১. ব্যাপারটা ঘটিয়া গেল
ব্যাপারটা ঘটিয়া গেল অবিশ্বাস্য অদ্ভুত।
হেমপ্রভা নিজেও ঠিক এতটা কল্পনা করেন নাই, কিন্তু ঘটিল। পাড়ার গৃহিণীরা বলিতে লাগিলেন–”ভগবানের খেলা”, “ভবিতব্য”! ভট্টাচার্য মহাশয় ভীত চিন্তিত হেমপ্রভাকে আশ্বাস আর অভয় দিয়া বলিলেন–বিধাতার নির্দিষ্ট বিধান! আমরা তো নিমিত্ত মাত্র মা!
কিন্তু এতখানি সারালো তত্ত্বকথার ভরসা সত্ত্বেও কোন ভরসা খুঁজিয়া পান না হেমপ্রভা। ছেলেকে গিয়া মুখ দেখাইবেন কোন্ মুখে? শুধুই কি ছেলে? তার উপরওয়ালা? মণীন্দ্র যদি বা কোনদিন মাকে ক্ষমা করিতে পারে, চিত্রলেখা কি কখনও শাশুড়ীকে ক্ষমা করিবে?
গোড়ার কথা এই–
ছেলে বৌ নাতি-নাতনীদের লইয়া একবার দেশের জমিদারিতে যাইবার শখ হেমপ্রভার অনেকদিনের, কিন্তু সাহেব ছেলের ইচ্ছা যদি বা কখনো হয়–ফুরসৎ আর হয় না, এবং সাহেব স্বামীর যোগ্য সহধর্মিণী চিত্রলেখার ইচ্ছা-ফুরসৎ কোনটাই হইয়া ওঠে না। বছরের পর বছর ঘুরিতে থাকে, মণীন্দ্র পূজার ছুটিতে পশ্চিম আর গ্রীষ্মের বন্ধে উত্তরে বেড়াইতে যান, হেমপ্রভার প্রস্তাবটা মুলতুবীই থাকে।
আসল কথা–বিষয়সম্পত্তি বা জমিদারি নামক বস্তুটার উপর কেমন একটা বিদ্বেষ ভাব ছিল মণীন্দ্রর, দেখাশোনা করা তো দূরের কথা, মায়ের খাতিরে একবার বেড়াইতে যাইতেও যেন রুচি হয় না। গুরুজনের সম্বন্ধে–তবু মণীন্দ্রর স্ত্রৈণ পিতা যে যথাসর্বস্ব স্ত্রীর নামে উৎসর্গ করিয়া দিয়া মণীন্দ্রকে মা’র মুখাপেক্ষী করিয়া রাখিয়া গিয়াছেন, এই অন্যায় ব্যাপারটা আর কিছুতেই . বরদাস্ত করিয়া উঠিতে পারেন না মণীন্দ্র, বিষয়ের সমস্ত উপস্বত্বটা নিজের সংসারে ব্যয় হওয়া। সত্ত্বেও নয়।
বাপের জমিদারির টাকা লইতে গেলে মায়ের সই লওয়া ছাড়া উপায় থাকে না এটা তো শুধু বিরক্তিকরই নয়, অপমানকরও বটে। অবশ্য বাপের বিষয়ের সুবিধাটুকু না থাকিলে যে দিন চলা ভার হইত এমন নয়, নিজের উপার্জনে যথেষ্ট ভদ্রভাবেই চলিয়া যায়, কিন্তু হেমপ্রভারই বা জগতে আছে কে? ‘মা’র টাকা লইব না বলিলে যে রীতিমত ঝগড়ার কথা হয়। কাজেই জীবনযাত্রার মানদণ্ড শুধু ভদ্রভাবে কাটানো’র অনেক ঊর্ধ্বেই উঠিয়া আছে। বিলাসিতার তো আর সীমারেখা নাই!
তাছাড়া চিত্রলেখা যা বলে সেটাও তো মিথ্যা নয়। জমিদারিটা মণীন্দ্রর বাপের জিনিস, তাতে তো আর ভুল নাই! কাজেই টাকাটা খরচ করিতে বিবেকে তেমন বাধে না, কিন্তু তদারক-তল্লাস করিতে রুচিতে বাধে।
হেমপ্রভাই বছরে তিনবার ছুটাছুটি করেন। বরাবরের জন্য যে দেশের বাড়িতে বাস করিতে পারেন না, সেটা শুধু নাতি-পুতির মমতাতেই নয়, ম্যালেরিয়া দেবীর নির্মমতার জন্যও বটে। যাই হোক, এবার গ্রীষ্মের বন্ধে অনেক দিনের সাধটা মিটিল হেমপ্রভার। জেদ ধরিল–চিত্ৰলেখারই ছেলেমেয়ে।
গ্রীষ্মের বন্ধের পূর্ব হইতেই তাহারা জোর গলায় বলিয়া বেড়াইতে লাগিল–আমরা এবার দেশে যাব।
চিত্রলেখা বিরক্ত হইয়া বলে–তা আর নয়? “দেশে যাব!” এই প্রচণ্ড গরমে দেশে গিয়ে মারা পড়া চাই যে!
যদিও মেয়ে তাপসীই বড়, তবু যুক্তি-তর্কের ধার অমিতাভর বেশী। সে বয়স ছাড়া বিজ্ঞ ভাব দেখাইয়া বলে–দেশে গিয়ে মারা পড়ব মানে কি? নানি’ যে প্রত্যেক বছর যান, কই মারা পড়েন না তো?
‘ঠাকুমা’ শব্দটি নেহাৎ সেকেলে বলিয়া চিত্রলেখা ‘নানি’ শব্দটা আবিষ্কার করিয়াছিল। …ছেলের এই ভেঁপোমিতে জ্বলিয়া উঠিয়া চিত্রলেখা বলে–ওঁর যা সয়, তোমাদের তা সইবে? উনি যে এই গরমে গিয়ে কতকগুলো আম কাঁঠাল খেয়ে দিব্যি হজম করেন, তোমরা পারবে তা?
–পারবই তো! অমিতাভর ছোট সিদ্ধার্থ সোৎসাহে বলে–আম খেতেই যাব যে আমরা। নানি বলেছেন আমাদের নিজেদের বাগান আছে, অনেক অনেক গাছ। দাদু মানে বাবার বাবা, নিজে হাতে করে কত গাছ পুঁতেছেন–দেখব না বুঝি? বা!
চিত্রলেখার বুঝিতে বাকি রহিল না হেমপ্রভা এবার চালাকি খেলিয়াছেন। এইসব সরলমতি বালক-বালিকারা যে নানি’র কুমন্ত্রণার প্রভাবেই বিপথগামী হইতে বসিয়াছে, এ বিষয়ে আর সন্দেহমাত্র থাকে না চিত্রলেখার।
রাগে সর্বাঙ্গ জ্বালা করে তার, চড়া গলায় ঝজিয়া বলে–আমি বলে দিচ্ছি এ সময় যাওয়া হতে পারে না কিছুতেই না। ব্যস্–এ বিষয়ে আর কোনো আলোচনা যেন ওঠে না কোনদিন।
এবার সুর ধরে তাপসী, মেয়েলী আবদারের সুরে বলে–বা-রে, আমরা বলে সব ঠিক করে ফেলেছি
–সব ঠিক করে ফেলেছ? চমৎকার! কিন্তু আমি জানতে চাই এ বাড়ীর কত্রী কে? তোমরা আমি?
তাপসী ভয় খাইয়া চুপ করিয়া যায়, কিন্তু অমিতাভ তাহার বদলে চটপট উত্তর দেয়–তাই বলে বুঝি আমরা নিজের ইচ্ছেয় কিছু করতে পাব না? দেশ-টেশ চিনতে হবে না আমাকে?
–কেন, চিনে কি স্বর্গের সিঁড়ি তৈরি হবে শুনি?
–স্বর্গের সিঁড়ি আবার কি, নানি বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন না? আমাকেই এরপর খাজনা-টাজনা। আদায় করতে হবে তো? প্রজারা আমাকে ‘বাবুমশাই’ বলবে দেখো তখন!
চিত্রলেখার রাগে আর বাক্যস্ফূর্তি হয় না। শাশুড়ীর কুটিল চাল দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া যায় বেচারা। এমনিতেই তো তার বরাবর সন্দেহ, শাশুড়ী ছেলেমেয়েগুলি পর করিয়া লইতেছেন। আধুনিকার রঙিন খোলস খুলিয়া ঈর্ষার চেহারা অনেক ক্ষেত্রেই ধরা পড়ে, কিন্তু এবার যে হেমপ্রভা চিত্রলেখার কল্পনার উপরে উঠিয়াছেন! ছেলেদের মন ভাঙাইবার জন্য আরও কি কি লোভনীয় দৃশ্যের অবতারণা করিয়াছেন তিনি, সেটা আর শুনিবার ধৈর্য থাকে না।
বীরদর্পে স্বামী নামক পোষা প্রাণীটির উদ্দেশ্যে ধাবিত হয়। যদিও মণীন্দ্র সব বিষয়েই। চিত্রলেখার রীতিমত অনুগত, সাদাকে কালো এবং কালোকে সাদা বলিতেও আপত্তি দেখা যায় না তার–যদি চিত্রলেখা সন্তুষ্ট থাকে–কিন্তু এক্ষেত্রে হঠাৎ এমন একটা কথা বলিয়া বসিলেন। যেটা সম্পূর্ণ বেসুরো। বলিলেন–কিন্তু সত্যি এত যখন ইচ্ছে হয়েছে ওদের হয় গেলই!
তিন ছেলেমেয়ে যে এইমাত্র অনেক হতাশামোদের ঘুষ দিয়া উকিল লাগাইয়া গিয়াছে। তাঁকে–সেটা আর প্রকাশ করেন না।
চিত্রলেখা অবাক হইয়া বলে–না হয় গেলই! তোমাকে মাথার চিকিৎসা করানো বিশেষ দরকার হয়েছে দেখছি। এই গরমে ওরা যাবে সেই পচা পুকুরে চান করতে?
মণীন্দ্র হাসিয়া ফেলিয়া বলেন–পচা পুকুরে চান করতেই বা যাবে কেন? আর মা তাই করতে দেবেন কেন? তবে গরম যদি বল–বাঙলা দেশের পাড়াগাঁ খুব যে–
–থাক হয়েছে, তোমাকে আর পল্লীগ্রামের হয়ে ওকালতি করতে হবে না, কিন্তু হঠাৎ তোমার ছেলেমেয়েদের এত দেশ-প্রেম উথলে উঠল কেন, সে খোঁজ রেখেছ?
মণীন্দ্র উড়াইয়া দিবার ভঙ্গীতে বলিলেন–ছেলেমানুষের আবার কারণ-অকারণ, মা’র মুখে গল্প-টল্প শুনে থাকবে হয়তো
–থাক যথেষ্ট হয়েছে, তুমি আর বালক সেজো না। কিন্তু আমি এই বলে রাখছি, আমার ছেলেমেয়েদের কানের কাছে দিনরাত ওই সব বিষমন্তর ঝাড়তে দেব না আমি। ছেলেরা আজকাল আমাকে গ্রাহ্য করে না তা জানো?
-ওটা এ বংশের ধারা, বুঝলে? বলিয়া মণীন্দ্র হাসিতে থাকেন।
এরকম ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় কার না গা জ্বালা করে?
চিত্রলেখা বিরক্তভাবে বলে–তোমাদের বংশের ধারা শোনবার মত সময় আমার নেই, কিন্তু জেনো–ছেলেমেয়েদের অসুখ করলে সে দায়িত্ব তোমার আর তোমার অপরিণামদর্শী মা’র।
–ছি ছি, অসুখ করবে কেন?
–না, অসুখ করবে কেন! চিত্রলেখা বিদ্রূপহাস্যে মুখ বাঁকাইয়া বলে–বাগানের আম খেয়ে মোটা হয়ে আসবে।
–আমের কথা যদি বললে–মণীন্দ্র হাসিতে হাসিতে বলেন–ছেলেবেলায় আমিও খুব…ও তুমি বুঝি আবার ওসব পেঁয়োমি পছন্দ করো না? তবে সত্যি, এ সময় মোটা হয়ে যেতাম।
–বেশ তো, তুমিই বা বাকি থাকো কেন? যাও না অমন দাওয়াই রয়েছে যখন, আমাকে সেজকাকার কাছে মুসৌরী পাঠিয়ে দিয়ে চলে যেও। টনিকের বদলে আম-কাঁঠাল-মন্দ কি?
মণীন্দ্র সন্ধির সূরে বলেন–এটা তোমার রাগের কথা, কিন্তু একবার সকলে মিলে দেশে গেলেই বা মন্দ কি চিত্রা?
সত্য বলিতে কি, ছেলেমেয়েদের উৎসাহের বাতাসে মনের মধ্যে কোথায় একটু স্নিগ্ধ সুর বাজিতেছিল, মায়ের জন্য একটু সহানুভূতি। কিন্তু চিত্রলেখা কি ধার ধারে এ সুরের?
–সকলে মিলে মেন্টাল হসপিটালে গেলেই বা মন্দ কি? বলিয়া বিদ্রূপ হাস্যে মুখ ঘুরাইয়া উঠিয়া যায় চিত্রলেখা।
মণীন্দ্র নিঃসন্দেহ হন। মুসৌরীই তাহাকে যাইতে হইবে। চিত্রলেখার পূজনীয় সেজকাকার আশ্রয়ে না হোক, কাছাকাছি। কারণ চিত্রলেখার বাপের বাড়িতে এই সেজকাকাটির কাছে আর সকলেই নিষ্প্রভ, তাই জ্যোতি যদি বিকীর্ণ করিতেই হয় তবে সেজকাকীমার চোখের উপর করিতে পারাই চিত্রলেখার পক্ষে চরম সুখ।
ছেলেমেয়েদের জন্য একটু মন কেমন করে মণীন্দ্রর। এত উৎসাহে জল ঢালিয়া দিবেন? তাছাড়া ছুটিতে বেড়াইতে গিয়া ‘সেজকাকাদের বাড়ির আওতায় থাকা? সেবারে দার্জিলিং গিয়া কি বিড়ম্বনা! উঠিতে বসিতে মায়ের কাছে সেজকাকার বাড়ির আদর্শের খোঁটা খাইতে খাইতে আধখানা রোগা হইয়া গেল ছেলেমেয়েগুলো। মায়ের সেই খুড়তুতো ভাইবোনদের মত কায়মনোবাক্যে সভ্য’ হইবার যোগ্যতা তাদের কই? উপরের খোলসটা খুলিয়া ফেলিলেই আসল চেহারা বাহির হইয়া পড়ে যে– সেজকাকাদের চাইতে হেমপ্রভার সঙ্গেই যার অধিক মিল।
শাশুড়ীর উপর এত বিষদৃষ্টি চিত্রলেখার কি সাধে?
ছেলেমেয়েদের মনের মত করিয়া মানুষ করিবার সাধ যে মিটিল না, হেমপ্রভার জন্যই নয় কি? কুসংস্কার আর কুদৃষ্টান্তের পাহাড় হইয়া বসিয়া আছেন চিত্রলেখার স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রার পথ জুড়িয়া। স্বাস্থ্যটা হেমপ্রভার আবার এমনি অটুট যে দূর-ভবিষ্যতেও কোন আলোকরেখা খুঁজিয়া পায় না চিত্রলেখা, বরং নিজেরই তার বারো মাসে দুইবেলা টনিক না খাইলে চলে না।
নিতান্ত অর্থনৈতিক কারণেই সহিয়া থাকা, তা নয়তো বিধবা মানুষের পক্ষে কাশীর মত উপযুক্ত স্থান আর কোথায়? মনে পড়িলেই স্ত্রৈণ শ্বশুরের উপর মন বিরক্তিতে ভরিয়া যায় চিত্রলেখার।
শেষ পর্যন্ত কিন্তু ছেলেমেয়েদের জেদই বজায় থাকিল।
অবশ্য চিত্রলেখা মুসৌরী চলিয়া গেল। বাধ্য হইয়া মণীন্দ্রকেও যাইতে হইল। না যাইলে যে কি হইতে পারে সে কথা ভাবিবার সাহস মণীন্দ্রর নাই। শুধু মাকে ও ছেলেমেয়েদের পাঠাইয়া দিবার জন্য কয়েকটা দিন পরে গেলেন।
চিত্রলেখার ছেলেমেয়েরা মাকে কতটা ভয় করে আর কতটা ভালবাসে সে বিচার করা সহজ নয়, তবে আপাততঃ দেখা গেল মায়ের অনুপস্থিতিটা তাদের কাছে প্রায় উৎসবের মত। নিজেদের ট্রাঙ্ক সুটকেস গুছাইয়া লওয়ার মধ্যে যে এত আমোদ আছে, একথা কি আগে জানা ছিল? চিত্রলেখা অতটা না চটিলে হয়তো এদিকস্টার তদারক করিয়া যাইত, কিন্তু রাগ-অভিমানের একটা বাহ্যিক প্রকাশ চাই তো!
তাপসী বড়, অতএব ম্যানেজমেন্টের দায়টা তার, সে ভাইদের পোশাক-পরিচ্ছদের বহুবিধ ব্যবস্থা এবং অনেক উপদেশ বর্ষণান্তে পিতার কাছে আসিয়া একটা অদ্ভুত আবদার করিয়া বসিল। মণীন্দ্রর পিতার আমলের একটা পুরানো দেরাজ–যেটা জাতিচ্যুত অবস্থায় ভাঁড়ার ঘরে ঠাঁই পাইয়াছে–তার চাবিটা চাই তাপসীর।
মণীন্দ্র অবাক হইয়া বলেন–কেন বলো তো, ওর চাবি নিয়ে কি করবে তুমি? চাল-ডাল লুকিয়ে রেখে যাবে নাকি? যা গিন্নী হয়ে উঠেছ দেখছি!
তাপসী হাসিয়া বাপের পিঠে মুখ খুঁজিয়া বলে–তাই বই কি? বাঃ! শাড়ী নেব!
–শাড়ী!
–হ্যাঁ বাবা। ওর মধ্যে মা’র ছেলেবেলার অনেক সুন্দর সুন্দর শাড়ী আছে। লাল, সবুজ, কত কি!
–থাকতে পারে, কিন্তু তুমি নিয়ে কি করবে? কাউকে দিতে চাও?
–ইস কাউকে দেব কেন? আমি পরবো।
–তুই শাড়ী পরবি? বিস্ময়ে হতবাক মণীন্দ্র শুধু ওইটুকুই বলিতে পারেন।
–পরলে কি হয়? বা রে! দেশে তো আমার বয়সের মেয়েরা শাড়ী পরে। পরে না? নানি বলেছেন–এত বড় মেয়ে শাড়ী পরলেই মানায়।
বারো বছরের মেয়ের মুখে এ হেন পাকা কথা শুনিয়া মণীন্দ্রর ভারী বিরক্তি লাগে, গম্ভীর স্বরে বলেন–তাপসী!
তাপসী ভয় পাইয়া চুপ করিয়া থাকে।
–শোনো, ওসব পাকামি ছেড়ে দাও, খবরদার যেন এ রকম কথা শুনতে না পাই। জানো, তোমাদের মা তোমাদের ওপর রাগ করে চলে গেছেন, আর তোমরা এমন সব কাজ করতে চাও যা তিনি মোটে পছন্দ করেন না!
ব্যস্, আর কিছু বলিতে হয় না। বড় বড় দুই চোখের কোল বাহিয়া যে জলের ফোঁটাগুলি ঝরিতে থাকে সেগুলি নেহাৎ ছোট নয়। চিরদিনের অভিমানী মেয়ে। চিত্রলেখা এইজন্যই আরও মেয়েকে দেখিতে পারে না। একটিমাত্র মেয়ে হইলেও নয়।
মেয়ে কোথায় চালাক-চতুর, স্মার্ট হইবে, শিশুর মত ছুটাছুটি করিবে, খেলা করিতে আসিয়া মা-বাপের গলা ধরিয়া ঝুলিয়া আদর কাড়াইবেনকল স্বরে কথা কহিবে–তা নয়, কেমন যেন জবুথবু সেকেলে সেকেলে ভাব। শিক্ষা দিতে যাও, কাঁদিয়া ভাসাইয়া দিবে।
এবার অপ্রস্তুত হইবার পালা মণীর। চোখের জল বরদাস্ত করা তাঁর কর্ম নয়। চিত্রলেখার অঞ্চলপ্রান্তে নিজেকে নিঃস্বত্ব হইয়া সঁপিয়া দিবার মূল কারণও হয়তো ওই।
গম্ভীর ভাবটা পাল্টাইয়া তাড়াতাড়ি হাল্কা সুরে বলেন–এই দেখ, একদম নেহাৎ বোকা! নে বাপু যত পারিস শাড়ী নে, দুটো-চারটে একসঙ্গে পরে জগদম্বা ঠাকরুণ হয়ে বসে থাকগে যা। কিন্তু চাবি-টাবি আমি চিনি না তো!
হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছিতে মুছিতে তাপসী ভাঙা গলায় বলে–ছোট আলমারির ড্রয়ারে অনেক চাবি আছে।
–থাকে তো বার করে নাও গে, কিন্তু সাবধান, তোমার মার কাছে যেন কোনদিন এই সব শাড়ী-ফাড়ীর কথা ফাস করে বলে ফেলো না, বুঝলে? সাংঘাতিক চটে যাবেন।
তাপসী ততক্ষণে ছুটিয়াছে। কি জানি–বাবা আবার মত বদলাইয়া বসিলে?
কিন্তু দিশাহারা তাপসী কোন্টা ফেলিয়া কোষ্টা রাখিবে? শাড়ীর স্তূপের মাঝখানে বসিয়া খেই পায় না বেচারা। বর্ণ-সমারোহে চোখ যে ধাঁধিয়া যায়, এর কাছে ফ্রক, ছি!
এমন প্রাণ ভরিয়া দেখিবার সুযোগও তো কখনো মেলে নাই। কালেকস্মিনে চাকর-বাকরে রোদে দিয়া ঝাড়িয়া তুলিয়া রাখে, হাত দিতে গেলে মা’র কাছে বকুনি খাইতে হয়। …এত শাড়ী চিত্রলেখা পরিল কখন?… কে জানে, হয়তো সবগুলো পরাও হয় নাই, হয়তো কোনখানা একবার মাত্র অঙ্গে উঠিয়াছে। সঞ্চয়ের নেশায় শুধু যথেচ্ছ জমা করিয়াছে বসিয়া বসিয়া।
ছেলে-বৌ আসিল না বলিয়া সাময়িক দুঃখপ্রকাশ করিলেও একপক্ষে হেমপ্রভা যেন হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলেন। আসিতে আমন্ত্রণ করিলেও ‘মেমসাহেবের’ ভয়ে চিন্তারও অন্ত ছিল না, তাছাড়া নাতি-নাতনীদের এমন একাধিপত্যে পাওয়ার সুবিধাও তো হয় না কখনো।
আরো একটা কারণ হয়তো লুকানো আছে মনের মধ্যে। কলিকাতার বাড়িতে-হেমপ্রভার যেন পায়ের তলায় মাটি নাই, চিত্রলেখার সংসারে তিনি প্রায় অবাঞ্ছিত আশ্রিতের মত। অবশ্য সব দোষই চিত্রলেখার বলা চলে না, হেমপ্রভার শান্তিপ্রিয় ভীরু স্বভাবেরও দোষ আছে কতকটা। নিজের অর্থ-সামর্থ্যের জোরে রীতিমত দাপটের সঙ্গেই থাকিতে পারিতেন তিনি। পারেন না। ছেলেকে বঞ্চিত করিয়া স্বামী যে তাহাকেই সর্বেসর্বা করিয়া গিয়াছেন, এর জন্য ভিতরে ভিতরে যেন একটি অপরাধ-বোধের পীড়া আছে। হয়তো এতদিনে মণীন্দ্রর নামে দানপত্র লিখিয়া দিতেনও, যদি না চিত্রলেখার স্বভাবের পরিচয় পাইতেন।
যাই হোক কলকাতার বাড়িতে হেমপ্রভা অবান্তর গৌণ। কিন্তু এখানে হেমপ্রভার পায়ের নীচে শক্ত মাটি। শুধু পায়ের নীচে নয়, আশেপাশে অজস্র। এখানে হেমপ্রভাই সর্বেশ্বরী, শিশু হোক তবু ওদের কাছেও দেখাইয়া সুখ আছে- আত্মতৃপ্তি আছে।
ভারি খুশি হইয়াছেন হেমপ্রভা। নাতি-নাতনীদের কাছে নিজের ঐশ্বর্য দেখাইয়া যেমন একটা তৃপ্তি আছে–তেমনি দেশের লোকের কাছে এমন চাঁদের মত নাতি-নাতনীদের দেখাইতে পাওয়াও কম সুখের নয়। এবেলা-ওবেলা ভালো ভালো জামা-কাপড় পরাইয়া বেড়াইতে পাঠান তাহাদের যেখানে নিজের যাওয়া চলে সঙ্গে যান। তাপসী যে বুদ্ধি করিয়া মায়ের রঙিন শাড়ীগুলো আনিয়াছে, এর জন্যও আনন্দের অবধি নাই হেমপ্রভার। শাড়ী না পরিলে মেয়ে মানায়?
এটি তাপসীও বুঝিতে শিখিয়াছে আজকাল। তাই সকালবেলাই চওড়া জরিপাড়ের লাল টুকটুকে একখানা জর্জেট সিল্কের শাড়ী পরিয়া ভাড়ারঘরের দরজায় আসিয়া হাজির।
-নানি, নানি গো, আজকে সেই যে কোথায় মন্দির দেখাতে নিয়ে যাবে বলেছিলে, যাবে?
-ওমা সে তো সন্ধ্যাবেলা, আরতি দেখতে—
বলিয়া মুখ তুলিয়া যেন অবাক হইয়া যান হেমপ্রভা।
সৌন্দর্যের খ্যাতি তাপসীর শৈশবাবধিই আছে বটে, কিন্তু এমন অপূর্ব তো কোনদিন দেখেন নাই! বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী কি হেমপ্রভার দুয়ারে আসিয়া দাঁড়াইলেন নাকি? বৈশাখের ভোরের সদ্যফোঁটা মল্লিকা ফুলের লাবণ্য চুরি করিয়া আনিয়া চুপিচুপি কে কখন মাখাইয়া দিয়া গেল তাপসীর মুখে-চোখে?
এই মেয়েকে চিত্রলেখা বিবিয়ানা ফ্যাশনে শার্ট পায়জামা আর খটখটে জুতা পরাইয়া রাখে! আসিয়া দেখুক একবার! আর একটা কথা ভাবিয়া মৃদু একটা নিঃশ্বাস পড়ে হেমপ্রভার, এই মেয়েকে ওর সাহেব বাপ-মা হয়তো পঁচিশ বছর পর্যন্ত আইবুড়ো রাখিয়া দিবে-পর্বতপ্রমাণ শুকনো পুঁথির বোঝা চাপাইয়া।
কিন্তু এমনটি না হইলে ‘কনে’?
মনে মনে ইহার পাশে একটি সুকুমার কিশোর মূর্তি কল্পনা করিয়া, আনন্দে বেদনায় হেমপ্রভার দুই চোখ সজল হইয়া আসে।
তাপসী ছেলেমানুষ হইলেও এই মুগ্ধদৃষ্টি চিনিতে ভুল করে না, তার লজ্জা ঢাকিতে আরও ছেলেমানুষী সুরে তাড়াতাড়ি বলে-সন্ধ্যেবেলা আবার যাবো নানি, এখন চলো–আমি এত কষ্ট করে সাজলাম!…এত বড় শাড়ীটা কি করে পরেছি বলো তো নানি? হুঁ বাবা, ভেতরে এত টা পাট করে নিয়েছি। ঠিক হয়েছে না?
–খুব ঠিক হয়েছে! হেমপ্রভা দুষ্ট হাসি হাসিয়া বলেন–আমিই হাঁ করে চেয়ে আছি, এরপরে দেখছি নাতজামাই আমার দণ্ডে দণ্ডে মূৰ্ছা যাবে।
সভ্য বধূমাতার অসাক্ষাতে এরকম দুই-একটা সভ্যতা-বহির্ভূত পরিচিত পরিহাস করিতে পাইয়া বাঁচেন হেমপ্রভা।
তাপসীও অবশ্য বকিতে ছাড়ে না–যাও, ভারি অসভ্য–বলিয়া পিতামহীর আরও কাছে সরিয়া আসিয়া দাঁড়ায়।
হেমপ্রভা নাতনীর চিবুক তুলিয়া ধরিয়া আদরের সুরে বলেন–তুই তো বললি যাও’, কিন্তু আমি শুধু তাকিয়ে দেখি আমার এই রাধিকা ঠাকরুণটির জন্যে গোকুলে বসে কোন্ কালাচাঁদ তপস্যা করছে?
–ইস ‘কালাচাঁদ’ বই কি–বলিয়া ছুটিয়া পালায় তাপসী।
হেমপ্রভা স্নেহমুগ্ধ দৃষ্টি মেলিয়া চাহিয়া থাকেন।
বৌমা মেয়েটিকে যত খুকী বানাইয়া রাখিতে চান তত খুকী তাই বলিয়া নাই। এই তো–ঠাট্টাটি তো দিব্য বুঝিয়াছে, উত্তর দিতেও পিছপা নয়। না বুঝিবেই বা কেন, অমন বয়সে যে হেমপ্রভার দুই বৎসর বিবাহ হইয়া গিয়াছে। সুদূর অতীতের বিস্মৃতপ্রায় স্মৃতির ভাণ্ডার হইতে দুই-একটা কথা স্মরণ করিয়া কৌতুকের আভায় প্রৌঢ়া হেমপ্রভার নীরস মুখও সরস দেখায়।
–নানি নানি, দিদিটার কাণ্ড দেখেছ? মিলিটারী ধরনের খাকী সুট পরিয়া বীরত্বব্যঞ্জক ভঙ্গীতে আসিয়া দাঁড়ায় অমিতাভ। অমিতাভর উচিত ছিল তাপসীর দাদা হইয়া জন্মানো। কিন্তু দৈবক্রমে বৎসরখানেক পরে জন্মানোর খেসারৎ-স্বরূপ বাধ্য হইয়া তাপসীকেই ‘দিদি’ বলিতে হয় বটে, কিন্তু ওই পর্যন্তই–আর সব বিষয়ে এই ছিচকাঁদুনে মেয়েটাকে নিতান্ত অপোগণ্ডের সামিলই মনে করে সে।
হেমপ্রভা হাসিয়া বলেন–কি কাণ্ড গো মশাই?
-এই দেখ না সক্কালবেলা কনে-বৌয়ের মত সেজে বসে আছে! এ, লাল শাড়ী আবার মানুষে পরে? মাকে কিন্তু আমি বলে দেব নানি বুঝলে, দিদিটার খালি মেয়েলীপনা! আর ওই রকম গিন্নী বুড়ীর মত জবড়জং হওয়াই ভালো নাকি? জানো নানি, মালি এত ফুল আর মালা দিয়ে গেছে, সেইগুলো দিদি এখন পরছে বসে বসে। রাম রাম!
–রাম রাম বইকি, আসল কথা দিদিকে স্বর্গের পরীর মতন দেখাচ্ছে বলে তোর হিংসে হচ্ছে, বুঝেছি।
কথাটা একেবারে মিথ্যাও নয়, হিংসা না হোক কিছুটা অস্বস্তি হয় বৈকি অমিতাভর। খাটো ফ্রক অথবা ঢিলে পায়জামা শার্ট পরা দিদি তার নিতান্ত নাগালের জিনিস। যে দিদি টফি চকোলেটের ভাগ লইয়া খুনসুড়ি করে, শব্দ প্রতিযোগিতার প্রতিশব্দ লইয়া তর্কাতর্কি করে, পড়ার জায়গায় গোলমাল করার ছুতা ধরিয়া ঝগড়া করে–সে দিদির তবু মানে আছে, কিন্তু শাড়ী-গহনা পরা চুলে ফুলের মালা লাগানো দিদিটা যেন নেহাৎ অর্থহীন, ওর মুখে যে নূতন রং সেটা অমিতাভর অচেনা, তাই উঠিতে বসিতে শাড়ী-গহনার খোঁটায় অস্থির করিয়া তোলে তাপসীকে।
গহনাগুলি অবশ্য পিতামহীর, তবে হেমপ্রভা চিরদিনই রোগা পাতলা মানুষ, আর তাপসী লাবণ্যে ঢলঢল বাড়ন্ত মেয়ে, তাই গায়ে মানাইয়া যায়। বাক্স খুলিয়া সব কিছু বাহির করিয়া দিয়েছেন হেমপ্রভা। দীর্ঘদিনের অবরোধ ভাঙিয়া অলঙ্কারগুলোও যেন মুক্তি পাইয়া বাঁচিয়াছে। এই মুক্তার শেলি আর জড়োয়ার নেকলেস, সোনার বাজুবন্ধ আর হীরার কঙ্কণ, এদের ভিতরে কি লুকানো ছিল প্রাণের সাড়া? হেমপ্রভার সোহাগমঞ্জরিত যৌবনদিনের স্পর্শ মাখানো ছিল ওদের গায়ে? তারই ছোঁয়াচ লাগিয়াছে তাপসীর ঘুমন্ত মনে?
আগেকার দিনে মেয়েদের সম্মান ছিল না–এটা কি যথার্থ? মানিনী প্রিয়াকে অলঙ্কারের উপঢৌকনে তুষ্ট করিয়া পুরুষ যে ধন্য হইত, সে কি নারীর অসম্মান? পুরুষের প্রেমের নিদর্শন বাহিয়া আনিত যে আভরণ, সে কি শৃঙ্খল?
আজকের মেয়েরা অলঙ্কার আভরণ আদায় করে কলহ করিয়া। ছি!
অমিতাভ আর একটু শানানো গলায় বলে–চুপ করে গেলে যে নানি? ভাবছ কি?
–ভাবছি? ভাবছি তোর দিদি যখন কনে বৌ সেজে বসে আছে–তখন দিদির একটা বরের দরকার তো?
–এঃ, ছি ছি ছি! শেম্ শে! দিদি, এই দিদি, শীগগির শুনে যা—
চুলে আটকানো রজনীগন্ধার গোছাটি সাবধানে ঠিক করিতে করিতে তাপসী আসিয়া দাঁড়াইল–যত ইচ্ছে চেঁচাচ্ছিস মানে? মা নেই বলে বুঝি!
–তাই তো! আর নিজে যে মা নেই বলে যত ইচ্ছে সাজছিস! দেখিস বলে দেব মাকে।
ভিতরে ভিতরে সে আতঙ্ক থাকিলেও তাপসী মুখে সাহস প্রকাশ করিয়া বলে–বেশ বলে দিস। কি বলবি শুনি? মেয়েরা যেন শাড়ী পরে না, গয়না পরে না!
–তোর মত তা বলে কেউ ফুলের গয়না পরে না। এ!
অভিমানী তাপসী বেলফুলের মালাগাছটি গলা হইতে খুলিয়া ফেলিতে উদ্যত হইতেই হেমপ্রভা ধরিয়া ফেলেন–দূর পাগলী মেয়ে! ওর কথায় আবার রাগ? বেশ দেখাচ্ছে। চলো এবেলাই যাই বল্লভজীর মন্দিরে। বোশেখী পূর্ণিমা, আজ সারাদিনই গোবিন্দ দর্শনের দিন। কই, সিধু কই?
–ও তো এখনো প্যান্টে বোম লাগাচ্ছে। বুঝলে নানি, মোটেই পারে না ও। কি মজা করে জানো? ভুল ভুল ঘরে বোতাম লাগায় আর টানাটানি করে ঘেমে ওঠে।
–তা ওদের সব চাকর-বাকরে পরিয়ে দেওয়া অভ্যেস, তুই পরিয়ে দিলি নি কেন?
–আমি? আমাকে গায়ে হাত দিতে দিলে তো? আবার বলে কিনা–সর্দারি করতে আসিস না দিদি। অভীর শুনে শুনে শিখেছে, বুঝলে? নিজে এদিকে মস্ত সর্দার হয়ে উঠেছেন বাবু–বলিয়া হাসিতে থাকে তাপসী।
হেমপ্রভা ডাক দেন–সিধুবাবু, আপনার হলো? আসুন শিগগীর, আর বেলা হলে রোদ উঠে যাবে–গরম হবে।
তিন নাতি-নাতনীকে লইয়া বল্লভজীর মন্দিরের উদ্দেশে রওনা হন হেমপ্রভা। কলিকাতায় ভালো মডেলের দামী গাড়ি থাকিলেও, এখানে হেমপ্রভার বাহন একটি পক্ষীরাজ সম্বলিত পালকি গাড়ি। কর্তার আমলে জুড়ি-গাড়ি ছিল, এখন প্রয়োজনও হয় না–পোষায়ও না।
বল্লভজীর মন্দির নূতন।
পাশের গ্রামের জমিদার কান্তি মুখুজ্জের প্রতিষ্ঠিত নূতন বিগ্রহ ‘রাইবল্লভে’র মন্দির। কান্তি মুখুজ্জের পয়সা শুধু জমিদারিতেই নয়–সেটা প্রায় গৌণ ব্যাপার, আসল পয়সা তার কোলিয়ারির।
দেশের লোকে বলে–টাকার গদি পাতিয়া শুইবার মত টাকা নাকি আছে কান্তি মুখুজ্জের। কান্তি মুখুজ্জে নিজে অবশ্য বৈষ্ণবজনোচিত বিনয়ে কথাটা হাসিয়া উড়াইয়া দেন, কিন্তু সদ্ব্যয়ের মাত্রাটা বাড়াইয়া চলেন।
হেমপ্রভাবাহিনী মন্দিরের কাছে আসিয়া দেখেন সমারোহের ব্যাপার। শুধু বৈশাখী পূর্ণিমা নয়–মন্দির-প্রতিষ্ঠার সাংবাৎসরিক উৎসব হিসাবেও বটে রীতিমত ধুমধাম পড়িয়া গিয়াছে। নাটমন্দিরে নহবৎ বসিয়াছে, কীর্তন মণ্ডপে’ ‘চব্বিশপ্রহর’ শুরু হইয়াছে। নৈবেদ্যের ঘরে জনতিনেক বর্ষীয়সী বিধবা রাশীকৃত ফল ও বঁটি লইয়া বাগাইয়া বসিয়াছেন, ফল ফুল ধূপধুনার সম্মিলিত সৌরভে বৈশাখের সকালের স্নিগ্ধ বাতাস যেন থরথর করিতেছে।
এসব অভিজ্ঞতা চিত্রলেখার ছেলেমেয়েদের থাকিবার কথা নয়, মুগ্ধ বিস্ময়ে চারিদিকে চাহিতে চাহিতে তাপসী উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় চুপি চুপি বলে কী সুন্দর নানি! রোজ রোজ আসো না কেন এখানে?
–রোজ? কি করে আসব দিদি, মহাপাপী যে! তা নইলে শেষকালটা তো এইখানেই পড়ে থাকবার কথা আমার। কলকাতায় গিয়ে–
–নানি! নানি! পিছন হইতে সিদ্ধার্থর আনন্দোচ্ছ্বসিত কণ্ঠ বাজিয়া ওঠে–ওই ওদিকে ইয়া বড় একটা কি রয়েছে দেখবে এসো! একটা বুড়ো ভদ্দরলোক বললে– ‘রথ’। রথ কি হয় নানি?
–রথে চড়ে ঠাকুর মাসীর বাড়ি বেড়াতে যান।…কই তুমি ঠাকুরপ্রণাম করলে না?
–ওই যাঃ! ভুলে গিয়েছি বলিয়া প্রায় মিলিটারী কায়দায় দুই হাত কপালে ঠেকাইয়াই সিদ্ধার্থ চঞ্চল স্বরে বলে–বোকার মত খালি ঠাকুর দেখছিস দাদা? রথটা দেখবি চল না! সত্যিকার ঘোড়ার মত ইয়া ইয়া দু’টো ঘোড়া রয়েছে আবার!
এরপর আর অমিতাভকে ঠেকানো শক্ত।
অগত্যা হেমপ্রভাকেও যাইতে হয়।
তাপসী অবশ্য এসব শিশুসুলভ উচ্ছ্বাসে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্তে নিবিষ্ট ভাবে ঠাকুরের দিকে চাহিয়া থাকিবার চেষ্টা করিতেছিল–কিন্তু ‘সত্যিকার ঘোড়া’র আকার বিশিষ্ট কাঠের ঘোড়ার সংবাদে হৃদয়স্পন্দন সুস্থির রাখা কি সহজ কথা?
মন্দিরের পিছনে প্রকাণ্ড চত্বরে নানাবিধ মূর্তিধারিণী “রাসের সখী” ও সুউচ্চ রথখানা পড়িয়া আছে। প্রয়োজনের সময় নূতন করিয়া চাকচিক্য সম্পাদন করিতেই হইবে বলিয়া বোধ হয় সারা বৎসর আর বিশেষ যত্নের প্রয়োজন অনুভব করে না কেউ।
ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিতে দেখিতে এবং ‘এত বড় পুতুল গড়িল কে’…‘রথের সিঁড়িগুলা কোন্ কাজে লাগে’…ঠাকুর নিজেই সিঁড়ি উঠিতে পারেন কিনা প্রভৃতি প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হেমপ্রভা যখন ফিরিতেছেন, তখন সামনেই হঠাৎ একটা গুঞ্জনধ্বনি শোনা গেল—’কান্তি মুখুজ্জে’! কান্তি মুখুজ্জে’! পূজা-উপচার সঙ্গে লইয়া নিজেই মন্দিরে আসিয়াছেন।
জমিদার তো বটেই, তাছাড়া মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা, কাজেই কীর্তনানন্দে বিভোর বৈষ্ণব ভক্তরা হইতে শুরু করিয়া পূজারী, সেবক-সেবিকা, সাধারণ দর্শকবৃন্দ পর্যন্ত কিছুটা ত্রস্ত হইয়া পড়ে।
বরাবর নাম শুনিয়া আসিয়াছেন–কখনো চাক্ষুষ পরিচয় নাই। হেমপ্রভা গায়ের সিল্কের চাদরটা আরও ভালোভাবে জড়াইয়া লইয়া নাতি-নাতনীদের পিছন দিকে সরিয়া যান, কিন্তু ব্যাপারটা ঘটে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। উপচার-বাহক ভৃত্যটাকে চোখের ইঙ্গিতে সরাইয়া দিয়া কান্তি মুখুজ্জে নিজে আগাইয়া আসিয়া বলেন–কি খোকা, চলে যাচ্ছ যে? প্রসাদ নেবে না?
উদ্দিষ্ট ব্যক্তি অবশ্য সিদ্ধার্থ। দাদার সামনে প্রতিপত্তি দেখাইবার সুযোগ সে ছাড়ে না। রীতিমত পরিচিতের ভঙ্গীতে কাছে সরিয়া আসিয়া গম্ভীরভাবে বলে–প্রসাদ আমাদের বাড়িতেও অনেক আছে। এদের সব রথটা দেখিয়ে আনলাম, এই যে আমার দাদা দিদি আর নানি।…আচ্ছা। ওই মিস্ত্রীটা কোথায় থাকে?
কান্তি মুখুজ্জে কেমন যেন আত্মহারা ভাবে এদের পানে চাহিয়াছিলেন, হঠাৎ এই অবান্তর প্রশ্নে সচেতন হইয়া বলেন–কোন্ মিস্ত্রীটা বলল তো?
–ওই কাঠের ঘোড়াগুলো যে গড়েছে! আমি একটা ঘোড়া গড়তে দেব মনে করছি। সিদ্ধার্থের এ হেন বিজ্ঞজনোচিত সুচিন্তিত মন্তব্যে উপস্থিত সকলেই হাসিয়া ওঠে। কান্তি মুখুজ্জে তাহার গায়ে একটি আদরের থাবড়া মারিয়া বলেন–ঘোড়া কেন দাদা, সোজাসুজি একটা হাতিই গড়তে দিও তুমি, কিন্তু এইটি তোমার দিদি? কী নাম তোমার লক্ষ্মী?
তাপসী অস্ফুট স্বরে নিজের নাম উচ্চারণ করে।
–তাপসী? চমৎকার! কিন্তু এ নাম তো তোমার জন্যে নয় দিদি। তপস্যা করবে সে, যে তোমাকে পেয়ে ধন্য হবে।..সন্দেহ করবার কিছু নেই, ব্রাহ্মণকন্যা তো বটেই, তবু পদবীটা যে। জানতে হবে আমার।…তোমার বাবার নাম কি দিদি?
লাজুক দিদি উত্তর দিবার আগেই অমিতাভ গম্ভীরভাবে বলে–বাবার নাম এম. ব্যানার্জি। দিদি ও ছোট ভাইয়ের মাঝখানে নিজে কেমন গৌণ হইয়া যাইতেছিল বলিয়াই বোধ করি নিজের সম্বন্ধে সকলকে সচেতন করিয়া দিতে উত্তরটা দেয় অমিতাভ। কিন্তু সিদ্ধার্থর কাছে তার পরাজয় অনিবার্য।
তীব্র তিরস্কারের ভঙ্গীতে দাদার দিকে চাহিয়া সিদ্ধার্থ বলে–আবার ওইরকম বলছিস? নানি কি বলে দিয়েছেন? এখানে কি বলতে হয়?…বাবার নাম হচ্ছে শ্রীমণীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বুঝলেন?
–বুঝেছি। ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ—
কান্তি মুখুজ্জে সোজাসুজি হেমপ্রভার সামনে আসিয়া বলেন–বাধ্য হয়ে আপনাকে সম্বোধন করতে হল, লজ্জা করবেন না–আমি আপনার চেয়ে অনেক বড়। এই মেয়েটি আপনার পৌত্রী?
‘নানি’ শব্দটা সন্দেহজনক বলিয়াই বোধ করি সম্পর্কটা যাচাই করিয়া লন ভদ্রলোক।
হেমপ্রভা মাথা হেলাইয়া জানান তাই বটে।
–তা হলে–আপনার কাছে আমার একটি আবেদন–মেয়েটিকে আমায় দিন। আমার একটি নাতি আছে, মা-বাপ-মরা হতভাগ্য, তবে আমার যা খুদকুঁড়ো আছে সবই তার। কিন্তু সে যাক–ছেলেটাকে একবার দেখে আপনি কথা দিন আমায়।
হেমপ্রভা যেন দিশেহারা হইয়া যান। অকস্মাৎ এ কি বিপদ!
এ অঞ্চলে কান্তি মুখুজ্জে যে-সে লোক নন। এত বড় একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির এই বিনীত আবেদনকে হেমপ্রভা উপেক্ষা করিবেন কোন মুখে? প্রতিবাদের ভাষা পাইবেন কোথায়? অথচ চিত্রলেখার মেয়েকে দান করিয়া বসিবার স্পর্ধাই বা কোথায়?
তাই সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে গোছ সুরে বলেন–আপনার ঘরে যাবে সে তো পরম সৌভাগ্যের কথা, তবে নেহাৎ ছেলেমানুষ
–ছেলেমানুষ তা দেখতে পাচ্ছি বৈকি, আমার নাতিটাও ছেলেমানুষ যে। অপেক্ষা করব বৈকি, দু-এক বছর অপেক্ষা করব আমি, কিন্তু ক্ষমা করবেন আমায়–এ মেয়েকে ছাড়বার উপায় আমার নেই। এর মুখে রাধারাণীর ছায়া দেখতে পাচ্ছি আমি। আমায় কথা দিন।
হেমপ্রভা কুণ্ঠিতভাবে বলিলেন–আপনার ঘরে কাজ করতে পেলে আমি তো ধন্য মনে। করব, কিন্তু ছেলেকে না জানিয়ে
–নিশ্চয়, জানাবেন তো বটেই,–কিন্তু আপনি ছেলের মা সেটা তো মিথ্যে নয়? আপনার কথা বিলেতের আপীল। তার ওপর আর কথা কি! অবিশ্যি আমার নাতিকেও আগে দেখুন আপনি…ওরে কে আছিস…বুলুবাবুকে ডেকে দে তো!
একটি ভৃত্য আসিয়া কহিল–দাদাবাবু ঠাকুরের সিংহাসনে নিশেন খাড়া করছে
–আচ্ছা একবার আসতে বল, বলবি আমি ডাকছি।
হুকুমটা দিয়া কান্তি মুখুজ্জে বোধ করি একবার মনে মনে হাসেন…সুন্দরী নাতনীটির জন্য দ্বিধায় পড়িয়াছে…রোসো, তোমাকেও আমার মত ফাঁদে পড়িতে হয় কিনা দেখ!
হ্যাঁ, ফাঁদে পড়িতে হয় বৈকি, একেবারে অথৈ জলে পড়িতে হয় যে! স্বপ্নের কল্পনা যদি প্রত্যক্ষ মূর্তি ধরিয়া সামনে আসিয়া দাঁড়ায়, দিশাহারা হইয়া পড়া ছাড়া উপায় কি?
ঠিক এমনি একটি তরুণ সুকুমার কিশোর মূর্তির কল্পনাই করিতেছিলেন নাকি হেমপ্রভা? দেবতা ছলনা করিতে আসিলেন না তো? তা নয় তো এ কি অপূর্ব বেশ! চওড়া জরির আঁচলাদার সাদা বেনারসীর জোড় পরা, কপালে শ্বেতচন্দনের টিপ। জুতাবিহীন খালি পা দুইখানির সৌন্দর্যই কি কম! হাতে একটা লাল শালুর নিশান। পিতামহের আহ্বানে আসিয়া হঠাৎ এতগুলি অপরিচিত মুখ দেখিয়া অবাক হইয়া দাঁড়াইয়াছে…
না, তাপসীর মত অত উজ্জ্বল গৌর রং নয় বটে, কিন্তু প্রথম ফায়ূনের কচি কিশলয় কি গৌর? সে কি কম উজ্জ্বল? মুখশ্রী গঠনভঙ্গী যে তাপসীর চাইতেও নিখুঁত, একথা অস্বীকার করিবার উপায় থাকে না হেমপ্রভার।
–এই যে এসেছ! কি হচ্ছিল?
এতগুলি অপরিচিত মূর্তির সামনে নিজের ছেলেমানুষী প্রকাশ করিবার ইচ্ছা বোধ করি বুলুর ছিল না। পিতামহের এ রকম অহেতুক প্রশ্নে মনে মনে চটিয়া গম্ভীরভাবে বলে সিংহাসনের ওপর নিশেনটা লাগাবো।
–তা বেশ। কিন্তু দেবতার মাথার ওপর আবার একটা শালুর নিশেন খাড়া করা কেন বল । তো?…বলিয়া সকৌতুকে হাসিতে থাকেন কান্তি মুখুজ্জে।
বুলু আরও গম্ভীরভাবে বলে–তাতে কি? রথের চুড়োয় নিশেন দেন না?
–ঠিক ঠিক, নিশ্চয় তো বটে, আমারই ভুল। আচ্ছা এসো, প্রণাম করো এঁকে– মণীন্দ্রবাবুর মা ইনি। মণীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়–বুঝেছ তো? ঈশানপুর, কুসুমহাট ইত্যাদি ওঁদের।
কান্তি মুখুজ্জের প্রকাণ্ড জমিদারির ঠিক সীমানাতেই এই সব মাঝারি তালুক। তবু বিবাদ বিসম্বাদের প্রয়োজন হয় নাই কোনদিন।
দায়সারা-গোছ একটা প্রণাম করিয়া বুলু চঞ্চলভাবে বলে–দাদু, যাই?
–আচ্ছা যাও। এখন তো এসেই পালাবার তাড়া! দেখব এরপর।…কি বলেন বেয়ান? হ্যাঁ, বেয়ানই বলি–সম্বন্ধটা যখন পাকা হয়ে গেল! দেখুন, আপনার আর কিছু বলবার আছে? ছেলে দেখলেন তো? এরা যে পরস্পরের জন্যে সৃষ্টি হয়েছে, এ কি অস্বীকার করতে পারেন?
–না মুখুজ্জে মশাই, প্রত্যক্ষ দেখলাম এ ভগবানের বিধান। বলবার কিছু নেই। …নিজের অজ্ঞাতসারেই কথাটা উচ্চারণ করেন হেমপ্রভা। কে যেন বলাইয়া লয় তাহাকে।
কান্তি মুখুজ্জে প্রাণখোলা হাসি হাসিয়া ওঠেন হবেই তো, কান্তি মুখুজ্জের চোখ ভুল করে না, বুঝলেন? জমির ওপর থেকে ধরতে পারি কার নীচে আছে কয়লা, আর কার নীচে হীরে!
বিচক্ষণ কান্তি মুখুজ্জে তো হীরক-খনি নির্ণয় করিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন, কিন্তু হেমপ্রভার কোথায় সে নিশ্চিন্ততার সুখ?
বাড়ি ফিরিয়া তিনি ছটফট করিতে থাকেন।
এ কি করিলাম! এ কি করিয়া বসিলাম!
মন্দির-প্রাঙ্গণে এ কি সত্য করিয়া বসিলেন হেমপ্রভা? এ যে কত বড় অনধিকারচর্চা সে কথা হেমপ্রভার চাইতে বেশী কে জানে? কেন হেমপ্রভা দুই হাত জোড় করিয়া ক্ষমা চাহিলেন না কান্তি মুখুজ্জের কাছে? কেন বলিলেন না—’যে সত্য রাখিতে পারিব না, সে সত্যের মূল্য কি?’ নিজের দৈন্য স্বীকার করিয়া লইলেই তো গোল মিটিয়া যাইত!
হেমপ্রভা মণীন্দ্রর মা, তাই তাহার উপরওয়ালা? হেমপ্রভার কথা বিলেতের আপীল? হায়, হেমপ্রভার জীবনে এ কথা পরিহাস ছাড়া আর কি! কিন্তু স্পষ্ট করিয়া এই সত্যটুকু প্রকাশ করিবার সাহস কেন হইল না তখন? অহঙ্কার? আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগিত?
কিন্তু তাই কি ঠিক? হেমপ্রভার কি তখন অত ভাবিবার ক্ষমতা ছিল? নিয়তি কি এই কথা বলাইয়া লইলেন না হেমপ্রভার বিহ্বলতার সুযোগে?
নিজের মনকে প্রবোধ দিতে যদিও বা নিয়তিকে দায়ী করা যায়, চিত্রলেখার সামনে দাঁড় করাইবেন কাহাকে? নিয়তিকে? তাপসীর বিবাহের সম্বন্ধ স্থির করিয়াছেন শুনিলে চিত্রলেখা শাশুড়ীকে পাগলাগারদের বাহিরে রাখিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিবে? হেমপ্রভার আহার-নিদ্রা ঘুচিয়া গেল। যে তৃপ্তিটুকু কয়দিন ভোগ করিয়া লইয়াছেন, এ যেন তাহারই খেসারৎ।
নিজের উপর রাগ হয়, কান্তি মুখুজ্জের উপর রাগ হয়, সারা বিশ্বের উপরই যেন বিরক্তি আসে। কোন মন্ত্রের প্রভাবে সেদিনের সকালটা যদি ফিরাইয়া আনা যাইত, মন্দিরের ত্রিসীমানায় যাইতেন না হেমপ্রভা। এত কাণ্ডের কিছুই ঘটিত না।
তবু সেই কিশোর দেবতার মত ছেলেটির মুখ মনে পড়িলেই যেন হৃদয় উদ্বেলিত হইয়া উঠিতে চায়। মনে হয়, ছেলে-বৌয়ের হাতে ধরিয়া সম্মতি আদায় করিয়া লইতে পারিব না? না হয় হেমপ্রভার মানটা কিছু খাটো হইল। না হয় জীবনে ওরা আর হেমপ্রভার মুখ না দেখুক, দেবমন্দিরে দাঁড়াইয়া যে সত্য করিয়া ফেলিয়াছেন হেমপ্রভা, তার মর্যাদাটুকু শুধু রাখুক ওরা।
মণীন্দ্রর নিজের কোন সত্তা থাকিত যদি, হয়তো এত অকূল পাথারে পড়িতেন না হেমপ্রভা, কিছুটা সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা করিতেন। কিন্তু চিত্রলেখা যে মণীন্দ্রর হৃদয়বৃত্তির সব কিছু আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে, একথা জানিতে কি বাকি আছে এখনও?
চিত্রলেখার মুখ মনে পড়িলে কোনদিকে আর কূলকিনারা দেখিতে পান না হেমপ্রভা।
দিন কয়েক কাটে।
হেমপ্রভা ভাবিতে চেষ্টা করেন–ও কিছু নয়, ব্যাপারটা হয়ত ঘটে নাই। সেদিনের সমস্ত কথাগুলি বার বার স্মরণ করিতে চেষ্টা করেন, এমন আর কি গুরুতর প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন তিনি? মেয়ে-ছেলে থাকিলেই কত জায়গায় সম্বন্ধ হয়…কিন্তু যতই হাল্কা করিবার চেষ্টা করুন, বিগ্রহের সমীপবর্তী মন্দির প্রাঙ্গণ যেন পাহাড়ের ভার লইয়া বুকে চাপিয়া বসিয়া থাকে।
তাছাড়া ভুলিয়া থাকিবার জো কই? কান্তি মুখুজ্জের বাড়ি হইতে প্রায় প্রত্যহই তত্ত্ব আসিতে শুরু করিয়াছে–একলা তাপসীর জন্যই নয় শুধু, তিন ভাইবোনের জন্য অজস্র খেলনা, খাবার, জামাকাপড়।
হেমপ্রভা নাচার হইয়া মনে মনে ভাবেন–আচ্ছা ঘুঘু বুড়ো! ঝুনো ব্যবসাদার বটে! মুখের কথা হাওয়ায় ভাসিয়া যাওয়ার আশঙ্কায় বস্তুর পাষাণভার গলায় বাঁধিয়া দিয়া হেমপ্রভাকে ডুবাইয়া মারার কৌশল ছাড়া এ আর কি?
সব কথা খুলিয়া বলিয়া ছেলেকে একখানা চিঠি লিখিবার চেষ্টা করেন হেমপ্রভা, কিন্তু মুসাবিদা ঠিক করিয়া উঠিতে পারেন না। এদিকে বিধাতাপুরুষ একদা যা মুসাবিদা করিয়া রাখিয়াছিলেন, পাকা খাতায় উঠিতে বিলম্ব হয় না তার। হেমপ্রভা কী কুক্ষণেই দেশে আসিয়াছিলেন এবার!
এদিকে নাতির জন্য ‘কনে’ দেখিয়া পর্যন্ত নূতন করিয়া যেন প্রেমে পড়িয়া গিয়াছেন কান্তি মুখুজ্জে। চোখে যৌবনের আনন্দদীপ্তি, দেহে যৌবনের স্ফুর্তি।..বিবাহের তারিখের জন্য ‘দুই এক বছর অপেক্ষা’ করার প্রতিশ্রুতিটাও যেন এখন বিড়ম্বনা মনে হয়। মনে হয়, এখনি সারিয়া ফেলিলেই বা ক্ষতি কি ছিল? কবে আছি কবে নাই!
কিন্তু নিতান্ত সাধারণ এই মামুলী কথাটা যে কান্তি মুখুজ্জের জীবনে এত বড় নিদারুণ সত্য হইয়া দেখা দিবে, এ আশঙ্কা কি স্বপ্নেও ছিল তার? কে বা ভাবিয়াছিল মৃত্যুদূত এমন বিনা নোটিশে কান্তি মুখুজ্জের দরজায় আসিয়া দাঁড়াইবে! বয়স হইলেও–অমন স্বাস্থ্য সুগঠিত দেহ, অমন প্রাণবন্ত উজ্জ্বল চরিত্র, অত আশা-আকাঙ্ক্ষাভরা হৃদয়, মুহূর্তের মধ্যে সবকিছুর পরিসমাপ্তি ঘটিয়া গেল।
শুধু হেমপ্রভার জন্য রহিল অগাধ পরমায়ু আর দুরপনেয় কলঙ্ক।
কলঙ্ক বৈকি! শুধু তো বিবাহের কথা দিয়া সত্যবদ্ধ হওয়া নয়, প্রতিকারবিহীন শৃঙ্খলের বন্ধনে সমস্ত ভবিষ্যৎ যে বাঁধা পড়িয়া গেল তাপসীর।
বিবেচক কান্তি মুখুজ্জে যে মৃত্যুকালে এত বড় অবিবেচনার কাজ করিয়া যাইবেন, এ কথা যদি ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করিতেন হেমপ্রভা, হয়ত এমন কাণ্ড ঘটিতে দিতেন না।
অকস্মাৎ মারাত্মক অসুখের সংবাদ বহন করিয়া যে লোকটা আসিল সে শুধু সংবাদ দিয়াই ক্ষান্ত রহিল না, বিনীত নিবেদন জানাইলকর্তার শেষ অনুরোধ, হেমপ্রভা যেন তাপসীকে লইয়া একবার দেখা করিতে যান। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হেমপ্রভার সাধ্য কি এ অনুরোধ এড়ান?
কিন্তু সেখানে যে তাহার জন্য মৃত্যুবাণ প্রস্তুত হইয়া আছে সে কথা টের পাইলে হয়তো এ ।অনুরোধও ঠেলিয়া ফেলা অসম্ভব ছিল না। কিছুই আশঙ্কা করেন নাই, গিয়া দেখিলেন বিবাহের সমস্ত ব্যবস্থা প্রস্তুত–পুরোহিত ও নাপিত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করিতেছে।
কুশল প্রশ্ন ভুলিয়া হেমপ্রভা সেই অর্ধ-অচৈতন্য রোগীর কাছে গিয়া প্রায় তীব্রস্বরে কহিলেন–এ কী কাণ্ড মুখুজ্জে মশাই?
কান্তি মুখুজ্জে চোখ খুলিয়া মৃদু হাসির আভাস ঠোঁটে আনিয়া ধীরে ধীরে কহিলেন– ঠিকই হল বেয়ান, দেখছেন না বিধাতার বিধান!
কিন্তু ওর বাপ-মা জানতে পর্যন্ত পেল না, এ মুখ আমি দেখাব কি করে তাদের? কি বলে বোঝাব?
–অবস্থাটা খুলে বলবেন। বুঝবে বই কি, আপনার ছেলে তো মূর্খ নয়। আর–আর মৃত্যু না হইলে নাকি স্বভাব যায় না মানুষের, তাই পরিহাসরসিক কান্তি মুখুজ্জে মৃদু পরিহাসের ভঙ্গীতে বলেন–সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবেন, ধরে এনে তো আর জেলে দিতে পারবে না আমাকে! অবিশ্যি বলবেন, তার কাছে ক্ষমা চেয়ে গেছে কান্তি মুখুজ্জে। অসময়ে ডাক এসে গেল যেকরি কি বলুন?
এ কথার আর কি উত্তর দিবেন হেমপ্রভা?
কিন্তু মুদিতপ্রায় নিষ্প্রভ চোখেও ধরা পড়িল হেমপ্রভার অসহায় হতাশ মুখচ্ছবি, তাই কিছুক্ষণ স্থির থাকিয়া ক্ষীণস্বরে কহিলেন–ভাববেন না–আমি কথা দিচ্ছি সুখী হবে ওরা, আমার বুলু বড় ভাল ছেলে, কিন্তু বড় হতভাগ্য। তাই লক্ষ্মীপ্রতিমার সঙ্গে বেঁধে দিলাম ওকে।…আর অভিভাবক ঠিক করে দিয়ে গেলাম ওর। আমি চোখ বুজলে যে ওর পৃথিবী শূন্য, বেয়ান! ক্লান্তিতে দুই চোখের পাতা জড়াইয়া আসিল।..ওদিকে তখন বিবাহের অনুষ্ঠান শুরু হইয়াছে।
ক্রন্দনরতা কনেকে অনেকে অনেক বুঝাইয়া চুপ করাইয়াছে।…কিন্তু ভিতর হইতে ক্রন্দনোচ্ছ্বাস গলা পর্যন্ত ঠেলিয়া আসিতেছে তাপসীর। সে তো নিজের হিতাহিত ভাবিয়া নয়, চিত্রলেখা জানিতে পারিলে কি হইবে সেই কথা ভাবিয়াই সর্বশরীর হিম হইয়া আসিতেছে তাহার। যেন তাপসী নিজেই কি ভয়ানক অপকর্ম করিয়াছে!
কান্তি মুখুজ্জে মারা গেলেন পরদিন সন্ধ্যায়।
ফুলশয্যা হইল না, কুশণ্ডিকার সিঁদুর পরিয়া ঠাকুমার সঙ্গে ফিরিয়া আসিল তাপসী।
পাড়ার গৃহিণীরা বলিতে লাগিলেন—’ভগবানের খেলা’…’ভবিতব্য’! ভট্টাচার্য টিকি দুলাইয়া আশ্বাস দিলেন–বিধাতার নির্দিষ্ট বিধান, আমরা তো নিমিত্ত মাত্র।
কিন্তু হেমপ্রভা কিছুতেই সান্ত্বনা খুঁজিয়া পান না। ছেলে-বৌকে মুখ দেখাইবেন কোন্ মুখে–এ উত্তর কে দিবে তাহাকে? কঠিন একটা রোগ কেন হয় না হেমপ্রভার? কান্তি মুখুজ্জের মত?…হায়, এত ভাগ্য হেমপ্রভার হইবে?
অথচ এ এমন ব্যাপার যে লুকাইয়া রাখার উপায় নাই, চাপিয়া ফেলার জো নাই!
অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া ছেলের নামে একখানা জরুরী টেলিগ্রাম পাঠাইলেন, ‘মা মৃত্যুশয্যায়, শেষ দেখা করতে চাও তো এসো।” পাঠাইয়া দিয়া অবিরত প্রার্থনা করিতে থাকেন কল্পিত রোগ যেন সত্য হইয়া দেখা দেয়…মণীন্দ্র আসিয়া যেন দেখে যথার্থই মৃত্যুশয্যায়।
অপরাধিনী মাকে তখন ক্ষমা করা হয়তো অসম্ভব হইবে না মণীন্দ্রের পক্ষে।
এবারে বিদেশে আসিয়া চিত্রলেখার মন বসিতেছিল না। ছেলেমেয়েদের না আনিয়া যে এত খারাপ লাগিবে এ কথা আগে খেয়াল হয় নাই। তাহারা কাছে না থাকিলে ছটা বিকীর্ণ করিবার উপায় কোথা? শুধু নিজেকে দিয়া কতটাই আর প্রকাশ করা যায়? কতই বা সাজসজ্জা করা যায় তিনবেলা?
মেয়েকে তালিম দিয়া গড়িয়া তোলার উদ্দেশ্য কি তবে? যদি উপযুক্ত ক্ষেত্রটাই মাঠে মারা গেল?
এবার তো আবার শুধু প্রতিবেশী হিসাবে নয়, সেজকাকীর সংসারেই আশ্রয় লইতে হইয়াছে যে–অবশ্য ‘পেয়িং-গেস্ট হইয়া। আসিবার আগে সেজকাকা একখানা বাড়ির আশ্বাস দিয়াছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আর জুটিল না। সেজকাকীর ভগ্নীপতির চাহিদা ফেলিয়া তো আর চিত্রলেখাকে দেওয়া যায় না! অগত্যা ভাইঝি ও ভাইঝি-জামাইকে নিজের বাড়িতেই আশ্রয় দিতে হইয়াছে তাহাকে, নেহাৎ যখন আসিয়া পড়িয়াছে।
কিন্তু ভাইঝি তো আর দুঃখী দরিদ্র নয় যে “বিনামূল্যের অন্ন” গলাধঃকরণ করিবে! বরং নিজেদের খরচের উপরিই সে দেয়। কিন্তু তাহাতেই বা শান্তি কই? সুখ কই?
সেজকাকার কালো কুমড়ো’র মত খেদি মেয়েটা যখন নাচিয়া গাহিয়া আসর জমকায় আর পাড়ার লোকের বাহবা কুড়ায়, সেজকাকীর দিদি যখন পাশের বাড়ি হইতে বেড়াইতে আসিয়া বোনঝির রূপগুণের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হইয়া ওঠেন, তখন সর্বাঙ্গ জ্বালা করে চিত্রলেখার।
তাপসীকে একবার দেখাইয়া এদের ‘বড় মুখ’ হেঁট করা গেল না, এ কি কম আপসোসের কথা? তাপসীর কাছে লিলি? কিসে আর কিসে! লিলি! কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন আর কাকে বলে!…ওই রূপে আবার সাজের ঘটা কত! এই যে নিত্য নূতন পোশাকের চটক, দেখানে-পনা ছাড়া আর কি! মতলব বোধ করি চিত্রলেখাকে অবাক করিয়া দেওয়া। অবশ্য চিত্রলেখা এত নির্বোধ নয় যে অবাক হইবে। লিলির তুলনায় ‘বেবি’ অর্থাৎ তাপসীর যে আরও কত অজস্র রকমের পোশাক-পরিচ্ছদ আছে সে কথাগুলি নিতান্তই গল্পচ্ছলে উচ্চারণ করিতে হয়। যথা–এত যে রকম রকম জামা-জুতো করিয়ে দিচ্ছি বিলাতী দোকানে অর্ডার দিয়ে, তা সৃষ্টিছাড়া মেয়ে কিছু যদি পরবে! অথচ এই দেখ, লিলি! যা দিচ্ছ তাই আনন্দ করে পরছে।
বেবির গানের মেডেলগুলা আনিবার কথা অবশ্য নয় কিন্তু কি জানি কি ভাবে আসিয়া পড়িয়াছে! সুটকেসের কোণেই পড়িয়াছিল হয়তো। যাই হোক, আসিয়া পড়িয়াছে বলিয়াই পাঁচজনকে দেখানো। নইলে ও আর কি–হরদমই তো পাইতেছে! রেডিও কোম্পানী তো চিত্রলেখার বাড়ির মাটি লইয়াছে! চিত্রলেখার ইচ্ছা নয় যে তুচ্ছ কারণে মেয়ে গলা নষ্ট করে। হা, তবে ‘হিজ মাস্টারস’-এর ওখানে বরং এক-আধবার পাঠানো চলে।…সেজকাকী আর তস্য দিদির দুর্ভাগ্য যে, ‘বেবী’র গান শুনিয়া জীবনটা ধন্য করিয়া লইবার সুযোগ পাইলেন না।
প্রথম প্রথম কথা কহার সুখটুকুই ছিল–কিন্তু ইদানীং যেন সেটাও যাইতে বসিয়াছে। দেখা যাইতেছে এসব গল্পে আর কেউ বিশেষ আমল দিতেছে না। এমন কি মণীন্দ্র পর্যন্ত মাঝে মাঝে চিত্ৰলেখার কাছে কথার ট্যাক্স চান। চিত্রলেখা নাকি আজকাল বড় বেশী বাজে বাজে কথা বলে!
শোনো কথা! এরপর আরো যে কি-না-কি বলিয়া বসিবেন মণীন্দ্র কে জানে! বৃদ্ধ হইতে যে আর বিশেষ বাকি নাই সেটা ধরা পড়ে এমনি বুদ্ধিভ্রংশ কথাবার্তায়! সংসারে কি আছে না আছে মণীন্দ্র জানেন? না বেবির গুণপনার সব হিসাব তিনি রাখেন? তবে? যা-তা একটা বলিয়া চিত্রলেখার মুখ হাসানো কেন?
রাগে রাগে কোন সময়ই তাই আর চিত্রলেখা মুখে হাসিই আসিতে দেয় না। এমনই যাই যাই’ গাছের মনের অবস্থায় হঠাৎ হেমপ্রভার ‘তার’ আসিয়া হাজির হইল।
অন্য সময় হইলে চিত্রলেখা হয়তো শাশুড়ীর এরকম বেয়াড়া আবদারে রীতিমত জ্বলিয়া উঠিত, কিন্তু এক্ষেত্রে মনে করিল–যাক, তবু মন্দের ভালো। স্বামীর কাছে মান খোয়াইয়া কলিকাতায় ফেরার কথা ভোলা যাইতেছিল না, এ তবু একটা উপলক্ষ পাওয়া গেল!
টেলিগ্রামখানা বার দুই-তিন পড়িয়া মণীন্দ্র বোধ করি মায়ের অসুখের গুরুত্বটা নির্ণয় করার চেষ্টা করিতেছিলেন, চিত্রলেখা সাড়া দিয়া কহিল–তা হলে যাবে নাকি?
–যাব না! মণীন্দ্র অবাক হইয়া তাকান। অবশ্য কিছুটা বিরক্তিও ধরা পড়ে প্রশ্নের সুরে।
–হ্যাঁ, যাবে তো নিশ্চয়ই, প্রশ্ন করাই অন্যায় হয়েছে আমার, যাক, আমিও মনে করছি চলে যাই এই সঙ্গে, আমায় কলকাতায় নামিয়ে দিয়ে তুমি পরের ট্রেনে চলে যেও।
মণীন্দ্র বোধ করি সামান্য আশা করিয়াছিলেন, মায়ের মৃত্যুশয্যাপার্শ্বে সস্ত্রীক উপস্থিত হইতে পারিবেন, কিন্তু চিত্রলেখার প্রস্তাবে হতাশ হন। কর্তব্যবোধ জাগাইবার দুরাশা অবশ্য নাই, তবু ক্ষীণকণ্ঠে প্রতিবাদ করেন–তোমার একবার না যাওয়াটা ভাল হবে? ধর যদি মা’র–
যতই হোক মা, তাই অকল্যাণকর বাকি কথা বোধ করি উচ্চারণ করিতে বাধে মণীন্দ্রর।
চিত্রলেখার অবশ্য জানিতে বাকি নাই, মণীন্দ্রর প্রাণ পড়িয়া থাকে কোথায়! নেহাৎ নাকি চিত্রলেখা বেশী আদিখ্যেতা দেখিতে পারে না, তাই ‘মা মা’ করিয়া বাড়াবাড়ি করিবার সাহস হয় না। তবে চিত্রলেখার অত শখ নাই। অগ্রাহ্যের ভঙ্গীতে বলে–তুমি যতটা সিরিয়াস’ ভাবছ, আমার তো তা মনে হচ্ছে না। সেকেলে মানুষ, অল্পে ব্যস্ত হওয়া স্বভাব আর কি! হয়তো সামান্য কিছু হয়েছে, তার’ ঠুকে দিয়েছেন।
–বেশী যে হয়নি তারই বা প্রমাণ কি পাচ্ছ তুমি?
–প্রমাণ আবার কি, নিজের ধারণার কথাই বলছি। কেবল তর্ক, চিরদিন এক স্বভাব গেল! যাক, তোমার মা’র বিষয় তুমিই ভাল বুঝবে, তবে তোমার যদি এতই তাড়া থাকে, বর্ধমানে নেমে পড়ে চলে যেও কুসুমহাটি, হাওড়া স্টেশনে এসে একটা ট্যাক্সি করে নিয়ে বাড়ি পৌঁছবার ক্ষমতা আমার যথেষ্ট আছে।
–তাহলে তুমি না যাওয়াই ঠিক করলে? কাজটা কি রকম হবে তাই ভাবছি!
চিত্রলেখা এবার ঈষৎ নরম সুরে উত্তর দেয়–বেশ তো, তুমি গিয়ে অবস্থা দেখে একটা টেলিগ্রাম করেও দিতে পার তো! দরকার বুঝি-যাওয়া এমন কিছু শক্ত নয়, ঘণ্টাকয়েকের মামলা, আমার পক্ষে এখন তৈরি হওয়া বড় সহজ কাজ নয়। উঃ, বিরাট জিনিসপত্র ম্যানেজ করা–
মণীন্দ্র দোষারোপের ভঙ্গীতে বলেন–তখনই বলেছিলাম ‘লাগেজ’ বড় বেশি হয়ে যাচ্ছে– ছেলেমেয়েরা এল না, মাত্র দু’জনের জন্যে সাতটা সুটকেস, দুটো হোল্ডল–
সে তুমি বলবে জানি, অথচ সেজকাকার বাড়িতে থাকা হল বলেই না এ সব লাগেজ বাড়তি মনে হচ্ছে! একটা সংসার ম্যানেজ করতে হলে কত কি লাগে! তা ছাড়া ছোটলোকের মত একই শাড়ী ব্লাউজ বার বার পরতে আমার প্রবৃত্তি হয় না সে তো তোমার অজানা নয়। কি আর করা যাবে?
স্বামীর সঙ্গে দুই দণ্ড প্রেমালাপ করিবে কি, কথাবার্তা শুনিলেই যে গা জ্বলিয়া যায়। চিত্রলেখার! উপরে যতই পালিশ পড়ক লোকটার, ভিতরে যে কোথায় একটু গ্রাম্যভাব রহিয়া গিয়াছে, যেটা এমন চটকদার পালিশের নীচে হইতেও মাঝে মাঝে উঁকি মারে, অন্ততঃ চিত্রলেখার সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে ধরা পড়িতে দেরি হয় না।
চিত্রলেখা উঠিয়া যাইবার কিছুক্ষণ পরেই সেজকাকীমার আবির্ভাব ঘটিল। বয়সে চিত্রলেখার চাইতে কয়েক বৎসর বড় হওয়াই সম্ভব, তবে সাজসজ্জায় চলনে-বলনে বয়স ধরা পড়ে না। চশমার কাঁচ মুছিতে মুছিতে ভাটিয়ালী শাড়ীর আঁচল পিঠে ফেলিয়া আসিয়া দাঁড়াইলেন।
পূজনীয়া খুড়শাশুড়ী মণীন্দ্র তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইবার ভঙ্গীতে অবহিত হন, অবশ্য দাঁড়ান না। মাজা-ঘষা মিহি গলায় অনুযোগের সুর ঝঙ্কৃত হইয়া ওঠে–এ তোমার অন্যায় মণীন্দ্র। তোমার মা’র অসুখ, বেশি হোক কম হোক–তুমি যাবে, উচিতও যাওয়া কিন্তু ও বেচারাকে খামকা সেই জঙ্গলের মাঝখানে টেনে নিয়ে যাওয়া কেন?
মণীন্দ্র গম্ভীর সুরে বলেন–আমি তো বলিনি যেতে!
–ইচ্ছে প্রকাশ করেছ তো! সেও একরকম বলাই হল! আমাদের তো ইচ্ছে নয় যে ও তাড়াতাড়ি চলে যায়। তাছাড়া এখানে এসে ওর হেলথটা একটু ইমপ্রুভ করছিল–অবশ্য তোমার মতামতের ওপর কথা বলতে চাই না, তবে তোমাদের কাকাবাবু বলছিলেন ‘পরে আমাদের সঙ্গে গেলেই হত!
বোঝা গেল কাকাবাবুর দূত হিসাবেই আসিয়াছেন তিনি, নিতান্তই কর্তব্যের খাতিরে। তা নয়তো স্বেচ্ছায় ঝঞ্ঝাটকে আগলানো! একটু আশ্চর্য বৈকি! অবশ্য আগে আগে যখন চিত্রলেখার সেজকাকীমার প্রতি দৃষ্টিটা ছিল বিমুগ্ধ বিচঞ্চল, তখন ভাসুরঝিকে খুব পছন্দই করিতেন ভদ্রমহিলা, কিন্তু ইদানীং যেন চিত্রলেখাই তাহাকে তাক লাগাইয়া দিতে চায়। কাজেই পছন্দটা বজায় রাখা দুষ্কর। তাঁ, তবে বাহিরে সভ্যতার ঠাট বজায় রাখিবার ক্ষমতা তাঁহার যথেষ্টই আছে। ওটা এখনও কিছুকাল সেজকাকীমার কাছে শিখিতে পারে চিত্রলেখা।– শাশুড়ী-জনোচিত মর্যাদা তিনি রক্ষা করেন জামাতার কাছে মেয়েকে আরও কিছুদিন রাখিবার অনুরোধ জানাইয়া।
মণীন্দ্র এতক্ষণ ‘পাইপ’ সরাইয়া রাখিয়া ভিতরে ভিতরে অতিষ্ঠ বোধ করিতেছেন। কথায় ছেদ টানিয়া দিতে তাড়াতাড়ি বলিলেন–বেশ তো থাকুক না আপনাদের কাছে, আপত্তির কি আছে! আমি রাত্রের ট্রেনেই স্টার্ট করব।
সেজকাকীমা একটু ফাঁপরে পড়েন। দূত হিসাবে আসিয়াছেন বটে, কিন্তু নিজস্ব ইচ্ছাটা তো আর বি দিয়া আসেন নাই। তাই আরও মিহি আরও অমায়িক সুরে বলেন– অবশ্য জীবন মরণের কথা কিছুই বলা যায় না, চিত্রার সঙ্গে যে তোমার মা’র একবার শেষ দেখা হবে না–এটাও যেন না হয়, জোর করে আটকাতে আমি চাই না।
–না, আপনার আর দোষ কি, উনি নিজে যা বিবেচনা করবেন–বলিয়া যেন অন্যমনস্ক ভাবে পাইপটা টেবিলে ঠুকিতে থাকেন মণীন্দ্র। চিত্রলেখা কি আর সাধে বলে, ভিতরে ভিতরে গ্রাম্যতা ঘোচে নাই! শ্বশুর-শাশুড়ীর সামনে কে তাহাকে পাইপ ধরাইতে নিষেধ করিয়াছে মাথার দিব্য দিয়া?
টেলিগ্রামখানা ছাড়িয়া পর্যন্ত ঘর-বার করিতেছিলেন হেমপ্রভা।
কি বলিবেন? কি করিবেন? আসিবামাত্রই কঁদিয়া কাটিয়া ছেলে-বৌয়ের হাত ধরিয়া ক্ষমা চাহিবেন? না রোগের ভান করিয়া বিছানায় পড়িয়া থাকিবেন? তাপসীকে না হয় সিঁদুর ঢাকিয়া বাঁকা সিঁথি কাটিয়া রাখিবেন, ছেলেদের ও চাকরবাকরদের না হয় শিখাইয়া রাখিবেন কোন কথা প্রকাশ না করিতে। ধীরে ধীরে মেজাজ বুঝিয়া…কিন্তু তারপর? তারপর কি বলিবেন হেমপ্রভা? কি বলিবেন ভাবিতে গেলে যে বুদ্ধিবৃত্তি অসাড় হইয়া যায়!
বর্তমান যুগে দেবতারা যে বধির এ বিষয়ে আর সন্দেহ কি! হেমপ্রভার এত প্রার্থনা বিফল হইয়া স্বাভাবিক নিয়মে দিনরাত্রি আবর্তিত হইতে থাকিল, হেমপ্রভার, হার্টফেল হইল না, দৈব দুর্ঘটনা ঘটিল না, সামান্য একটু জ্বর পর্যন্ত দেখা দিল না।…সম্ভাব্য সময়ে স্টেশনে গাড়ি গেল এবং সেই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যথার্থ রোগিণীর মত নির্জীব হইয়া বিছানায় আশ্রয় লইলেন হেমপ্রভা।
কথায় বলে, বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো! এমন নিরেট সাবধানতার মাঝখানে যে এত বড় ছিদ্র ছিল সে কথা কে হুশ করিয়াছিল! সব প্রথম যার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা–গাড়ীর সেই কোচম্যানটাকে যে সাবধান করিয়া রাখা হয় নাই, সেটা আর খেয়ালে আসে নাই হেমপ্রভার!
সময় যত নিকটবর্তী হইতে থাকে বুকের স্পন্দন তত দ্রুত হইয়া ওঠে। অবশেষে গাড়ীর চাকার শব্দ–গেট খোলা এবং বন্ধ করার শব্দ–পরিচিত জুতার শব্দ বুকের উপর যেন হাতুড়ি পিটিতে থাকে কিন্তু চিত্রলেখা কই? শুধু একটা ভারী জুতার শব্দ কেন?…না, চিত্রলেখা আসে নাই। ঈশ্বর আছেন’ শুধু এইটুকু চিন্তা করিতে না করিতে ছেলের মুখ দেখিয়া হেমপ্রভা চোখে অন্ধকার দেখেন।…না, গোপন নাই। সেই ভয়ঙ্কর কথাটা প্রকাশ হইয়া গিয়াছে! মুখ দেখিয়া সন্দেহ থাকে না কিছু। এক মিনিট..দুই মিনিট… প্রত্যেকটি মিনিট এক-একটি বৎসর। জলদগম্ভীর স্বরে শুধু একটি শব্দ উচ্চারণ করেন মণীন্দ্র–’মা’!
একটি শব্দের মধ্যে কত অজস্র ভাব!
হেমপ্রভা আর নিজেকে সামলাইতে পারেন না। হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া ওঠেন– আমাকে তুই সাজা দে মণি, তোর যা মন চায় সেই শাস্তি দে আমাকে, মেয়েটাকে কিছু বলিসনি।
–বলবার তো আর কিছু রাখোনি মা, বলবার ভাষাও খুঁজে পাচ্ছি না আমি। মণীন্দ্রর কণ্ঠস্বরে রোষ ক্ষোভ হতাশা নিরুপায়ের বেদনা সব কিছু যেন ভাঙিয়া পড়ে।
–মণি, আমায় তুই মার! মেরে ফেল আমায়
–পাগলামি করো না মা, ঈশ্বর রক্ষা করেছেন যে চিত্রা আসতে চাইল না। কিন্তু এ কি করলে মা? কি করলে? বেবিটাকে মিথ্যে করে দিলে একেবারে? চিরদিনের মত মাটি করে দিলে?
–নিজের অপরাধ কমাতে চাই না মণি। হেমপ্রভা হঠাৎ যেন কোথা হইতে বল সঞ্চয় করিয়া উঠিয়া বসেন, অপেক্ষাকৃত ধীরস্বরে বলেন–জানি আমারই সমস্ত দোষ, তবু একটি কথা তোমায় বলব আমি–অপাত্রে পড়েনি তাপসী। হয়ত তুমিও সে ছেলেকে দেখলে
–থাক থাক, ও কথা আমার সামনে আর বলল না মা। একটা বাচ্ছা ছেলে–সে আবার অপাত্ৰ-সুপাত্র! কান্তি মুখুজ্জে কোলিয়ারি কিনে অনেক পয়সা করেছে বটে, কিন্তু মা-বাপ-মরা নাতিটাকে কি সুশিক্ষা দিয়েছে তার খবর জানো কিছু! ম্যাট্রিক পাস করেছে কি করেনি তাও জানো না বোধ হয়! উঃ, আমার সমস্ত আশা ধ্বংস হয়ে গেল! তোমার বুদ্ধির ওপর একটু আস্থা ছিল, কিন্তু তোমাকে যে লোকে এত বড় ঠকানোটা ঠকাতে পারে এটা কোনদিন ধারণা করতে পারিনি।
হেমপ্রভা সমস্ত অভিমান বিসর্জন দিয়া শান্তভাবে বলেন–ঠকা-জেতা তুমি নিজে একবার পরীক্ষা করে দেখ। সে ভদ্রলোক নিশ্চিন্ত হয়ে মরেছেন যে, মা-বাপ-মরা ছেলেটার একটা অভিভাবক ঠিক করে দিয়ে গেলেন। সেই অভিভাবকের কাজ তুমি করো, ও যাতে মানুষের মত মানুষ হয়ে ওঠে দেখো। পয়সার তো অভাব নেই তার
–বুঝেছি মা, পয়সার লোভটাই সামলাতে পারনি তুমি। মণীন্দ্র নীরস স্বরে মন্তব্য করেন–তোমার ওপর ধারণাটা অনেক উঁচু ছিল, যাক সে কথা, তবে পরের ছেলের অভিভাবক সাজবার স্পৃহা আমার নেই। বেবি-অভীদের তৈরি হতে বল, বিকেলের ট্রেনে বেরোব।
–আজকেই চলে যাবি মণি? তার একবার খোঁজ করবি না? বুড়ো মাকে তুই জীবনেও ক্ষমা না করতে পারিস করিসনে, কিন্তু মেয়েটার আখের ভাব! শুনেছি পাসের খবর বেরোলে কলকাতার হোস্টেলে পড়তে যাবার কথা, এখন ঠাকুর্দা মরে গিয়ে কি অবস্থায় আছে বেচারা, কোন খবরই নিতে পারিনি, তুই একবার খোঁজ করে দেখ–
–যে অনুরোধ রাখতে পারব না, সে রকম অসঙ্গত অনুরোধ করো না মা। ..অভী! অভী! এই যে, তোমরা এখনই তৈরি হয়ে নাও, বিকেলের গাড়ীতে কলকাতায় ফিরতে হবে।
মায়ের যাওয়ার নাম মাত্র উচ্চারণ করেন না মণীন্দ্র। রায় দিয়া গম্ভীরভাবে উঠিয়া যান।
হেমপ্রভা অবাক অনড় ভাবে বসিয়া থাকেন। না, মণীন্দ্র তাঁহাকে তিরস্কার করে নাই, গালি দেয় নাই, কিন্তু চিত্রলেখা এর চাইতে আর কত বেশী অপমান করিতে পারিত!
ভয়! ভয়!
ছোট মনটুকু আচ্ছন্ন করিয়া আছে এই করাল দৈত্য। অপরাধটা তার দিক হইতে হইল কখন একথা জানে না তাপসী, তবু সেই অজ্ঞাত অপরাধের ভারে বেচারা যেন আড়ষ্ট হইয়া গিয়াছে। অথচ বাবা তাহাদের কাহাকেও তোকই এতটুকু তিরস্কার পর্যন্ত করিলেন না!
নানির সঙ্গে কি কথাবার্তা হইল কে জানে, তবু নানির ঘর হইতে বাহির হইবার সময় বাবার অস্বাভাবিক থমথমে মুখ দেখিয়া, একলা তাপসী কেন, তিনটি ভাই-বোনই সন্ত্রস্ত হৃদয়ে বিরাট বাড়ীর একটু নির্জন কোণ খুঁজিয়া নীরবে বসিয়া ছিল।
ছোট্ট সিদ্ধার্থও যেন অনুভব করিতে পারিতেছে, যা ঘটিয়া গিয়াছে তাহা অন্যায় অসঙ্গত–না ঘটিলেই বাঁচা যাইত। এই অসঙ্গত আচরণের কৈফিয়ৎ বুঝি সকলকেই দিতে হইবে। কখন সেই রুদ্রমেঘ ভাঙিয়া পড়িবে, সেই আশঙ্কায় স্তব্ধ হইয়া থাকে তিনজন।
কিন্তু ভাঙিয়া পড়িল না। ছেলেমেয়েদের ডাকিয়া শুধু এইটুকু জানাইলেন মণীন্দ্র যে বিকালের গাড়ীতেই রওনা হইতে হইবে তাহাদের।
কিন্তু ভাঙিয়া যে পড়িল না সেইটাই কি স্বস্তির? বরং কঠিন তিরস্কারের ভিতর কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজিয়া পাওয়া সম্ভব ছিল। বাবার মূর্তিটাই যে তিবস্কারের মত উদ্যত হইয়া রহিল।
ভয়! ভয়!
ট্রেনের গতি দ্রুত হইতেছে–আর নিকটবর্তী হইয়া আসিতেছে কলিকাতা–যেখানে চিত্রলেখা আছেন!…হায়, মা’র সঙ্গে মুসৌরী যাইলে তো এত কাণ্ডের কিছুই ঘটিত না! কেনই যে দেশে যাইবার শখ এত প্রবল হইল!..আচ্ছা সেই ছেলেটিও এই ট্রেনেই কলিকাতা আসিতেছে না তো? কলিকাতায় থাকিয়া পড়িবার কথা ছিল।…বুড়ো ভদ্রলোক তো মারা গেলেন–বাড়ীতে নাকি আর কোন লোক নাই।…কী আশ্চৰ্য্য, অতটুকু একটা মানুষ অত বড় একটা বাড়ীতে একলা থাকিতে পারে নাকি! কে যেন বলিতেছিল–বরাবর রাণীগঞ্জে থাকে ওরা। সেখানেই বা আছে কে? মা বাপ ভাই বোন কিছুই নাই, এ আবার কি রকম কথা! একটিমাত্র দাদু, তাও তো মরিয়া গেলেন…আচ্ছা সারাদিন কথা কয় কার সঙ্গে? চাকর? ঠাকুর? দূর!..কলকাতায় কত কলেজ…সব কলেজেই হোস্টেল থাকে?…তাপসীও ম্যাট্রিক পাসের পর কলেজে ভর্তি হইবে–উঃ, কত দেরি তার–তিন-তিনটি বছর পরে তবে ম্যাট্রিক পরীক্ষা!
–বেবি, জানলার ধার থেকে সরে এস, কয়লার গুঁড়ো লাগছে মুখে। বাপের কণ্ঠস্বরে অত চমকাইবার কারণ কি ছিল? যেন চুরি করিতে গিয়া ধরা পড়িয়াছে তাপসী। আবার সেই ভয়টা বুকের উপর চাপিয়া বসিতেছে শ্রীরামপুর…উত্তরপাড়া…লিলুয়া নামগুলো নূতন নাকি? বুকের ভিতর এত শব্দ কেন? চিত্রলেখা নিকটবর্তী হইতেছেন বলিয়া?
ছেলেমেয়েদের ও স্বামীর মুখ দেখিয়া শাশুড়ীর মৃত্যু সম্বন্ধে আর সন্দেহ রহিল না চিত্রলেখার। তা এত তাড়াহুড়া করিয়া মরিবার কি দরকার ছিল? চিত্রলেখার বদনাম করিতে ছাড়া আর কি! যাক তবু ভালো, মনের দুঃখে গেঁয়ো ভূতদের মত জুতা খুলিয়া পা খালি করিয়া আসিয়া হাজির হন নাই মণীন্দ্র! স্বামীর কাছে অন্ততঃ এটুকু সভ্যতাজ্ঞানের পরিচয় পাইয়া কিছুটা হৃষ্ট হয় চিত্রলেখা।
স্বামীকে জিজ্ঞাসা করিতে সাহসে কুলায় না, বড় মেয়ে-ছেলের কাছেও কেমন যেন একটু লজ্জা করে, তাই চুপিচুপি সিদ্ধার্থকে ডাকিয়া প্রশ্ন করে–তোমাদের নানি কবে মারা গেলেন?
–নানি! দুই চোখ বড় করিয়া সিদ্ধার্থ মায়ের মুখের পানে তাকায়। মা কি হঠাৎ পাগল হইল নাকি? তীক্ষ্ণস্বরে কহিল–নানি মারা যাবেন কেন?
–ওঃ! যাননি তাহলে? ধন্যবাদ। তা তোমরা হঠাৎ অসুস্থ মানুষকে ফেলে চলে এলে যে? একটু ভাল আছেন বুঝি?
টেলিগ্রামের কথা ছেলেমানুষ সিদ্ধার্থ জানে না, জানিবার কথাও নয়, তাই একটু থামিয়া বলিয়া ফেলে–নানির অসুখ করতে যাবে কেন? শুধু তো মন খারাপ!
এক মুহূর্তে কঠিন হইয়া ওঠে চিত্রলেখা। ওঃ, অসুখটা তবে ছল! ছেলে-বৌকে দেশে টানিয়া লইয়া যাইবার ছুতা! মায়ের উপর তবে ক্রুদ্ধ হইয়া ছেলেমেয়েদের লইয়া আসিয়াছেন মণীন্দ্র! প্রলয়গম্ভীর মুখের কারণ এতক্ষণে বোঝা গেল। ভালই হইয়াছে যে এতদিনে মায়ের স্বরূপ চিনিয়াছেন মণীন্দ্র। ভালো! ভালো! উভয়পক্ষই বেশ জব্দ হইয়াছেন। চাপা হাসি চাপিয়া ছোট্ট ছেলেটাকেই বিদ্রূপব্যঞ্জক ভঙ্গীতে শুধায় চিত্রলেখা–তা হঠাৎ তার মন খারাপের কারণটা কি হল?
বাবার কাছে বলিয়া ফেলিবার ভয়ে সেখানে একটা নিষেধ ছিল বটে, কিন্তু মার কাছে বলিতে আলাদা করিয়া কোন নিষেধের অর্ডার পাওয়া যায় নাই, তাই সিদ্ধার্থ সোৎসাহে বলে–তা মন খারাপ হবে না–দিদির বিয়ে হয়ে গেল–তোমরা দেখতে পেলে না, কিছু উৎসব হল না–নেমন্তন্ন হল না–
ছেলেটা নিতান্ত মেল ট্রেনের গতিতে কথা কয় বলিয়াই এতগুলো কথা বলিয়া ফেলিতে পারে, কারণ প্রথমাংশটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ছিলা-ছেঁড়া ধনুকের মত সোজা হইয়া উঠিয়াছে চিত্রলেখা–কী বললি? কী হয়ে গেল? দিদির কী হয়ে গেল?
মায়ের মূর্তি দেখিয়া উৎসাহটা নিতান্তই স্তিমিত হইয়া পড়ে বেচারার। ভয়ে ভয়ে বলে–দিদির হঠাৎ বিয়ে হল কিনা। সেই বুড়ো ভদ্দরলোক তাড়াতাড়ি মরে গেল যে আজ বিয়ে হল–কাল মরে গেল–ব্যস্!
চিত্রলেখা আর সিদ্ধার্থর কাছে দাঁড়াইয়া সময় নষ্ট করিবার প্রয়োজন অনুভব করে না। হার্টের অসুখ ভুলিয়া বিদ্যুৎবেগে মণীন্দ্রর বসিবার ঘরে আসিয়া দাঁড়ায়। ট্রেনের পোশাক এইমাত্র ছাড়িয়া বসিয়াছেন তিনি–পিতাপুত্রী দু’জনেই আছেন–চমৎকার!
বিদ্যুতের মত আসিয়া বাজের মত ফাটিয়া পড়াই সামঞ্জস্যপূর্ণ, তাই প্রশ্নটা বাজের মত শোনায়–ব্যাপারটা কি হয়েছে শুনতে পারি?
মণীন্দ্র গম্ভীরভাবে একবার সেই অগ্নিময় মুখচ্ছবির পানে চাহিয়া ধীরস্বরে বলেন– শোনবার মত নয়।
–বলতে লজ্জা করছে না? প্রকৃত ঘটনা শগগির বলো আমায়, কি ভেবেছ কি তোমরা?
–প্রকৃত ঘটনা–আমি যতটুকু জানি তা এই–একজনের প্ররোচনায় পড়ে মা বেবির একটা বিয়ে দিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন…বেবি, তুমি ওপরে যাও, অভীর সঙ্গে খেলা করগে।
চিত্রলেখার লিপস্টিক রঞ্জিত ওষ্ঠাধরের পথ বাহিয়া যে লাভাস্রোত প্রবাহিত হইবে, সেটা কল্পনা করিয়া বোধ করি বালিকা কন্যার জন্য করুণা হইল মণীন্দ্রর। কিন্তু চিত্রলেখা অত
ভাবপ্রবণ নয়, তাই চিলের মত তীক্ষ্ণকণ্ঠে চীৎকার করিয়া ওঠেনা, উঠে যাবে না ও, সমস্ত পরিষ্কার শুনতে চাই আমি। জেনে রেখো, তোমার মা’র এসব স্বেচ্ছাচার কিছুতে সহ্য করব না। তোমার মা বলে রেহাই দেব না।
–কি করবে? মা’র নামে চার্জশীট আনবে?
–দরকার হলে তাও করতে কুণ্ঠিত হব না এটা জেনো।…এই বেবি, সরে আয় এদিকে, সরে আয় বলছিসিঁদুর পরেছিস! লজ্জা করছে না? উঠে আয় বলছি!
সিন্দুররেখা একটু ছিল বৈকি, নবোঢ়ার গৌরবদীপ্ত উজ্জ্বল রেখা নয়, ভীরু কুণ্ঠিত ক্ষীণ একটু আভাস…চিত্রলেখার রুমালের ঘর্ষণে সেটুকু মুছিয়া যায়–শুধু একটু বেদনাময় আভাস রাখিয়া।
তাপসী অমন শুষ্ক চোখে তাকাইয়া থাকে কেমন করিয়া? ঘন পল্লব বেষ্টিত বড় বড় দুই চোখের বড় বড় জলের ফেঁটাগুলি হারাইয়া গেল কোথায়? শুকনো পাংশুমুখে চোখ দুইটা বড় বেমানান দেখিতে লাগে।
–যাও সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেল গে, আর দ্বিতীয় দিন যেন এসব অসভ্যতা দেখতে পাই না। মায়ের আদেশে অন্ততঃ এইটুকু উপকার হয় তাপসীর, মায়ের সম্মুখ হইতে সরিয়া যাইবার একটা ছুতা পায়।
মণীন্দ্র একটু তিক্ত হাসির সঙ্গে বলেন–চিহ্নটা মুছে ফেলতে পারো–ঘটনাটা তো মুছে ফেলবার নয়!
বিরক্তিটা কেবলমাত্র চিত্রলেখার ওপরই নয়, মায়ের উপর–হয়তো বা নিজের ভাগ্যেরও উপর।
চিত্রলেখা মুহূর্তে জ্বলিয়া উঠিয়া উত্তর করে–তুমি কি আশা করছ এই খেলাঘরের রাবিশ বিয়ে আমি সমর্থন করব?
–খেলাঘরের আর কি করে বলা চলে? অনুষ্ঠানের তো কিছুই ত্রুটি হয়নি শুনলাম– কুশণ্ডিকা সপ্তপদী পর্যন্ত হয়ে গেছে!
–কন্যা সম্প্রদান বলে একটা কথা আছে না? তোমার অনুপস্থিতিতে তোমার মেয়েকে সম্প্রদান করা হয় কোন্ আইনে? কোন্ অধিকারের বলে অপর কারো পক্ষে এ কাজ সম্ভব হয়?
–হিন্দু আইনের বলেই হয়। আমার পরিবর্তে আমার মা কন্যা সম্প্রদান করলে সেটা আইনের চক্ষে অসিদ্ধ নয় চিত্রা।
–তাহলে তুমি এটাকে বিয়ে বলে মেনে নিতে চাও?
–উপায় কি! ওপরে যতই ময়ূরপুচ্ছ এঁটে বেড়াই, ভেতরে তো হিন্দু ছাড়া আর কিছুই নই। আমরা! অগ্নি-শালগ্রাম সাক্ষ্য করা হিন্দু বিবাহ নাকচ করে দেব কিসের জোরে?
–কিসের জোরে নাকচ করা যায় সে তোমাকে শেখাবার রুচি নেই, কিন্তু কি করে করা যায় দেখিয়ে দেব জেনো। বেবির যদি উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত বিয়ে আমি না দিই, তাহলে আমি–, সভ্যতা ভব্যতা এবং আধুনিকতার বহির্ভূত কটু একটা দিব্যি উচ্চারণ করিয়া ঠিকরাইয়া বাহির হইয়া গেল চিত্রলেখা।
মণীর নিষ্ঠুরের মত চলিয়া যাওয়ার পর হেমপ্রভা প্রথমটা বজ্রাহতের মতই স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিলেন, ক্রমশ নিজেকে প্রস্তুত করিয়া লইলেন। ভালোই হইল যে মায়ার বন্ধন মুক্ত করিয়া দিতে ভগবান এমন করিয়া সাহায্য করিলেন। কি মিথ্যার উপরই প্রাসাদ গড়িয়া বাস করা। সে প্রাসাদ যদি ভাঙিয়া পড়ে তো পড়ক, হয়তো ঈশ্বরের আশীর্বাদ সেটা।
পয়সার খোঁটাটাই বড় কঠিন হইয়া বাজিয়াছে। পয়লার লোভে হেমপ্রভা একটা অসঙ্গত কাজ করিয়া বসিতে পারেন–এত অনায়াসে এত বড় কথাটা উচ্চারণ করিল মণীন্দ্র! ছেলের উপর দুরন্ত অভিমানটা বৈরাগ্যের বেশে আসিয়া দেখা দেয়।
নিজের দিকটাই এত বড় হইয়া উঠিল। মায়ের মনের দিকটা একবার তাকাইয়া দেখিল না! কী লজ্জায় কুণ্ঠায় মরমে মরিয়া আছেন তিনি, সেটা অনুভব করিবার চেষ্টা মাত্র করিল না! যা ঘটিয়া গিয়াছে তাহার তো চারা নাই, কিন্তু এত অগ্রাহ্য করিয়াই লাভ কি? একেবারে স্থির বিশ্বাস করিয়া বসিল–অপাত্র! নিজেই একবার দেখাশোনা করো, ম্লেচ্ছ খৃষ্টান নও যৈ মেয়ের আবার বিবাহ দিবে! অল্প বয়সে বিবাহ দিয়া অনেকে তো ছেলেকে জামাইকে বিলাতেও পাঠায়। তাই কেন মনে করো না? না হয় পাঁচ-সাত বৎসর ছাড়াছাড়িই থাকত?-বারো বছরের মেয়ের যৌবন আসিতে কত যুগ লাগে? পরিপুষ্ট গঠনভঙ্গির ভিতর এখনই কি ছোঁয়া লাগে নাই তার?…আচ্ছা বেশ, ফ্যাশানের দায় চাপাইয়া নবযৌবনা কন্যাকে শিশু করিয়া রাখ–কিন্তু হেমপ্রভা যদি মনে-প্রাণে নিষ্পাপ থাকিয়া থাকেন, একদিন নিজেদের ভুল বুঝিতে হইবে তোমাদের।
ভগবানের কাছে বার বার প্রার্থনা করিতে থাকেন হেমপ্রভা–অগ্রাহ্য অবহেলায় যার নামটা পর্যন্ত শুনিতে রুচি করিল না মণীন্দ্র, সেই ছেলেই যেন শিক্ষায়দীক্ষায় চরিত্র-গৌরবে উজ্জ্বল হইয়া ওঠে, লোভনীয় হইয়া ওঠে। নিতান্তই বড় স্নেহের তাপসীর ভাগ্যের সঙ্গে জড়িত তাই, তা নয়তো হয়তো হেমপ্রভা অভিসম্পাত দিয়া বসিতেন–সেই লোভনীয় বস্তুর পানে চাহিয়া যেন একদিন অনুতাপের নিঃশ্বাস ফেলিতে হয় মণীন্দ্রকে চিত্রলেখাকে।…না থাক, হেয়প্রভা কায়মনে আশীর্বাদ করিতেছেন–তাপসীর ভবিষ্যৎ যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন না হয়। তবে হেমপ্রভা এবার সরিয়া যাইতে চান।
নিজস্ব সমস্ত সম্পত্তি তাপসীর নামে দানপত্র করিয়া দিয়া হেমপ্রভা আষাঢ়ের এক বর্ষণমুখর রাত্রে সর্বতীর্থসার বারাণসীর উদ্দেশে রওনা হইয়া গেলেন। কলিকাতার বাড়ীতে আর ফিরিলেন না।
তাপসীর উপর অনিচ্ছাকৃত যে অপরাধ করিয়া ফেলিয়াছেন তাহারই খেসারৎ স্বরূপ বোধ করি এই দানপত্র।
শাশুড়ীর আক্কেল দেখিয়া চিত্রলেখা আর একবার স্তম্ভিত হইল। এ কি ঘোর শত্রুতা! তাছাড়া বেবিকে লায়েক’ হইয়া উঠিবার আবার একটি সুযোগ করিয়া দেওয়া হইল! একেই তো মেয়ে মায়ের তেমন বাধ্য নয়, আবার অতগুলো বিষয়-সম্পত্তির মালিক হইয়া উঠিলে রক্ষা থাকিবে?…চিত্ৰলেখার বিরুদ্ধে এ যেন যুদ্ধ ঘোষণা হেমপ্রভার! শাশুড়ীর কাশীবাসের সংবাদে যথেষ্ট হৃষ্ট হইবার সুযোগ আর পাইল না বেচারা!
যাক তবু নিষ্কণ্টক!