Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

পরের দিন দুপুরে খোকন

পরের দিন দুপুরে খোকন সোফায় বসে সিগারেট টানছিল। সোনালী বিছানার উপর বসে ভাজা মশলা চিবুতে চিবুতে বলল, কাল রাত্রে তোমাকে খুব কষ্ট দিয়েছি, তাই না খোকনদা?

কষ্ট দিয়েছিস নাকি?

এক সেকেন্ডের মধ্যে তুমি ঘুমিয়ে পড়লে দেখে আমার এত কষ্ট লাগছিল যে কী বলব।

তুইও তো সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লি।

মোটেও না। আমি আর ঘুমোইনি।

বাজে বকিস না।

সত্যি বলছি আর ঘুম এলো না।

কেন?

সোনালী একটু হেসে বলল, তুমি এমন ক্লান্ত, অসহায় হয়ে আমাকে জড়িয়ে শুয়েছিলে যে আমি তোমাকে ছেড়ে উঠতেও পারলাম না ঘুমোতেও পারলাম না।

বানিয়ে বানিয়ে আজেবাজে কথা বলবি না।

সত্যি খোকনদা, তুমি ঠিক ছোটবেলার মতন…

এই বুড়ো বয়সে ছেলেবেলার মতন…

আজ্ঞে হ্যাঁ।

খোকন মনে মনে একটু লজ্জা পায়। একটু পরে খোকন জিজ্ঞাসা করল, আমি ওইভাবে শুয়েছিলাম বলে তোর রাগ হয়নি?

রাগ হবে কেন? তবে অনেক কাল পরে তুমি আমার পাশে শুয়েছিলে বলে একটু অস্বস্তি লাগছিল।

অস্বস্তি মানে?

তোমার হাত-টাত কত ভারী, কত মোটা হয়ে গেছে।…

খোকন হাসে।

তবে তোমার গায়ে একটা ভারি সুন্দর গন্ধ আছে।

খোকন হেসে জিজ্ঞাসা করে, তাই নাকি?

সত্যি। তোমার গায়ের গন্ধ আমার খুব ভালো লাগে।

সবার গায়েই একটা গন্ধ থাকে। তোরও আছে।

আমার গায়ে গন্ধ?

হ্যাঁ, তোর গায়েও গন্ধ আছে বৈকি!

সোনালী বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, ঘণ্টা আছে।

সোনালী আর কথা বলে না। শুয়ে পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ওর ঘুম আসে। সামনের সোফায় বসে সিগারেট টানতে টানতে খোকন ওর দিকে তাকায় অনেকক্ষণ। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

পাশ ফিরতে গিয়ে হঠাৎ সোনালী চোখ মেলে তাকায়। খোকনকে দেখে। জিজ্ঞাসা করে, তুমি একটু ঘুমোবে না খোকনদা?

না।

রাত্রে তো ঘুম হয়নি। এখন একটু ঘুমোও।

সোনালী আবার ঘুমিয়ে পড়ে।

বিকেলবেলায় সমুদ্রের ধারে বেড়াতে বেড়াতে মিস্টার সরকার সোনালীকে বললেন, এখানে সুন্দর সুন্দর সিল্কের শাড়ি পাওয়া যায়। দামও সস্তা।

তাহলে বড়মাকে একটা ভালো শাড়ি কিনে দাও।

তুই কিনবি না?

আমি সিল্কের শাড়ি দিয়ে কি করব?

আমি তো ভাবছিলাম শুধু তোর জন্যই একটা শাড়ি কিনব।

কেন?

তোর বড়মার অনেক শাড়ি আছে।

তা হোক। তুমি বড়মাকেই কিনে দাও।

খোকন হাসতে হাসতে বলল, সোনালী তুই বেশ ভালোভাবেই জানিস বাবার মাথায় যখন এসেছে তখন তোর শাড়ি কিনবেনই, কিন্তু বেশ ন্যাকামি করে…

সোনালী আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ওর পিঠে দুম করে একটা ঘুষি মেরে বলল, আর আজেবাজে কথা বলবে?

ও ভয়ে কম্পিত নয় বীরের হৃদয়।

ওরা তিনজনেই হাসেন।

শিবানী হাসতে হাসতে বললেন, তোদর ছেলেমানুষী আর যাবে না।

পরের দিন সকালে গভর্নমেন্ট এম্পোরিয়াম থেকে দুটো শাড়িই কেনা হল। এম্পোরিয়াম থেকে হোটেলে ফেরার পর শিবানী বললেন, সোনালী আজ বিকেলে এই শাড়িটা পরিস।

কলকাতায় গিয়ে পরব।

না আজ বিকেলেই পরিস।

বিকেলে ওই শাড়িটা পরে সোনালী সামনের বারান্দায় আসতেই মিস্টার সরকার আর ওঁর স্ত্রী একসঙ্গে বললেন বাঃ! কী সুন্দর দেখাচ্ছে।

সোনালী ওদের দুজনকে প্রণাম করল। খোকন এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে ভুবনেশ্বর গেছে। খেয়ে-দেয়ে রাত দশটা-সাড়ে দশটায় ফিরবে। তাই ওকে প্রণাম করতে পারল না।

মিস্টার সরকার সোনালীকে একটু আদর করে বললেন, তুই সত্যিই সোনালী।

শিবানী ওর কপালে একটা চুমু খেয়ে বললেন, যত দিন যাচ্ছে তুই তত সুন্দরী হচ্ছিস।

লজ্জায় আর খুশিতে সোনালী মুখ তুলতে পারে না।

সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গিয়ে সবাই একবার সোনালীর দিকে দেখেন। ও লজ্জায় মুখ তুলে হাঁটতে পারে না। মিস্টার সরকার গর্বের সঙ্গে বললেন, দেখেছ শিবানী আজকে কেউ সমুদ্র। দেখছে না, সবাই তোমার মেয়েকে দেখছে।

বড়মা, জ্যাঠামণি এইসব কথা বললে আমি এক্ষুনি হোটেলে ফিরে যাব।

শিবানী বললেন, কালও কত লোক তোকে দেখেছিলেন। এতে লজ্জা পাবার কি আছে?

.

রাত্রে বি এন আর হোটেলের ডাইনিংরুমে এক মজার কাণ্ড ঘটল। মধ্য বয়সী এক দম্পতি মিস্টার সরকার শিবানীকে বললেন, আপনার এই মেয়েটিকে যে আমি পুত্রবধু করার লোভ সামলাতে পারছি না।

সোনালী ওই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে ঘরে চলে গেল।

সোনালীর কাণ্ড দেখে ওরা চারজন একসঙ্গে হেসে উঠলেন।

দু-এক মিনিটের মধ্যে খোকন ফিরে এসে ওকে এত সেজেগুঁজে একলা থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করল, তুই একলা একলা কী করছিস?

এমনি বসে আছি।

বাবা মা কোথায়?

ডাইনিংরুমে।

তোর খাওয়া হয়ে গেছে?

হ্যাঁ।

ওঁদের খাওয়া হয়নি?

হয়েছে।

তবে ওঁরা কি করছেন?

এক ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলছেন।

তা তুই চলে এলি?

সোনালী এতক্ষণ মুখ নীচু করে একটার পর একটা প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। এবার ও খোকনের দিকে তাকিয়ে বেশ একটু উৎকণ্ঠার সঙ্গে বলল, জানো খোকনদা ওই ভদ্রমহিলা কি অসভ্য!

খোকন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কেন কি হয়েছে?

হঠাৎ বড়মা আর জ্যাঠামণিকে এসে বলছে আপনার মেয়েকে পুত্রবধু করতে ইচ্ছে করছে!

খোকন হো হো করে হেসে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গে সোনালী ওর হাতে একটা চড় মেরে বলল, তুমিও ভীষণ অসভ্য।

কয়েক সেকেন্ড পরেই সোনালী খোকনকে প্রণাম করতেই ও জিজ্ঞাসা করল, চড় মেরেই প্রণাম?

নতুন শাড়ি পরেছি না।

খোকন কয়েকটা মুহূর্তের জন্য অপলক দৃষ্টিতে সোনালীকে দেখে বললে, সত্যি আজ তোকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।

সকালবেলার প্রথম ঝলক সোনালী রোদের মতন ও হঠাৎ মিষ্টি হেসে বলল, সত্যি খোকনদা?

খোকন ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, দারুণ!

খোকন আর কোন কথা না বলে বাবা মার সঙ্গে দেখা করতে গেল। দশ-পনেরো মিনিট পরে এঘরে ফিরে আসতেই সোনালী জিজ্ঞাসা করল, জ্যাঠামণি বা বড়মা আমার সম্পর্কে কিছু বললেন?

খোকন মুখ টিপে হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, তুই কি জানতে চাস? বিয়ের কথা?

খুব গম্ভীর হয়ে সোনালী বলল, বাজে অসভ্যতা কোরো না।

তোর ভয় নেই। কেউ তোকে দুম দাম বিয়ে দিয়ে পার করবে না।

সোনালী চুপ করে বসে থাকে। কোনো প্রশ্ন, কোনো মন্তব্য করে না।

খোকন চুপ করে থাকে না। আস্তে আস্তে সোনালীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, তোর বিয়ে দিতে হবে ঠিকই কিন্তু বাবা-মা তোকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেই পারেন না।

সোনালী এবারও কিছু বলে না।

খোকন বলে, আমি ভাবতেই পারি না তুই অন্য কোথাও চলে যাবি। তুই না থাকলে আমি তো বোবা হয়ে যাব।

সোনালী এসব কথার কোন জবাব না দিয়ে শুধু বলল, আর কথা না বলে জামা-কাপড় বদলে শুয়ে পড়ো।

তোর ঘুম পাচ্ছে নাকি?

আজ বোধহয় সারারাতই জেগে থাকব।

কেন?

কেন আবার? দুপুরে ঘণ্টা চারেক ঘুমিয়েছি।

তাহলে তো আজ জোর আড্ডা হবে।

না, না, তুমি এত ঘোরাঘুরি করে এসেছ, তুমি নিশ্চয়ই ঘুমোবে।

গল্প করলে আমার ঘুম আসে না।

তুমি শোও। আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। সোনালী একটু থেমে, একটু হেসে বলল, কাল রাত্রে তুমি আমাকে যা দিয়েছ, তার কিছু প্রতিদান আজ দিই।

সে রাত্রে খোকন সত্যি ঘুমিয়ে পড়ে।

এরপর যখন খোকন ছুটিতে এসেছে তখনই কথায় কথায় বলেছে মা, সোনালী যদি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমাকে চা না দেয় তাহলে পুরীর ওই ভদ্রলোকের ছেলে ক্যাবলার সঙ্গেই আমি…

সোনালী দুম দুম করে খোকনের পিঠে দুটো-তিনটে ঘুষি মেরে বলে, ক্যাবলার বোনের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবো।

বিহাইকাকা বলেছিল ক্যাবলা ছেলেটি বেশ ভালো। মল্লিক বাজারে মোটরের চোরাই পার্টস বিক্রি করে বেশ টু পাইস…

আর কেবলি বুঝি তোমার সঙ্গে আই-আই টিতে পড়ে?

তবে ক্যাবলা জামাই হলে বাবা নিশ্চয়ই ওকে অফিসের জমাদার করে নেবে।

সোনালী বাচ্চাদের মতন চিৎকার করে, খোকনদা!

শিবানী আর শুয়ে থাকতে পারে না। উঠে এসে বললেন, তোদের জ্বালায় কোনোদিন দুপুরে আমার বিশ্রাম করার উপায় নেই।

দ্যাখো না বড়মা…

ওকে এক কাপ চা করে দিলেই তো…

কিন্তু আমাকে যা তা বলছে কেন?

খোকন…তুই বড্ড ওর পিছনে লাগিস।

খোকন ফিরে যাবার দু-এক দিন আগে সব ঝগড়া হঠাৎ থেমে যায়।

জানিস সোনালী, হোস্টেলে এমনি বেশ ভালোই থাকি কিন্তু ছুটির পর ফিরে গিয়ে কিছুদিন বড্ড খারাপ লাগে।

সত্যি বলছ, নাকি আমাকে খুশি করার জন্য বলছ?

সত্যি বলছি। হোস্টেলে পড়াশুনা ইয়ার্কি-বাঁদরামি করে দিনগুলো ভালোই কাটে, তবে এখন ফিরে গিয়ে মাসখানেক শুধু এখানকার কথা মনে পড়বে।

আমার কথা মনে পড়ে?

খোকন সিগারেট টানতে টানতে শুধু মাথা নাড়ে।

কি মনে হয়?

খোকন দু-এক মিনিট কি যেন ভাবে। তারপর আস্তে আস্তে দৃষ্টিটা বাইরের দিকে ঘুরিয়ে যেন আপন মনেই বলে, তোর কথা খুব বেশি মনে হয়।

কেন?

খোকন যেন ওর কথা শুনতে পায় না। বলে, তোকে নিয়ে অনেক কথা ভাবি।

আমাকে নিয়ে এত কী ভাবে খোকনদা?

ও একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে, সে এখন বলতে পারব না।

কেন?

খোকন ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে, মানুষ মনে যা কিছু ভাবে তা কি সব সময় বলতে পারে?

আমার কথা আমাকেও বলা যায় না?

খোকন আবার মাথা নাড়ল। বলল, না।

বেশ কিছুক্ষণ পরে সোনালী বলল, তুমি চলে গেলে আমারও খুব খারাপ লাগে। মনে হয় কেন তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতাম, কেন তোমার গা টিপে দিইনি…

আর কি মনে হয়?

বাড়িটা ভীষণ ফাঁকা লাগে!

তাই নাকি?

হ্যাঁ খোকনদা। লেখাপড়া, কাজকর্ম কিছুতেই মন বসাতে পারি না।

কেন?

কেন আবার? শুধু তোমার কথা মনে হয়।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর হঠাৎ খোকন তাকে জিজ্ঞাসা করল, তুই সত্যিই আমাদের ছেড়ে চলে যাবি?

কোথায় চলে যাব?

কোথায় আবার? বিয়ে করে চলে যাবি?

ওসব কথা আমি ভাবি না।

একেবারেই ভাবিস না?

না।

কিন্তু একদিন তো তোকে চলে যেতে হবে, তা তো জানিস?

সোনালী কোন জবাব দেয় না।

আচ্ছা সোনালী আমি যদি তোকে যেতে না দিই?

সোনালী হেসে বলে, এখানে থাকতে পারলে তো আমারই মজা।

সত্যি বল তুই থাকবি?

থাকব না কেন?

তোর আপত্তি নেই?

এখানে থাকতে আমার আবার কি আপত্তি?

মিস্টার সরকার অফিস থেকে এসে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই বললেন, শিবানী আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম আজই মিস্টার ব্যানার্জির মেয়ের বিয়ে।

আজই? শিবানী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

আমার একদম মনে ছিল না। তারপর ঘোষের কাছে শুনেই…

আজ তো আঠারোই। আমারও একদম খেয়াল ছিল না।

চটপট তৈরি হয়ে নাও। একটা শাড়ি কিনতে হবে তারপর মিত্তিরকে তুলে নিয়ে হাওড়া হয়ে কোন্নগর যাওয়া।

মিত্তিরের গাড়ি কি হলো?

ওর গাড়ি টিউনিং করতে গ্যারেজে দিয়েছে।

তার মানে পার্ক সার্কাস ঘুরে হাওড়া হয়ে কোন্নগর?

কি আর করা যাবে? তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।

কাল খোকন যাবে, আর আজ… কিন্তু ব্যানার্জির মেয়ের বিয়েতে না গিয়ে তো উপায় নেই।

তা ঠিক। শিবানী একটু ভেবে বললেন, ফিরতে ফিরতে নিশ্চয় বারোটা একটা হয়ে যাবে?

মিস্টার সরকার একটু হেসে বললেন, এখন ছটা বাজে। সাতটায় বেরিয়ে শাড়ি কিনে মিত্তিরের বাড়ি পৌঁছতেই আটটা। সোনালীর হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে বললেন, বিয়ে বাড়ি পৌঁছতেই দশটা বেজে যাবে।

তার মানে ফিরতে ফিরতে দুটো আড়াইটে!

তবে কাল রবিবার। এই যা ভরসা।

তৈরি হয়ে সোনালীকে সব বুঝিয়ে ওদের বেরুতে বেরুতে সোয়া সাতটা হয়ে গেল।

ওরা বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই খোকন সিগারেট ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, সোনালী, চা কর।

ও হাসতে হাসতে বলল, জ্যাঠামণি, বড়মা বেরুবার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝি তোমার বাঁদরামি শুরু হলো?

ভালো করে সেবা-যত্ন কর; তা নইলে আমি চলে যাবার পর মনে মনে আরও কষ্ট পাবি।

অযথা এসব কথা বলে আমার মন খারাপ করে দিও না।

খোকন হঠাৎ দু হাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে কপালের সঙ্গে কপাল ঠেকিয়ে বলল, আমি চলে গেলে সত্যি তোর মন খারাপ হয়?

না হবার কি আছে?

তুই আমাকে ভালোবাসিস?

তুমি জানো না?

না।

বুঝতে পারো না?

খোকন অদ্ভুতভাবে ওর দিকে তাকিয়ে শুধু মাথা নাড়ল।

তাহলে তোমার জেনে কাজ নেই।

তুই বল না আমাকে ভালোবাসিস কিনা।

ভালোবাসব না কেন?

কি রকম ভালোবাসিস?

সোনালী মাথা দুলিয়ে বলল, আমি অত জানি না।

জানিস না?

না। সোনালী ওর হাত দুটো টেনে বলল, হাত খোলল। চা করব।

চা করতে হবে না।

এক মিনিট আগেই বললে চা কর। আবার…

আগে আমাকে একটু আদর কর।

অসভ্যতা কোরো না। তুমি হাত খোলো।

আগে আমাকে একটু আদর কর। তা না হলে আমি হাত খুলছি না।

অসভ্যতা কোরো না খোকনদা। তুমি আমাকে ছেড়ে দাও। আমার অনেক কাজ আছে।

একটু আদর না করলে আমি ছাড়ছি না।

আমি আদর করতে জানি না।

জানিস না?

না।

আমাকে আদর করতে ইচ্ছে করে না?

বাজে বকবে না। তুমি এই পাঁচ বছর হোস্টেলে থেকে অত্যন্ত অসভ্য হয়ে গেছ।

তাই নাকি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। তুমি কি ভেবেছ আমি কিছুই বুঝি না? আমিও দুদিন পর বি-এ পরীক্ষা দেবো।

আমি কী অসভ্যতা করলাম?

সব বলা যায় না।

এমন অসভ্যতা করেছি যে বলাই যায় না?

তোমাদের মতন হোস্টেলের ছেলেদের কাছে এসব অসভ্যতা না হলেও…

কি সব অসভ্যতা?

বলেছি তো আমি সবকিছু খুলে বলতে পারব না। তুমি আমাকে ছেড়ে দাও।

খোকন একটু হেসে ওকে ছেড়ে দিল। বলল, তুই ঠাট্টা-ইয়ার্কি বুঝিস না সব ব্যাপারেই তুই বড্ড সিরিয়াস।

সোনালী ড্রইংরুম থেকে বেরুতে বেরুতে বলল, এ ধরনের ঠাট্টা-ইয়ার্কি তুমি আমার সঙ্গে করবে না।

আচ্ছা তুই চা কর।

পারব না।

চা খাওয়াবি না?

না।

কাল চলে যাবার পর যখন…

আমার কিছু মন খারাপ হবে না। তুমি আজই চলে যাও।

কিন্তু আমার যে ভীষণ চা খেতে ইচ্ছে করছে।

শুধু চা কেন, আরও অনেক কিছু খেতেই তোমার ইচ্ছে করছে কিন্তু আমার দ্বারা কিছু হবে না।

চা খাওয়াবি না?

তুমি আমার সঙ্গে বকবক কোরো না। সোনালী এবার আপন মনেই বলে, হাজার কাপ চা খাইয়েও তোমার মন ভরবে না। একটু আগেই তোমার যে মূর্তি দেখেছি তাতে আমার আর কিছু বুঝতে বাকি নেই।

খোকন ওর কথার কোনো জবাব না দিয়ে নিজের ঘরে গেল। প্যান্ট-বুশসার্ট পরে বেরুবার সময় বলল, আমার ফিরতে রাত হবে।

আমি একলা একলা থাকব?

খোকন চলে গেল।

সোনালী দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। ভাবছিল নানাকথা। খোকনদার কি মাথা খারাপ হয়েছে? ও কেন এমন পাগলামি করে? তাছাড়া আমার সঙ্গে কি ওর এই পাগলামি করার সম্পর্ক?

সোনালী খোকনের কথা ভাবতে ভাবতেই রান্নাঘরের কাজ শেষ করল। তারপর নিজের ঘরে এলো। বসল। সঙ্গে সঙ্গেই উঠে খোকনের সঙ্গে গার্ডেনে তোলা ওদের দুজনের ছবিটার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। ঘড়িতে ঢং ঢং করে দশটা বাজতেই সোনালী চমকে উঠল। মনে মনে একটু ভয় পেল। তাছাড়া হঠাৎ খোকনের জন্য মনটা বড় চঞ্চল হয়ে উঠল। জানালা দিয়ে অনেকক্ষণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। না খোকন আসছে না। এক এক মিনিট এক এক ঘণ্টা মনে হয়। সোনালী ছটফট করে। ঘড়িতে সাড়ে দশটার ঘণ্টা বাজতেই ওর কান্না পায়।

সোয়া এগারটার সময় খোকন আসতেই সোনালী আর কান্না চেপে রাখতে পারে না। অঝোরে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতেই বলে, এভাবে আমাকে একলা রেখে যাবার কোন মানে হয়? আমি ভয় ভাবনায় মরে যাচ্ছিলাম।

খোকন শুধু বলল, কাদিস না। আমার ঘরে আয়। কথা আছে।

আমাকে একলা রেখে তুমি এতরাত পর্যন্ত কেন বাইরে ছিলে, আগে সেকথা বলো।

সত্যি অন্যায় হয়েছে। তুমি আমাকে ক্ষমা কর।

খোকনের কথা শুনে সোনালী চমকে ওঠে। বলে, তুমি এভাবে কথা বলছ কেন খোকনদা?

খোকন নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, অন্যায় করেছি, ক্ষমা চাইব না?

সোনালী ওর পিছন পিছন ওর ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কী হয়েছে বলো তো?

কি আবার হবে? কিচ্ছু হয়নি।

সোনালী খোকনের কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলল, আমাকেও বলবে না? আমি না তোমার সোনা, সোনালী?

খোকন আর চুপ করে থাকতে পারে না। দুহাত দিয়ে ওর কোমর জড়িয়ে বুকের ওপর। মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল, সোনালী, তোকে ছাড়া আমি বাঁচব না।

আমি কি মরে যাচ্ছি যে তুমি একথা বলছ?

না, না সোনালী, তোকে আমি হারাতে পারব না। কোনোদিন না। সোনালী আঁচল দিয়ে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলে, আমি কোথায় হারিয়ে যাচ্ছি যে তুমি এমন করে কাঁদছ?

খোকন মুখ তুলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুই আমাকে ভালোবাসিস না?

নিশ্চয়ই ভালোবাসি।

খুব ভালোবাসিস?

মনে তো হয়।

তুই আমাকে বিয়ে করতে…

সোনালী সঙ্গে সঙ্গে একটা হাত দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরে বলে, খোকনদা!

সোনালীর হাত সরিয়ে খোকন বলল, আমি কি খুব অন্যায় কথা বললাম?

সোনালী কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি জানি না খোকনদা। তুমি আমাকে এসব প্রশ্ন কোরো না।

খোকন নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, আমার পাশে একটু বসবি?

সোনালী কোন জবাব না দিয়ে পাশে বসল।

তুই আমার জন্য খুব ভাবছিলি?

ভাবব না?

কি ভাবছিলি?

অনেক রকম আজেবাজে চিন্তা হচ্ছিল।

আজেবাজে মানে?

ভাবছিলাম কোনো বিপদে পড়লে কিনা।

খোকন একটু থেমে জিজ্ঞাসা করল, আমি তো কাল চলে যাচ্ছি। চিঠি লিখবি তো?

তুমি চিঠি লিখলেই জবাব দেবে।

না, এবার তুই আগে লিখবি।

কেন?

আমি যে প্রশ্ন করলাম, তার জবাব দিবি।

না, না খোকনদা, ওসব কথা আমি লিখতে পারব না!

কিন্তু আমি যে তোর জবাব না পেলে শান্তিতে পরীক্ষা দিতে পারব না।

মনে রেখো এবার ফাইন্যাল পরীক্ষা।

তাই তো বলছিলাম…

ওসব পাগলামি ছাড়ো। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলে আমি আর তোমাকে ভালোবাসব না।

খোকন সোনালীর মুখের সামনে মুখ নিয়ে হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল, পরীক্ষার রেজাল্ট যদি ভালো হয়, তাহলে আপত্তি করবি না তো?

লজ্জায় সোনালী প্রায় দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

.

পরীক্ষা দিয়ে ফিরতেই হাওড়া স্টেশনে সোনালীকে একলা দেখে খোকন অবাক। জিজ্ঞাসা করল, কিরে মা আসেনি?

না।

তুই একলা এসেছিস?

হ্যাঁ।

মা এলেন না কেন?

আমি বারণ করলাম।

কেন?

তোমার সঙ্গে ঝগড়া করব বলে।

ঝগড়া!

তুমি যেন গাছ থেকে পড়লে মনে হচ্ছে।

কিন্তু…

এই দুমাসের মধ্যে আমাকে একটা চিঠি দাওনি কেন?

খোকন সোনালীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলল, তোকে আজ দারুণ দেখাচ্ছে!

আঃ! কি বাজে বকছ!

স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেই খোকন বলল, চল সোনালী রিকশা করে বাড়ি যাই।

তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?

রিকশায় গেলে বেশ প্রাণভরে আড্ডা দেওয়া যাবে।

তুমি রিকশায় এসো। আমি ট্রামে-বাসে ফিরে গিয়ে বড়মাকে খবরটা দিই।

ট্যাক্সিতে উঠেই সোনালী বলল, তোমার চেহারাটা দারুণ খারাপ হয়ে গেছে।

হবে না? একে পড়াশুনোর চাপ, তার উপর তোর চিন্তা।

বড়মা জিজ্ঞাসা করলেও এই জবাব দেবে তো?

খোকন হাসে।

ছুটির দিনগুলো আনন্দে, হৈ-হুঁল্লোড় করে প্রায় ঝড়ের বেগে ফুরিয়ে গেল।

রেজাল্ট বেরুবার দিন বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।

বিহারী ছুটতে ছুটতে এসে খোনকে জড়িয়ে ধরে বলল, খোকনদা এখন আমি মরলেও আমার কোনো দুঃখ থাকবে না।

কে তোমাকে মরতে দিচ্ছে?

তোর অনুমতি নিয়ে আমাকে মরতে হবে?

একশো বার!

.

রেজাল্ট বেরুবার এক মাসের মধ্যেই খোকন বাঙ্গালোরে বারোশো টাকা মাইনের চাকরি পেয়ে গেল। সবাই খুশি, সবাই আনন্দিত কিন্তু খোনকে দেখে খুশি হওয়া তো দূরের কথা, বেশ চিন্তিত মনে হয়!

শিবানী খোকনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে, তুই এত কি ভাবছিস?

কিছু না।

কিছু না বললেই আমি শুনব! আজ কদিন ধরে সব সময় চুপচাপ বসে আছিস। কি হয়েছে তোর?

সত্যি বলছি কিছু হয়নি।

রাত্রে সবাই শুয়ে পড়ার পর সোনালী আস্তে আস্তে খোকনের ঘরে এসে ওর পাশে বসল। একটু চুপ করে থাকার পর বলল, তোমাকে এমন চিন্তিত থাকতে দেখে জ্যাঠামণি ভীষণ চিন্তিত।

খোকন কোন কথা বলে না।

তুমি আমাকেও কিছু বলবে না?

কি বলব বল।

তুমি এত কি ভাবছ?

কি আর ভাবব? ভাবছি তোর কথা।

সোনালী আর কোনো প্রশ্ন করতে পারল না।

.

খোকনের বাঙ্গালোর রওনা হবার আগের রবিবারের কথা। সোনালী বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমায় গেছে। খোকন ওর বাবা মার ঘরে ঢুকেই মুখ নীচু করে বলল, একটা কথা বলতাম।

ওর মা একটু হাসতে হাসতে বললেন, তা এমন করে বলছিস কেন?

খোকন মুখ নীচু করেই বলল, আমি সোনালীকে বিয়ে করব।

মিস্টার সরকার পাগলের মতন চিৎকার করে উঠলেন, ননসেন্স! ভাই-বোনে কখনো বিয়ে হয়?

শিবানী তাড়াতাড়ি খোকনের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বললেন, তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?

খোকন জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের মতামত বলবে না?

মিস্টার সরকার আবার গর্জে উঠলেন, রাসকেল, গেট আউট। এক্ষুনি বেরিয়ে যা হতভাগা!

শিবানী দুহাত দিয়ে ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে বললেন, হাজার হোক সোনালী একটা ড্রাইভারের মেয়ে…

খোকন পাগলের মতো হো হো করে হাসতে হাসতে বলল, মা! ওয়ান্ডারফুল! ওয়ান্ডারফুল! আমি ভুলে গিয়েছিলাম, সোনালী বিহারী ড্রাইভারের মেয়ে!

.

খোকনের পৌঁছনোর সংবাদ আসার পর কলকাতা থেকে ওরা তিনজনেই চিঠি দিলেন কিন্তু তার কোনো উত্তর এল না। মিস্টার সরকার টেলিগ্রাম করে ওর খবর জানতে চাইলেন।

ঠিক দুদিন পরের কথা।

এগারোটা বাজতে না বাজতেই মিস্টার সরকার অফিস থেকে ফিরে এসেই বাচ্চা ছেলের মতন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, শিবানী, খোকন পাগল হয়ে গেছে!

পাগল!

হ্যাঁ।

ছোট্ট শিশুর মতন হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মিস্টার সরকার টেলিগ্রামটা শিবানীর দিকে ছুঁড়ে দিলেন।

পাশের ঘর থেকে সোনালী উন্মাদিনীর মতন চিৎকার করে উঠল, খোকনদা!

Pages: 1 2 3 4 5
Pages ( 5 of 5 ): « পূর্ববর্তী1 ... 34 5

1 thought on “সোনালী || Nimai Bhattacharya”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *