Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

দিন আর আমাদের কাটতে চায় না।

চার চারটে সুস্থ সবল জোয়ান ছোকরার পক্ষে এ খানিকটা অবিশ্বাস্য ব্যাপারই বটে।

কেন, কলকাতায় কি খেলাধুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে? গড়ের মাঠ কি ভাগাভাগি করে নিয়ে লোকে সেখানে দালান-কোঠা তুলেছে? ফুটবল ক্রিকেট হকি কি দেশ থেকে আইন করে তুলে দেওয়া হল?

না।

তবে?

কলকাতার ছবিঘরগুলো কি সব বন্ধ? থিয়েটার বায়োস্কোপ সভাসমিতি মজলিশ কি আজ শহর থেকে উধাও?

না। তা নয়!

তবে?

কলকাতার সাঁতার, কুস্তি, বক্সিং, দৌড়ঝাঁপ সব কি উঠে গেছে?

না। সবই আছে। শুধু ঘনাদা মেসে নেই।

সত্যিই ঘনাদা মেস থেকে চলে গেছে। একেবারে তল্পিতল্পা গুটিয়ে আমাদের হতভম্ব করে চলে গেছেন এবং এ পর্যন্ত আর ফিরে আসেননি।

প্রথমে দিন দুয়েক আমরা তেমন গ্রাহ্য করিনি।

এ মেসের এমন মৌরসি পাট্টা ছেড়ে ঘনাদা যাবেন কোথায়? ফিরে তাঁকে আসতেই হবে।

কিন্তু দেখতে দেখতে দু-দশ দিনের জায়গায় দু-চার মাস কেটে গেছে, এখন প্রায় বছর ঘুরতে যায়, তবু ঘনাদার ফেরবার নাম নেই।

প্রথম বিস্মিত থেকে আমরা চিন্তিত হয়েছি, তারপর ব্যাকুল হয়ে খোঁজখবর করেছি এবং শেষে, এখন তাঁর ফেরবার সম্ভাবনা সম্বন্ধে হতাশ হয়ে, শিবুর উপর খাপ্পা হয়ে উঠেছি।

কারণ ঘনাদাকে মেস ছাড়া করবার মূলে যদি কেউ থাকে তো সে শিবু।

কী দরকার ছিল বাপু সেই টুপির কথাটা তোলবার?

টেনজিং নোরকে হিলেরির সঙ্গে এভারেস্ট চূড়া জয় করেছেন—সকালের কাগজে খবরটা পড়ে, বসবার ঘরে আমরা গুলতানি করছি। এমন সময় ঘনাদা তাঁর টঙের ঘর থেকে নেমে এলেন।

কী ব্যাপার হে, এত হই-চই কীসের! ঘনাদা তাঁর আরামকেদারায় গা এলিয়ে শিশিরের দিকে হাত বাড়ালেন।

শিশির কৌটো খুলে তাঁকে সিগারেট এগিয়ে দিচ্ছে যথারীতি, হঠাৎ বলে উঠল,—ব্যাপার গুরুতর, ঘনাদা। খবরের কাগজে এখুনি একটা প্রতিবাদ পাঠাতে হবে।

প্রতিবাদ! কেন হে? ঘনাদা সিগারেটটা তখন ধরাচ্ছেন।

প্রতিবাদ নয়! শিবু দস্তুরমতো উত্তেজিত, এ তো জালিয়াতি! এ তো চুরি! এ তো মানহানি!

রহস্যটা আমরাও তখন ধরতে পারিনি। ঘনাদা সিগারেটে প্রথম টানটা দিয়ে এতক্ষণে একটু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মানহানি আবার কার?

আপনার! শিবু বোমাটি ছাড়ল।

আমার! ঘনাদার সিগারেটে দ্বিতীয় টানটা ভাল করে দেওয়া হল না।

হ্যাঁ, আপনার! আমরা প্রতিবাদ করব, নালিশ করব, খেসারত আদায় করব, শিবু ঝড়ের মতো বলে চলল, বলে কিনা এভারেস্টে উঠেছে!

ব্যাপারটা এতক্ষণে আমরা বুঝেছি এবং ঘনাদাকে আড়চোখে দেখে নিয়ে তৈরিও হয়েছি।

গৌরই বোকা সেজে জিজ্ঞাসা করলে, তুমি কি বলতে চাও এভারেস্টে এরা ওঠেনি?

আলবত তা-ই বলতে চাই।শিবু নিজের বাঁ হাতের চেটোর উপরই ডান হাতে ঘুষি মারল।

তোমার এ রকমের সন্দেহের কারণ? শিশির গম্ভীরভাবে শুধদলে।

কারণ? শিবু নাটকীয় ভাবে সকলের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললে,কারণ, টুপি।

টুপি! আমরা যেন আকাশ থেকে পড়লাম।

হ্যাঁ, ঘনাদার টুপি! শিবু ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বললে, এভারেস্টে উঠলে সে টুপি পেত না? আর সে টুপি পেলে এভারেস্টে প্রথম ওঠবার বাহাদুরি আর করত!

ঠিক! ঠিক! আমরা সবাই সায় দিলাম, কাগজে এখুনি ঘনাদার নাম দিয়ে একটা চিঠি পাঠাতে হবে। আমরাই লিখে দিচ্ছি, ঘনাদার শুধু একটা সই!

ঘনাদার সিগারেটে তৃতীয় টান আর দেওয়া হল না। তিনি আরামকেদারা থেকে কী একটা কাজের নাম করে উঠে পড়লেন। সেই যে উঠে বেরিয়ে গেলেন, আর যে ফিরবেন কখন কী জানি।

ঘনাদার অভাবে মেস আমাদের অন্ধকার।

আড্ডায় এসে আমরা বসি, বিরস মুখে এক এক করে, আবার উঠে যাই। কিছুই আর জমে না।

হঠাৎ সেদিন সন্ধ্যায় এই ঢিমে আসর একটু চঞ্চল হয়ে উঠল। ঘনাদার তেতলার ঘরখানা এ পর্যন্ত খালিই আছে। প্রথমে নিজেদের গরজে আমরা কাউকে সেখানে ঢুকতে দিইনি।

কিন্তু গত দু-এক মাস ধরে মেসের অন্য বোর্ডারদের মুখ চেয়ে নিজেদের জেদ ছেড়ে দিতে হয়েছে। ঘনাদার আসবার কোনও ভরসাই নাই। মেসের ক্ষতি করে কতদিন একটা ঘর আটকে রাখা যায়? এখনও কেউ ঘর দখল করেনি, তবে লোকে। আসা-যাওয়া করছে।

কিন্তু হঠাৎ ওপরের সেই ঘরে কীসের শব্দ? জিনিসপত্র নাড়ার না? পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ির পর শিবুই আগে বারান্দায় গিয়ে একবার ওপরে উঁকি দিয়ে এল। হাঁ, ওপরের ঘরে আলো জ্বলছে।

কাউকে আর কিছু বলতে হল না। হুড়মুড় করে সবাই একসঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে গিয়ে উঠলাম।

ঢোকবার আগেই ঘরের ভেতর থেকে ডাক এল, আসুন, আসুন!

ঘরের চৌকাঠেই থমকে দাঁড়ালাম সবাই। ইনি তো ঘনাদা নন!

আসুন, আসুন, ভেতরে আসুন। ভদ্রলোক অমায়িক। ঘনাদা রোগা লম্বা শুকনো, ইনি মোটা বেঁটে এবং দিব্য গোলগাল। কিন্তু তবু কোথায় যেন মিল আছে! সে মিল ভাল করেই কিছুক্ষণ পরে টের পেলুম, কিন্তু তখন দরজায় আমাদের অবস্থা ন যযৌ ন তস্থৌ।

আমতা আমতা করে বললাম, না, ভেতরে আর যাব না। আমরা আসি।

আসবেন কী! বিলক্ষণ! ছুটোছুটি করে এসে দরজা থেকেই ফিরে যাবেন!

ব্যাপারটা একটু বিসদৃশই বটে। এসে যদি চলে যাই তা হলে এত হন্তদন্ত হয়ে আসবার মানেটা কী! তবু কাঁচুমাচু হয়ে বোঝাবার একটু চেষ্টা করলাম, না, মানে আমরা ভেবেছিলাম–আমাদের ঘনাদা এ-ঘরে থাকতেন কিনা!

ঘনাদা! ভদ্রলোক যেন চিন্তিত।

আমরা বুঝিয়ে বললাম, হাঁ, নাম ঘনশ্যাম দাস। এই মেসে অনেকদিন ধরে ছিলেন কিনা—

হঠাৎ হো হো হাসিতে আমরা চমকে উঠলাম।

ভদ্রলোক বেশ কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে তারপর বললেন, ঘণ্টা!

ঘণ্টা! আমরা তাজ্জব।

হাঁ, হাঁ, আমাদের ঘণ্টা!ভদ্রলোক এবার আরও একটু বিশদ হলেন, আপনারা যাকে ঘনাদা বলতেন সেই হল আমাদের ঘণ্টা। হাঁ মনে পড়েছে বটে, ঘণ্টা এই রকম একটা মেসে কোথায় থাকত বলেছিল। তারপর গল্প-টল্পও দু-চারটে শুনেছি।

আপনি ঘনাদাকে চিনতেন? আমরা উদগ্রীব।

চিনতাম বই কী! ভদ্রলোক হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, কিন্তু ঘণ্টা তো আর ফিরবে না।

ফিরবে না! কেন? আমরা ঘরের ভিতর তখন ঢুকে পড়েছি।

কানের প্লাগ খুলে গেল যে!

কানের প্লাগ! খালি তক্তপোশটায় কখন সবাই বসে পড়েছি টেরও পাই নাই। ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, কানের প্লাগ খুলে গেল মানে।

মানে? মানে বোঝাতে অনেক দূর যেতে হবে।ভদ্রলোক চিবুক ও বুকের মাঝে অদৃশ্য গলাটায় হাত বুলিয়ে কড়িকাঠের দিকে মুখ তুলে অনেক দূরেই যেন দৃষ্টি মেলে শুরু করলেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে। এদিকে ইংরেজ-মার্কিন, ওদিকে রুশ, কে আগে বার্লিন দখল করবে তার পাল্লায় রুশদের জিত হয়েছে। বার্লিন একটা ধ্বংস-পুরী। ইংরেজ মার্কিনের বোমা আর রুশদের গোলায় শহর গুড়ো হয়ে যে ধুলো উড়েছে আকাশে, তাই তখনও থিতোয়নি। দিনের বেলাতেই যেন ঝাপসা কুয়াশায় অন্ধকার। ভয়ে ভয়ে পথ চলতে হয়, কোথাও কোনও নড়বড়ে ছাদ কি দেওয়াল মাথায় ভেঙে পড়ে তার ঠিক নেই।

কাইজার উইলহেল্ম স্ট্রাস—চমকে উঠবেন না, ওটা রাস্তার নাম—তা থেকে বেঁকে একটা সরু গলি রাস্তায় চলেছি সেদিন, এমন সময় চমকে উঠলাম!

দাদা।

কাতর ডাকটা আমার পেছন থেকেই, কিন্তু চমকালাম—আওয়াজ শুনে নয়, এই দাঁতভাঙা ভাষার দেশে দাদা বলে বাংলায় কে ডাকতে পারে তা-ই ভেবে।

ফিরে তাকিয়ে দেখি আমাদের ঘণ্টা। অকাজে বেপোট জায়গায় বেঘোরে পড়তে তার জুড়ি নাই। বিরক্ত হয়েই বললাম, তুমি আবার এখানে কোথা থেকে হে।

ঘণ্টা ছুটে এসে আমার হাত দুটো বাড়িয়ে ধরে বললে, সব কথা পরে বলব দাদা, এখন আমায় বাঁচাও।

দিব্যি বেঁচেই তো আছো দেখছি, বাঁচাব আর কী? বলে বিদ্রুপ করে আবার মায়াও হল একটু। বললাম, কী ফ্যাসাদ আবার বাধিয়েছ শুনি।

ঘণ্টা কিছু বলবার আগেই হঠাৎ বড় রাস্তার দিকে মেশিন-গান পটপটিয়ে উঠল। চোখের পলক পড়তে না পড়তে ঘণ্টা আর সেখানে নাই। এক দৌড়ে রাস্তার ধারে এক বোমা-ভাঙা বাড়ির শুকনো এক চৌবাচ্চায় গিয়ে তখন সেঁধিয়েছে। সেখানে গিয়ে ধরতেই কাঁপতে কাঁপতে বললে, ফ্যাসাদ দাদা ওই।

অবাক হয়ে বললাম, আরে, ও তো বেওয়ারিশ বাড়ি-ঘর পেয়ে যুদ্ধের গোলমালে যারা লুটপাটের ফিকিরে আছে তাদের রুশ সান্ত্রীরা গুলি করছে। তোমার ওতে ভয়টা কীসের?

ভয়টা কীসের তো বলে দিলে! আমার চেহারাটা কি লুটেরার বদলে দেবদূতের মতো যে, সান্ত্রীরা আমায় ছেড়ে কথা কইবে।

ঘণ্টার কাঁদুনি শুনে হাসিই পেল একটু, বললাম, চেহারা তোমার যা-ই হোক না, মিলিটারি পাস তো আছে।

হাঁ, মিলিটারি পাস! আমি কি রুজভেল্ট চার্চিলের ইয়ার, না স্টালিনের দোস্ত যে মিলিটারি পাস পাব! প্রাণটা নিয়ে ইদুরের মতো এই ক-দিন বার্লিন শহরে লুকোবার গর্ত খুঁজে ছুটোছুটি করছি। কখন ধরা পড়ি কে জানে?

এবার পিঠ চাপড়ে তাকে সাহস দিয়ে বললাম, আচ্ছা ভয় নাই, মিলিটারি পাসের ব্যবস্থা তোমায় করে দেব।কিন্তু মরতে এই শহরে এমন সময় কেন এসেছিলে বলো তো?

ভরসা পেয়ে ঘণ্টা তখন একটু চাঙ্গা হয়েছে। বললে, বেশি কিছু নয়, দাদা একটা হিসাবের কল। তার একটা সুলুক সন্ধান নিয়ে যেতে পারলেই মোটা বকশিশ পেতাম। কিন্তু কারিগর সমেত সেকল এখন রুশদের গোলায় কোন পাতালে চাপা পড়েছে কে জানে!

না হেসে আর পারলাম না। বললাম, সাগর ডিঙোতে তোমার মতো ব্যাঙকে যারা পাঠিয়েছে তাদেরও বলিহারি! আরে, ওটা সামান্য হিসাবের কল নয়, পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য ইলেকট্রোনিক ব্রেন, আর ও যন্ত্র যিনি তৈরি করে বিজ্ঞানের জগতে যুগান্তর এনেছেন তাঁর নাম হল ড. বেনার। ওদিকে মিত্রশক্তি আর এদিকে রাশিয়া তাঁকে পাবার জন্য অর্ধেক রাজত্ব এখুনি দিতে প্রস্তুত। কিন্তু পাবে কোথায়? সে গুড়ে বালি! ড. বেনার মারাও যাননি, তাঁর যন্ত্রও কোথাও চাপা পড়েনি। মিত্রশক্তি যেদিন নরম্যান্ডির কূলে নেমেছে, তিনটে স্পরকেল সাবমেরিনে তাঁর যন্ত্রপাতি সাজসরঞ্জাম চড়িয়ে সেদিনই তিনি উধাও।

হতভম্ব হয়ে ঘণ্টা এবার শুধােলে, এত কথা তুমি জানলে কী করে, দাদা?

কী উত্তর আর দেব। হেসে বললাম, এই বার্লিন শহরে ঘাস কাটতে কি অলিগলি ঘুরে বেড়াচ্ছি মনে করো?

ঘনাদার দাদা সত্যিই একটু হেসে এবার থামলেন। বদ অভ্যাস যাবে কোথায়? শিশির সিগারেটের টিনটা আপনা থেকেই তখন বাড়িয়ে দিয়েছে। দাদা কিন্তু সেটিকে মোলায়েম ভাবে প্রত্যাখ্যান করে প্রকাণ্ড এক ডিবে থেকে সশব্দে এক টিপ নস্যি নিয়ে নাক মুছলেন।

ড. বেনারকে তারপর আর পাওয়া গেছে? গৌরের আর তর সইছে না। আমাদেরও অবশ্য তাই।

বলছি, সবই বলছি। কিন্তু তার আগে ড. বেনারের যন্ত্রটার একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। বড় বড় অফিসের ক্যালকুলেটিং মেশিন দেখেছেন, দু ঘণ্টার অঙ্ক দু সেকেন্ডে সব কষে দেয়? গাঁয়ের কামারশালের সঙ্গে টাটার কারখানার যা তফাত, এই ক্যালকুলেটিং মেশিনের সঙ্গে ড. বেনারের ইলেকট্রোনিক ব্রেনের তা-ই। সাত-সাতটা অঙ্কের শুভঙ্কর সাত বছরে যে-অঙ্কের শেষ পায় না, ভূতুড়ে যন্ত্র তা সাত সেকেন্ডে কষে দিতে তো পারেই, তা ছাড়া কী যে পারে না—তা-ই বলাই শক্ত। মিত্রশক্তি আর রাশিয়া হন্যে হয়ে ড. বেনারকে এই জন্যেই খুঁজেছে। বিজ্ঞানের যত আশ্চর্য আবিষ্কার, তত সূক্ষ্ম জটিল তার অঙ্ক। ড. বেনারের ভূতুড়ে যন্ত্র যারা দখলে পাবে অন্য পক্ষকে তাঁরা পাঁচশো বছর পিছিয়ে ফেলে যেতে পারবে।

কিন্তু কোথায় ড. বেনার, আর কোথায় তাঁর ভূতুড়ে কলের মাথা?

যুদ্ধ শেষ হল। গলায় গলায় যাদের ভাব, তারা আদায় কাঁচকলায় গিয়ে পৌছোল। দু দলের চর-গুপ্তচরেরা দুনিয়া তোলপাড় করে ফেললে, কিন্তু ড. বেনার নিপাত্তা। অতলান্তিকের তলাতেই কোথাও স্পরকেল ড়ুবোজাহাজগুলি সমেত তিনি ড়ুবেছেন, এই ধারণাই শেষ পর্যন্ত সকলের হত, যদি না…

ঘনাদার দাদা একটু থেমে আমাদের অবস্থাটা একটু লক্ষ করে নিয়ে আবার শুরু করলেন, যদি না নরওয়ের ক-টা তিমি ধরা জাহাজ পর পর অমন নিখোঁজ হত।

আজকালকার তিমিরা জাহাজ তো তখনকার পালতোলা মোচার ভোলা নয়, সে জাহাজকে জাহাজ, আবার কারখানাকে কারখানা। আস্ত তিমি ধরে গালে পরে তেল-চর্বি থেকে ছাল চামড়া হাড় মাংস সব সেখানে আলাদা করে বার করবার বন্দোবস্ত আছে। তার হারপুন কামান যেমন আছে, বেতারযন্ত্র আছে তেমনই বিপদে পড়লে খবর পাঠাবার। সেরকম জাহাজ নেহাত চুপিসারে টুপ করে ড়ুবতে পারে না, একটু কান্নাকাটি শোনা যাবেই।

ব্যাপারটা কী, জানবার জন্যে কেঁচো খুঁড়তে একেবারে গোখরোর গর্তে গিয়ে পৌঁছোলাম। ব্যাফিন আইল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ফ্রবিশার বে, সেইখানে ছোট এক বেনামি দ্বীপ। ভাড়া করা একটা মোটর লঞ্চে সেখানে যখন গিয়ে উঠলাম তখন গভীর রাত।

রাত অবশ্য সেখানে মাসখানেক ধরেই গভীর। উত্তর মেরুর কাছাকাছি জায়গা তো! একটা দিনরাতেই প্রায় বছর কেটে যায়।

একটা সরু খাঁড়ির মধ্যে মোটর লঞ্চ ঢুকিয়ে নামলাম তো বটে, কিন্তু সেই আবছা অন্ধকারের রাজ্যে বরফ-ঢাকা পাথুরে জায়গায় দু-পা গিয়েই ঘণ্টা আর যেতে চায় না। ঘণ্টা সেই থেকে সঙ্গে আছে বলা বাহুল্য।

ঘণ্টাকে বোঝাব কী? নিজেরই তখন কেমন অস্বস্তি হচ্ছে, দুনিয়ার হেন বিপদ নেই যাতে পড়িনি। কিন্তু এ যেন সব কিছু থেকে আলাদা ব্যাপার! ভয়ংকর একটা আতঙ্কই যেন আবছা অন্ধকার হয়ে চারিদিকে ছমছম করছে, আকাশ থেকে, মাটির তলা থেকে একটা বুক-গুর-গুর করা ভয়ের কাঁপুনি উঠে সমস্ত শরীর হিম করে দিচ্ছে। কিন্তু তা বলে থামলে তো চলবে না। ঘণ্টাকে ধমক দিতে যাচ্ছি এমন সময় চিৎকার করে উঠল, পালাল! পালাল!

ফিরে দেখি, সত্যি একটা আবছা মূর্তি পাথুরে একটা ঢিবির পাশ থেকে ছুটে আমাদের লঞ্চটায় গিয়ে লাফিয়ে ওঠে আর কি!

তখুনি ছুট, খানিকটা ধস্তাধস্তি! মূর্তিটাকে কাবু করে মাটিতে ফেলতেই সে কাতরে উঠল, ছাড়ো, আমায় ছাড়ো, যদি বাঁচতে চাও তো এখুনি না পালালে নয়!

চোস্ত জার্মান কাতরানি শুনে টর্চটা জ্বেলে তার মুখে ফেলে দেখি, এ কী! এ যে ড. বেনার। কিংবা তাঁর ভূতও বলা যায়। ফ্যাকাশে মুখে যেন রক্ত নেই! শরীরে হাড়ের ওপর শুধু চামড়াটা আঁটা।

অবাক হয়ে গেলাম, ব্যাপার কী ড. বেনার? আপনার খোঁজে যমের এই উত্তর দোরে এলুম, আর আপনি পালাচ্ছেন কেন?

সব বলব, আগে লঞ্চে উঠে বেরিয়ে পড়ো, তারপর।

আমি কিন্তু নাছোড়বান্দা। সব কথা না শুনে নট নড়ন-চ, নট কিচ্ছু।

নিরুপায় হয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ড. বেনার তারপর যা বললেন তা শুনে আমরা থ! দুনিয়ায় এরকম তাজ্জব ব্যাপার কখনও কেউ শোনেনি, কল্পনা পর্যন্ত করেছে কিনা সন্দেহ।

ড. বেনার অতলান্তিকে ডোবেননি, তিনটে সাবমেরিন নিয়ে অনেক ভেবে চিন্তে যমের অরুচি দ্বীপে এসে উঠেছিলেন। যেসব লোকজন সঙ্গে এনেছিলেন তাদের দিয়ে কয়েক বছর ধরে ধীরে ধীরে তিনি তাঁর আশ্চর্য কলের মাথা তারপর। বসিয়েছেন। এমন সব উন্নতি তারপর সে কলের করেছেন যে, জার্মানির যে-যন্ত্র তখনই পৃথিবীর বিস্ময় ছিল তা এর কাছে ছেলেখেলা হয়ে গেছে। এই এক দানবীয় কলের মাথা দিয়ে সমস্ত পৃথিবী তিনি জয় করবেন, শাসন করবেন—এই তাঁর জেদ। একলের মাথা শুধু অঙ্ক কষে না, ভাবে, আর যে-কোনও বিষয়ে ভেবে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছোয় তা নির্ভুল। পৃথিবীর সব দিকের সমস্ত বৈজ্ঞানিকের মাথা একত্র করলেও এর তুলনায় তা সমুদ্রের কাছে ডোবা। সৃষ্টি রহস্যের বড়বড় কূটকচাল তো বটেই, ছোটোখাটো তুচ্ছ বিষয়েও তার বুদ্ধির প্যাঁচ একেবারে থ করে দেয়। এই দানবীয় কলের মাথার পরামর্শ পেলে মানুষের সভ্যতা গোরুর গাড়ির তুলনায় একেবারে রকেটে উড়ে এগিয়ে যাবে। শুধু ক-টা কল টিপলেই হল। আলাদিনের পিদিম এর কাছে কিছু নয়।

ড. বেনার হাতে স্বর্গ পেয়ে যখন ধরাকে সরা দেখছেন এমন সময় একদিন বিনা মেঘে বজ্র পড়েছে। ড. বেনার আঁতকে উঠে একদিন টের পেয়েছেন যে, তিনি কলকে নয়, কলই তাঁকে চালাচ্ছে! কল টিপে ভাবালে যে ভাবত সে-যন্ত্র কেমন করে স্বাধীন হয়ে উঠেছে। আর সে স্বাধীনতার মানে কী? নিজের ভাবনা নিজেই শুধু ভাবে না, এমন অদৃশ্য আশ্চর্য শক্তি তার ভেতর জেগেছে যে তাই দিয়ে ধারে কাছে তুচ্ছ মানুষ যারা থাকে, তাদের একেবারে খেলার পুতুল বানিয়ে দেয়। তার সে শক্তির কাছে কারও রেহাই নাই। মানুষ তাকে দিয়ে এতদিন প্রশ্নের উত্তর জেনেছে, এখন সে মানুষকে প্রশ্ন করে তার সবকিছু জানবে, যেমন খুশি চালাবে—এই তার দানবীয় খ্যাপামি। হাতে ছুরি পেলে দুরন্ত ছোট ছেলের যেমন সবকিছু কেটে সুখ, এ যন্ত্রের তেমনই পৈশাচিক বিলাসপ্রশ্ন করায় আর প্রশ্ন শোনায়। সময় যেন তার কাটে না। আর কিছু যখন নেই তখন খালি প্রশ্ন করতে হবে তাকে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন! আর পট পট তার উত্তর দিয়ে তখুনি সে চাইবে আবার প্রশ্ন। জিজ্ঞাসা করবার মতো প্রশ্ন খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে উন্মাদ হয়ে ড. বেনারের সঙ্গীরা একে একে সব শেষ হয়ে গেল। ক-টা তিমি ধরা জাহাজ কী কুক্ষণে এখানে এসে পড়েছিল। তাদের লোক লস্কর সব দুদিনেই কাবার! পালাবার উপায় নাই তার হাত থেকে। অদৃশ্য অজানা শক্তিতে এ দ্বীপের দশ মাইলের মধ্যে যে কেউ আছে, তার কাছে বাঁধা। ড. বেনার তাঁর জীবনের সমস্ত বিষয়ে পাণ্ডিত্য হাটকে কোনও রকমে প্রশ্নের পর প্রশ্ন জুগিয়ে এখনও টিকে ছিলেন, কিন্তু তাঁর সমস্ত পুজিও শেষ। এখুনি না পালালে আর রক্ষা নাই।

সব শুনে জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু অদৃশ্য শক্তিতে যদি বাঁধা হন তা হলে আপনি পালাচ্ছেন কী করে? আমরাই বা কিছু বুঝতে পারছি না কেন?

ড. রে বললেন, নেহাত দৈবাৎ একটা সুযোগ পেয়ে একটা তার আমি আলগা করে দিতে পেরেছি আজ। কলের মাথা তাই খানিকক্ষণের জন্যে বিকল হয়ে আছে। কিন্তু সে বেশিক্ষণ নয়, এখুনি হয়তো শুধরে নিয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

তা হলে উপায়?

উপায় এখুনি লঞ্চ চালিয়ে বেরিয়ে পড়া।

কিন্তু দশ মাইল পার হবার আগেই যদি ওই দানব জেগে উঠে!

তারও একটা উপায় করেছি। ড. বেনার পকেট থেকে ক-টা ছোট ইলেকট্রিক প্লাগের মতো জিনিস বার করে আমাদের হাতে দিয়ে বললেন, শিগগির এইগুলো দু কানে গুঁজে দিন। পরীক্ষা এখনও হয়নি, তবে আমার ধারণা—কলের মাথার অদৃশ্য শক্তি কানের ভেতর দিয়েই আমাদের মগজে হুকুম চালায়। আমার গোপনে তৈরি এ-প্লাগ সে-শক্তিকে খানিকটা ক্ষীণ করে দিতে পারবে।

মোক্ষম সময়েই প্লাগের ঠুলি দুটো হাতে পেয়েছিলাম। শরীরে হেঁচকা টানে যেমন হয় হঠাৎ মাথায় ঠিক তেমনই একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়েই বুঝলাম দৈত্য-মাথা জেগেছেন। তৎক্ষণাৎ ঠুলি দুটো দুকানে গুঁজলাম। কিন্তু ঠুলিতে কি আটকায়! মনে হল কে যেন আমার মগজে ভর করে প্রাণপণে আমায় কোথায় টানছে। ঠুলির দরুন টানটা একটু কম—এই যা।

পড়ি কি মরি তিনজনে লঞ্চে গিয়ে উঠে ইঞ্জিন চালিয়ে দিলাম। কানের ঠুলি যেন অদৃশ্য টানে ফেটে বেরিয়ে যাবে।

লঞ্চ তখন চলেছে এই ভাগ্যি। কিন্তু আহাম্মকের মরণ যাবে কোথায়? কানের যন্ত্রণাতেই বোধহয় ঘণ্টা একটা কানের ঠুলি একবার একটু খুলতেই—আর দেখতে হল না! ধর, ধর করতে করতে ঘণ্টা লঞ্চ থেকে জলে লাফিয়ে পড়ল। আমাদের

লঞ্চ তখন তীরবেগে বার-দরিয়াই চলেছে। ঘণ্টার সঙ্গে সেই শেষ দেখা।

হঠাৎ কাশির শব্দে আমরা ফিরে তাকিয়ে একেবারে থ।

আমরা যদি থ হয়ে থাকি তো আমাদের নতুন দাদা একেবারে হাড়গোড় ভাঙা দ।

কোনও রকমে শুকনো গলায় ঢোঁক গিলে বললেন, এ কী! ঘন্—মানে ঘনশ্যাম তুমি কি, কখন এলে?

ঘনাদার মুখে কোনও ভাবান্তর নেই। গম্ভীরভাবে বললেন, তা এসেছি অনেকক্ষণ।

কিন্তু তুমি তো…,নতুন দাদার কথাটা আর শেষ হল না।

ঘনাদা বললেন, হ্যাঁ, অক্ষত শরীরেই ফিরে এসেছি কাজ শেষ করে।

কী করে, ঘনাদা? কেমন করে? আমরা এক সঙ্গেই বোধহয় চেঁচিয়ে উঠলাম।

ঘরে তক্তপোশ ছাড়া আর বসবার জায়গা নেই। তারই একধারে বসে শিশিরের এগিয়ে দেওয়া টিনটা থেকে একটা সিগারেট নিয়ে হাতের ওপর ঠুকতে ঠুকতে ঘনাদা তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন, অত অবাক হবার কী আছে! এমন শক্ত ব্যাপার তো কিছু নয়। তাকে স্রেফ একটি প্রশ্ন গিয়ে করলাম : ব্যস, তাতেই খতম।

কী প্রশ্ন, ঘনাদা?

ঘনাদা বললেন, প্রশ্ন আর কী! জিজ্ঞাসা করলাম—গাছ আগে, না বীজ আগে? সে তা-ই ভাবছে, ভাবতে ভাবতে এতদিনে শেষও হয়ে গেছে বোধহয়।

হঠাৎ জোর করে ঘনাদার পায়ের ধুলো নিয়ে আমাদের নতুন দাদা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *