হৃদয়ে ফুটল কুসুম
পিকলুদের বাড়ির পিছনদিকে বড় একটি পানা পুকুর আছে। সেটা কচুরিপানায় ভরা। পুকুরের ধার ঘেষে একটি শিরীষ গাছ। জোরে হাওয়া বইলে, গাছের সরু ডালগুলি দুলে ওঠে। শনশন করে একটা ভূতুরে আওয়াজ হয় গাছটায়। কুচি-কুচি কিছু পাতা নাচেতে নাচতে গাছের নীচে ঝরে পড়ে। পূর্বদিকে পুকুরের ওপাশে, নিতাই মল্লিকদের বাঁশবন। শনশন হাওয়াটা সেখানে ঢুকে গিয়ে ফিসফিস করে কী সব কথা কয় যেন ! ঠিক বোঝা যায় না।
যেহেতু পুকুরের দিকটা বাড়ির পিছন দিক, তাই বাথরুম পায়খানা করার জায়গা ওদিকটায় করা হয়েছে। দিনের বেলা সেদিকে যেতে কোন অসুবিধা বা ভয় হয় না। রাতের বেলা একা একা সেদিকটায় যেতে গা ছমছম করে ওঠে ভয়ে। তার কারণ আছে।
পিকলুর এক ডিভোর্সি এক পিসি আছে। থাকে এখানে। পিকলুর মা নেই। পিকলুর জন্মের কয়েক মাস পরেই, তার মা মাথায় গোলমাল শুরু হয়। হঠাৎ একদিন সে, কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে যান বাড়ি ছেড়ে।
বাবা ভবঘুরে মানুষ। যাত্রা-গান করে বেড়ায়। থাকে এখানে সেখানে। বাড়ি আসে কালে-ভদ্রে। পিকলু এই পিসির কাছেই মানুষ। সে নাকি একদিন রাতে পায়খানা করে ফিরবার সময়ে, একটা ভূতকে শিরীষ গাছ থেকে নেমে পানা পুকুরের উপর দিয়ে হেঁটে বাঁশ বাগানের দিকে যেতে দেখেছিল।
তারপর থেকে বাড়ির সকলেই রাতে ওই দিকটায় যেতে ভয় পায়।
বাড়িতে পিসি ছাড়া আর থাকেন কাকা কাকিমা ও ঠাকুর্দা। পিকলু আর পিসি থাকে একসাথে। আর কাকা কাকিমা ঠাকুর্দা একসাথে থাকেন। দু’টো হাড়ি। কাকিমা নিজেদের জন্য রান্না করেন। পিকলুর আর নিজের জন্য রান্না করে তার পিসি। পিসির মনটা খুব ভাল। দয়া মায়া আছে মনে।
পিকলুরা আসলে উদ্বাস্তু। পূর্ববাংলা থেকে দেশ স্বাধীন হবার পর, তার ঠাকুর্দা অবিনাশ দাস ১৯৪৮ সালে বরিশাল ছেড়ে এদেশে চলে এসেছিলেন। তখন কী অবস্থা তাদের পিকলু শুনেছে ঠাকুর্দার মুখে। শ’য়ে শ’য়ে লোক এসে জড়ো হল শিয়ালদহ স্টেশনে।ঠাকুর্দারাও জড়ো হয়েছিলেন সেখানে। একবারে নরক-গুলজার অবস্থা। যেখানে রান্না খাওয়া, সেখানেই স্নানকরা, মলমূত্র ত্যাগ, এমন কি প্রকাশ্যে জৈব-ক্রিয়া সম্পন্ন হত। কাউকে সে ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠতে দেখা যেত না সে সময়। নিত্যদিন পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া অশান্তি লেগেই থাকত ঘুমের সময়টুকু ছাড়া। সেখানে বেশ কিছুদিন এই দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যে থাকার পর, একদিন পুলিশের তাড়া খেয়ে ঠাকুর্দারা শিয়ালদহ স্টেশন ছেড়ে এসে উঠলেন, কালীঘাট পোড়া বস্তির একটা ভাড়া করা টালির ঘরে। একটা মাত্র ঘর। সেখানেই রান্না খাওয়া শোয়ার ব্যবস্থা করতে হত কষ্ট করে। আর একটি মাত্র বারোয়ারি খাটা পায়খানা ছিল সকলের মল-মূত্র ত্যাগ করার জন্য। সেখানে ভোর বেলা থেকে লাইন লেগেই থাকতো। সে এক কষ্টদায়ক পরিস্থিতি ছিল।
পিকলুর বাবা কাকা আর পিসির জন্ম বরিশালে। পিকলুর জন্ম হয়েছে চেতলা হাসপাতালে। তখন ওরা থাকত কালীঘাট পোড়া বস্তিতে। পোড়া বস্তি নাম হয়েছিল কারণ বিশ্বযুদ্ধের সময় ওখানে বিমান থেকে বোম পড়ে পুড়ে গেছিল বস্তিটা। সেবার হাতিবাগানেও নাকি বিমান থেকে বোম পড়েছিল।
একদিন ঠাকুর্দা অনিলের কাছে খবর পেলেন, অনিল যে সিগারেট বিড়ির দোকানে কাজ করে, সেখানে এক খরিদ্দারের কাছে শুনেছে, উদ্বাস্তুরা নাকি গড়িয়ার কাছে মুসলমানদের ছেড়ে যাওয়া জমিতে বসবাস করা শুরু করেছে।
তার কয়েকদিন পর ঠাকুর্দাও এসে এখানে একটা একচালা ঘর তৈরী করে একা বাস করতে থাকেন। সেটা ছিল একটা চাষের জমি। পাশেই ছিল বড় একটা পুকুর। যেখান থেকে জল নিয়ে চাষের জমিতে দেওয়া হত বোধহয়।
পিকলুর বাবা কাকা পিসি আর তার মা পোড়া-বস্তির সেই ভাড়া বাড়িতে থেকে গেল। তারপর আদি-গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। ঠাকুর্দার কাছে পিকলু শুনেছে প্রথম প্রথম রাতের দিকে মুসলমানরা ‘আল্লা হো আকবর’ ধ্বনি তুলে, হাতে ধারালো অস্ত্র দা-কাস্তে নিয়ে তারা উদ্বাস্তুদের তাড়া করে আসত। ঠাকুরদার মতো উদ্বাস্তরা তখন, ঘর থেকে স-দলবলে সকলে মিলে বেরিয়ে পড়ে, ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি তুলে হাতের কাছে পাওয়া দরজার খিল, আঁশ-বঁটি নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলত। মুসলমানরা তাদের সংখ্যা দেখে আর এগোতে ভরসা পেত না। ফিরে যেত। ফিরে না গিয়ে এগোলে নিশ্চিতভাবেই একটা রক্তগঙ্গা দাঙ্গা বেঁধে যেত। মাঝে মাঝে এই গন্ডগোলের জন্য থানা থেকে পুলিশও আসত। ঘরে পুরুষদের পেলে ধরে নিয়ে যেত। তাই পুরুষরা পুলিশ আসছে খবর পেলেই, মেয়েদের ঘরে রেখে, নিজেরা বাড়ি ছেড়ে পালাত। এরপর একটি রাজনৌতিক দল ‘উদ্বাস্তু সমিতি’ গড়ে তুলত। ধীরে ধীরে উদ্বাস্তুদের অধিকার কায়েম করল। তাদের সব দাবী দাওয়া নিয়ে সরকারের কাছে আবেদন জানানো হল । মিছিল করে গিয়ে থানায় ডেপুটেশন দেওয়া হল। তাদের সঙ্গে পিকলুর ঠাকুর্দাও গিয়েছিলেন। এইভাবে যখন দু’এক বছরের মধ্যে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে এল, তখন বাবা কাকা পোড়া বস্তির ভাড়া বাড়ি ছেড়ে এখানে এসে উঠলেন। ঠাকুর্দা সংসারের খরচ যোগাবার জন্য বাঘাযতীন বাজারে ফুটপাথের উপর একটা পান বিড়ির দোকান দিলেন। প্রথম প্রথম ঠাকুর্দার সঙ্গে পিকলুর বাবাও বসত দোকানে। একবার কালী পূজার পরদিন, বাজারে এক যাত্রাদল এলো যাত্রা করতে। যাত্রপালার নাম ‘সীতা হরণ’। তাদের অভিনয় দেখে অনিল এত মুগ্ধ হয়ে গেল যে, দোকানদারী করায় আর তার মন রইল না। সেই দিনই ঠাকুর্দাকে একটা চিরকূট লিখে, যাত্রাদলের সঙ্গে সে চলে গেল। প্রথমদিকে মাঝে মাঝেই সে বাড়ি আসত। ঘরে মন বসাবার জন্য ঠাকুর্দা এক গৃহস্থ ঘরের একমাত্র মেয়ে দেখে তার সঙ্গে তার বিয়ে দিলেন। তখন সে বাড়িতেই বেশীরভাগ সময় থাকত। মাঝে মাঝে যাত্রা দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। তারপর পিকলুর প্রসবের সময় বাঙুর হাসপাতালে বাবা যেতেন মার জন্য খাবার নিয়ে। সন্তান কোলে নিয়ে, বউকে রিক্সায় বসিয়ে বাড়ি ফিরে ছিল। ঠাকুরদা তা দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। ভেবে ছিলেন সন্তানের আকর্ষণে, অনিল এবার যাত্রাপালার আকর্ষণ ভুলতে পারবে। অনিল মানে পিকলুর বাবা। পিকলুর জন্মের দু’তিন মাসের মধ্যেই তার মায়ের মধ্যে মানসিক গোলমাল শুরু হলো। ঠিক মতো স্নান-খাওয়া করত না। ঘরের কোন কাজ কর্ম করতো না। তারপর হঠাৎ একদিন সে কাউকে কিছু না বলে, বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে যায়। সে ঘর ছেড়ে চলে যাবার পর অনিল অনেক খোঁজ-খবর করেছিল তার। কোথায়ও খুঁজে না পেয়ে, আবার অনিল (পিকলুর বাবা) একদিন গৃহ ত্যাগ করল। সংসার থেকে তার টান যেন চিরতরে উঠে গেল।
ঠাকুর্দার বয়স হওয়ায় ঠাকুর্দা এখন আর দোকানে যেতে পারেন না। দোকানটা এখন কাকা চালান। তার নাম সুনীল।
পিসি দু’একটা বাড়িতে সকালে রান্নার কাজ করে। সেটা এই উদ্বাস্তু কলোনীর থেকে একটু দূরে, বস্তির বাইরে কেনা জমির বাবুদের বাড়ি। উদ্বাস্তু কলোনীতে কে রান্নার লোক রাখবে? কার এত টাকা -কড়ি আছে? পিসি পিকলুকে মুড়ি খেতে দিয়ে সেখানে কাজে যায়। দুপুরে পিকলু প্রাইমারী স্কুলে পড়তে যায়। সেখানে খাবার দেয়। বিকেলবেলা বাড়ি ফিরলে পিসি তাকে খেতে দেয়। পিসির ভাল নাম দুর্গা। ডাক নাম বুড়ি।
বাড়ির সামনের দিকে একটা পেয়ারা গাছ আছে। সেখানে টিয়া পাখি এসে মাঝে মাঝে বসে। পাকা পেয়ারা ঠুঁকরে খায়। নিচেও অনেক পাকা পেয়ারা পড়ে থাকে। দুপুরে বাড়ি থাকলে পিকলুও দু’একটা কুড়িয়ে নিয়ে খায়। পিসি তখন ঘরে ঘুমায়।
সেদিন দুপুরে তেমন দু’টো পেয়ারা নিয়ে পুকুরপাড়ে শিরীষ গাছের ছায়ায় বসে খাচ্ছিল। দেখল একটা কাঠবিড়ালি গাছটা থেকে তড়তড় কনর নেমে এলো। এ’দিক সে’দিক দু’এক চক্কর দিয়ে পিকলুর দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে রইল।
তা দেখে পিকলু বলে উঠল,
কাঠবিড়ালি কাঠবিড়ালি পেয়ারা তুমি খাও?
দুধ মুড়ি খাও?
কাঠবিড়ালি বলে উঠল, খাই খাই, সব খাই।
পিকলু তখন একটা পেয়ারা তার দিকে ছুঁড়ে দিতেই। কাঠবিড়ালি টুক করে সেটা লুফে নিয়ে, তড়তড় করে শিরীষ গাছটায় উঠে গেল।
সকালে পিসি তাকে মুড়ি খেতে দিলে, সে এসে কাঠবিড়ালিকে ডাকে, বন্ধু তুমি কোথায়? তার ডাক শুনে কাঠবিড়ালি গাছে থেকে নেমে এসে বলে, ডাকছ কেন?
– এই নাও, তোমার জন্য মুড়ি এনেছি, খাও।
পিকলু বলে।
কাঠবিড়ালি শুনে বলে, তুমি আমার ভাল বন্ধু।
তারপর কাঠবিড়ালিটা পিকলুর দেওয়া মুড়িগুলি খুঁটে খুঁটে খেতে থাকে।
এইভাবে কাঠবিড়ালির সঙ্গে পিকলুর খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায়। পিকলু স্কুলে গিয়ে চম্পার কাছে কাঠবিড়ালির গল্প বলে। চম্পা বড় বড় চোখ করে তার কথা শোনে। বিস্ময়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পিকলুর দিকে।
জানুয়ারি মাসে পুকুরটা কচুরিপানার বেগুনি ফুলে ভরে যায় । তখন পুকুরটাকে একটা ফুলের বাগান বলে ভুল হয়। চম্পা একদিন স্কুল ছুটির পর কাঠবিড়ালি দেখতে পিকলুদের বাড়িতে এসেছিল। সে পুকুরটাকে দেখে একটা ফুলের বাগান ভেবে ভুল করেছিল। তা জেনে পিকলু হেসেই বাঁচে না। সেদিন অবশ্য পিকলু চম্পাকে কাঠবেড়ালি দেখাতে পারেনি। কিন্তু চম্পার তাতে কোন দুঃখ ছিল না। সে পিকলুদের বাড়ির পাশে এমন সুন্দর একটা বেগুনি ফুলের বাগান দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরেছিল।
দু’তিন দিন কাঠবেড়ালি বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল না পিকলুর। সে ভাবল বন্ধুর হল কি? সে আসছে না কেন? তিন-চার দিন পর তার সঙ্গে দেখা হল পিকলুর। তাকে দেখে পিকলু বলল, এতদিন আসনি কেন বন্ধু?
– আমি তো এখানে ছিলাম না
– কোথায় ছিলে?
– মাসির বাড়ি বেড়াতে
– কেন সেখানে কি?
– মাসির মেয়ের বিয়ে ছিল
– মাসির বাড়ি কোথায়?
– অই তো বাঁশবাগানের ধারে গাব গাছটায়।
– কি করে যাও সেখানে?
– কেন? এই কচুরিপানার উপর দিয়ে হেঁটে।
কাঠবিড়ালির কথা শুনে পিকলুর মনে পড়ল,
মাসিও বলেছিল, একটা ভূতকে শিরীষ গাছ থেকে নেমে পানা পুকুরের উপর দিয়ে হেঁটে বাঁশ বাগানের দিকে যেতে দেখেছিল।
সে কথা মনে পড়তেই পিকলু কাঠবেড়ালিকে বলল, তুমি এই শিরীষ গাছটার কোথায় থাক?
– অই মগডালের একটা কোটরে।
– আচ্ছা তুমি কি জানো, এই শিরীষ গাছে একটা ভূত থাকে?
– জানি তো। আমার খুব বন্ধু হয়
– তাই নাকি?
– হ্যাঁ তো?
– কি করে ভূতটা?
– সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমায়। রাতে এ”পাড়া সে’পাড়া ঘুরতে বের হয়, যখন আমি ঘুমাই।
পিকলুর ভূত দেখার খুব ইচ্ছে।
তাই সে কাঠবেড়ালিকে বলল, একদিন তোমার ভূত বন্ধুকে আমাকে দেখাবে?
– আচ্ছা, ওকে বলে দেখি, কি বলে।
– ঠিক আছে। আমার বন্ধু হামিদা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল পর্শু।
– তাই নাকি?
– হ্যাঁ, তুমি তো ছিলে না এখানে, তোমার মাসির বাড়ি গেছিলে।
– ঠিক আছে, তবে আর একদিন নিয়ে এসো তোমার বন্ধুকে।
– আচ্ছা, আমি বলে দেখব ওকে, দেখি আবার নিয়ে আসতে পারি কিনা।
এইভাবে ভালই দিন কাটছিল পিকলুর। কিন্তু একইভাবে ভাল কারোর চিরদিন কাটে না।
কিছুদিন পর একদল সাপুরে এসে পুকুরের পাশে ছোট মাঠটায় তাঁবু গাড়ল। তাদের কাজ সাপ, বেজী, পাখি এসব ধরে হাটে-বাজারে বিক্রি করা। একদিন কাঠবেড়ালিটাকেও ওরা ধরে ঝুড়িতে পুরে কোথায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিল।
কাঠবেড়ালি বন্ধুকে হারিয়ে পিকলু খুব মুষড়ে পড়ল। কিছুদিন এই মনখারাপ নিয়ে কাটল তার। স্কুলে পিকলুর মুষড়ে পড়া ভাব দেখে, চম্পা জানতে চাইল, কি হয়েছে তোর?
পিকলু তখন চোখের জল না আটকাতে পেরে, কেঁদে বলল, জানিস চম্পা ওই সাপুরেরা আমার বন্ধু কাঠবেড়ালিকে ধরে নিয়ে গেছে। ধরে নিয়ে গিয়ে কোথায় বেচে দিয়েছে।
শুনে চম্পা বিস্মিত হয়ে বলে, তাই নাকি?
– হ্যাঁ-রে চম্পা
– তুই কাঁদিস না, কাঁদলে কি আর তোর বন্ধু ফিরে আসবে?
– না, তা আসবে না। তবে তুই বল, এতে কান্না পায় কিনা?
চম্পা তা শুনে, সান্ত্বনার সুরে বলে, তবু তুই কাঁদিস না।
পিকলু হাতের উল্টো পিঠের চেটো দিয়ে চোখের জল মুছে নিল।
এরপর দ্বিতীয় আঘাত নেমে এলে এল পিকলুর জীবনে। পিসি হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে গেল একদিন। আর বাড়ি ফিরল না। অনেক খোঁজা-খুঁজি করেও তার আর কোন সন্ধান পাওয়া পাওয়া গেল না কোথায়ও। থানা পুলিশ করেও কোনও লাভ হল না। পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করল না এর। কারণ পিসি যে দু’টি বাড়িতে রান্নার কাজ করত, সেখানে গিয়ে পুলিশ একবারের জন্য অনুসন্ধান করেনি। পাড়ায় এসেও তার সম্পর্কে কোন খোঁজ-খবর নেয়নি।
তারই কিছুদিন পর, সংসার চালাবার মতো খরচ ঘরে না থাকায়, একজন কাঠের দোকানদারকে ডেকে ঠাকুর্দা ওই শিরীষ গাছটা দু’হাজার টাকায় বেচে দিলেন। তাদের লোকজন এসে শিরীষ গাছটা করাত দিয়ে কেটে, ভ্যান বোঝাই করে গুঁড়িগুলি নিয়ে চলে গেল।
এরপর পিকলু একেবারে একা হয়ে গেল। এর কিছু পর বাবা বাড়িতে ফিরে এল। পিকলুর জন্য নতুন প্যান্ট-শার্ট কিনে নিয়ে এসেছে। সে পিকলুকে তার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইল। ঠাকুর্দা শুনে বললেন, তোর নিজেরই তো থাকা খাওয়ার ঠিক নেই। ছেলেকে নিয়ে রাখবি কোথায়? ঠাকুর্দা পিকলুকে ছাড়তে রাজী হল না তার সঙ্গে। বলল, ও আমাদের সঙ্গেই এখানে থাকবে।
এ কথা শুনে, বাবা আর কিছু বলতে ভরসা পেল না। বাবা বাড়িতে দু’চার দিন থেকে আবার বেরিয়ে পড়লেন। যাবার দিন পিকলুকে খুব আদর করলেন। পিকলুর চোখে জল এসে গেল।
তারও খুব ইচ্ছে করছিল, বাবার সঙ্গে বাবার হাত ধরে বেরিয়ে পড়তে। কিন্তু সে কি করবে? সে তো খুব ছেলেমানুষ। কে আর তার কথার গুরুত্ব দেবে?
বাবা চলে যাবার পর, পিকলু আবার খুব একা হয়ে পড়ল। পিসি নেই, কাঠবেড়ালি বন্ধু নেই, এমনকি শিরীষ গাছটাও আর নেই। পিকলু আজকাল পুকুরপারের দিকটায় গেলেই, শিরীষ গাছটা নেই দেখে বুকের ভিতরটা খাঁ খাঁ করে ওঠে। পিসির কথা মনেহয়। আর মনেহয় পিসির দেখা ভূতটা এখন কোথায় থাকে? পুকুর পাড়ের দিকটায় আজকাল খুব একটা যায় না পিকলু।
পিসির মৃত্যুর পর ঠাকুর্দাও কেমন মন মরা হয়ে পড়েছে। একা একা বসে কি ভাবে। পিকলুকে একদিন কাছে ডেকে নিয়ে বলে, তোর মতো দুর্ভাগ্য খুব কম আছে। জন্মের সময় মাকে হারালি। এখন আবার তোর পিসিকে হারালি। বাবাটাও তোর ভবঘুরে মানুষ। এবার থেকে তোর নিজের দায়িত্ব নিজেকে বুঝে নিতে হবে।
– কেন দাদাভাই? তুমি তো আছো?
– আমি আর কতদিন?
– ও কথা তুমি বোলো না, দাদাভাই। আমার খুব কষ্ট হয়।
শুনে ঠাকুর্দা আর কিছু বললেন না। চুপ করে থেকে, কী ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কি জানি, কী সব ভাবেন দাদাভাই ! আজকাল পিকলু কাকা কাকিমাদের ঘরে খায়। থাকে নিজের ঘরে।
পিকলু সেখান থেকে উঠে যায়। ঘরের সামনের পেয়ারা গাছটার নীচে গিয়ে দাঁড়ায়। আজও টিয়া পাখিরা পেয়ারা খেতে আসে। পাকা পেয়ারা গাছের নীচে পড়ে থাকে। কিন্তু পিকলুর আজকাল আর পেয়ারা খেতে মন চায় না। ওদিকে তাকিয়ে দেখতেও মন চায় না।
পিকলুদের বাড়িটা কলোনির ভিতরে হলেও, বড় রাস্তার মোড়ে। বাড়ির পিছন দিকে বড় একটা পুকুর। প্রোমোটিংয়ের জন্য আদর্শ একটা প্লট। কলোনীতে বহুদিন আগে থেকেই প্রোমোটিং শুরু হয়েছে। পিকলুর দাকুর্দার কাছেও কয়েকবার কয়েকজন প্রোমোটার প্রোমটিংয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছিল। তিনি দূর দূর করে তাদের তাড়িয়েছেন।
বলেছেন, আর কখনও যেন তোমাদের এমুখো হতে না দেখি। এ সব খবর পাড়ার লোকেরা জানে। তাই আজকাল আর কোন প্রোমোটার তার কাছে ঘেষতে ভরসা পায় না।
পিকলু চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে, পাড়ার চরিত্রটা কেমন বদলে যাচ্ছে। পিকলুরা যখন এই কলোনীতে এসে বসতি গড়েছিল। তখন পিকলুর বয়সছিল দু’বছর। এখন পিকলুর বয়স দশ বছর। মাত্র আট বছরে
আশে পাশের মাঠগুলি ভরে উঠেছে কাঁচা-পাকা বাড়িতে। আগে যে মাঠে পিকলুরা ঘুড়ি উড়াত, সে কত রকমের ঘুড়ি। যেমন- ময়ূরপঙ্খী, চাঁদিয়াল, মুখপোড়া, পেটকাট্টি, চন্দ্রমুখি, চাপরাশী, সতরঞ্জী, মোমবাতি,কড়িটানা, চৌরঙ্গী প্রভৃতি।
বিশ্বকর্মা পূজার সাতদিন আগে থেকে
ঘুড়ি উড়ানো শুরু হতো।শেষ হতো পূজার সাতদিন পর। সে যে কী উন্মাদনা ! মজায় দিনগুলো কেটে যেতো, তা আর কি বলবো?
নিজের হাতে ঘুড়ি তৈরী করে নিতাম। সে ঘুড়ি উড়াবার মজাই ছিল আলাদা। সে সব এখন স্মৃতি। বিশ্বকর্মা পূজার দিন তো সারা আকাশ জুড়ে ঘুড়ির মেলা থাকত সে’সময়। আকাশে তাকালে আজকাল আর সে’রূপ চোখে পড়ে না তার। মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়,রুক্ষতায় ভরে ওঠে।
তাছাড়া অন্য সময়গুলি কাটত – গোল্লাছুট, দাঁড়ি-বান্দা, হা-ডুডু, ডাংগুলি খেলে, সেগুলি এখন আর নেই। আগে ছিল মাটির সরু রাস্তা, পায়ে হাঁটা পথ। দু’পাশে ছোট-বড় নালা। তাতে কচু ও জংলা গাছ হয়ে ভরে থাকত। বর্ষাকালে বৃষ্টির জলে সেই নালাগুলিই ভরে উঠত যখন, সেখানে কই,সিঙ, মাগুড়, ল্যাটা মাছের আমদানী হত। পিন্টু আলপিন বাঁকিয়ে বড়শি বানিয়ে কত মাছ ধরেছে সেখান থেকে। আজকাল সেই নালাগুলি নেই। সেই নালাগুলি ভরাট করে রাস্তা বড় হয়েছে। মাটির রাস্তা ইট সুড়কি দিয়ে পাকা করা হয়েছে। সেখানে আজকাল সাইকেল, ঠেলা, রিক্সা, চার চাকার ভ্যান চলাচল করে। আগে দু’পায়ে চলা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। কাঁচা রাস্তা উঁচু-নীচু থাকার ফলে সাইকেল চালানোও সম্ভব ছিল না। শোনা যাচ্ছে কিছুদিনে মধ্যেই বিজলি বাতির পোস্ট বসবে। কিছুদিন আগেও এখানে শিয়ালের ডাক শোনা যেত। দূরে ঝোপে ঝাড়ে তাদের দেখা পাওয়া যেত, আজকাল আর তাদের দেখা পাওয়া যায় না। তাদের ডাকও শোনা যায় না।
পিকলু যেবার প্রাথমিক স্কুল থেকে পাশ করে হাইস্কুলে ভর্তি হল, সেবার ঠাকুর্দা তাকে একটা স্কুল ব্যাগ কিনে দিয়েছিল। খুব সুন্দর নীল রঙের ব্যাগ। পিকলুর খুব পছন্দ হয়েছিল ব্যাগটা। বই খাতা, জলের ব্যাগ, ছাতা সব রাখার আলাদা আলাদা জায়গা আছে ব্যাগটায়। পিকলু সেটা নিয়েই নতুন হাই স্কুলে যেত। এটা ছেলেদের স্কুল। এখানে কত নতুন বন্ধু হয়েছে তার ক্লাসের ছেলেরা সব।
হাই-স্কুলটা ছিল বেশ মজার জায়গা।
টিফিনের সময় মাঠে ফুটবল খেলা হতো। পিকলুর ফুটবল খেলতে খুব ভাল লাগত। সে খেলতোও খুব ভাল। অন্য স্কুলের সঙ্গে পিকলুদের স্কুলের ইন্টার- স্কুল টুর্মামেন্ট ম্যাচ হতো। যখন সে এইট-নাইনে পড়ে। স্কুলের হয়ে পিকলু সে খেলায় সুযোগ পেতো। টুর্নামেন্ট কাপও জিতে এনেছে, স্কুলের হয়ে। ফলে স্কুলের শিক্ষকরা তাকে স্নেহ করতেন, ভাল বাসতেন।
তখন পাড়ায়ও এপাড়া সাথে পাশের পাড়ার ফুটবল ম্যাচ হতো। পিকলুকে হায়ার করে অন্যপাড়ার জন্যও খেলতে নিয়ে যেতো। সে ম্যাচে জিতলে, তার সম্মানে, খেলার পরে জুটতো ডবল ডিমের মামলেট, আর ঘুগনি পাউরুটি। সেটা খুব আনন্দদায়ক ছিল পিকলুর কাছে।
পাশের পাড়ায় দু’টি ফুটবল টিম ছিল। ‘চ্যাং’ দা আর ‘ব্যাং’ দার টিম। চ্যাং-দা মানে চয়ন চ্যাটার্জীদার টিম। আর ব্যাং-দা মানে বিমল ব্যাানার্জীদার টিম। তারাও পিকলুকে হায়ার করে দূরে দূরে খেলতে নিয়ে যেতেন, গাড়িতে করে।
কখনও বিবেকানন্দ পার্ক। কখনো রবীন্দ্রসদন স্ট্যাডিয়াম। খেলে সেরে বাড়ি ফেরার সময় চ্যা-দা বিশটা টাকা হাতে গুজে দিতেন। সে ছিল তখন পরম প্রাপ্তি। সেই টাকা ইচ্ছে মতো খরচ করতে পারতো পিকলু, কাউকে কোন হিসেব দিতে হতো না। স্বাধীনভাবে খরচ করো। কেউ কিছু বলার নেই।
একবার বিবেকানন্দ মাঠে ফাইন্যাল ম্যাচ। পিকলুকে হায়ার করে নিয়ে গেছে ব্যাং-দা।
মাঠে নেমে পিকলু দুরন্ত খেললো। কিন্তু অপর পক্ষ, প্রতিপক্ষকে গোল করার কোন সুয়োগ দিল না। খেলার হাফ-টাইম পর্যন্ত ড্র। কেউই গোল করতে পারেনি। হাড্ডা-হাড্ডি লড়াই হয়েছে।
দ্বিতীয় হাফে মাঠে নেমে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটা গোল দিয়ে দিল পিকলুদের। সময় ফুরিয়ে আসার আগেই গোল পরিশোধ করতে হবে। খেলা হচ্ছে খেলা হচ্ছে, এমন সময় একটা কর্ণার কিপ পেয়ে গেল পিকলুরা। বাদল কর্ণার কিক করলো। পিকলু প্রতিপক্ষকে আড়াল করে, নিজের পায়ে বলটা নিয়ে, একপাক ঘুরেই বলটা গোলে কিক করলো। গোলকিপার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে বল ধরতে উল্টো দিকে ঝাঁপ দিলো। ‘গোল’ ‘গোল’ বলে মাঠে প্রতিধ্বনি উঠলো। দলের সহ-খেলোয়াররা ছুটে এসে পিকলুকে জড়িয়ে ধরল।
তারপর বাকী সময়টা দু’দলের মধ্যেই টানা-টানি রেশা-রেশির খেলা চললো। খেলা শেষ হওয়ার ঠিক দ’মিনিট আগে পিকলুদের দলের খেলোয়ার
সুমন একটা গোল দিয়ে দলকে জিতিয়ে দিলো।
ম্যাচে জিতে শীল্ড পাওয়ার পর, ব্যাং-দা তো একটা ম্যাটাডোর ভাড়া করে শীল্ড নিয়ে খেলোয়ারদের সঙ্গে করে, হৈ হৈ করে পাড়ায় ফিরে ছিল, আনন্দ করে। সেদিন ব্যাং-দা খেলোয়ারদের দু’টো করে বড় রাজভোগ খায়িয়ে ছিলো। রাজভোগ দু’টো এতো বড় ছিল যে পিকলুর পেট আধা ভরে গেছিলো। বাড়ি ফেরার সময় ব্যাং-দা পিকলুকে হাতে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে, বলেছিল, এটা রাখ্। তোর খেলা ভাল হয়েছে।আরও ভাল করে খেলবি।
সে সময় পিকলু ভেবে ছিল, বড় হয়ে সে সত্যিই খেলায় মন দেবে। খেলোয়ার হবে।
দেখতে দেখতে স্কুলটা পুরনো হয়। স্কুলের বন্ধুরাও পুরনো হয়। পুরনো হযে ঠাকুর্দার নতুন কিনে দেওয়া ব্যাগটা ছিঁড়ে যায়। দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর কেমন করে কেটে যায় পিকলু টের পায় না। এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে সে। এখন তার বয়স ষোল। কৈশোরের দিনগুলি কেমন করে কেটে গেল, সে বুঝতেও পারল না। এর মধ্যে তার বাবা দু-তিন বার বাড়িতে এসেছিল। দু-চার দিন কাটিয়ে আবার চলে গেছেন। বাবার জন্য পিকলু আজকাল আর তেমন কোন টান অনুভব করে না নিজের ভিতর।
সামনে মাধ্যমিকের টেষ্ট পরীক্ষা হবে। তারই প্রস্তুতি চলছে এখন পিকলুর। পিসি থাকলে খুব খুশি হত। মায়ের স্নেহ-মমতা পাওয়া পিকলুর ভাগ্যে ঘটেনি। তার সে অভাব পূরণ করেছিল পিসি। তাই পিসির কথা তার খুব মনে পড়ছিল।
দেখতে দেখতে টেষ্ট পরীক্ষা এসে গেল। পিকলু দিন-রাত এক করে পড়ে পরীক্ষা দিল। পরীক্ষার ফল বের হবার পর দেখা গেল, পিকলু ভাল ফল করেছে টেষ্টে। ষাটের উপরে সব বিষয়েই তার মার্ক। ঠাকুর্দা তা দেখে খুব খুশি হলেন। কয়েকদিন পর তিনি একটা নতুন ঘড়ি কিনে এনে পিকলুকে উপহার দিলেন। পিকলু ঘড়িটা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল।
আজকাল পিকলুর মনেহয়, কাঠবিড়ালির সঙ্গে কি তার সত্যিই কোন কথা হয়েছিল? নাকি সেটা ছিল একটা অলীক কাল্পনিক ভাবনা। ঠিক জানে না পিকলু। সত্যি-ই জানে না।
একসময় যে পিসি ছিল তার একান্ত আপন। পিসি যে ছিল তার কাছে , আজ তো সেটাই তার কাছে অলীক মনে হচ্ছে। বাবা যে আছে তার একটা কোথায়ও, এটাও তো তার কাছে বাস্তব মনেহয় না অনেক সময়।
পিকলু নিজেও আজকাল আর আগের মতো কল্পনাপ্রবণ নেই। অনেক কঠোর কঠিন রূঢ় বাস্তব হয়ে গেছে তার হৃদয়। আগে যেমন তার মনটা একটা কাঁচা কাদার তালের মতো নরম ছিল। আজকাল তার রস-কষ সব শুকিয়ে খটখটে মাটির ডেলা হয়ে গেছে।
পিকলুর মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে কাল থেকে। তার পরীক্ষার সিট পড়েছে দেশবন্ধু হাই স্কুলে। বাসে করে সেখানে যেতে হয় তাকে। প্রথমদিন বাংলা পরীক্ষা হয়ে গেছে। আজ ইংরেজী পরীক্ষা। পিকলু ঠাকুর্দার দেওয়া ঘড়িটা পরে স্কুলে পরীক্ষা দিতে যায় রোজ। সময় মেপে পরীক্ষার সব প্রশ্নের যেন সময়ের মধ্যে দেওয়া যায়, সে কথা ভেবেই সে ঘড়িটা পড়ে পরীক্ষা দিতে যায়।
আজ পরীক্ষা দিতো দিতে পিকলু দেখলো, পাশের ছেলেটা খাতার নীচে লেখা কাগজ রেখে, তা দেখে টুকে লিখছে। দেখে তার খুব শঙ্কা হলো। সে মন স্থির করে প্রশ্নগুলি বুঝে উত্তর দিতে না পারলে তো সে পাশ করতে পারবে না। কিন্তু পাশের ছেলেটাকে কাগজ দেখে টুকতে দেখে মাথাটা কেমন গুবলেট হয়ে গেছে।
সে গার্ডকে বলে, উঠে একবার বাথরুমে গেল। বাথরুম সেড়ে, চোখে-মুখে জল দিয়ে কিছুটা শান্ত হয়ে ফিরে এলো। দেখলো ছেলেটা টোকা-টুকি করতে গিয়ে গার্ডের হাতে ধরা পড়ে, লেখা কাগজের টুকরোটা তার খাতার মধ্যে গুঁজে দিয়েছে।
সে বাথরুম থেকে ফুরতেই, গার্ড তাকে, সেই কাগজের টুকরোটা দেখিয়ে বললো, এ কাগজ তোমার?
– না স্যার। আপনি খাতা মিলিয়ে দেখুন, এ কাগজের লেখা কিছু আমার খাতায় পাবেন না।
গার্ড দু’জনের খাতাই মিলিয়ে দেখে, কাগজের টুকরোর লেখা , ছেলেটার খাতায় পেলো।পিকলুর খাতায় পেলো না। পিকলুকে রেহাই দিয়ে, ছেলেটাকে হল থেকে বহিষ্কার করলো। পিকলুর গা দিয়ে জ্বর সারলো। এবার শান্ত মনে পরীক্ষা শেষ করে হল থেকে বের হলো পিকলু।
এ রকম অভিজ্ঞতা তার প্রথম হলো।
বাকী পরীক্ষাগুলি নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হলো পিকলু।
সুবোধ মল্লিক রোড চওড়া হবে, তাই পাশের ফুটপথের অনেকগুলি দোকান ভাঙা পড়বে। তার মধ্যে কাকার দোকানটাও আছে।
ঠাকুর্দা শুনে বললো, কি করবি এখন সুনীল?
– কি করবো, বুঝতে পারছি না।
– এতে বোঝা-বুঝির কি আছে?
– মানে?
– সরকার দোকান ঘরটা ভাঙার আগে, তুই দোকানের মালপত্র সব বাড়িতে নিয়ে আয়। তারপর দোকানের কাঠামোটা ঠেলা কিংবা ভ্যানে করে বাড়ি নিয়ে এসে, বাড়ির সামনে দোকানটা লাগা। পাড়ায় তো সিগারেট বিড়ির দেকান নেই। সেসব কিনতে বড় রাস্তায় যেতে হয়। লাগিয়ে দ্যাখ, চলে কিনা?
ঠাকুর্দার কথা শুনে কাকা তাই করলো। আগে দোকানের সব মালপত্র ঘরে এনে রাখলো। পরের দিন দোকানের কাঠামোটা ঠেলায় করে বাড়িতে নিয়ে এলো।
বাড়ির সামনে দিয়েই পাড়ার লোকের চলাচলের মাটির কাঁচা রাস্ত। রাস্তার পাশেই একটা ভাল দিন দেখে, দোকান ভাল করে সাজিয়ে, পুরোহিত ডেকে পুজো দিয়ে দোকান খুললো।
সকাল বেলা কাকা উঠে দোকান খোলে। একটু বেলার দিকে উঠে কাকিমা চা করে, কাকাকে চা বিস্কুট দিয়ে যায়। ঠাকুর্দাকেও দেয়। নিজেও খায়। পিকলু চা খায় না। সে শুধু বিস্কুট খায়।
মাস দুয়েক এইভাবে চালিয়ে, তেমন কিছু সুবিধা করতে পারলো না। বিক্রি-বাটা নেই। পাড়ার লোক দু-চার পয়সার বিড়ি কেনে। তাতে চায়ের জলও গরম হয় না। কাকা একদিন ঠাকুর্দাকে সে কথা জানালো। ঠাকুর্দা কাকার কথা শুনে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বারান্দার টেবিলটা দেখিয়ে বললেন, দোকানের পাশে টেবিলটা পেতে, চায়ের দোকান লাগিয়ে দে। বিড়ি সিগারেটের দোকানের সঙ্গে পাঁচ দশ কাপ চা বিক্রি হলে মন্দ কি?
– আমি তো চা বানাতে পারি না
– শিখে নিবি। খুব কঠিন কাজ না। কেউ চা খেতে এলে, প্রথম প্রথম বৌমা ঘর থেকে চা করে পাঠাবে। তুই শিখে নেবার পর, বৌমা ঘরের কাজে হাত আটকা থাকলে, তুই নিজেও করতে পারবি।
পরদিন থেকে বিড়ি সিগারেটের দোকানের সঙ্গে চায়ের দোকানও শুরু হয়।
প্রথম দিন মোট সাত কাপ চা বিক্রি হয়। বিড়ি সাগারেটের বিক্রি সামান্য বাড়ে।
এক সপ্তাহের মধ্যে কাকাও ভাল চা বাননো শিখে নেয়।
প্রথম মাসটা চা সিগারেট বিড়ি বিক্রির বৃদ্ধির কারণে, আয় একটু বাড়ে।
কাকিমা বুদ্ধি দেয়, চায়ের সঙ্গে ঘুগনি আলুর দম বিক্রির ব্যবস্থা রাখো না কেন? আমি ঘরে করে, ডেকচি ভরে দোকানে পাঠিয়ে দেবো।
কাকার মুখে, ঠাকুর্দা এই কথা শুনে বলে, বাঃ, বেশ। বৌমা তো বেশ ভালই বলেছে। তুই তাই কর তাহলে।
ঘুগনি আলুর দম চা বিস্কুট বিড়ি সিগারেট পান-পরাগ, লজেন্স সব পাওয়া যায় বলে, দোকানে আজকাল বেশ ভিড় হয়। বিশেষ করে সকালে সন্ধ্যায়। আয়ও বেশ ভাল হচ্ছে। সংসারের দুরাবস্তা কিছুটা ঘুচছে।
পাড়ার শিবনাথ বিশ্বাস কাঠের কাজ করেন। তিনি একদিন কাকাকে বলেন, কয়েকটুকরো কাঠ জোগাড় করো। তোমাকে দু’খানা বেঞ্চি তৈরী করে দি। পাড়ার লোকেরা চা ঘুগনি খেতে এসে বসতে পারবে। কাকার মনে কথাটা ধরে।
ঠাকুর্দাকে তিনি কথাটা বলেন। ঠাকুর্দা শুনে বলেন, বিশ্বাস তো বেশ ভালো কথাই বলেছেন। কি মাপের কাঠ লাগবে, বিশ্বাসের কাছ থেকে মাপটা লিখে, কাঠের দোকান থেকে কিনে নিয়ে আয়। যা টাকা লাগে আমি দেব।
দেখতে দেখতে দু’দিনে দুখানা শক্ত পোক্ত বেঞ্চ তৈরী করে দেয় শিবনাথ বাবু। কাকা তাকে বললো, আপনাকে মজুরী কত দেবো বলুন।
– আমি আর কি বলবো? আপনি যা খুশি দ্যান।
কাকা তাকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিতে। সে খুব খুশি হয়।
শিবনাথ বাবু লোকটি শান্ত প্রকৃতির নিরিহ মানুষ। পাড়ায় সেই অর্থে তার কোন বন্ধু নেই। আবার সকলের সঙ্গেই তার ভাব। তিন-চারটা ছেলে মেয়ে। তাদের খিদে মেটে না।
শিবনাথ বাবুর স্ত্রী মায়ারানী সারা দিন ছেলে মেয়দের খাবার জোগাড় করতে ব্যস্ত। অকর্মন্য শিবনাথ বাবুকে ধারে কাছে দেখতে পেলে ঝাল ঝারেন।
আর কাকেই বা ঝাল ঝারবেন? ভীষণ মুখরা। মুখে যা খুশি আসে, তাই বলে দেন, যার তার সামনে। তাই শিবনাথ বাবু পারত পক্ষে স্ত্রীর মুখোমুখি হতে চান না। কাকার চায়ের দোকানে এসে বসে থাকেন। সবার কথা একগাল হাসি নিয়ে শোনেন। কাউকে কোন মতামত বা পরামর্শ দেন না। আর লোকেরাও তার তার কাছে কোন পরামর্শ চায় না। আর মুখোমুখি হয়ে পড়লে, স্ত্রী যা বলেন, তার কোন জবার দেন না। নির্লিপ্ত ভাবে বসে থাকেন। দেখে মনে হয় না যে তার কানে স্ত্রীর কথাগুলি ঢুকছে।
স্ত্রী মুখ ঝামটা দিয়ে, তাকে খেতে ডাকলে, তিনি রান্না ঘরে গিয়ে ঢোকেন নিরিহ ভঙ্গীতে, অপরাধীর মতোন। তা দেখে তার স্ত্রীর খুব মায়া হয়। তিনি আর কিছু বলেন না। যত্ন করে তাকে খাবার বেড়ে দেন।
শিবনাথ বাবু তাকে বলেন, তুমিও বসো আমার সঙ্গে।
– আহা আর ঢঙ করতে হবে না। তুমি বসো।
শিবনাথ বাবু ভয়ে ভয়ে, সাহস করে তার হাতটা ধরে টেনে নিয়ে তার পাশে বসিয়ে দেয়। মায়ারানী কিছু না বলে, হতভম্ব হয়ে শিবনাথ বাবু মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। খাবার বলতে, শুধু বাড়ির পাশের পুকুরের কলমি শাক চচ্চরি আর লাল চালের মোটা ভাত।
শিবনাথ বা্বু যত্ন করে শাক দিয়ে ভাত মেখে, একগ্রাস ভাত কলাই করা থালা থেকে তুলে নিয়ে
তার মুখের সামনে তুলে ধরে। মায়ারানী এবার আর না করতে পারে না। লাজুক ভঙ্গিতে মুখটা ফাঁক করে হা করে।
শিবনাথ তার হা করা মুখের ভিতরে ভাতের গ্রাসটা ভরে দেয়। তারপরের গ্রাসটা নিয়ে সে নিজের মুখে তুলে দেয়। এক থালাতেই তারা দু’জনে খেতে থাকেন। এমন মোহময় দৃশ্য খুব একটা দেখা যায় না আজকের পৃথিবীতে।
সেবার বর্ষায়, টানা দু’দিন প্রবল বৃষ্টি হওয়ায় পর, পিকলুদের বাড়ির পাশের পুকরটা জলে ভরে গিয়ে পাড়ের চারপাশটা ভেসে যায়। রাস্তা-ঘাট জলে ভরে ওঠে। পিকলুদের বাড়ির উঠোনে জল চলে আসে। ঘরে অবশ্য জল ঢোকেনি। সকালে উঠে পিকলু দেখে লাইন দিয়ে কই মাছ উঠে এসেছে উঠোনে। পিকলু সেগুলি ধরতে গিয়ে হাতে প্রথমটায় মাছের কাঁটা খায়। পরে হাতে মোটা করে গামছা জড়িয়ে নিয়ে পিকলু সাতটা কই মাছ ধরে, তারপর একটা হাড়িতে জলে দিযে সেগুলি ভরে রাখে। বেলার দিকে ঠাকুর্দা ঘুম থেকে উঠে হাড়িতে মাছগুলি দেখে অবাক হয়ে জানতে চায়, এগুলি ধরলো কে?
পিকলু বলল, আমি
– কি ভাবে ধরলি, হাতে কাঁটা মারেনি?
– প্রথমটা ধরতে গিয়ে, হাতে কাঁটা খেয়েছি। ঠাকুর্দাকে ডান হাত তুলে দেখাল সে। তারপর বলল, পরের মাছগুলি হাতে গামছা পেঁচিয়ে ধরেছি।
তিনি সে কথা শুনে পিকলুর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে উঠলেন, সাবাস ব্যাটা।
তারপর একটু উদাস হয়ে গিয়ে বললেন, তোর পিসি এখন এখানে থাকলে খুব খুশি হত। কই মাছ তার খুব পছন্দের ছিল। তেল-কইয়ের ঝাল খুব ভাল রাঁধত সে।
পিসির কথা মনে পড়ায়, তার মনটাও খুব খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে ভাবল, কাউকে কিছু না বলে, পিসি কোথায় উধাও হয়ে গেল? কেন?
পাড়ার লোকেরা অবশ্য আড়ালে-আবডালে বলে পিসি কারও হাত ধরে পালিয়ে গিয়ে আবার বিয়ে করেছে। তাকে নিয়ে চলে গেছে কোথায়ও।
পিসির আগে একবার বিয়ে হয়েছিল মাছঅলা গোপাল দাসের সঙ্গে। তার সঙ্গে বছরখানেক সংসার করেছিল। তারপর কি হল কে, তাদের মধ্যে কারণে-অকারণে ঝগড়া লেগেই থাকত। ঘরে ঝগড়া অশান্তি করে পিসি মাঝে মাঝেই এখানে চলে আসত। এরপর একদিন তাদের বিয়েটা ভেঙে যায়, পিকলু জানে না, কেন।
পিসি তারপর থেকে এখানেই থাকত। দু’একটা বাড়িতে রান্নার কাজ করে নিজের খরচ চালাত। কারও কাছে হাত পাততো না। তার খুব আত্মসন্মান বোধ ছিল। বিবাহ বিচ্ছেদের পর উকিল তাকে খোরপোশের দাবি করতে বলেছিলেন। পিসি তাতে রাজি হয়নি। বলেছে, যে আমায় নিয়ে সংসার করতে চায় না, তার কাছে কেন আমি খোরপোশের দাবি করব? আমি কোনও খোরপোশের দাবি তার কাছে করব না। তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিলাম।
এর কিছুদিন পর গোপাল দাস এক এক মাছের আরতদারের ছোট মেয়ে চম্পাকে বিয়ে করে, এখন বেশ সুখেই আছে মনেহয় তারা।
পিকলুর মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হযেছে কিছুদিন আগে। ফল প্রকাশ হতে দু’তিন মাস দেরী। এই সময়টা পিকলু কি করবে ভাবতে গিয়ে, তার মনেহল, কম্প্যুটারের প্রথমিক পাঠটা এসময়, স্বল্প খরচে, একটা সরকারী কম্প্যুটার সেন্টারে ভর্তি হয়ে, শিখে নিলে মন্দ হয় না। স্কুলের আরও কয়েকজন বন্ধু ভর্তি হবে সেখানে।
ঠাকুর্দাকে সে কথা জানাতে। তিনি তা শুনে বললেন, তুইও ভর্তি হয়ে যা সেখানে, যা খরচ লাগে আমি দেব। এই কথা শুনে পিকলুর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল আনন্দে।
পিকলুর ঠাকুর্দার ব্যাঙ্কে সামান্য কিছু টাকা জমানো আছে, ভবিষ্যতের বিপদ আপদের কথা ভেবে। পিকলুকে টাকাটা তিনি সেখান থেকে তুলেই দেবেন। এটা পিকলুর ভবিষ্যতের ব্যাপার। একটা কিছুতে লেগে না থাকলে সে, এই সময় তার অস্থির মনে কামনার কু-প্রভাব কম পড়বে। এই বয়সটায় কামনার চঞ্চলতা তরুণ মনকে অস্থির করে তোলে। আর তার ব্যর্থতায় মন নানারকম নেশার দিকে ধাবিত হয়, সামান্য স্বস্থির আশায়। কিন্তু সেটা ক্রমশই আসক্তিতে পরিণত হয়ে, তাকে তীব্র আকর্ষণে টেনে ধরে, বিবেক স্খলনের দিকে তাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে, ধীরে ধীরে তাকে অসামাজিক জীব করে গড়ে তোলে। তাই এই সময়ে এমন একটা কিছু নতুন বিষয় শেখাকে আক্রে ধরলে কিছুটা এর আক্রমণ থেকে নিস্তার পাওয়া গেলেও, যেতে পারে।
কম্প্যুটার সেন্টারে ভর্তি হয়ে পিকলু মনদিয়ে কম্প্যুটার শিখতে লাগল। তিনমাসের মধ্যে কম্প্যুটারের প্রাথমিক পাঠ সে সাফল্যের সঙ্গে শেষ করে ফেলল। তার কম্প্যুটার শেখার আগ্রহ, কম্প্যুটার সেন্টারের ইনস্ট্রাকটারে চোখে পড়ল। তার নিষ্ঠা ও সততা তাকে খুশি করল। সে তাকে কম্প্যুটার সেন্টারের দেখভালের দায়িত্ব দিল। তাতে তার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। কম্প্যুটারের হার্ডওয়ার শেখার ইচ্ছে হল তার।
মাধ্যমিকের ফল বেরোলে দেখা গেল।
পিকলু দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেছে।
তার কিছুদিন পরেই পিকলুর বাবা আবার বিয়ে করে, নতুন বউকে নিয়ে বাড়ি এলো। ঠাকুর্দা তা দেখে একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। বললো, হারামজাদা তুই এটা কি করেছিস, আমাদের কাউকে কিছু না জানিয়ে?
তোর বউ আছে, ছেলে বড় হয়েছে।
অনিল বললো, বউ কি আর বেঁচে আছে?
ঠাকুর্দা বললো, মরে গেছে তুই জানিস?
– এতে জানা বোঝার কি আছে? বেঁচে থাকলে এতোদিনে সে নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরে আসতো।
ঠাকুর্দা পিকলুর বাবার কোন কথাই শুনলো না,
তার উপর ভীষণ রেগে গেল। চ্যালা কাঠ তুলে নিয়ে তাকে মারতে গেল। বাবা সরে না গেলে, তার মাথা ফাঁক হয়ে ফিনকি রক্ত বের হতে পারত। এসব দেখে বাবা নতুন বউ সহ বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল। পাড়ার লোকেরা মজা দেখতে এসেছিল।
বাবাকে বউ সহ বাড়ি থেকে দূর করে তাড়িয়ে দিতে কেউ কেউ খুশি হল। আবার কেউ কেউ ঠাকুর্দার নিন্দা করতে লাগল। নতুন মাকে দেখে পিকলুর খুব পছন্দ হয়েছিল। টানা টানা চোখ, টিয়া পাখির মতো নাক, গায়ের রঙ চাঁপা ফুলের মতো সোনালি-হলুদ। দেখতে একেবারে পরির মতো।
জীবনে মায়ের সান্নিধ্য পায়নি পিকলু, তাই তাকে মা বলে খুব ডাকতে ইচ্ছে করছিল। ঠাকুর্দার রাগত ভয়াল মূর্তি দেখে, তা আর সাহস হয়নি পিকলুর। পিকলুর বাবা ঠাকুর্দার সেই ভয়ঙ্কর রূপ দেখে তখনই তার নতুন বউকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিলো। লোকের মুখে এই ঘটনাটা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা পাড়ায়। পিকলুর তাই পাড়ার লোকের কাছে মুখ দেখাতে লজ্জা করতো। তাই সে বেশিরভাগ সময়টাই কম্প্যুটার সেন্টারে কাটাতো।
শীতল বাতাস জানলা দিয়ে এসে ঘরে ঢুকছে। কোথায়ও বৃষ্টি হয়েছে বোধহয। কয়েকটা দিন ধরে উষ্ণতার মাত্রা এতো বেড়ে গেছিল যে আর সহ্য করা যাচ্ছিল না। ঠাকুর্দা বারান্দায় বসে, গুণগুণ করে কী গান ধরেছেন যেন। দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল না। পিকলু তাই তার কাছে গিয়ে শুনতে চেষ্টা করল। ঠাকুর্দা গাইছেন,
‘হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল, পার কর আমারে’।
গানটা ঠাকুর্দার মুখে গানটা শুনে তার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। একমাত্র আপন বলতে, ঠাকুর্দাই তার সম্বল। মা নেই, পিসি নেই, বাবা থাকতেও নেই।
কাকা কাকিমা আছেন, কিন্তু তারা নিজেদের সংসার নিয়েই ব্যস্ত। একমাত্র ঠাকুর্দার কাছে তার মনের চাহিদাগুলি জানাতে পারে। এরপর ঠাকুর্দা চলে গেলে, সে তো একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবে। সে ঠাকুর্দার কাছে গিয়ে বলল, তুমি এসব গান গাইবে না। শুনলে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়। শুনে ঠাকুর্দা গান থামালেন। তারপর ইশারায় তার পাশে বসতে বললেন। পিকলু তার পাশে বসলে, তার গায়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। পিকলু দেখল, ঠাকুর্দার চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। পিকলু হাত দিয়ে তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল, তুমি কেঁদো না ঠাকুর্দা।
কম্প্যুটার সেন্টারে পিকলুর এক বান্ধবী জুটেছে। নাম কুলসুম নূর। মেয়েটি বেশ
বুদ্ধিমতী। অল্পদিনের মধ্যেই কম্প্যুটারের প্রাথমিক পাঠটা শিখে নিয়েছে। সদালাপী এবং দেখতেও আকর্ষণী লাবন্যময়ী। কালোর উপর মুখখানা খুব মায়াবী। চাঁদের আলো মাখা। তাকে বন্ধু পেয়ে পিকলু যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। আজকাল পিকলুর বেশ আনন্দেই কাটছে।
ঠাকুর্দার মুসলমানদের উপর খুব রাগ। তাঁর বদ্ধমূল ধারনা, মুসলমানদের জন্যই তাদের বরিশাল ছেড়ে ছিন্নমূল হয়ে এদেশে পালিয়ে আসতে হয়েছে। তা না, হলে তারা ওখানে সুখেই ছিলেন। তাদের সুখ হরণ করেছে ওদেশের মুসলমানরা। এই বদ্ধমূল ধারনা ঠাকুর্দার মাথায় গেঁথে গেছে। তার মন থেকে এ ভাবনা দূর করা যাবে না।
পিকলু একালের ছেলে, তার মনে ঠাকুর্দার মতো কোনও মুসলমান বিদ্বেশভাব নেই। সে মুক্তমনা স্বভাবের। তাই শাহিনের সঙ্গে মিশতে তার মনে কোন দ্বিধা-দন্দ্ব নেই। সে স্বাভাবিকভাবেই তার সঙ্গে মেলামেশা করে।
একদিন কুলসুম, পিকলুকে তাদের বাড়ি নিয়ে গেছিল। পার্কসার্কাসের কাছে দরগা রোডে একটা ফ্ল্যাটের দোতলায় থাকে। ছিমছাম সাজানো দু’টি ঘর। সংসারে তার আছে, মা আর বাবা। বাবার সাথে পরিচয় হয়নি। শাহিনের মাকে দেখে, কথা বলে মনে হয়েছে, তিনিও শাহিনের মতো খুব মিষ্টি স্বভাবের মানুষ। সহজেই অপরকে আপন করে নিতে পারেন। খুব ভাল লেগেছে পিকলুর তার সঙ্গে পরিচয় হয়ে। শাহিন তার জন্য চা আর ডিম ভাজা করে এনেছিল। শাহিনের মা বলেছিলেন, খাও বাছা। চা আর ডিম ভাজা খেয়ে, কিছুক্ষণ বসার পর ফিরে আসার সময়, শাহিনের মা বলেছিলেন, আবার এসো বাছা। তার মিষ্টি স্বরে যেন আন্তরিকতা ঝরে পড়ছিল।
পিকলুর বাবা অসুস্থ হয়ে জলপাইগুড়ি টাউনের ময়নাগুড়ি হাসপাতালে ভর্তি আছে শুনে, ঠাকুর্দা অস্থির হয়ে উঠলেন। পিকলুকে বললেন, আমার তো অতদূরে যাওয়ার ক্ষমতা নেই। তোর কাকারও দোকান ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তুই যদি একবার গিয়ে দেখে আসতিস তবে ভাল হতো। বাবা অসুস্থ শুনে পিকুরও মনটা কেমন করে উঠল। মা কোথায় আছে, কেমন আছে, আছে কিনা কিছুই জানা নেই। বাবা এখনও আছে তার, দূরে থাকলেও আছে।
পিকলু ঠাকুর্দার কথা শুনে বলল, হ্যাঁ আমি যাব। কালই রওনা হবো। পিকলুর কথা শুনে ঠাকুর্দা যেন স্বস্থির নিশ্বাস ফেললেন।
ঠাকুর্দা সেদিনই ব্যাঙ্ক থেকে তুলে পাঁচ হাজার টাকা দিলেন পিকলুর হাতে। বললেন, অজানা অচেনা জায়গায় যাবি, সাবধানে টাকাটা রাখিস। কারও সাথে অযথা আলাপ জমাতে যাবি না।
পরদিন সকাল পাঁচটায় গড়িয়া থেকে শিলিগুড়ির বাস ধরে পিকলু রওনা হয়ে গেল।
এই প্রথম কলকাতা ছেড়ে পিকলুর কোথায়ও যাওয়া। কি খাবে, কোথায় থাকবে কিছুই জানা নেই পিকলুর। তার কাছে অকূল সমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার মতো।
বাস উল্টোডাঙা পেরিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটতে শুরু করল। পিকলুর খানিকক্ষণ পর ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। পিকলুর সঙ্গে এতগুলি টাকা, সে সতর্ক হয়ে ঘুম তাড়াল। বাইরে তাকিয়ে রইল।
বাস চলছে তো চলছেই। দশটার পর মালদায় এসে গাড়িটা থামল। এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার চলতে শুরু করবে। পিকলু লাগেজ সঙ্গে নিয়ে বাস থেকে নেমে, একটা চায়ের দোকানে দাড়িয়ে চা-বিস্কুট খেল। বাসের অনেকেই সেখানে চা-বিস্কুট খাচ্ছে পিকলু দেখল। সামনে কয়েকটা ভাত পরটার দোকানও আছে। দু’একজন সেখানে ঢুকে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যে তারাও ফিরে এল। বাস আবার ছেড়ে দিল।
বারটা নাগাদ পিকলু শিলিগুড়িতে এসে নামল বাস থেকে। একে একে সকলেই বাস থেকে নেমে গেল। বাস খালি হয়ে গেল।
পিকলু দেখল তার খুব খিদে পাচ্ছে।
সে একটু খোঁজাখুঁজি করতেই ভাতের একটা হোটেল পেয়ে গেল। সেখানে ঢুকে পড়ল। হাত-মুখে জল দিয়ে এসে সে একটা টেবিলে বসল।
একপ্লেট ভাত, ঝিরিঝিরি করে কাটা সামান্য আলু ভাজা, বিস্বাদ ফ্যানের মতো একবাটি ডাল আর একবাটি আলু-পটলের জন্য ১৩০ টাকা খরচ হয়ে গেল। কলকাতায় সত্তর টাকায় এসব জুটে যেত। কোন উপায় নেই। খেয়ে হাতমুখ ধুয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এল সে। বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে লাগল।
সে দেখল, শহরটা বেশ জমজমাট।
এখানে সেখানে মৌচাকের মতো মানুষের ভিড়।বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখল। এখান থেকে অনেক জায়গায় যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। ফালাকাটা, মালবাজার, নকশালবাড়ি, নাগরাকাটা, বীরপাড়া
আরও কত সব জায়গার। সে খোঁজ করে মযনাগুড়ি যাবে এমন একটা বাসে উঠে বসল।
মযনাগুড়ি এসে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল। সেখানে নেমে সে হাসপাতালের খোঁজ করে সেখানে পৌঁছাল।
এনকোয়ারিতে ‘অনিল দাস’ বাবার নাম বলে খোঁজ করতেই,কাউন্টারে বসা লোকটি, একটি রেজিষ্টার খাতা খুলে দেখে, তাকে জানাল, ১৭ নম্বর বেডে খোঁজ করুন।
পিকলু ১৭ নম্বর বেড খোঁজ করে দেখল, বেডটা খালি, কেউ নেই। সে ভাবল, কি হল? বাবা তো এখানে নেই। সে ভাবনায় পড়ল। ভাবল একবার কি গিয়ে, এনকোয়ারির লোকটা বলবে, ১৭ নম্বরে কেউ নেই।
বেডের সামনে দাঁড়িয়ে, পিকলু অসহায় ভাবে ভাবছিল, তাহলে কি এতদূর থেকে এত কষ্ট করে এত খরচ করে এসে বাবার সঙ্গে তার দেখা হবে না। আবার তাকে ফিরে যেতে হবে কলকাতা? ফিরে গিয়ে কি জবার দেবে ঠাকুর্দাকে? যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। পিকলু এইসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। কখন এসে একজন শীর্ণকায় লোক সেই বেডে এসে বসেছে,পিকলু খেয়াল করেনি। লোকটার ডাকে পিকলুর সম্বিত ফিরল।
পিকলু তুই কখন এসেছিস?
কথাটা শুনে সে লোকটার দিকে তাকিয়ে বাবা বলে চিনতে পারল না। কী চেহারা হয়েছে তার। চোখ দুটি ভিতরে বসে গিয়ে ছোট হয়ে গেছে। গাল দু’টি চুপসে ভিতরে ঢুকে গেছে, দুু’পাশের হনু দু’টি বেরিয়ে প্রকট হয়ে পড়েছে।
পিকলু তাকে না চিনতে পারলে কি হবে? পিকলুর বাবা তাকে চিনতে পেরেছে। পিকলু বলল, তুমি কোথায় গেছিলে? আমি তো এসে তোমায় না দেখে খু্ব ঘাবড়ে গেছিলাম। শুনে মলিন হেসে তার বাবা বলল, পেচ্ছাব করতে ল্যাট্রিনে গেছিলাম।
– তুমি কেমন আছ, বাবা।
– ভাল নেই রে। তুই এখান থেকে আমাকে নিয়ে চল। এখানে থাকলে আমি আর বাঁচব না রে।
– ঠিক আছে দেখি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে।
সেই দুপুরে শিলিগুড়িতে একথালা ভাত খেয়েছিল । এখন সন্ধ্যায় বেশ খিদে পাচ্ছে তার। ভাবল, ভিজিটিং আওয়ারস শেষ হলে, হাসপাতাল থেকে বাইরে বেরিয়ে, ঘুগনি-রুটি খেয়ে নেবে। ভিজিটিং আওয়ারস শেষ হওয়ারও একঘন্টা পরে, ডাক্তার এসে বসেন। তখন বাবার ব্যাপারে তার সঙ্গে কথা বলে, বাবার কি হয়েছে জানতে পারবে। ভিজিটিং আওয়ারস শেষ হওয়ারও একটু আগে, পিকলু বাবার কাছে জানতে চাইল, বাবা তুমি কিছু খাবে এখন?
– কি আর খাব? পারলে, একভাঁড় দই এনে দে।
– আচ্ছা বলে পিকলু বাইরে বেরিয়ে এল। বড় রাস্তার কাছে একটা দোকানে বসে সে একটা পাওরুটি আর এক প্লেট ঘুগনি নিয়ে খেল। পরে ফেরার সময় একটা মিষ্টির দোকান থেকে ২০০ গ্রামের দইয়ের একটা ভাঁড়, আর দু’টো বড় বড় রাজভোগ কিনে নিল। তারপর সেগুলি নিয়ে বাবার হাতে দিয়ে বলল, নাও খাও। পিকলু দেখল, সেগুলো দেখে বাবার চোখ চকচক করে উঠল, খুশিতে। যেন কতদিন খায়নি এসব, এইভাবে সে দই- মিষ্টি খেতে লাগল।
পিকলু বলল, বাবা তুমি খাও, আমি দেখে আসি ডাক্তার এসে অফিস রুমে বসেছে কিনা।
বাবা তৃপ্তি সহকারে খেতে খেতেই বললেন, আচ্ছা যা। আমাকে এখান থেকে ছুটি করিয়ে নিবি। কথাটা শুনে পিকলুর খুব কষ্ট হল। চোখ ছলছল করে উঠল। সে৷ কিছু জবাব না দিয়ে, বাবার কাছ থেকে উঠে, অফিস ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। অফিসের সামনে গিয়ে দেখতে পেল, ভিতরে দু’জন বসে আছেন। একজন মহিলা, একজন পুরুষ মানুষ। তারা নিজেদের মধ্যে কী কথা বলছিল। পিকলু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ভিতরে আসতে পারি?
মহিলা বলল, আসুন।
পিকলু ভিতরে ঢুকতেই, এবার পুরুষ মানুষটি জানতে চাইল, কাকে চান?
– আমি ডাক্তার বাবুর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
লোকটি এবার বলল, কি বলবেন বলুন? আমিই ডাক্তার।
পিকলু এবার তাকে নমস্কার করে বলল, আমি ১৭ নম্বর বেডের অনিল দাসের অসুখের ব্যাপারে জানতে চাই, কি হয়েছে তার?
– আপনি কে হন তার?
– ছেলে।
– ও আচ্ছা। আপনি কি জানেন, আপনার বাবা মদ খান?
– না। উনি আমাদের সঙ্গে থাকেন না। উনি কখন কোথায় থাকেন, তাও আমরা জানি না। উনি এখানে সেখানে ঘুরে ঘুরে যাত্রা নাটক করে বেড়ান।
ডাক্তার বাবু সব শুনে বললেন, অনিল বাবু মদ খেয়ে খেয়ে লিভার আর কিডনির বারটা বাজিয়ে ফেলেছেন। কিডনি কাজ করছে না। ওনাকে বাঁচাতে হলে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে হবে। এখানে সে ব্যবস্থা নেই, আপনাকে শিলিগুড়ির বড় হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তা করাতে হবে।
– কত খরচ হবে তাতে? পিকলু জানতে চাইল।
– তা কম করেও পাঁচ- সাত লাখ টাকা লাগবে।
শুনে পিকলুর মাথাটা ঘুরে গেল। সে ভাবল পাঁ…..চ….. সা……ত…… লা…….খ !
এত টাকা কোথা থেকে জোগার হবে? সে আর ভাবতে পারে না।
সে ডাক্তার বাবুর কাছে সব শুনে বাইরে বেরিয়ে এল। বাইরে বেরিয়ে এসে প্রথমেই কলকাতায় কাকাকে ফোন করল। কাকা ফোন ধরতেই সে কাকাকে সব কথা যতটা সম্ভব গুছিয়ে বলার চেষ্টা করল। সে সব শুনে বলল, তুই বাবার সঙ্গে কথা, একটু ধর, আমি বাবাকে ডেকে দিচ্ছি।
একটু পরে ঠাকুর্দা এসে বলল, হ্যাঁ পিকলু বল, কি হয়েছে?
পিকলু আবার তাকে ডাক্তারের বলা সব কথা গুছিয়ে বলল। দাকুর্দা সব শুনে বলল, তুই অনিলকে এম্বুলেন্স করে কলকাতায় নিয়ে আয়।
যা করার এখানেই করা হবে।
পিকলু ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলল, আমি বাবাকে কলকতায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাব। আমি বন্ড লিখে দিচ্ছি, আমি নিজ দায়িত্বে বাবাকে কলকাতা নিয়ে যাচ্ছি। আপনি বাবাকে ডিসচার্জ সারটিফিকেট লিখে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।
রাতটা হাসপাতাল চত্বরে কাটিয়ে, পরদিন সকালেই হাসপাতাল কতৃপক্ষর সাথে কথা বলে, একটা এম্বুলেন্স ভাড়া করে পিকলু বাবাকে ময়নাগুড়ি থেকে কলকাতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করল। সঙ্গে কিছু কলা ও আর পাউরুটি কিনে নিল, খাওয়ার জন্য।
কলকাতায় ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে গেল।
স্থানীয় কাউন্সিলার বিশ্বনাথ বাবুর সঙ্গে ঠাকুর্দার কাউন্সিলার হবার আগে থেকেই ভাল জানা পরিচয় ছিল। ঠাকুর্দার তার সঙ্গে কথা বলে অনিলকে বাঙুর হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিতে বললেন। বিশ্বনাথ বাবু মানুষটি সহৃদয় এবং মানবদরদী। তিনি হাসপাতালের সুপারকে তার প্যাডে অনিলের ভর্তির জন্য সুপারিশ পত্র লিখে পাঠালোর হাসপাতালে ভর্তি করে নেবার জন্য। হাসপাতালের সুপারকে বিশেষভাবে জানাল, অনিল ভীষণ দুস্থ ও অসহায় পরিবারের একজন লোক, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে না নিলে, সে হয়তো বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে।
পিকলু সেই সুপরিশ পত্র সঙ্গে নিয়ে, স্থানীয় একটা ক্লাব থেকে এম্বুলেন্স ভাড়া করে, বাবাকে নিয়ে বাঙুর হাসপাতালে গেল। সুপার সুপারিশ পত্র পড়ে, হাসপাতালের আনুষ্ঠানিক কিছু নিয়ম কানুনের ফর্ম তাকে দিয়ে পূরণ করিয়ে নিয়ে, বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি হবার ব্যবস্থা করে দিলেন।
বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে, কয়েকদিন কম্প্যুটার সেন্টারে যেতে পারেনি পিকলু। কয়েকদিন পিকলুর দেখা না পেয়ে শাহিন মনে মনে খুব অস্থির হয়ে পড়েছিল। ভেবেছে, এমন কি হয়েছে যে পিকলু কম্প্যুটার সেন্টারে আসছে না? তার আবার কিছু হয়নি তো? আগে রোজই কম্প্যুটার সেন্টারে দু’জনের দেখা হত বলে, কেউই কারও ফোন নম্বর সেভ করে রাখার কথা ভাবেনি। আজ শাহিনের মনে হল, পিকলুর নাম্বারটা সেভ করা করে রাখলে, আজ আর তাকে এতটা দুশ্চিন্তায় পড়তে হত না। তার সঙ্গে কথা বলে সব জানা যেত। তার নাম্বারটা সেভ করে না রাখার জন্য, তার খুব আপসোস হতে লাগল মনে মনে।
পিকলুর মনটাও অস্থির হয়ে পড়েছে, শাহিনের সঙ্গে কয়েকদিন দেখা না হওয়ার জন্য। ভাবল আজ বাবাকে বাঙুর হাসপাতালে দেখে ফেরার সময় কম্প্যুটার সেন্ট্রারটা একবার ঘুরে আসবে।
প্রতিদিনই বিকেলে ভিজিটিং আওয়ার্সের সময় পিকলু বাবাকে হাসপাতালে দেখতে যায়। বাবার জন্য কোনদিন কলা কোনদিন আপেল বা সরবতী লেবু কিনে নিয়ে যায়। বাবা মাস দেড়েক হল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। এখন অনেকটা সুস্থ। কিডনি বদলাতে হয়নি। ডাক্তার বলেছে, নিয়ম মেনে চললে, আর ঔষুধগুলি নিয়মিত খেলে তাকে আর এখনই কিডনি বদলাতে হবে না। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবে সে।
বাবাকে দেখতে যাওয়ার সময় হাসপাতালের গেটে প্রায় প্রতিদিনই এক পাগলিকে দেখতে পায় পিকলু। পরনে শতছিন্ন শাড়ি, মাথার চুলে জট পাকিয়েছে। সারা গায়ে নোংরার আস্তরণ। কোন দিনই বোধহয় স্নান করে না। কাছে গেলে তার গা থেকে দুর্গন্ধ নাকে এসে লাগে। অনেকেই নাকে কাপড় চাপা দিয়ে ওর সামনে দিয়ে চলে যায়। পাগলিটা তা দেখে ফিকফিক করে হাসে। পিকলুর তাকে দেখে খুব মায়া হয়। সে কোনও কোনও দিন বাবার জন্য কেনা কলা, আপেল কিংবা সরবতী লেবু তাকে দিয়ে যায়। তা পেয়ে পাগলিটা যে কী খুশি হয়।
সেদিন বাবাকে দেখে ফেরার সময়, পিকলু দেখে বড় রাস্তা পার হতে গিয়ে পাগলিটা, বাইকের ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে গিয়ে, মাথায় চোট পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
বাইকটা ধাক্কা মেরেই দ্রুত গতিতে ছুটে পালিয়ে গেছে। পিকলু তা দেখে, পথচারী কয়েকজনকে ডেকে তাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তাকে ভর্তি করে দিল। সেদিন এখানেই এত দেরী হয়ে যাওয়ায় তার আর কম্প্যুটার সেন্ট্রারে যাওয়া হল না।
শ্রাবণ মাসের শেষ। তিনদিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তা ঘাটে প্যাচপ্যাচে কাদা। হাঁটা দায়। এই ক’দিনের বৃষ্টিতে ঠাকির্দার ঠান্ডা লেগে জ্বর এসেছে। বুকে কফ জমেছে। রাতে তার কাশতে কাশতে ঘুম ভেঙে যায়। ভাল ঘুম হয় না। শরীরটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। পিকলু তাকে স্থনীয় ডাক্তার অতুল হালদারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে দেখে বরলেন, চিন্তার কোন কারণ নেই। বুকে কফ জমেছো। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি। খাওয়ার পরে তিনবার করে খাবেন। জ্বরের জন্য তিনি ‘প্যারাসিটামল’, আর তার সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক ‘সেপটার্ম’ ট্যবলেট। আর একটা কাশির সিরাফ ‘কসোভো-এলএফ’ লিখে দিলেন তিনি। বললেন এগুলি খাওয়ার পর দিনে তিনবার করে খাবেন। কশির সিরাফ খাওয়ার পর আধ-ঘন্টা জল খাবেন না। ওষুধগুলি খেয়ে তিনদিন পর এসে রোপোর্ট করবেন, পেশেন্ট কেমন আছেন।
আচ্ছা বলে, আমি ঠাকুর্দাকে নিয়ে তার চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলাম। তারপর ঠাকুর্দাকে বাসায় রেখে, তার জন্য প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধগুলি কিনতে গড়িয়া গেলাম।
সেখানে দেখা হল পরিমলের সঙ্গে। পরিমল সাহা। হাইস্কুলে সে আমার সঙ্গে পড়ত। এখন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টিভ হিসাবে ওষুধের দোকানে ওষুধ সাপ্লাই করে। পুরনো দিনের অনেক গল্প হল তার সঙ্গে। তারপর ওষুধের দোকান থেকে বেরিয়ে, এককাপ চা খেয়ে, মোবাইল নাম্বার আদান প্রদান করে বিদায় নিলাম।
বাবা এখন অনেকটাই সুস্থ। তাই কয়েকদিন বাবাকে দেখতে হাসপাতালে যাওয়া হয়নি। বাবাকে আজ দেখতে যাব ভাবলাম।
কুলসুম কিছুদিন পিকলুকে কম্প্যুটার সেন্টারে না দেখতে পেয়ে অস্থির হয়েে পড়ল মনে মনে। ভাবল পিকলুর কিছু হয়নি তো? সে কম্প্যুটার সেন্টার থেকে পিকলুর ঠিকানা জোগাড় করে, তার এক সেখানকার বান্ধবীকে নিয়ে, ঠিকানা খুঁজে খুঁজে পিকলুদের বাড়িতে এসে হাজির। পিকলু বাড়ি ছিল না। বাবাকে দেখতে হসপিটালে গেছিল। ঠাকুর্দা তাদের দেখে বলল, কে মা তোমরা পিকলুকে খুঁজছো?
– আমরা কম্প্যুটার সেন্টার থেকে আসছি। ও অনেকদিন সেখানে যাচ্ছে না দেখে খোঁজ নিতে এসেছি।
– ওহ্, আচ্ছা। পিকলুর বাবা খুব অসুস্থ। হসপিটালে ভর্তি আছে। সেখানে রোজ পিকলুকে যেতে হয়। তাই যেতে পারছে না।
– কি হয়েছে ওঁনার?
– কিডনি, লিভারের সমস্যা।
– তাই নাকি?
– হুম।
– এখন কেমন আছেন?
– ভাল আছেন।
– বেশ। ওকে বলবেন, আমরা এসেছিলাম।
– কি নাম তোমার?
– কুলসুম।
– তোমরা মুসলমান।
– হ্যাঁ আমি মুসলমান আর ও (পাশের মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল, আমাদের বন্ধু হিন্দু। ওর নাম কাবেরী।
– বেশ। বলব।
হিন্দু মুসলমানের চিরন্তন এই সৌহার্দপূর্ণ মিলন দৃশ্যটি অবিনাশ বাবুর মনে খুব রেখাপাত করে। সত্যি সব মুসলমানরা তো খারাপ নয়। কিছু কিছু মানুষের জন্য তাদের সকলের বদনাম হয়।
পিকলু কয়েকদিন পর বাবাকে হসপিটালে দেখতে গেল। গিয়ে দেখল বাবা ভাল আছেন।
– তুই এতদিন আসিসনি কেন?
– ঠাকুর্দা অসুস্থ ছিল।
– কি হয়েছে বাবার?
– তেমন কিছু না। ঠান্ডা লেগে সর্দি কাশি জ্বর হয়েছিল।
– এখন কেমন আছে
– ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে একটু সুস্থ আছেন এখন।
– আচ্ছা।
– তোমার কিছু লাগবে, এনে দেব?
– না, আমার কিছু লাগবে না।
পিকলু বাবাকে দেখার পর ভাবল, একবার দেখে যাই, ওই মহিলা কেমন আছেন, যাকে পিকলু সেদিন হসপিটালে ভর্তি করে দিয়ে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে জানতে পারল, মহিলা বাইকের ধাক্কায় পিচ রাস্তায় পড়ে গিয়ে মাথা দারুণ আঘাত পাওয়ায় তার পুরনো স্মৃতি তিনি ফিরে পেয়েছেন। স্মৃতিভ্রংশ অবস্থা তার কেটে গেছে। তার মনে পড়ে গেছে, পুরনো দিনের সব কথা। তার স্বামী, তার দেওয়র, তার শ্বশুরের কথা মনে পড়ে গেছে। বাড়ি কোথায় তাও মনে পড়ে গেছে।
হসপিটালে বলেছে, তার বাড়ি যাদবপুরের একটা উদ্বাস্তু কলোনীতে। শ্বশুরের নাম অবিনাশ সরকার। স্বামীর নাম অনিল সরকার, আর দেওয়রের নাম সুনীল সরকার।
এইসব শুনে পিকলুর বিস্ময়ের ঘোর কাটতে একটু সময় লাগল। মাকে চিনতে পেরে তার, মা গো বলে ডাক ছেড়ে পায়ে লুটিয়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল তার। হসপিটালে এটা করলে বড্ড নাটকীয় হয়ে যাবে, বলে নিজেকে সে সংবরণ করে নিল।
সে কর্মরত নার্সকে বললেন, উনি আমার মা হন। ওনাকে আমি এখান থেকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাই।
– আপনিই না সোদিন ওনাকে এখানে ভর্তি করে দিয়ে গেছিলেন?
– হ্যাঁ।
– তখন তো বলেননি, উনি আপনার মা হন।
– আমি কি তখন জানতাম ছাই।
– মানে?
– উনি আমার জন্মোর কয়েকদিন পরেই স্মৃতিভ্রংশ হয়ে, কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিলেন। বাবা কাকা কত খোঁজা-খুঁজি করেছেন, থানায়ও জানিয়েছিলেন, কোথায়ও পাননি।
– ওহ আচ্ছা
নার্স আলমারি থেকে একটা ফর্ম বের করে তাকে, পিকলুর নাম ঠিকানা লিখে, সেখানে পিকলুকে বন্ড সই করে, হসপিটালের রেজিষ্টারে সে সব নথিভুক্ত করে, তাকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
পিকলু তাকে নিয়ে এলেন বাড়িতে।
ঠাকুর্দা পিকলুকে দেখে বললেন, কিরে তোর বাবা কেমন আছে এখন?
– বাবা ভাল আছে দাদাভাই।
– ইনি কে?
– দেখ তো চিনতে পার কিনা?
ঠাকুর্দা চশমার কাঁচ মুছে, ভাল করে নিরক্ষণ করে বললেন, দেখে তো খুব চেনা চেনা লাগছে। অনিলের বউ প্রতিমা বলে মনে হচ্ছে যেন।
– বাবা বলে মহিলা এবার ঠাকুর্দার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ঠাকুর্দা তাকে দু’হাত দিয়ে তুলে বুকে টেনে নিলেন।
পিকলুকে বললেন, কোথায় পেলি একে?
পিকলু তাকে সব ঘটনা খুলে বলল।
ঠাকুর্দা শুনে প্রতিমাকে বলল, এতদিন কোথায় ছিলিস মা?
– জানি না বাবা
– কি করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিলিস তুই?
– কিছু মনে নেই আমার।
আচ্ছা, চল চল, ঘরে চল। বলে ঠাকুর্দা তাকে ঘরে নিয়ে গেলেন।
ঠাকুরদা মোটেই আস্তিক নয়, বরং তাকে যুক্তিবাদী নাম্তিক বলেই মনেহয় আমার। তবুও তিনি এসময় দু’হাত উপরের দিকে তুলে বললেন, অসীম কৃপা তোমার। তোমার লীলা বোঝা ভার। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই বোধহয় এইরূপ দ্বিধা দ্বৈরথ দন্দ্ব কাজ করে।
এর কিছুদিন পর বাবাও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। তাকে হসপিটাল থেকে খাওয়ার জন্য প্রেসক্রিপশনে কতগুলি ওষুধ লিখে দিয়েছেন ডাক্তারবাবু। আর কতগুলি খাবার খেতে বারণ করে দিয়েছেন। বাবাকে বলেছেন, নিয়ম মেনে চললে, আর ওষুধগুলি ঠিক মতো খেলে সুস্থ থাকবেন আপনি।
হঠাৎ লটারীর টিকিটে প্রথম প্রাইজ পেলে, যেমন কোন লোকের খবই আনন্দ হয়। মা বাবাকে একসঙ্গে কাছে পেয়ে, পিকলুরও তেমন খুশির জোয়ার আসে মনে। মায়ের সান্নিধ্য সে তো কোনদিনই পায়নি। বাবাকেও কাছে পায়নি সে কোনদিন তেমনভাবে। পিসির কাছে থেকেই সে মানুষ হয়েছে বলা যায়। মা বাবাকে একসঙ্গে হঠাৎ করে, কাছে পেয়ে যেন পিকলুর হাতের মুঠোয় আচমকা চাঁদ সূর্য এসে ধরা দিয়েছে। পিকলুর জীবনটাই একেবারে যেন বদলে যেতে শুরু করেছে। আজকাল তার মন-মেজাজটা সব সময়ই ফুরফুরে থাকে।
বড় ছেলে আর তার বৌকে ফিরে পেয়ে অবিনাশ সরকার খুব খুশি হলেন। তিনি ভাবতে পারেননি তাদের আবার কাছে পাবেন কখনও।
তার জীবনে তাই অনেকটা সানন্দ ফিরে এসেছে।
বাবা ফিরে আসার কিছুদিন পর, ঠাকুর্দা একদিন মায়ের সামনেই বাবাকে বললেন, কিরে হারামজাদা, তোর নতুন বউটা কোথায় এখন?
ঠাকুর্দার কথা শুনে, বাবা বললেন, আমি অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি হওয়ার পরই সে আমায় ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
ঠাকুর্দা তখন মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, জানো বউমা, হারামজাদা আবার একটা বিয়ে করে এখানে এনে তুলতে চেয়ে ছিল। আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি ওদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছি।
মা শুনে বলল, ও বিয়ে করলে, আমি সতীন নিয়েও সংসার করতে কোনও আপত্তি করতাম না। কারণ, আমি তো জানি, আমায় ছাড়া ওনার থাকতে কত কষ্ট হয়েছে। তাছাড়া আমি যে আমার ফিরে আসব, তারও কোন নিশ্চয়তা ছিল না।
ঠাকুর্দা মার এই শুনে বাবাকে বললেন, দ্যাখ প্রতিমা তোকে কত ভালবাসে।
ঠাকুর্দার কথা শুনে, বাবা চুপ করে, অপরাধীর মতো মাথা নীচু করে রইলেন।
সরকার থেকে বাঘাযতীনে ঠাকুরদার নামে দোকানের জন্য একটু গুমটি ঘর তৈরী করে দিয়েছে। সেখানে গিয়ে বাবা নতুন করে দোকানের মালপত্র সাজিয়ে নিয়ে বসা শুরু করলেন।
ঠাকুর্দার কথা মতো, বাড়িতে দেওয়া চা-ঘুগনি, বিড়ি-সিগারেটের দোকানটাও আজকাল ভাল চলে কাকার। বাবাও আর আগের মতো উড়নচন্ডী নেই। অনেকটা সংসারী হয়েছে। সংসারে সাচ্ছন্দ ফিরে এসেছে।
মা তো তার সংসার ফিরে পেয়ে, খুবই খুশি। কাকিমার সঙ্গে তার ভাব হয়েছে খুব। সংসারের সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ কর্ম মায়ের মত না নিয়ে করে না কাকিমা। ফলে সংসারে কোন অশান্তি নেই। ঠাকুর্দাও আগের চেয়ে অনেক চনমনে হয়ে উঠেছেন মনে-প্রাণে।
কম্প্যুটার সেন্টারে অনেকদিন যাওয়া হয়নি পিকলুর। তাই সে ভাবল আজ একবার কম্প্যুটার সেন্টারে গিয়ে ঘুরে আসবে। সন্ধ্যার সময় সেখানে গেল পিকলু। সেখানে গিয়ে পুরনো বন্ধু অনেকের সঙ্গেই তার দেখা হয়ে গেল। এতদিন পর তাকে সেখানে দেখে কেউ কেউ তার এতদিন অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাইল। পিকলু তার বাবার অসুস্থতার কথা বিস্তারিতভাব তাদের সকলকে জানাল। এখন কেমন আছে বাবা, তারা জানতে চাইলে, পিকলু বলল, এখন তিনি ভাল আছেন আগের চেয়ে অনেকটাই। পিকলু আশা করেছিল, আজ এখানে অনেকদিন কুলসুমের সঙ্গে দেখা হবে। কিন্ত তার সঙ্গে দেখা হল না। দেখা না হওয়ার সে মনে মনে হতাশ হল খুব। ভেবেছিল, কুলসুমের সঙ্গে দেখা হলে তার মাকে ফিরে পাওয়ার রোমাঞ্চকর কাহিনি শুনিয়ে সে তাকে তাক লাগিয়ে দেবে। ঠাকুর্দার কাছে সে শুনেছে, কুলসুম কম্প্যুটার সেন্ট্রারের একজনকে নিয়ে তাদের বাড়িতে তার খোঁজ করতে গেছিল।
এবারের পুজোটা সবাই মিলে খুব আনন্দে কাটল। অষ্টমীর দিন মা আর কাকিমা অঞ্জলী দিতে মন্ডপে গেল। অনেকে পুজো মন্ডপে মাকে দেখে খুব উচ্ছ্বাস প্রাকাশ করল। ওদের উচ্ছ্বাসের প্রকাশ দেখে মাও ভীষণ আপ্লুত হল। নবমীর দিন পাড়ায় অরন্ধন পালন হল। সকলে মিলে প্যান্ডেলে নিরামিশ খাওয়া-দাওয়া হল। ফ্রাইড-রাইস, আলুর দম, খেজুর-আমসত্ত্বের চাটনি, পাঁপর আর একটা করে বড় কমলাভোগ।ঠাকুর্দা ছাড়া বাড়ির আর সকলে গেছিল। ঠাকুর্দা সেদিন বাড়িতে দুধ মুড়ি কলা খেয়েছিল।
দশমীর দিন মা আর কাকিমা একটা ঠাকুরের থালায়, সন্দেশ ও তেল সিঁদুর নিয়ে দুর্গা-মাকে বরণ করতে গেল। সেখানে গিয়ে লাইন দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মাকে সিঁদুর পরিয়ে, মিষ্টি মুখ করিয়ে, সকলের সঙ্গে আনন্দ করে সিঁদুর খেলে ওরা বাড়ি ফিরলেন, খুশি মনে।
ঠাকুর্দার পায়ে ইদানিং বাতের ব্যথা শুরু হয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে, তিনি বারান্দায় এসে রোদে বসেন একটা টুল পেতে। মা এসে তার পায়ে, তেল গরম করে এনে মেখে দেন যত্ন করে। দাদুর তাতে খুব আরাম হয়। তখন তার মনে পড়ে উমারানীর কথা। তার স্ত্রী। সেও ঠাকুর্দার পায়ে এভাবে তেল মেখে দিতেন একসময়। যখন বরিশালের দেশের বাড়িতে, ঠাকুর্দা গ্রামে গ্রামে ঘুরে পাইকারী দরে নারকেল সুপারি কিনে এনে গঞ্জের হাটে বিক্রি করে, ক্লান্ত হয় সন্ধ্যায বাড়ি ফিরতেন। বের হতেন সকালে কাঁচালঙ্কা আর পেঁয়াজ দিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে।
তখন সবে অনিলের (বাবার নাম) জন্ম হয়েছে।
সুনীল আর বুড়ির জন্ম হয়নি। দিনগুলি কী সুন্দর কাটছিল তখন। তারপর একে একে সুনীল বুড়ির জন্ম হল। ধীরে তার পরিশ্রমের শক্তি কমে এলো। আগের মতো অত গ্রাম ঘুরে সুপারি নারকেল কিনতে পারতেন না। সল্প মাল নিয়েই গঞ্জের হাটে বেচে আসতেন। তাতেও সংসার চলে যাচ্ছিল কষ্টে আনন্দ করে। একদিন বাগানে পাঁকা পেঁপে গাছ থেকে আঁকশি দিয়ে পাড়তে গিয়ে, সাপের কামড় খেয়ে উমারানী ঘরে ফিরল। তখন গ্রামে কোন ডাক্তার বদ্দ্যি ছিল না তেমন। তাই সাপের বিষ ঝাড়ার ওঝা ডেকে আনলেন ঠাকুর্দা। ওঝা নানা চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারলেন না। বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। তার কথা খুব মনে পড়ছে আজ এতদিন পর। ঠাকুর্দা ভাবতে ভাবতে। সুদূর অতীতকালে চলে গেছিলেন তিনি।
রোদ সরে গেছে। চলুন এবার ঘরে দিয়ে বসবেন। মায়ের কথায় তন্ময়তা কাটল তার।
– হ্যাঁ, চলো। বলে ঠাকুর্দা টুল থেকে উঠে, মায়ের হাত ধরে, নিজের ঘরে গিয়ে বসলেন।
কম্প্যুটার সেন্টারে যেতে যেতে ভাবছিল শাহিন, বেশ কিছুদিন ধরে পিকলুর সঙ্গে দেখা না হওয়ায় মনটা তার উদ্বিগ্ন ছিল। বাড়িতে গিয়েও পিকলুর দেখা পায়নি। শুনে এসেছে তার বাবা অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি আছেন বলে, সেখানে তাকে যাতায়াত করতে হচ্ছে, তাই পিকলু কম্প্যুটার সেন্টারে যেতে পারছেন না।
এখনও কি তাহলে তার বাবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেননি। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই আর একটা কথা তার মনে হল, আচ্ছা সে যে দিন দিন পিকলুর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে, এর পরিণতি কি? তার বাবা মা তো, হিন্দু ছেলেকে তার হাসবেন্ড হিসাবে কখনোই মেনে নেবে না, তাদের প্রাণ থাকতে। কারণ তারা খুব ধর্মপ্রাণ মানুষ। আল্লা অন্ত তাদের প্রাণ, মান। তাহলে উপায়?
ঘর থেকে পালিয়ে সংসার গড়া ছাড়া তার কোন উপায় থাকবে না। তাছাড়া পিকলুর বাড়ি থেকে যে তাদের সম্পর্ক মেনে নেবে, তারই বা নিশ্চয়তা কি? এইসব ভাবতে ভাবতে কুলসুমের মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। সে অন্যমনস্ক হয়ে পথ হাঁটছিল, এমন সময় পাশের গলি থেকে একটা মোটরবাইক, কোন হর্ণ না দিয়েই, আচমকা বেরিয়ে এসে শাহিনকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে দ্রুতগতিতে পালিয়ে যায়। কয়েকজন পথচারী এসে তাকে তুলে ধরে বসায়। কোমড়ে ভীষণ চোট লেগেছে তার, দাঁড়াবার উপায় নেই।
উঠে বসে শাহিন দেখে, তার হাতের ব্যাগটা দূরে ছিটকে পড়েছে। তার কথায় একজন ব্যাগটা সেখান থেকে তুলে এনে তার হাতে দেয়। কুলসুম ব্যাগটা খুলে মোবাইল বের করে, বাবকে ফোন করে, তার অ্যাক্সিডেন্টের কথা জানায়। খবরটা শুনে তার বাবা উদভ্রান্তের মতো ছুটে আসেন। একটা ট্যাক্সি ধরে তাকে পার্কসার্কাসের ট্রাই নামে একটা নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করান।
পরদিন পিকলু কম্প্যুটার সেন্টারে গিয়ে শোনে কুলসুমের বাইক অ্যক্সিডেন্ট হয়েছে। সে এখন পার্কসার্কাসের একটা নার্সিংহোমে ভর্তি আছে। এই শুনে পিকলু কম্প্যুটার সেন্টার থেকে বেরিয়ে কুলসুমদের দরগারোডের বাড়িতে চলে যায়। সেখান থেকে নার্সিংহোমের ঠিকানা ও বেড নাম্বার নিয়ে কুলসুমের সঙ্গে দেখা করতে ছোটে।
পিকলুকে নার্সিংহোমে দেখে কুলসুমের বুকের ভিতরে অভিমানের মেঘ জমে। কান্না পায়। বৃষ্টির মতো ঝরঝর করে ঝরে পড়তে চায়। কিন্তু সে তা পারে না। কষ্টটা বুকের মধ্যে চেপে রেখে সে মলিন হেসে পিকলুকে বেডের পাশের টুলটা দেখিয়ে বলে, বসো।
– কে খবর দিল, এখানকার?
– কম্প্যুটার সেন্টারে গিয়ে তোমার অ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়ে, তোমাদের বাড়িতে গেছিলাম। সেখান থেকে এখানকার ঠিকানা ও বেড নাম্বার পেয়েছি।
শুনে কুলসুমের বুকের ভিতরটা খুশিতে ভরে উঠল। খুশির জোয়ারে বুকের জমা মেঘ যেন কোথায় ভেসে গেল। তার কথা এভাবে কেউ একজন ভাবে, এমন কেউ একজন আছে তার জন্য ! এই ভাবনার সৌরভ তার সারা মন জুড়ে রইল, যতক্ষণ পিকলু তার কাছে রইল।
আবার আসব, বলে পিকলু সেদিনকার মতো বিদায় নিল।
কুলসুম দু’সপ্তাহের বেশি নার্সিংহোমে ভর্তি ছিল। পিকলু মাঝে মাঝেই তার সঙ্গে দেখা করতে গেছে। একদিন কুলসুমের সঙ্গে দেখা করে ফেরার সময় পিকলুর স্কুলের বন্ধু পরিমল সাহার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। পরিমল ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে তাদের কোম্পানীর ওষুধ পেশেন্টদের প্রেসক্রাইব করার জন্য, ফ্রি স্যাম্পেল দিতে এসেছিল।
পরিমল তাকে দেখে বলল, কিরে তুই এখানে?
– আমার পরিচিত একজন এখানে ভর্তি আছে। তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম।
– আচ্ছা। কেমন আছিস তুই? কোন তাড়া নেই তো তোর? চল একটা চায়ের দোকানে বসে একটু চা খাই।
– না তেমন কোন তাড়া নেই। চল।
হাঁটতে হাঁটতে তারা পার্কসার্কাস চার নম্বর ব্রীজের কাছে এসে একটা চায়ের স্টলে এসে দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে পরিমল পিকলুকে বলল, এখন তুই কি করছিস?
– কিছুই না। একটা কম্প্যুটার সেন্টারে আছি।
– আচ্ছা, তুই কম্প্যুটার জানিস? আমাদের কোম্পানীতে একজন কম্প্যুটার জানা লোক নেবে। তুই করবি?
– করব না কেন? তুই কথা বলে দেখ।
– আচ্ছা, তবে তুই কাল সকাল দশটার মধ্যে আমার সঙ্গে গড়িয়াহাটা মোড়ে ট্রেডার্স এসেম্বির নীচে দেখা কর।
– আচ্ছা।
ওরা টি-স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে মাটির ভাড়ে চা খেয়ে, ভাড় দু’টি সামনে রাখা টিনের ড্রামে ফেলে দিল। পরিমল চায়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে, পিকলুকে বলল, আচ্ছা আজ চলি তাহলে। কাল ঠিক সকাল দশটায় দেখা হচ্ছে।
– একদম। টা টা …
পরিমলের সহায়তায় তাদের ‘সেভ লাইভ’ ওষুধের কোম্পানীতে কম্প্যুটারে কাজেের চাকরিটা হয়ে গেল পিকলুর। সকাল দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত ডিউটি। সপ্তাহে রবিবার বন্ধ থাকে কোম্পানী। অর্থাৎ সেদিন ছুটি থাকবে পিকলুর। প্রথম একবছর শিক্ষানবিশ (apprentice) হিসাবে কাজ শিখতে হবে। বৃত্তি (stipend) পাবে মাসে তিন হাজার টাকা করে। পিকলু কাজে লেগে গেল।
প্রথম মাসে তিন হাজার টাকা পেয়ে, পিকলু এনে ঠাকুর্দার হাতে তুলে দিল। ঠাকুর্দাই তাকে কম্প্যুটার সেন্টারে ভর্তি হবার সময়, ভর্তির জন্য টাকাটা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে এনে পিকলুকে না দিলে, তার কম্প্যুটার শেখা হত না।
মাসের প্রথম বৃত্তিটা তুলে এনে ঠাকুর্দার হাতে দেওয়ায়, ঠাকুর্দা খুব খুশি হলেন।
নিজের কাছে দু’হাজার টাকা রেখে, পিকলুকে এক হাজার টাকা ফেরৎ দিয়ে বললেন, এটা তোর কাছে রাখ। তোরও তো কিছু খরচ আছে।পিকলু জানে, পায়ে হাত দিয়ে কেউ ঠাকর্দাকে প্রণাম করলে, ঠাকর্দা খুব খুশি হন। পিকলু তাই টাকাটা হাতে নিয়ে, ঠাকুর্দাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল। ঠাকুর্দা পিকলুকে বুকে টেনে নিয়ে, মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বললেন, সুখি হও বাছা। দীর্ঘজীবী হও।
পুজোর পর এবার শীতটা পড়েছে বেশ জাকিয়ে। মাঝে মাঝেই কনকনে ঠান্ডা বাতাস ছুটে এসে শরীর কালিয়ে দিচ্ছে। ঠাকুর্দার বাতের ব্যথাটা আবার ক’দিন ধরে বেড়েছে। হাঁটতে গেলে পায়ে ব্যথা লাগে। তাই কেউ এনে তাকে বাইরে রোদে বসিয়ে না দিলে, তিনি একা ঘর থেকে হেঁটে এসে বসতে পারেন না। কাকিমা কাকার দোকানে কাকার সহয়তা করতে গেছে।
সকালে কাকার দোকানে খরিদ্দারের চাপটা একটু বেশি থাকে, তাই কাকামি সেসময় সেখানে গিয়ে কাকার সহায়তা করে। কখনও খরিদ্দারদের কাছে খাবার এগিয়ে দেয়। আবার কখনও খরিদ্দারদের কাছ থেকে হিসেব করে পাওনা টাকা বুঝে নিয়ে ক্যাশবাক্সে রাখে।
মা রান্নাঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত। আজ রবিবার। পিকলুর অফিস ছুটি। সে ঘর থেকে বারান্দায় এনে রোদে টুলে বসালেন ঠাকুর্দাকে। তিনি প্রসন্ন হয়ে , তার হাতের হাঁটার লাঠিটা ডান পাশে রেখে, পিকলুকে বাঁ পাশের ছোট জলচৌকিটা দেখিয়ে বললেন, বস এখানে। পিকলু তার কথা মতো সেখানে বসার পর, ঠাকুর্দা তাকে বললেন, কেমন চলছে তোর অফিস?
– ভালই।
– মন দিয়ে কাজ কর। চাকরি-বাকরি স্থায়ী হলে, তোর বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে শুরু করব।
– সে চেষ্টা কোরো না দাদাভাই।
– কেন? কারও সাথে কিছু …. এইটুকু বলে, ঠাকুর্দা চোখ তুলে পিকলুর দিকে তাকাল।
– আচ্ছা আমি যদি প্রেম করে কাউকে বিয়ে করি, তুমি কি রাগ করবে তাহলে?
– রাগ করব কেন? বেজাতের মেয়ে না হলেই হল।
– বেজাত মানে?
– হিন্দু নয় এমন কোন মেয়ে
– মুসলমান হলে?
– হারামজাদা, তাহলে তোকে আমি বাড়ি থেকে দূর দূর করে তাড়াব।
– আচ্ছা দাদাভাই, তোমার এত মুসলমানদের প্রতি রাগ কেন?
– ওদের জন্যই তো আমাদের দেশ ছাড়তে হয়েছে।
– দেশ কি তোমার জায়গা জমি ছিল।
– না ছিল না।
– তাহলে থাকতে কোথায়?
– সনাতন হাজরার একটা বড় সুপারি বাগান ছিল। তার অনুমতিতে সেখানেই একটা চালা ঘর তুলে তার অনুমতিতে বসবাস করতে লাগলাম। তারপর তোর ঠাকুমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। সেখানেই তার সঙ্গে থাকতাম।
– ঠাকুরমাকে তুমি পেলে কোথায়?
– তোর ঠাকুরমার মা সনাতন হাজরার বাড়িকেই কাজ করত। সে আমাকে খুব পছন্দ করত। সনাতন হাজরার কাছে সে তার মনের কথা জানায়। সনাতন বাবুর আন্তরিক প্রচেষ্টাতেই আমাদের বিয়েটা হয়ে যায়। সেই ঘরেই খুব সুখে দিন কাটছিল আমাদের। সেই চালাঘরেই তোর বাবা কাকা আর পিসিমার জন্ম হয়। একদিন সাপের কামড়ে তোর ঠাকুমার মৃত্যু হয়। তাকে বাঁচানো যায়নি।
– তবে তোমরা সে দেশ ছেড়ে চলে এলে কেন?
– সাতচল্লিশে দেশ ভাগ হওয়ার পর, যখন বরিশাল জিন্নার পূর্ব পাকিস্থান হয়ে গেল। তখন সনাতন বাবু কি ভেবে, তারপরই মাকির হায়দারের সঙ্গে পারস্পরিকভাবে জমি হস্তান্তর করে এদেশে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ঘুটিয়ারি শরিফে চলে আসেন। জমির দখল নিয়ে মাকির হায়দারের আমাদের বাগান ছেড়ে উঠে যেতে বলেন। তখন কি করব? বুঝলাম আমাদের মতো অসহায় হিন্দুদের এদেশে থাকা নিরাপদ হবে না।
সেই কথা ভেবেই দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। অনেক অমানসিক কষ্ট আসার পথে সহ্য করে এদেশে এসে পৌঁছালাম। তারপর শিয়ালদহ স্টেশনে এসে কিছুদিন নরক যন্ত্রণা ভোগ করলাম। সে সময় তুই কোথায়? তোর বাবার বিয়েই হয়নি।
– তারপর?
– তারপর শিয়ালদহ স্টেশনে একদিন রেল পুলিশের কাছে বেধরক মার খাওয়ার পর, স্টেশন ছেড়ে পালিয়ে, কালীঘাটের পোড়াবস্তিতে একটা বস্তির ঘরে ভাড়ায় এসে উঠলাম। তোর বাবা হাজরার একটা সিগারেট বিড়ির দোকানে কাজ পেয়েছিল। সেখানেই বস্তির অনাথ একটা মেয়ের সঙ্গে তোর বাবার বিয়ে দিলাম। মেয়েটার বাবা মা কেউ ছিল না, পিসির কাছে থাকত মেয়েটা। ওর পিসি বাজারে সব্জি বেজে সংসার চালাত। খুব কষ্টে চলত ওদের। ওর পিসি একদিন আমাকে বলল, ওদের অবস্থার কথা জানিয়ে ওর মেয়েটার একটা গতি করতে, বিয়ের জন্য একটা সুপাত্র জোগাড় করে দিয়ে। শুনে আমি মনে মনে ভাবলাম, অনিলের সঙ্গে মেয়েটার বিয়ে দিলে মন্দ হয় না। মেয়ে নম্র স্বভাবের, কাজ কর্মেও পটু। তাই একদিন, অনিলে ডেকে বললাম, মেয়েটাকে তোর কেমন লাগে?
– ভালই। কেন বাবা?
– ওকে বিয়ে করতে তো তোর কোন আপত্তি নেই?
– তুমি যা ভাল বোঝ করবে। আমার আর তাতে আপত্তি করার কি আছে?
অনিলের মত পেয়ে, আমি ওর পিসিকে ডেকে বলি, তোমার মেয়ের পাত্র হিসাবে কি তোমার অনিলকে পছন্দ হয়?
– কি যে বলেন আপনি? অনিলের মতো ক’টা ছেলে আছে এ পাড়ায়?
– তবে তোমার ভাইজিকে বোলো, অনিলের সঙ্গে বিয়েতে ওর কোন আপত্তি আছে কিনা?
– বেশ।
তারপরই দু’পক্ষের সন্মতিতে অনিলের বিয়েটা হয়ে যায়,অনাড়ম্বর এক অনুষ্টানের মাধ্যমে।
– তারপর এখানে এলে কি করে?
– তোর বাবা দোকানে একজনের কাছে শুনে এসেছিল, তার দু-একদিনের মধ্যেই আমি এখানে এটা চালাঘর তুলে একা বাস করতে থাকি। বাবা কাকা পিসি তোর মা থাকত সেই পোড়াবস্তির ভাড়া ঘরেই।
– আচ্ছা দাদাভাই, মুসলমানরা যদি তোমাদের তাড়িয়ে দিয়ে, অপরাধ করে থাকে, তবে তোমরা যে ওদের জমি দখল করে এখানে বসবাস করছ এটা অপরাধ নয়?
ঠাকুর্দা পিকলুর মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, তুই বেশ বড় হয়ে গেছিস আজকাল।
– কেন?
– এটা একটা যুক্তিগ্রাহ্য কথা বলেছিস তুই। এভাবে আমি কখনও ভেবে দেখিনি।
– ভাবো ভাবো। ভাবা প্রাকটিশ কর।
ডানপাশে রাখা বলে হাতের লাঠিটা তুলে ঠাকুরবদা বললেন,
– ওরে হারামজাদা, তুই সিনেমার ডায়লগ মারছিস আমার কাছে।
হারামজাদা বলা ঠাকুর্দার একটা মুদ্রাদোষ।
পিকলু জলচৌকি ছেড়ে উঠে পালাল সেখান থেকে।