অনিন্দ্যসুন্দরের অপমৃত্যু
‘মৃত্যুর সময়ে বয়স কত হয়েছিল? বাহান্ন—তাই তো?’ দেবদূত সূর্যকান্ত প্রশ্ন করল।
‘হ্যাঁ—বাহান্ন’। শ্রান্ত স্বরে জবাব দিলেন অনিন্দ্যসুন্দর চৌধুরী। তাঁর মনে হল, সেই এসে থেকে যেন শুধু প্রশ্নেরই জবাব দিয়ে যাচ্ছেন।
‘মৃত্যুর কারণ?’ দেবদূত বলে চলল।
‘হার্ট অ্যাটাক। অন্তত আমার তাই ধারণা।’ অনিন্দ্যসুন্দর উত্তর দিলেন।
‘হুম।’ দেবদূতকে যেন সামান্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হল, ‘এইবারে শেষ প্রশ্ন। খাতায় লেখা আছে, হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক কারণ, যে-কোনও একটায় দাগ দিন: আত্মোৎসর্গ, দুর্ঘটনা, রক্তচাপ, কায়িক শ্রম, নির্বুদ্ধিতা, খুন ইত্যাদি। এখানে দেখছি ”খুন” শব্দটায় টিক মার্ক দেওয়া আছে।’
অনিন্দ্যসুন্দর সোজা হয়ে উঠে বসলেন ‘খুন?’
‘হ্যাঁ,’ সুর্যকান্ত বলল, ‘খাতার এই পাতাটা আপনার নামে। এখানে তো দেখছি, খুনই বলা আছে। অবশ্য আমার ভুল হলে আপনি ধরিয়ে দেবেন বইকী। আপনি তো খুনই হয়েছেন, তাই-না, মিস্টার চৌধুরী?’
‘না, মানে, আমি তো সেরকম ভাবিনি। আমি…।’
‘তার মানে, আপনি যে খুন হয়েছেন, তা আপনি জানেন না?’ সহানুভূতির সুরে বলল সূর্যকান্ত।
‘না, এ-আমি স্বপ্নেও ভাবিনি!’
সূর্যকান্ত দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল: ‘হ্যাঁ, কখনও-কখনও যে এরকম হয় না তা নয়। তবে খুন হলে বেশিরভাগ লোকই সেটা বুঝতে পারে। অন্তত শেষ মুহূর্তে হলেও টের পায়। এধরনের খুনের খবর যে কীভাবে মোলায়েম করে ভাঙতে হয়, তা আমি আজও শিখলাম না।’
‘এ আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না।’ বেশ কয়েকবার এই কথাটা আপনমনে উচ্চারণ করলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
‘আপনাকে আঘাত দেওয়ার জন্যে দুঃখিত, মিস্টার চৌধুরী। তবে জানবেন, এখানে এসবে কিছু যায় আসে না।’
‘মনে আছে, আমি স্টাডি-রুমে বসেছিলাম। হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। হঠাৎ এক সাংঘাতিক যন্ত্রণায় আমার ঘুম ভেঙে যায়…ঠিক বুকের ভেতর…তারপর আর কিছু ভেবে ওঠার সময় পাইনি।’
‘এছাড়া আরও একটা কথা এখানে লেখা আছে,’ খাতায় চোখ বুলিয়ে সূর্যকান্ত বলল, ‘আঘাতটা আপনার হার্টেই লেগেছিল, মিস্টার চৌধুরী। আপনারই কাগজ-কাটার ছুরি দিয়ে আপনাকে আঘাত করা হয়েছে…পিঠে…।’
‘এতো রীতিমতো পৈশাচিক,’ বিস্মিত সুরে বলে উঠলেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘আমার কাগজ-কাটার ছুরিটা কী সুন্দর…ওটার হাতলটা সত্যিকারের হাতির দাঁতের তৈরি…কে এ-কাজ করেছে?’
‘তার মানে? কে কী কাজ করেছে?’
‘কে আমাকে খুন করেছে?’
‘সেকী! আমি কী করে জানব?’
‘আপনি না জানলে, কে জানবে! আমি তো ভেবেছি আপনার ওই নরকের খাতায় সব খবরই লেখা আছে।’
‘এটা নরকের খাতা নয়।’
‘সে যাই হোক, বলুন, কে আমাকে খুন করেছে?’
‘মিস্টার চৌধুরী!’ কঠোর স্বরে বলে উঠল সূর্যকান্ত, ‘প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ইত্যাদিকে এখানে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না—এটা আপনার জানা উচিত।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি এমনিই জানতে চাই।’
‘আপনাকে কে খুন করেছে, আমি জানি না, মিস্টার চৌধুরী। আমি দেবদূত হতে পারি, তাই বলে সবজান্তা নই। কারও সম্পর্কে আমরা সমস্ত তথ্য জানতে পারি তার মৃত্যুর পর। তখনই তার নামে খাতা তৈরি হয়। সুতরাং নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার খুনের জন্যে যে দায়ী তার মৃত্যুর পর সব তথ্য আমার হাতে আসবে, তখন সহজেই আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।’
‘সেটা কবে?’
‘যদি খুনি ধরা পড়ে এবং তার ফাঁসি হয়, তা হলে—বলতে পারেন, খুব শিগগিরই জানতে পারব। আর খুনি যদি সেরকম চালাক হয়ে থাকে এবং পুলিশের চোখে ধুলো দিতে পারে, তা হলে অনেক বছরের ধাক্কা।’
‘অতদিন আমি অপেক্ষা করতে পারব না! আমি এক্ষুনি জানতে চাই।’ অনিন্দ্যসুন্দর উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে শুরু করলেন।
‘মিস্টার চৌধুরী, আমি দুঃখিত…।’
‘এখানে এমন কেউ নেই, যিনি সব জানেন?’
‘অবশ্যই আছেন, দেবরাজ। উনি সব জানেন।’
‘তা হলে তাঁকেই জিগ্যেস করুন।’
‘অসম্ভব। এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে তাঁকে বিরক্ত করতে পারি না। মিঃ চৌধুরী, বসুন।’
কিন্তু সে-কথায় কর্ণপাত করলেন না অনিন্দ্যসুন্দর, পায়চারি করেই চললেন। তারপর হঠাৎই সূর্যকান্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি বলেছিলেন, এখানে আমি সুখে-শান্তিতে বাস করতে পারব?’
‘নিশ্চয়ই।’ গভীর আশ্বাসের সুরে বলল সূর্যকান্ত।
‘কে আমাকে খুন করেছে সেটা না-জানতে পারলে কী করে আমি সুখে-শান্তিতে থাকব বলতে পারেন?’
‘তাতে অসুবিধেটা কী আমি তো বুঝে উঠতে পারছি না, মিস্টার চৌধুরী!’
বেশ চেষ্টা করে নিজেকে গুছিয়ে নিলেন অনিন্দ্যসুন্দর, তারপর সোনার চেয়ারে আবার বসলেন। শান্ত স্বরে বলতে শুরু করলেন, ‘সূর্যকান্তবাবু, দয়া করে বলবেন, আপনার খাতায় আমার পেশার জায়গায় কী লেখা আছে?’
‘আপনি রহস্য-গোয়েন্দা গল্পের লেখক ছিলেন।’
‘ঠিক তাই। সুন্দর সান্যাল ছদ্মনামে আমি পঁচাত্তরটা রহস্য উপন্যাস লিখেছি—তার একডজনেরও বেশি সিনেমা হয়েছে—এ ছাড়া অসংখ্য ছোট গল্প তো আছেই। এ থেকে কিছু আঁচ করতে পারছেন, সূর্যকান্তবাবু?’
‘না, মানে, ঠিক…।’
‘এখনও বুঝতে পারছেন না?’ অনিন্দ্যসুন্দর প্রায় ধৈর্য হারালেন: ‘আমি কে, না, প্রখ্যাত রহস্যকাহিনীকার সুন্দর সান্যাল, বিগত তিরিশ বছর ধরে যে শুধু প্রশ্ন করে গেছে, কে খুন করেছে? এবং বারবার তার উত্তরও দিয়েছে। আর, এখন! আমি নিজেই খুন হলাম অথচ জানি না, কে আমাকে খুন করেছে!’
দেবদূত সূর্যকান্ত হাসল। বলল, ‘এবার আপনার কথা ধরতে পেরেছি, মিস্টার চৌধুরী। কিন্তু যে-প্রশ্নের উত্তর আপনি জানতে চান তা যথাসময়ে আমাদের হাতে আসবে। এখন একটু ধৈর্য ধরে শান্ত হোক—।’
‘খুনির পরিচয় আমাকে জানতেই হবে,’ অনিন্দ্যসুন্দর উদ্দেশ্যে অটল, ‘সেটা না-জানা পর্যন্ত আমার সুখ নেই, শান্তি নেই। পিঠে ছুরি মেরে খুন করেছে! ওঃ কী আস্পর্ধা!’
সূর্যকান্ত সান্ত্বনার সুরে বলল, ‘মিস্টার চৌধুরী, অল্পেতে হতাশ হবেন না। আগে এ-জায়গাটা ঘুরে-ফিরে দেখুন। যেসব সুখ-সুবিধে এখানে আছে…।’
অনিন্দ্যসুন্দর চেয়ারে এলিয়ে পড়লেন, মেঝের দিকে চোখ রেখে বললেন, ‘আমি কিচ্ছু দেখতে চাই না। এসব সুখ-সুবিধে শুধু কথার কথা।’
‘মিস্টার চৌধুরী!’
‘মিথ্যে। সব মিথ্যে। সুখ! শান্তি! আমার মনে এতটুকু সুখ নেই। আমার এখানে একটুও ভালো লাগছে না।’
‘এখানে আপনার ভালো লাগতে বাধ্য,’ সূর্যকান্তের স্বরে আতঙ্ক উঁকি মারল ‘এখানে সুখী না-হওয়াটা সম্পূর্ণ অসম্ভব। কারণ এটা স্বর্গ—আপনি স্বর্গে রয়েছেন, মিস্টার চৌধুরী।’
‘স্বর্গ না ঘেঁচু! আমার এখানে একটুও ভালো লাগছে না।’
দেবদূত উঠে দাঁড়াল। সুন্দর মার্বেল পাথরের মেঝেতে নগ্ন পায়ে নিঃশব্দে পায়চারি করতে লাগল। আপনমনেই বারকয়েক বিড়বিড় করে বলল, ‘কী অদ্ভুত কাণ্ড! নাঃ, এ অসম্ভব!’ তারপর অনিন্দ্যসুন্দরের দিকে ফিরে বলল, ‘মিস্টার চৌধুরী, আর-একবার ভেবে দেখুন। আপনি…।’
‘না, আমার একটুও ভালো লাগছে না।’
‘দয়া করে একটু বোঝার চেষ্টা করুন, মিস্টার চৌধুরী।’ সূর্যকান্ত অনুনয় করল, ‘আপনি যদি এভাবে সারা স্বর্গে ঘুরে বেড়ান আর বলতে থাকেন, আপনার মনে এতটুকু সুখ-শান্তি নেই, তা হলে আমাদের সম্মান, সুনাম সব কোথায় যাবে বলুন তো? স্বর্গে এসে আপনার মনে সুখ নেই এ-কথা শুনলে, লজ্জায়, অপমানে দেবরাজ ইন্দ্রের যে মাথা কাটা যাবে!’
‘বিশ্বাস করুন, আমার মনে এতটুকু শান্তি নেই।’ অনিন্দ্যসুন্দর আবার বললেন, এবং তাঁর অভিব্যক্তিতেও সে-ইঙ্গিত স্পষ্ট।
‘ঠিক আছে, আমি দেবরাজ ইন্দ্রকে জিগ্যেস করে দেখছি।’ সূর্যকান্ত বলল। তার অভিব্যক্তি দেখে বোঝা গেল, এইমুহূর্তে সুখ এবং শান্তি তার মন থেকেও উবে গেছে। একটু ইতস্তত করে সে আবার বলল, ‘দেবরাজ এত ব্যস্ত থাকেন…তা ছাড়া আজকাল তাঁর মেজাজটাও ভালো নেই। কিন্তু তাঁকে তো বলতেই হবে। নইলে তিনি যদি একবার জানতে পারেন যে, স্বর্গে এসেও একজন মানুষ অসুখী, তা হলে আমাকেই দোষ দেবেন। আমি এই ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার, মিস্টার চৌধুরী। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, এখানকার সব দায়দায়িত্ব আমার ঘাড়েই চাপবে।’
‘ভালো না-লাগলে কী করব বলুন!’
শিউরে উঠে দেবদূত আবার পায়চারি শুরু করল। খোলা জানলা দিয়ে মাঝে-মাঝে ভেসে আসছে উচ্ছ্বল হাসির টুকরো শব্দ, কখনও-বা সঙ্গীতের হালকা সুর। কিন্তু ঘরের ভেতরে অনিন্দ্যসুন্দর চৌধুরী গম্ভীর হতাশ মুখে বসে।
হঠাৎই সূর্যকান্তের মুখে হাসি ফুটে উঠল। দ্রুতপায়ে নিজের টেবিলের কাছে ফিরে গেল সে, বসল চেয়ারে।
‘মিস্টার চৌধুরী, আপনি তো রহস্য গল্পের লেখক,’ দ্রুত স্বরে বলতে শুরু করল দেবদূত, ‘সূত্র তৈরি করতে বা খুনিদের ফাঁদে ফেলতে আপনার জুড়ি নেই, কী বলেন?’
‘তা বলতে পারেন।’
সূর্যকান্ত বলে চলল, ‘যে-মতবলটা আমার মাথায় এসেছে সেটা পুরোপুরি বেআইনি, কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এ ছাড়া পথ নেই। মিস্টার চৌধুরী, যদি আপনাকে আবার পৃথিবীতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, তা হলে আপনি পারবেন নিজের হত্যা-রহস্যের সমাধান করতে? কী মনে হয় আপনার?’
‘সে আমি বোধহয়…।’
‘এর বেশি আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়।’ কঠোর স্বরে বলল সূর্যকান্ত।
‘চেষ্টা করে দেখতে পারি, কিন্তু আমি কীভাবে…?’
‘খুব সহজ।’ বাধা দিয়ে বলল সূর্যকান্ত, ‘আপনি এখন পরলোকে বাস করছেন, সুতরাং সময় বলে এখানে কিছু নেই। আমরা শুধু যা করব, তা হল, একটা সময়ের পুনরাবৃত্তি ঘটাব, মানে, অ্যাকশন রিপ্লে করব…ধরুন, একটা দিন। আপনি পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে আপনার মানবজীবনের শেষ দিনটা আবার নতুন করে বাঁচবেন। দেখুন…এই যে! আপনি মারা গেছেন রাত ঠিক এগারোটায়। সেইদিন সকাল ঘুম ভাঙার পর থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত সময় আপনাকে দেওয়া হল।’
‘মাত্র একটা দিন?’ অনিন্দ্যসুন্দরের ভুরু কুঁচকে উঠল: ‘ওইটুকু সময়ে কি পারব?’
‘তা যদি না-পারেন, তা হলে চেষ্টা করে আর…।’
‘না, পারব।’ ঝটিতি বলে উঠলেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘বলুন, কখন যেতে হবে?’
‘এক্ষুনি। কিন্তু প্রথমেই একটা কথা বলে রাখি, মিস্টার চৌধুরী। জীবনের শেষ দিনটার প্রতিটি খুঁটিনাটি ঘটনা এই খাতায় লেখা রয়েছে, সুতরাং সেরকম কোনও তথ্যগত পরিবর্তন আপনি করতে পারবেন না। তবে হ্যাঁ, একটু-আধটু গোয়েন্দাগিরি তো আপনাকে করতেই হবে, যেটা আপনি প্রথমবারে করতে পারেননি। আর, দরকার হলে খাতায় অল্পস্বল্প মোছামুছি আমি করে নেব, কিন্তু সেরকম বড় কিছু পালটাতে গেলে ভীষণ মুশকিলে পড়তে হবে।’
‘কিন্তু—।’
‘সোজা কথায়, বড়সড় কোনও ওলটপালট ছাড়াই আপনাকে ম্যানেজ করতে হবে। এতে কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। মনে রাখবেন, মরণশীল প্রাণীদের যে-বর ক্বচিৎ-কখনও দেওয়া হয়, সেই অমূল্য বর আপনাকে দেওয়া হবে।’
‘ভবিষ্যৎদৃষ্টি!’ বিস্ময়ে বলে উঠলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
‘হ্যাঁ। কিন্তু, মিস্টার চৌধুরী, আগেই বলে রাখি, আপনাকে কিন্তু আবার একইভাবে খুন হতে হবে।’
অনিন্দ্যসুন্দরের উজ্জ্বল চোখ মুহূর্তে নিভে গেল। হতাশ সুরে তিনি বললেন, ‘আবার সেই পিঠে ছুরি খেয়ে মরতে হবে—।’
মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল দেবদূত। বলল, ‘খাতায় তাই লেখা আছে।’ তারপর অমোঘ নির্ঘোষের মতো গর্জে উঠল তার মন্দ্রস্বর, ‘আমার প্রস্তাবে রাজি হওয়া-না-হওয়া সম্পূর্ণ আপনার ইচ্ছে। মত দেওয়ার আগে ভালো করে ভেবে দেখুন।’
‘না…আমি রাজি। কে আমাকে খুন করেছে জানতেই হবে।’
‘বেশ, তা হলে তাই হোক। আমার শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন, মিস্টার চৌধুরী। এখানে সমস্ত আত্মাই সুখী হোক, সেটাই আমরা চাই।
‘ধন্যবাদ।’ অসন্তুষ্ট স্বরে বললেন অনিন্দ্যসুন্দর এবং বিশাল সোনার দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন।
…ঘুম ভাঙল তাঁর নিজের বিছানায়, নিজের বহুপরিচিত শোওয়ার ঘরে। বাড়িটা অন্ধকার ছায়াময় এক প্রাচীন প্রাসাদ। অনিন্দ্যসুন্দরের অত্যন্ত প্রিয়। কারণ, তাঁর ধারণা, কোনও রহস্যকাহিনিকারের পক্ষে এ-বাড়ির প্রকৃতি ও পরিবেশ যথেষ্ট মানানসই। বসবার ঘরের সুপ্রাচীন পিতামহ-ঘড়িতে এগারোটার ঘণ্টা বাজতে শুরু করল। শুয়ে-শুয়েই ঘণ্টার শব্দ গুনে চললেন তিনি, এবং হঠাৎই তাঁর মনে হল, এ-হয়তো রাত এগারোটার ইঙ্গিত—কিন্তু সে-এক ভয়ঙ্কর মুহূর্তের জন্য। তারপরই নিজের ভুল বুঝতে পারলেন অনিন্দ্যসুন্দর। দেখলেন, পরদার ফাঁক দিয়ে তীব্র সূর্য ঘরের মেঝেতে জায়গা করে নিয়েছে। এখন তা হলে বেলা এগারোটা। সুপ্রসিদ্ধ লেখকের ঘুম থেকে ওঠার উপযুক্ত সময়ই বটে। অনিন্দ্যসুন্দর বরাবরই রাত জেগে লেখেন, ফলে এগারোটায় ভোর হওয়া তাঁর কাছে রোজকার ব্যাপার। কিন্তু আজকের কথা আলাদা। ইস, কতটা সময় শুধু-শুধু নষ্ট হল। হাতে আর মাত্র বারোটা ঘণ্টা। মনে-মনে আপশোস করে তিনি বিছানায় উঠে বসলেন।
দরজায় অনেকক্ষণ ধরেই কেউ নক করছিল।
‘ভেতরে এসো।’ অনিন্দ্যসুন্দর বললেন।
দরজা খুলে তাঁর সেক্রেটারি কিংশুক বোস ঘরে ঢুকল। বলল, ‘একটু আগেই চিঠিপত্র এসেছে—।’
‘তা কী হয়েছে?’
‘দেখলাম, রমেন গুপ্তর একটা চিঠি রয়েছে।’ কিংশুক একটা চিঠি এগিয়ে দিল অনিন্দ্যসুন্দরের দিকে।
রমেন গুপ্ত ‘লহরী প্রকাশন’-এর মালিক এবং অনিন্দ্যসুন্দরের বহু রহস্য উপন্যাসের প্রকাশক। চিঠিটা হাতে নিয়ে কিংশুককে আবার নতুন করে জরিপ করলেন তিনি। কিংশুক বোস শিক্ষিত, নম্র স্বভাবের মানুষ। তাঁর বাড়িতেই থাকে। বয়স বছর পঁয়ত্রিশ। কদাচিৎ হাসে। এখন, এই মুহূর্তে, ওর ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির ছোঁয়া। ও বলল, ‘সাধারণ চিঠি ভেবে আমি ওটা খুলে পড়েছি। মনে হল, চিঠিটা আপনার পড়ে দেখাটা খুব জরুরি।
চিঠিটায় চোখ রাখলেন অনিন্দ্যসুন্দর:
প্রিয় অনিন্দ্য,
আশা করি, কুশলে আছ। জরুরি প্রয়োজনে তোমাকে এ-চিঠি লিখছি। যা বলবার খোলাখুলিই বলব। তোমার শেষ উপন্যাসটা, ‘খুনের নাম পাপ’, রীতিমতো দোনোমনো করেই আমি ছেপেছি। হয়তো ভালোই বিক্রি হবে—যদি হয় তা শুধু তোমার নাম আর খ্যাতির জন্যে। সত্যি বলতে কি, আমার মনে হয়, ইদানীং তোমার লেখা বেশ ঢিলে হয়ে পড়েছে। প্রত্যেকটা বই তার আগের বইয়ের চেয়ে দুর্বল। তোমার প্লটের সমুদ্র কি শুকিয়ে এসেছে? মনে হয়, তোমার একটা লম্বা বিশ্রাম প্রয়োজন। কিন্তু তোমার সঙ্গে আরও তিনটে বই ছাপার চুক্তি থাকায় আমি তো মহা মুশকিলে পড়েছি। সেই নিয়েই কথাবার্তা বলতে বৃহস্পতিবার সকাল দশটা নাগাদ তোমার বাড়িতে যাব। প্রীতি ও শুভেচ্ছা নিও। ইতি—
তোমার রমেন
‘তোমার রমেন,’ তিক্ত হাসি হাসলেন অনিন্দ্যসুন্দর। প্রকৃত বন্ধুই বটে! হঠাৎই তাঁর খেয়াল হল কিংশুক এখনও দাঁড়িয়ে।
‘আমার একটা সাজেশন আছে।’ ও বলল।
‘তাই নাকি!’ কঠোর স্বরে বললেন অনিন্দ্যসুন্দর।
‘রমেনবাবুর মত, আপনি কিছুদিনের জন্যে বিশ্রাম নিন। আমারও তাই মত। কিন্তু যে-কদিন আপনি বিশ্রাম নেবেন, বিখ্যাত সুন্দর সান্যালের রহস্য উপন্যাসের আনন্দ থেকে পাঠক-পাঠিকাদের বঞ্চিত করার কোনও প্রয়োজন নেই।’
‘তার মানে?’ বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে নেমে পড়লেন অনিন্দ্যসুন্দর।
শান্ত স্বরে কিংশুক বলল, ‘সুন্দর সান্যাল ছদ্মনামে আমিই নতুন-নতুন বই লিখতে থাকব। রমেন গুপ্তকে জানানোর কোনও দরকার নেই। আর, আমাদের পাঠক-পাঠিকাদেরও জানিয়ে কোনও লাভ নেই।’
‘আমাদের পাঠক-পাঠিকা! তোমার কি ধারণা, আমার মতো ভাষা আর স্টাইলে তুমি লিখতে পারবে?’
‘তার চেয়েও বেশি পারব, মিস্টার চৌধুরী। আপনার চেয়ে আমি অনেক ভালো লিখব।’
‘কী—এতখানি আস্পর্ধা তোমার! এত দুঃসাহস!’
‘মিস্টার চৌধুরী, মনে করে দেখুন তো, আপনার শেষ কয়েকটা বইতে আমি কীভাবে আপনাকে হেল্প করেছি? প্লট নিয়ে মাথা ঘামানো থেকে শুরু করে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সম্পাদনা—সবই আমি করেছি।’
‘বেরিয়ে যাও আমার সামনে থেকে। গেট আউট!’
‘…সুন্দর সান্যালের সুনাম বজায় রাখতে গেলে এ ছাড়া আর কোনও পথ নেই। বইয়ের রয়্যালটি যা পাব, আমি আর আপনি আধাআধি ভাগ করে নেব।’
‘কাল থেকে তোমাকে আর কাজে আসতে হবে না। তোমার ছুটি!’
‘মিস্টার চৌধুরী…।’
‘বেরিয়ে যাও!’
‘আমার মতো কাজের লোক আর আপনি পাবেন না। তা ছাড়া, আমি না-হলে আর একটা বইও আপনি নিজে লিখতে পারবেন না।’
‘শিগগির মালপত্র গুছিয়ে রওনা হও, কিংশুক, নইলে তোমাকে আমি ঘাড় ধরে বের করে দেব!’
‘আপনাকে এর জন্যে পস্তাতে হবে।’ এই কথা বলে কিংশুক ঘরে ছেড়ে চলে গেল।
হ্যাঁ, এইভাবেই অনিন্দ্যসুন্দরের জীবনের শেষ দিনটা শুরু হয়েছিল। রমেন গুপ্তর চিঠি এবং কিংশুকের সঙ্গে ঝগড়া। একই ঘটনা হুবহু দুবার ঘটলে কীরকম অদ্ভুতই না-লাগে। যেন এ-ঘটনা আগেও ঘটেছে—হয়তো কোনও স্বপ্নে…।
এ-চিন্তায় চমকে উঠলেন অনিন্দ্যসুন্দর। স্বপ্ন? দেবদূত সূর্যকান্তের সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়ার ব্যাপারটা সত্যিই কোনও স্বপ্ন নয় তো?’
তাঁর অভিনব চিন্তাধারায় বাধা দিয়ে ঝনঝন শব্দে টেলিফোন বেজে উঠল। এক্সটেনশান ফোনটা তাঁর হাতের কাছেই। সুতরাং যান্ত্রিকভাবেই ফোন তুললেন অনিন্দ্যসুন্দর।
‘হ্যালো?’
‘সূর্যকান্ত বলছি।’
‘কে সূর্য—ও হ্যাঁ, কী ব্যাপার? কোত্থেকে বলছেন?’
‘কোত্থেকে বলছি।’ সূর্যকান্ত অপরপ্রান্তে যেন অবাক হল: ‘বোকার মতো প্রশ্ন করছেন কেন, মিস্টার চৌধুরী?’
‘কী—কী চাই বলুন?’
‘দেখলাম, ঠিকমতো পৃথিবীতে পৌঁছেছেন কিনা। কেমন চলছে?’
‘সবে তো এলাম—এখনও তো ভালো করে শুরুই করতে পারিনি!’
‘ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি কাজে লেগে পড়ুন, মিস্টার চৌধুরী। জানেন তো, হাতে সময় বেশি নেই। বিদায়।’
‘বিদায়।’ ফোন নামিয়ে রাখলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
যাক, একটা ব্যাপারের অন্তত নিষ্পত্তি হল। কোনও স্বপ্ন তিনি দেখেননি। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজে নেমে পড়া যাক। কিন্তু সূর্যকান্ত যদি সর্বক্ষণ এরকম উঁকি মেরে দেখেন, তা হলে কি স্বস্তিতে কাজ করা যাবে?
পরবর্তী তিরিশ মিনিট তাঁর কেটে গেল হাত-মুখ ধোওয়া, দাড়ি কামানো ও পোশাক-পরিচ্ছদ পালটানোর ব্যস্ততায়। কিংশুকের কথা ভাবছিলেন তিনি—শান্ত, ভদ্র, বিনয়ী কিংশুক তার জঘন্য স্বরূপ প্রকাশের জন্য। এতদিন থাকতে আজকের দিনটাই বেছে নিল! হ্যাঁ, সুন্দর সান্যালের নাম ও খ্যাতির প্রতি কিংশুকের নির্লজ্জ লোভ রয়েছে—যে সুন্দর সান্যাল তাঁর প্রাণের চেয়েও প্রিয়। না, কিংশুক বোসের যথেষ্ট খুনের মোটিভ রয়েছে।
এরপর কী যেন হয়েছিল?
সবিস্ময়ে অনিন্দ্যসুন্দর আবিষ্কার করলেন, তাঁর কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে, ঠিক রাত এগারোটায়, স্টাডি-রুমে, হাতির দাঁতের হাতলওলা কাগজ-কাটার ছুরিতে তাঁকে খুন হতে হবে। তাছাড়া আর কিছুই তাঁর মনে পড়ছে না। দেবদূতের কাছ থেকে আরও কিছু খবরাখবর নিয়ে এলে ভালো হত।
কিন্তু অন্যদিকে ভাবতে গেলে, এই বেশ হয়েছে। ভবিষ্যতের প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি আগে থেকে দেখতে পেলে তিনি হয়তো শিউরে উঠতেন। আর, এভাবে তিনি বেশ খোলা মনে তদন্তের কাজ করতে পারবেন।
সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার পথে অনিন্দ্যসুন্দর টের পেলেন, তাঁর খিদে পেয়েছে। খাওয়ার ঘরে ঢুকে দেখেন, রাঁধুনি সীতার মা তার মেয়ে সীতাকে নিয়ে ব্রেকফাস্ট তৈরির কাজে ইতি টানতে ব্যস্ত। সীতার মায়ের মোটাসোটা ঘামে ভেজা শরীরের দিকে তাকালেন তিনি। তার শ্রান্ত মুখটা তীক্ষ্ন নজরে জরিপ করলেন। ওদিকে মেয়ে সীতা মা-কে টুকিটাকি সাহায্য করতে ব্যস্ত। মেয়েটা বেশিরভাগই তাঁর স্ত্রীর ফাইফরমাশ খাটে। কিন্তু তাঁকে খুন করার মতো কোনও কারণ ওদের দুজনের মধ্যে খুঁজে পেলেন না অনিন্দ্যসুন্দর। তা ছাড়া প্রতিদিন রাতে ওরা বাড়ি চলে যায়। সুতরাং সন্দেহভাজনের তালিকা থেকে ওদের দুজনের নাম তিনি স্থির বিশ্বাসে বাতিল করলেন।
‘তাড়াতাড়ি জলখাবার খেয়ে নিন, বড়বাবু,’ সীতার মা পাঁউরুটি ও ডিমের পোচ তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘রান্নাবান্না সময়মতো শেষ করতে হবে। দুপুরে বৌদিমণি একজনকে নেমন্তন্ন করেছেন।’
‘কাকে?’
‘রণবিলাসবাবুকে।’
এইবার মনে পড়েছে! এ-ঘটনাও প্রথমবারের পুনরাবৃত্তি। রণবিলাস দত্ত। বিশাল চেহারার যুবক। মাথায় একরাশ কোঁকড়ানো চুল।
‘গুডিমর্নিং, ডার্লিং।’
একটা ঠান্ডা চুম্বনের চকিত হালকা ছোঁয়ায় ঘুরে দাঁড়ালেন অনিন্দ্যসুন্দর। একটা তীক্ষ্ন চিন্তা বর্শার মতো হাওয়া কেটে ছুয়ে গেল তাঁর মনের ভেতর দিয়ে—এ-চুম্বন বিশ্বাসঘাতী। কিন্তু নম্রস্বরেই তিনি উত্তর দিলেন, ‘গুডমর্নিং, তৃণা।’ বিব্রত অপ্রস্তুত চোখে একবার দেখলেন সীতা ও তার মায়ের দিকে। ওরা তখন চলে যাচ্ছে রান্নাঘরে।
প্রাতরাশের দিকে ক্ষণেকের জন্য অমনোযোগী হয়ে নিজের স্ত্রীকে চোখের নজরে ব্যবচ্ছেদ করলেন অনিন্দ্যসুন্দর। তৃণা চৌধুরী। আটাশের উগ্র যুবতী—প্রায় তাঁর অর্ধেক বয়েস। হাবেভাবে চলনে-বলনে যেন বিদেশি আধুনিকা। সর্বদা ভীষণ সেজেগুজে থাকে। তবে অপূর্ব সুন্দরী। সেই কারণেই ওকে বিয়ে করেছিলেন অনিন্দ্যসুন্দর। নিজের বয়েসের কথাটা খেয়াল করেননি। তৃণার চোখে দেখতে চেয়েছেন নিজের সর্বনাশ। তাঁর সাধের তৃণা। কিন্তু…।
‘রণবিলাস তা হলে দুপুরে খেতে আসছে?’
‘তোমার কি আপত্তি আছে, ডার্লিং?’
‘হ্যাঁ, আপত্তি আছে। একটা কপর্দকহীন ইয়াং অ্যাথলিট আমার বাড়িতে ঘুরঘুর করে বেড়াবে আর আমার বউয়ের দিকে হ্যাংলার মতো চেয়ে থাকবে, তাতে আমার যথেষ্ট আপত্তি আছে।’
‘তোমার কল্পনাশক্তির তুলনা নেই, ডার্লিং!’
‘ওকে তুমি ভালোবাসো, তৃণা?’
‘মোটেই না।’
‘তুমি মিথ্যে কথা বলছ, তৃণা। কাল আমি সব দেখেছি।’
অনিন্দ্যসুন্দর নিজেকে অবাক করলেন। কথাগুলো মুখ থেকে বেরোনোমাত্র, হঠাৎই তাঁর সব মনে পড়ে গেল। খুন হওয়ার উত্তেজনায় তিনি নিশ্চয়ই এসব ভুলে বসেছিলেন। এ সমস্ত ঘটনা হুবহু আগে একবার ঘটে গেছে!
‘বাগানে তোমাদের আমি দেখেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি ততটা অবাক হইনি। কারণ আগেও তোমরা কখনও তেমন সাবধান হওনি।’
তৃণার সমস্ত রক্ত কেউ যেন শুষে নিয়েছে, ও বসে পড়ল শ্লথ ভঙ্গিতে।
‘অবাক হলে, তৃণা? তা হলে একটা কথা তোমাকে বলে রাখি। রণবিলাস দত্ত আজ দুপুরে নেমন্তন্ন খেতে এলে আমার একটুও আপত্তি নেই। সত্যি বলতে কি, আমার পরামর্শ যদি শোনো, তা হলে দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর তোমরা দুজনে একটু আলোচনা করে দেখো। আমি যে তোমাদের ব্যাপার সব জানি, সে-কথা ওকে বলো। তারপর দুজনে মিলে ঠিক করো কী করবে। এখন তোমার মাত্র দুটো পথ খোলা আছে। প্রথমটা হল, আমাকে ছেড়ে রণবিলাসের সঙ্গে চলে যাওয়া। অবশ্য, এটা মনে রেখো, ওর পকেটে একটা ফুটো পয়সাও নেই, আর আমি নিজের পয়সা খরচ করে তোমাদের প্রেমকুঞ্জ বানিয়ে দেব, এ-আশা তুমি নিশ্চয়ই করো না। রণবিলাসের সঙ্গে উপোস করে-করে যখন তোমার সমস্ত শখ মিটে যাবে, তখন ইচ্ছে করলে আমার কাছে আবার ফিরে আসতে পারো। আর তোমার দ্বিতীয় পথ হল, এখানে থেকে যাওয়া। সেক্ষেত্রে আমি চাইব তোমার বিশ্বাস, সততা। আর শ্রীরণবিলাস দত্তকে অন্য কোনও আস্তানা থেকে দু-বেলা দু-মুঠোর ব্যবস্থা করতে হবে।’
অনিন্দ্যসুন্দর মনে-মনে ভাবলেন, এতেই রণবিলাস-অধ্যায়ের একটা হেস্তনেস্ত হবে। তৃণা শুধুমাত্র ভালোবাসা অবলম্বন করে বেঁচে থাকার মেয়ে নয়। আয়েস-স্বাচ্ছন্দ্যে থেকে-থেকে ওর অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে—প্রাচুর্য আর বিলাসিতা ওর জীবনের সঙ্গে আন্তরিকভাবে জড়িত। কিন্তু এই চূড়ান্ত নোটিস তিনি আগেও একবার দিয়েছেন। শুধু একটা জিনিস তখন ভাবেননি। এখন ভাবছেন। তৃণার খুন করার মোটিভ।
সারাটা জীবনে লেখক হিসেবে যে-সুপ্রচুর অর্থ-প্রতিপত্তি তিনি অর্জন করেছেন, তার অর্ধেকের উত্তরাধিকারিণী এখন তৃণা। তাঁর উইলে সেই কথাই লেখা আছে। রণবিলাস যদি সে-কথা জানত! তাঁর তৃণা যদি সত্যিই ছেলেটাকে নিজের করে চায়, আর একইসঙ্গে তাঁর উইলে নিজের উত্তরাধিকারও বজায় রাখতে চায়, তা হলে ওর সামনে মাত্র একটা পথই খোলা আছে…।’
‘তুমি আমাদের সঙ্গে খাবে তো?’ তৃণা তাঁকে প্রশ্ন করছে।
‘না,’ উদার স্বরে উত্তর দিলেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘শুধু-শুধু তোমাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাই না। তা ছাড়া, এই তো, এত বেলায় জলখাবার খাচ্ছি। তারপর কিছু দরকারি কাজও আছে।’
এরপর তৃণা চলে গেল। অনিন্দ্যসুন্দর তাকিয়ে রইলেন ওর অপস্রিয়মাণ তন্বী শরীরের দিকে। তারপর মনোযোগ দিলেন ডিম ও পাঁউরুটির প্রতি, দ্রুতহাতে প্রাতরাশ শেষ করলেন।
মধ্যাহ্নভোজের অতিথির জন্য প্রয়োজনীয় আয়োজনের দায়িত্ব সীতার মায়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে এলেন ডাইনিংরুম থেকে।
এবার তিনি হাজির হলেন স্টাডি-রুমে—তাঁর রক্তে রঞ্জিত অকুস্থলে।
নিজের মরণ-কামরায় ঢুকে ভয় পেলেন অনিন্দ্যসুন্দর। সমস্ত জানলায় পরদা টানা থাকায় গোটা ঘরটা ছায়াময় রহস্যে ছমছমে। অস্বস্তিভরে পরদাগুলো সরিয়ে দিলেন তিনি। সূর্যের আলো ঠিকরে এল ঘরের ভেতরে। এবার তিনি চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলেন।
ওই তো তাঁর মজবুত মেহগনি কাঠের টেবিল। নিশ্চয়ই তিনি টেবিলের কাছে চেয়ারে বসে ছিলেন। হয়তো, প্রায়ই যেমন ঘুমিয়ে পড়েন, সেরকমই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন—টেবিলে দু-হাত ছড়িয়ে এবং মাথা হাতের ওপরে এলিয়ে। সোজা কথায় খুনিকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছেন। আর, ওই তো সেই কাগজ-কাটার ছুরিটা। অনিচ্ছাভরে ছুরিটা তুলে নিলেন তিনি, যেন ওটার ফলায় লেগে রয়েছে শুকনো কালচে রক্ত।
অবশ্য রক্ত থাকার কথা নয়…অন্তত এখন!
না, জিনিসটা খুনের এক কুৎসিত হাতিয়ার, মনে-মনে ভাবলেন অনিন্দ্যসুন্দর। ছুরির হাতলটা মসৃণ ভারি হাতির দাঁতের তৈরি, প্রায় ইঞ্চিচারেক লম্বা। খুনি যদি অসতর্ক হয়, তা হলে তার স্পষ্ট হাতের ছাপ রেখে যাবে এই ছুরির বাঁটে। চকচকে ফলাটা বেশ লম্বা—কিন্তু খুব ধারালো কিংবা ছুঁচলো নয়। তবে অব্যর্থ নিশানায় উপযুক্ত শক্তিতে প্রোথিত হলে কার্যসিদ্ধির পক্ষে যথেষ্ট—কোনও মানুষের হৃৎপিণ্ড সহজেই স্তব্ধ হবে।
শিউরে উঠলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
দরজায় কারও নক করার শব্দে তাঁর চিন্তার ঘোর বিচ্ছিন্ন হল। কোনওরকম আমন্ত্রণের অপেক্ষা না-করেই যে নক করেছে সে ঘরে ঢুকল।
‘ব্যস্ত আছ, সুন্দরকাকা?’
‘না, না। আয় অভী, ভেতরে আয়।’
অভীক ভেতরে ঢুকে লাফিয়ে উঠে বসল টেবিলের ওপর। ওর শরীরের ওজনে আর্তনাদ করে উঠল মজবুত মেহগনি টেবিল। অভীকের প্যাঁচার মতো ছোট-ছোট চোখ পুরু চশমার কাচের পিছন থেকে জুল-জুল করে চেয়ে রইল।
‘টাকা-পয়সার অবস্থা কীরকম, সুন্দরকাকা?’
‘এবার কত লাগবে?’ অনিন্দ্যসুন্দর চৌধুরী প্রশ্ন করলেন।
‘তিনহাজার।’
রিভলভিং চেয়ারে শরীর এলিয়ে বসলেন অনিন্দ্যসুন্দর। টেবিলের ওপরে বসা মাংসের স্তূপটিকে লক্ষ করতে লাগলেন। অবশেষে বললেন, ‘অভী, আগেরবারই তো তোকে বলেছি, এভাবে তোর ধার-দেনা আর আমি শোধ করতে পারব না। অন্তত, যদ্দিন না তুই একটা চাকরি-বাকরির চেষ্টা করছিস। সুতরাং আমার সোজা উত্তর হল, না।’
‘আমার অবস্থা খুব খারাপ, সুন্দরকাকা।’
‘সে তুই বুঝবি।’
‘তা কী করব বলবে তো?’
‘সেও তোর ব্যাপার।’
‘তা হলে আমাকে হুট করে যা-হোক একটা কিছু করতে হবে…।’
এই মন্তব্যে চমকে উঠলেন অনিন্দ্যসুন্দর। তৃণা ও কিংশুকের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তার মতো অভীকের সঙ্গে তাঁর এই আলোচনা আগেও একবার হয়ে গেছে! তাঁর সম্পত্তির বাকি অর্ধেকের উত্তরাধিকারী অভীক—না, অনিন্দ্যসুন্দর ভালোবেসে এই অংশ ওকে দেননি, তাঁর একমাত্র আত্মীয় হওয়ার সুবাদে এই সম্পত্তি অভীকের প্রাপ্য। আর এখন সেই অকালকুষ্মাণ্ড ভাইপো তাঁর কাছে এসে টাকা চাইছে।
খুনের আরও একটা মোটিভ।
‘হুট করে কিছু…করে বসবি…এর…এর মানে কী, অভী?’
‘জানি না। কিন্তু তুমি টাকা না-দিলে যা-হোক একটা কিছু তো আমাকে করতে হবে—আর তার জন্যে পুরোপুরি দায়ী হবে তুমি।’
বিশাল স্তূপটা টেবিল থেকে নেমে দাঁড়াল, এগিয়ে গেল দরজার দিকে, এবং নিষ্ক্রান্ত হল ঘর থেকে। এত মোটা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ভাইপো অভীকের চলাফেরায় কেমন একটা চাবুকের ভঙ্গি রয়েছে। আশ্চর্য, কই আগে তো কখনও অনিন্দ্যসুন্দর এটা খেয়াল করেননি। অবশ্য, আজ তিনি এমন-এমন সব জিনিস আবিষ্কার করছেন, যা আগে কখনও লক্ষই করেননি।
জানলা দিয়ে ছিটকে আসা রোদ হঠাৎই তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। না, এই মুহূর্তে ঘরটা তাঁর একটুও ভালো লাগছে না। বরং বাইরের খোলা হাওয়ায় একটু ঘুরে এলে কেমন হয়! তা ছাড়া শীতের মধ্যে রোদের আমেজটা ভালোই লাগবে—আর ঠান্ডা মাথায় একটু চিন্তা-ভাবনারও প্রয়োজন আছে। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
বাগানে এসে নির্জনতার পরিবর্তে হীরা সিংকে আবিষ্কার করলেন তিনি। বৃদ্ধ হীরা সিং বাগানের মালি, কেয়ারটেকার, ড্রাইভার—একাধারে সব, এবং কখনও-সখনও সীতা ও সীতার মায়ের অনুপস্থিতিতে রান্নাবান্নাও করে। এ ছাড়া হীরা সিংয়ের আরও-একটা পরিচয় হল, সে জেলখাটা কয়েদি। এখানে এসে অনিন্দ্যসুন্দরকে সে অনেক ভাবে সাহায্যও করেছে। মালিকের দেওয়া তরল নেশা গলায় ঢেলে ঘোরের মাঝে নিজের জীবনের বহু অপকীর্তির কথাই অনিন্দ্যসুন্দরকে শুনিয়েছে। আর অনিন্দ্যসুন্দর সেইসব কীর্তিকাহিনী টুকে নিয়েছেন নিজের ডায়েরিতে। বাড়িয়েছেন তাঁর প্লটের সঞ্চয়। তিনি জানতেন, এর কিছু-কিছু ঘটনা এখনও পুলিশের অজানা, এবং সেই অপরাধগুলোর জন্য কোনও শাস্তি পায়নি হীরা সিং। বহু জায়গাতে এখনও তার নামে হুলিয়া ঝুলছে।
এইমুহূর্তে প্লট সংগ্রহের মরজি অনিন্দ্যসুন্দরের ছিল না। কিন্তু হীরা সিংয়ের মনে বুঝি অন্য অভিসন্ধি ছিল।
‘নানা রকোম কোথা কানে আসছে, বড়েসাব।’
‘কী কথা, হীরা সিং?’
‘আপনার কিতাবের কোথা—।’
‘আমার বইয়ের কথা? কী হয়েছে আমার বইতে?’
‘শুনেছি কি আপনি আর কিতাব লিখবেন না?’
ও, কিংশুক দেখছি সবাইকে বলে বেড়িয়েছে! রমেন গুপ্তর চিঠির সারমর্ম তা হলে বাড়িতে আর কারও জানতে বাকি নেই। তৃণা জানে, রণবিলাস জানে, এমনকী অভীকও জানে।
‘সে-কথা যদি সত্যিও হয়, তা হলে তোমার কী আসে-যায়, হীরা সিং? চাকরি খোয়া যাবে?’
আড়চোখে তাঁর দিকে তাকাল বৃদ্ধ হীরা সিং। প্রখর সূর্যের আলোয় তার কুৎসিত চেহারা আরও কুৎসিত দেখাচ্ছে। সে উত্তর দিল, ‘নোকরির কোথা ভাবছি না, বড়েসাব, ভাবছি আপনাকে যে-সব কহানী সুনিয়েছি তার কোথা। যতোদিন আপনি কিতাব লিখছিলেন, ততোদিন সব ঠিক ছিল। কিন্তু আভি কিতাব লিখা বন্ধো হয়ে গেলে, আপনি হয়তো পুলিশের সাথে বাতচিত করতে পারেন। তাদের বোলতে পারেন আমার পুরানা কিসসার কোথা—।
‘সে আমি কেন বলতে যাব, হীরা সি? তুমি কবে কী করেছ, তাতে আমার কী? তুমি এখন ভালো হয়ে গেছ, আমার এখানে চাকরি করছ, সৎভাবে জীবনযাপন করছ।’
‘পুলিশ ওসব শুনবে না।’
‘আমি তো আর পুলিশকে কিছু বলতে যাচ্ছি না…হীরা সিং, আমার কথা কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?’
স্পষ্টই বোঝা গেল বিশ্বাস সে করেনি। ঘুরে দাঁড়িয়ে বুড়ো লোকটা কোদাল দিয়ে আবার মাটি কোপাতে লাগল। তার কোদাল চালানোর ভঙ্গি বলিষ্ঠ, ক্ষিপ্র, নিখুঁত। আর ভাঁজ-পড়া মুখ অন্ধকার এবং ভয়ঙ্কর।
অদ্ভুতভাবে অনিন্দ্যসুন্দরের আবার মনে পড়ল, এসবই আগে একবার ঘটে গেছে। নিজের বাগানে কবর খুঁড়ে এইমুর্হতে তিনি আবিষ্কার করেছেন এক ভয়ঙ্কর সম্ভাব্য খুনিকে।
স্টাডি-রুমে টেবিলের কাছে আবার ফিরে এলেন তিনি, শ্লথ ভঙ্গিতে বসে পড়লেন চেয়ারে। আশ্চর্য, প্রথমবারে যখন জীবনের শেষ দিনটা এইভাবে তিনি কাটিয়েছিলেন তখন তো এসব কথা তাঁর মনে আসেনি! তখন কেন বুঝতে পারেননি, তাঁকে ঘিরে রয়েছে এমন সব ভয়ঙ্কর মানুষেরা, যারা তাঁর মৃত্যুতে লাভবান হবে? একমাত্র সীতা আর সীতার মা ছাড়া তাঁকে খুন করবার উপযুক্ত মোটিভ প্রত্যেকেরই রয়েছে। এবং তাদের অন্তত একজনের সে-কাজ সম্পন্ন করবার দুঃসাহসও রয়েছে।
টেলিফোন বেজে উঠল। কোনওরকম চিন্তা-ভাবনা না-করেই অনিন্দ্যসুন্দর টেলিফোনটা তুলে নিলেন।
‘সূর্যকান্ত বলছি।’
‘ও…বলুন।’
‘কোনও গণ্ডগোল হয়েছে নাকি, মিস্টার চৌধুরী? আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, মুষড়ে পড়েছেন?’
‘ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছি।’
‘তাই নাকি?’
‘দুজন ঠিকে কাজের লোক ছাড়া আমার বাড়ির প্রত্যেকে আমি মরলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।’
‘এতে মন খারাপ করার কিছু নেই, মিস্টার চৌধুরী।’
‘নেই?’
‘যদি বোঝেন পৃথিবীতে কেউ আপনাকে চায় না, তা হলে এখানে ফিরে আসতে আপনার একটুও দুঃখ হবে না।’
‘হুম। ঠিকই বলেছেন।’
‘আর কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো, মিস্টার চৌধুরী?’
‘সত্যি বলতে কি, একটা অসুবিধে হচ্ছে। কোনও সূত্র এখনও পাইনি।’
‘খোঁজার চেষ্টা করুন।’
‘সেইখানেই তো হয়েছে বিপদ। এমনিতে আমার বইয়ে—কিংবা বাস্তবেও—সূত্র পাওয়া যায় খুনের পরে, আগে নয়। খুন করার পরেই খুনি সমস্ত সূত্র ফেলে যায়। এবার বলুন, এখন তা হলে আমি কী করি?’
‘আমি কী-করে বলব, মিস্টার চৌধুরী? এখান থেকে রওনা হওয়ার আগে সে-কথা আপনার ভাবা উচিত ছিল।’
‘সেটা করলেই বোধহয় ভালো হত।’
‘এখন চুপচাপ বসে রাত এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আপনার উপায় নেই। তা হলে তখনই দেখা হবে। চলি।’
ফোন নামিয়ে রেখে ফ্রিজ থেকে সামান্য হুইস্কি আর সোডা নিয়ে বসলেন অনিন্দ্যসুন্দর। দুর্ভাবনার সময় মদ তাঁকে স্বস্তি এবং শান্তি দেয়। এখন দেবে কি না কে জানে!
দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল চারটে। তাঁর নির্ধারিত পুনর্জীবনের পাঁচ ঘণ্টা ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত। মাত্র আর সাত ঘণ্টা বাকি। বিষণ্ণ মনে জানলার কাছে এগিয়ে গেলেন অনিন্দ্যসুন্দর। আকাশে মেঘ করেছে, বৃষ্টি হতে পারে।
খুন করার পক্ষে উপযুক্ত রাত।
এইভাবে, আকস্মিক এক দুর্ঘটনাচক্রে, জানলায় আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন অনিন্দ্যসুন্দর। তৃণা এবং রণবিলাস। তরুণ অ্যাথলিট রণবিলাস তাঁর স্ত্রীকে অটুট মনোযোগে চুম্বন করতে ব্যস্ত।
সেইমুহূর্তে অনিন্দ্যসুন্দর চৌধুরীর মনের গভীরে জন্ম নিল এক নতুন প্রতিজ্ঞা।
সাধারণ আবেগতাড়িত মানুষের মতো জানলার কাচে ঘুষি বসালেন না তিনি, মাথার চুলও ছিঁড়লেন না। পরিবর্তে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ল। ইতিমধ্যে চুম্বন-অধ্যায় শেষ করে রণবিলাস সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনিন্দ্যসুন্দরের এই প্রশান্তির কারণ, তাঁর মনে এক সূক্ষ্ম পরিকল্পনা ক্রমে চেহারা নিয়েছে।
একটু পরে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলেন তিনি। সীতার মাকে উদ্দেশ্য করে সরবে ঘোষণা করলেন, ‘সীতার মা, রণবিলাসবাবু রাতে খেয়ে যাবেন। সেইসঙ্গে কিংশুক এবং অভীকও। আর হীরা সিংকে বোলো, রাতের খাবার যেন সে-ই পরিবেশন করে।’
কিংশুকের ঘরে পৌঁছে তিনি দেখেন, সে জিনিসপত্র গোছগাছ করছে।
‘সুটকেসটা এখন রেখে দাও, কিংশুক।’
‘কিন্তু আপনিই তো আমাকে চলে যেতে বলেছেন।’ তাঁর সেক্রেটারি গম্ভীর মুখে জবাব দিল।
‘তা বলেছি। কিন্তু আমার ইচ্ছে, আজকের রাতটা তুমি থেকে যাও। তাতে তোমার ভালোই হবে, কিংশুক।’
অভীক চৌধুরী তখনও দিবানিদ্রায় অচেতন ছিল, অনিন্দ্যসুন্দর তাকে ধাক্কা দিয়ে জাগালেন।
‘আজ রাতে তোর কোথাও যাওয়ার থাকলে, ক্যান্সেল কর, অভী। তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে। তাতে তোর লাভই হবে।’
এবার অনিন্দ্যসুন্দর উপস্থিত হলেন বাগানে।
‘দুপুরে আপনার সঙ্গে খেতে বসতে পারিনি বলে মাপ চাইছি, রণবিলাসবাবু,’ তৃণার ঠোঁটে চুমু এঁকে দেওয়া শিল্পীকে লক্ষ করে বললেন তিনি, ‘কিন্তু রাতে আপনাকে না-খাইয়ে ছাড়ছি না।’
রণবিলাসের সুন্দর মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল, কিন্তু দ্বিধাভরা অস্ফুট স্বরে সে বলল, এ তো তার সৌভাগ্য। আর তৃণা ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক।
গোপন উত্তেজনায় ওদের দিকে চেয়ে হাসলেন অনিন্দ্যসুন্দর। যদি তাঁর পরিকল্পনা সফল হয়…।
নৈশভোজপর্ব শুরু হল রাত ঠিক সাড়ে আটটায়।
অন্ধকার এবং শীতের তীব্রতা এখন চরম অঙ্কে। সীতা ও সীতার মা চলে যাওয়ার পরই শুরু হয়েছে অপ্রত্যাশিত অঝোর বৃষ্টি। এখনও থামেনি। হীরা সিং নীরবে পরিবেশন করছে। তার মুখে করাল ছায়া থমথম করছে।
একমাত্র অনিন্দ্যসুন্দরই খুশি মনে খেয়ে চলেছেন। অন্যেরা যান্ত্রিকভাবে হাত ওঠা-নামা করলেও স্পষ্ট বোঝা যায়, তাদের মন অন্য দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত। তৃণার চঞ্চল চোখ থেকে-থেকেই ছুঁয়ে যাচ্ছে রণবিলাসের মুখ, আর রণবিলাসও সে-দৃষ্টি ফিরিয়ে দিচ্ছে। কিংশুকের শুকনো মুখ ভাবলেশহীন এক মুখোশ। সেই মুখোশ চিরে মাঝে-মাঝে ঝিলিক মারছে বিরূপ মনোভাবের ইশারা। সাধারণত অভীকের খাওয়া ‘পেটুক’ আখ্যা দেওয়ার মতো, কিন্তু আজ তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। চোরা দৃষ্টিতে সকলেই অনিন্দ্যসুন্দরকে লক্ষ করছে।
নটা নাগাদ খাওয়া-দাওয়ার পাট শেষ হল। উঠে দাঁড়ালেন অনিন্দ্যসুন্দর। ওদের দিকে চেয়ে হাসলেন: ‘ঘণ্টাখানেক পরে তোমরা সবাই স্টাডি-রুমে এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে। বিশেষ কিছুই না, বিদায় দেওয়ার আগে সকলের সঙ্গে একটু গল্পগুজব করা—অনেকটা ফেয়ারওয়েল পার্টির মতো।’
এই সাংকেতিক মন্তব্যে সকলেই নিষ্পলক চোখে হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। পরিতৃপ্ত ভঙ্গিতে দোতলায় নিজের শোওয়ার ঘরে গেলেন অনিন্দ্যসুন্দর, একটা সুটকেস গুছোতে শুরু করলেন। দু-জোড়া মোজা সবে সুটকেসে ভরেছেন, টেলিফোন বেজে উঠল।
‘সূর্যকান্ত বলছি।’
‘ভাবছিলাম, আপনি বোধহয় এখুনি ফোন করবেন।’
‘শেষ কয়েকটা ঘণ্টা ধরে দেখছি, আপনার মেজাজ একদম পালটে গেছে।’
‘হ্যাঁ তা গেছে।’
‘ওই সুটকেস নিয়ে কোথায় চলেছেন?’
‘একটু পরেই তো আমাকে লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে, তাই না?’
‘এখানে বাড়তি মোজার দরকার নেই, মিস্টার চৌধুরী। সবকিছুই আমরা দিয়ে দিই।’
‘আপনি আমার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করছেন—।’
‘আমার গোয়েন্দাগিরি করবার দরকার হয় না।’
‘আপনি কি ভাবছেন, আপনাকে আমি ঠকাব—ফাঁকি দেব?’
কোনও উত্তর নেই। টেলিফোন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু এটাই একরকম স্পষ্ট উত্তর। দেবদূত চিন্তায় পড়েছে। যদি ঠকানোর কথায় সে দুশ্চিন্তায় পড়ে থাকে, তা হলে তাকে ঠকানো নিশ্চয়ই সম্ভব! গোছগাছ করতে-করতে চাপা হাসিকে প্রশ্রয় দিলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
সুটকেসে দিনকয়েকের মতো জামা-কাপড় ভরে নিলেন তিনি। টুথব্রাশ ও শেভিং কিট নিতেও ভুললেন না। একটা দেওয়াল-সিন্দুকের কাছে গিয়ে সেখান থেকে দশ হাজার টাকা বের করে নিলেন। এটা তাঁর বিপদের সঞ্চয়। ড্রেসিং-টেবিলের ড্রয়ার থেকে তুলে নিলেন নিজের অটোমেটিক পিস্তল—পরীক্ষা করে দেখলেন গুলি ভরা আছে কি না। হ্যাঁ, আছে। এই অটোমেটিক পিস্তল তাঁর অতিরিক্ত জীবনবীমা।
কিন্তু প্রতিশ্রুতিমতো ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তিনি নীচে নামলেন না। সন্দেহভাজনদের তিনি উৎকণ্ঠার মধ্যে রাখতে চান। তিনি জানেন, ওরা অপেক্ষা করবে। বিশেষ করে খুনি, সে…তাকে তো অপেক্ষা করতেই হবে। নরম সোফায় গা এলিয়ে বিশ্রাম করতে লাগলেন অনিন্দ্যসুন্দর, মুখে ধূমায়িত পাইপ, মনে ভবিষ্যতের নতুন পরিকল্পনা।
প্রায় সওয়া দশটা নাগাদ সুটকেস হাতে নীচে স্টাডি-রুমে এলেন তিনি। উপস্থিত হলেন তৃণা ও অতিথিদের সামনে। আবিষ্কার করলেন, ওরা প্রত্যেকেই তাঁর পছন্দমাফিক কম-বেশি বিচলিত। কিংশুকের ফরসা মুখে লালচে আভা। অভীক বদমেজাজি শুয়োরের মতো মুখ কালো করে এককোণে বসে আছে। একটা সেটিতে নির্লজ্জভাবে ঘন হয়ে বসে আছে তৃণা ও রণবিলাস। আর বৃদ্ধ হীরা সিং বাইরের বারান্দায় থামের আড়ালে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়েছিল, অনিন্দ্যসুন্দর তাকে ভেতরে ডেকে নিলেন। তারপর পকেট থেকে একটা তালা ও চাবি বের করে ঘরের দরজায় ভেতর থেকে তালা দিয়ে দিলেন। এবার তিনি এসে বসলেন নিজের মেহগনি-টেবিলে—ওদের মুখোমুখি।
‘তোমাদের কেউ কি আজকের দিনটায় এক অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করেছ,’ বলতে শুরু করলেন তিনি, ‘যেদিনটা আর মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর শেষ হয়ে যাবে?’
ওরা স্বাভাবিকভাবেই কিছু বুঝে উঠতে পারল না। কয়েকমুহূর্ত তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিল বাড়ির গায়ে আছড়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটার ধারাবাহিক শব্দ, এবং কখনও-কখনও বজ্রপাতের তীব্র সংঘাত।
‘কীসব বলছ, ডার্লিং, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’ তাঁর স্ত্রী তৃণা। ও সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে এক-পা এগিয়ে এসেছে।
শীতল দৃষ্টিতে ওকে জরিপ করলেন তিনি। ওর পরনে আঁটোসাঁটো স্বচ্ছ জাপানি জর্জেট শাড়ি। সুগভীর নাভির ওপরে ও নীচে তিন ইঞ্চিব্যাপী মসৃণ ত্বক উন্মুক্ত। ব্লাউজের আকৃতি ও প্রকৃতি দেখে মনে হয়, শুধুমাত্র তৃণার শরীরের গঠন সেটাকে স্বস্থানে বজায় রেখেছে। এসবই নিঃসন্দেহে রণবিলাস দত্তের উপকারের জন্য।
‘বোসো, তৃণা, উত্তেজিত হোয়ো না।’ তাঁর স্বরে এমন কিছু ছিল যাতে তৃণা পিছিয়ে গেল, ‘ভেবেছিলাম, অন্য কেউ না-পারলেও তুমি হয়তো ব্যাপারটা লক্ষ করবে। মেয়েদের সহজাত ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের অনুভূতি দিয়ে।’
‘কী লক্ষ করব, অনিন্দ্য?’
‘আজকের দিনটায় এক অদ্ভুত ব্যাপার তুমি খেয়াল করোনি? একবারও তোমার মনে হয়নি, আজ সারাদিন ধরে তুমি যা-যা করছ, বলছ, সবই তোমার খুবই চেনা? হুবহু এসব কাজ তুমি আগেও একবার করেছ, বলেছ এই একই কথা?’
মুখভাবে স্পষ্টতই বোঝা গেল উপস্থিত সবাই তাঁকে মাতাল ভাবছে, কিংবা ভাবছে তিনি ওদের সঙ্গে রসিকতা করছেন।
একচিলতে হাসি ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে বলে চললেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘গতকাল রাতে আমি…না, হয়তো কাল রাতে নয়। কারণ, মরণোত্তর জগতে সময়ের হিসেব রাখা খুব শক্ত—অবশ্য আমি সেখানে খুব বেশিক্ষণ ছিলাম না, সুতরাং আমার বিশ্বাস, হয়তো কাল রাতেই হবে। কাল রাতেই আমি খুন হয়েছি।’
এক রুদ্ধশ্বাস অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে এল তৃণার ঠোঁট চিরে।
‘বাঃ, তোমার তা হলে মনে পড়েছেন সোনা?’ প্রশ্ন করলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
‘মনে পড়েছে?’
অর্থাৎ, অনিন্দ্যসুন্দর কী বিষয়ে কথা বলছেন, সেটা তৃণা একটুও বুঝতে পারছে না। ওর মুখভাব দেখে তাঁর মনে হল, না, অভিনয় নয়। তিনি অন্যান্যদের দিকে তাকালেন, ওরা সকলেই অবাক অবুঝ চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে।
সুতরাং তিনি খুলে বললেন। বললেন, সূর্যকান্তের কথা, কেন তিনি আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন, সেই কথা। ওরা গভীর মনোযোগে শুনল, মাঝে-মাঝে এ-ওর দিকে তাকাতে লাগল।
তাঁর কাহিনি শেষ হলে অভীক বলে উঠল, ‘সুন্দরকাকা, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ডাক্তার দেখাও।’
‘রমেন গুপ্ত বলেছে আপনার কিছুদিন বিশ্রামের দরকার,’ প্রতিহিংসার ব্যঙ্গে তীক্ষ্ন হল কিংশুকের কণ্ঠস্বর, ‘এখন দেখছি ঠিকই বলেছে!’
‘এ নেহাত পাগলের আড্ডাখানা!’ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রণবিলাস দত্ত: ‘আমি চললাম।’
‘বোসা সবাই।’ পকেট থেকে অটোমেটিকটা বের করে উঁচিয়ে ধরলেন অনিন্দ্যসুন্দর। তাঁর অভিব্যক্তিতে স্থির প্রতিজ্ঞা।
ওরা সবাই আবার বসল। একইসঙ্গে টেলিফোন বেজে উঠল।
অনিন্দ্যসুন্দর ফোনটা তুলতেই অপর প্রান্তে কেউ বলতে শুরু করল, ‘কী হচ্ছে এসব, মিস্টার চৌধুরী?’
‘নিতান্তই সস্তা প্যাঁচ,’ সহজ সুরে জবাব দিলেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘সব রহস্য উপন্যাসেই এরকমটা হয়। একেবারে শেষ পরিচ্ছেদে ডিটেকটিভ সন্দেহভাজন সকলকে একটা ঘরে জড়ো করে। তারপর নিজের তদন্তের কাহিনি শোনায়, আর তখন খুনি সাধারণত নিজের দোষ স্বীকার করে, কিংবা বেহিসেবি হয়ে ধরা পড়ে যায়। আপনাকে ওই খাতায় শুধু একটু মোছামুছি করতে হবে।’
‘ঠিক আছে, আপনার কথাই বিশ্বাস করলাম, মিস্টার চৌধুরী। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনার হাতে আর মাত্র কুড়িমিনিট সময় আছে।’
অনিন্দ্যসুন্দর ফোন নামিয়ে রাখতেই রণবিলাস মন্তব্য করল, ‘নিশ্চয়ই ওই দেবদূত ফোন করেছিল?’
‘হ্যাঁ।’ অনিন্দ্যসুন্দর বললেন।
রণবিলাস চুপ করে গেল।
‘আমার হাতে যে আর সময় বেশি নেই, সেটাই সে মনে করিয়ে দিল।’ অনিন্দ্যসুন্দর বলতে শুরু করলেন, ‘যাই হোক, আমার গল্প তোমাদের বিশ্বাস হয়নি মানলাম, কিন্তু এবারে আমি তথ্যের দিকে নজর দেব। আশা করি, সেগুলো তোমরা বিনা বিতর্কে মেনে নেবে। এই ঘরে তোমরা পাঁচজন রয়েছ। এবং পাঁচজনের প্রত্যেকেই মনে-মনে চাও, আমার মৃত্যু হোক। কিন্তু তার মধ্যে একজন সেটা এত বেশি করে চায় যে, সে—খুন করতেও পেছপা হবে না।
‘এই যে আমার প্রিয় ভাইপো অভীক। দেনায় ও গলা পর্যন্ত ডুবে গেছে। এ-দেনার হাত থেকে ওর রক্ষা পাওয়ার একমাত্র আশা, আমার উইলের উত্তরাধিকারসূত্রে কিছু অর্থ লাভ করা। মানছি, অভীকের টাকার প্রয়োজনটা এই মুহূর্তে। কিন্তু আমি যদি মারা যাই, তা হলে উইলের প্রবেট নেওয়া হবে, আর ওর পাওনাদাররাও সাময়িক ধৈর্য ধরবে।
‘তারপর রয়েছে কিংশুক, আমার প্রাক্তন সেক্রেটারি। কিংশুকের ধারণা, আমি পথ থেকে সরে গেলে, সুন্দর সান্যালের উন্নতি ও খ্যাতির দায়িত্ব সে একাই নিতে পারবে। আগামীকাল আমার প্রকাশক দেখা করতে আসছে, আর সেটাই হল কিংশুকের মস্ত সুযোগ—যদি আমি মারা যাই, তবেই।
‘এবার আসছে হীরা সিং। ওর বিশ্বাস, আমি লেখা ছেড়ে দিলে ওকে পুলিশে ধরিয়ে দেব। কারণ তখন ওর অতীতের কীর্তিকলাপ আমার গল্পে আর কাজে আসবে না।
‘সবশেষে আমার প্রিয়তমা স্ত্রী তৃণা এবং ওর বন্ধু শ্রীযুক্ত রণবিলাস দত্ত। রণবিলাসবাবুর হাতে যদি সুপ্রচুর অর্থ থাকত, তা হলে তৃণা কবে আমাকে ছেড়ে চলে যেত। আমার সম্পত্তির অর্ধেক যদি ও হাতে পায়, তা হলে আমার কাছে যেমন সুখ-প্রাচুর্যে ছিল, সেরকম ভাবেই ওর জীবন কাটাতে পারবে। সুতরাং ওদের একজনের হয়তো মনে হতে পারে, আমাকে খুন করাটা জরুরি।’
‘তোমার মনমেজাজ দেখছি ভালো নেই, সুন্দরকাকা।’ অভীক শান্ত স্বরে বলল।
‘মনমেজাজ ভালো নেই, তবে মাথার ঠিক আছে, অভী। এটা হল আমার কাগজ-কাটার ছুরি। হিসেব মতো, এই টেবিলে বসে আমার ঘুমিয়ে পড়ার কথা। কাঁটায়-কাঁটায় ঠিক এগারোটায় খুনি—তোদের পাঁচ জনের একজন—এই কাগজ-কাটা ছুরিটা নিয়ে আমার পিঠে বসিয়ে দেবে, আমাকে খুন করবে।’
কিংশুক এখন ভীষণ মনোযোগে সব শুনছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই অদ্ভুত রহস্য ওকে মুগ্ধ করেছে। ও বলে উঠল, ‘মিস্টার চৌধুরী, ধরে নিলাম, আপনি যা-যা বললেন সব সত্যি। কিন্তু আপনি কি সময়মতো টেবিলে ঘুমিয়ে পড়ে খুনিকে খুন করার সুযোগ দেবেন?’
‘কক্ষনও না, কিংশুক, কক্ষনও না। যখন আমি জেনেই ফেলেছি যে, আমি খুন হব, তখন চট করে ঘুমিয়ে পড়াটা কী খুব সহজ হবে? আমার তো মনে হয়, এই পরিস্থিতিতে ঘুম পাওয়াটা একেবারেই অসম্ভব, কি বলো?’
‘তা হলে আর প্রথমবারের মতো ঠিক এগারোটার সময় আপনার খুন হওয়ার কোনও প্রশ্ন ওঠে না।’
‘এগজ্যাক্টলি, কিংশুক। এই রহস্যের আসল অর্থটা তুমি নির্ভুলভাবে ধরতে পেরেছ। না, খুনটা এখন প্রথমবারের মতো নিয়ম মেনে আর হতে পারে না। খুনের পদ্ধতির সামান্য এদিক-সেদিক করতেই হবে। অবশ্য তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, দেবদূত বলেছিল, প্রয়োজন হলে তার খাতায় একটু-আধটু মোছামুছি করে নেবে।’
ঘরের প্রত্যেকে অধীর কৌতূহলে প্রতিটি কথা শুনছে। স্পষ্টই বোঝা যায়, পরিস্থিতির বৈচিত্র্য ওদের সাময়িকভাবে স্তব্ধ করে দিয়েছে।
‘মিস্টার চৌধুরী,’ কিংশুক বলে চলল, ‘কী করে যে আপনি নিজের খুনের তদন্ত করবেন, সেটা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। সাধারণত আমাদের বইতে—মানে, আপনার বইতে—খুন হয়, খুনি সূত্র ফেলে যায়, এবং তারও পরে ডিটেকটিভ এসে তার কাজ শুরু করে। কিন্তু এক্ষেত্রে কোন সূত্র ধরে আপনি এগোবেন? একটা সাদামাটা উদাহরণ আপনাকে দিই—ওই কাগজ-কাটা ছুরিতে খুব সুন্দর হাতের ছাপ পড়বে, কিন্তু খুন করার আগে তো খুনি সে-হাতের ছাপ ফেলবে না। আর যখন ফেলবে, তখন আপনার তদন্তের পক্ষে অনেক দেরি হয়ে যাবে।’
‘ভালো সমস্যা তুলে ধরেছ, কিংশুক। আমার সঙ্গে থেকে-থেকে তোমার উন্নতিই হয়েছে দেখছি। হ্যাঁ, স্বীকার করছি, একেবারে প্রথমে এই অসুবিধেটার কথা আমার মনে পড়েনি। সত্যিই তো, খুন হওয়ার আগে সেই খুনের সমাধান আমি করব কেমন করে?’
‘আর তোমার হাতে মাত্র দশমিনিট সময় আছে, সুন্দরকাকা।’ উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল অভীক।
‘বড়েসাব, আপনি কি ভাবছেন, খুন করবার আগে খুনি সব কবুল করবে?’ এ-প্রশ্ন এল হীরা সিংয়ের কাছ থেকে।
‘তা হয়তো করতে পারে,’ সুষম কণ্ঠে বললেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘কিন্তু সে-ভরসায় আমি বসে নেই।’
‘তা হলে আপনি এভাবেই বসে অপেক্ষা করবেন—দেখবেন, খুনি আপনাকে আক্রমণ করতে আসছে। তখনই খুনিকে চিনতে পারবেন এবং আপনার কৌতূহলও মিটে যাবে।’ এ-প্রস্তাব রণবিলাস দত্তের।
হাসলেন অনিন্দ্যসুন্দর। যেন বন্ধুমহলে কোনও তর্কের উত্তরে বলছেন এমন সুরে জবাব দিলেন, ‘না, তা নয়। সেরকম সাহস আমার নেই, রণবিলাসবাবু, যে শান্তভাবে টেবিলে বসে দেখব, খুনি এসে আমার পিঠের ওপর ঝুঁকে পড়েছে, এবং তারপর, তার ছুরির সামনে নিজেকে উৎসর্গ করব।’
‘তা হলে আর কী পথ আছে, আমি তো বুঝতে পারছি না।’ বিরক্ত তীক্ষ্ন স্বরে তৃণা বলল।
‘সত্যিই তো, তুমি বুঝবে কেমন করে। মন দিয়ে শোনো, স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলছি। এতক্ষণে এটুকু নিশ্চয়ই আঁচ করেছ, একটা মতলব আমার মাথায় আছে। সূর্র্যকান্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা আমি করব না—কারণ সে আমার সঙ্গে চমৎকার ব্যবহার করেছে—এমনকী এই মাঝরাতে আমার এই স্টাডি-রুমে এসে পর্যন্ত আমার ওপর নজর রাখছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, খুনটা মোটেই আর হবে না!’
নিজেদের হতাশা ওরা গোপন রাখতে পারল না। অনিন্দ্যসুন্দর আবার হাসলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘এগারোটার পরে দেবদূতের কাছে আমার আর কোনও বাধ্যবাধকতা থাকছে না। নিয়মিত ছকে তার নির্ধারিত সময়টা খুনি কাজে লাগাতে পারছে না, ফলে আমি বেঁচেই থাকব—বহু বছর বাঁচব। কিন্তু যেহেতু তোমাদের আসল পরিচয়টা এখন আমার কাছে স্পষ্ট, সেহেতু এই বাড়িতে আর একটা দিনও আমি থাকব না। দেখতেই পাচ্ছ, আমার সুটকেস গুছিয়ে নিয়েছি! এ-জায়গা ছেড়ে আমি চলে যাব দূরে—বহুদূরে। তারপর, কী-করে, তৃণা, তোমাকে, আর অভী, তোকে, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যায়, সে-ব্যবস্থা আমি করছি। আর লেখক হিসেবে আমার ভবিষ্যতের কথা যদি তোল, তা হলে বলে রাখি, আজকের এই ঘটনা নিয়ে একটা নতুন বই লেখার কথা আমার মাথায় এসেছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই কাহিনির অভূতপূর্ব বৈচিত্র্য সুন্দর সান্যালের টলে যাওয়া আসনকে আবার নিজের জায়গায় সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। তুমি তোমার নিজের পথ বেছে নাও, কিংশুক। আর হীরা সিং, একজন দায়িত্বশীল আইন-মেনে-চলা নাগরিক হিসেবে আমাকে আমার কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।’
আরও একবার হাসলেন অনিন্দ্যসুন্দর।
সন্দেহের ছায়ায় আবৃত পাঁচটি মানুষই নিস্পন্দ, নীরব। দেওয়াল-ঘড়িতে এগারোটা বাজতে ঠিক সাত মিনিট বাকি।
বৃদ্ধ হীরা সিংই প্রথম মুখ খুলল, ‘বন্দুক দেখিয়ে এইভাবে আমাদের দাঁড় করিয়ে রাখছেন, বড়েসাব? তা হলে ওই চাকু দিয়ে কোই ভি আপনাকে খুন করতে পারবে না। আপনি শেষ পর্যন্ত দেবতার সোঙ্গে বেইমানি করবেন?’
‘বেইমানি আমি করব না।’ শান্ত স্বরে উত্তর দিলেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘তোমাদের বন্দুক দেখিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আমার নেই।’ নিজের বক্তব্য যেন প্রমাণ করতেই পিস্তলটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন তিনি: ‘আমার পরিকল্পনা অনেক সহজ-সরল, তাতে বন্দুক-ছুরির কোনও ব্যাপার নেই।’
‘সে-পরিকল্পনাটা কী আমরা জানতে পারি?’ কিংশুক দাবি করল।
‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। এইতো আমি, নির্ধারিত জায়গায় নির্ধারিত সময়ে চুক্তিমতো বসে আছি। আর একইসঙ্গে, আমাকে যারা খুন করতে পারে, তাদেরও আমি এখানে হাজির করেছি। এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর কী হতে পারে?’
‘এর মধ্যে কোথাও একটা চালাকি আছে।’ তাঁর ভাইপো বলে উঠল।
‘থাকাই তো উচিত, অভী। তোদের পাঁচজনের একজন হচ্ছে খুনি। এবার খুনি মহোদয়, আপনার সামনে দুটো পথ খোলা আছে। ঠিক এগারোটায় আপনি ইচ্ছে করলে আমাকে খুন করতে পারেন—এই উজ্জ্বল আলোয়, আমাকে বাদ দিয়েও চার-চারজন সাক্ষীর সামনে। সেক্ষেত্রে পুলিশের হাতে আপনাকে ধরা পড়তেই হবে, কারণ আমি হলফ করে বলতে পারি, বাকি চারজন জঘন্য চরিত্রের মানুষ আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়ার জন্যে ভয়ঙ্কর ব্যস্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু দ্বিতীয় একটা পথও আপনার আছে আমাকে খুন করার সুযোগটা আপনি ছেড়ে দিতে পারেন। সুতরাং আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে দায়ী হচ্ছেন আপনি নিজে, এবং সূর্যকান্তের সঙ্গে কোনওরকম বিশ্বাসঘাতকতা আমি করছি না। এগারোটা বেজে একমিনিটে এই বাড়ি ও তোমাদের জীবন ছেড়ে আমি চিরদিনের মতো চলে যাব।’
সশব্দে টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে নিয়ে স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে বললেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘হ্যালো দেবদূতসাহেব—কী ব্যাপার?’
‘মিস্টার চৌধুরী, আপনি আমাকে ঠকাচ্ছেন! দেবদূত বলে উঠল।
‘উঁহু, মোটেই না। খুনিকে বের করার এটাই হচ্ছে একমাত্র পথ। খুনের আগে কোনও সূত্র পাওয়া সম্ভব নয়, এবং খুনের পরে আমি আর বেঁচে থাকছি না। যদি খুনি নিজে সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে আমাকে খুন করবে না, তা হলে আপনি আমাকে দোষ দিতে পারেন না।’
‘আপনি খুব চালাক, মিস্টার চৌধুরী!’
‘ধন্যবাদ।’
‘কিন্তু সেরকম চালাক নন। আপনি ভুলে যাচ্ছেন, রাত এগারোটায় খুনিকে একটা বিশেষ কাজ করতে হবে—আপনার মতো তাকেও সময় দেওয়া রয়েছে। সুতরাং তার একটা পালটা মতলব থাকতে পারে।’
টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন অনিন্দ্যসুন্দর। তাঁর মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে। এ-কথা তিনি একবারও ভাবেননি। মনোযোগী দর্শকদের কাছে তাঁর টলে যাওয়া আত্মবিশ্বাস গোপন রইল না।
‘কটা বাজে?’ অভীক প্রশ্ন করল। ও চোখে ভালো দেখতে পায় না।
‘এগারোটা বাজতে তিন।’ দেওয়াল-ঘড়ির সবচেয়ে কাছে দাঁড়িয়ে আছে কিংশুক বোস।
একটা ভারী নিস্তব্ধতা ঘরে জাঁকিয়ে বসল। তৃণা ও রণবিলাস চকিত দৃষ্টি বিনিময় করল। অন্যান্যরা অনিন্দ্যসুন্দর চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে। ওদের অবিশ্বাসী অভিব্যক্তি এখন পুরোপুরি অদৃশ্য। আর ওদেরই মাঝে বসে খুনি মনে-মনে এক চরম সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে।
হঠাৎ উঠে দাঁড়াল রণবিলাস দত্ত, লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল ঘরের দরজার কাছে। ওর চলার শিকারি চিতার ক্ষিপ্রতা এবং এতটুকু পায়ের শব্দ নেই। সতর্ক হয়ে ওকে লক্ষ করতে লাগলেন অনিন্দ্যসুন্দর, অনুভব করলেন অটোমেটিকের স্পর্শ।
দরজার কাছে গিয়ে থামল রণবিলাস, চকিতে ঘুরে দাঁড়াল।
‘মিস্টার চৌধুরী একটা কথা ঠিকই বলেছেন,’ রণবিলাস দত্ত ধীরে-ধীরে বলতে শুরু করল, ‘অন্যান্যদের চোখের সামনে খুনি যদি খুন করে, তা হলে তাঁরা সাক্ষী দিতে পারবে। এবং তাঁদের নিরাপত্তা পুরোপুরি বজায় থাকবে। কিন্তু যদি সকলের চোখ এড়িয়ে খুনটা করা যায়, তা হলে? তখন কেউই সঠিক বলতে পারবে না, কে খুন করেছে। এ-কথা সত্যি যে, আমাদের প্রত্যেকেরই খুনের মোটিভ রয়েছে, আমাদের সবাইকেই পুলিশ সন্দেহ করবে—এমনকী এরকমভাবেও তারা কেস সাজাতে পারে যে, আমরা পাঁচজনে মিলে প্ল্যান করে মিস্টার চৌধুরীকে খুন করেছি। কিন্তু পুলিশ যদি এই ঘরোয়া বৈঠকের কথা একেবারেই না জানতে পারে? তা হলে আমাদের কারওরই কোনও ভয় নেই, আর খুনি ঠিক প্রথমবারের মতোই আইনের চোখে ধুলো দেওয়ার একই ঝুঁকি নেবে। শুধু যা করতে হবে, তা হল, কোনও প্রত্যক্ষ সাক্ষী না-রেখে রাত ঠিক এগারোটায় মিস্টার চৌধুরীকে খুন করতে হবে।’
এগারোটা বাজতে একমিনিট।
‘কিন্তু সেটা খুনি করবে কীভাবে?’ অনিন্দ্যসুন্দর চৌধুরী তীব্র স্বরে জানতে চাইলেন, কিন্তু সবিস্ময়ে উপলব্ধি করলেন, তাঁর গলার স্বর কাঁপছে, ‘একঘর লোকের সামনে প্রত্যক্ষ সাক্ষী না- রেখে কী করে আমাকে খুন করবে সে?’
রণবিলাস দত্ত হাসল। ঘোরতর শত্রুর হাসি।
‘কেন, সে তো খুব সহজ,’ উত্তর দিল সে, ‘শ্রীযুক্ত সুন্দর সান্যাল, রহস্য-গোয়েন্দা গল্পের প্রখ্যাত লেখক, এটা কী করে আপনার চোখ এড়িয়ে গেল বলুন তো? আমাকে কাজের কাজ যা করতে হবে, তা হল, টুক করে ঘরের আলোটা নিভিয়ে দেওয়া!’
অনিন্দ্যসুন্দর কিছু করে ওঠার আগেই রণবিলাসের আঙুল পৌঁছে গেল আলোর সুইচে। অন্ধকার নেমে এল চকিতে, অস্তিমান রইল। যে-বিদ্যুতের ঝলক এতক্ষণ প্রায় ধারাবাহিকভাবে আলোর বর্শা নিক্ষেপ করে চলেছিল, এখন, এইমুহূর্তে, উচ্ছৃঙ্খল দুর্বৃত্তের মতো স্তব্ধ হল। উত্তাল আক্রোশে বাইরের দেওয়ালে ঝাঁপিয়ে পড়া বৃষ্টির শব্দে লোপ পেল সমস্ত পায়ের শব্দ।
নিজের পরিচয় অজ্ঞাত রেখে চলাফেরায় খুনির আর কোনও অসুবিধে নেই!
বিস্ময়ে সাময়িকভাবে বিমূঢ় হয়ে না-পড়লে অনিন্দ্যসুন্দর হয়তো কিছু করতেন। কিন্তু তিনি নিশ্চল নিস্পন্দ হয়ে বসে রইলেন চেয়ারে।
কেউ একজন তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। একটা হাত তাঁর মাথাটা ঠেলে দিল সামনে, টেবিলের ওপর। তিনি ঘুমিয়ে পড়লে ঠিক যেমনটা হত। অনিন্দ্যসুন্দর বুঝলেন, অন্য হাতটা তখন খুঁজে বেড়াচ্ছে কাগজ-কাটা ছুরিটা…খুঁজে পেল…শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরল।
আঘাতটায় সেরকম যন্ত্রণা অনুভব করলেন না তিনি।
আবছাভাবে অনিন্দ্যসুন্দর টের পেলেন, যে-হাতটা তাঁর মাথাটা টেবিলে ঠেলে ধরেছিল, সেটা এখন তাঁর প্যান্টের বাঁ-পকেট হাতড়ে বেড়াচ্ছে, তুলে নিচ্ছে তাঁর রুমালটা…এবার খুনি ছুরির হাতল থেকে মুছে ফেলছে তার আঙুলের ছাপ…।
অনিন্দ্যসুন্দরের মাথার মধ্যে যেন তীক্ষ্ন শব্দে ঘণ্টা বেজে চলেছে…।
নাকি সেটা টেলিফোন বেজে ওঠার শব্দ…।
‘সুস্বাগতম, মিস্টার চৌধুরী। একেবারে কাঁটায়-কাঁটায় ফিরে এসেছেন।’
সূর্যকান্তের টেবিলের সামনে সোনার সিংহাসনে শ্লথ ভঙ্গিতে বসে পড়লেন অনিন্দ্যসুন্দর।
‘পৃথিবীতে কেমন কাটালেন, মিস্টার চৌধুরী?’
‘আমি আবার খুন হয়েছি!’
‘নিশ্চয়ই!’
‘কে খুন করেছে আমাকে?’
দেবদূত সশব্দে হেসে উঠল। সেই হাসিতে গমগম করে উঠল শ্বেতপাথরে অলঙ্কৃত প্রাসাদ।
‘সেটা জানতেই তো আপনি আবার ফিরে গেলেন পৃথিবীতে! আর এখন কিনা সেই একই প্রশ্ন করছেন? আপনি নিশ্চয়ই তৃতীয়বার পৃথিবীতে যাওয়ার কথা ভাবছেন না?’
‘না, ধন্যবাদ,’ শ্রান্ত স্বরে বললেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘কিন্তু এখানে আমি এতটুকু শান্তি পাব না—।’
‘আবার সেই পুরোনো কথা!’ তড়িঘড়ি বলে উঠল দেবদূত, ‘তার চেয়ে আসুন আপনার খুনের রহস্যটা নিয়ে একটু মাথা ঘামানো যাক। নিজেকে খুনির জায়গায় কল্পনা করুন, মিস্টার চৌধুরী। যখন রণবিলাসবাবু আলো নিভিয়ে দিলেন, তখন আপনি হলে কি টেবিলের কাছে গিয়ে খুনটা করতেন?’
দু-হাতে মাথা রেখে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন অনিন্দ্যসুন্দর। তারপর বললেন, ‘না, আমি সেটাকে একটা ফাঁদ বলে সন্দেহ করতাম। কারণ, ছুরি বসানোর সময় কেউ হয়তো আলোটা আবার জ্বালিয়ে দিতে পারত, এবং আমি হাতেনাতে ধরা পড়তাম।’
‘ঠিক বলেছেন, মিস্টার চৌধুরী। সেটা প্রচণ্ড ঝুঁকির কাজ হত। এবারে আর-একটা প্রশ্ন। আপনি যদি খুনি হতেন, তা হলে যাকে খুন করলেন তারই পকেট থেকে রুমাল বের করে ছুরি থেকে নিজের আঙুলের ছাপ মুছে ফেলার কী কারণ আপনার থাকতে পারে?’
‘এর একটাই উত্তর,’ বললেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘নিশ্চয়ই আমার কাছে কোনও রুমাল ছিল না।’
‘ঠিক।’ সম্মতি জানাল দেবদূত: ‘এবার বলুন তো, ওই পাঁচজনের মধ্যে কে জানত যে, আপনি সবসময় প্যান্টের বাঁ-পকেটে রুমাল রাখতেন?’
‘বুঝেছি, আপনি কি বলতে চান!’ অনিন্দ্যসুন্দরের ঠোঁটে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল।
প্রত্যুত্তরে সূর্যকান্তও হাসল: ‘এবারে নিশ্চয়ই আপনি এখানে সুখী হবেন, মিস্টার চৌধুরী।’
‘তৃণার তরুণ প্রেমিক রণবিলাস ছিল আলোর সুইচের কাছে, ‘আত্মগতভাবেই বললেন অনিন্দ্যসুন্দর, ‘খুনটা ও শেষ না-করা পর্যন্ত রণবিলাস যে আলো জ্বেলে দেবে না, সে-ভরসা তৃণার ছিল। তা ছাড়া, তৃণার সঙ্গে কোনও রুমাল ছিল না। ছুরির হাতলটা যদি ও শাড়িতে মুছতে যেত, তা হলে শাড়িতে রক্ত লেগে যাওয়ার ভয় থাকত। সুতরাং আমার রুমালটাই ও বেছে নিয়েছে। আমি রুমাল কোথায় রাখি, সেটা সবচেয়ে ভালো জানত তৃণাই—আর কেউ নয়!’
‘ঠিক আমি যা ভেবেছি তাই, মিস্টার চৌধুরী।’
‘গোয়েন্দাগিরিতে আপনি দেখছি নেহাত কম যান না!’
দেবদূত কষ্টকৃত বিনয়ের ভাব ফুটিয়ে তুলল। নরম সুরে স্বীকার করল, ‘এখানে থাকতে-থাকতে টুকটাক কিছু শিখেছি আর কী। বলতে পারেন একরকম সঙ্গগুণ বা মেলামেশার ফল—।’
‘সঙ্গগুণ? মেলামেশা?’
‘কেন, আপনাকে বলিনি, মিস্টার চৌধুরী? ওঃ হো। প্রথমেই যদি বলতাম, তা হলে আপনি হয়তো এতটা অসুখী হতেন না, বরং খুশিই হতেন। ঠিক আছে, আর দেরি নয়। আসুন, সবার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি হলেন পাঁচকড়িবাবু, ইনি দীনেন্দ্রবাবু আর ইনি শরদিন্দুবাবু…।’
‘পাঁচকড়িবাবু, দীনেন্দ্রবাবু, শরদিন্দুবাবু!’
‘হ্যাঁ, মিস্টার চৌধুরী। কেন, আপনি জানেন না, রহস্য-সাহিত্যিকরা মারা গেলে স্বর্গে আসেন!’