পাষাণপ্রতিমা, যশোবতীর হস্তধৃত মাল্যখানি আসিয়া বৃদ্ধের কণ্ঠলগ্ন হইল।

এসময় বায়ু স্থির, গৃহাভিমুখী পক্ষীরা মুখরিত, স্রোত শান্ত এবং প্রকৃতি স্তব্ধ নিথর হইয়াছিল।

সীতারামের অবস্থার কথা স্মরণ করিয়া, শুভকাৰ্য্য যত সংক্ষেপে করা যায় তাহা করা হইতেছিল। ইতিমধ্যে কৃষ্ণপ্রাণ, দক্ষিণা আচারবিরুদ্ধ হইয়াছে, এই কথা বুঝিতে পারিলেন। পুরোহিতচিত কণ্ঠে কৃষ্ণপ্রাণ কহিলেন, “নিয়ম এই যে, আমি আর একটি মুদ্রা বেশী পাইব…”

লক্ষ্মীনারায়ণ ট্যাঁক খুঁজিলেন, কাপড় ভাল করিয়া ঝাড়িলেন। কোন মুদ্রাখণ্ডের সন্ধান পাওয়া গেল না। তখন তিনি শুধু মাত্র অসহায়ভাবে বলিলেন, “তা হলে…”

“সর্ব্বনাশের কিছু নেই, ভালমত অনুসন্ধান কর, ক্ষুণ্ণমনা ক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণ দ্বারা শুভকাৰ্য্য সম্ভব নয়” বলিয়া কৃষ্ণপ্রাণ স্মিতহাস্য করিলেন।

তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া কোন মুদ্রার সন্ধান পাওয়া গেল না। লক্ষ্মীনারায়ণ আপনার লোকেদের কাছে কর্জ চাহিলেন, কিন্তু তাহাদের সকলের কাছেই কিছু কড়ি ছিল, রৌপ্যমুদ্রা ছিল না। সুতরাং লক্ষ্মীনারায়ণ আসিয়া অনুনয় বিনয় করত কহিলেন, “ঠাকুর মশাই, এখন…”

“রৌপ্যমুদ্রা বিনা শুভকাৰ্য্য হয় না…”

অদূরে বসিয়া বৈজুনাথ এই ব্যাপার দেখিতেছিল, সে একটি ঝাঁপা হইতে খানিক তাড়ি নিজের মুখে ঢালিয়া মন্তব্য করিল, “যাঃ শালা-পাকা খুঁটি বুঝি কাঁচে গো” তাহার কথা কাহারও কর্ণে প্রবেশ করিল না। তখনও লক্ষ্মীনারায়ণ দাঁড়াইয়া অপদস্থ হইতেছিলেন; বৈজুনাথ উচ্চৈঃস্বরে কহিল, “আমি ধার দিতে পারি” বলিয়া ঠেটির ট্যাঁকে হাত দিয়া অনুভব করিতে লাগিল।

লক্ষ্মীনারায়ণ অত্যন্ত রাগান্বিত, বৈজুনাথের কথায় তাঁহার সব্বাঙ্গ যেন হোমাগ্নিতে পরিবর্তিত হইল, তিনি ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, “হারামজাদা ইতর চাঁড়াল…”

শান্তকণ্ঠে বৈষ্ণব কৃষ্ণপ্রাণ সহাস্যবদনে কহিলেন, “কন্যা সম্প্রদানকালে ক্রোধ পরিত্যাজ্য” বলিয়া ক্রমাগত সাধুভাষায় আপনার মনোভাব ব্যক্ত করিতে লাগিলেন, “যে কোন জাতি বর্ণের নিকট হইতে ধাতু তথা অর্থমুদ্রা গ্রহণযোগ্য, একমাত্র মুদ্রার ক্ষেত্রে জাতিবিচার চলে না…এতদ্ব্যতীত শ্মশানে উচ্চ নীচ ভেদ নাই।” মনে হইল কোন অকাট্য সংস্কৃত শ্লোকের ইহা সরল ভাষায় অনুবাদ।

এই বিচারে সমবেত জনমণ্ডলী গভীর শ্রদ্ধার সহিত কৃষ্ণপ্রাণের প্রতি অনিমেষ নয়নে চাহিয়াছিল। লক্ষ্মীনারায়ণ বিভ্রান্ত, একবার ইহাদের দিকে অন্যবার তাঁহার নীচকুলোব মহাজনের দিকে তাকাইলেন। বৈজু ইহাদের কথাবার্তা শুনিয়াছিল, সে হাতের কব্জিতে মুখ মুছিয়া একটি মুদ্রা লইয়া দাঁড়াইয়া অন্যহাতে আপনার মোচ চুমরাইতেছিল। জ্যোতিষী অনন্তহরি লক্ষ্মীনারায়ণকে খানিক সৎসাহস দিলেন।

লক্ষ্মীনারায়ণ লজ্জিত পদে বৈজুর নিকট আসিয়া হস্ত প্রসারিত করিলেন। চণ্ডাল তাঁহার হস্তে মুদ্রাটি দিবার জন্য আপনার নেশা-বেসামাল দেহকে সংযত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড রোল উঠিল, “ওরে ব্রাহ্মণের চরণে দে, না হলে মহাপাতক হবি”; বৈজুর অবস্থা বুঝিয়া ব্রাহ্মণ এক-পা পিছাইয়া গিয়াছিলেন। সে টাল সামলাইতে না পারিয়া পড়িয়া গেল, তাহার হাত হইতে মুদ্ৰাখণ্ড গড়াইয়া প্রায় গঙ্গার কিনারে গিয়া পড়িল। বৈজু নেশাবিজড়িত কণ্ঠে বলিল, “আমি শালা ত প্রণামী দিচ্ছি না যে পায়ে দেবো…।” অবশ্য তাহার এ উক্তি কেহ নিশ্চিত শুনিতে পাইল না।

লক্ষ্মীনারায়ণ গঙ্গাজল মুদ্রাটির উপর ছিটাইয়া তাহাকে শুদ্ধ করিয়া লইয়া আসিলেন। পুনৰ্ব্বার এই শ্মশানভূমিতে পুণ্য বিবাহমন্ত্র উচ্চারিত হইল, আসন্ন সন্ধ্যার গঙ্গার কল্লোল-ধ্বনিকে আহত এবং স্তব্ধ করিয়া দূর গগনে আবর্তিত হইতে লাগিল। এই মন্ত্রশক্তি, মানব দেহের হিঙ্গুল রক্তস্রোতকে উদ্ধতনখর ও প্রকৃতিস্থ করিতে সক্ষম হয় নাই। ইহা মায়িক সুতরাং হৃদয়ের স্পন্দন পাতালগত শিকড়মতই স্থবির হইয়া রহিল।

বিবাহের প্রথম অধ্যায় নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হইল। মৎস্যক্ৰীড়া কড়ি খেলা পর্যন্ত হইল, পুরাতন উর্ণনাভের মত হাতখানি ক্রীড়াচ্ছলে, কখন বা কড়ি সন্ধানকালে, যশোবতীর দেহের সর্বত্রে কর্ষণ করিল। তিনি ভীতা হইলেন না, নিঃশ্বাসের গতির সমতার কোন ব্যতিক্রম ঘটিল না; নবোঢ়া বধুর মত ক্লান্ত হইয়াও তিনি যে সহজ হইয়াছিলেন, এমতও নহে। কৃষ্ণপ্রাণ গঙ্গাতীরের বাসর পরিত্যাগ করিয়া লক্ষ্মীনারায়ণের নিকটে গিয়া বলিলেন, “কি বলব, আমার মনে হয় আমরা যেন সত্যযুগেই আছি, মায়ের কি শক্তি।”

এখন আকাশ তারাতৃষ্ণ, তবু দেখা গেল লক্ষ্মীনারায়ণের মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে।

যশোবতী বসিয়া আছেন। তিনি যেন বা ত্রিগুণাত্মিক মায়ার দ্বারা পীড়িতা নহেন। অথবা স্বাভাবিক জ্ঞান তাঁহা হইতে অপহৃত হইয়াছে। সম্মুখে উদার গঙ্গা ইদানীং চালোকে বেলোয়াড়ী। তিনি কৃষ্ণতম অন্ধকারের আধার মাত্র, পরিদৃশ্যমান স্থূলতা যে অন্ধকারে অপ্রকট হইতেছে; যাহা ঘটিল তাহার স্মৃতি পর্যন্ত তাঁহাকে ক্ষেত্র করিয়া জাগিয়া উঠিতেছে না। অনেক প্রাণ আছে যাহার স্পন্দন নাই, ক্ষুধা নাই। শুধু মরণোন্মুখ ঘুমে তাঁহার চক্ষুদ্বয় খসিয়া আসিতেছে। তথাপি বেশ কিছুক্ষণ ধরিয়া তিনি যেমন বা কাশির মত আওয়াজ শুনিতেছিলেন। অনন্তর কোনক্রমে একবার পাশ ফিরিয়া দেখিলেন যে, আত্মরক্ষায় বদ্ধপরিকর পোকার মত দুটি চোখ তাঁহার দিকে চাহিয়া আছে, এতদৃষ্টে তাঁহার দেহ রোমাঞ্চিত হইল না, শুধু মাত্র অল্প ভাঙন দেখা গিয়াছিল। বৃদ্ধের হাতে মৃদু স্পন্দন ছিল, মনে হয় তাহা গঙ্গার হাওয়া-সম্ভব। যশোবতীর মুখে কালোচিত অবগুণ্ঠন ছিল না, তিনি অপলক নেত্রে বৃদ্ধের দিকে চাহিয়া রহিলেন, এ সময়ে তাঁহার দেহস্থিত কূট অন্ধকার যৌবশরীরকে আলোড়ন করিয়া সুদীর্ঘ দীর্ঘনিঃশ্বাস হইয়া চলিয়া গেল, নাসার বেসরকে তাহা লাল করিয়াছিল, নোলক তটস্থ হইয়াছিল, এবং জীবন সুদৃশ্য হইয়াছিল।

বৃদ্ধ সীতারাম অনেকক্ষণ একভাবেই ছিলেন, হয়ত নববধূর সহিত বাক্যালাপ করিবার তাঁহার বাসনা হইয়াছিল; তাহার জন্য শক্তি সঞ্চয় করিতেছিলেন। তিনি কি যেন বলিলেন…।

যশোবতী সত্যই তাঁহাকে বুঝিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, অভিমান তাঁহার হয় নাই। অন্তত তাঁহার মুখে একটি সপ্রতিভ লক্ষণ দেখা গিয়াছিল।

যশোবতাঁকে সীতারাম দেখিতে লাগিলেন। নববধুর দৃষ্টি এখন অন্যত্রে নিবদ্ধ ছিল। যেখানে মাদুরে বিশ্রামরত সকলের সম্মুখে উবু হইয়া বসিয়া, বৈজু গান শুনাইতেছিল। রামপ্রসাদী শেষ হইল। যাহাদের এখনও তেজ ছিল তারা আর একটা, আর একটা’, বলিয়া অনুরোধ করিল; তাহার প্রত্যুত্তরে সে কহিল, “বাবু মশায়, আমি এবার নিজ মন মত একটা গান বলব…”

বৈজুর বাক্যে কৃষ্ণপ্রাণ ইত্যাদি যাঁহারা জাগিয়াছিলেন তাঁহারা হরিধ্বনি করত কহিলেন, “তাই হোক।” বৈজু তাহার জোয়ারী গলায় হস্তের ঝাঁপা বাজাইয়া ধরিল, “বলি শোন–

বিবাহ এক রক্তের নেশা,
বর বউ যেন বাঘের মত…”

গীতের বাণী পোড়া কাগজের মত গঙ্গার হাওয়ায় ফর ফর করিয়া উড়িয়া যাইতেছিল, তথাপি শ্রোতাদের কর্ণে প্রবেশ করিয়াছিল; বৈজু এখনও তাহার হাঁটুর প্রায় কাছেই চাপড় মারিয়া হৈ হৈ করিয়া গাহে।

ব্রাহ্মণেরা এ উহার দিকে চাহিয়া তারস্বরে হো হো শব্দ করিয়া উঠিয়া তাহার পরেই কিয়দংশ সমস্বরেই কহিলেন, “মর হারামজাদা…বেল্লিক…শালা…চাঁড়াল…”। কৃষ্ণপ্রাণ আপনার খড়ম হাতে লইয়াছিলেন।

বৈজুনাথের কোন কিছুই হয় নাই। সে উঠিয়া নেশা বিবশ পা ছড়াইয়া আবার চলিতে আরম্ভ করিল, গান তাহার কণ্ঠে ছিল।

“বিবাহ এক রক্তের নেশা–
বর বউ যেন বাঘের মত,
বাঘ বাঘিনী রক্ত চোষা ॥”

যশোবতী অত্যধিক বিস্ময় সহকারে এই গান শুনিতেছিলেন। বৈজুর দেহ দুলিতেছে। সহসা কৃষ্ণপ্রাণ ছুটিয়া আসিয়া বলিলেন, “দেখ ব্যাটা চাঁড়াল, আমি তোর গান ঘুচিয়ে দেবো…”

“হেরেরেরে–কি অল্ল্যায় হলো…” বলিয়া বৈজু ঈষৎ টলিয়াছিল। “ন্যায় অন্যায় তুই কি করে বুঝবি বজ্জাত হারামজাদা…” নিজের ব্যাঘ্ৰস্বর শুনিয়া কৃষ্ণপ্রাণ নিজেই চমকাইয়া শঙ্কিত এবং নিজের হস্তপ্ত খড়মের দিকে চাহিয়া কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইলেন।

“তা বটে তা বটে, ন্যায় অন্যায় বুঝবই যদি তবে চাঁড়ালির পেটে জন্মাব কেনে…”

“ফের যদি গাইবি হারামজাদা তো…” তদনন্তর কণ্ঠস্বর মিহি করিয়া কৃষ্ণপ্রাণ কহিলেন, “বিয়ের ক’নে বসে–”

“তা বাসরঘরে গোঁপ চোমরান গান হবে না ঠাকুর, এ কি হবিষ্যি গান হবে…”

“তুই মাতাল, তা না হলে…”

বৈজু ঐ স্থান হইতে বিবাহের বাসর দেখিল। কি দেখিল সেই জানে, হয়ত বা নানা আসনে চন্দ্রালোকই দেখিয়া থাকিবে। সে গম্ভীর হইয়া অল্পক্ষণ দাড়ি চুলকাইল। তাহার পর সজল নেত্রে কহিল, “চাঁড়ালের ঘরে জন্মেছি ঠাকুর, ন্যায় অন্যায় জানিনা। তবু তুমি শেখালে গো” বলিয়া প্রণাম করিল। কৃষ্ণপ্রাণ তাহাকে প্রণত রাখিয়া ফিরিয়ে গেলেন।

প্রভুভক্ত কুকুর যেমন প্রভুর দিকে মুখ তুলে, তেমনই সীতারাম নববধূর দিকে মুখ তুলিয়া কিছু বলিতে চাহিলেন। বৈজুর গানের অসৎ কলিগুলি যশোবতী শুনিয়াছিলেন, তথাপি তাঁহার মনে কোন বিকার উপস্থিত হয় নাই, এ কারণ যে সেখানে পুষ্পের অজ্ঞতা ব্যতীত কিছুই ছিল না।

বৈজুর দিক হইতে মুখ ফিরাইয়াই বৃদ্ধের দিকে দৃষ্টি পড়িল। গাল চোষার অল্প আওয়াজ এখন আগ্রহের সৃষ্টি করিয়াছিল, তিনি স্বীয় মুখোনি তাঁহার প্রায় নিকটেই আনিলেন, কিন্তু চো চোক আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শুনিতে পাইলেন না। কিছুক্ষণ পরে মুখ তুলিতে গিয়া দেখিলেন, আপনার বসন প্রান্ত বৃদ্ধ মুঠা করিয়া ধরিয়া আছেন, অতঃপর ক্ষিপ্রবেগে তাঁহারই হাতের কব্জি ধরিতেই তিনি সবিস্ময়ে দেখিলেন, অঙ্গুলিগুলি একটির পর অন্যটি নামিতেছে উঠিতেছে। ইহাতে, ইহাতেই মনে হয় যশোবতীর চক্ষুর্ঘয় কিঞ্চিৎ উদগ্রীব হইয়াছিল।

যদিচ আপাত দৃষ্টিতে এহেন অঙ্গুলি আন্দোলন সত্যই ত্রাসের সঞ্চার করে, তবু তাহারই মধ্যে প্রেমিকের হৃদয়ের উষ্ণতার, গভীরতার, সুকুমার ব্যঞ্জনা ছিল; সুকুমারস্বভাবা যশোবতী হাতটি ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলেন, ইদানীং অনুভব করিলেন, বৃদ্ধের এই বিশীর্ণ হাতখানির মধ্যে বলবতী ধাবমান ইচ্ছা প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে এবং তাঁহার সমস্ত হাতখানিকে উর্দ্ধে লইয়া যাইতে চাহিতেছে। যশোবতীর সাহায্যে প্রবীণ হাতখানি শক্তিলাভ করিল, যেন আপনা হইতে উঠিয়া তাঁহার অবগুণ্ঠন উন্মোচন করিয়াই সেখানে স্থির হইয়া রহিল।

এই দেহের অথৈ সৌন্দৰ্য্য যেমন বা সন্ন্যাস লইয়াছে। স্তম্ভিত বৃদ্ধকে মুহূর্তের মধ্যেই চরিত্রবান করিল, সীতারাম আমিত্ব-অহঙ্কার বর্জিত, কিন্তু মানুষের দন্তপাতি অদৃশ্য হইলেও, জিহ্বা অক্ষয় হইয়া আপন স্থানে বসিয়া থাকে, রস উপলব্ধি করে। উদ্ভিন্নযৌবনার হেমদেহ স্পর্শে বৃদ্ধের গায়ে যেন মাংস। লাগিল। সীতারাম কি যেন বলিলেন। যশোবতী তাহা সঠিক বুঝিয়ে না পারিয়া নূতন করিয়া ঘোমটা রচনা করিবার জন্য দুই হাতে বসন প্রান্ত উত্তোলন করা মাত্রই প্রাচীন হাতখানি তাহার বক্ষে আসিয়া দারুভূত হয়, শতাব্দীক্লিষ্ট বল্কলসদৃশ অঙ্গটি দেখিয়া যশোবতী এককালে অন্ধকার-শঙ্কিত, উৎখাত হইলেন। তাঁহার দীর্ঘশ্বাসের আঘাতে বৃদ্ধের হাতখানি ক্রমে যেমন বা নামিয়া গেল।

“বউ বউ” মর্মান্তিক শব্দ হইল। যশোবতী মুখোনি নিকটে আনিলেন, এখন বৃদ্ধের চোখদুটি আয়ত হইল, কহিলেন, “ঘোমটা…না না।”

যশোবতী ঘোমটা খুলিয়া, পরমুহূর্তে যথাস্থানে রাখিয়া সকল দিক নিরীক্ষণ করত অতি সন্তর্পণে ঘোমটা উন্মোচন করিলেন।

পক্ককেশ-চন্দ্রালোকে যশোবতী চির-রহস্যের সম্মুখে আসিয়া নিঃসঙ্গ; বৃদ্ধের গূঢ় অন্ধকারকে সুযোগ বলিয়াই মনে হইল। আবেগে কহিলেন, “বাঁচব বাঁচব” ফলে মুখের কষ বহিয়া লালা নিঃসৃত হয়।

নিঃসঙ্গতা-আহত যশোবতী কেবলমাত্র মস্তক আন্দোলিত করিলেন।

“তুমি…এসেছ” ইহার পর কম্পিত অঙ্গুলি দ্বারা আপনাকে নির্দ্দেশ করিয়া নিশ্চয় বলিয়াছিলেন, “বাঁচব”; সীতারামের কথা স্পষ্ট না হইলেও তাঁহার আকৃতিতেই বক্তব্যকে প্রকাশ করিতেছিল। অনন্তর বৃদ্ধ একটি দম লইয়া, পদাঘাত করিবার অমানুষিক ঔদ্ধত্যের সহিত কহিলেন, “বাঁচব” এবং যুগপৎ মহা আক্রোশে আকাশের দিকে–এখন যে আকাশ চন্দ্রাহত তারা ভরা–তাহার দিকে চাহিলেন।

আকাশে, উর্ধে, ক্রমাগতই হংসবলাকায়ূথ, যাহাদের ছায়া ইতঃমধ্যের শূন্যতায় নিখোঁজ সুতরাং তাহারা অশরীরী; তথাপি, কভু নিম্নের স্রোতের শব্দকে নিষ্ফল করত তাহাদের মুখনিঃসৃত ধ্বনি শোনা যায়; যশোবতাঁকে এ শব্দনিচয় দিকভ্রান্ত করে–কেন না তিনিও দেখিতেছিলেন, একদা মনে হইল এ-শব্দ বৃদ্ধের মুখপ্রসূত শব্দ বৈ অন্য নহে; সেই হেতু বৃদ্ধের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন। সেখানে এখনও বৃদ্ধের চোখে শিশির তত্ত্ব। আরবার তিনি, যশোবতী, উড্ডীয়মান হংসশ্রেণী দেখিলেন।

অকস্মাৎ দেখা গেল, এ-উড্ডীয়মান হংসশ্রেণী কি যেমন বা পরিত্যাগ করিল, ফলে এ-দিঙমণ্ডল চকিতেই নিষ্ঠুর কুটিল, আকাশপথে কি যেন, পালক যেমত, ভাসিয়া ভাসিয়া নামে। ক্রমে ইহা স্পষ্ট। একটি উর্ণা তথা ব্যাধের জাল খসিয়া আসিতেছে যাহা কিছুকাল পূৰ্বে নিশ্চয়ই হংসশ্রেণীকে রুদ্ধ করিয়াছিল।…অনুঢ়া, রম্য, প্রাণময়ী অদ্যও–এ হংসশ্রেণী; জালটি আকাশে যদিও একাকী, তথাপি সৌখীন, বাবু, নয়নাভিরাম! এ দৃশ্যে সীতারাম পশুশাবকের মতই কুঁকুঁ শব্দ করিতেছিলেন, এখন শিহরিয়া প্রাণান্ত মুখব্যাদান করিয়া তড়িৎ বেগে একটি হাত আপনার চোখের উপর রাখিতে চেষ্টা করিলেন, কেননা জালের ছায়া তাঁহার দেহে পড়িয়াছিল।

যশোবতী এতক্ষণ বিন্দু মাত্র, যেহেতু এই নৈশ সৌন্দৰ্য্য, তাঁহার বালিকা মনে ভয়াবহ রূপে দেখা । দেয়, নির্বাসিত লহমার ব্যথায় তাঁহার জানকীসদৃশ শরীর জর্জরিত, এবং রোমহর্ষে যে অস্তিত্ব খুঁজিয়া। পাইয়াছিলেন–তাহার বলে পার্শ্বস্থিত নিপীড়িত বৃদ্ধকে দেখিয়াই বস্ত্রপ্রান্ত দ্বারা তাঁহার, বৃদ্ধের, স্বামীর মুখমণ্ডল আবৃত করিলেন।

