Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হাতলের লড়াই || Sanjib Chattopadhyay

হাতলের লড়াই || Sanjib Chattopadhyay

হাতলের লড়াই

অন্ধকার হওয়ার আগেই আমি সাধারণত সিনেমা হলে ঢোকার চেষ্টা করি। একবার অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর ঢোকার চেষ্টা করে ধোলাই খেতে খেতে বেঁচে গিয়েছিলুম। চড়া আলো থেকে হঠাৎ অন্ধকার। হাতড়াতে হাতড়াতে ঢুকেছি। কিছুই চোখে পড়ছে না। সম্পূর্ণ অন্ধ। টিকিটচেকার টর্চলাইটের আলো ফেলে এক ঝলকে সিট দেখিয়ে সরে পড়লেন। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চোখে আরও ধাঁধা লেগে গেল। দাঁড়িয়ে থাকলে তো চলবে না। আসনে গিয়ে বসতেই হবে। বরাতক্রমে সিটটাও পড়েছে, সারির একেবারে শেষে দেয়াল ঘেঁষে। পা ঘষে ঘষে, পা ঘষে ঘষে, টিকিটচেকার যে রো দেখিয়েছিলেন তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালুম। তলায় একটা লাল আলো জ্বলছে। ঠিকই তবে সেই আলোয় ওপরের অন্ধকারের বিশেষ কোনও অসুবিধে হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। ডান হাতটা পাশে বাড়িয়ে দিলুম। একটা কিছু ধরে, কায়দা করে জোড়া জোড়া হাঁটু ভেদ করে ঢুকতে হবে তো। হাতটা নরম মতো একটা কিছুতে গিয়ে ঠেকতেই সেটা সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বুঝলুম, চেয়ারের পেছন নয়, অন্য কিছু। নারীকণ্ঠ, ইশ করে উঠল। সর্বনাশ! হাত তুমি কী ছুঁয়েছিলে? না জানাই ভালো। সাবধান হলুম। কোনওক্রমে প্রথম হাঁটু জোড়া অতিক্রম করে, টাল সামলাবার জন্যে নীচের দিকে হাত বাড়ালুম কিছু একটা ধরার আশায়। মনে হল নরম পাশ বালিশে হাত পড়েছে। জিনিসটা থিরথিরিয়ে কেঁপে উঠল। নারীকণ্ঠের তিরস্কার অসভ্য। ভয়ে সিঁটিয়ে গেলুম। মরেছে, কোনও মহিলার ঊরুতে হাত পড়েছে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, ওয়ে অফ নো রিটার্ন মানে এমন পথে চলে এসেছি যে আর ফেরার উপায় নেই। এগোতে আমাকে হবেই। ভেবেছিলুম পর্দায় আলোকিত কোনও দৃশ্য ফুটে উঠবে, আর সেই আলোয় পরিষ্কার পথ চিনে নেব। সে গুড়ে বালি। জঙ্গলের ডকুমেন্টারি শুরু হয়েছে। যাই হোক, এইবার খুব সাবধানে হাত বাড়ালুম। হাতে বুরুশের মতো কী একটা লাগল। অনেকটা টুথব্রাশের মতো। আর সঙ্গে সঙ্গে কে আমার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান লাগাল। আমি হুমড়ি খেয়ে একটা কোলের ওপর পড়ে গেলুম। সিল্কের নরম কোল। সেন্টের গন্ধ। পড়ে গিয়েই আমি বুদ্ধি করে বললুম —মা আমাকে হ্যাঁচকা টান মেরে ফেলে দিয়েছে। বলেই মনে হল ইংরেজি তরজমার প্রয়োজন। বললুম, সরি ম্যাডাম। আনইন্টেনশানাল ফল্ট। একসকিউজ মি। এ সব বলেছি বটে কিন্তু পড়ে আছি কোলে। এইবার পাশ থেকে জাঁদরেল কেউ আমার চুলের মুঠি ধরে ফেলে দিলে পাশের খালি আসনে। আর সেটাই আমার সিট। এমনই মজা, সিটে এসে পড়লুম আর পর্দায় ভেসে উঠল উজ্জ্বল দৃশ্য। মানুষের চোখে একটা সুইচ থাকে। অফ থাকতে থাকতে হঠাৎ অন হয়ে যায়। আমারও তাই হল। সারা হল আমার চোখে এখন পরিষ্কার। গোলাপি আলোয় অসংখ্য মাথা গোল গোল লেডিকেনির মতো ভাসছে। আমার ডান পাশে দেয়াল। বাঁ-পাশে, পালোয়ানের মতো চেহারার বর্ষীয়ান এক মহিলা। এই মহিলাই আমার চুলের মুঠি ধরেছিলেন। তার পাশে সুন্দরী এক মহিলা। যার কোলে আমি পড়েছিলুম। তার পাশে এক পো লোক। যার গোঁপকে মনে হয়েছিল বুথব্রাশ। এইসব দেখতে দেখতেই আলো জ্বলে উঠল। মূল বই আরম্ভ হওয়ার আগে, সিগারেট খাবার জন্যে দু-চার মিনিটের বিরতি। আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলুম। বাইরে যেতে হবে তো। বর্ষীয়ান মহিলা থাবড়া মেরে বসিয়ে দিলেন, বোসো হারামজাদা। আবার অন্ধকারে ঢুকে পড়ে মরার ইচ্ছে। এই শাসন বড় ভালো লাগল। অবিকল আমার মায়ের মতো। বাইরে গিয়ে সিগারেট খাওয়া আর হল না। ফুস করে আলো নিবে গেল। শুরু হল গেল মেট্রো গোলউইন মেয়ারের যাত্রা। গোলের মধ্যে সিংহের হাঁউ হাঁউ গর্জন বার তিনেক।

খুব মন দিয়ে সিনেমা দেখছি। মারাত্মক সব ব্যাপার চলছে পর্দায়। কোনওদিকে আর তাকাবার অবসর পাচ্ছি না। সুন্দরী নায়িকা স্নান করতে নামছেন বাথটাবে। পাশের মহিলা শব্দ করে হাই তুললেন, তারপর তাঁর ওপাশের সুন্দরী মেয়েটিকে বললেন, আর কি সে বয়েস আছে রে শিবি, জোর করে এই সব বই দেখাতে নিয়ে এলি? এ যে ছোঁড়াছুঁড়ির প্রেম! আবার হাই তুললেন মৃদু শব্দ করে। সামনে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আরও আরাম করে বসলেন। ডান দিকে হেলতেই। আমার কাঁধে তাঁর কাঁধ ঠেকে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, কিছু মনে করিস নি। সিট করেছে দেখেছিস, একটু মোটা হলে আর বসার উপায় নেই।

এই গল্পটা আমার বলার উদ্দেশ্য নয়, কারণ এটা হল প্রেমের গল্প। সিনেমা হল থেকে বাসরঘরে গিয়ে এর পরিণতি। নানা, ওই বয়স্ক মহিলার সঙ্গে নয়। বিয়ে হল, তাঁর পাশে যে। সুন্দরী মেয়েটি বসেছিল তার সঙ্গে। যাকে তিনি শিবি বলে ডাকছিলেন। মেয়েটি তাঁর বোনঝি। এ খুব গোলমেলে মধুর রসের গল্প। তবে একটা কথা বলে রাখি, অন্ধকারে সিনেমা হলে ঢুকলেই যে সুন্দরী স্ত্রী লাভ হবে, এমন সিদ্ধান্ত না করাই ভালো। আমার হয়েছিল—আমার বরাত ভালো ছিল বলে।

আমার আজকের গল্প হল লড়াইয়ের গল্প।

আজ আমি আলো নেওয়ার অনেক আগেই আমার আসনে এসে বসেছি। আমার ডান দিক খালি। আমার বাঁদিক খালি। আমি মাঝের আসনে বসে আছি গদিয়ান হয়ে। সামনে ঝুলছে ঝলমলে শাটিনের পরদা। মাথার ওপর মোহিনী আলো, সিনেমা হল যখন ফাঁকা থাকে, বেশ লাগে চুপচাপ বসে থাকতে। ভাব এসে যায়। নিজেকে কখনও মনে হয় রাজা। কখনও মনে হয় প্রেমিক। বাইরে বাস্তব জগৎ কেলোর-বেলোর করছে। ভেতরে ছায়া ছায়া স্বপ্নজগৎ। পরদায়। ভেসে উঠবে নায়ক নায়িকা। সুন্দর চেহারা, ভরা যৌবন। নর্তকীরা আসবে কোমর দোলাতে। সুর, সুরা, স্বপ্ন, প্রেম, প্রাকৃতিক দৃশ্য। সে যে কী কাণ্ড! উপরি পাওনা, পাশেযদি আতর মাখা কোনও তরুণী এসে বসেন!

ভাবতে ভাবতে সময় চলে যাচ্ছে। আর যতই সময় যাচ্ছে ততই আসন পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। প্রায় ভরে এসেছে। কেমন সব লক্ষ্মীছেলের মতো বসে আছে। ফুলস্টপের মতো কালো কালো মুণ্ডু আলো-অন্ধকারে ভাসছে। দপ করে আলো নিভে গেল। আমার বাঁ পাশ ভরেছে। ডান পাশ। এখনও খালি। দু-হাতলে দু-হাত ফেলে রাজার মতো বসে আছি সামনে বুক চিতিয়ে। অন্ধকার। ঝিমঝিম ঠান্ডা। রিমঝিম সংগীত। পরদা ওপরে উঠছে পরতে পরতে। স্ক্রিনে ছবি পড়েছে। বিজ্ঞাপন-সুন্দরী স্লো মোশানে ভিজে সমুদ্র সৈকতে বাতাসে চুল উড়িয়ে ছুটে আসছে আমাদের দিকে। পেছনে ল্যাজ তুলে ছুটে আসছে একটা ঘোড়া। দুজনেই শ্যাম্পু করেছে। একজন চুলে, একজন ল্যাজে। কী সে শ্যাম্পু!

বিজ্ঞাপন দেখতে বেশ মজা লাগে। মনেই হয় না, এ দেশে দারিদ্র আছে, খুনোখুনি আছে, ভ্রাতৃবিরোধ আছে। শ্যাম্পুর পরে শুরু হয়েছে টুথপেস্ট। কে একটা মেয়ে, কী একটা টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মাজার ফল হাতে হাতে পাচ্ছে। কিন্নর চেহারার একটা ছেলে তাকে বুকে চেপে ধরেছে। টুথপেস্টের এত গুণ! এ দেশের আইবুড়ো মেয়েরা জানে না নাকি?

এইবার জাঙিয়া। উঃ, এমন জাঙিয়াও আছে, যা পরলে আর কিছু পরতে হয় না। একটা ঝকঝকে মোটর গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ডনজুয়ান। গায়ে একটা ওভারকোটের মতো কী চাপানো। তার একটা দিক তুলে তিনি জাঙিয়া প্রদর্শন করছেন, আর দুদিক থেকে দুই সুন্দরী শরীরে একেবারে লেপটে আছে খোঁটার গায়ে উচ্ছেলতার মতো।

এর পরই শুরু হল শরীরে লোম ওঠাবার মলমের বিজ্ঞাপন। মোদ্দা কথা ব্লেড দিয়ে না চেঁচে মলম লাগাও, তাহলে সিল্কের কাপড় হড়কে নেমে যাবে। একটি সুন্দরী মেয়ের দুটি ঠ্যাং নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কসরত চলল।

শেষ হতে না হতেই লিরি লিরি করে একটা সুরেলা গান শুরু হল। আর নালা-নর্দমা-জলের কলে নয়, একেবারে পাহাড়ি ঝরনায় চান শুরু করে দিল এক কিশোরী। এই সাবান ভাসে তো, এই এক চাকা লেবু। সে কী নৃত্য! বেজে উঠল বিয়ের সানাই। হলুদ মাখানো হচ্ছে বিয়ের কনেকে। হলুদ নয়। হলুদওলা মলম। টুথপেস্টের মতো টিউব থেকে গিলগিল করে বেরিয়ে আসছে।

সানাইয়ের কালোয়াতি, মেয়েদের ফিনফিনে হাসি।

লেসারের তরোয়াল হাতে এক আধুনিক বীর এইবার যুদ্ধে নেমেছেন। এক নায়িকা ছুটে আসছেন মালা দিতে। কীসের যুদ্ধ! কার সঙ্গে যুদ্ধ! যাক গে, ও বড় গোলমেলে ব্যাপার। আসল কথা হল বিশেষ একটি মিলের কাপড় পরে যুদ্ধে যেতে বলছে, তাহলে রাজত্ব এবং রাজকন্যা দুই-ই একসঙ্গে লাভ হবে।

বাঁ পাশের ভদ্রলোক আপন মনে বললেন, বইটা মনে হচ্ছে খুবই ছোট। ওই জন্যে লোকে হিন্দি বই দেখে। আমার ডান পাশ তখনও খালি। তিনি মনে হয় জ্যামে ফেঁসে গেছেন। কলকাতায় যা হয় আর কি! একেবারে না এলেই ভালো হয়। বেশ ছড়িয়ে বসেছি।

ক্ষণ বিরতির পর শুরু হল ভারত সরকারের ডকুমেন্টারি। বাঁ পাশের ভদ্রলোক মন্তব্য করলেন, এই সব রাবিশগুলো কেন দেখায়? সময় নষ্ট। নাও, এখন বসে বসে গুজরাটি খরা দেখো। ভদ্রলোকের সবেতেই বিরক্তি। পৃথিবীতে কিছু কিছু এমন মানুষ আছেন; কিছুতেই যাঁরা সন্তুষ্ট নন। কী আর করা যাবে!

বই শুরু হল। আমেরিকার প্রশস্ত রাজপথ দিয়ে একটা গাড়ি ছুটে চলেছে। পেছনের জানলা দিয়ে লোটা লোটা কানওলা একটা কুকুরের মুখ বেরিয়ে আছে। কেমন মজা করে চলেছে। ওদেশের। কুকুরও গাড়ি চাপে আর এদেশের মানুষ ছাগলের মতো গাদাই হয়ে বাসে ব্যা ব্যা করতে করতে অফিসে যায়। হায় দেশ!

আমার ডানপাশে ধপাস করে কে একজন এসে বসলেন। বসার ওজন বুঝে মনে হচ্ছে মিস্টার ইন্ডিয়ার কেউ হবেন টবেন। মোষের মতো নিশ্বাস পড়ছে। মহিষাসুরও হতে পারে। মা দুর্গার কাঁচা ফসকে পালিয়ে এসেছে। আমার একটা হাত ও-দিকের হাতলে আলগা ফেলা ছিল। তিনি প্রথমেই কী করলেন, আমার হাতটাকে এক ঠেলায় আমার কোলে ফেলে দিয়ে নিজের ঘেমো দুম্বো হাতটা হাতল জুড়ে রাখলেন। প্রথমে আমি কিছু মনে করিনি। যাক গে, বাঁ দিককার হাতলটা তো আমার দখলে আছে। সেই যথেষ্ট।

বই চলছে। সেই কুকুরওলা গাড়িটা বিশাল একটা বাগানবাড়িতে ঢুকছে। ঢুকুক। বাড়িটা একেবারে শহরের বাইরে। ভীষণ নির্জন। আমার নিজেরই বুকটা কেমন করছে। ভয় ভয় লাগছে। হঠাৎ মনে হল, ভদ্রলোক কোন অধিকারে আমার হাতটা ফেলে দিলেন ওইভাবে। আমিও পাঁচ পঁচানব্বইয়ের টিকিট কিনেছি, উনিও কিনেছেন। হাতলে দুজনের অধিকার সমান। সমান। মামার বাড়ি না কি! যেই মনে হওয়া, গোঁত্তা মেরে ওই লোমওলা ঘেমো হাতটাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে আমার অধিকার কায়েম করলুম। মনে মনে বললুম, অসভ্যতার একটা সীমা আছে।

মিনিট দুই আমার হাতটা থাকার সুযোগ পেল তারপই সেই লোমশ হাত আচমকা আমার হাতটাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে হাতল দখল করে নিল। এই শুরু হয়ে গেল লড়াই। তবে রে! আমি মিনিটখানেক অপেক্ষা করে আবার আচমকা ঠেলে ফেলে দিয়ে হাতল আমার দখলে নিয়ে এলুম। চোখ দুটো পর্দায়, মন কিন্তু পড়ে আছে ডান পাশের হাতলে। বাঁ পাশের দর্শকটিকে নিয়ে আমার তেমন সমস্যা নেই। তিনি তাঁর বাঁ পাশে একজন মহিলাকে নিয়ে বড়ই ব্যস্ত হয়ে। পড়েছেন। আমি জানি সারাক্ষণ তিনি বাঁ দিকেই কান্নিক মেরে থাকবেন।

এত বড় একটা হলের এত দর্শক কত ভাবেই না ব্যস্ত। কেউ মন দিয়ে ছবি দেখছেন। কেউ আছেন অন্ধকার দৃশ্যের অপেক্ষায়। অমনি ঘাড় আর দেহ হেলে পড়বে সঙ্গিনীর দিকে। পর্দার। প্রেম নেমে আসবে জীবনে। সবাই সব নিয়ে মশগুল। কারুর ধারণাই নেই এদিকে কি হচ্ছে! অন্ধকারে নিঃশব্দে চলেছে নিরক্ত বিপুল সংগ্রাম। হাতলের লড়াই। এ ঠেলছে, ও ঠেলছে। এই আমি হারি তো পরক্ষণেই আমি জয়ী। তবে জয়ী হয়ে বেশিক্ষণ রাজ্য আমার দখলে রাখতে পারছি না। কারণ লোকটি বেশ বলশালী। হাত নয় তো, কলাগাছের কাণ্ড! তা হোক, মানুষ জেতে মনের জোরে। আমার মনের জোর ক্রমশই বাড়ছে। হুহু করে বাড়ছে। প্রায় স্বদেশি যুগের দেশসেবকদের মতো করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে। ইন কিলাব…।

পর্দায় চোখ আছে মন নেই। কী যে ঘোড়ার ডিম হচ্ছে ওখানে। আমরা দুই যোদ্ধা কেউ কারুর দিকে তাকাচ্ছি না। শুধু অন্ধকারে আমি ঠেলছি, তিনি ঠেলছেন, তিনি ঠেলছেন, আমি ঠেলছি।

এইবার আমার হাতটাকে হাতলের ওপর কষকষে করে রেখে বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরলুম। নে। ব্যাটা এইবারে সরা দেখি, কেমন সরাতে পারিস। তিনি ঠেলছেন। পারবে না ম্যান। এইবার দু হাতে লড়ছি। ভদ্রলোকের জোরে নিশ্বাস পড়ছে। খুব তকলিফ হচ্ছে। প্রাণ ঢেলে ঠ্যালা মারছেন।

আমি তো এইটাই চাই। চাপ যখন তুঙ্গে উঠেছে, খুস করে হাতটা সরিয়ে নিলুম, আর ভদ্রলোকের হাত হড়াস করে চলে এল আমার পাশে, আচমকা ঘষড়ে গেল হাতলের ধারে, কনুইটা খটাস করে ঠুকে গেল আমার আসনের পেছনে। লেগেছে। অস্পষ্ট শোনা গেল—শালা, নুনছাল উঠে গেল। যাবেই তো। এটাই তো আমি চেয়েছিলাম বৎস। আমি ওই হাতের তলা দিয়ে আমার হাতটা কায়দা করে তুলে দিলুম হাতলে। শুধু গায়ের জোরে যুদ্ধ জেতা যায় না। চাই বুদ্ধি। যুদ্ধের ভাষায় যাকে বলে স্ট্র্যাটেজি।

পরদায় এখন ভীষণ কিছু ঘটতে চলেছে। মনে হয় একটা মার্ডার হবে। সেই রকম বাজনাই বাজছে। মরুক গে। ও তল্লাটে যা হচ্ছে হোক। আসল খেল তো আমার ডান পাশের হাতলে। ভদ্রলোক এইবার খেপে গেছেন। হেঁইসো মারি হেঁইও বলে আমার হাতটাকে আবার ফেলে দিলেন। জোরসে ঠেলো হেঁইও বলে আমি আবার ফেলে দিলুম। এত দুঃখেও আমার সেই গানের লাইনটা মনে পড়ছে—ওঠা-নামা প্রেমের তুফানে।

কী হল, কিছুই বুঝলাম না। সিনেমা শেষ হয়ে গেল।

ভদ্রলোক এই প্রথম আমার দিকে তাকালেন, মৃদু হেসে বললেন—বইটা খুব সুন্দর তাই না!

আমি বললুম—তা না হলে ছটা অস্কার পায়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress