অনশ্বর (Onossor) : 03
রায়পিসিকে পৌঁছে দিয়ে শ্যামলাল জ্যোৎস্নার আলো-জাল-বোনা পথ দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হল। ওর কেবলই মনে হচ্ছিল আর ক’দিন পরেই এমন সোনার দেশ ছেড়ে কোথায় কতদূরে যাবে সে! সেখানে এমনধারা কি গুলঞ্চলতা দোলে ডালে ডালে, এমন লাল কলমী-শেওলার সাদা ফুল ফোটে বিল বাঁওড়ের জলে, এমন কেলেকেঁাড়া ফুলের সুগন্ধ বার হয়, এমন পাখী ডাকে বনের ধারে?
কি জানি সে কেমন দেশ! তবু যেতে হবে, কারণ বাবার ইচ্ছে। চিরকাল পণ্ডিতি করে সংসার চালিয়ে এসেছেন, আজ কোনো সম্বল নেই তাঁর এ বুড়ো বয়েসে। বাবার অন্নে তার এই চব্বিশ বছরের জীবনটা কবিত্ব করে বেশ নিরুদ্বেগেই কেটেচে, আজ তাকে দাঁড়াতেই হবে বুড়ো বাবাকে সাহায্য করবার জন্যে। উনি যা বলেন, যেখানে নিয়ে যান।
বাড়ি ফিরবার পথে গোষ্ঠ ঘোষের চণ্ডীমণ্ডপে কি একটা নাটকের রিহার্সাল দিচ্ছে ছেলেছোকরারা। ওর বড় ইচ্ছে হল একবার বসে একটুখানি যোগ দিয়ে যায় এদের আড্ডায়। এই সব করেই এত বড় হয়ে উঠেছে এই গ্রামে। এ ছাড়া জীবন কল্পনা করতেই পারে না। তার বাবা এতদিন পর্যন্ত তাকে বালকের মতো পালন করে এসেচে, কোনো শক্ত কাজে লাগায়নি, জীবন-সংগ্রামের ক্ষেত্রে নামতে দেয়নি। সাহায্য করেচে ওর মধ্যে একটি শান্ত, নিস্পৃহ, সরল নিরুদ্বিগ্ন কবিমন গড়ে উঠবার। অতি ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে সে কবিমন এই গ্রামের আবহাওয়ায়। আজ মূল শেকড়সুদ্ধ সেই কচি গাছটিকে উপড়ে নিয়ে গিয়ে পোঁতা হবে কোন সুদূর অজানা দেশের রুক্ষ, নীরস, পাথুরে দেশের কঙ্করময় মৃত্তিকায়!
গোষ্ঠ ওকে দেখে বললে—আরে এসো এসো শ্যামদা, আজ কি পথ ভুলে এ্যালেন নাকি এদিকি?
—কি থিয়েটার হবে এবার তোমাদের ক্লাবের? দেখতে এলাম!
—শুধু এলি হবে না, আপনার রোজ এসে শেখাতি হবে। কানাইকে একটু মানুষ করে দ্যান। কথাবার্তা ওর মোটে শুরুদ্ধ উশ্চারণ হতি চায় না—আসুন বসুন—
শ্যামলালকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে গোষ্ঠ ঘোষ খেজুরের পাতায় বোনা চ্যাটার ওপর বসালে। হাতের লেখা একখানা খাতা এগিয়ে দিয়ে বললে—শিবাজীর পার্ট একটুখানি দেখিয়ে দিয়ে যান আমারে—শুধু আপনি একটুখানি পড়ে যান—
কানাই জেলে একটা বিড়ি ধরিয়ে এনে খাতির করে বললে—খান—
গোষ্ঠ বললে—ও কি! উনি ওসব খান-টান না। বামুনপাড়ার বওয়াটে ছোঁড়াদের মতো নন উনি। লেখাপড়া নিয়েই থাকেন।
শ্যামলালকে এরা সত্যি অন্য চোখে দেখে। ও যে অন্য ধরনের মানুষ, তা সবাই জানে। শ্যামলাল অনেকক্ষণ বসে বসে শিবাজীর পার্ট শেখালে গোষ্ঠকে। সবাই এগিয়ে এসে মন দিয়ে শুনতে লাগলো।
ওপাড়ার নন্দ সাঁপুই বললে—নাঃ, এমন শুরুদ্ধু উশ্চারণ না হলি কি আর পার্ট করা চলে? কি চমৎকার পড়া! আর একটু পড়ে দ্যান, যেন মধু!
গোষ্ঠ বললে—আরে তা না হলি ওরে এত খাতির করবো কেন? এমন ছেলে এ গাঁয়ে কডা আছে? শ্যামদা, ‘দুই পুরুষ’ খুলবো যদি আপনি ভরসা দ্যান—‘দুই পুরুষ’ আর ‘পথের শেষে’—
—আমার দ্বারা আর হবে না। আমি চলে যাচ্ছি।
প্রায় সকলেই সমস্বরে বলে উঠলো—কোথায় কোথায়?
—পশ্চিমে।
—কেন?
শ্যামলালকে আবার তার যাওয়ার উদ্দেশ্য বিস্তৃতভাবে বুঝিয়ে দিতে হল। নানা রকম প্রশ্ন নানা দিক থেকে বর্ষিত হতে লাগলো। এরা সবাই ঘরবোলা নিতান্ত সরল গেঁয়ো লোক, অতদূর তো দূরের কথা, কলকাতাতেই অনেকে এখনো যায়নি। শ্যামলালও সে দেশের কথা বিশেষ কিছু জানে না। স্কুলের ম্যাপের সাহায্যে যতটা সে জানতে পেরেচে, তাই বুঝিয়ে বললে। অনেকে অবাক হয়ে গেল।
গোষ্ঠ বললে—আমাদের নামিয়ে দিয়ে যান শ্যামদা। আপনি থাকলি মস্ত ভরসা।
—সে হয় না। তোমাদের নামতে এখনো একমাসের উপর দেরি। আমাকে দু-চার দিনের মধ্যে যেতে হবে। আজ এখন আসি।
কানাই বললে—চা খাবেন বসুন। আমাদের চা চড়েচে, গুড়ির চা কিন্তু খেতে হবে।
—না না, এত রাতে আমার জন্যে আবার চা কেন?
—আপনার একার জন্যি নয়, সবাই খাবে।
শ্যামলাল প্রত্যাখ্যান করতে পারলো না। আসলে এসব তার খুব ভালো লাগে। এই গ্রাম্য আমোদ-প্রমোদের মধ্যে, এইসব আটচালার চণ্ডীপণ্ডপে ঘোরাঘুরির মধ্যে জীবনকে সে এতদিনে খুঁজে পেয়েছে। উঠতে ইচ্ছে করে না তার, বিশেষতঃ যখন অল্পদিনের মধ্যে এদেশ থেকেই সে চলে যাচ্ছে, আবার কতদিন পরে ফিরবে তা কে জানে!
কি সুন্দর চাঁদ উঠেচে এখানকার আকাশে, কি চমৎকার সুগন্ধ এখানকার মাটির পথে পথে!
রামলাল বললে—এত রাত হল কেন রে তোর? আমরা সবাই না খেয়ে রয়েছি যে—
খাওয়াদাওয়ার পর পিতাপুত্রে নানারকম বৈষয়িক পরামর্শ হল। হানিডাঙ্গার বটকৃষ্ট তরফদার দু’টাকা ন’আনা খাজনা দেয়, একখানা দাখিলা সই করে তাকে পাঠিয়ে দিতে হবে ভাদ্র কিস্তির জন্যে। পুকুরের পাড়ের বাঁশঝাড় থেকে দশ টাকার বাঁশ বিক্রি করতে হবে পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের কাছে। পুকুরটা নিকিরিদের কাছে জমা দিয়ে দিতে হবে। হাতে কিছু টাকা দিয়ে যেতে হবে শ্যামলালের মাকে।
হাওড়া থেকে ট্রেনে চড়বার সময় রামলাল ও শ্যামলাল পরস্পরের দিকে চাইলে। কলকাতা পর্যন্ত তো এক রকম বেশ এসেছে ওরা, এ তেমন অজানা নয়। অজানার উজানে পাড়ি শুরু হল এবার। ঘরবোলা লোক ওরা, অতিকষ্টে চিঁড়ের পুঁটুলি, আমসত্ব ও পাটালি বেঁধে বিদেশে পা বাড়িয়েচে। শ্যামলালের বয়েস পঁচিশ বছর হলে কি হয়, মনে এখনো সে বালক, বা তার বাপ-মাও তাকে বালকই ভাবে। আসবার সময় ওর কড়ে আঙ্গুল কামড়ে পর্যন্ত দিয়েছে ওর মা। বি-এন-আর রেলে ওরা কখনো চড়েনি, হাওড়া স্টেশনও কখনো দেখেনি।
ট্রেন ছাড়লো সন্ধ্যার কিছু আগে। দুধারে রেলের ইয়ার্ড, অপরিষ্কার বস্তি, কলকারখানা। এত ঘিঞ্জি জায়গা! আন্দুল, মৌরীগ্রাম, চেঙ্গাইল—কোনো জায়গায় এতটুকু সৌন্দর্য নেই। না গাছপালার সৌন্দর্য, না ভূমিশ্রীর কমনীয়তা। সব চেয়ে মনে হল শ্যামলালের, এ সব দেশে নির্জন জায়গা নেই কেন, তাদের গ্রামের বা তার আশেপাশের বিস্তীর্ণ মুক্ত প্রান্তর বা নদীর ধারের মতো? যেখানেই বসবে এখানে, সেখানেই লোক। নির্জনে একমনে বসে ভাববার মতো এতটুকু জায়গা নেই কি এদেশে! ভাগ্যিস তাদের বাড়ি এসব অঞ্চলে হয়নি তাই রক্ষে! তার কবি-মন যেন শিউরে ওঠে।
সে বললে—বাবা, ঘুমুলে নাকি?
রামলাল বৃদ্ধ ব্যক্তি, সারাদিনের পথশ্রমে কাতর অবস্থায় চোখ বুজে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল, শ্যামাকে নিয়ে যাচ্চে তো সম্পূর্ণ অজানা বিদেশে, কাজটা ভালো হল কি? ছেলেটার ভবিষ্যতের জন্যেই সেখানে যাওয়া, তার নিজের জন্যে নয়। সে জানে তার ছেলে কবি ধরনের। সাংসারিক কাজকর্মের তত উপযুক্ত নয়। ওর ঘাড়ে শক্ত কাজের ভার দিতে বা সাংসারিক দায়িত্বের চাপ দিতে পারবে না রামলাল। ওর মনের স্বাধীন আনন্দকে সে নষ্ট করে দিতে চায় না। রামলাল চোখ বুজলে তারপর যা হয় হবে।
রামলাল এই বিদেশে আসবার মতলব করেনি শুধু নিজের ইচ্ছাতে। এর পেছনে আছে তাদের স্কুলের ভূতপূর্ব হেডমাস্টার ভুবন মুখুয্যের পরামর্শ। ভুবন মুখুয্যে সেকালের এন্ট্রান্স পাশ, বয়েস অনেক হয়েচে, রামলাল ১৯১২ সালে প্রথম ভুবন মুখুয্যের অধীনে মাইনর স্কুলের হেড পণ্ডিতি কাজে ভর্তি হয়। রামলালদের গ্রাম পাঁচঘরাতেই ভুবন মুখুয্যে ঘরদোর বেঁধে গত চল্লিশ বছর বাস করছেন। ভুবনবাবু আনন্দমোহন বসুর বিশেষ ভক্ত-শিষ্য, নিজে যদিও আনুষ্ঠানিক ব্রাহ্ম নন, তবুও ধর্মমতে অতখানি অজ পাড়াগাঁয়ের গোঁড়ামি থেকে সম্পূর্ণ উদার ও স্বাধীন।
ভুবনবাবু বলতেন—জানো, আজকাল ছেলেরা বিলেত যায়, বাপের টাকা খরচ করে আসে। বিলেত গিইছিল বাপের ব্যাটা আনন্দমোহন বোস। কেমব্রিজ টের পেয়ে গিয়েছিল ছেলে একখানা এসেছে বটে! ইউনিভার্সিটি ইউনিয়নে এমন বক্তৃতা দিলে ব্রিটিশ কুশাসনের বিরুদ্ধে যে বিলিতি ছোকরার দল অবাক হয়ে গেল। হেনরি ফসেট ছিলেন পার্লামেন্টের জাঁদরেল মেম্বর, তাঁর সঙ্গে এমন বন্ধুত্ব হল যে ইলেকশ্যনের সময় হেনরি ফসেটের প্রতিনিধি হয়ে ব্রাইটনে ভোটারদের মধ্যে আনন্দমোহন বসুকে বক্তৃতা করতে হয়—সে বক্তৃতা কাগজে পড়ে ফসেট বললে, আমি এর চেয়ে ভালো বক্তৃতা করতে পারতুম না—হ্যাঁ, ছাত্র বটে!
সেই ভুবনবাবুই বলেছিলেন, ওহে, গর্তের মধ্যে ফেলে রেখো না ছেলেকে। দূরে পাঠাও, চোখ মুখ কান ফুটতে বড় সাহায্য হয় ওতে। কার মধ্যে কি থাকে কে জানে? বিদেশ যেতে দাও—মায়ের আঁচল ধরে থাকবে কেন চিরকাল?
শ্যামলাল আবার বললে—ও বাবা, ঘুমুলে?
রামলাল ধড়মড় করে উঠে বসে বললে—না বাবা, গাড়ির ঝাঁকানিতে একটু তন্দ্রা এসেছিল। খিদে পেয়েচে, খাবি কিছু?
—না, এই তো খাবার খেয়ে এলাম হাওড়া ইস্টিশান থেকে! তুমি ঘুমোও।
সারারাত্রির মধ্যে ভাল ঘুম এল না রামলালের। কোথায় যাচ্চে, কিসের মধ্যে, সম্পূর্ণ অজানার উদ্দেশ্যে—কি এর পরিণাম হবে কে জানে রামলাল নিজের জন্যে মোটেই ভাবে না, ভাবে তার ছেলের জন্যে। নিজের তো তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেচে, এখন যাতে ছেলেটার কোনো ভবিষ্যতের সুব্যবস্থা করতে পারা যায়। পল্লীগ্রামের ইস্কুল-মাস্টারির যা পরিণাম, সে তো নিজেকে দিয়েই সে বুঝতে পারচে।
এই দূর অজানা বিদেশে যদি তার মৃত্যুও হয়, তবুও তার ক্ষতি নেই কিন্তু সে যেন ছেলের সুরাহা দেখে মরতে পারে।
শরৎকালী গাঙ্গুলী কেমন লোক হবে কে জানে?
ছেলেকে ডেকে বললে—হ্যাঁরে, তোর এই মামা কেমন লোক শুনেচিস?
—ভাল লোক।
—সে আমি খানিকটা জানি। একসময় আমাদের সংসারে কিছু কিছু সাহায্য করতেন—
—কেন?
—ওর বোনকে ও পাঠাতো। সংসারের কষ্টও তো ছিল।
—তুমি নিতে কেন?
—সে তুমি বুঝবে না বাবা। একবার ছ’মাস অসুখে পড়ে রইলাম। অতি কষ্টে চাকরিটা বজায় রাখলাম ইনসপেক্টর আফিসে লিখে। কিন্তু খাই কি? তোমার গর্ভধারিণী তখন লিখলে তার ভাইয়ের কাছে। শরৎকালী দাদা সেই মাসেই দশ টাকা পাঠিয়ে দিলেন—তারপর মাসে মাসে দশ টাকা করে পাঠাতেন। এবার খাবি কিছু? খেয়ে শুয়ে পড়—
তার পরদিন ভোরের দিকে ঘুম ভাঙলো রামলালের। বেজায় ভিড়ে ঘুম আদৌ ভালো হয়নি। তবে রাত তিনটের পর কি একটা বড় ইস্টিশানে গাড়ি এল, সেখানে অনেক লোক নেমে যাওয়াতে গাড়ির ভিড়টা পাতলা হয়ে গিয়েছিল। ঘুম যেটুকু হয়েচে, তারপর। তার আগে চোখ বুজতে পারা যায়নি।
শ্যামলাল ধড়মড় করে উঠে বসে দু’হাতে চোখ কচলে বাইরের দিকে চেয়ে বললে— বাঃ বাঃ, বাবা দেখচো বাইরের দিকে?
—উঠলি? কি দেখবো?
—সুন্দর দেশ না! এত ফাঁকা জায়গা দেখেচ কখনো বাংলা দেশে? ওই দ্যাখো বাবা, ওগুলো নিশ্চয় পাহাড়—বাঃ বাঃ কি চমৎকার! নীল নীল পাহাড় কেমন দেখাচ্চে বাবা? এতদিন ছবিতে দেখেছিলাম—এইবার চোখে দেখলাম। তাকিয়ে দ্যাখো বাবা—
—দেখচি। বেশ।
আসলে রামলালের ও সবদিকে তত দৃষ্টি ছিল না। পাহাড়-টাহাড় দেখে দুটো হাত বেরুবে কারো? শ্যামলাল ছেলেছোকরা, সে দেখুক গিয়ে ওসব। একসময়ে তার কবি-দৃষ্টি ছিল। সংসারের ভীষণ চাপে সব শুকিয়ে গেল কিনা! আর এই একঘেয়ে ইস্কুল-মাস্টারি যে কি দুঃখের, যে দীর্ঘদিন ধরে করেচে সেই জানে।
এখন আর কিছু নয়, খোকাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করাই তার জীবনের ব্রত। এই মহাব্রত উদযাপন করবার জন্যেই দিকদিশাহীন এই অকূলে রামলাল দুঃসাহসিক পাড়ি জমিয়েচে এই বুড়ো বয়েসে। মরণে সে ভয় পায় না—তার আগে খোকাকে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে যদি যেতে পারা যেতো!
শ্যামলাল উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলো—দ্যাখো বাবা, এই সরুমতো পথটা কেমন পাহাড়ের ওপর দিয়ে উঠচে—কি সুন্দর সিনারি!
—হুঁ।
—আচ্ছা বাবা, ওগুলো কি শালগাছ?
—বোধ হয় তাই হবে। হ্যাঁরে খোকা, তোর কি মনে হয়?
—কিসের কি মনে হয়?
—বিদেশে গিয়ে ভালো করচি?
—নিশ্চয়।
—তোর মনে সাহস আছে?
—খুব।
—তবেই হবে।
—বাবা, ওসব তুমি কিছু ভেবো না। আমি যখন তোমার সঙ্গে যাচ্ছি তোমার ভাবনা কি? আমার একটা কিছু সুবিধে হলে তোমাকে নড়ে বসতে দেবো ভেবেচ? বসে বসে খাওয়াবো।
রামলাল অধৈর্য ভাবে বলে উঠলো—রাম রাম, ওসব কথায় এখন দরকার নেই—
—কি ভাবচো বল তো?
—নানান ভাবনা ভাবচি, বিদেশে কতদিন আমাদের লোকে খেতে দেবে? আর তা খাবোই বা কেন? অল্পদিনের মধ্যে একটা কিছু ব্যবস্থা করে নিতে পারা যাবে কিনা—
—শালবনটা দ্যাখো বাবা—
—বেশ।
—না, ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখো না? ওটা বোধ হয় পাহাড়ী নদী বয়ে যাচ্ছে! কি বড় বড় পাথর পড়ে আছে! অত পাথর এল কোথা থেকে বাবা?
—পাহাড়ের দেশ, তা পাথর আসবে না? যাক সে কথা। তোর গর্ভধারিণী চিঠি দিয়েচে তোর শরৎকালী মামার কাছে তো? আমাদের সে চেনে না, কখনো দেখেনি। কি যে হবে, তাই ভাবচি—
—বড্ড ভাবো তুমি বাবা। সে যা হয় হবে। তুমি এখন সিনারি দ্যাখো তো? ওই দ্যাখো একটা পাহাড়ের চূড়ো যেন মন্দিরের মতো। পাহাড় দেখে চোখ যেন জুড়িয়ে গেল—আঃ—শ্যামলাল একটা আরামের দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললে শেষের দিকে।
ওর বাবা বিরক্ত হয়ে বললে—পাহাড় খেয়ে তো পেট ভরবে না বাবা—
—তুমি কিছু ভেবো না বাবা। তোমার ভার আমি নেবো।
রামলাল আবার বিরক্ত হয়ে উঠলো। ওই সব অবাস্তব ছেলেমানুষি কথা ওর ভালো লাগে না। কবিত্ব করলে তো পেট ভরবে না। বাপের মনের দুঃখ ওই সব উচ্ছ্বাসে-ভরা ছেলেছোকরা কি বোঝে! আজকাল যে নিজের পায়ে দাঁড়ানো কত দুরূহ কাজ, যে অভিজ্ঞ লোক, জানে। এসব ছেলেছোকরা কখনো জানে সংসারের দুঃখের বার্তা, না রামলাল ওকে বুঝতে দিয়েচে? ডানা দিয়ে সযত্নে সস্নেহে ঢেকে রেখেচে না এতদিন! কাজেই সে এখন কেন পাহাড়-টাহাড়, সিনারি-ফিনারি দেখবে না?
বেলা দশটার সময় রেলপথের দু’দিকের জঙ্গল এত নিবিড় হয়ে উঠলো যে অ-কবি রামলালও যেন অবাক হয়ে গেল। না, দেশটা যেন বড্ড জঙ্গলে ভরা! এখানে ডাক্তারি চলবে? শ্যামলালই বা এখানে কি করবে বুঝতে পারা গেল না।
ধুরুয়াডিহি স্টেশনে নেমেও এই কথাই মনে হল ঠিক। শরৎকালী গাঙ্গুলী স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে উপস্থিত ছিলেন। রোগা, ফর্সা চেহারা। সত্তরের ওপর বয়েস হবে হিসেবমতো—কিন্তু পঞ্চাশের বেশি দেখায় না। না, দেশের জল-হাওয়ার গুণ আছে বলতে হবে। শরৎকালীবাবুর চোখে পুরু চশমা, হাতে রূপো-বাঁধানো পাহাড়ী কাঠের ছড়ি, গায়ে একটা গরম কাপড়ের ফতুয়া। এখন গরম কাপড়ের ফতুয়া গায়ে কেন, রামলাল বুঝতে পারলে না।
রামলালকে স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে বললেন—এসো ভায়া। একা পড়ে থাকি, বাঙালীর মুখ দেখতে পাই নে, কখনো তো আসতে না! এসেচ বড্ড ভালো করেচ। একটা কথা, চলে যেতে পারবে না এখান থেকে। অন্নপূর্ণাকেও কেন নিয়ে এলে না? কতদিন দেখিনি—
শ্যালকের ব্যবহারটি বেশ উদার ও খোলাখুলি। রামলালের মনের যে সঙ্কোচ, উদ্বেগ ও আশঙ্কা ছিল, এই শুভ্রবেশ সৌম্যদর্শন ভদ্রব্যক্তির আবির্ভাবে যেন এক মুহূর্তে সব কেটে গেল।
সে হেসে বললে—আপনি তো বললেন দাদা, তাদের আনা কি সহজ? সেখানেও তো একটা সংসার—গরু আছে, বাছুর আছে, আম কাঁঠাল গাছ আছে—সব ফেলে কি আসা চলে হঠাৎ দাদা?
—না না, আমি বলি শোনো ভায়া। এসো বাবাজী, দীর্ঘজীবী হও। বেশ ছেলেটি। নাম কি বললে, শ্যামলাল? বেশ, বেশ। কতদূর পড়াশুনো করেছিলে?
রামলাল এর উত্তর দিলে। বললে—বেশি না দাদা। অবস্থা তো বুঝতেই পারচেন, কোথা থেকে বেশি পড়াবো! তবে ও বাড়ি বসে খুব পড়াশুনো করেচে। ওই ওর বাতিক। আর বেশ কবিতা লেখে।
শরৎকালীবাবু হেসে বললেন—বেশ ভালো। তবে কবিতা ফবিতায় কাজ হবে না বাবাজী। বাস্তব জীবনে কবিতা-ফবিতার স্থান কোথায়? ওসব বইয়ে পড়তেই মিষ্টি লাগে। এখন এখানে এসেচ, পুরুষমানুষ—যাতে দু’পয়সা রোজগার করতে পারো, তার চেষ্টা করতে হবে। পয়সা রোজগারের অনেক ফন্দি আছে এখানে—চাই শক্তিমান বুদ্ধিমান লোক। তোমার মাকে যাতে এখানে এনে ফেলতে পারো, তার চেষ্টায় থাকো। ও ম্যালেরিয়ার দেশে আর ফেলে রেখো না। আচ্ছা চলো—বাড়ি চলো বাবাজী, চলো ভায়া—সে সব কথা পরে হবে এখন—