Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » স্মৃতির আনন্দে মহালয়া ও সাহিত্য সাধনা ২০২৩ || Sanjit Mandal

স্মৃতির আনন্দে মহালয়া ও সাহিত্য সাধনা ২০২৩ || Sanjit Mandal

প্রতিবারই মহালয়ায় ঘুম ভাঙে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কন্ঠে মন্ত্রোচ্চারণের অপূর্ব দ্যোতনায়। সেই নিতান্ত ছেলে বেলা থেকেই। এইবারেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। ছোট বেলায় শুধু আমাদের বাড়িতে নয় অনেক বাড়িতেই রেডিওর অনুপ্রবেশের অনুমতি ছিলো না, তাই নিতান্ত শিশু বয়সেই দিদিদের হাত ধরে রাধিপিসীদের বাড়িতে মহালয়া শুনতে যেতাম। আমাদের বাড়ির পিছনেই থাকতো ওরা, আমার বাবার সেজ কাকার একমাত্র মেয়ে রাধিপিসী, তাই সেজ ঠাকুরদা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ঘরজামাই রেখেছিলেন। কাঠা চারেক জমি মেয়ের নামে লিখে দিয়ে টালির চালের ঘর বেঁধে দিয়েছিলেন। পিসীর বর সন্তোষ পিসেমশাই পোর্ট কমিশনে কাজ করতেন। পিসী নিঃসন্তান ছিলো আর আমাদের অর্থাৎ তার খুড়তুতো জ্যাঠতুতো ভাই বোনদের ছেলেপুলে দের খুব ভালোবাসতো । এই পিসীর বাড়িতে রেডিও ছিলো, সেই রেডিওতে মহালয়া শোনার জন্য সারাবছর আমরা মুখিয়ে থাকতাম। আমাদের ছোট বেলায় মহালয়ার ভোরে একটু শীত শীত ভাব ছিলো, তাই আমরা সকলে চাদর মুড়ি দিয়ে মহালয়া শুনতে যেতাম, এবং কিছুক্ষণ শোনার পরে আমার প্রথম বিস্ময় ভরা প্রশ্ন ছিলো রেডিওর পিছনে তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না তাহলে কে কথা বলছে, কারা গান করছে? অদম্য কৌতুহল চাপতে না পেরে মাঝে মাঝে কাপড় দিয়ে ঢাকা দেওয়া রেডিওটার পিছনে গিয়ে দেখে আসতাম, কেউ সেখানে আছে কি না। কাউকেই দেখতে না পেয়ে বিস্ময়ে হতবাক হতাম। আর পিসীকে ও দিদিদের বারবার জ্বালাতন করতাম, বলোনা পেছন থেকে কে কথা বলছে কারা গান করছে, প্রতিবারই বড়োরা হাসাহাসি করতো, বলতো এখন মন দিয়ে চুপ করে শোন পরে বুঝিয়ে বলবো। এই পরে কোনো দিন বুঝিয়ে বলেছিল কি না সেটা এখন আর খেয়াল নেই, তবে আধঘন্টা দেখার পরেই দিদিদের পাশে ঘুমিয়ে পড়তাম এটা মনে আছে।

আমাদের ছোট বেলায় মহালয়ার মধ্যে একটা মাদকতা ছিলো। আমাদের ছোট বেলায় এখনকার মতো লাখো হাজারো উপভোগের উপকরণ ছিলো না, হাজারটা মিডিয়ার এ বলে আমাকে দেখ তো ও বলে আমাকে দেখ, এই আমাকে দেখ এর প্রতিযোগিতা ছিলো না। একটাই সবেধন নীলমনি আকাশবাণী। তাতেই খবর, তাতেই নাটক, গল্প-দাদুর আসর। বিবিধ ভারতী এসেছে অনেক পরে, তদের মন মাতানো গানের ডালি নিয়ে, এসেই শ্রোতাদের মন জয় করে নিয়েছিল। ছায়াছবির গান আর অনুরোধের আসর ছিলো অসম্ভব ভালো বাসার আর ভালো লাগার অনুষ্ঠান, আমি আর আমার সেজদি বাণী দুজনে রাধা পিসির ঘরের পিছনের বেড়ার ধারে সন্ধ্যের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খেয়েও গানের মহিমায় ডুবে যেতাম, অকল্পনীয় সেই আনন্দের কথা মনে পড়লে আজও নষ্টালজিক হয়ে পড়ি। চোখের সামনে কাউকে না দেখেই কেবলমাত্র গলা শুনে নাটক গান গল্প ইত্যাদি শুনে অনুধাবন করতে করতে আমাদের কল্পনাশক্তি বহুদূর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে ছিলো। আজকাল যেমন সব কিছুই জলভাত হয়ে গেছে, আজকাল কল্পনা করার প্রয়োজন পড়েনা, এখন মুঠোফোনের দৌলতে গোটা পৃথিবী ই হাতের মুঠোয়, তখনকার দিনে এমনটা ছিলো না। তখন মানস চক্ষে অনেক কিছু দেখে বুঝে নিতে হতো। আজকাল মহালয়ারই কতো রকমফের দেখি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে, বিভিন্ন রকম ভাবে, নাচ গান, অসুরের সাথে যুদ্ধ বিভিন্ন আঙ্গীকে বর্ণময় কুশীলবদের নিরলস পরিশ্রমে অসাধারণ উপস্থাপনা। চোখ ধাঁধানো স্টেজ আর আলোর খেলায় অসাধারণ বর্ণময়। তবে ছোট বেলার সেই রেডিওর পিছনে কে আছে বলে খুঁজে হাতড়ানো বিস্ময়ের ঘোর কেটে গেছে বহুদিন আগে। একবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে সরিয়ে মহানায়ক কে দিয়ে মহালয়া করিয়ে সেই মহালয়া সম্প্রচারিত হয়েছিল আকাশবাণী থেকে। জমে নি, পরের বছর থেকে সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ কেই ফিরিয়ে আনতে হয়েছে। বাঙালি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ কে ভালো বেসে ফেলেছে, তার বিশুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণ, উদাত্তকণ্ঠস্বর, স্পষ্ট উচ্চারণে বাঙালি আগাগোড়া নষ্টালজিক। বাণী কুমারের গ্রন্থনা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পাঠ, পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সংগীত পরিচালনা, আর স্বর্ণযুগের শিল্পীদের হৃদয় ছোঁয়া গান আপামর বাঙালিকে মহিষাসুর মর্দিনী তে মজিয়ে রেখেছে দশকের পর দশক বিশ্বব্যাপী সর্বত্র । এবারের টিভি চ্যানেলে বেশ কয়েকজন নবীন শিল্পী তাদের ক্যারিশ্মা দেখিয়েছেন, মহিষাসুর মর্দিনীর সাথে আরও বেশ কয়েকজন অসুরের বিনাশ দেখানো হয়েছে, অনেক কিছু পৌরাণিক ঘটনা কে একসাথে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। মন্দ লাগেনি। ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে ঘুম জড়ানো চোখেই পয়ষট্টি বছর আগে যেমনটা দেখতাম, এবারেও তেমনটা ই দেখেছি মানসচক্ষে, তবে পিসীর বাড়িতে নয় দিদিরাও কেউ সঙ্গে ছিলো না, বেহালার পৈত্রিক বাড়ি ছেড়ে সন্তোষপুরের নতুন বাড়িতে একা একাই টিভি দেখি, পুরানো সেই দিনের কথা বড্ড মনে পড়ে যায়। এখানে পাড়ার পুজোর মাইকের দৌলতে মহিষাসুর মর্দিনী যেমন শুনেছি তেমনই একটি বাংলা চ্যানেলের অসাধারণ উপস্থাপনাও খুব ভালো লেগেছে।

এখানে আমার আর একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি, আমরা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েই পাড়ার পুজোর দায়িত্ব পেয়েছিলাম, এবং নতুন নতুন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুজোর একটা ছাপ রেখে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। এই প্রচেষ্টার অঙ্গ ছিল বাংলা ছায়াছবি দেখানো, কোনো প্রখ্যাত শিল্পীদের এনে জলসা করানো, নাটক, গান,আবৃত্তি ইত্যাদি করে সংস্কৃতিক বিনোদনের ব্যবস্থা করা। একবার আমরা ন হন্যতের লেখিকা শ্রীমতী মৈত্রেয়ী দেবীকে যেমন পুজো উদ্বোধনে এনেছিলাম তেমনই আমরা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে একসাথে এনেছিলাম বেহালায় আমাদের পাড়ার ক্লাব সংগঠনীর দুর্গাপূজায়, মনে আছে আমরা সারাদিন প্রচার করেছিলাম তাদের আসার কথা কিন্তু কেউ-ই বিশ্বাস করেনি, ভেবেছিলো কি সব ছেলে ছোকরারা পুজো করছে তাও আবার শুধু রামকুমারকে নয় সঙ্গে আবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র কেও আনছে। কিন্তু ওরা যখন সত্যিই এলেন এবং মঞ্চে উঠে রামকুমার হারমোনিয়াম ধরলেন আর বীরেন্দ্র কৃষ্ণ চণ্ডী পাঠ শুরু করলেন, মাইকে সেই পরিচিত স্বর শুনে আশ পাশের চার পাঁচটা পাড়া থেকে দলে দলে মানুষ জন আসতে শুরু করলেন, আমাদের পুজোর মাঠে অতো লোকের মতো জায়গা ছিলো না, বহুদূর পর্যন্ত মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন শুধু চোখের দেখা দেখবেন বলে।
সেদিন অনুষ্ঠান শেষে যখন তাদের দুজনকে হাত ধরে স্টেজ থেকে নামিয়েছিলাম, মনে হয়েছিল আমার জনম সার্থক হয়েছে।

এবারে শারিরীক কারণে তর্পণ করা হয়নি। পিতৃকুল এবং মাতৃকুল উভয় কুলের কাছে ক্ষমা চেয়ে সংসারের মঙ্গল কামনা করে দিন শুরু করেছি। দিনের প্রথম ভাগ এভাবেই সমাপ্ত করে দ্বিতীয় ভাগের জন্য প্রস্তুত হয়েছি।

দ্বিতীয় ভাগে আমার আমন্ত্রণ ছিলো হাজরায় সুজাতা সদনে, চন্দ্রিমা বসুর আর আর ফ্যাশন হাব এর শারদীয় পত্রিকা শুনো বর নারী শারদ সংখ্যা ১৪৩০ এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে।
এই পুজো সংখ্যায় আমার একটি গল্প ও একটি কবিতা স্থান পেয়েছে। আর আর ফ্যাশন হাব যেহেতু পুরোপুরি ফ্যাশন কেন্দ্রীক এবং প্রফেশনাল তাই ওদের উপস্থাপনা ও সুন্দর এবং দেখার মতো। পুজো সংখ্যার লেখক লেখিকা ছাড়াও আমন্ত্রিত ছিলেন ফ্যাশন জগতের অনেক কুশীলব। অন্যান্য অনেক ব্যবসায়ীক সাহিত্য পরিবারের মতো এরা টাকা নিয়ে লেখা ছাপেনি বরং বিনামূল্যে বই ও উপহার দিয়েছেন। সেই সঙ্গে লেখক লেখিকা দের মানপত্র দিলে আরও ভালো লাগতো। সুন্দর গ্লসি পেপার ঝকঝকে ছাপানো অক্ষর এ ৪ সাইজের প্রায় সাড়ে আট ফর্মার বইটি ফ্যাশন আর সাহিত্যের মেলবন্ধনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বইটির প্রচ্ছদেও অভিনবত্বের ছাপ আছে, ফ্যাশন শো তে অংশ গ্রহণ কারী ছেলে মেয়েরাই দেবী দুর্গার বিভিন্ন রূপে এবং দেবতা ও অসুরের বিভিন্ন বেশে প্রচ্ছদে এবং বইয়ের পাতায় পাতায় এবং সাধারণ পোশাকে অনুষ্ঠানে ও উপস্থিত। অনুষ্ঠান টি শেষ হতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো।

এই বিকেলেই আমার সাহিত্য জগতের অভিন্নহৃদয় বন্ধু শ্রী মানিক দাক্ষিত আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলেন শিয়ালদার কাছে কৃষ্ণপদ ঘোষ মেমোরিয়াল হলে, ওখানে তার একক ছড়া কবিতা ও অনুকবিতার সংকলন গ্রন্থ উত্তরণ, এবং তার সম্পাদনায় আনন্দধারা সাহিত্য পত্রিকার তৃতীয় উৎসব সংকলন গ্রন্থ জাগরণ এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে। জাগরণ বইটি তে আমার এবং আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধুদের প্রবন্ধ ও গল্প ইত্যাদি স্থান পেয়েছে। দুটি বইয়েরই প্রচ্ছদ পরিকল্পনা শ্রী মানিক দাক্ষিতের নিজস্ব এবং বলা বাহুল্য দৃষ্টি নন্দন। উত্তরণ বইটি ছড়ায়, আঁকায় লেখায় রেখায় ও অলঙ্করণে দৃষ্টি নন্দন ও সুখপাঠ্য। প্রায় সাড়ে সাত ফর্মার বইটি শ্রী দাক্ষিতের মুকুটে আর একটি নতুন পালকের সংযোজন।
আনন্দধারা সাহিত্য পত্রিকার উৎসব সংকলন জাগরণ বইটি শ্রী দাক্ষিতের আর একটি অনবদ্য সৃষ্টি। জাগরণ বইটিতে একই মলাটের মধ্যে বিভিন্ন লেখক ও কবির গল্প, অনুগল্প, রম্যরচনা, কবিতা, অণু কবিতা, ছড়া,প্রবন্ধ, মুক্ত গদ্য, লিমেরিক ও ভৌতিক গল্প স্থান পেয়েছে। এই বইয়ের প্রতিটি লেখাই সুখপাঠ্য। আট ফর্মার বইটি শ্রী মানিক দাক্ষিতের একক ব্যয়ে প্রস্তুত, তিনি কারোর কাছ থেকে একটি পয়সাও নেননি শুধু নয় বিনামূল্যে বই ও মানপত্র উপহার দিয়েছেন। সাহিত্য কে যারা প্রকৃত ই ভালো বাসেন, এবং সাহিত্যের জন্য নিরলস সদ্ভাবনায় নিযুক্ত থাকেন, যারা নতুন নতুন সাহিত্যের সৃষ্টি সাধন করেন তিল তিল করে দৈনন্দিন খরচ বাঁচিয়ে, শ্রী মানিক দাক্ষিত তাদের মধ্যে অন্যতম।

মহালয়ার পূণ্য লগনে বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কৃষ্ণপদ মেমোরিয়াল হলের অনুষ্ঠান কবি, ছড়াকার কচিপাতা ও অজগর শিশু পত্রিকার সম্পাদক হাননান আহসান মহাশয়ের সুযোগ্য পরিচালনায় খুবই সুন্দর, মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও খুব উপভোগ্য হয়েছে, ওই দিন আরও পাঁচটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। সারাদিন সাহিত্যের পরিমণ্ডলে কবি সাহিত্যিকদের সান্নিধ্যে এক অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে রাতে বাড়ি ফিরেছি এক বুক আশা নিয়ে। সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী হানাহানির ঊর্ধ্বে উঠে শান্তির পায়রা ওড়ানোর জন্য সুস্থ সাহিত্যের কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র সুসাহিত্যই পারে জাতি ধর্ম উচ্চ নীচ ভেদাভেদ মুছে দিয়ে সমগ্র পৃথিবীর মানুষকে কাছাকাছি টেনে এনে যুদ্ধের দামামা থামিয়ে দিয়ে শান্তির বাতাবরণ প্রস্তুত করতে।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress