Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সাগর সঙ্গমে || Sankar Brahma

সাগর সঙ্গমে || Sankar Brahma

আমি গ্রামের মেয়ে, বিয়ের পর এই প্রথম শহরে এলাম। এ বাড়ির আত্মীয়-স্বজনেরা অনেকে আমায় দেখতে এসেছেন। নতুন বউ দেখার আগ্রহ দেখে এদের আমি বিচলিত বোধ করেছি। প্রথমদিকে আমি হেসেছি, কথাও বলেছি ওদের কারও কারও সঙ্গে। কিন্তু মন আমার সায় দেয়নি তা’তে।
এমন কাউকেই পাইনি আমি এখানে, যার কাছে আমার মনের কথা খুলে বলতে পারি।

বিয়ের অনেক আগেই অন্য একজনের জন্য আমার হৃদয়ে আসন পেতে রেখেছিলাম । বিয়ের পর আমার শরীরের মালিক হলেন স্বামী সাগর মিত্র। আর আমার মন পড়ে রইল তার কাছে। মন যাকে দিয়েছি তার সম্পর্কে কোন কথা স্বামীর কাছে আমি বলিনি। সব সময় একটা ভয় নিয়ে কাটত আমার , এই বুঝি তার কথাটা বেরিয়ে যায় আমার মুখ ফসকে।
চার বছর আগেকার কথা। বয়স তখন আমার ষোল। রেল-লাইনের ওপারের অবন্তীপুর গ্রামের ছেলে বসন্ত রায় আমাদের গ্রামে ফুটবল ম্যাচ খেলতে এসেছিল। তাকে দেখেই আমার ভাল লেগেছিল সেদিন। সুঠাম চেহারা। হাসি মাখানো মিষ্টি মুখখানা আমার খুব আপন মনে হয়েছিল । তারপর তার সঙ্গে একদিন আমার পরিচয় হয় নদীর ঘাটে বটতলার ধারে। আমি গেছিলাম জল আনতে, সে এসেছিল ঘুরতে ঘুরতে সেখানে।
– আপনি তো ফুটবল খেলেন?
– হ্যাঁ, তুমি আমার খেলা দেখেছো?
– হ্যাঁ, দেখেছি সেদিন ছাতিমতলার মাঠে
– ওহ্ আচ্ছা। তুমি ছাতিমতলায় থাক?
– হ্যাঁ
– কাদের বাড়ি?
– মল্লিকদের বাড়ি।
– আচ্ছা বুঝেছি, ওই ক্লাবের মাঠের পাশেই যে হলুদ রঙের বাড়িটা?
– হ্যাঁ।

তারপর থেকে দিনে একবার তার সঙ্গে দেখা না হলে, ভাল লাগত না আমার। তাই তাকে শুধুমাত্র একবার চোখের দেখা দেখবার জন্য নানান বাহনায় আমি কলসী কাঁখে নদীর ঘাটে জল আনতে চলে যেতাম। নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে থাকতাম রেললাইনের ওপাশের গ্রামটার দিকে যেখানে বসন্ত থাকত। সেও আসত আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি তাকে মনে মনে ভালবেসে ফেলেছিলাম। খালি কলসী কাঁখে নিয়েই তার সঙ্গে গল্প করতে করতে নদীর পাড় ধরে অনেকটা হেঁটে আসতাম আমরা। সে সময়টা আমি বিভোর হয়ে ছিলাম তাকে নিয়ে। এ’ভাবেই বছর দুয়েক কাটল আমাদের।
খেলোয়ার কোটায় সে রেলে চাকুরী পেল একটা।
শুনে আমার যে কী আনন্দ হয়েছিল, তা বলার নয়।
তারপর ধীরে ধীরে তার চাল-চলন কেমন বদলে যেতে লাগল। মাঝে মাঝে লক্ষ্য করে দেখতাম, ওর চোখে মুখে ফুটে উঠত আমার প্রতি একটা বিরক্তির ভাব।
সেদিনও ওর জন্য ঘাটে দাঁড়িয়ে, স্টেশনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কিন্তু সেদিন আর ও এলো না। ভেবেছিলাম হয়তো কোন কাজে আটকে গিয়ে আজ আসতে পারেনি । মন খারাপ নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।
তারপর দিনও পথ চেয়ে তার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেদিন সে ট্রেন থেকে নামল বটে , কিন্ত আমার দিকে একবারও না তাকিয়ে, আশ্চর্য ভাবে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হন-হন করে চলে গেল। ভাবলাম, হয়তো কোন ব্যাপারে বাবুর আমার উপর রাগ হয়েছে। তাই তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে আমি তাকে ডাক দিলাম। কিন্তু আমার দিকে সে একবার ঘুরেও তাকাল না। চলে গেল।
এইভাবে দু’দিন কাটার পর, তৃতীয়দিনেও তার জন্য আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। সেদিনও সে আমায় উপেক্ষা করে চলে যাচ্ছিল।
আমি তার সামনে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে বললাম, কি হয়েছে তোমার? আমায় এড়িয়ে যাচ্ছ কেন?
আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সে বলল,
তোমার এই নোংরা পোষাক, অশিক্ষিত আর গেঁয়ো ব্যবহার আমার কাছে অসহ্য। তুমি আর এসো না আমার কাছে। আমাকে আর বিরক্ত কোরো না।
গরম তরল লোহা যেন কেউ আমার কানে ঢেলে দিল । কষ্টের একটা বিষাক্ত তীর বুকে বিঁধিয়ে দিল আমার। সেখান থেকে কিভাবে আমি ঘরে ফিরেছিলাম টের পাইনি। আমার কাঁখ থেকে কলসীটা ছিটকে পড়ে, ভেঙে চুরমার হয়ে গেছিল এবং আমার ভাগ্যটাও ।
ছুটতে ছুটতে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। তিনদিন কিছু মুখে দিইনি। ওই তিনদিন
শত চেষ্টা করেও আমাকে দিয়ে কেউ দরজা খোলাতে পারেনি।
আমার বাবা মাও যেন এই রকম একটা ঘটনার অপেক্ষায়ই ছিল। আগেই আমার প্রেমের কথা গ্রামের প্রতিবেশীদের মারফৎ তাদের কানে উঠেছিল। আমায় কিছু বলেননি তারা। স

সেদিন ছিলাম আমি গেয়ো অশিক্ষিত মেয়ে আর আমার পরনে ছিল নোংরা শাড়ি। আর আজ আমি শহুরে। আমার চাল-চলনে পুরোপুরি শহুরে ভাব। আর পোষাক দামী নতুন চকচকে। আজ আমি বুঝতে পারি, পুরুষ মানুষ একটু চকচকে জিনিষই পছন্দ করে।
আজ আমি এমন একজন মানুষের হাতে পড়েছি, যে আমাকে আজ পর্যন্ত কেন ব্যাপারে দোষী সাব্যস্ত করেনি, কোন কারণে। সুন্দর নম্র ব্যবহার তার। আমাকে সে সবরকমের স্বাধীনতা
দিয়েছে। আমার কোনরকম অসুবিধা যাতে না হয়, সেদিকে তার সদা-সর্বদা দৃষ্টি থাকে। আমার কৈশোরের ওই মন দেওয়া- নেওয়ার ব্যাপারটা না থাকলে, হয়তো তাকে পেয়ে, আমি নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করতাম। সে যত আমায় ভালবাসে, আদর করে তত আমার মনের ভিতরটা একটা কষ্টের ভারে ভারী হয়ে ওঠে। বুকের ভিতরটা কেমন হু হু করে ওঠে বসন্তর জন্য। এ এক অসহ্য যন্ত্রণা। স্বামীর সঙ্গে ভালবাসার অভিনয় করে যেতে হয়। এক মুহূর্তের জন্যও তাকে আমি হৃদয়ে স্থান দিতে পারি না। তাতে আমার যন্ত্রণা বাড়ে বই কমে না মোটেও।
যাকে আমি বহুদিন আগে হৃদয়ে স্থান দিয়েছি
তাকে আমি ভুলতে পারি না কিছুতেই। আজও সেই স্মৃতি আমাকে কুরে-কুরে খায়। মনে পড়ে
সেই নদী তীর, কলসী কাঁখে তার সঙ্গে হাঁটা, কত কথা…….
শুয়ে শুয়ে এইসব ভাবছিলাম। দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে ছটা বাজতেই ভাবনায় ছেদ পড়ল আমার। এখন উঠতে হবে। অফিস থেকে ওর ফেরার সময় হয়েছে।
বিয়ের পর আর বাপের বাড়ি যাইনি ইচ্ছে করেই। ভেবেছিলাম ওই গ্রামের সঙ্গে আর কোন
সম্পর্ক রাখব না। অসহ্য স্মৃতির দহন আর ওখানে গিয়ে বাড়াব না।
অফিস থেকে ফিরে, হাত মুখ ধুয়ে, টিফিন জলখাবার খেয়ে উঠে, আমাকে আদর করতে করতে ও বলল, জানো অফিসের জরুরী কাজে আমাকে কয়েকদিনের জন্য বাইরে যেতে হবে। সেই কয়েকটা দিন যদি তুমি বাপের বাড়ি গিয়ে থাক, তবে আমি নিশ্চিন্ত হই।
ও অফিস-ট্যুরে বের হবার পর, আমিও সুটকেস গুছিয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে এলাম। বাপের বাড়িতে এসে মায়ের কাছে শুনলাম, আমার বিয়ের পরই বসন্ত বিয়ে করেছে।
এতদিন যে কষ্ট মনের ভিতর চেপে রেখেছিলাম তা আবার উথলে উঠল। প্রবল আকর্ষণে আমি যন্ত্রচালিতের চলে গেলাম নদী ধারে। একা একা বসে রইলাম ঘাটে। মাঝে মাঝে নুড়ি-পাথর কুড়িয়ে নদীর জলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেললাম। ছোট ছোট ঢেউ উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে, আমার মনের বিচ্ছিন্ন স্মৃতিগুলির মতো। সেখান থেকে উঠে নিজের অজান্তেই আমি চলে গেলাম
বসন্তের বাড়ি, আমার সেই মনের মানুষের কাছে।
এক-দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ভাল আছ? বউ কেমন হয়েছে? মনের মতো পেয়েছো তো?
আমাকে দেখেই চমকে উঠল সে। তার মুখটা কাল হয়ে গেল। যেন কেউ একপোচ কালি লেপে
দিয়েছে তার মুখে। করুণ হেসে বলল, আমার কাছে এসো না। দূরে দাঁড়িয়ে কথা বল। আমার মারাত্মক রোগ হয়েছে।
সন্দেহের চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, এমন কি রোগ হয়েছে তোমার, যা আমি দেখে টের পাচ্ছি না।
সে তখন বুকের জামার বোতামগুলি খুলে দেখাল, দেখে চমকে উঠলাম আমি, হাড়-পাঁজরা
বেরিয়ে গেছে, গোনা যাচ্ছে। বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠল আমার।
সে বলল, বউ এখানে নেই। সে বাপের বাড়ি চলে গেছে,আমার যক্ষা হয়েছে শুনে। তারপর সে উদাসভাব আমার দিকে চেয়ে রইল।
কিছুক্ষণ সেখানে থেকে, আমি বললাম – আজ আসি তবে?
বসন্ত বলল, তুমি আমায় ক্ষমা করতে পারবে না জানি। হয়তো সেই শাস্তিই ঈশ্বর আমাকে দিয়েছেন। শুনে বুকটা আমার কান্নায় মুচড়ে উঠল।
আমি বললাল, এসব কথা আর বলবে না কক্ষনো। আমার একটা শেষ ইচ্ছে তোমায় রাখতেই হবে। কথা দাও রাখবে।
– দিচ্ছি কথা, রাখব।
– তুমি তো জান আমি আজ অন্যের আমানত। কাছে থেকে তোমার সেবা-যন্ত করার আজ আর আমার কোন অধিকার নেই। তবে দূর খেকে যদি কোন সাহায্য করতে পারি,তবে তা তুমি ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
বসন্ত কোন কথা বলল না। চোখ দিয়ে তার অশ্রু
গড়াতে লাগলো। ফিরে এলাম আমি।

আমার স্বামী অফিস-ট্যুর সেরে ঘরে ফিরে আসতেই, তার কাছে সবকথা খুলে বললাম। মনে মনে খুব ভয় ছিল, সে হয়তো আমার অতীতের ভালবাসার ঘটনা জেনে খুব রাগ করবে। কিন্ত আশ্চর্য, তার হল বিপরীত প্রতিক্রিয়া। আমার চেয়েও বসন্তের প্রতি তার বেশী সহানুভূতি দেখা গেল। নিজে উদ্যোগ নিয়ে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিল। জলের মতো তার জন্য টাকা খরচ করল।
কিছুদিন পর সে সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে এসেছে। শুরু করেছে আবার তার বউকে নিয়ে নতুন জীবন।
এতদিনে আমার বুক থেকে যেন সব ভার নেমে গেল। এতদিন বসন্তের প্রেম-স্মৃতি গোপন কাঁটার মতো বুকে বিঁধেছিল। সে কাঁটা থেকে রক্তক্ষরণ হতো মাঝে মাঝে বুকের ভিতর। কাউকে বলতেও পারতাম না। আর আজ আমারও যেন নতুন করে জীবন শুরু হল।
স্বামীকে সম্পূর্ণ আপন করে পাওয়া হলো আমার।
একদিন মন প্রাণ সঁপে দিয়েও যার মন পাইনি, যার কাছে ছিলাম অশিক্ষিত গেঁয়ো ভূত।
আর অনিচ্ছা সত্বেও যাকে বিয়ে করেছিলাম, আজ সে আমাকে রাজরানীর মতো তুলে দিলেন সম্মান।
আগে নিবিড় ভাবে ভালবাসতাম অতীতের নদীকে, আর বর্তমানে আমি ভালবাসি আমার সাগরকে।


—————————————————–
একটি ওড়িয়া গল্পের অনুকরণে লেখা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress