এই-যে জগৎ হেরি আমি ,
মহাশক্তি জগতের স্বামী ,
এ কি হে তোমার অনুগ্রহ ?
হে বিধাতা কহো মোরে কহো ।
ওই – যে সমুখে সিন্ধু , এ কি অনুগ্রহবিন্দু ?
ওই – যে আকাশে শোভে চন্দ্র সূর্য গ্রহ ,
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তব অনুগ্রহ ?
ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্র একজন
আমারে যে করেছ সৃজন ,
এ কি শুধু অনুগ্রহ করে
ঋণপাশে বাঁধিবারে মোরে ?
করিতে করিতে যেন খেলা
কটাক্ষে করিয়া অবহেলা ,
হেসে ক্ষমতার হাসি অসীম ক্ষমতা হতে
ব্যয় কয়িয়াছ এক রতি
অনুগ্রহ করে মোর প্রতি ?
শুভ্র শুভ্র জুঁই দুটি ওই – যে রয়েছে ফুটি
ও কি তব অতি শুভ্র ভালোবাসা নয় ?
বলো মোরে , মহাশক্তিময় ,
ওই – যে জোছনা – হাসি ওই – যে তারকারাশি ,
আকাশে হাসিয়া ফুটে রয় ,
ও কি তব ভালোবাসা নয় ?
ও কি তব অনুগ্রহ – হাসি
কঠোর পাষাণ লৌহময় ?
তবে হে হৃদয়হীন দেব ,
জগতের রাজ – অধিরাজ ,
হানো তব হাসিময় বাজ ,
মহা অনুগ্রহ হতে তব
মুছে তুমি ফেলহ আমারে —
চাহি না থাকিতে এ সংসারে ।
ভালোবাসি আপনা ভুলিয়া ,
গান গাহি হৃদয় খুলিয়া ,
ভক্তি করি পৃথিবীর মতো ,
স্নেহ করি আকাশের প্রায় ।
আপনারে দিয়েছি ফেলিয়া
আপনারে গিয়েছি ভুলিয়া
যারে ভালোবাসি তার কাছে
প্রাণ শুধু ভালোবাসা চায় ।
সাক্ষী আছ তুমি অন্তর্যামী
কতখানি ভালোবাসি আমি ,
দেখি যবে তার মুখ হৃদয়ে দারুণ সুখ
ভেঙে ফেলে হৃদয়ের দ্বার ,
বলে , “ এ কী ঘোর কারাগার !”
প্রাণ বলে , “ পারি নে সহিতে ,
এ দুরন্ত সুখেরে বহিতে । ”
আকাশে হেরিলে শশী আনন্দে উথলি উঠি
দেয় যথা মহাপারাবার
অসীম আনন্দ উপহার ,
তেমনি সমুদ্র – ভরা আনন্দ তাহারে দিই
হৃদয় যাহারে ভালোবাসে ,
হৃদয়ের প্রতি ঢেউ উথলি গাহিয়া উঠে
আকাশ পুরিয়া গীতোচ্ছ্বাসে ।
ভেঙে ফেলি উপকূল পৃথিবী ডুবাতে চাহে ,
আকাশে উঠিতে চায় প্রাণ —
আপনারে ভুলে গিয়ে হৃদয় হইতে চাহে
একটি জগতব্যাপী গান ।
তাহারে কবির অশ্রু হাসি
দিয়েছি কত – না রাশি রাশি ,
তাহারি কিরণে ফুটিতেছে
হৃদয়ের আশা ও ভরসা
তাহারি হাসি ও অশ্রুজল
এ প্রাণের বসন্ত বরষা ।
ভালোবাসি , আর গান গাই
কবি হয়ে জন্মেছি ধরায়
রাত্রি এত ভালো নাহি বাসে ,
উষা এত গান নাহি গায় ।
ভালোবাসা স্বাধীন মহান ,
ভালোবাসা পর্বতসমান ।
ভিক্ষাবৃত্তি করে না তপন
পৃথিবীরে চাহে সে যখন —
সে চাহে উজ্জ্বল করিবারে ,
সে চাহে উর্বর করিবারে ,
জীবন করিতে প্রবাহিত ,
কুসুম করিতে বিকশিত ।
চাহে সে বাসিতে শুধু ভালো
চাহে সে করিতে শুধু আলো
স্বপ্নেও কি ভাবে কভু ধরা ,
তপনেরে অনুগ্রহ করা ?
যবে আমি যাই তার কাছে
সে কি মনে ভাবে গো তখন
অনুগ্রহ ভিক্ষা মাগিবারে
এসেছে ভিক্ষুক একজন ?
অনুগ্রহ পাষাণমমতা
করুণার কঙ্কাল কেবল ,
ভাবহীন বজ্রে গড়া হাসি —
স্ফটিককঠিন অশ্রু – জল ।
অনুগ্রহ বিলাসী গবিত ,
অনুগ্রহ দয়ালু – কৃপণ —
বহু কষ্টে অশ্রুবিন্দু দেয়
কাছে যবে আসিবারে চায়
প্রণয় বিলাপ করি উঠে —
গীতগান ঘৃণায় পলায় ।
হে দেবতা , অনুগ্রহ হতে
রক্ষা করো অভাগা কবিরে ,
অপযশ অপমান দাও —
দুঃখ জ্বালা বহিব এ শিরে ।
সম্পদের স্বর্ণকারাগারে ,
গরবের অন্ধকার – মাঝ ,
অনুগ্রহ রাজার মতন
চিরকাল করুক বিরাজ ।
সোনার শৃঙ্খল ঝংকারিয়া
গরবের স্ফীত দেহ লয়ে
অনুগ্রহ আসে নাকো যেন
আমাদের স্বাধীন আলয়ে ।
গান আসে ব ‘ লে গান গাই ,
ভালোবাসি ব ‘ লে ভালোবাসি ,
কেহ , যেন মনে নাহি করে
মোরা কারো কৃপার প্রয়াসী ।
নাহয় শুনো না মোর গান ,
ভালেবাসা ঢাকা রবে মনে ।
অনুগ্রহ করে এই কোরো —
অনুগ্রহ কোরো না এ জনে ।