সীতারামের ক্রন্দনের আপ্লুত স্বর ও মুখ মারুতে বস্ত্রখণ্ড উঠা নামা করিতেছিল। ভৌতিক ভাবে সহসা বস্ত্রপ্রান্ত উড়িয়া গেল, একটি কণ্ঠস্বর হাওয়ায় উড়িল, “ভয় ভয়।”

যশোবতী বুদ্ধিভ্রংশ হইলেন না, বৃদ্ধের কপালের দুইপার্শ্বে হাত রাখিয়া আকাশ ঢাকিলেন। কামযোগ। দূরত্বের মধ্যে দুজনে মুখোমুখী। সহসা যশোবতী কেমন যেন পাগলিনী হইলেন, মোলক কম্পিত, নথ রাশ মানিতেছে না।…সীতারাম বলিলেন, “ভয় ভয়।” দিশাহারা যশোবতী মুখোনি আরও নীচু করিলেন, অঙ্গের মাংসল খেমটা সাহস বৃদ্ধের চোখে মুখে বর্ষিত হইল।

চকিত হরিণীর ন্যায় তাকাইলেন, তাঁহার মুখে লালার চিহ্ন। এ সময় দুরাগত হাস্যধ্বনি। গঙ্গার নিকটে বসিয়া একটি পা ছড়ান অন্ধকার সেই উলঙ্গ গীতখানি ধরিয়াছে।

যশোবতী যেমন বা অপমানিত হইয়াছিলেন।

তথাপি উঠিয়া চারিটি খুঁটিতে চাঁদোয়া বাঁধিয়া আসিয়া বৃদ্ধের পাশেই বসিলেন। সীতারাম এই চাঁদোয়ার জন্য কিছুটা সোয়াস্তি বোধ করিয়াছিলেন, কেননা মৎস্য-পিত্ত আকাশ নাই, কেবলমাত্র চাঁদোয়ার কতক ছিদ্র বহিয়া আলোক সম্পাত হইয়াছে। ভয় যেন অন্য কোথাও স্তন্যপানরত।

সীতারাম ডাকিলেন, “বউ”.তাহার অনেকক্ষণ পর আবার শোনা গেল, “আমি আবার আমার জমি-” আশ্চর্যের বিষয় এই যে এইবার স্পষ্টই শোনা গেল, “বউ তোমাকে নিয়ে ঘর ঘর” এই কথা তিনি এক নিঃশ্বাসে বলিয়াছিলেন। ছেলেমানুষের মত তাঁহার বাচন ভঙ্গি, ছেলেমানুষের মত আশা। যশোবতী সম্মুখের স্রোত দেখিতে দেখিতে এই বাক্যগুলি শুনিয়াছিলেন।

“বউ, গান বল–”

যশোবতীর চক্ষুদ্বয় বিস্ময়ে ভরিয়া গেল, জীবনে এই বোধহয় প্রথম হাসি আসিল, পাছে অন্য কোন লোক তাঁহার হাসি শুনিতে পায়, সেই হেতু মুখে সত্বর বস্ত্রপ্রদান করিয়াছিলেন। হাস্য সম্বরণ যখন হইল না তখন স্বামীর দেহের পাশেই মুখ খুঁজিয়া কুকুর কুণ্ডলী থাকিয়া হাসিতে লাগিলেন। বৃদ্ধ সীতারাম ইহাতে উৎসাহিত বোধ করিয়া গীত ধরিলেন, শুদ্ধবঙ্গভাষা অপহৃত হইয়াছে, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা দিয়া শব্দ উৎসারিত হইতে লাগিল। রেনিটি’র ঘরের কীৰ্ত্তন ‘কি হে বাঁশী বাজায়, বধূ’ এ গীতের অন্যকলি অস্পষ্ট, ক্রমাগত ‘বধূ’ই শুনা গেল। আর যে যখন তিনি খাদ হইতে (!) স্বর আনিবার চেষ্টা করিতেছিলেন তখন একনিষ্ঠ গাম্ভীর্য্য মুখ চোখে ঠিকরাইয়া প্রকাশ পাইল। বৃদ্ধ থামিয়া যুগপৎ হাসিতে ও নিঃশ্বাস লইতে লাগিলেন। যশোবতী অন্যদিকে মুখ করিয়া থাকা সত্ত্বেও যেন স্বামীর দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন এবং মধ্যে মধ্যে হাসিতেছিলেন।

সীতারাম উত্তেজনায় অস্থির, এইবার ‘কালীয়দমন’ যাত্রার একটি টপ্পা ধরিলেন। “বলি পরাণ বাঁশী ফেলে দাও, আমাকে মজিও না প্রাণ তোমাতে মজাও”–এই মধ্যরাত্রে গঙ্গাযাত্রী বৃদ্ধের বুকে পীতধড়া বনমালা পরিহিত কালো ছোঁড়ার চাপল্য জোয়ার হানিল। আশ্চৰ্য্য হাতের ফেরতাই দেখা দিল, তেহাই পড়িল এবং সঙ্গে সঙ্গে হিক্কা উঠিল। যশোবতী তখনও হাসিতেছিলেন।

তিনি এই ভয়ঙ্কর পরিবর্তনের কথা কোনক্রমেই জানিতে পারেন নাই। আপনার কোমরের কষি আলগা হইল, তিনি উঠিয়া স্বামীর এই বিকট মূর্তির দিকে চাহিয়া যেন ফুলিয়া উঠিলেন। বস্ত্রের কষি হইতে হস্তদ্বয় মুক্ত করিয়া তাঁহার বুকে হাত বুলাইতে লাগিলেন, কি করা কর্তব্য তাহা তিনি জানিতেন না।

অতি প্রত্যুষে কুশণ্ডিকা হইয়া গেল। ঢাকি বাহক সকলেই চলিয়া গেল। বৃদ্ধের পৃষ্ঠের রক্তিম নারায়ণ-চিহ্ন তখনও নববধূর চোখে ভাসিতেছিল, কখন স্রোত কভুবা মৎস্যের লাফান তাঁহার দৃষ্টিপথে

পড়িয়াছিল। কোন কিছুকে অর্থ করিবার মত তাঁহার মন ছিল না।

লক্ষ্মীনারায়ণ গঙ্গার নিকটে বসিয়া যশোবতাঁকে উপদেশ দিতেছিলেন। পুরাকালের রমণীগণের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের মহিমা কীৰ্ত্তন হইতেছিল। যশোবতী একদৃষ্টে পিতার কথা শুনিতেছিলেন, এই চাহনির মধ্যে এতেক সরলতা ছিল, যে…লক্ষ্মীনারায়ণের মনে হইতেছিল, যশোবতী তাঁহার কথা ঠিক বিশ্বাস করিতেছেন না, ফলে তিনি ঈষৎ নির্বোধ বনিয়া ঘোট ঘোট অঙ্গ ভঙ্গিমায় তাহা ঢাকিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন।

“বাবা” যশোবতী ডাকিলেন।

গঙ্গার হাওয়া এবং জলোচ্ছাসে যে রৌদ্র, তাহা উচ্চারিত বাক্যটিকে লিখিত করিয়া দেয়; এ কারণে যে যশোবতীর ‘বাবা’ কথাটি বলার ভঙ্গিতে যে নিঃসঙ্গতা ছিল, যে নিঃসঙ্গতায় বাদল ছিল, যে বাদলে আদিম উষ্ণতার হেত্বাভাস–তাহা তাঁহাকে, লক্ষ্মীনারায়ণকে, বিবৃত করিয়াছিল।

লক্ষ্মীনারায়ণের মনের কোথাও যেন সে কথা, শিশুসুলভ হাতের নরম স্পর্শ করিয়াছিল, ব্রাহ্মণদেহে যোগসাধনার ধারা বর্তমান, মূঢ় জনের মত অল্পেই হা-হা করিয়া কাতর হইয়া উঠে না। কারণ মনে পাণ্ডিত্যের ধারা বর্তমান, তবু প্রবহমান গঙ্গার দিক হইতে সুযোগ বুঝিয়া দৃষ্টি ফিরাইলেন। কেননা সেখানে, এ গঙ্গায় উপত্যকার অন্তস্থিত পার্বত্য ছায়ায় যে মাতৃত্ব উৎপন্ন উৎসাহিত উৎসারিত বর্ধিত হয়, তাহারই দ্বাপরকালিক আভাস ছিল!

ইদানীং সে গঙ্গা–শিবের জটা বহিয়া যাহা নামিয়াছে, যাহাতে কোন গল্প নাই–তাহা, পিতা ও কন্যার ইতঃমধ্যে সঞ্চারিত। যশোবতী স্বচক্ষে সেই পবিত্র স্রোতেধারা দেখিয়াছিলেন; এখন মুগ্ধ, তিনি মনে মনে আকাশ লইয়া খেলিতে মুখর বাত্ময়; যে অমরতা লইয়া ইহজগত, তাহার আলো তাহার পুষ্পরাশি নয়ছয় করিয়াছে, কাব্যে যাহা ছন্দ-মিলের ধ্বনি মাত্র, সুশীল ও সুবোধ মানুষের মৃত্যুতে যাহা সান্ত্বনা বচন, তাহা, এখন, এই খেলার বস্তু এবং যাহা যশোবতী অবোধ পৃথিবী হইতে সংগ্রহ করিয়াছিলেন। তিনি অন্যমনস্কা অথবা সংস্কারবশতভাবে ডাকিলেন, “বাবা।”

এই সম্বোধনের মধ্যে ত্রিসন্ধ্যা এক হইয়াছিল! লক্ষ্মীনারায়ণ অন্ধকার হইয়া নিশ্চিহ্ন, ক্রমাগত গ্রহনক্ষত্রের স্বভাব সুলভ আবেগসঞ্চার তাঁহাকে কেন্দ্র করিয়া দৃঢ় হইয়া উঠিল, যাহাকে নিগ্রহ করিতে তিনি শক্তিহীন। তাঁহার মন যুক্তির জগতের জন্য চঞ্চল; সেখানে শস্যের জীর্ণতা মনকে সহজ করিলেও মন বীজকে সাদরে রাখে, জীর্ণতাকে সঙ্গোপনে লালন করে। লক্ষ্মীনারায়ণ অগোচরে আপনার নাম, নিজেই, ধরিয়া ডাকিয়া পরে কহিলেন, “মা গো, সব কপাল! তুমি সীতাকে জান মা, রাবণবধের পরে রাম তাঁকে ত্যাগ করেন সীতা সহ্য করলেন, লক্ষ্মণ চিতা সাজালেন…মে হৃদয়ং নিত্য নাপসৰ্পতি রাঘবাৎ, কোন ক্রমেই তাঁর মন রাঘব থেকে ছেড়ে যায়নি। মা আমার কত ব্যথা সহ্য করেছিলেন, তবু পতিভক্তি…” লক্ষ্মীনারায়ণের চোখে জল আসিল। নিশ্চয়ই পৈতা দিয়া চোখ মুছিলেন।

যশোবতীও পিতার চক্ষু মুছাইয়া কহিলেন, “তুমি তুমি…” আর কিছু বলিতে পারিলেন না। অথচ নির্ভীক গম্ভীর সুন্দরী মনোরমা যশোবতী বলিতে চাহিয়াছিলেন, ‘পিতা তুমি আমাকে সনাথ করিয়াছ– ইহা হইতে আর কি রমণীর প্রেয় হইতে পারে; তিনি ঊর্ধ্বে আছেন ইহা আমি জানিতাম, পরে অন্তর্যামী জানিয়াছিলাম, এখন…’ বলিয়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়াছিলেন–যাহা ডালিমের বেদনাময় যৌবনের দ্বারা সম্ভব। কারণ এ সময় শোনা গেল, চণ্ডাল হাঁকিতেছে, “ঠাকুর এস, এস হে। এখুনি আবার যাত্রী আসবে…গো।”

বৈজুনাথের ডাকে লক্ষ্মীনারায়ণ যেন বা মুক্ত আকাশ দেখিলেন, কন্যাকে তদবস্থায় রাখিয়া কয়েক পদ আসিয়া মনে হইল যেন আপন গৃহদ্বারে পৌঁছিয়াছেন। নিশ্চিন্তভাবে খানিক দণ্ডায়মান থাকিয়া সহসা ঘুরিয়া দেখিলেন, যশোবতী সীতারাম হইতে এখন দূরে।

লক্ষ্মীনারায়ণ কন্যাকে ডাকিলেন। যশোবতী বলিলেন, “বাবা আমি এখানে…”।

“ছিঃ ছিঃ অমন ক’র না, লোকে কি বলবে? তোমার দুই ছেলে রয়েছে…তাছাড়া যেটুকু সময় পাও স্বামীসেবা কর মা…।”

যশোবতী স্বামীর নিকটে গিয়া বসিলেন।

বৈজুনাথ এ জমিকে প্রণাম করিয়া চিতার মাপ লইতে লাগিল। মাটির উপর হামাগুড়ি দিয়া হাত মাপিতে মাপিতে অনেক দূর পর্যন্ত গেল; খুঁটি বসান হইল, সে গান গাহিয়া উঠিল, সে গান, “যে দেশে রজনী নেই মা, সেই দেশের এক লোক পেয়েছি”। দাঁড়াইয়া হাঁটু ঝাড়িয়া খুব বিজ্ঞের মত কহিল, “বেশ হয়েছে, লাও এবার নিকিয়ে ষটকোণে বীজমন্ত্র লেখ…জয় গুরু!”

“মর হারামজাদা! ওরে চাঁড়াল, চিতাটা যে একটু বড় হল, তোর কি মনে হয়?”

“চিতা বড় হবে কেনে…উত্তর দক্ষিণে গঙ্গা, একজন জ্যান্ত…শালা হাওয়া ভারী খচ্চড় জাত, জ্যান্তই থেকে যাবে…তখন হা হুতাশ…করবে কে…” এই বলিয়া পুনৰ্ব্বার হাঁটুতে হাত দিল।

“লে শালার আবার মায়া ফুকারি…” অনন্তহরি ছ্যাঁচড়া কণ্ঠে বলিলেন।

বৈজুনাথ রুখিয়া উত্তর করিল, “না শালা আমরা কাঁদি না, মুতি–চোখে ত জল নেই।”

“আঃ আস্তে আস্তে, আমার মেয়ে রয়েছে বসে…তোর একটা…”

“ওহো এখনও ত তার নাড়ী আছে ঠাকুর…”

“হারামজাদা তোর জ্বালায় পৃথিবীতে কি চন্দ্র সূৰ্য্য উঠবে না…মারের চোটে…”

“বাবু তোমাদের থেকে উঁচু জাত নেই…যারা…আচ্ছা আচ্ছা ঠাকুর, বুড়ো আর কনে বউ যদি…” বলিয়াই বৈজুনাথ যশোবতীর দিকে তাকাইল। ঘাসে মুখ রাখিয়া হরিণী যেমত চাহিয়া থাকে, সেইরূপ দৃষ্টি দেখিতে পাইয়া সে থ’ হইয়া গেল। সে বলিতে চাহিল, “আচ্ছা সারা দুনিয়ার লোক মিলে যদি হা-হুঁতাশ করে, আকাশে কি তাহলে টেলিগ্রাফ হবে?’ পরক্ষণেই অতি সন্তর্পণে মুখ ফিরাইল। স্বগত উক্তিতে ওষ্ঠ কম্পিত, অস্পষ্ট পাখোয়াজের বোল শুনা যাইতেছে।

ব্রাহ্মণেরা সকলেই প্রশ্ন করিল, “কি রে…”

“না, ভাবছি বাবু…”

“ভাবনার কি আছে…” কৃষ্ণপ্রাণ কহিলেন।

“বাবুমশায় সুখে পুড়তে পারে সেটাও ত দেখতে হবে…। আমার মতে চিতা আরও বড় দরকার…”

মুখভঙ্গী করিয়া অনন্তহরি কহিলেন, “তুই শালা কাঠ দিবি? শালা আমার খাঞ্জা খাঁ। এত কাঠ পাবে কোথায়…”।

“বাড়ীর খরচার মত কাঠ লোকে জমা রেখেছে–তারা দেবে কেন?” কৃষ্ণপ্রাণ কহিলেন।

“ওই ত বলে কে…” লক্ষ্মীনারায়ণ শুধুমাত্র সায় দিলেন।

“লে লে চিতা ছোট কর…”

“ভাবছ কেনে গো, কত কর্পূর আসবে, মাখন ছুঁড়বে, এইটা সতীদাহ বলে কথা! এ কি তোমার আমার লাস? পুড়ল না পুড়ল কি এসে গেল? মড়ার মুখ থেকে ছাগল পিণ্ডি চাটবেক…”

বলিয়া সে গর্ব অনুভব করিল।

ব্রাহ্মণেরা সকলেই মুখ বিকৃত করিয়াছিলেন। বৈজুনাথ একের পর এক সকলের মুখের দিকে তাকাইয়া নিজের মধ্যে যেন ফিরিয়া গেল। অনন্তর গভীর নিঃশ্বাস ত্যাগ করত কহিল, “কত সোনা পড়বে, ইঃ–সতীদাহ বলে কথা।” বলিয়া সেই ভাবেই দাঁড়াইয়া রহিল, পরক্ষণেই অদূরে দেখিল, সেই সীতা-স্মৃতি নয়নযুগল।

এহেন দৃষ্টি তাহাকে যেন আকর্ষণ করিতেছিল; সে, চণ্ডাল বৈজুনাথ, আপনার অজ্ঞাতেই দুই এক পা আগাইয়া গেল। ব্রাহ্মণ সকলেই, তাহাকে সচেতন করিলেন। সে অন্যমনস্কভাবে ঘুরিয়া দাঁড়াইল, সম্মুখের উচ্চবর্ণের মুখগুলি সে এমত দৃষ্টিকোণ হইতে দেখিয়াছিল, যাহাতে প্রত্যেকেই তাহার কাছে বীভৎস প্রতীয়মান হয়। ইঁহাদের, ব্রাহ্মণদের, সাধারণ কথাবার্তায় কলহরত খানকীদের আওয়াজ ছিল; সে আপনকার ভারাক্রান্ত মুখোনি উঠাইবার চেষ্টা করিল, আবার প্রয়াস পাইল; একারণে যে, সে অদ্য ফুটন্ত ফুলের বীরত্বের উপর দিয়া বহমান একটি কাকলী শুনিল, এই পাখী হলুদ, অভিমানী বধূদের কথা কহিতে অনুরোধ করে। মনে হইল তারা, কাহারা বাতায়নে দাঁড়াইয়া সুদূরতা দেখে।

ইতিমধ্যে কে যেন কহিল–”তাহলে…কি হবে…?”

“আর মাপের দরকার নেই…”

“খেলা করবার জন্য মাপ নেওয়া হচ্ছে.” এই উষ্মপ্রকাশ করিয়াই তৎক্ষণাৎ লক্ষ্মীনারায়ণ মিষ্টকণ্ঠে কহিলেন, “নে বাবা…কত কাঠ লাগবে বল, সেই অনুপাতে কাঠ যোগাড় করতে হবে ত…!”

চণ্ডালের চোখে জল ছিল না, তবু যেন তাহার মনে হইল তাহার চোখে জল আছে, সে হাত দিয়া চক্ষু মুছিয়া কহিল, “বললাম হে…তুমি গুঁড়ি দশ বার যোগাড় কর, চেলা ক’গাড়ি আর যারা আসবে সবাই কাঠ আনবে বয়ে গো। আগে আমার মনে পড়েনি…তুমি…”

“না না…খুঁটি ছোট কর…”

চণ্ডাল আবার মাপিতে হামাগুড়ি দিতে বসিল, দুই হাত মাপিয়াই সে স্থির; এক অনৈসর্গিক অনুভব বৈজুনাথকে আকাশ বাতাসের সংস্পর্শে আনিয়া দিল, মাটির প্রতি গভীর মনোযোগে একনিষ্ঠ একাগ্রতা সহকারে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল, কাহাকে যেন সে দেখিতে পাইয়াছে–শাস্ত্র যাহাকে ভাবময় তত্ত্ব বলে, তাহার সহিত সে অনায়াসে কথা কহিতে পারে। সে অবাক, সে অভাবনীয় স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করিল, অনন্তর আপন ধীর কণ্ঠস্বরে তাহাকে গল্প বলিতে সুরু করিল, “রাম নামে অযযাধ্যার রাজার পুত্র ছিল…” এসময় দৃশ্যমান মায়া অন্তর্ধান হয়, সে রুষ্ট হইয়া মহা আক্রোশে মাটিতে চপেটাঘাত করিল। নিজের ওষ্ঠদ্বয় কামড়াইতে লাগিল; মনের মধ্যে অগণন কালো সাদা দেখিল, তাহার অর্থ এই হয় যে ‘এ মাটি আমার আমি তার–’ এক মুহূর্তের জন্য মুখোনি জন্তুর মত বাঁকা করিয়া দণ্ডায়মান ব্যক্তিদের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল, আরবার যশোবতাঁকে দেখিল। ইহার পরে তাহার বিরাট দেহটা উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে, সে হাঁটু ঝাড়িতে ঝাড়িতে কহিল, “আমি পারব না…চিতা করতে।”

“সেকি…বেটা মহাপাতক হবি রে।” পলকের জন্য যশোবতীর দিকে চাহিয়া লইয়া সে কহিল, “আমার খিদে পেয়েছে…”

পুনরায় সে কহিল, “আমার খিদে পেয়েছে।” ইহার অর্থ আধ্যাত্মিক, বৈজ্ঞানিক না ভৌতিক তাহা কেহ নির্ণয় করিতে সময় ক্ষয় করিলেন না।

“কেন চণ্ডাল হয়ে জন্মেছিস জানিস, তুই বেটা জাত বজ্জাত…তোর পাখা উঠেছে…”

বৈজুনাথ কোন উত্তর করিল না। তাহার গতি আসন্ন-প্রসবা গাভীর মতই ভারাক্রান্ত, কখনও বা সে শান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। আবার চলিল, গঙ্গার জল মাথায় দিল।

সম্ভবত, রাত্র দিন যদি সত্য হয়, তাহা হইলে, সালঙ্কারা যশোবতী ইহা দেখিয়াছিলেন। উহা বৈশাখের শূন্য প্রান্তরের দ্বিপ্রহরের নভ-আগত নূতন ধূলার সূর্যমুখী ঘূর্ণি যেমত স্পন্দিত একটি দেহ বৈভব–যাহার অন্তরীক্ষে নরকপাল এবং অন্য অন্য অস্থিনিচয় এবং বহির্দেশে, পাহাড়ী গ্রামের নিরবচ্ছিন্ন অপরাহু! অবশ্য যুগপৎ যশোবতীর সমস্ত দেহমন বৈজু-আলোড়িত গঙ্গা হইতে ভগবানের পূৰ্ব্বত কণ্ঠস্বর শুনিল।

অনন্তর বৈজুনাথ গঙ্গা ত্যাগ করিয়া বিমূঢ়ভাবে সকলকে দেখিয়া বিড়ালের মতই চক্ষুদ্বয় সঙ্কীর্ণ করে এবং পরক্ষণেই এক দৌড়ে আপনার আড়ায় গিয়া রক্ষিত ঝাঁপা হইতে তরল জ্ঞানহীনতা পান করিল।

সমবেত ব্রাহ্মণগণ বৈজুনাথের ব্যবহারে যারপরনাই আশ্চৰ্য্যান্বিত; কিছুকাল অতিবাহিত হইল, অনন্তহরি কহিলেন, “ওর জন্যে ভেব না, বেটা নেশাখোর… কাঠ এসে পড়লেই সব ঠিক হবে…তুমি আর দাঁড়িও না খুড়ো।”

কৃষ্ণপ্রাণ তাঁহার কথায় সায় দেওয়াতে লক্ষ্মীনারায়ণ কালবিলম্ব আর না করিয়া আপন কন্যার কাছে। আসিলেন, যশোবতী তখনও সেইভাবে বসিয়া আছেন। পিতা কন্যাকে দেখিয়া চমকাইয়া উঠিলেন, কেননা যশোবতাঁকে অপরিমিতা কৃষ্ণবর্ণা দেখাইতেছিল; তথাপি তিনি কোনমতে অসংলগ্নভাবে অনেক। কথাই কহিলেন, “কি মা, বেশ ভাল লাগছে ত…যাক সব ভালয় ভালয় হল। মা, ভগবানকে ডাক…মন। বসছে ত মা…তিনি বল দেবেন, আমি…আমি এবার যাব।” পিতা যেন আদিমতা।

“বাবা…”

“কোন ভয় নেই, তোমার পুণ্যে মাগো–আমাদের স্বর্গ বাস হবে, মৃত্যু মরণ যদি…কেউ আগে, কেউ পরে; আবার এমনও হতে পারে” বলিয়া জি কাটিয়া কহিলেন, “সীতারাম পুনর্জীবন লাভ করতে পারে…তোমার কপাল জোর” বলিয়াই নিকটে অপেক্ষমাণ ব্রাহ্মণদের সমর্থনের আশায় তাকাইলেন।

তাঁহারা, ব্রাহ্মণেরা, ইহাতে পুঁথিগত মস্তক আন্দোলন করেন। ইহার পর তাঁহাদের মৃত্যু সম্পর্কে অসংখ্য যোগের প্রেরণা, যুবতীজনের বক্ষের বসন্তকে ভিখারী মায়াবাদে সম্মোহিত করিল; কিন্তু একথা প্রকাশ থাক, কিছু পূর্বাহে–যখন লক্ষ্মীনারায়ণ তাঁহাকে কৃষ্ণবর্ণা দেখেন, তখন তাঁহার কন্যার চতুর্থ অবস্থা আগত; ফলে, যশোবতীর কেমন এক বিশ্বাস হইয়াছিল যে তিনি নিজেই সাধক রামপ্রসাদকে বেড়া বাঁধিতে সাহায্য করিয়া থাকিবেন। এবং একারণে এখনও সৰ্ব্ব দেহে বিদ্যুৎ খেলিতেছিল। তিনি আপনার সেই অন্তরঙ্গতা লইয়া ইহাদের স্নেহ বচন শুনিতেছিলেন, এমত সময়ে তাঁহাদের বাক্যে সতীমাহাত্ম্য গৰ্জন করিয়া উঠিল–কৃষ্ণপ্রাণ যথাযথ অলঙ্কার দিয়াছিলেন।

যশোবতী কৰ্ত্তব্যবশে একদা স্বামীর প্রতি অবলোকন করিয়া ভাবিলেন, জীবন যৌবন দিয়া অমোঘকালের সহিত যুদ্ধ আর কতকাল! ঝটিতি তাঁহার সম্মুখে উদ্ভাসিত হইল জগজন-চিতচোর। নারায়ণ, শ্রীকৃষ্ণ সাক্ষাৎ পূর্ণব্রহ্ম, তাঁহার মুকুটের ময়ূর-পুচ্ছে ইহলৌকিক যোনি-চিহ্ন!

যশোবতীর দৃষ্টিপথে, মানস চক্ষে, কল্পনায়, সতীদাহ অনুষ্ঠান ভাসিয়া উঠিল; অনেক সতীদাহ দেখিয়াছিলেন, সুতরাং তাঁহার পক্ষে এ কল্পনা কষ্টসাধ্যের নয়। দেখিলেন, অসংলগ্ন অনেক রূপ কৰ্ম্ম ভাসিয়া উঠিল, কখন আপনার প্রায়শ্চিত্ত পিণ্ডদান কখন বা আপনার তর্পণাদি উদক ক্রিয়ার নিমিত্ত, গঙ্গা অভিমুখে ধীর মন্থর গতিতে তিনি গমনশীলা, এ গতি অতীব সুদারুণ। প্রতি পদক্ষেপে অতীত পদদলিত হইতেছে, সম্মুখে জাগ্রত অবস্থামাত্র। তিনি যেমত বা নীড়ৈকলম্পট শ্যেনপক্ষীর ন্যায়, ক্রমাগতই ধাবমান। এখন ত্রিতাপহারিণী গঙ্গায় তাঁহার সুন্দর তড়িৎ-সম্ভবা তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ দেহের অধোভাগ নিমজ্জিত, সুখস্পর্শ হস্তের অঙ্গুলিতে কুশ অঙ্গুরীয় ইদানীং কিয়ৎ পরিমাণে আপনাকে ভেদজ্ঞানে রাখিয়াছে, দ্বিবিধবোধের মধ্যে তাঁহার চেতনা অলস। একদিক আয়ুষ্মান্–অন্যপক্ষে রথের শব্দ, শূন্যে পক্ষীরা উড্ডীয়মান।

সহসা বায়ু স্তব্ধ, আলোকরশ্মি বস্তুরূপ ধারণ করত ধ্বংসপ্রাপ্ত, দুঃখ অস্ফুট আঃ ধ্বনি সহকারে লুপ্ত হইল। আতপ-তপ্ত পদ্মের ন্যায়, পরিক্লিষ্ট উৎপলের ন্যায় ধূলামলিন স্বর্ণের ন্যায় যশোবতী, মুখমণ্ডল তুলিয়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করত চাহিলেন, পারিপার্শ্বিক দিকসমূহে শূন্যতা মেঘসন্নিভ; কাব্যঘন কিছুকাল পূৰ্ব্বের আপনার গাত্রহর্ষে লোক চরাচর যে আবেগে স্পন্দিত হইয়াছিল, তাহারই ক্ষীণ, সূক্ষ্ম, ম্লান, ধীর, অস্পষ্ট, অল্পকম্পন তরঙ্গস্তর এখানে পরিব্যাপ্ত। পিতৃলোকগত যশোবতী! আপনাকে আহ্বান করিতে গিয়া স্বপ্নহীন; তাঁহার ওষ্ঠদ্বয় কম্পিত হইল–সঙ্গে সঙ্গে বনান্তরাল চমকিত সবুজতা ফুসিয়া উঠল, অন্তঃসত্ত্বা সর্পের গর্ভপাত হইল। শ্রাবণমেঘের কিশোর বজ্র সকল দিত্মণ্ডলে ইতস্ততঃ ছুটাছুটি করিতে লাগিল।

যশোবতী নির্বিকার, গঙ্গার শৈত্য আর নাই, কুশ অঙ্গুরীয় অজগলস্তন; গম্ভীরকণ্ঠে কহিলেন, “তুমি পিতৃলোকে গমন করিয়াছে, মদ্দত্ত সুনির্মল স্বচ্ছ জল গ্রহণ কর”, বলিতে ‘তুমি’ শব্দ উচ্চারিত হইল না, বলিলেন, “আমি পিতৃলোক গমন করিয়াছি মদ্দত্ত সুনির্মল জল গ্রহণ করি…” এসময় তাঁহার স্বরভঙ্গ, জিহ্বা কণ্ঠগত শুষ্ক হইয়াছিল, স্তন্যপানে সুতৃপ্ত ধ্বনির ন্যায় তাঁহার কণ্ঠস্বর বিশ্বসংসারে আলোড়িত হয়। ক্রমে আপনার মুখগহ্বরে সকল কিছু দান করিতে গিয়া হচেতন হইয়া গঙ্গায় পতিত হইলেন। সকলে তাঁহাকে কোনরূপে গঙ্গা হইতে উদ্ধার করিয়া এখানে আনিল। জ্ঞানের পর তাঁহার ওষ্ঠপ্রান্তে মৃদু হাস্য ছিল।

চতুর্দোলার আসনে যজ্ঞবাট করা হইয়াছে, চারিভিতে ছোঁড়া কদলীবৃক্ষ লাল সূতা দিয়া গণ্ডীবদ্ধ, উপরে মালাকার মেঢ় ঝুলাইতে ব্যস্ত, প্রতিটি মেঢ়ে দশমহাবিদ্যার এক এক রূপ আলেখ্য, শেষ কয়েকটি মালাকরের ছেলেরা আঁকিতেছে, তাহাদের বধূরা ফুলমালা গাঁথে, ধান্য কঙ্কন, খৈয়ের সাত নহর তৈয়ারী হয়। দিকে দিকে হরিধ্বনি, কাঁসর ঘণ্টা ঢাক বাজিতেছে, পক্ষীরা ভয়ার্ত পলায়মান, গাছে গাছে ‘চালকা’ কাপড়ের নিশান উড়িতেছে। কীৰ্ত্তন হয়, কোথাও খাঞ্চে করিয়া সামলা মাথায় একজনা। ঢপ গাহিতেছে, তাহার সামলার চুমকী পুঁতি আবেগে চঞ্চল। সিন্দুর বিক্রেতা গেরী মাটিতে লা। মিশাইয়া ভাটি বসাইয়াছে; নূরীরা রুলী গড়ে, তাঁতিরা এবং কাঁপালিরা সূতা কাটিয়া আলতায় রঙ করিতেছে, ছুতার আপন মনে তুলসীমালা গাঁথিতে ব্যস্ত; বাটাদার কড়ির পাহাড় করিয়াছে; লোয়াদার বাতাসাওয়ালারা একদিকে বাতাসা কাটিতেছে (যাহা অসম্ভব কারণ লোয়াদা এইস্থান হইতে, পদব্রজে, প্রায় চল্লিশ মাইল)। পুণ্যলোভী স্ত্রীলোকেরা স্থানচ্যুত হইবার আশঙ্কায়, পার্শ্ব পরিবর্তন পর্য্যন্ত করিতেছেন না, ফলে অনেকেই স্থান অপবিত্র করিতেছেন। কেহ কেহ উত্তম স্থানের লোভে দৌড়াদৌড়ি করিতেছেন। ব্রাহ্মণেরা শশব্যস্তে পাঁজী পাঠ করিতেছেন, অন্যান্যেরা পরামর্শে নিশ্চল, সহসা নস্য লইয়া পুনৰ্ব্বার শাস্ত্রীয় বুদ্ধিযুক্ত। যশোবতী একভাবে বসিয়াছেন, বর্গভীমা মন্দিরে ইষ্টকে প্রতিমা উল্লিখিত ভঙ্গীতে; অভিজাত গৃহের রমণীরা তাঁহাকে সাজাইতে ব্যস্ত, তাঁহারা আপন আপন গৃহ হইতে প্রসাধন সামগ্রী আনিয়াছেন, গোলাপ-পাশে সূক্ষ্ম কারুকার্য্য, ইঁহাদের আনীত দর্পণের পিছনে কলাইকৃত প্রসাধনরত রাধা প্রতিমা, জড়োয়া সুখপক্ষী অঙ্কিত কাজললতা। স্বর্ণভৃঙ্গার হইতে তাঁহাকে উম্মল-পানি দেওয়া হইতেছে, তিনি সহাস্যবদনে তাহা পান করিতেছেন এবং তাঁহার চক্ষু আরক্ত। হায় মোহিনী মায়া! গোলাপের সহচরী, ফলে গোলাপের ম্লান তাঁহাকে পাইয়াছিল। নিকটে বন্ধ-চিত্র জাঁতি দিয়া একজন গুবাক কাটিতেছেন। জাঁতির সুরত ক্রীড়ারত স্ত্রী-পুরুষের হেবজ হাস্য, লোকক্ষয়কারী প্রবৃদ্ধকালের অহঙ্কারকে চূর্ণ করিতেছে! এয়োস্ত্রীগণ চুল দিয়া পথ মার্জনা করিলেন, জল সিঞ্চিত হইল। অধুনা যশোবতী চতুর্দোলায়, তিনি যেন লক্ষ্মীমূৰ্ত্তি, একহস্তে প্রস্ফুটিত পদ্ম, কখনও বা দেখিলেন পঞ্চ পল্লব, অন্য হাতে বরাভয়। যশোবতী ইদানীং সাক্ষাৎ চম্পক ঈশ্বরী। তাঁহাকে নামান হইল। হাজার হাজার স্ত্রী শরীর তাঁহার পায়ের কাছে কাছে গড়াইয়া পড়িতেছে। কাহারও মস্তকে তাঁহার পা পড়িয়া পিছলাইতেছে; কোন কোন রমণী অজ্ঞান হইতেছেন। কত শাঁখা তাঁহার পায়ে লাগিতেছে সিঁন্দুর পড়িতেছে। চতুর্দোলা হইতে নামিবার পরে অনেকেই তাঁহার স্মৃতি সংগ্রহের জন্য কেশ আকর্ষণ করিতে তৎপর…, একটি একটি চুল গেল, অনেক কিছুই গেল, ক্রমে বীভৎস রূপ ধারণ করিলেন। তিনি দৌড়াইয়া চিতায় উঠিলেন…অগ্নি সংযোগ করা হইল, শাঁখা কড়ি স্বর্ণালঙ্কার উড়িল। লেলিহান শিখায় গৃহাভিমুখী সুখপক্ষীর দল ছত্রাকার, কোনটি বা বিমোহিত হইয়া চিতার মধ্যে নিশ্চিহ্ন। প্রলয়ের শব্দ ধ্বনিত হইল। একটি রমণী তাঁহাকে দেখিয়া অচেতন হইলেন, ক্রোড়ের শিশু স্তন্যপান করিতে লাগিল আর কাঁদিতে লাগিল। চিতা হইতে দেখিলেন–পার্থিব মায়াবন্ধনে অধীর হইয়া একটি লোক লাঠির উপরে মুখ ন্যস্ত করিয়া আছে, আর কখনও কখনও লোকটির দৃষ্টি ধূম উদগীরণকে অনুসরণ করিতেছে।

যশোবতীর ভ্রম দর্শন অপগত হইল। তিনি যেন বা ঝুঁকিয়া পড়িতেছিলেন, কোনক্রমে টাল সামলাইয়া কহিলেন, “বাবা তুমি” বলিয়া লক্ষ্মীনারায়ণের কানে কানে কহিলেন, “ভয়!”ভয় বাক্যটিতে যে তৃণগুল্ম জড়াইয়াছিল তাহা সকলই কাঁপিয়া উঠিল।

“কোন ভয় নেই মা, তোমার ছেলেরা রইল, আমিও যত তাড়াতাড়ি…”

যশোবতী আশ্বস্ত হইলেন।

লক্ষ্মীনারায়ণ অন্য পার্শ্বে, বেলাতটে শায়িত বলরাম ও হরেরাম উদ্দেশ্যে কহিলেন, “তোমাদের বাড়ীতে কি খবর দেবে…।”

“একটা খবর…চিড়ে গুড় ত বহু আছে…এখন,…থাক আপনি তাড়াতাড়ি আসবেন” বলরাম কহিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *